লাইন না লার্নিং? আগামী দিনের কেরিয়ারে কোনটা গুরুত্বপূর্ন? জীবন ও জীবিকা -১৮
বিপ্লব পাল, ২৭শে মে, ২০২৩
আজকের "জীবন ও জীবিকা" লাইভ সেশন থেকে আমি যা শিখলাম---
# ১ আমার এই জীবন ও জীবিকা সিরিজ লিখে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। অভিভাবকরা হয় পড়ছে না, নইলে পড়ে বুঝছে না। কারন আমার এই সিরিজের মূল বক্তব্যই হচ্ছে কেরিয়ার গড়তে মূল উপাদন হচ্ছে, সেলফ লার্নিং, ইন্টার্নশিপ, ৬ টি অভ্যেস [ যা আমি পর্ব -১৬ তে বিস্তারিত লিখেছি], সুস্বাস্থ্য [ দেহ এবং মনের -পর্ব ৮], স্যোশালাইজেশন স্কিল এবং সেলফ ড্রাইভ [ পর্ব ৯] ।
কি নিয়ে, কোন লাইন নিয়ে পড়াশোনা করবে তা গৌন। আজ যে সব লাইনে চাকরি আছে ১৫ বছর বাদে নাও থাকতে পারে। সেই জন্যে সবার থেকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত "লার্নিং" স্কিলের ওপর। কি শিখছে তা গৌন। কিভাবে শিখছে সেটাই মুখ্য। কারন আমরা যে পৃথিবীতে প্রবেশ করেছি, তাতে ওটা আর নেই যে একজন কেমিস্ট্রিতে এম এস সি পাশ করে সারা জীবন শিক্ষকতা করে কাটিয়ে দিল। আর নতুন কিছু শেখার দরকার হল না জীবনে। এ আই এর যুগে সব পেশা নতুন ভাবে তৈরী হবে। সবাইকে প্রতি দুবছর অন্তর অন্তর মেজর আপডেট করতে হবে। সুতরাং আগামী দিনের জন্য, লাইন না, লার্নিং গুরুত্বপূর্ন। কারন সবাইকে ক্রমাগত নতুন প্রযুক্তি শিখে যেতে হবে।
# ২ স্কুল এবং কলেজ, বেসিক, ফাউন্ডেশন তৈরী করার জায়গা। মাইক্রোস্পেশালাইজেশনের চিন্তা তখনই আসা উচিত, যখন ফাউন্ডেশনাল সাবজেক্টে কিছুটা দক্ষতা এসেছে। আমি উদাহরন দিচ্ছি। একজন প্রশ্ন করলেন, তার ছেলে বা মেয়ে কার্ডিওভাস্কুলার টেকনিশিয়ান বা ওই জাতীয় কোন কোর্সে ইন্টারেস্টেড। আরেকজন বাবা চান, তার ছেলে ব্যঙ্কের ক্রেডিট রিক্স ম্যানেজমেন্টে আসুক। ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ছে অথচ অনেক বাবা মা চাইছেন তাদের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ আই বা ডেটা সায়েন্স নিয়ে পড়ুক।
এবার দেখুন মেডিক্যাল লাইনে যেকোন কোর্সের ভিত্তি ফিজিওলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রি। সে ডাক্তার, নার্স, ফার্মা যেদিকেই যাক। এখন এসব লাইন বাদ দিয়ে, যদি কেও পরবর্তী জীবনে মেডিক্যাল টেকনিশিয়ানের লাইনগুলি-যেমন রেডিওলজি, ল্যাব টেকনিশিয়ান ইত্যাদির দিকে যায়, কলেজ লেভেলে ফিজিক্স, বায়োকেমিস্ট্রি ফিজিওলজি এসব সাবজেক্ট থাকলে অনেক সুবিধাই হবে। বেসিক স্ট্রং থাকলে, সে মেডিকেল লাইনের যেকোন স্পেশালাইজেশনেই ভাল কাজ করতে পারবে।
যারা ক্রেডিট রিস্ক বা এ আই নিয়ে পড়তে চাইছে, তাদের সব কিছুর ফাউন্ডেশন সংখ্যাতত্ত্ব এবং গণিত। স্টাটে মাস্টার ডিগ্রি করে, এসব দিকের যেকোন লাইনে কাজ পেতে পারে। এক্ষেত্রে আমরা কি দেখছি?
অভিভাবকরা ছাত্রছাত্রীদের গণিত এবং সংখ্যাতত্ত্বের ভিত শক্ত করার দিকে নজর দিচ্ছেন না। অথচ লাখ লাখ টাকার ডেটা সায়েন্সে এ আই এর কোর্স নিয়ে ভাবছেন। তাতে কি লাভ? ওগুলো আরেকটা স্ক্যাম। অঙ্ক, স্টাট ভাল না শিখে, কেউ এ আই বা ডেটা সায়েন্সের কেরিয়ারে বেশী কিছু করতে পারবে না। বেসিকে নজর দিন আগে।
বেসিক্যালি মেডিক্যাল লাইনই বলুন, আইন ই বলুন-আর কর্মাস অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং--এগুলি ফলিত সাবজেক্ট। ফাউন্ডেশনাল সাবজেক্ট হচ্ছে
এপ্লায়েড ম্যাথ / স্টাট
ফিজিক্স
কেমিস্ট্রি
এলালাইটিক/লজিক ( যা এলগোরিদমে লাগে, আইন শিক্ষায় লাগে)
ইংরেজি-কমিউনিকেশন
এগুলির শক্ত ভিত্তি থাকলে, যেকোন লাইন শেখা জলভাত।
# ৩ একজন জানতে চেয়েছেন, তার স্কুলে পড়া মেয়ে, ফরেন্সিক সাইকোলজি নিয়ে পড়তে চাইছে। আজ লাইভে আরেকজন জানালেন, তার সন্তান ইন্টারন্যাশানাল রিলেশনশিপ নিয়ে পড়তে চাইছে।
আচ্ছা, আপনাদের কি একবার ও মনে হচ্ছে না, এগুলো পাগলামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে? স্কুলে যারা পড়ছে তারা এখনো বিজ্ঞানের বেসিক শেখে নি। তারা সাইকোলজিরই কি বুঝবে- ফরেন্সিক অনেক দূর!
তারা কি জানে ইন্টারন্যাশানাল রিলেশনে কি পড়ানো হয়? পলিটিক্যাল সায়েন্সের সেই বেস কেউ স্কুলে তৈরী করতে পারে? পলিটিক্যাল সায়েন্সের ভাল বেস ছাড়া এসব কেউ বোঝে?
ওদের আগে অঙ্ক ইংরেজি বিজ্ঞান দর্শন ইত্যাদি বেসিক সাবজেক্টের ভিত্তি গুলো পোক্ত করুন! বেসিক স্ট্রং হলে, আর একটু বুঝলে, তারাই খুঁজে নেবে তাদের জন্য কি ভাল।
# ৪ আজ লাইভে একটি মেয়ে পরামর্শ চাইল- এম বি এতে ভর্তি হবে নাকি এম এস সি তে । এদিকে সে নিজেই জানে না এম বি এ তে লোকে কি শেখে, কি ধরনের চাকরি করে। তার বিজনেসে এপ্টিচুড আছে কি না। বিজনেস লাইনের চাপ তার সহ্য হবে কি না। সেত কোনদিন একপিস কিছু বেচেও নি যা বুঝলাম। এম বি এ করে ভাল চাকরি লোকে তখন পায়-যখন তার জব এক্সপেরিয়েন্স আছে, ব্যবসা করার এটিচুড আছে।
মেয়েটি ব্যতিক্রম না। ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রামের ছেলেপুলেরা এইভাবে ভর্তি হচ্ছে। মানে করানো হচ্ছে। গ্রামে শহরে ছড়িয়ে গেছে কলেজের এজেন্টরা। এরা টার্গেট করছে যাদের কয়েক বিঘা জমি আছে। বলছে দুকাঠা বেচেদিন-ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে- প্রচুর মাইনের চাকরি করবে। গ্রামের দিকের লোকেদের কোন আইডিয়া নেই। ছেলেটির ও কোন আইডিয়া নেই ইঞ্জিনিয়ারিং কি বস্তু। এবার সে ডিগ্রি নিয়ে বেকার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেড়োবে। তারপরে এম বি এর সেলসের লোকেরা এসে বলছে- না না বিটেকে কিস্যু হবে না। আরেক কাঠা বিক্রি করুন,। এম বি এ লাগবে। ছেলেটির বাবা তাও দিচ্ছে। তারপরে হয়ত একটা ১০ হাজারটাকার সেলসের জব পাচ্ছে। দুদিন বাদে সেই কাজের চাপ না নিতে পেরে বাড়িতে এসে বেকার বসে থাকছে বা সরকারি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ছেলেটি যদি এগ্রিকালচার নিয়ে পড়ত-সাবজেক্ট টা ভাল বুঝত। সেখানে সাইন করত। এখন সে তার বাবার জমিতেও কাজ করতে পারবে না। সে যে কেরিয়ারে ভাল করতে পারত, সেটা শিখল না । না ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর কাজে আসছে। স্ক্যামারদের খপ্পরে এসে তার বাবা কয়েক কাঠা জমি বেচে ছেলেকে বিকালঙ্গ করলেন আর কি! এটাই চলছে এখন বাংলায়।
আমি আরেকটা ঘটনা বলি। দুমাস আগে একটি ছেলে আমার সাথে যোগাযোগ করে। ছেলেটি বাইজুর অপারেশনে কাজ করত। বাইজু ৫০% ছাঁটাই করেছে। তার ও চাকরি গেছে। ছেলেটির বয়স ৩০। আমি জিজ্ঞেস করলাম তোমার স্কিল কি? তার কোন স্কিলই নেই। সে বাইজুতে ছিল ম্যানেজার। বিভিন্ন ডিভিশনের লোকেদের সাথে কোঅর্ডিনেট করত। বলে আমি এম বি এ করেছি! বিটেক করেছি! প্রথমে স্ক্যামারদের খপ্পরে এসে ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে। ভাল চাকরি পায় নি। যেহেতু কিছুই শেখে নি। ফলে ভাল চাকরি পেতে, দ্বিতীয়বার স্ক্যামারদের খপ্পরে এসে এম বি এ করেছে।এ দিকে কোন স্কিলই শেখে নি। এটাই চলছে। চারিদিকে এজেন্টরা বসে আছে। তারা অভিভাবকদের কানে তুলে দিচ্ছে, এই লাইন ভাল, এখানে ভবিষ্যত। সেটা হয়ত ঠিকই। অভিভাবকরা ও দেখছেন সরকারি চাকরি স্ক্যামের চক্করে বিশ বাঁও জলে। ফলে, তারাও আতঙ্কিত হয়ে স্ক্যামারদের টাকা দিচ্ছেন।
ছেলেটি প্রথমে খুব গর্বের সাথে আমাকে বলেছিল, স্যার আমার বিটেক এমবিএ আছে। মানে তার এখনো ধারনা ওই সার্টিফিকেটগুলো থাকলে, তাকে প্রচুর সন্মান দেওয়া হবে। মানীগুনি উচ্চমেধার ভাবা হবে। সমাজ যেভাবে শিখিয়েছে আর কি। কিন্ত যখন আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, তোমার স্কিল কি? এবং সে কিছুই বলতে পারল না সে জীবনে কি শিখেছে- একটু বাদে কেঁদে ফেলল। বাবা সঞ্চয় ভেঙে ছেলেকে পড়িয়েছেন। এখন বাবার ক্যান্সার। কোথায় ছেলেটি বাবাকে সাহায্য করবে। তার বদলে বিটেক এম বি এ করে রিটায়ার্ড বাবা্র পেনশনের টাকায় বেঁচে আছে।
আমি তাকে বল্লাম আবার নতুন করে শেখ। এবার সলিড একটা কোডিং ল্যাঙ্গুয়েজ শেখ। কিন্ত আর কাউকে টাকা দিও না। ইউটিউব থেকে নিজে শেখ। শিখে ইন্টার্নশিপ নিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু কর। জানি পেইনফুল। ৬ টা বছর নষ্ট হল। কিন্ত কোন কিছুই লেট না। আবার শুরু কর। এবার ভুল থেকে শিখে, ঠিক ভাবে কর। ভুল জীবনে হয়। কিন্ত সেই ভুল থেকে শিখে এগিয়ে যেতে হয়।
কিন্ত বিশ্বাস করুন বাজারে চাকরির অবস্থা বাজে না। ইনফ্যক্ট এত ভাল চাকরির অবস্থা কোন কালে দেখি নি। কিন্ত কোন চাকরি? যেখানে ছেলেমেয়েটির কোডিং, সিস্টেম জ্ঞান একদম পরিস্কার হবে-তাকে সেলফ লার্নার হতে হবে। বেসিক ফাউন্ডেশন ভাল, এমন ছাত্র কর্পরেট পাচ্ছে না। যেগুলি খুব ভাল মাইনের চাকরি। সেখানে লোকই পাওয়া যাচ্ছে না।
সুতরাং আগে থেকেই এইসব মাইক্রোস্পেশালাইজেশন নিয়ে ভাববেন না।
আগে তাদের লার্নিং স্কিল বাড়ান। ভাল অভ্যেস [ ৬ টি হ্যাবিট পর্ব-১৬] শেখান। বেসিক ফাউন্ডেশন শক্ত হোক। তাদের ভাল চাকরি, ভাল কেরিয়ার, ভাল গ্রোথের কোন অভাব নেই। অহেতুক কেরিয়ার নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না।
যাদের বেসিক ভাল, চাকরি তাদের খুঁজে নেবে। আর সেটা না থাকলে, চিরকাল চাকরি খুঁজতে হবে।
আগামী পর্ব এবং আগের পর্ব পড়তে আমার প্রোফাইল ফলো করুন।
আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্ত প্রশ্ন করতে থাকুন। আমাদের একটা হোয়াটসাপ গ্রুপ করা হয়েছে। সেখানে উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সহজ হবে। হোয়াটসাপের গ্রুপের লিং কমেন্টে দিচ্ছি।
আর লেখাগুলো সর্বত্র শেয়ার করুন। যাতে ছাত্রছাত্রীরা স্ক্যামারদের খপ্পরে পরে জীবনে সর্বনাশ না ডেকে আনে।
No comments:
Post a Comment