Wednesday, December 30, 2009

২০০৯ সালের সব থেকে বড় ঘটনা কি?

এই ধরনের ব্লগ খোলা উচিত না। তবুও একটা রেট্রোস্পেকশন চাইছি।

[১] বাংলাদেশের ভোটে ইসলামিক শক্তির 'কনক্লুসিভ' পরাজয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির পুনঃজাগরন
[২] ভারতের বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদি শক্তির শোচনীয় পরাজয়। হিন্দুত্ববাদ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে পরিতক্ত্য।
[৩] কর্পরেট আগ্রাসানের বিরুদ্ধে ফলশ্রুতি হিসাবে পশ্চিম বঙ্গে ৩৩ বছর কমিনিউস্ট শাসনের পর, ৩৩ বছরে প্রথম প্রতিটি নির্বাচনে কমিনিউস্ট শক্তির শোচনীয় হার। লালগরে কর্পরেট তথা রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে আদিবাসিদের সফল আন্দোলন।
[৪] অর্থনৈতিক মন্দা থেকে আমেরিকার ঘুরে দাঁড়ানো।
[৫] ল্যাটিন আমেরিকাতে সমাজতান্ত্রিক দলগুলির নির্বাচনী সাফল্য।
[৬] ইউরোপে ইসলামের বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া।
[৭] তালিবানদের হাতে পাকিস্তানের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থা।
[৮] মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইরাণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন।
[৯] কোপেন হেগেনের কার্বন সার্কাস।
[১০] আরো তীব্রতর খাদ্য এবং শক্তি সংকট

কিছু কিছু ঘটনা আঞ্চলিক হলেও বিশ্বরাজনীতিতে এর প্রভাব আছে। পশ্চিম বঙ্গের নন্দীগ্রাম এবং লালগড়, নিও লিব্যারালিজমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে এখন আন্তর্জাতিক প্রতীক। কারন এত সফল ভাবে আর কোথাও রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায় নি । শয়ে শয়ে মৃত্যুর মিছিলের ওপরে মানুষের জয় ঘোষিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামিক শক্তির চুড়ান্ত পরাজয়, নিঃসন্দেহে ইসলামিক বিশ্বে নতুন ট্রেন্ড। বাংলাদেশের মুসলমানরা প্রমান করেছেন, তারা একবিংশ শতাব্দিতে দৌড়াতে চাইছেন-সপ্তম শতকে আরবের উটের দুধ খাওয়ার ইচ্ছা তাদের নেই। যেটা মিশর, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমন কি তুরস্কেও সম্ভব হয় নি। ভারতে সিপিএম এবং বিজেপির পরাজয় খুব পরিস্কার ভাবেই একবিংশ শতাব্দিতে অচল আদর্শবাদের বিরুদ্ধে মানুষের রায়।

বাকী সব বিষয়গুলি-পাঠকের হাতে তুলে দিলাম বিশ্লেষনের জন্যে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে এর প্রভাব কি হবে?

Sunday, December 27, 2009

জেমস ক্যামেরুনের অবতারঃ শুধুই কল্পবিজ্ঞান আর থ্রিডির খেলা?

.
.
.


(১)
ক্রীসমাসের এই ছুটিতে আমেরিকা তথা বিশ্বে সবথেকে আলোচিত টাইটানিকের পরিচালক জেমস ক্যামেরুনের "অভতার" (বাংলা অবতার)। শুধু অত্যাধুনিক স্টিরিওগ্রাফিক ক্যামেরা বা থ্রি ডাইমেনশনার কম্পুটার গ্রাফিক্সের জন্যেই অবতার নিয়ে এত সোরগোল হচ্ছে তা ঠিক না। হলে গিয়ে মনে হল আমেরিকান বস্তুবাদি সভ্যতায় বিধ্বস্ত অনেকেই ফিরে যেতে চাইছে, ফিরিয়ে দাও সে অরণ্যের যুগে যেখানে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করেই বেঁচে থেকেছে মানুষ।

অভতারের এমন দুড়ন্ত ক্রেজ আমার গত দশ বছরের আমেরিকান জীবনে বিরল অভিজ্ঞতা। আমার বাড়িথেকে ১৫ মিনিটি দুরে দুটো মাল্টিপ্লেক্স। কলম্বিয়ার আই-ম্যাক্সে আছে ১২টা আর আরুনডেলের সিনেম্যাক্সে আছে ২৪ টা থিয়েটার। আই ম্যাক্সের ৫ টাতে আর সিনেম্যাক্সের ১২টা থিয়েটারে চলছে অভতার। এত শো দেখানোর পরেও যা ভীর দেখলাম, সেটা বহুদিন আগে হিন্দি সিনেমার ফার্স্ট ডে ফার্স্টশোতে ভারতে দেখেছি। এখানে সিনেমার জন্যে বিশাল লাইন, ধাক্কাধাক্কি কল্পনাতীত। সাধারনত শো শুরু হওয়ার ত্রিশ মিনিট আগে আমি যাত্রা শরু করি। কাঁটার মতন হিসাব মেলে প্রতিবার। হলে পৌঁছাব ১৫ মিনিটে, পার্ক করে টিকিট কেটে ঢুকে যাব শো শুরু হওয়ার ৫ মিনিট আগে । এখানে কদাচিৎ হলগুলি ৪০% ভর্তি থাকে। শেষ স্ল্যামডগ মিলিয়নারের মতন সুপারহিট সিনেমাতেও দেখেছি ৩০-৪০% মতন সীট প্রাইম টাইমে ভর্তি ছিল। ফলে পার্ক করে, মেশিন থেকে টিকিট কেটে ঢুকে যেতে কোন সময়, লাইন, হ্যাপা কিছুই লাগে না। এবার যথারীতি আই ম্যাক্সের সামনে ২-৪০ নাগাদ পৌঁছালাম। তারপর দেখি গাড়ি ঠেলে ঢুকতেই পারছি না। শেষে ১৫ মিনিট ধরে গাড়ি যখন এগোল না, সোজা আবার বাড়ির দিকে চলে এলাম। এবার ঠিক করলাম ৬টা শো তে ৫টার সময়ে যাব।

ও বাবা। সেখানেও বিধি বাম। এবার পার্ক করে পৌঁছলাম বটে, কিন্ত রাতের বাকী ১৪টা শোতে আই ম্যাক্সে টিকিট নেই।শেষে আরুনডেলের সিনেম্যাক্সে ছুটলাম। ওখানে অনেকগুলো থিয়েটারে চলছে বলে, প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর, অবতারের একটা নতুন শো শুরু হচ্ছে। সেখানে থ্রিডির শেষ শো-রাত দশটার টিকিট পেলাম। সাথে চার বছরের পুত্র সন্তান বলে প্রথমে রাজী হইনি। পরে দেখলাম, কালকেও এর থেকে ভাল কিছু হবে আশা নেই। ফলে চোখ কান বুঁজে ভাগ্যকে মেনে নিতেই হল।

গত সপ্তাহে অভতার, গোটা পৃথিবীতেই হাউসফুল। ৬১৫ মিলিয়ান ডলার তুলেছে এক সপ্তাহের বক্স অফিসে যা এক-কালীন রেকর্ড। কিন্তু কি ম্যাসেজ পাঠালেন ক্যামেরুন, যার জন্যে উত্তাল সারা পৃথিবী?

(২)
প্যান্ডোরা ২১৫৪ ঃ নাভিদের সমাজ এবং মানুষের সাম্রাজ্যবাদ

ক্যামেরুন তার সাক্ষাতকারে, কনফারেন্সে বারবার বলেছেন, অভতারের ম্যাজিক সিনেমার শিল্প বিপ্লবে না। দর্শক আসবে শুধু গল্পের জাদুতে। কিন্ত এ শুধু গল্প না-আমেরিকা তথা বস্তুবাদি সভ্যতার বিরুদ্ধে কিছু প্রশ্ন। যা আমরা ইদানিং করছি। কিন্ত অভতারের মতন এত শক্ত বক্তব্য একমাত্রেই শিল্পেই সক্ষম। শিল্পের দরকার ঠিক এই কারনেই - মানুষের নির্লিপ্ত স্তরকে অতিক্রম করে, চেতনার দরজায় ধাক্কা মারে।

আলফা সেঞ্চুরীর গ্রহ পলিফেমাসের উপগ্রহ প্যান্ডোরা। পৃথিবী সাদৃশ জলবায়ু এবং বায়োষ্ফিয়ার। ২১৫৪ সালে ঘটনার শুরু। মানুষ সেখানে পৌঁছে গেছে। পলিফেমাস নিয়ে মানুষের আগ্রহের কারন এই গ্রহে আনোবাটিয়ামের খনি। উনোবাটিয়াম এন্টি গ্রাভিটি ম্যাটেরিয়াল-পৃথিবীতে এর খুব দাম। আর ডি এ কর্পরেশন, যা পৃথিবীর একটি পাবলিক কোম্পানী, এখানে এসেছে আনোবাটিয়ামের খনি বানাবে বলে। কিন্ত সেটা করতে গেলে প্যান্ডোরার আদিবাসি নভিদের তাড়াতে হয় তাদের আদিভূমি থেকে। প্রথমে তারা নভিদের লোভ দেখিয়েছে অন্য জায়গায় পুনর্বাসন দেবে বলে। নভিরা রাজি হয় নি। ফলে আর ডি এক্স কর্পরেশন নিয়ে সেছে এক বিরাট প্রাইভেট সেনা বাহিনী। কিন্ত এখনো আক্রমন করছে না। হাজার হলেও মানুষ সভ্য! রেড ইন্ডিয়ানদের মতন নভিদের মেরে ফেললে "ব্যাড প্রেসের" জন্যে শেয়ার প্রাইসে ধ্বস নামবে। অনেকটা টাটা সেলিমদের নন্দীগ্রামে যেমন হয়েছিল আর কি। ওখানে সিপিএমের হার্মাদরা ছিল সেলিমদের প্রাইভেট আর্মি।

তাই নাভিদের বুঝিয়ে পটিয়ে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্যে তৈরী হয়েছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মার্ভেল অবতার। এদের ডি এন এ মানুষ আর নভিদের সংকর। অভতারের বায়োলজিক্যাল দেহটা নভিদের কিন্ত তাদের মাথাকে পরিচালনা করে মানুষ। আর ডি এ কর্পরেশনের বেস স্টেশন থেকে। তবে সেই মানবই নভি অবতারের পরিচালক হতে পারবে, যে মানুষটির ডি এন এর সাথে নভির সংকরটি বানানো হয়েছে। অনেকটা কৃষ্ণ যেমন ছিলেন মানুষের দেহে বিষ্ণু অবতার। ক্যামেরুন ঠিক এই সাদৃশ্যের জন্যেই এদের নাম দিয়েছেন অবতার, যা সংস্কৃতে অভতার। নাভিদের দেহে মানুষ অবতার। যাদের আসল কাজ নাভিদের সংস্কৃতিকে ভাল করে জেনে বুঝে তাদেরকে পুনর্বাসনের জন্যে রাজী করানো!

প্যান্ডোরার নাভিরা বিবর্তনের প্যালিওলিথিক ধাপে আছে। কৃষিভিত্তিক সমাজে ঢোকার পূর্বে শিকারী মানুষেরা যেমন ছিল। প্যান্ডোরায় অভিকর্ষজ বল কম। তাই নাভিরা ১০ ফুট লম্বা। এখানকার উদ্ভিদ প্রজাতিও বিশাল লম্বা অভিকর্ষজ বলের অভাবে। আর সেই পরিবেশে বিবর্তনের জন্যে নাভিরা অনেকটাই বিড়াল মানুষ। ক্যাট ফ্যামিলির প্রিডেটরদের মতন ক্ষীপ্র তাদের গতি গাছ থেকে মাটিতে।

কিন্ত গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নাভিদের সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। নাভিরা প্যাগান। আরো নিঁখুত ভাবে লিখলে প্যান্থেওনিক প্যাগান। অর্থাৎ হিন্দুদের মতন এদেরও বিশ্বাস, আশে পাশের সব পশু, পাখী, গাছ-পালা সবকিছুই ঈশ্বর। যদিও এদের সংস্কৃতি আফ্রিকার প্যালিওলিথিক আদিবাসিদের মতন। নভিদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে হিন্দু ধর্মকে আরো প্রবল ভাবে রূপকের আকারে ঢুকিয়েছেন ক্যামেরুন সুপার কনসাসনেশ বা বিশ্বচেতনার মধ্যে দিয়ে। নাভিরা বিশ্বাস করে সমগ্র প্রকৃতির সাথে তারা অবিচ্ছেদ্য-মানসিক এবং দৈহিক ভাবে। এই সিনেমাতে সেটা এসেছে নানা ভাবে। অভতার প্রজেক্টের লিড বিজ্ঞানী ডঃ গ্রেস আগাস্টাইনের বিশ্বাস প্যান্ডোরার বৃতৎতম বটবৃক্ষটির শিকড়গুলি আসলেই নিউরাল নেটওয়ার্ক। যার সাহায্যে সমস্ত নাভিরা একটি সামগ্রিক চেতনার যাথে যুক্ত। শুধু তাই না। নাভিদের ঘোড়া বা উড়ন্ত বিশাল পাখী তারুক সবার সাথেই তারা চুলের মাধ্যমে 'চেতনার' বন্ডিং করে তাদেরকে ব্যাবহার করে। এই সামগ্রিক বিশ্বচেতনা বা সুপার কনসাসনেস এর ধারনা শ্রী অরবিন্দের লেখাতে বারবার এসেছে-যাকে অরবিন্দ বলেছেন সুপার মাইন্ড।

"To be in the being of all and to include all in one's being, to be conscious of the consciousness of all, to be integrated in force with the universal force, to carry all action and experience in oneself and feel it as one's own action and experience, to feel all selves as one's own self, to feel all
delight of being as one's own delight of being is a necessary condition of the integral divine living."
— Sri Aurobindo, The Life Divine

(৩)
বস্তুবাদ বনাম প্যাগানিজমঃ

প্যাগানিজম এই গল্পে প্রকৃতি মায়ের ধারক এবং বাহক। আধুনিক বস্তবাদি তথা একেশ্বরবাদি চিন্তায় প্যাগানিজম হচ্ছে কুসংস্কার। প্যান্থেওনিক প্যাগান হিন্দুদের ইঁদুর বিড়াল গরু পূজা ইত্যাদি বস্তুবাদি বা একেশ্বরবাদি দৃষ্টিতে হাস্যকর। যার জন্যে ইতিহাসে আমরা দেখব হিন্দু বা মায়ান বা রেড ইন্ডিয়ান প্যাগান সভ্যতার ওপর উন্নত মিলিটারীর অধিকারী খ্রীষ্ঠান বা ইসলামিক সভ্যতা বারবার আক্রমন চালিয়েছে। খ্রীষ্ঠান বা ইসলামিক ইতিহাসে এই সব আক্রমনকে দেখা হয় অসভ্য প্যাগানদের সভ্য করার ইতিহাস। এখানেও মানুষ নভিদের সভ্য করতে চেয়েছে বলে দাবী করছে। কিন্ত এই দাবীর অন্তসার শুন্যতা প্রমান হয় প্যান্ডোরাতে আর ডি এ কর্পরেশনের হেড পার্কার সেলফ্রিজ এর কথাবার্তায়। কর্পরেট অফিসার পার্কার এই গল্পে ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি এবং এন্টাগনিস্ট। সে এই ব্যাপারে খুবই পরিষ্কার যে আসল মোটিভেশন হচ্ছে 'লাভ'। সভ্য করার কথাটা সুগারকোট। অথচ বাবরনামা থেকে লর্ড ক্লাইভ-সবার লেখাতেই পার্কারের বক্তব্য পাওয়া যাবে-সেটা হচ্ছে নেটিভ হিন্দু প্যাগানরা সাপ ব্যাঙ পূজ়ো করা অসভ্য-তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনুন্নত। তাই এদের সভ্য করতে ঈশ্বর তাদের পাঠিয়েছেন। অথচ এদের সবার তলপেটেই ছিল পার্কারের মতন সম্পদের জন্যে লোভ।

কিন্তু এই বস্তবাদি বা একেশ্বরবাদি সভ্যতা যেটা বোঝে না-সেটা হচ্ছে প্যান্থেওনিক প্যাগানিজম কিন্ত একেশ্বরবাদি ধর্মগুলো বা অধুনা বস্তবাদি সভ্যতা থেকে আরো হাজার হাজার বছর পুরানো। হাজার হাজার বছরের বিবর্তন তাদের শিখিয়েছে প্রকৃতি বান্ধবতা। তারা জানে প্রকৃতিই তাদের ঈশ্বর। প্রকৃতি ধ্বংশ হলে তারাও বাঁচবে না। অথচ আজকের বস্তুবাদি মানুষ, এত উন্নত মানুষ কোপেনগেহেনে যে তামাশা আর সার্কাস চালালো, তাতে এটা পরিষ্কার বস্তুবাদি মানুষ প্যাগানদের থেকে বেশী জানতে পারে, কিন্ত বিচক্ষনতায় অনেক পিছিয়ে। আমরা কি চাই? জ্ঞানী না বিচক্ষন মানুষ?

বহুদিন আগে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনির সাথে আলাপে আমি বলেছিলাম, বুদ্ধের আকাঙ্খামুক্ত জীবনাদেশ বস্তুবাদি উন্নতির পরিপন্থী। তিনি হেসে বলেছিলেন, আরো একশো বছর দেখ বাছা-এই রেকলেস গ্রীড বা সীমাহীন লোভ হচ্ছে বাঘ। যখন খাবার পাবে না, সে তোমাকেই খাবে। আধুনিক সভ্যতার বাঘ হচ্ছে বিজ্ঞান। আমি সেই সন্ন্যাসীনিকে দেখে হেঁসেছিলাম। আজ কোপেনহেগেন সম্মেলনের পরে সেই হাঁসি আমাকেই ঠাট্টা করছে।

তবে ক্যামেরুনের গল্পে বিজ্ঞান মোটেও এন্টাগনিস্ট না। বরং সেও প্রকৃতি রক্ষার পক্ষে প্রটাগনিস্ট। কিন্ত ধণতন্ত্রের সেবাদাস যে বিজ্ঞান, সে এক অর্থে বন্দিনী! সেটাই আমরা দেখবে অভতার প্রকল্পের বিজ্ঞানী ডঃ গ্রেসের চরিত্রে। ডঃ গ্রেসের সাথে কর্পরেট অফিসার পার্কার সেলফরিজের কথাবার্তাই বিজ্ঞান বনাম ধণতন্ত্রের সংঘাত বারবার এসেছে। বিজ্ঞানী গ্রেস ও নভিদের দলে-তিনিও চাইছেন না কিছু খনিজের জন্যে এই উপগ্রহের সবুজকে ধ্বংশ করতে। কিন্ত পার্কার তাকে মনে করাচ্ছেন, গ্রেসের স্যালারী তথা অভতার প্রজেক্টের টাকা আসছে শেয়ার হোল্ডারদের টাকায়। যাদের অভতার বা প্যান্ডোরার জৈব বৈচিত্র নিয়ে কোন উৎসাহ নেই। তারা চাইছে উনোবটিয়াম। তারা চাইছে বস্তবাদি সভ্যতার জারজ সন্তান 'লাভ'। অর্থাৎ অবতার গল্পে খুব পরিস্কার ভাবে বলেছে বিজ্ঞান মোটেও অভিশাপ না। তাকে অভিশাপ বানিয়েছে মানব সভ্যতা। যদিও এই গল্পে বিজ্ঞানকে অভিশাপ বানানোর জন্যে ধণতন্ত্রকেই দোষারোপ করা হয়েছে, বাস্তব সত্য হচ্ছে বিংশ শতাব্দির কমিনিউস্ট দেশগুলিও বিজ্ঞানকে কম অভিশাপ বানায় নি। সেই অর্থে যেকোন বস্তুবাদি সভ্যতাই বিজ্ঞানকে রাজনৈতিক কারনে ব্যাবহার করে তাকে মানব সভ্যতার অভিশাপ বানিয়েছে।

তবে এই গল্পের ভিলেন অবশ্যই আমেরিকান মেরিন। আমেরিকান সেনাবাহিনীর সব ধরনের অসভ্যতাকেই ব্যাঙ্গ করেছে অভতার। দেখিয়ে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের সাথে ধনতন্ত্রের পার্টনারশিপ। ক্যামেরুন সাক্ষাৎকারে খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন, এ হচ্ছে আমেরিকার হটকারি বিদেশনীতির বিরুদ্ধে হলিউডের প্রতিবাদ। বৃহত্তর অর্থে অবশ্য আমার মনে হয়েছে সামগ্রিক বস্তুবাদি মানব সভ্যতাকেই দুষেছেন ক্যামেরুন।


(৪)
সভ্যতা বনাম সংস্কৃতিঃ

সভ্যতা বনাম সংস্কৃতির লড়াই হলিঊডে এই প্রথম না। ক্যামেরুন নিজেই অভতারেও ওপর " Dancing with Wolves" এর প্রভাব স্বীকার করেছেন। যেখানে বস্তবাদি সভ্যতায় উন্নত এক মানুষ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে বুঝতে পারে, আদিবাসীরা সভ্যতার বিচারে পিছিয়ে থাকলে কি হবে, সংস্কৃতির বিচারে অনেক এগিয়ে।

আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি বোঝাতে, স্বামী সূপর্ণানন্দর উদাহরনটি প্রানিধানযোগ্য। উনি বলতেন তাজমহলের ইমারতটা হচ্ছে সভ্যতা-আর তাজমহলে কবর দেওয়া সাহাজাহানের মমতাজের প্রতি যে ভালোবাসা সেটা হচ্ছে সংস্কৃতি। একটা মাথার সম্পদ, অন্যটা হৃদয়ের।

এখানেও নভি অভতার তথা গল্পের প্রটাগনিষ্ট জ্যাক সুলি নভিদের বাগে আনতে এসে, নিজেই নভি সভ্যতার প্রেমে পড়লেন। কারন নভিরা বস্তবাদি সভ্যতায় অনুন্নত হলে কি হবে, তাদের সংস্কৃতি অনেক উন্নত। সেই সংস্কৃতি হচ্ছে প্রকৃতি আর মানুষকে ভালবাসা। সেই জন্যে মানুষরা যখন নাভিদের শিক্ষিত করতে চাইল-নাভিরা বলে পাঠালো মানব সংস্কৃতি থেকে তাদের শেখার কিছু নেই। ওই হানাহানি বা লোভের সংস্কৃতি থেকে কি শিখবে তারা?

অবশ্য ক্যামেরুনের এই চিন্তা আবেগের দিক দিয়ে যতটা ঠিক, বিবর্তনের দিক দিয়ে ঠিক না। হিংসা এবং অহিংসা, লোভ এবং স্বার্থবিসর্জন, এই সব বৈপরীত্যের মিশ্রনই আমাদের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস বাড়িয়ে থাকে। হিংসা আর লোভ আমাদের মধ্যে এমনি এমনি আসে নি। এসেছে বিবর্তনের পথে আমাদের টিকিয়ে রাখতেই। আবার সেই লোভই আমাদের ধ্বংশের পথ দেখাচ্ছে।

থ্রিডিতে প্যান্ডোরাকে যেভাবে মূর্ত করেছেন পরিচালক, তা সত্যিই অনবদ্য। আমারত মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল প্যান্ডোরাতে ঝর্ণার ধারে বসে আছি। অভতারের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে সত্যই অভূতপূর্ব। পরিচালকের মতন আমিও চাই অরবিন্দর সুপার মাইন্ড মানব সভ্যতাতেও আসুক। তবে তা বোধ হয় বৈজ্ঞানিক দিয়ে খুব সঠিক চিন্তা না।

Monday, December 21, 2009

এত রক্ত কেন?

কিন্ত যেভাবে হিংসাতে সারা পশ্চিম বঙ্গ উত্তাল, তাতে চুপ করে থাকা গেল না।

রাজনৈতিক পরিবর্তন এলে কিছু লাশ পড়বে-এসব বিপ্লবী বিশ্বাস। পরিতক্ত্য ধারনা। উন্নত বিশ্বে রাজনীতির জন্যে এই ভাবে মানুষ খুন হয় না।

রাজনৈতিক খুন এবং হিংসার পেছনে কারন গুলো নিম্নরুপঃ

(১)
নিউ ম্যালথেসিয়ান তত্ত্ব ঃ
জমি কম, লোক বেশী। সীমিত সম্পদ নিয়ে পশুর মতন খেওখেয়ি। তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে যত কাজ দেখেছি, তাতে এই নিউ ম্যালথেসিয়ান তত্ত্বটা বার বার এসেছে। কেও কি অস্বীকার করতে পারে কেশপুর থেকে নন্দীগ্রাম থেকে সিঙ্গুরে, এই সীমিত সম্পদ নিয়ে মারামারি করার ভূমিকা? ১৯৭৭ সালে এক একর জমির ওপর কজন জীবিকা নির্বাহ করত? এখন কজন করে?

জন সংখ্যা চীনের মতন কড়া হাতে নিয়ন্ত্রন করতেই হবে।

(২)
গণতন্ত্রের অভাবঃ

নানান লেভেলে। সব লেভেলেই ব্যাবসায়ীরা কব্জা করতে চাইছে গন-নিয়ন্ত্রন ব্যাবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। প্রতিটা রাজনীতিবিদই এখন ব্যাবসায়ীদের
বোরে মাত্র। গণতন্ত্রের এই ব্যাবসা বন্ধ করতে দরকার রাজনৈতিক সংস্কার। সিপিএম বাস্তঘুঘু জন্মের পেছনে, এটাই কারন। যা কংগ্রেসের ও বহুদিনের রোগ

(৩)

সমাজ জীবনের ওপর সরকারী নির্ভরতা বড্ড বেশী। যার জন্যে যে ভোটে জিতবে, তার সামনে অসংখ্য ব্যাবসা। এটা বন্ধ করতে হবে।
সরকারী সব ডিপার্টমেন্ট গুলো মন্ত্রীদের হাতে না থেকে বিধান সভার একটা কমিটির হাতে থাক যাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং কিছু গুনী ব্যাক্তি থাকুন। ঘুঘু এত খাবার পেলে, অনেক ডিম ত পাড়বেই। আর সীমিত সম্পদ থাকলে খেয়োখেয়িও শুরু হবে

(৪)
পুলিশ যেন কোন মন্ত্রীর হাতে না থাকে। এতে পুলিশ একটা রাজনৈতিক দলের সেবাদাসের পরিনত হচ্ছে।ফলে লোকে পুলিশের ওপর ভরসা হারিয়ে নিজেরাই অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। পুলিশ থাকুক বিচারপতি এবং বিধান সভার কোন কমিটির হাতে।

******************
সমস্যা অনেক। সমাধান চাই।

সমস্যা একটাই-সেটা হচ্ছে রাজনীতির ব্যাবসা। এটাকে বন্ধ না করলে, আরো লাশে লাল হবে এই বঙ্গের মাটি।

Thursday, December 17, 2009

খাদ্যদ্রব্যের দাম-শেষের সেদিন অন্ধকার

ভারতে খাবারের দামে আগুন নেভানো যাচ্ছে না। অনেক কারন আছে-জলবায়ু এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাবারের দামের উর্দ্ধগতি তার অন্যতম। আনন্দবাজার সেটাই লিখেছে।

এমনটা হবে আমি ২০০৭ সালের এক প্রবন্ধেই ব্যাখা করেছিলাম।

সমস্যা হচ্ছে ভারতে সমস্যা সমাধানের জন্যে আমরা প্রযুক্তির দিকে না তাকিয়ে-রাজনৈতিক দলাদলি করি বেশী। একদিকে সুবিধাবাদি দক্ষিনপন্থী ঘুঘু, অন্যদিকে নির্বোধ বামপন্থী-আর মধ্যেখানে নিধিরাম সর্দার কংগ্রেস। ২০-২০ ম্যাচ খেলছে। লংটার্ম কোন প্ল্যানিং নেই! অথচ প্রযুক্তি ছাড়া, স্ট্রাটেজি ছাড়া ভারতীয় কৃষিকে বাঁচাবে কার সাধ্য?

ভেবে দেখুন

(১) কৃষিক্ষেত্র থেকে ফসল আর আগের মতন হচ্ছে না। অজৈব চাষ করে মাটি শেষ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর আরো বেশী জল, সার লাগছে।

(২) ব্যাপক নগরায়নের জন্যে চাষযোগ্য জমিও ক্রমহ্রাসমান।

(৩) অথচ লোক সংখ্যা বেড়েই চলেছে-যেখানে সবাইকে পেট পুরে খেতে দিতে হলে, এমনিতেই ভারতে খাদ্যাভাব থাকে। গুদামে গম পচার কথা না।

(৪) ভূর্গভস্থ জল কমে চলেছে। আর চাষে আরো বেশি করে জল লাগছে। ফলটা কি হবে? সেচের খরচ সাংঘাতিক! ফলে উৎপাদিত শষ্যের দাম বেশী হবেই!

এসব আমরা সবাই জানি! তাহলে ব্যাবস্থা নিচ্ছি না কেন?

(১) কেন ইস্রায়েল থেকে শিখছি না কি করে শুধু আদ্রতা রেখে চাষে জলের ব্যাবহার ৯০% কমানো যায়?
(২) কেন সেচে সোলার বিদ্যুত ব্যাবহার করা হচ্ছে না? এতে খরচ অনেক কমত।
(৩) সমবায় গড়ে তুলতে কোন পার্টির কোন আগ্রহ নাই।
(৪) খাদ্য সংরক্ষনের জন্যে সোলার চালিত আধুনিক হিমঘর কোথায়?
(৫) দেশের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিনপনের ও দুরাবস্থা। একটু বেশী উৎপাদন করলেই আলু ২ টাকা কিলোদরে রাস্তায় পচে! চাষিরাই বা নিজেদের আত্মহত্যার পথা কেন চওড়া করে খুলবে?

আসল ব্যাপারটা কি? গণতান্ত্রিক কোন কাঠামোতে ভোট নিয়ে ফোকাসটাই মুখ্য। টি-২০ গেম। জনগনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনা নেই। খাবারের দামের যে বিষ্ফোরন হবে ভারতে বহুদিন থেকে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। আমি ত দুবছর আগে আমেরিকাতে প্রকাশিত প্রবন্ধের ভিত্তিতে এই নিয়ে লিখেও ছিলাম। গনতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের কথা শোনে নি কেন? আমার দেখলে হাঁসি পায় যেখানে রোগ এত গভীরে এই ইউ সি আই এই নিয়ে বন্ধ ডাকছে!

রুগী মুমুর্ষ। দরকার চিকিৎসা। প্রযুক্তি আর স্ট্রাটেজি। সেই নিয়ে কারুর হুঁস নেই। সবাই সবাইকে দোষারোপ করতেই ব্যাস্ত।

কেন এমন হয়? আমেরিকাতে ২০০৭ সালে খাবারের দাম বাড়তেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গবেষনা শুরু করে-এবং তার ভিত্তিতে কিছু আসু পরিবর্তন ও আসে আমেরিকার কৃষিক্ষেত্রে। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কি শুধু ডিগ্রি দেওয়ার জন্যে আছে? তারা কি আদৌ দেশের সমস্যাগুলো নিয়ে গবেষনা করে? সেসব না করলে চেতনাটাই বা আসবে কি করে?

সমাধানের আসল পথ হচ্ছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং গবেষনা। স্বাধীনতার ৬০ বছর বাদেও এই বোধটাই আমাদের জন্মালো না। শুধু খাদ্য আন্দোলনের রোমমন্থন-নইলে রাজনীতি।

এই ভাবে একবিংশ শতাব্দিতে কোন দেশ চালানো যায় না।

Thursday, December 10, 2009

কমিনিউজম নিয়ে ভুল ধারনার তথ্য তালিকা

কমিনিউজম নিয়ে কমিনিউস্ট এবং এন্টি-কমিনিউস্টদের ভুল ধারনা সর্ববিদিত। নানান ফোরামেই আমরা বাঙালী কমিনিউস্টদের দেখা পাব যাদের অধিকাংশের পড়াশোনা বেশ সীমিত। আবার যারা কমিনিউস্টদের গালাগাল দেন, তাদের লেখাপড়া আরো বেশী সীমাবদ্ধ। তাই বাঙালী কমিনিউস্ট এবং তার বিরোধিদের ভুল ধারনার একটা তথ্য তালিকা তৈরী করলাম। ভুল ধারনার জন্মসূত্র অবশ্যই কমিনিউজম নিয়ে বলশেভিকদের ভুল প্রচার। লেনিনিজম কত ভ্রান্ত, সেটা বুঝতে মার্ক্সের প্রতিটা লেখা বুঝতে হবে এবং তার সাথে ১৯০০-১৯৫০ সালের মধ্যে আমেরিকান এবং বৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে লেনিনবাদ বনাম মার্ক্সবাদ নিয়ে যে বিস্তর গবেশণা হয়েছে, সেগুলি দেখা দরকার। সোভিয়েতের পতনের সাথে সাথে, রাশিয়ান ঐতিহাসিকরা স্বাধীনতা পেয়েছেন এবং আরো অনেক নথিপত্র তাদের হাতে এসেছে-যার ভিত্তিতে বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাস ও রাশিয়াতে নতুন করে লিখতে হচ্ছে। ১৯৫০ সালের পর এবং অধুনা কম্প্যুটার সিম্যুলেশনের উন্নতিতে স্যোশাল ফিল্ড থিওরী, সোশাল থার্মোডাইনামিক্স, ইত্যাদি নব নব সমাজবিজ্ঞানের গবেষনায় এবং গবেষনায় নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কারে, সামাজিক বিবর্তন আরো ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা চলছে। পরিশেষে ডারুইনিয়ান ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে সমাজ বিজ্ঞানে একটি নতুন শাখার জন্মে হয়েছে যা মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে উৎসাহী। এতকিছু লেখা একটা ব্লগে সম্ভব না। এই ব্লগ শুধু একটা সংক্ষিপ্ত সামারী।

(১) কমিনিউজম, মার্ক্সিজম, লেনিনিজম, সমাজতন্ত্র সব এক। বাস্তব হচ্ছে, এদের মধ্যে পার্থক্য- আপেল বলাম ওরেঞ্জ। কমিনিউজম বলতে আমরা মূলত লেনিনিস্ট কমিনিউজমকে বুঝি কিন্তু ধর্মীয় কমিনিউজমের অস্তিত্ব বিংশ শতকে বিস্তর ছিল। আমেরিকা আইন করে তাদের বন্ধ করে। নানান ধর্মীয় আন্দোলন মানুষকে কমিউন করে থাকতে উৎসাহিত করেছে। বাস্তবে এগুলি সবই ধণতন্ত্র যে ভাবে মানুষের মধ্যে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রশয় দিয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদি আন্দোলন।

(২) বস্তুবাদি সমাজতন্ত্র বনাম আদর্শবাদি সমাজতন্ত্রঃ মার্ক্স যদিও এই ভাবেই ভাগ করতেন-আদতে মার্ক্সিস্ট সমাজতন্ত্রও সেই হিন্দু বা ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মতনই গাড্ডায় আছে। দায়ী লেনিন। মোটামুটি ১৮৭০ সাল থেকেই মার্ক্সবাদ আস্তে আস্তে বৈজ্ঞানিক পথ ছেড়ে, আদর্শবাদি পথে সরে আসতে থাকে। সেই পতন তরান্বিত করেন লেনিন।

(৩) মার্ক্সিজম এবং সমাজতন্ত্র এক, মার্ক্সিজম মানেই কমিনিউজম ঃ বিজ্ঞানে নিউটনিস্ট বা আইনস্টানিস্ট হয় না। দুর্ভাগ্য বশত মার্ক্সিজমে হয়! মার্ক্সিজম আদৌ কোন আদর্শবাদকে নির্দেশ করে না। এটি আদি সমাজ বিজ্ঞানের পদ্ধতি-বা ঐতিহাসিক বিবর্তনকে বস্তুবাদ দিয়ে বোঝার চেষ্টা। কমিনিউজম সমাজের বিবর্তনের শেষ ধাপ। বস্তুত এটাই সত্য মার্ক্স কোন আদর্শবাদের নির্দেশ দিয়ে যান নি-দিয়ে গেছেন একটা পদ্ধতি। সেটাকেই ইসলাম বা খ্রীষ্টানদের মতন আদর্শবাদি তত্ত্বে পরিণত করেন লেনিন।

(৪) মার্ক্সিজমই একমাত্র বলে সমাজ বিবর্তনের শেষ ধাপ কমিনিউজম। ঠিক না। সমাজ বিজ্ঞানের যাবতীয় উল্লেখযোগ্য তত্ত্বই বলে সমাজ বিবর্তনের শেষ ধাপ কমিনিউজম। তবে লেনিনের মতন মারধোর চোট্টামি করে না। সোশ্যাল থার্মডাইনামিক্স বলে একটা সাবজেক্ট আছে। সেখানে যেখা যায়, সব সিস্টেম ক্যাওস কমিয়ে ক্রিষ্টালাইজ করতে থাকে-এবং মোটামুটি এটা নিশ্চিত কমিনিউজম মানব বিবর্তনের শেষ ধাপ। তবে এই সব কমিনিউস্টদের বিপ্লব করে কমিনিউজম আনার রোম্যান্টিসিজম বেঢপ ঢপবাজি। এগুলোর সাথে মোল্লাদের বিশুদ্ধ ইসলামিক রাষ্ট্রের ধারনার কোন পার্থক্য নেই। সমাজের যেভাবে বিবর্তন হচ্ছে, যেভাবে প্রযুক্তি এগোবে, তাতে স্যোশালিজম থেকে কমিনিউজম এমনিতেই আসবে।

বর্তমান পৃথিবীকে একটা আনস্টেবল স্টেট ধরা যেতে পারে-যখন জল থেকে বরফ হচ্ছে-কিছু কিছু বরফ খন্ড-তার মধ্যে মধ্যে জল। বরফ গুলোকে ধরা যেতে পারে স্টেট। তারপরে সেই স্টেট গুলো একসাথে জমাট বেঁধে সব বরফ হল-মানে রাষ্ট্রের পতন হল। পৃথিবীর যে সমস্যাগুলোর সমাধান না করলে, আমরা সবাই মারা যাব বা প্রযুক্তি লুপ্তহবে-তা একা কোন রাষ্ট্রের পক্ষে করা আর সম্ভব হচ্ছে না। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বেশ দ্রুত লুপ্ত হবে।

যেটা আমাদের কমি বন্ধুরা বুঝতে চাইছে না-একদেশে কমিনিউজম বা সমাজতন্ত্রও করা সম্ভব না। সামান্য তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলেই বোঝা যায়।
বিপ্লব করেও কমিনিউজম আসবে না। কমিনিউজম আসবে শুধু মাত্র উন্নত, আরো অনেক অনেক উন্নত উৎপাদন শীল সমাজের মধ্যে দিয়ে। এই ধরনের নিম্ন উৎপাদনশীল সমাজে কমিনিউস্ট বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা ব্যার্থ ত হবেই-শুধু শুধু অসংখ্য লোক মারা যাবে। অধিকতর উন্নত উৎপাদন শীলতার ডিমান্ডই উৎপাদনের ওপর শ্রমিকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করবে-যা সফটঅয়ার বা অত্যাধুনিক টেলিকম বা বায়োটেক শিল্পে আস্তে আস্তে আসছে। এগুলো জ়োর করে লাঠি মেরে করতে গেলে, হিতে বিপরীত হবে। যা এদ্দিনে হয়েছে।

(৫) মার্ক্সই প্রথম শোষন এবং ধনের অসাম্যের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের কথা বলেন-ডাঁহা ভুল। সব ধর্মীয় আন্দোলনই ( ক্রীষ্ঠান, ইসলাম, বৈষ্ণব) একধরনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন -শোষন এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে। সেকালে বস্তুবাদ জানাছিল না। তাই ধনের অসাম্যের বিরুদ্ধে সব ধর্মীয় আন্দোলনই সোচ্চার হয়েছে। এই লেখাটা দেখা যেতে পারে।


(৬) মার্ক্সবাদ এবং লেনিনবাদ এক-লেনিনবাদ মার্ক্সবাদের এক্সটেনশনঃ এটাও মস্ত ভুল বহুদিন ধরে বলশেভিকরা রটিয়ে আসছে। বাস্তব হচ্ছে লেনিনই মার্ক্সবাদের সর্বাধিক ক্ষতি করেছেন। বুঝে এবং না বুঝে। এই নিয়ে অনেক লেখা আছে। লেনিনের কাছে মার্ক্সের মুস্টিমেয় লেখা ছিল।কারন সেযুগে মার্ক্সের লেখা সহজলভ্য ছিল না। লেনিনঞ্ছিলেন জার্মানীতে-সেখানেও মার্ক্সের সব লেখা পাওয়া যেত না।
দ্বান্দিক বস্তুবাদের টেকনিকগুলো একটু রপ্ত করলেই দেখা যাবে, মার্ক্সের লেখায় ডায়ালেক্টিক্স প্রচুর-লেনিনের লেখায় তা অনুপস্থিত। এই সব কারনে মার্ক্স কমিনিউজম এবং কমিনিউস্ট বলতে ঠিক যা যা বলতে চেয়েছিলেন-তার সবটাই লেনিন ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।

লেনিনিজম মার্ক্সিজম থেকে সম্পূর্ন আলাদা। ইসলামি সমাজতন্ত্রের সাথে মার্ক্সিজমের যতটা যোগসুত্র-লেনিনিজমের সাথে মার্ক্সিজমের যোগ ঠিক ততটাই। প্রায় অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয়-আন্তর্জাতিকতা, জাতীয়তাবাদ, পুঁজির বিবর্তন-ইত্যাদি নিয়ে মার্ক্স এবং লেনিনের ধারনা ১৮০ ডিগ্রি বিরোধি।

(৬) ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে অক্টবর বিপ্লব সাধিত হয়! সত্য আসলে এটাই, নির্বাচনে সমাজতন্ত্রীদের কাছে হেরে, লেনিনের দলবল রেড আর্মি দিয়ে বিরোধিদের মেরে ধরে কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলী ভেঙে দেন এবং এক দলীয় শাসন চালু করেন। শুধ তাই নয় এটাও রটানো হয়, রাশিয়া ছিল সেই সময় অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ। বাস্তবে শিপ্লু উৎপাদনে সেই সময় রাশিয়া ছিল পঞ্চম-এবং দ্রুতহারে বাকি ইউরোপের সাথে তাল মিলিয়ে সেখানে শিল্পোন্নয়ন হচ্ছিল। বলশেভিকদের বেসও ছিল শ্রমিকদের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে না। বেসিক্যালি ওটা ছিল গনতন্ত্র ধ্বংশ করার বিপ্লব।

(৭) কমিনিউজমে সবাই খেতে পাবে-লক্ক্যনীয়-এখানে কমিনিজম বলতে আমি জোর করে চাপানো লেনিনিজম বলছি-যা ফ্যাসিজমের আরেকটা ভ্যারিয়েশন। বাস্তব এটাই পৃথিবীর সব থেকে বড় দুর্ভিক্ষ গুলি, লেনিনিস্ট কমিনিউস্ট জমানাগুলোতেই হয়েছে

(৮) কমিনিজম এলে সবাই শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাবে। এটা ঠিক। কিন্ত সেই সুরক্ষা মুসলোলিনীর ইটালি বা হিটলার ও দিত। আরো ভাল ভাবেই দিত। যেকোন ফ্যাসিস্ট এবং আইডিওলজ্যিক্যাল অটোক্রাটিক শাসকরা ( আদর্শবাদি স্বৈরাচারিরা- সবার কথা-আদিল আমিন বা এরশাদের কথা বলছি না) শিক্ষা ক্ষেত্রে সব থেকে ভাল কাজ করে। যেমন এখন ইরান করেছে। এর সাথে কমিনিউজমের যোগ নেই-ন্যাশানাল সোশ্যালিস্টরা [ এবং তাদের ভ্যারিয়ান্টরা ] সবাই এই কাজে সফল হয়েছে। কিন্ত ব্যাক্তি স্বাধীনতা বর্জন করে-এই ধরনের উন্নতি কাম্য না। জাপান বা যেকোন স্ক্যন্ডেনেভিয়ান দেশই ১০০% সাক্ষর বা শিক্ষার মান ওখানেও অনেক উঁচু-তাদের এই ধরনের স্বৈরাচারের সাহায্য নিতে হয় নি কিন্ত।

(৯) কমিনিউজম মানে অগনতান্ত্রিক স্বৈরাচার।

সঠিক বাক্য হবে লেনিনিজম মানে অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচার।

মার্ক্স কমিনিউজিম এর ব্যাখ্যায়, ডিক্টেটর অব প্রলেতারিয়েত মানে এক দলীয় শাসন হবে-গণতন্ত্র ধ্বংশ করতে হবে-বিরোধিদের শুলে চড়াতে হবে-এটা কোথাও বলেন নি।

ক্ষমতা দখলের জন্যে স্বৈরাচারী কমিনিউজমের সম্পূর্ন দায়ভার লেনিনের। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ঢপবাজিও আর এক দলীয় স্বৈরতন্ত্র ও তার নিজস্ব আবিস্কার। বস্তুত মার্ক্সবাদ নামক দুধে যত জল ঢালা আছে, তার সব জলই এই মহান তাত্ত্বিক ধাপ্পাবাজটির।

(১০) পুজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ-এটি লেনিনিজম। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে মার্ক্স কখনো সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে দেখেন নি-দেখেছেন সমাজ বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ন ধাপ হিসাবে যাতে আন্তর্জাতিকতার শুরু হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদ এই জন্যেই ধাপ্পাবাজি যে রাষ্ট্রের উৎপত্তির মধ্যেই এর বীজ রয়েছে-এবং আন্তর্জাতিকতা না এলে তা যাবে না-এবং সেই আন্তর্জাতিকতার আগমনের জন্যে আন্তর্জাতিক বানিজ্য হচ্ছে সর্বাধিক গুরত্বপূর্ন ক্যাটালিস্ট-যার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল দেশের শ্রমজীবি মানুষ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাবে-কারন রাষ্ট্রের বাউন্ডারী শিথিল হবে।
সেখানে লেনিনের তত্ত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক বানিজ্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ । আর আন্তর্জাতিকতা হচ্ছে- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল শ্রমজীবি মানুষ একত্রিত হও! এটা হচ্ছে লেনিনিস্ট আন্তর্জাতিকতা-যা ঘোড়ার গু এবং গরুর গবর ছাড়া কিছু না। কেন না, রাষ্ট্রের সীমানা শিথিল না হলে, সমস্ত দেশের শ্রমজীবি মানুষ একত্রিত হতে পারে না-এসব তাত্বিক কল্পনা প্রসূত শ্লোগান। আন্তর্জাতিকতা নিয়ে মার্ক্সীয় ভাবনায় জল কম-কারন তা আমদের চোখের সামনে দেখছি-একবিংশ শতাব্দিতে। কিন্ত লেনিনিস্ট আন্তর্জাতিকতা-"সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক"- কোলকাতার লেনিন সরনির ব
দ্ধ নর্দমার জল।

(১১) কমিনিউস্ট বিপ্লব এলেই নারী মুক্তি আসবে-নারী পুরুষ সমান হবেঃ

কমিনিউস্টরা দাবি করে, একমাত্র সমাজতন্ত্রের পথেই নারী মুক্তি সম্ভব-ধনতন্ত্রে তা সম্ভব না। বুর্জোয়া ফেমিনিজম শ্রেনী দ্বন্দের বিকৃত রূপ।

এবার আসুন আমরা আমাদের কমি বন্ধুদের ইতিহাস থেকে কিছু প্রশ্ন করিঃ

(১) কমিনিউজমের ইতিহাসে কোন দেশে-কোন কালে কোন মহিলা কি জেনারেল সেক্রেটারী হতে পেরেছেন?
(২) কমিনিউমের ইতিহাসে কোন গঠিত পলিটবুরোতে-কোন দিন কি পাঁচ জন মহিলা ( পলিটবুরোর ৩০%) থাকতে পেরেছেন ? ( ভারতের পলিটবুরোতে একমাত্র বৃন্দা কারাত আছেন। তাও তাকে রাখা হয়েছিল না। পলিটবুরোতে কেন মহিলা নেই, সেই নিয়ে তিনি কান্নাকাটি শুরু করলে তাকে শান্তনা পুরস্কার দেওয়া হয়)।
(৩) কমিনিউমের ইতিহাসে কোন সেন্ট্রাল কমিটিতে কোনদিন কি ২৫% এর বেশী মহিলা মেম্বার ছিল?

বন্ধুগন-সোভিয়েত, চিন, ভারত, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা-সর্বত্র এই প্রশ্ন গুলি খুঁজতে থাকুন। দেখবেন-কমিনিউজম আসলেই পুরুষতন্ত্রের বস্তুবাদি রূপ। গোল্ডবার্গ তার বইতে ( Why Men Rule)যে লিখেছিলেন-যে রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরকালই পুরুষের হাতে ছিল-কমিনিউজমে তার ব্যাতিক্রম হয় নি।


উপসংহারে কিছু বলা উচিত। কমিনিউস্ট এবং কমিনিউস্ট বিরোধিরা আসলেই না বুঝে একটা ভুল রাজ়নৈতিক দিশা দিচ্ছেন জনগনকে। জনগন বাঁচতে চাইছে-চাইছে তাদের সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। সেটা বাজার অর্থনীতি বা কমিনিউস্ট বিপ্লব দিয়ে হবে না -তা আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি। বাজার অর্থনীতি যাও বা কিছুটা সফল-কমিনিউস্ট বিপ্লব সর্বত ভাবেই ব্যার্থ। দরকার নতুন রাজনৈতিক পথের। যা উৎপাদন ব্যাবস্থাকে আরো বেশী মজবুত করবে। এবং তা সম্ভব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক অনেক বেশী বৃদ্ধি করে।

Saturday, November 28, 2009

জনচেতনা মঞ্চের মত সিটিজেন ফোরাম কেন দরকার?



আমি জনচেতনা মঞ্চ নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার সময় আমার সুহৃদ রাজনৈতিক বন্ধুদের কাছ থেকে যেসব ফিডব্যাক পেলাম তা নিম্নরূপ

(১) সফিদা বা সোমনাথদা সারাজীবন ভ্যাঙ্গার্ড পার্টির ত্তত্ব ( সবার ওপর পার্টি সত্য) অনুশীলন করে জনচেতনা মঞ্চের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক সন্ন্যাস খুঁজছেন ? কারন জনচেতনা মঞ্চের বহুত্ববাদি ধারনা-অবশ্যই লেনিনের সবার ওপর পার্টি সত্য এর বিরোধি
(২) এটা কি চা বিস্কুট খাওয়ার আড্ডা?
(৩) কেন রাজনৈতিক দল ঘোষনা না করে একটা ফোরাম ঘোষনা করা হল? একটা নতুন রাজনৈতিক দল কেন গঠন করা হল না?

তৃতীয় প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ সেটাই আমি আলোচনা করব বিস্তারিত ভাবে তার আগে প্রথম প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন সোমনাথ চ্যাটার্জি তার লেখাতে এই উত্তর দিয়েছেন সফিদাও এক সাক্ষাতকারে এই ব্যাপারে তার বক্তব্য জানিয়েছেন তাও নিজের দুকথা জানিয়ে রাখি

সবার ওপর পার্টি সত্য- এই মারাত্মক ব্যাধিটি পশ্চিম বঙ্গের কি ক্ষতি করেছে তা রাজ্যবাসী মাত্রই জানেন নন্দীগ্রাম থেকে সিঙ্গুর-অফিস থেকে আদালত-স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-আজ কোন জায়গায় পশ্চিম বঙ্গে রাজ্যবাসীর কথা, তাদের জীবিকা সংস্থানের কথা আগে ভাবা হয়? সর্বত্রই পার্টি পার্টি পার্টি করে ব্যান্ডবাদ্যের কুনাট্য এই কুম্ভীপাককে বধ করে, যারা পরিবর্তনের কথা বলছেন-তাদের মধ্যেও সেই প্রতিচ্ছবিই দেখা যাচ্ছে যেসব বুদ্ধিজীবি তৃণমূলের সাথে, মমতা তাদের মাসোহারার ব্যাবস্থা করছেন ( নৈতিক দ্বায়িত্ব বোধ হয়) -কমিটির শীর্ষপদে বসাচ্ছেন ঠিক যেমন করে পার্টির সব চামচা-তাবেদারবৃন্দকে পারিতোষিক পাইয়ে দিয়ে সিপিএম পশ্চিম বঙ্গের শিক্ষা সহ যাবতীয় পরিকাঠামোকে উচ্ছনে পাঠিয়েছে পরিবর্তনের সাথে সাথে সিপিএমে গুন্ডারা তৃনমূলে এসে তরী ভেড়াচ্ছে এটা হচ্ছে আমাদের পশ্চিম বঙ্গে পরিবর্তন পরিবর্তন আমিও চাই-কারন তা না হলে বহুত্ববাদি গণতন্ত্রই টেকে না কিন্ত রাজা যদি আলখাল্লা বদলিয়ে সিপিএম এর বদলে তৃনমূল হয়, রাজ্যবাসীর লাভটা কি? সবার ওপর পার্টি সত্য কি মারাত্মক ব্যাধি-তা আমরা জেনেছি, দেখেছি সফিদা বা সোমনাথদার সাথে সিপিএমের সম্পর্ক বিচ্ছেদের মাধ্যমে পার্টির সংবিধানকে দেশের সংবিধানের চেয়ে বড় বলে মানতে হবে! মামার বাড়ির দাবি নাকি? কিন্ত তাও সিপিএম এই রাজ্যে ৩৩ বছর টিকেছে-কারন বাঙালীর কূট কাচালের ধারাটাই আত্মঘাতি রাজনীতির ( এই নিয়ে অতীতে লিখেছিলাম)।
কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে নতুন রাজনৈতিক দলের বদলে কেন ফোরাম? দল ভিত্তিক রাজনীতির প্রতি কেন অনাস্থা?

এর উত্তর ভাল করে জানা দরকার আমি যা বলছি, তা একান্ত ভাবেই আমার নিজের কথা গণতন্ত্রের প্রতি আমার ১০০% আস্থা আছে কিন্ত দলীয় রাজনীতির প্রতি নেই

প্রথমত গনতন্ত্র একটি ডাইনামিক সিস্টেম-যা বিবর্তনের মাধ্যমে উন্নত হয় বিবর্তনের সুযোগ আছে বলেই সংসদীয় গণতন্ত্র বাকি সব রাজনৈতিক সিস্টেমের থেকে শ্রেষ্ঠ এই সিস্টেমে আজকে লোকে খেতে না পেলেও কালকে পাবে-কারন সেই ক্ষুদাটা ভোট বাক্সে প্রতিফলিত হতে পারে আবার সমস্যা এখানটাতেই-গরীব মানুষের ভাষা কি পার্লামেন্টে পৌঁছাচ্ছে? উত্তরটা সরাসরি ভাবেই না কারন তা হলে ছত্তিসগড়ের জঙ্গলগুলি যা আদিবাসিদের গত হাজার বছরের আবাসস্থল ওইভাবে সরকার কর্পরেটদের হাতে দিয়ে দিতে পারে না তা সত্ত্বেও আমরা দেখছি এবার জাতীয় কংগ্রেস জিতে গেল-কারন তারা মুখে অন্তত ১০০ দিনের কাজের ওপরই গুরুত্ব দিয়েছে বেশী-ধর্ম, জাতপাতকে অন্তত দূরে সরিয়ে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদি পার্টিগুলিকে কোনঠাসা করেছে এর জন্যেই গণতন্ত্র শ্রেষ্ট অর্থাৎ প্রথমেই যে কাজটা করা ভীষন ভাবে জরুরী-সেটা হচ্ছে জন সাধারনের ভয়েস, পার্লামেন্টে পৌঁছে দেওয়া এই কাজটা কোন পার্টিই করছে না তারা ব্যাবসায়ীদের দালাল মাত্র আর তথাকথিত বামপন্থীরাও পার্টির ক্রীতদাস -হুইপ মেপে কথা বলেন নতুন পার্টি খুলে অবস্থার পরিবর্তন হবে-সেই আশা ক্ষীন কারন সব দেশের মতন এখানেও গণতন্ত্র ঠিকাদারতন্ত্রে পরিনত। ৮-১০ কোটি টাকা খরচ করে ভোটে জিতে জ়নপ্রতিনিধিদের সামনে ঠিকাদারি করা ছাড়া উপায় কি? টাকাটা উঠবে কোথা থেকে?

দ্বিতীয় সমস্যাটা পরিবেশ এবং রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে মনে রাখতে হবে রাজনৈতিক হিংসার উৎস সেই ঠিকাদারতন্ত্র এই যে এত কোটি টাকা লাগছে নির্বাচনে জিততে-ফলে টাকাটা তুলতে পঞ্চায়েত মিউনিসিপালিটি গুলো লুটতে হবে ত প্রমোটারদের সুবিধা করে দিতে হবে নইলে ভোটে জেতার টাকাটা উঠবে কি করে? আজকে খানাকুলে এই মারামারি-কাটাকাটির উৎস কি? ওখানকার সবলোকই জানে এটা পঞ্চায়েতকে লুঠ করার অধিকারের জন্যে সিপিএম এদ্দিন লুঠ করেছে-আজ তৃনমূল যেসব জায়গায় এসেছে-সেই সমস্ত জায়গায় লুঠের ভাগ নিয়ে কোন্দল নিউজ পেপারে চোখ রাখুন এটা বন্ধ হবে না কারন আমাদের গনতন্ত্র এখন সত্যিকারের ঠিকাদারতন্ত্র। আবার কোলকাতার দূষন থামানোর জন্যে সিপিএম আজও সি এন জি আলা বাস বা অটো চালু করতে পারল না কারন তৃনমূলের বিরোধিতা এবং নিজেদের ভোট হারানোর ভয় দিল্লী কিন্ত এটা পেরেছে বাংলা পারে নি ঢাকাও পেরেছে আমরা পারি নি বি বি সির রিপোর্ট বলছে কলকাতা পৃথিবীর অন্যতম দূষিত শহর ৪% লোকের এখানে ক্যান্সার হবেই-৬০% লোক পঞ্চাশ পার করার আগেই কোন না কোন রোগে ভুগবে এই হচ্ছে কলকাতার বাস্তব অবস্থা অথচ কোন পার্টি এই নিয়ে কোন আন্দোলন করল? বুদ্ধিজীবিদের শহরের তকমাতে কি লাভ যে শহর জীবন্ত মৃত্যপুরী? কিসের বুদ্ধিজীবিতা যেখানে শহরের স্বাস্থ্য নিয়ে কোন আন্দোলন নেই? এর থেকে নিদারুন বন্ধ্যাজীবিতাও ভাল!

এখানেই সিটিজেন ফোরামগুলি পৃথিবীর সবদেশে দুর্দান্ত কাজ করে চলেছে কারন ব্যাবসায়ী-রাজনীতি চক্র ভাংতে এর থেকে ভাল কোন উপায় নেই আমেরিকাতে আমার অভিজ্ঞতা খুব ভাল দুটো গল্প বলি ২০০২ সালে নিউজার্সির মিডলটাউনের ডেমোক্রাট মেয়র ঘোষনা করেন শহরের মাঝখানে, যা ছিল ছোট খাট কিছু দোকানের সমষ্টি সেখানে বৃহৎ মল হবে-মিনি ম্যানহাটন গড়ে উঠবে শহরের সিটিজেন ফোরাম এর বিরুদ্ধে প্রতি শনিবার-রবিবার সেখানে জনসভা করেছে মেয়রকে কয়েক মাসের মধ্যেই পিছু হটতে হয় সেই আন্দোলন কিন্ত রিপাবলিকান পার্টি করে নি-কারন তারাও ব্যাবসায়ীদের দালাল ছাড়া কিছু না দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা লং বীচে ২০০৭ দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার অত্যন্ত সুন্দর মনোরম শহর-পাঁচ লাখ লোকের বাস কিন্ত বিচ গুলো ও সমুদ্রের জল সেখানে সাংঘাতিক ভাবে দূষিত হচ্ছিল কারন মেয়র এবং কং গ্রেস ম্যানটা সমুদ্রের ধারে ঢালাও কর্মাশিয়াল কমপ্লেক্সে অনুমোদন দিচ্ছিলেন টাকার খেলা এখানেও চলে এগুলির পেছনে ছিল ডেমোক্রাটিক পার্টি এখানেও রিপবলিকান পার্টি কিছুই করে নি-কারন তাদের টিকিও ব্যাবসায়িদের কাছে বাঁধা পরিবেশ সচেতন লোকেরা সেখানে ফোরাম তৈরী করে, সেখানকার কংগ্রেসম্যানকে ভোটে হারায় নিজেদের ক্যান্ডিডেট দিয়ে আমি ওদের হয়ে কিছু কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি-সব দেশেই গনতন্ত্রের সাথে ঠিকাদারদের যোগসাযোগ এত দৃঢ়-এটা থামাতে সিটিজেন ফোরামের কোন বিকল্প নেই যারা এই ফোরামে ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন-তাদের অনেকেই ডেমোক্রাটিক বা রিপাবলিক্যান পার্টির কার্ড হোল্ডার কিন্ত তবুও ওরা জানতেন, ওদের পার্টি এসব ব্যাপারে কিছু করবে না ফোরামের মাধ্যমেই এগোতে হবে

তাই আমি আমার সমস্ত রাজনৈতিক বন্ধুদের অনুরোধ করব-জনচেতনা মঞ্চ সফল করার কাজে এগিয়ে আসুন আপনাদের পার্টি অনেক কিছুই করতে পারবে না-কারন তাদের টিক ব্যাবসায়িদের কাছে বাঁধা আছে যা এই ফোরাম পারবে এটা পার্টির সমর্থকরা যত শীঘ্র বুঝবেন-ততই মঙ্গল

তাই তাদের অনুরোধ করছি এই লিংকে ক্লিক করে জনচেতনা মঞ্ছে যোগ দিন

Tuesday, November 24, 2009

ভারতীয় রাজনীতি না সাম্প্রদায়িকতার অন্ধ গলি?

বাবড়ি মসজিদ ভাঙা নিয়ে লিব্রাহাম রিপোর্ট এর পর্যালোচনায় আজ ভারতীয় সংসদে যে নাটক অনুষ্ঠিত হল, তা এক কথায় ধর্মনিরেপেক্ষ ভারতবর্ষের জন্যে এক চুড়ান্ত দুঃস্বপ্ন। বিজেপি সাংসদরা অনুতাপের বদলে জয় শ্রী রাম হাঁকলেন-আর তার প্রত্যুত্তরে সমাজবাদি দল সংখ্যালঘু ভোট আবার কাছায় তোলার আশায় আল্লাহ আকবর ধ্বনি দিল! হায় ভারতের মহান ধর্ম নিরেপেক্ষ গণতন্ত্র-কংগ্রেস বা অধুনা তৃণমুল এই ঘটনার প্রতিবাদ এখনো জানাচ্ছে না-কারন তাহলে হিন্দু মুসলমান দুদিকেই ভোট হারানোর ভয়। এই হচ্ছে তাদের ধর্ম নিরেপেক্ষতার স্বরূপ। একমাত্র সিপিএম ছাড়া আর কেওই সংসদে এই ধরনের নোংরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অফিসিয়াল প্রতিবাদ জানাই নি। যদিও সিপিএম পশ্চিম বংগে মাদ্রাসা শিক্ষায় দান খয়রাত করে, সংখ্যালঘু তোষন ভালভাবেই করে চলেছে-তবুও সংসদে এই ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্যে প্রকাশ কারাতকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি কংগ্রেস এবং তৃনমূল কংগ্রেসের নীরবতা একধরনের বিচ্ছিরি সুবিধাবাদি মনোভাবকেই প্রকট করে তুলছে-সেই সুবিধাবাদি মনোভাব হল সব ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তোষন করা। বাবরি মসজিদ যার ফলশ্রুতি। এই ভাবে বাঘের পিঠে চেপে নদী পার হওয়া যায় বটে-কিন্ত নদী পার হওয়ার পরে, সেই বাঘ কিন্ত সওয়ারীকে গিলে খেয়ে ফেলবে।

Sunday, November 22, 2009

নাটক কলি বুলি এবং ব্রেখটের এপিক থিয়েটার


প্রবাসে বাংলা নাটক দেখার অভিজ্ঞতা আমার কাছে এখনো অব্দি বেশ তিক্ত। আমেরিকাতে প্রায় ৩৫ টি বাংলা নাটকের গ্রুপ আছে এবং বাংলা সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে এদের প্রচেষ্ঠাকে আমি অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। কিন্ত ভাল স্ক্রিপ্ট ছাড়া যেমন হলিউডের সুপার সিনেমাটিক ডিজিটাল সিনেমাও বক্স অফিস বাঁচাতে অক্ষম , ঠিক ঠাক নাটক সিলেকশন না হলে , এপিক থিয়েটারের মতন চমকপ্রদ টেকনিকও ম্লান হতে বাধ্য।

নাটকের একটি মূল উপাদার দর্শক। ব্রেখটের এপিক থিয়েটারে তা আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারন এর সব টেকনিকই দর্শকের মনে সামাজিক চেতনার উন্মেষ ঘটানোর জন্যে। সমাজে চলে আসা অনাচার অত্যাচার শোষনগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষনের নানা ছলা কলা কৌশল এপিক থিয়েটার নিয়ে থাকে। সুতরাং নাটকের থিমের সাথে যদি দর্শকের নাড়ির যোগ না থাকে-এপিক থিয়েটারের দিকে পা মাড়ানোই উচিত না। প্রবাসী বাঙ্গালীদের কেওই শোষিত বা অত্যাচারিত না-বরং সবাই বুর্জোয়া এলিট। তাদের জন্যে সত্তরের দশকের বামপন্থী বাতিল তত্ত্ব কি মানসিক চিন্তার খোরাক দেবে?

ব্রেখটের এপিক থিয়েটার-সাধারনত কোন ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক উপাখ্যান যার মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিক বস্তবাদের দন্দগুলিকে ক্যানভাসের মতন আঁকে। এবং নাটকের মধ্যেই কুশীলবরা অপ্রত্যাশিত আচরন করেন, চরিত্র থেকে বেড়িয়ে আসেন( এলিনিয়েশন টেকনিক)-যাতে দর্শকের মনে সামাজিক দ্বন্দগুলি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই প্রশ্ন ওঠা তখনই সম্ভব, যখন দর্শক তার জীবনের ঘটনার মধ্যে দিয়ে সেই দ্বন্দগুলিকে অনুভব করে। সুতরাং নাটকের থিমটা যদি আজ লে-অফ, সাব-প্রাইম ক্রাইসিস নিয়ে হত-যেখানে ওয়াল স্ট্রীটের ফ্যাইনান্সিয়াল জিনিয়াসরা হচ্ছে আজকের কংস মামা -যাদের জন্যে প্রবাসী বাঙালীদেরও সারাজীবন একটা অস্থিরতা অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়-তাহলে, অবশ্যেই কুশীলবদের প্রশ্ন দর্শকদের ভাবাত। সেসব না করে কংস-হিটলার-অত্যাচারী-স্বৈরাচারী ইত্যাদি তাত্ত্বিক ভুতের ডায়ালোগ ছুড়ে বা অদ্ভুত অঙ্গিভংগী করে ( জেস্টাস -এপিক থিয়েটারের আরেকটি টেকনিক) লোক হাঁসানো যায়-এপিক থিয়েটার ও হয়-কিন্ত এপিক থিয়েটারের আসল উদ্দেশ্য-দর্শককে ভাবিয়ে তোলা, তা কিন্ত সর্বত ভাবে ব্যার্থ হচ্ছে।

এছাড়া কিছু টেকনিক্যাল স্ন্যাগ আমার কাছে অগ্রহনযোগ্য।

প্রথমত রাধা এবং তস্য নায়িকাদের বয়স ষাটের কাছাকাছি। ব্রেখটের নাটকে স্টেজ, আলো, পোষাক পার্ফেক্ট হতে হবে বা নায়িকা রাধিকাকে অষ্টাদশী হতে হবে তার কোন মানে নেই। বরং দর্শক কনসাসলি বুঝবে একটা নাটক চলছে-সেটাই ব্রেখট চাইতেন ফোর্থ ওয়াল ভাংতে। কিন্ত ষাট বছর বয়সের ভদ্রমহিলা যদি স্টেজে অষ্টাদশী তরুনীর রোল করতে চান ( চাইতে দোষ নেই) তাহলে ত তাকে গলার টোন, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ , লাস্যময়তা, মেক-আপ ঠিক করতে হবে। রাধিকার মুখঅয়বয়ে ভাবের কোন পরিবর্তনই লক্ষিত হল না-আর এদিকে ক্রমাগত সে সমাজ সংস্কারের কথা তোতাকাহিনীর মতন বলে চলেছে। রাধিকার রোলে নাটকটি সম্পূর্ণ ব্যার্থ হয়েছে।

কংসের অভিণয় বেশ ভাল লাগল। সাডেন চেঞ্জগুলো বেশ সার্থক। অধিকারীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক ছিল-কিন্ত গলার স্বরে কোন মড্যুলেশন ডেপথ নেই। ওটা না থাকলে অধিকারী মানায় না। বাকী সবার ভয়েস মনোস্কেলে। মড্যুলেশন ব্যারিটনে এরা বোধ হয় বিশ্বাস করেন না। সমস্যা হচ্ছে ব্রেখটের নাটকে কুশীলবরা যদি এমন গলায় কথা বলেন যে তাতে মনে হয়, ভাষা এবং বাক্যটি তার নিজস্ব না-তাহলে এলিনিয়েশন বা দ্বন্দের সেখানেই সলিল সমাধি। কেও কেও এটা ঠিকই করেছেন-কেও কেও পারেন নি। ফলে অভিনয়ের ক্ষেত্রে ভালোই ডিসপ্যারিটি পরিলক্ষিত হয়।

যাইহোক রাধিকার অভিনয় ছাড়া বাকি নাটক বসে দেখা যায়। উপভোগ্যও বটে।
ভিডিওটা এই লিংকে দিলাম।

Sunday, November 8, 2009

প্রবন্ধ সংকলন (২০০৫-২০০৭) বার করলাম

[ ২০৬ টি প্রবন্ধের সংকলন যা ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে লিখে ছিলাম-এই লিংকে প্রকাশ করলাম]

চোখের সামনে প্রকাশনার বিবর্তন যত দ্রুত ঘটছে- আমি মাঝে মাঝে নিজেই ভাবি দশ বছর বাদে ভবিষ্যত কি? মনে মনে লিখতে হবে না ত?

২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসে একটা ছোট গল্প লিখে মুক্তমনা তথা বাংলা ওয়েবে খাতা খুলেছিলাম। তখন ব্লগ ছিল না। পিডিএফ করে সার্ভারে পুরে অভিজিত মুক্তমনায় আর কুদ্দুস খান ভিন্নমতে প্রকাশ করতেন। অভিজিতের উৎসাহেই বাংলায় লেখার চেষ্টা শুরু করি। '৯৫ সালে শেষ বাংলা লিখেছিলাম-তারপর ২০০৫ সালে এসে বাংলায় দুটো বাক্য ঠিক ঠাক লিখতে পারব-সেটাই ভাবতে পারতাম না। অভিজিত সেই সব অজস্র বাংলা বানান ভুলে ভরা লেখা ছাপিয়ে আমাকে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে গেছে। অভিজিত মুক্তমনা প্রকাশনাটা না চালিয়ে গেলে, আমার বাংলায় লেখা লেখি কোন কালেই সম্ভব হত না। আমার মতন আরো অনেক বাঙালী লেখকই অভিজিতের কাছে এই ব্যাপারে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।

মৌলবাদের বিরুদ্ধেই মূলত লিখে গেছি এই সময়। আসলে এই সময়টা বাংলাদেশে বি এন পির সময়কাল এবং ইসলামিক মৌলবাদ তার সহস্রফণায় আমাদের ভীত করে তুলেছিল। পাশাপাশি গুজরাটের দাঙ্গার টাটকা ঘা তখনও দগদগে। ফলে ধর্মীয় মৌলবাদ বিরোধি লেখাই এই সময়টাতে অনেক বেশী লিখেছি। সেটাই ছিল সময়ের দাবী। তবে আমি বরাবরই সমাজ এবং নৃতত্ব বিজ্ঞান দিয়েই ধর্মকে বোঝার চেষ্টা করে আসছি। এছারাও এই সংকলনে অনেক নারীবাদি প্রবন্ধ আছে। আসলে আমার কাছে ধর্মটা মূলত পুরুষতন্ত্রের ম্যালাডিস হিসাবেই প্রতিভাত। তাই এতগুলি নারীবাদি লেখা বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে এসে গেছে। তবে যাদের যৌনতা নিয়ে শুচিবাই আছে, তারা নারীবাদি লেখাগুলো না পড়লেই ভাল করবেন কেন না তা আপনাদের রক্ষনশীল মনোভাবে ভীষন ভাবেই আঘাত করতে পারে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশেষ করে, মার্কিন সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা সিরিজ লিখছিলাম। ১১টা কিস্তি লিখে আর শেষ করি নি। আমি ইরান, ইস্রায়েল, আমেরিকা-আসলে এদের কাওকেই পছন্দ করি না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে, বেশ কিছু ভুল করেছি আগে। মুম্বাই এর ২০০৬ সালের বিষ্ফোরনের পরে আমার মনে হয়েছিল যেহেতু বি এন পি সন্ত্রাসবাদি পুষছে ( যা এখন খুব ভাল ভাবেই প্রমাণিত) , সেহেতু ভারত সরকারের উচিত সন্ত্রাসবাদি ক্যাম্পগুলোতে ইস্রায়েলের স্টাইলে বোমা বর্ষন করা । এই নিয়ে ফরিদ ভাই এর সাথে বাদ-বিতন্ডাও হয়েছে। আমার এই বিশ্লেষনে ভুল ছিল। এই জন্যে নয়, যে আমি কোন দেশের সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করি। কারন আমার ধারনা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অতি দ্রুতই বিলুপ্ত হবে । তাই উত্তর আধুনিকতার প্রতিনিধি হিসাবে জাতিয়তাবাদ পরিহার করে চলার পথপ্রদর্শক আমাদেরই হওয়া উচিত। আমার আসলে ভুলটা হয়েছিল এই জন্যে যে গণতান্ত্রিক সরকারের নেপথ্যের কুশীলবদের চিনতাম না তখন। পরবর্তীকালে আমি সখের সাংবাদিকতা শুরু করি ( আমি লস এঞ্জেলেস প্রেসক্লাবে কার্ডধারী জার্নালিস্টও হয়েছি) । সরকার, মিডীয়া এবং ব্যাবসায়ীদের মধ্যে নেক্সাস, যা আমাদের সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে, সেটা বেশ ভাল ভাবে টের পেতেই অনেক ভুল ভেঙে গেছে। ফলে দিল্লী এবং ওয়াশিংটনে আসল খিলাড়িদের জানার পরে, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হই যে মেইন স্ট্রীম মিডিয়া সবদেশেই যেভাবে ঘটনাটা খাওয়ানোর চেষ্টা করে-তা একধরনের আই ওয়াশ। সব রাজনীতিই আসলে পুতুল নাচের ইতিকথা। পুতুলই আমরা দেখি-সুতো আর খেলোয়াড় আমাদের চোখে পড়ে না। তাই বি এন পির কিছু নেতার জন্যে আমার উগ্র জাতিয়তাবাদি অবস্থান নেওয়া বেশ ভুল ছিল। ভুলের মধ্যে দিয়েই আমরা শিখি-এবং এই শেখাটাই উত্তোরনের একমাত্র পথ। তবে ভুল ঠিক-সব লেখাই দিলাম।

এখন বাংলা লেখা আরো সহজ হয়ে গেছে, অভ্র ফন্ট আসার পর। নিজের ব্লগে লিখে সোস্যাল নেট ওয়ার্কিং ফোরাম গুলোতে ছেড়ে দিলেই কাজ শেষ। ইনফর্মেটিভ লেখা আমি লিখি না-কারন আমার ধারনা লোকে গুগুল করে সব ইনফর্মেশন জোগার করতে পারে। এবং সেটাই হবে ভবিষ্যতে তথ্য সংগ্রহের মডেল। তাই তথ্য শুধু বিশ্লেষনের জন্যেই ব্যাবহার করা উচিত। ব্যাক্তিগত উপলদ্ধি এবং অনুভুতির জগতটাকে আমরা আজ সোস্যাল মিডিয়ার জন্যে যত ভাল ভাবে জানছি-তা আগে সম্ভব ছিল না। স্যোশাল মিডিয়া থেকে যে সামাজিক উপলদ্ধি তৈরী হচ্ছে-আইডিয়া গুলোর একটা ডারুইনিয়ান প্রসেসে ছড়িয়ে যাচ্ছে-এটা ভবিষ্যতের প্রকাশনা এবং জ্ঞান বৃদ্ধির মডেল। তাই আমার ধারনা স্যোশাল মিডিয়াতে সম্পাদকরা মেম্বারদের ব্যাক্তিগত উপলদ্ধির জগতটা নিয়ে বলতে বাধা সৃষ্টি না করলেই ভাল হয়। তথ্য আমরা অনেক ওয়েব সোর্স থেকেই জানতে পারব-কিন্ত ব্যাক্তিগত উপলদ্ধি জানার জন্যে স্যোশাল মিডিয়ার বিকল্প নেই। আমার লেখাগুলো মূলত সেই উপলদ্ধির জগৎ থেকেই উঠে আসা। এটা ঠিক না বেঠিক স্টাইল আমি জানি না-তবে তথ্যভারাক্লান্ত লেখাতে আমার বেশ অনীহা। যাইহোক মোটামুটি ৮০% লেখা আমি উদ্ধার করতে পেরেছি ওই তিন বছরের। বানান ঠিক করতে পারলাম না-কারন প্রায় সবটাই বর্নসফটে লেখা, আর বর্নসফটের লাইসেন্স আমার কবে হারিয়ে গেছে! ফলে সেই পিডিফ যা ছিল তাই ভরসা!

পাঠক আমার পল্লবগ্রাহীতা নিজগুনে ক্ষমা করবেন আশা করি। লিংকের পেজটির বাম দিকের নীচে নানান টপিকে ভাগ করে লেখাগুলি ফেলা আছে। সেখান থেকে আপনারা বিষয় অনুসারে লেখা ব্রাউজ করতে পারবেন।

Sunday, October 18, 2009

বাঙালী সমাজতন্ত্রীদের ব্যার্থতার কারন অনুসন্ধান


আমি এই ব্লগে আজ যা লিখব-যাদের জন্যে লিখব, তাদের অনেকেই এখন হয়ত বুঝবে না। হয়ত তাদের সারাটা ব্যার্থজীবনে ও বুঝে উঠবে না। তবুও যদি, এই লেখা তাদের মনে নতুন দিশার জন্ম দিতে পারে-মানসিক অন্ধকারে একটুও ফুটে ওঠে আলো-আমি বাধিত হব।

A.

বাঙালী কবে থেকে বামপন্থী? আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটো পর্ব। প্রথমে জাতিয়তবাদি বিপ্লবী যেমন ক্ষুদিরামরা ছিলেন ধর্মীয় জাতিয়তাবাদি। গীতা হাতে দেশ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। সেটা ছিল এক অর্থে ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলন। তবে আল-কায়দার পরিচালিত ইসলামিক প্রতিবাদি আন্দোলনের সাথে
আমাদের ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলনের সব থেকে বড় পার্থক্য হচ্ছে-আন্দোলনটা বৃটিশদের তাড়াবার জন্যে হলেও, বিপ্লবীরা বৃটিশ ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যাবস্থা এবং সমাজেই আ রাখতেন বেশী। সনাতন হিন্দু সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে, তারা বিপ্লবী হন নি। আল-কায়দা পুরো উলটো। তারা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধেই শুধু যুদ্ধ করে না-পাশ্চাত্য সমাজব্যাবস্থার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে।

এটা চলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। ১৯২০ সাল থেকেই মানবেন্দ্র রায় বা চাচা মুজফরের চেষ্টায়, বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ এবং আদর্শ ভারতেও এল। এরা প্রথম জীবনে সবাই ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলনেরই শরিক ছিলেন। মূলত জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন হিসাবে কৃষক-প্রজা পার্টি এবং ভারতীয় কমিনিউস্ট পার্টির জন্মের মধ্যে দিয়ে বাঙালীর বামপন্থী হওয়া শুরু।

এর পরে ১৯৭০-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত র‌্যাডিক্যাল কমিনিউস্টরা দুই বাংলা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। পেটের তীব্র ক্ষুদায় পশ্চিম বঙ্গে যেমন নক্সল পন্থীরা তেমনই বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দাবিদার কর্নেল তাহেরের দলবল রাষ্ট্র যন্ত্রকে ভীষন ভাবেই চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে। কিন্ত পেটের ক্ষিদের সাথে রোম্যান্টিসিজম মেশানো এই অর্ধ-বিপ্লবীদের সব চেষ্টা ব্যার্থ হয়। মিলিটারি শাসনে বাংলাদেশ থেকে কমিনিউজম প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে থাকে এবং ৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর ১৯৯৩ সালে কমিনিউস্ট পার্টি অব বাংলাদেশে সব থেকে বড় ভাঙন আসে। এবং বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনে সিপিবি ( কমিনিউস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ ) একটিও আসন পায় নি।
পশ্চিম বঙ্গের ইতিহাস একটু উলটো। এখানে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে সিপিএম লোককে সমাজতান্ত্রিক রিলিফ দেওয়ার কথা ঘোষনা করে। ১৯৭৭-১৯৮২ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের রাজত্বকালে ব্যাপক ভাবে পশ্চিম বঙ্গে ভূমি সংস্কার আন্দোলন হয়। রায়তরা জমির ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। কিন্ত একই সাথে দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন শ্রমিক আন্দোলনের ফলে পশ্চিম বঙ্গ থেকে সব শিল্প গোটাতে থাকে। ১৯৮৫ সালের মধ্যেই পশ্চিম বঙ্গে অবস্থিত ভারতের সর্বাধিক সমৃদ্ধ শিল্পাঞ্চল গুলি-যেমন হাওড়া বা দুর্গাপূর শিল্প নগরীর পরিবর্ত্তে শিল্প-শ্বশান নগরীতে পরিণত। হাওড়া-ব্যন্ডেল এবং কৃষ্ণনগর শিয়ালদহ-দুই লাইনেই আমার ছোটবেলা থেকে যাতায়াত- ট্রেন লাইনের দুধারে শুধু কারখানার কঙ্কাল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ত না। ফলে ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলি যেমন সাংঘাতিক ভাবে এগিয়ে যায়, পশ্চিম বঙ্গ বামফ্রন্ট শাসনে ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়ে। ১৯৭৭ সালে গুজরাতিদের গড় ইনকাম ছিল বঙ্গবাসীদের মোটে ৩০% বেশী-মহারাষ্ট্র এবং গোয়া বাদ দিয়ে তখন বাকী রাজ্যগুলি মাথাপিছু ইনকামে পশ্চিম বঙ্গের পেছনেই ছিল। বর্তমানে গুজরাতিদের মাথাপিছু গড় উপায় বাঙালীদের থেকে ২৫০% বেশী। গুরগাঁও বা হায়দ্রাবাদে গেলে মনে হয়, কোলকাতা তৃতীয় বিশ্বের আর দিল্লী বা হায়দ্রাবাদ প্রথম বিশ্বের শহর।
B.
যাইহোক বামফ্রন্ট সরকারের ব্যার্থতা নিয়ে লিখতে বসি নি। এসব তথ্য বা বিতর্ক সবই সবার জানা। মূল ব্যাপার হল, দীর্ঘ ৩২ বছর রাজত্বের পর, সিপিম সরকার নিশ্চিত ভাবেই পশ্চিম বঙ্গ থেকে বিদায়ের মূখে। বিগত লোকসভা নির্বাচন এবং তার পরবর্ত্তী সমস্ত স্থানীয় নির্বাচনে তারা গোহারা হারছে। সাথে সাথে পশ্চিম বঙ্গের কমিনিউস্ট আন্দোলনের একটি দীর্ঘ অধ্যায় ও শেষ হতে চলেছে। আমার ধারনা ২০১১ সালের পর পশ্চিম বঙ্গে সিপিমকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে-সেমন করে এখন নক্সাল দলগুলিকে খুঁজতে হয়। সিপিএমের অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের জনবিক্ষোভ এতই তীব্র, ২০১১ সালের হারে পর যখন পুলিশ বাহিনী নিজেদের অধিকারে থাকবে না, তখন পার্টিটা আদৌ টিকবে কি না আমার সন্দেহ আছে। রুমানিয়াতে চেসেস্কুর পতনের পর, সাধারন মানুষ যেমন স্থানীয় অত্যাচারী কমিনিউস্ট নেতাদের ধরে ধরে পিটিয়েছিল-পশ্চিম বঙ্গের পরিস্থিতি ঠিক একই ধরনের অগ্নিগর্ভ।

যাকগে স্পেকুলেশন আমার কাজ না। সেটা নিয়ে লিখছিও না। মূল কথাটা হল, বাঙালীরা ছিল দক্ষিন এশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সব থেকে বড় ধারক এবং বাহক। সেই ইতিহাস আজ সমাপ্তির পথে। নক্সাল দলগুলির অজস্র দল-উপদল। সিপিএম শেষ। কমিনিউস্টদের আজ সম্পূর্ন ভাবেই সাধারন বাঙালী বর্জন করেছে।

এর মানেত এই নয়-মুক্তবাজার অর্থনীতিই আমাদের আলো দেখাবে? এনরন, ওয়ার্ল্ড কম, সত্যম কেলেঙ্কারীর পরে, আমরা সবাই জানি-মুক্তবাজার অর্থনীতি আসলেই চোর-ডাকাতদের আখরা যাদের মুখে সি ই ওর মুখোশ। ধনতন্ত্রের কলে মানুষের যন্ত্রনা আগেও যা ছিল-আজও তাই আছে। পৃথিবীর সব দেশেই গণতন্ত্রটা ঠিকাদারতন্ত্র। কিছু ব্যাবসায়ী আসল রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দখল করে সাধারন মানুষকে ঠকাচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গের অবস্থা এমনই করুন, সেই ঠকানোকে জনগন মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে কারন, উলটো দিকের অত্যাচারি সিপিএম দানবকুলের হাতে করা আর হাজতবাস করা সমার্থক হয়ে উঠেছিল। সিপিএম জেলরদের কাছে হাজতবাস করার থেকে ব্যাবসায়ীদের হাতে ঠকা ভাল, এই বাস্তব বাঙালী আজকে মানছে। না মেনে উপায় নেই। আমাদের আজ এতটাই দুর্দিন।

C.

তাহলে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় ভুলটা কোথায় যদি ধনতন্ত্রে মানুষের সমস্যাগুলোর সমাধানের বদলে, সেগুলো বেড়েই চলে?

আসলে সমস্যা হচ্ছে-সভ্যতার আদি থেকেই সমাজতান্ত্রিক চিন্তা চলে আসছে ( এটি পড়তে পারেন)। কার্ল মাক্স সেগুলোকে আদর্শবাদি ভাবধারা বললেন- কিন্ত বাস্তব হচ্ছে, তিনি নিজেও যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ওপর ভিত্তি করে সমাজতান্ত্রিক বিবর্তনের ছবি আঁকলেন, তাও সেই আদর্শবাদই হইল। বস্তুবাদ কথাটি মার্ক্সীয় তত্ত্বে হাজার বার আসে বটে-কিন্ত বস্তবাদের দর্শন আরেকটু গভীরে পড়লে বোঝা যাবে, মার্ক্সীয় দর্শন-যা অভিজ্ঞতাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত-তা বাস্তববাদের ( রিয়ালিজম) সাথে সীমা রেখাটানার কাজে নিতান্তই দুর্বল। তাও দান্দিকতা বা ডায়ালেক্টিজম দিয়ে, বাস্তবতার অনেক কাছাকাছি আসা যায়। সেটাই দ্বান্দিকতার কাজ-কিন্ত পরবর্ত্তী কালে বৈপ্লবিক মার্ক্সিস্ট ই হোন ( যেমন লেনিন) বা গনতান্ত্রিক মার্ক্সবাদিই হোন ( বার্নস্টাইন বা কাউটস্কি) , বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে দ্বান্দিকতাকে বর্জন করে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ফ্রেম ওয়ার্কের ওপর সমস্ত ফোকাস ঘুরিয়ে দেন। ব্যাস এই লেনিনজমে এসে মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধার সম্পূর্ণ ভাবেই বৈদিক সমাজতন্ত্র বা ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মতন আরেকটি ধর্মীয় প্রতিবাদি আন্দোলনের রূপ নেয়। ফলে বিংশ শতাব্দির শুরু থেকেই মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা সম্পূর্ন ভাবে সমাজবিজ্ঞান বা নৃতত্ব বিজ্ঞান থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। আমি মার্ক্সীয় তত্ত্বের কতগুলি মূল ধারনার বিশ্লেষন করে উদাহরন দিচ্ছিঃ
D.
(1) শোষন এবং উৎপাদন ব্যাবস্থাঃ
শোষন কথাটি উদবৃত্ত মূল্য এবং উদবৃত্ত শ্রমের সাথে সংযুক্ত। ধরা যাখ খগেন বাবু মালিক। উনার শ্রমিক ক টাকা শ্রম নিয়ে একটি বস্ত্র উৎপাদন করল। উনি খ টাকায় বেচে দিলেন। গ টাকা লাভ হল। এটা উদবৃত্ত মূল্য এবং এই লাভটা শ্রমিককে শোষন করা টাকা।

প্রশ্ন হচ্ছে চায়ের দোকানের দীপুকে ত এই ভাবেই শোষন করা হয়। কিন্ত তাও, ওপরের মডেলটা অতি সরলীকরন। কারন
১) খগেন বাবু নিজেই শ্রমিক এবং মালিক হতে পারেন। সম্পূর্ণ পারিবারিক উৎপাদন ব্যাবস্থা হতে পারে। এদের মার্ক্স পেটি বুর্জোয়া বলতেন-এবং এদের অবলুপ্তি হবে-এমন ঘোষনাও দিয়েছিলেন। বাস্তবে হয়েছে উলটো।
২) লোকসান ও করতে পারেন। রিস্ক নিচ্ছেন-তার জন্যে একটা গ্যাম্বলিং মূল্যও তার পাওনা।
৩) মার্কেটিং সেলস করতে তাকেও পরিশ্রম করতে হয়। এই গ টাকা লাভটা, তার পারিশ্রমিক হিসাবেও ভাবা যেতে পারে।
৪) গ লাভের টাকাটা শ্রমিকদের মধ্যে বিতরন করা হয় পাবলিক কোম্পানীতে বোনাস হিসাবে
(৫) বর্তমানের পাবলিক কোম্পানীগুলিয়ে মালিক ব শেয়ার হোল্ডার মোটেও প্রফিট থেকে লাভ করে না। প্রফিট সেখানে কর্মীরাই পায়। শেয়ার হোল্ডাররা লাভ করে স্পেকুলেটিভ ভ্যালুয়েশন থেকে। যেমন জেনেনটেকের মতন কোম্পানীগুলি কোন কোয়াটারে কত লাভ করছে, তার থেকেও বেশী গুরত্ব দিচ্ছে, নতুন কি ওষুধ আবিস্কার করল তার ঊপরে। কোম্পানীর ভবিষ্যত ভ্যালুয়েশন সেখানেই।

আরো অনেক কিছুই এই মডেলের বিরুদ্ধে যেতে পারে। সেটা বড় কথা না-যেটা এখানে দ্রষ্টব্য সেটা হচ্ছে কি মার্ক্সীয় শোষন মডেল বা ১-৫ , তার এন্টি থিসিস যা যা বল্লাম, এর কোনটাই সার্বজনীন না। কখনো খাটবে, কখনো খাটবে না।

তাহলে কি 'শোষনের' সামাজিক সুত্র ( Social Law) বার করা সম্ভব? বিজ্ঞানে সুত্র কি করে বার করে?

অভিজ্ঞতাবাদ বা এম্পিরিসিজম কিছু সামাজিক সুত্র গঠনের ওপর নির্ভর করে। মার্ক্সিজিম ও যেহেতু এম্পিরিসিজম সেহেতু মার্ক্সিয় তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রথমেই যে প্রশ্ন উঠবে-আমাদের এই জটিল সমাজ ব্যাবস্থার মধ্যে সামাজিক সুত্র বার করা সম্ভব কি না? এর বাস্তব তাৎপর্য্য পশ্চিম বঙ্গে যা দেখেছি তা সাংঘাতিক।

একটা চেনা ঘটনা বলি। মেদিনীপুরের পাঁশকুড়াতে একটি চালকল ছিল। ১৫ জন শ্রমিক কাজ করত। মালিক এক স্কুল মাস্টার। এমনিতেই চালকলে লাভ খুব কম। বাপের তৈরী কল বলে উক্ত মাস্টারমশাই টি অনেক কষ্ট করে চালাতেন। কখনো সখনো নিজের পকেট থেকেই চালাতেন। হ ঠাৎ করে পুজোর মাসে বোনাসের দাবীতে সেই চালকল বন্ধ হল। পেছনে ছিল সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু। এই ঘটনা পশ্চিম বঙ্গে হাজারে হাজারে ঘটেছে আর আমাদের রাজ্যে শক্ত সামর্থ ছেলেরা ভারতের অন্য রাজ্যে গিয়ে করে খাচ্ছে। আমি এই বছরই কিছু গ্রামে ঘুরলাম। যেখানে ঘরের পর ঘরে পুরুষ নেই। সবাই অন্যরাজ্যে চলে গেছে। পুজ়ো বা ঈদের সময় বছরে একবার আসবে।

শোষনের তত্ত্ব কি এখানে খাটে না? শোষনকে সামাজিক সূত্র হিসাবে ধরলে নিশ্চয় খাটে। কিন্ত বাস্তবতা কি তাই? সামাজিক সুত্র দিয়ে কি এখানে বাস্তবতা (রিয়ালিটি) কে ধরা গেল?

আসলেই অভিজ্ঞতা বা ইতিহাসের ভিত্তিতে সামাজিক সুত্র তৈরী করা খুবই কঠিন কাজ। এবং ইতিহাস বা সামাজিক ঘটনাবলীর মধ্যে আদৌ কোন সূত্র লুকিয়ে আছে কি না ( স্ট্রাকচারালিজম) - বা যদিও বা থাকে, তা বর্তমান বা ভাবীকালে, বা সব দেশের সব সমাজে প্রযোজ্য হবে কি না তা আরো শক্ত ঠাঁই।

আমি পেশাদারি জীবনে নানান রকমের গণিতিক এম্পিরিক্যাল মডেলিং করি। আমার কাজ তাও প্রকৃতি বিজ্ঞানের ওপর যেখানে ফোটন ইলেক্ট্রনরা প্রাকৃতিক সুত্র মেনে চলে। তা সত্ত্বেও, অধিকাংশ জটিল সিস্টেমের ক্ষেত্রে কখনো সখনো ২০-৩০টা গণিতিক মডেল ফিট করার পরে, শেষ মেশ কোনক্রমে একটি মডেল দাড়ায় যা একটি নির্দিষ্ট লিমিটের মধ্যে খাটে। এমন নয় যে ওই ২০-৩০ মডেল যা বাতিল করতে হল, তার কোন বেসিস নেই। প্রতিটি মডেলই অতীতের পর্যবেক্ষন এবং যুক্তির ওপরে দাঁড় করিয়ে বানানো হয়। তাতেও দেখেছি সিস্টেমে যখন র‌্যান্ডমনেস বা বিশৃঙ্খলা আসে, যা মানব সমাজের ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রেন বা ফোটনের চেয়ে আরো বেশী প্রযোজ্য, তখন সাংঘাতিক যুক্তি এবং সঠিক পর্যবেক্ষনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মডেলও কাজ করে না। কারন, যেখানে স্ট্রাকচার নেই, সেখানোত জোর করে স্ট্রাকচার বা প্যাটার্ন ঢোকানো যায় না। যেখানে সামাজিক সুত্র তৈরী করা যায় না-সেখানে জোর করে সামাজিক সূত্র তৈরী করতে গেলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে হয়। অথচ যাবতীয় মার্ক্সিস্ট তত্ত্বই এই অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে যে মার্ক্সের তৈরী সামাজিক সুত্রগুলি ইতিহাসের ধারায় বা সমাজে প্রতিভাত হয়। কিন্ত বাস্তব হচ্ছে, তা কখনো হয়, কখনো হয় না। আসলেই কোন সার্বজনীন সামাজিক সূত্রের অস্তিত্ব নেই। মানব সমাজের মতন বিশৃঙ্খল সিস্টেম সূত্র মেনে চলতেই পারে-কিন্ত সেখানে সার্বজনীনতা বা ইন্ডাকশনিজম চলে না। মার্ক্সীয় তত্ত্বের বাকী পিলারগুলি কেও আমরা এই রিয়ালিজম বনাম এম্পিরিসিজমের সমস্যা থেকেই বিশ্লেষন করতে পারি।
E
বেস এন্ড সুপার স্ট্রাকচারঃ
রাজনৈতিক এবং সামাজিক সিস্টেম কিভাবে তৈরী হয়? মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কই বা কি ভাবে গঠিত হয়? মার্ক্সীয় তত্ত্বে তা সম্পূর্ণ ভাবেই উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। বেস মানে হল উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্ক। এবং এই বেসের ওপর ভিত্তি করেই সামাজিক বা রাজনৈতিক (রাষ্ট্রীয়) গঠনের সুত্রপাত।

"In the social production of their existence, men inevitably enter Into definite relations, which are independent of their will, namely [the] relations of production appropriate to a given stage in the development of their material forces of production. The totality of these relations of production constitutes the economic structure of society, the real foundation, on which arises a legal and political superstructure, and to which correspond definite forms of consciousness. The mode of production of material life conditions the general process of social, political, and intellectual life. It is not the consciousness of men that determines their existence, but their social existence that determines their consciousness. At a certain stage of development, the material productive forces of society come into conflict with the existing relations of production or — this merely expresses the same thing in legal terms — with the property relations within the framework of which they have operated hitherto. From forms of development of the productive forces, these relations turn into their fetters. Then begins an era of social revolution. The changes in the economic foundation lead, sooner or later, to the transformation of the whole, immense, superstructure. In studying such transformations, it is always necessary to distinguish between the material transformation of the economic conditions of production, which can be determined with the precision of natural science, and the legal, political, religious, artistic, or philosophic — in short, ideological forms in which men become conscious of this conflict and fight it out. Just as one does not judge an individual by what he thinks about himself, so one cannot judge such a period of transformation by its consciousness, but, on the contrary, this consciousness must be explained from the contradictions of material life, from the conflict existing between the social forces of production and the relations of production"-A Contribution to the Critique of Political Economy (1859):

অর্থাৎ মার্ক্স ধরেই নিলেন, উৎপাদনের সাথে মানুষের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক সূত্রবালি তৈরী করা যায়। উৎপাদন ব্যাবস্থার সাথে মানুষের সম্পর্কর ওপর সামাজিক সিস্টেম নির্নিত হয় এটা কিছুটা সত্য ত বটেই-কিন্ত সমস্যা হচ্ছে সেই সত্য সার্বজনীন কি না! একজন বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হলেত মা তাকে ফেলে দেয় না-বরং বেশী ভালোবাসা দিয়ে থাকে! অথবা মাতৃভাষার প্রতি অবুঝ ভালোবাসা কি এই সুপার স্ট্রাকচার দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়?
আসলে সংস্কৃতি এবং সামাজিক আইনগুলি -তথা মানুষের মধ্যে পারিস্পারিক সম্পর্কের উৎপত্তি নিয়ে সমাজবিজ্ঞান, গণিত, বায়োলজি এবং নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানে গত পাঁচ দশক ধরে ব্যাপক গবেষনা হয়েছে। একটা বিশৃঙ্খালিত মানব সম্পর্ক থেকে কিভাবে সামাজিক আইনের জন্ম হতে পারে না নিয়ে ব্যাপক গণিতিক এবং জেনেটিক্সের গবেষনা মানব ও প্রকৃতি ও সংস্কৃতির উদ্ভব নিয়ে আমাদের ধারনাকে আমূল বদলে দিয়েছে। এর কোন কিছুই মার্ক্সীয় তত্ত্বে ঢোকে নি বা মার্ক্সীস্টরা বোঝার চেষ্টাও করেন নি কি দ্রুতহারে মানব প্রকৃতি এবং সমাজবিজ্ঞান জেনেটিক্স নির্ভর হয়ে উঠেছে-তা আর আর কোনভাবেই শুধু উৎপাদনের সুত্র বা বেস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।
বেস এবং সুপার স্ট্রাকচারের মূল অনুমান ভিত্তি হচ্ছে মানুষের ব্যাবহারিক প্রকৃতির ওপর কোন জন্মনির্ধারিত রেস্ট্রিকশন নেই। অর্থাৎ জীনের ফেনোটাইপ না, পরিবেশই মানুষকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন করে । বেস এবং সুপারস্ট্রাকচারের ভিত্তিভুমি হচ্ছে এই পরিবেশ নির্ভর মানুষের ধারনা।

কিন্ত এই ধারনা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। তাই বার্নাড থিয়েরী মানুষের সামাজিক প্রকৃতির জ়ৈব কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলেছেনঃ
(Adaptation and self-organization in primate societies.(Genes and Humanity's Past: A Renewed Dialogue)
" Even if we admit that behavior is more sensible to environmental variations than morphology, it is a phenotype and, as such, subject to internal constraints" . Behavior is not infinitely flexible; we must admit that the epigenetic systems of transformation confine it to a limited number of possible solutions."

কিন্ত হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে মার্ক্সিস্টরা সেই গত একশো বছর ধরেই বিজ্ঞান থেকে সরে গিয়ে বেস-সুপারস্ট্রাকচারের ন্যায় অপবিজ্ঞান এবং অপদর্শনের চর্চা করে চলেছেন। লুই পিয়েরী আলথুজার নামে এক ফরাসী মার্ক্সিস্ট দার্শনিক নিয়ে অনেক মার্ক্সিস্টরা মাতামাতি করেন-তিনি মার্ক্সিজমে স্ট্রাকচারালিজম নিয়ে 'অনেক' কাজ করেছেন। কিন্ত তার লেখা বা চিন্তায় আধুনিক বিশৃঙ্খল বিজ্ঞান বা জেনেটিক্স বিজ্ঞান কিভাবে মানব ও সামাজিক প্রকৃতিগুলিকে বোঝার চেষ্টা করেছে-তার কোনকিছুই পাওয়া যাবে না। ফলে মার্ক্সিস্ট মহলে তিনি কেঊকেটা হলেও, বাস্তবে তার চিন্তাধারাও সম্পূর্নভাবে আধুনিক বিজ্ঞান বিরোধি অপদর্শনের জন্ম দিয়েছে। এরা হচ্ছে মার্ক্সিজমের জাকির নায়েক। জাকির নায়েককে নিয়ে যেমন ধর্মপ্রান মুসলিমরা নাচানাচি করে, ঠিক তেমনই আলথুজারের ন্যায় অপদার্শনিকদের নিয়ে মার্ক্সিস্টরা লাফা-লাফি করে। উভয় ক্ষেত্রেই কারন আধুনিক সমাজ এবং জ়ৈববিজ্ঞানে এদের নিদারুন অন্ধত্ব। হিন্দুত্ববাদি, ইসলামিস্ট বা মার্ক্সিস্টদের মধ্যে আমি বর্তমানে কোন পার্থক্যই দেখতে পাই না। কারন এই শ্রেনীর লোক হওয়ার একটাই যোগ্যতা-বিজ্ঞান এবং দর্শনে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা।

F.

শ্রেনীতত্ত্ব-আরেকটি ধাপ্পাবাজি-

উৎপাদন ব্যাবস্থার ভিত্তিতে মানব সমাজকে ভাঙতে গিয়ে এখানেও মার্ক্স সামাজিক সূত্রের জন্ম দিয়েছেন-যা বাকী মার্ক্সিস্ট তত্ত্বের ন্যায় অর্ধসত্য-যা কোথাও খাটে, কোথাও খাটে না। প্রলেতারিয়েত, বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া ইত্যাদি শব্দগুলির সবই সেই ধোঁয়াশা মার্কা ডায়ালোগ। মার্ক্সীয় সূত্র এবং সংজ্ঞা ধরে এগোতে গেলে চায়ের দোকানের দিন আনা দিন খাওয়া মালিক হচ্ছে বুর্জোয়া আর বছরে কুড়ি লাখ টাকা মাইনে পাওয়া সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে প্রলেতারিয়েত! এমন নয় এসব সীমাবদ্ধতা মার্ক্সিস্টরা জানেন না। এর জন্যেও তারা তত্ত্ব্বের অনেক পরিবর্ত্তন ও করেছেন। কিন্ত তা বাস্তবে কুকুরের লেজ সোজা করা। কারন যেখানে ওই ধরনের শ্রেনীর অস্তিত্ব বা বিভাজন সম্ভব না, সেখানে হাজার হাজার তত্ত্ব এবং লেজুর তত্ত্বের প্রদুর্ভাব ঘটিয়েও বাস্তবকে ছোঁয়া যায় না। সবথেকে বড় কথা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে, উন্নতদেশগুলিতে প্রলেতারিয়েত বলে কেও থাকছে না ( রোবটদের যদি প্রলেতারিয়েত বলা যায় সে হবে অন্য কথা)। ২০০১ সালে ওয়ালমার্ট দেখতাম ৩০টা কাউন্টারে একটি বা দুটিতে অটোচেকআউট থাকত। শ্রমিক অনেক বেশী থাকত। এখন প্রায় সব কাউন্টারই অটোমেটিক হয়ে যাচ্ছে। জমি-বাড়ি-ম্যানুফাকচারিং-ট্রাভেল ইত্যাদিতে দালালির ব্যাবসা আমেরিকাতে আর হচ্ছে না-কারন এখন ইন্টারনেট ক্রেতার সাথে বিক্রেতার সরাসরি মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে। ক্ল্যারিকাল কাজও উঠে গেছে। ফলে চাকরি পেতে গেলে আজকাল স্কিলড লেবার হতেই হবে-হিউমান রিসোর্সে যে কাজ করে তাকেও স্যাপ বা ওরাকলের এইচ আর প্যাকেজ চালানো জানতে হয়।

প্রশ্ন উঠতেই পারে ভারতে মত দেশে যেখানে ৩০% লোক খেতে পাচ্ছে না-মেশিনের বদলে টি বয় চা দিচ্ছে-সেখানে এর রেলিভ্যান্স কি? সেখানেও কিন্ত আমরা দেখছি স্কিলড লেবার ছাড়া ভদ্র চাকরি বাকীরা পাচ্ছে না। কিন্ত আনস্কিল্ড লেবার বাড়লেও, আনস্কিলডদের জন্যে মার্কেট তাই বলে বাড়ছে না-কমছে। করণিকের চাকরি ভারতেও অবলুপ্তির মুখে। সোনা বা শাড়ির ডিজাইন একদম প্রত্যন্ত গ্রামীন শহরেও ইন্টারনেট থেকে কপি করেই হচ্ছে। এসব আমি ডকুমেন্টারী করতে গিয়েই দেখেছি। গ্রামীন কৃষিতে আনস্কিলড লেবারদের যে মার্কেটছিল, যন্ত্রায়নের ফলে, সেখানেও কাজ অনেক কমেছে। ১৯৭৭ সালে একজন আনস্কিল্ড লেবার পশ্চিম বঙ্গে বছরে ৭০-৯০ দিন কাজ পেত। আজকে তা ২০-৪০ দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাঙালী আনস্কিলড শ্রমিকদের সামনে পাঁচটি পথ-ভিক্ষুক হওয়া, আত্মহত্যা করা, অন্যরাজ্যে চাকরীর সন্ধানে গিয়ে স্কিলড লেবার হওয়া, চুরি-ডাকাতি-স্মাগলিং (লুম্পেন প্রলেতারিয়েত) বা মেয়েকে মুম্বাই এ বেশ্যাবৃত্তি করতে পাঠানো। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই পাঁচটি ঘটনাই সমান্তরাল ভাবে ঘটে চলেছে। মুম্বাইযে গোটা ভারত থেকে যে মেয়ে সাপ্লাই হয় তার ৪৫% বঙ্গবাসী বা বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ভাগ্যহীনা নারী। অত্থচ বাঙালী মধ্যবিত্ত নিজেদের ব্যার্থতা বিশ্লেষন না করে, হয় সাংস্কৃতি গর্বে মশগুল বা মাক্সীয় তত্ত্বের স্বেমহনে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে।

G.
যাইহোক যেটা আমার বক্তব্য সেটা হল, যন্ত্রের ফলে উদ্ভুত সামাজিক বিবর্তন থেকে প্রলেতারিয়েতদের ভারতেও বাঁচানো যাচ্ছে না। উন্নততর উৎপাদন ব্যাবস্থার বিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে, তারাও হারিয়ে যাচ্ছে-বিপ্লব হচ্ছে না। কারন শ্রেনী তত্ত্ব তাদের কাছে যতই সত্য লাগুক, পেটের আগুন না মেটালে তারাও বাধ্য হয় পশ্চিম বঙ্গ ছাড়তে। দিল্লীতে আমি এবার সপ্তাহ দুই ছিলাম। আমাদের অফিসে একটি কফি বয় ছিল বাঙালী। কফি খেতে গিয়ে একদিন দেখি সে কমরেড হিরেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের লেখা কিছু পড়ছে। আমি অবশ্য বেশী কিছু উৎসাহ দেখাই নি কথা বলার জন্যে। যাইহোক একদিন সে আমাকে বলে-আপনি ত বাঙালী? আমি বল্লাম হ্যাঁ। আমার খুব বেশী কথা বলার ইচ্ছা ছিল না-কারন এর আগেও দিল্লীর এশিয়াড ভিলেজে ওয়েটারের কাজ করা এস এফ আই এর প্রাত্তন নেতা দেখেছি যে শেষমেশ বাপের আশ্রয়টুকু যাওয়ার পর পশ্চিম বঙ্গে কিছু না করতে পেরে ওয়েটারের কাজ নিয়েছে। পশ্চিম বঙ্গে চাকরী না পাওয়ার পরে, মাস্টার ডিগ্রী নিয়ে ওয়েটার বা কফি বয়ের কাজ করতে করতে ও এরা বামপন্থার সীমাবদ্ধতা বুঝবে না। যাইহোক-ছেলেটি হঠাৎ করে বলে আপনি কোলকাতার লোক। আমি আবার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম-না, তবে পশ্চিম বঙ্গের লোক। সে এবার আগ বাড়িয়ে বললো , দেখুন আমি এম এ পাশ করেছি সি ইউ থেকে-আপনার চেনাশোনা কেও থাকলে একটু ভাল কাজ দিতে বলুন না। আমরাত আপনার কোম্পানীর কর্মী না-কনট্রাক্টে আসি-খুবই কম মাইনা পাই।
আমি বল্লাম- কেন পশ্চিম বঙ্গ ছাড়লে-তুমি ত মনে হচ্ছে বেশ উচ্চশিক্ষিত।
ও বললো আপনি ত সবই জানেন। আপনিও বিদেশে আছেন।

আমি বললাম, সেত বুঝলাম-কিন্ত যেটা বুঝলাম না সেটা হচ্ছে, পশ্চিম বঙ্গের এই দুরাবস্থার পরেও কি করে কমিনিউজমে তোমার আস্থা অটুট আছে?

ও বললো -দেখুন আমাদের মালিক, ঘন্টা প্রতি আমাদের ১০ টাকা দেয়, আর আপনার কোম্পানীকে চার্জ করে ঘন্টায় ২৭ টাকা। আমাদের ২১ জন এখানে কাজ করছে। এটাকে শোষন বলবেন না?

আমি বল্লাম নিশ্চয় এটা শোষন। কিন্ত তাহলে পশ্চিম বঙ্গে শোষন হীন সাম্যাবস্থা আনার চেষ্টা ছাড়লে কেন?

এবার ছেলেটা ছল ছল করে উঠল। বললো-স্যার ঠাট্টা করছেন? বাড়িতে দুই বোন। বিয়ে দেওয়া হয় নি। স্কুল সার্ভিস কমিশনে বসা ছাড়াত কোন চাকরি নেই রাজ্যে। গ্রামে মাত্র দুবিঘা জমি। এবার আপনিই বলুন আমার কি করা উচিত ছিল? নেতাদের পেছনে ঘুরে ত আর পেট ভরে না।

আমি বল্লাম, তুমি কি একবার ও নিজেকে প্রশ্ন করেছ-কেন দিল্লীতে তোমার মতন উচ্চ শিক্ষিতরা নানান ভাবে করে খাচ্ছে-আর রাজ্যে তোমার বেকার থাকা ছাড়া উপায় নেই? এর পেছনে তোমার পার্টির কোন ভূমিকা নেই? একটা জিনিস ভেবে দেখলেও পার-শোষনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার পরেও, শুধু বেঁচে থাকার জন্যে তোমাকে শোষনক্লিষ্টতাকে ভীষন ভাবে মেনে নিয়ে দিল্লীতে আসতে হচ্ছে। তাহলে এটা বুঝছ-বেঁচে থাকার বাস্তবতা সমাজে সাম্য বা শোষনহীনতার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ?

শেষের গল্পটা বলার একটা বিশেষ কারন আছে। পৃথিবীর প্রতিটা দেশেই কমিনিউজমের যাবতীয় পরীক্ষা ব্যার্থ হয়েছে-কারন উৎপাদন ব্যাবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয় নি। ক্ষমতাই আসার পর বামফ্রন্ট সরকার একগাদা সরকারী ব্যাবসা খুলেছিল-তার একটিও চলে নি। ভূমি সংস্কারে ফলে গ্রামের কারুর হাতে পুঁজি ছিল না, গ্রামীন শিল্পের বিকাশের জন্যে। মুখে বড় বড় কথা বলেছে-কিন্ত এদিকে কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। ফলে গ্রামে জীবিকার সুযোগ বাড়ে নি-বরং আরো অনেক কমে গেছে। ফলে গোটা রাজ্যটাই একটি অচলায়াতনে পরিণত হয়েছে। আর কমিনিউস্ট পার্টির অর্ধশিক্ষিত নেতারা তত্ত্ব আউড়ে গেছেন। যা ছিল সম্পূর্ণ বাস্তব বর্জিত স্বমৈথুন।

তাহলে কমিনিউস্টদের সারাটা জীবন কি ব্যার্থ? তা আমি বলবো না। যারা মানুষকে প্রকৃত ভালোবেসেছেন, তিনি, হিন্দুত্ববাদি বা ইসলামিস্ট বা কমিনিউস্ট যাই হোন না কেন-তার জীবন সার্থক। কারন মানুষকে ভালবাসার ওপরে কোন তত্ত্ব হতে পারে না। সমস্যা হচ্ছে বাঙালী কমিনিউস্টরা আসলে সেই প্রকৃতির ও নন-এদের অধিকাংশই অজ্ঞতা, অহংকার, অভদ্রততা, দ্বিচারিতা, সুবিধাবাদি এবং মূর্খতার পাঁচ মেশালি চচ্চড়ি।

ফলে কেও ই নতুন সমাজতান্ত্রিক পথের সন্ধান দিতে পারছে না। ধনতান্ত্রিক সমাজের সমস্যাগুলি চলে যায় নি-শোষন ক্রমবর্ধমান-আর মুক্তবাজারের নামে চুরি-ডাকাতিও আমরা দেখছি। গণতন্ত্রে সাধারন মানুষকে নিয়ে আসা যাচ্ছে না। সেই ঠিকাদারতন্ত্র রয়েছে। কিন্ত তাই বলে ত মানুষ স্ট্যালিনিজমের মতন খুনী স্বৈরাচারী শাসন চাইবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব উৎপাদনও চাইবে না-কারন সেসব কিছুই প্রমানিত ভাবে ব্যার্থ। ফলত, ভারতীয় অর্থনীতিতে দক্ষিন পন্থী প্রভাব ক্রম বর্ধমান-কারন বামপন্থীদের দেওয়া অর্থনীতিতে পশ্চিম বঙ্গের হাল হবে। লোকজন গরীব থেকে ভিখিরী হবে।
ফলে যে বিকল্প অর্থনীতি বা রাজনীতির সন্ধান করা উচিত ছিল-তা বাঙালী বামপন্থীরা করে নি। এম্পিরিসিজমের মূল মন্ত্রই হচ্ছে, যা কাজ করছে না, তা ফেলে দিয়ে উন্নততর মডেল আনতে হয়। মার্ক্সিজমের সূত্রগুলি অর্ধ সত্য এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যার্থ-এটাকে মেনেই বিজ্ঞানের দিকে চোখ রেখে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। মার্ক্সিজমের ব্যার্থতাগুলি না মানলে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন আরো ডুবে যাবে। ব্যার্থতাই নতুন সত্যের জন্ম দেয়। নতুন তত্ত্বের জন্ম দিয়ে থাকে। কিন্ত মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক ব্যার্থতাকে অপবিজ্ঞান বা অর্ধবিজ্ঞান বলে না মানলে বাঙালীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন চোরাবালিতে আরো ডুবতেই থাকবে। জনগন আমাদের বুঝতে ভুল করছে বা টাইম নিচ্ছে বা একদিন ঠিকই চিনবে-এই টাইপের আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া এদের ভাগ্যে আর কিছুই জুটবে না।









Saturday, October 10, 2009

ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরষ্কার-কমিটিকে তিরষ্কার করবে কে?

ওবামা যখন পৃথিবীর সর্বাধিক শক্তিশালী মসনদটিতে আসীন হইয়াছিলেন, আমাদিগের ন্যায় বাদামী হইতে কালো চামড়ার জনসমুদয় আহ্লাদিত হৃদয়ে মহামানবকে গ্রহণ করিয়াছিলাম। সাদা রঙের আধিপত্য শেষ হইবার মহেন্দ্রক্ষন উপস্থিত -উপরি পাওনা, তিনি বিশ্বে শান্তি স্থাপন করিবার আপ্রান চেষ্ঠা চালাইবেন এবং আমেরিকা অর্থনৈতিক মন্দা হইতে উদ্ধার পাইয়া হাডসন নদীর সীলগুলির ন্যায় ডাও জোন্সে ওঠা-নামা করিবে এমন দিব্যভ্রমে দিন গুজরান হইতেছিল।

সহসা প্রত্যুষে খবর পাইলাম ওবামা নোবেল শান্তি প্রাইজে ভূষিত হইয়াছেন! ভিরমি খাই নাই। যে শান্তি প্রাইজ মহত্মা গান্ধীর ও অধরা এবং হেনরি কিসিঞ্জিরারের ন্যায় যুদ্ধাপরাধিদের শোভামাল্য-তাহা কে পাইবেন বা কে পাইবেন না, ইহা লইয়া ইহকালে মাথাব্যাথা করিব- মেগাপ্যাস্কেল মিডিয়া উর্দ্ধচাপেও এমন বৃহৎ আহাম্মকি অসম্ভব। আমি কূপিত হইতেছিলাম এই সনের পদার্থবিদ্যায় নোবেল বিজেতা চার্লস কাওএর দুর্ভাগ্যে। বেচারী ১৯৭৮ সালে অপটিক্যাল ফাইবার আবিস্কার করিয়াছিল-ইহার পর টানা ৩১ টি শরৎকাল অতিবাহিত করিয়া নোবেল কমিটি বুঝিলেন, অপটিক্যাল ফাইবার মানব সভ্যতার কল্যান সাধন করিতেছে! ব্যাবসায়ীরা অবশ্য বুঝিতে দেরী করেন নাই-১৯৯০ সন হইতেই টন টন ফাইবার ভুতলে গ্রথিত হইতেছিল-শুধু নোবেল কমিটির দক্ষুদোয় হইতে ৩১ বৎসর লাগিল! ইহাই প্রথা হইলে কূপিত হইতাম না-কিন্ত ছয় মাস ধরিয়া গোটা ছয়েক ভাষন প্রদান করিয়া যদি কেও নোবেল শান্তি প্রাইজ পাইতে থাকেন, তাহা অপেক্ষা আমাদের পাড়ার ক্লাবের শারদীয়া পুরস্কারের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশী হইবে, ইহা লইয়া সন্দেহ নাই!

ওবামা শান্তির জন্যে চেষ্টা চালাইতেছেন-ইহা অস্বীকার করিতেছি না! প্রশ্ন হইতেছে আমিও লেখনীর মাধ্যমে শান্তি প্রচেষ্টা চালাইতেছি-তাহা হইলে আমি নোবেল প্রাইজ হইতে বঞ্চিত হইব কেন? সাফল্য নাই বলিয়া? ওবামা কি সাফল্য পাইয়াছেন? ইরান বা ইস্রায়েলের যুদ্ধংদেহী রূপ কমিয়াছে? হামাস রকেট হানা বন্ধ করিয়াছে? ইস্রায়েল নতুন সেটলমেন্ট স্থগিত করিয়াছে? জাতি সংগে বোমা মারিয়া তালিবানরা শান্তির পথে হাঁটিতেছে? ইরাক হইতে কবে আমেরিকা সম্পূর্ণরূপে পালাইবে?
জনাব যুদ্ধ-মন্ত্রী রবার্টগেটের মন্ত্রনাই উনি আফগানিস্থানে আমেরিকান সেনা উপস্থিতি বাড়াইতেছেন। পাছে চীন কূপিত হয়, তাই উনি দলাই লামার সাথে দেখা করিতে পর্যন্ত অস্বীকার করিলেন! বস্তুত ওবামা শান্তির প্রচেষ্টার নামে যাহা করিতেছেন, তাহা হইল বাক্য সাজাইয়া ডায়ালোগবাজি। ইহাতে তালিবান, ইরান, হামাস, ইস্রায়েল-কাহারও কিছু বদলাইতেছে না-বদলাইবেও না। মিডিয়া ম্যাজিকের দৌলতে, ডুগডুগি বাজাইয়া ওবামা নামক মহামানবটি শান্তিজল ছিটাইতেছেন-কিন্ত শান্তি শান্তি ও শান্তি বলিয়া মন্ত্র উচ্চারনেই যদি শান্তি আসিত, আপামর হিন্দু পুরোহিতকূল নোবেল হইতে বঞ্চিত হইবেন কেন?

আলফ্রেড নোবেল জানিতেন শান্তিপুরষ্কারে রাজনীতি হইবে। তৎকালে নরওয়ে এবং ডেনমার্ক একটিই রাষ্ট্র ছিল এবং ডেনমার্ক বিদেশনীতি দেখিত। নোবেল শান্তি প্রাইজ, বিদেশনীতির কালো গহ্ববরে গড়াইতে পারে-ইহা তিনি বিলক্ষন জানিতেন। তাই উইলে লিখিয়াছিলেন নরওয়ের পার্লামেন্ট শান্তি পুরস্কারের সিদ্ধান্ত লইবে। ইহাতেও তিনি নোবেল শান্তি তরীটি বাঁচাইতে পারেন নাই-গান্ধী চারবার মনোনীত হইয়াছিলেন। কিন্ত একবারও নোবেল শান্তি প্রাইজ পান নাই-কারন বৃটিশদের ভয়ে নরওয়ের পার্লামেন্ট চাপিয়াছিল। গান্ধীকে শান্তি নোবেল প্রাইজ হইতে বঞ্চিত করিয়া -প্রাইজটি এমনিতেই খোরাকে পরিনত হইয়াছিল। ইহার পর কিসিঞ্জার বা আরাফতের ন্যায় যুদ্ধব্যাবসায়ী ( আরাফত লইয়া আমার কোন ভ্রুম নাই। বাঙ্গালীদের অনেকেই তাহাকে বিপ্লবী যোদ্ধা বলিয়া সন্মান করে। আমি অক্ষম। কারন যে ব্যাক্তি বিপ্লব ও স্বাধীনতা যুদ্ধের নামে অস্ত্র স্মাগলিং করিয়া বিদেশে দুই বিলিয়ান ডলারের সম্পত্তি কামাইতে পারে-তাহার জন্যে যুদ্ধাপরাধীই সঠিক ্বিশেষন। ) যেদিন হইতে শান্তি প্রাইজ পাইতেছে, সেদিন হইতে নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাইয়াছে। ডঃ ইউনুস অর্থনীতিতে নোবেল পাইলেই খুশী হইতাম-কারন এই খোরাক প্রাইজ তাহার যথাযোগ্য সন্মান নহে।

আপাতত মনে হইতেছে ওবামা খোরাকি উপহারটি না গ্রহন করিলেই ভাল করিবেন। ওবামা ওবামাই থাকুন। নোবেল শান্তি পুরস্কারের ন্যায় খোরাকি না গ্রহন করিলেই তাহার মর্যাদা বাড়িবে।


Tuesday, September 15, 2009

ধর্ম, অধর্ম ও রক্ষনশীল জীবন

(১)
গোকুর নাথ। না তিনি বাঙালী নন। ফ্লোরিডা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের ছাত্র ছিলেন- অতীতে নিজেকে র‌্যাশানালিস্ট বলে দাবী করতেন। গত দুই দশক ধরে ইস্কনের শিষ্য। আজ তিনি আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কেন তিনি, ধর্মে বিশ্বাস হারিয়ে আবার ধর্মে ফিরে এলেন। এখানে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা অপ্রাসঙ্গিক। কারন বৈষ্ণব ধর্ম ও এক ধরনের অদ্বৈতবাদ-তাই ঈশ্বর বিশ্বাস ফিরে পাওয়া কথাটা ব্যাবহার করাটা টেকনিক্যালি ভুল। কিন্তু ব্যাবহারিক দিক দিয়ে ঠিক।

আগে বাংলাদেশী ফোরামে কিছু ধার্মিকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। যারা এক সময়ে র‌্যাশানিলিস্ট ছিলেন, কিন্ত আবার ইসলামে আস্থা ফিরে পেয়েছেন। একাধিক উদাহরন আমি নিজেই দেখেছি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞান ভিত্তিক, যুক্তি ভিত্তিক একটা জীবন শুরু করেও অনেকে আবার সেই ধর্মের কোলেই ফিরে যাচ্ছে। যুক্তিবাদ কি তাহলে অসার? প্রবীর ঘোষের সংঠন সেই মুষ্টিমেয় কজন। তার থেকে রাম-শ্যাম যদু মার্কা গুরুদের ও অনেক বেশী বড় সংগঠন। ব্যাপারটাকে আমরা যুক্তিবাদিরা -ভাল জিনিসের কদর কম, বা খুব কম লোক বোঝে ইত্যাদি দিয়ে আত্মশান্তনা দিয়ে থাকি।

কিন্ত কেন লোকে ধর্ম ছাড়ছে না?

আমরা কি ঠিক বুঝছি? ঈশ্বরের সপক্ষে যুক্তিগুলো এতই হাস্যকর-সেটা আমি একদম প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বুঝে আসছি। আমার মাথার ওপর ঈশ্বরের দশমনি বোঝা কেও চাপায় নি ছোটবেলা থেকে। ফলে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আদৌ কোন দিন আমি ঈস্বরে বিশ্বাস করতাম কিনা জানি না। ফলে আমার জীবনে ঈশ্বরের বিশ্বাস হারানোর হ্যাপা পোহাতে হয় নি কোনদিন-কারন ঈশ্বর বাবাজী কোনদিনই আমার বুদ্ধির প্রাচীর ভেদ করে ঢুকতে পারলেন না। ঈশ্বরের অনস্তিত্বের এই সামান্য যুক্তিগুলো সংখ্যা গরিষ্ঠ লোকে বুঝবে না-এটা কোন যুক্তিতে বুঝবো? বেঁচে থাকতে গেলে যথেষ্টই বুদ্ধির দরকার হয়। সাধারন মানুষের বুদ্ধি এত কম না, যে তারা বুঝবে না ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। এতবড় গোজামিল, চোখে না পড়ার কিছু নেই।

তারপরেও কিছু কিছু যুক্তিবাদি আবার ধর্মে ফিরে আসছে কি করে? প্রশ্নটা নিয়ে আমাদের গভীরে ভাবা উচিত।

(২)
মানুষের নির্মানের মূলে যৌক্তিকতা না অযৌক্তিকতাবাদ? না মানবতাবাদ? শুধু যুক্তিবাদ দিয়ে কি জীবন ধারন করা সম্ভব? পৃথিবীর সেরা সেরা গান, সাহিত্য-সব কিছুই ত ঈশ্বরকেন্দ্রীক। যার পেছনে কোন যুক্তি নেই। অঙ্কুর নাথ যেমন বললেন, আমি হরে কৃষ্ণ নাম উচ্চারন করি হাজার বার-তাতে নাকি আষাঢ়ের বর্ষন ধারার মতন নেমে আসে পরম শান্তি। দুঃখ নেই। সে নাকি সচ্চিদানন্দ ( সদাই যে আনন্দে থাকে) । ধর্মপ্রান মুসলমানদের কাছেও, নামাজটা সেই সিগারেট বিড়ি টানার মতন অভ্যেস। একটু টান দিলে, মনটা চাঙ্গা থাকে। তার কি যাই আসে, ঈশ্বর আছে কি নেই? সেত প্রাণে খুশী। আর মৃত্যুত সবারই নিয়তি। সে যদি খুশী মনে মর‌তে পারে-ক্ষতি কি। মঠে থাকে, কোন কেলেঙ্কারী নেই জীবনে, নিষ্ঠাবান ব্রহ্মচারী। আমি যুক্তিবাদি, সে সচ্চিদানন্দ-আলটিমেটলি দুজনেই মারা যাব। ১৩ বিলিয়ান বছরের মহাবিশ্বে কি পার্থক্য হবে এতে? জীবনের উদ্দেশ্য যদি অন্যমানুষের ক্ষতির কারন না হয়, তাহলে কেন তার জীবনের উদ্দেশ্যে যুক্তিবাদ আসবে?

ইয়াং জেনেরাশনে অধিকাংশই যুক্তিবাদি হয় তাদের জীবনের স্বাধীনতার ওপর ধর্মের খবরদারি দেখে। কয়েকজন ব্রিলিয়ান্ট ইরানিয়ান ছাত্রকে চিনতাম-তারা যথেচ্চার মদ্যপান করত, আর শুয়োরের মাংস খেতে খেতে মোল্লাদের গালাগাল দিত। অনুমান করি, তাদের মূল ক্ষোভের কারন, মোল্লা ব্যাটাদের জন্যে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না-যৌবনে প্রেমটেম করাও ছিল রাষ্ট্রের চোখে ভয়ংকর। অর্থাৎ ধর্মের কুপ্রভাবে, তারা যৌবন ধর্ম ঠিকটঠাক পালন করতে পারে নি বলে রাগ। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে বেশ কিছু বাংলাদেশী মেয়ে ধর্মকে গুলি মেরে আমেরিকান মেয়েদের মতন জীবন যাপন করত। তারা আস্তিক না নাস্তিক জানি না-তবে মোল্লাদের খপ্পর থেকে বেড়তে পেরে খুব খুশী।আবার ইন্টারনেটের কিছু পৌঢ় ধার্মিক দাবী করেন-তারা এককালে বামপন্থী যুক্তিবাদি প্রগতিশীল ছিলেন-ইদানিং ইসলামের মাহাত্ম্য বুঝে, আবার হাড়িকাঠে গলা দিয়েছেন। এর মধ্যে তারা নাকি পরম শান্তির সন্ধান পাচ্ছেন! হিন্দু বামপন্থীদের মধ্যেও এমন আকছার ঘটে। যৌবনে মার্ক্সিট ( অবশ্য সেটা মাছভাতের থেকে কি আলাদা জিনিস তা অধিকাংশ বাঙালী কমিনিউস্টই জানে না) , মধ্যযৌবনে সেনস্ট্রিস্ট, সেখান থেকে বার্ধক্যে রক্ষনশীল জ্যাঠামশাইদের সর্বত্রই দেখি।

ধর্ম সংক্রান্ত এই পরিবর্তনগুলো আমাদের জীবনে কেন আসে?
(৩)
এর সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনস্তিত্বের সম্পর্ক নেই। আসলে সবাই একটা বস্তুবাদি 'কমফর্ট জোন' বা সুখের সন্ধানে। এর মূলে অবশ্যই আমি কে বা জীবনের উদ্দেশ্যকি এই প্রশ্নগুলি। তবে এইসব প্রশ্ন বিদ্ধ হয়ে কোন প্রানী কিছু করে না। সমাজ আর পরিবেশ এর উত্তরগুলো আমাদের জোর করে গিলিয়ে দিয়ে থাকে। মৌমাছিদের জৈবচক্রে "জীবনের উদ্দেশ্য কি" তাই নিয়ে নিশ্চয় প্সশ্ন ওঠে না। হাজারে হাজারে সবাই যা করছে, তারাও তাই করে। ক্যানোনিক্যাল ধর্মগুলো-মানে যে ধর্ম গুলো কখন কি করিতে হইবে তাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছে-তাদের অনুসারিরা আচরনে পুরুষ মৌমাছি। "ব্যাক্তি-স্বাতন্ত্রের" প্রশ্ন সেখানে নেই-স্বাধীন অস্তিত্বের কথা সেখানে ভাবা নিষিদ্ধ-পুরুষ মৌমাছির মতন আচরনই সেখানে সিদ্ধ।

শিল্প বিপ্লবের আগে এসব নিয়ে সমস্যা ছিল না। নাস্তিক ছিল না যে তা না-কিন্ত যুথবদ্ধ জীবন ছাড়া একাকী বেঁচে থাকা ছিল অসম্ভব। অথচ আজ আমেরিকার যেকোন শহরে ৩০ বছরের নীচে অধিকাংশ নারী বা পুরুষ একাই থাকে। সবারই প্রায় একাধিক যৌন সঙ্গী। তাই নিয়ে কেও চিন্তিতও নয়। এবং এইসমস্ত দেশ সমূহ, প্রোডক্টিভিটিতে পৃথিবীর সবার ওপরে। পাশ্চাত্যের এই সব দেশ সমূহের সমস্যা হল-জন সংখ্যা হ্রাস। কারন, অনেক মেয়েরাই সন্তান ধারনে অনিচ্ছুক। তবে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে সেটাও সমস্যা না। মূল কথা ফার্টালিটি রেট ২ এর ওপরে থাকা দরকার। রাশিয়াতে ১৯৯৫ সালে ১ এর নীচে নেমে গিয়েছিল। বর্তমান রাশিয়ান সরকার, মা হওয়ার জন্যে বিভিন্ন ইনসেন্টিভ চালু করে। তিন সন্তান হলে এস ইউ ভি, চার সন্তান হলে বিনা পয়সায় ফ্ল্যাট--এসব করে, বর্তমানে রাশিয়াতে ফার্টিলিটি রেট আবার দুই এর কাছাকাছি। সুতরাং ধর্মের ভয় দেখিয়ে, শুধু রক্ষনশীলতার মাধ্যমেই রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস ধরে রাখা যায়, তা ঠিক না। মেয়েদের দোখজের ভয় না দেখিয়ে, শরিয়ার চাবুক না মেরে, লোভ দেখিয়েও রাষ্ট্রের জন সংখ্যা ধরে রাখা যায়।

তবে সন্তানের জন্ম দিলেই ত হল না-তাদের মানুষ করার ব্যাপারও আছে। রক্ষনশীলদের ধারনা, শক্তিশালী পরিবার থেকেই ভবিষ্যতের শক্তিশালী নাগরিক বেড়োবে। কথাটা আংশিক সত্য। ভারত বা চীনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখান কার ছাত্রদের সাফল্যের মূল কারন, তাদের পরিবার ছেলে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে অনেক বেশী যত্নবান। সেই তুলনায় পাশ্চাত্য সমাজ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। আমেরিকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে এশিয়ানরা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ।

কিন্তু এর সাথে ধর্মের সম্পর্ক কোথায়? চীনারা ত ধর্ম মানে না। ভারতের সেরা ছাত্ররা-[যারা বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে নিজেদের ছাপ রেখেছে]-তারা হয় নাস্তিক বা নাস্তিক্য হিন্দুধর্মের অনুসারী। আমি অবশ্য ভারতীয় সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের এই ক্যাটেগরীতে রাখছি না-এদের অধিকাংশই বৌদ্ধিক বিষয়গুলিতে নিরক্ষর। মোদ্দাকথা পারিবারিক রক্ষনশীলতাকে ধর্মের সাথে গোলানো উচিত না। ধর্মহীন মানেই রক্কনশীলতার বিরোধিতা-এই ধারনাকে আমি ভূল বলে মনে করি। নাস্তিক চীনারাও রক্ষনশীল-আমি নিজেও ব্যাক্তিগত জীবনে রক্ষনশীল। কারন মূল কারন অনেক-
(১) আমাদের দেহ-মনের সিস্টেমটা একটা মেশিন-যা বিবর্তনের ফলে এসেছে। এবং আমাদের বিবর্তন হয়েছে সমাজবদ্ধ ডিসিপ্লিন্ড জীব হিসাবেই। ফলে দেহ বা মনের সঠিক যত্ন না নিলে-বা ডিসিপ্লিনড জীবন, যেমন অত্যাধিক মদ্যপান না করা, ধূমপান বা নেশা না করা, যথেষ্ঠ নিদ্রা, ঠিক ঠাক আহার-শারীরিক কসরৎ -ইত্যাদি না করলে, আমরা শীঘ্রই অসুস্থ হয়ে পড়ব। এর সাথে সাথে অহঙ্কারহীন, ক্ষমাশীল জীবন পালন করলে, আমাদের রক্তচাপটাও ঠিক থাকে। এতে কেও ধর্মের গন্ধ পেলে মুশকিল। আবার কেও যদি মনে করে এর জন্যে ধর্মে ফিরে যেতে হবে সেটাও মুর্খামি। খুব স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক যুক্রিতেই আসে আমাদের অহঙ্কারহীন থাকা উচিত। কারন, আমরা যে 'আমি' 'আমি' করছি-সেটা ত স্বতন্ত্র কিছু না। বাবা-মা-বন্ধু-শিক্ষক-পুস্তক-লেখক-সমাজ-পরিবেশ আমাদের যা শিখিয়েছে তার থেকে একটা 'আমি' তৈরী হয়েছে। তাছারা সেই 'আমি' বাঁচেই বা কদ্দিন? ১০০ বছর? ১৩ বিলিয়ান বছরের মহাবিশ্বের কাছে, তা কতটুকু সময়? পলকের ও কম।
(২) অনেক লিব্যারালদের ধারনা-অন্যের ক্ষতি না হলে বা অন্যের অধিকার ক্ষুন্ন না হলে, আমাদের সব কিছু করার স্বাধীনতা আছে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারনা। কারন এখানে ভাবা হচ্ছে ব্যাক্তি আমির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ আমি বা আপনি সমাজ থেকে পৃথক এক স্বতন্ত্র সামাজিক জীব। এটি সম্পূর্ণ বস্তুবাদ বিরোধি আদর্শবাদি ধারনা-কারন সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট খাওয়া থেকে রাতে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমার প্রতিটি কাজের জন্যে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দরকার হয়। আমার খাদ্য, শিক্ষা, চাকরি, বাসস্থান-এই ইন্টারনেট-সব কিছুই সমাজ বা রাষ্ট্রের উৎপাদন থেকে এসেছে। আমি নিজেও এই উৎপাদন ব্যাবস্থার অংশ-তার বাইরে আমার অস্তিত্বই নেই। সুতরাং এই উৎপাদন ব্যাবস্থাকে ক্ষতি করে, এমন কিছু করার স্বাধীনতা আমার থাকতে পারে না। এই উৎপাদন ব্যাবস্থাকে ক্ষতি না করে, সব কিছুই আমরা করতে পারি।

এই প্রসঙ্গে যেসব দম্পত্তি ইচ্ছা করে চাইল্ডলেস বাই চয়েস থাকেন বা সন্তান নিচ্ছেন না-তাদের স্বাধীনতার বিশ্লেষনে আসা যেতে পারে। এর অধিকার কি থাকা উচিত? কারন তারা এই উৎপাদন ব্যাবস্থার শরিক হয়েও, নিজেদের কর্তব্য করছেন না। লিব্যারালদের মতে, এই স্বাধীনতা থাকা উচিত পূর্ণাঙ্গ। এখন ভারত বা বাংলাদেশে দম্পতিরা এমন করলে, তাদের ট্যাক্স মকুব করা উচিত-কারন তারা জনসংখ্যা কমিয়ে রাষ্ট্রের সেবা করছেন। অন্যদিকে ইউরোপে এমন করলে, তাদের ওপর প্রচুর ট্যাক্স চাপানো উচিত। কারন সেখানে জনসংখ্যা হ্রাস হচ্ছে। বাস্তবে সেটাই হচ্ছে-ইউরোপে সন্তান না থাকলে প্রচুর ট্যাক্স দিতে হয়-স্বাধীনতা থাকলেও, পেনল্টি দিতে হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এই স্বাধীনতার ব্যাপারটা ভীষন ভাবে পোষ্ট-মডার্ণ। ধার্মিকদের মতন কোরান বা বাইবেলের ম্যানুয়াল ধরে এ খর্ব করা যায় না-আবার স্থান কাল পাত্র না বিবেচনা করে-এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ভারতের মতন জন বহুল দেশে, মুসলিমদের জন্মহার খুবই বেশী-যে কারনে-তারা সন্তান ঠিক ঠাক মানুষ করতে পারেন না। এবং বর্তমানে ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার হার ভারতের আদিবাসিদের থেকেও খারাপ। আমেরিকান মুসলিমদের মধ্যেও এই ধরনের গোঁড়া মুসলিম আছে-তবে তারা ব্যাতিক্রম। সেই জন্যে আমেরিকাতে মুসলিমরা , সাদা আমারিকানদের থেকেও ভাল করছে। কিন্ত ইউরোপ বা ভারতে তারা নিদারুন ভাবে পিছিয়ে। একই ধর্মের লোকেরা দুই দেশে দুই ধরনের পার্ফমান্স দিচ্ছে-কারন, ধর্মের আসলেই কোন ভূমিকা নেই। মূল কথা হল দেশ-কাল-পরিস্থিতি বুঝে লোকেরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি না। সেটাই আসল কথা।

অর্থাৎ এই রক্ষনশীলতার ব্যাপারটা আমরা আমাদের সমাজের রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমের ফিটনেসের জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। সেটাকে ত্যাগ করা বা গ্রহন করাটা-সম্পূর্ণ ভাবেই পরিস্থিতি নির্ভর সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। সার্বজনীন সর্বকালীন ধর্ম বা উদারপন্থা-এর কোনটারই কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই। যেকারনে কোরান বা বাইবেল, বর্তমান মানুষের জীবনে অর্থহীন-ঠিক একই কারনে উদারনৈতিক চিন্তাধারা বা লিব্যারালিজমও অর্থহীন। কারন প্রতিটি পরিস্থিতি স্থান কাল পাত্র ভেদে আলাদা। তাদের জন্যে কোন সার্বজনীন, সর্বকালীন আইন বা গাইডেন্স থাকতে পারে না।

কিন্তু তাহলে রাষ্ট্রের আইন কি হবে? সেখানে ত এই পোষ্টমডার্ন দর্শন চলবে না। তাহলে আইনের বই এর সাইজ, বহুতল বাড়ির সাইজকে ছাড়িয়ে যাবে! সেখানে কিছু গাইডেন্স আনতেই হবে। অর্থাৎ কিছুটা এম্পিরিসিজম বা সমাজবিজ্ঞানের গবেষনাকে কাজে লাগিয়ে, রাষ্ট্রকে তার স্বার্থের জন্যে পজিশন নিতেই হবে। সামাজিক আইনগুলি থেকে ধর্মের বিসর্জন একান্ত ভাবেই দরকার। সেখানে বিজ্ঞানের গবেষনা আসুক। আমাদের উদ্দেশ্যত নাগরিক এবং রাষ্ট্রের মঙ্গল।সেখানে পাশ্চাত্যের আইন, শরিয়া আইন এসব না বলে, সমাজ বিজ্ঞানের গবেষনার ওপর ভিত্তি করে আইন আনা হৌক। আমেরিকাতে আস্তে আস্তে তাই হচ্ছে। গোটা বিশ্বের যেকোন উন্নত দেশেই তাই হচ্ছে আস্তে আস্তে। সেখানে আল্লার আইনের নামে এক অন্ধকারযুগকে আনার কোন মানে নেই। অথচ মুসলীম বিশ্বে এই ভাবেই পুরুষের হাতে নিগৃহীত হচ্ছে অসংখ্য নারী। বিয়ার খাওয়ার জন্য যদি কোন নারীকে বেত্রাঘাত মারা হয়-তাহলে মানতেই হবে, মেয়েদের জন্যে শরিয়া আইনের চেয়ে জঙ্গলে গিয়ে বাস করা ভাল। সেখানে স্বাধীনতাটুকুত আছে। ভারতে হিন্দু পুরুষের হাতেও একই ব্যাপার আগে হত-কিন্ত রাষ্ট্র যেহেতু নারী পক্ষে, গত দুই দশকে শহরের কিন্ত অনেক পরিবর্তন এসেছে। গ্রামে অবশ্য এসব প্রগতি অনেক দূর। মৌলবাদিরা পাশ্চাত্যের আইন, পাশ্চাত্যের নগ্ন নারী-নারীর যৌনতার স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি ধুয়ো তুলে, শরিয়া আইনকে টেকাতে চাই। কিন্ত বাস্তব সত্য হচ্ছে পাশ্চাত্যে আইন গুলি আস্তে আস্তে সমাজ বিজ্ঞান নির্ভর হচ্ছে। এটা ঠিকই নারী স্বাধীনতার সাথে সাথে নারীদের মা হওয়ার ইচ্ছা কমেছে। কিন্ত তাতে ধর্মের মতন অন্ধযুগকে ফেরাতে হবে কেন? রাশিয়ার মতন ইন্সেন্টিভ স্কীম চালু করলেই ত মিটে যায়। আবার এটাও দেখা গেছে, কিছু কিছু আমেরিকান পরিবার, নিজেদের স্বার্থের জন্যে ছেলে মেয়েদের যথেষ্ট যত্ন নিচ্ছেন না। ওবামার বাবা ওবামাকে ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আমেরিকায় বাবা-মা ছেড়ে পালানো খুব সাধারন ব্যাপার। কিন্ত এই ব্যাপারে মিডিয়া খুব সরব এবং আইনও সেই সব বাবা মাদের কঠোর শাস্তি দিয়ে থাকে, যদি দোষী প্রমানিত হয়। এর জন্যে কি ধর্মের আইন লাগে? জীবনের একটা পরিস্কার উদ্দেশ্য থাকলেই এসব এমনিতেই আসে। ধর্মের আফিং খাইয়ে দিয়ে এইসব করানো অর্থহীন। তাতে সাইড এফেক্ট অনেক বেশী।

(৪)

যাইহোক এবার কিছু ব্যাক্তিগত সমস্যার কথায় আসি। আমাদের উপমহাদেশে নাস্তিক হিসাবে পরিবার পরিজনদের মধ্যে বেশ অসুবিধায় থাকি প্রায় সকলেই। কোন মাসিমা পুজোর প্রসাদ দিলে, আমি নাস্তিক, তাই প্রসাদ খাই না-এমন সাধারনত আমি বা কোন বোধ সম্পন্ন নাস্তিকই বলবে না-কারন আমরা তাকে আঘাত করতে চাই না। কোন ধার্মিক মুসলমান বন্ধু যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে, তাদেরকেও নিশ্চয় বলা ঠিক না, আল্লা নেই, তুমি বোকামো করছ। হ্যা, সে যদি আল্লার সপক্ষে প্রমান দিতে চাই, আমি তাকে পরিস্কার ভাবেই গাধা বলব। কিন্ত সে যদি মানসিক শান্তির জন্যে বা তার নিত্য কাজের মধ্যে স্বস্তির জন্যে নামাজ পড়ে, তাকে যেচে গিয়ে গাধা নিশ্চয় আমরা কেওই বলি না। উচিত ও না। পূজোর ব্যাপারটাও তাই। তিথি নক্ষত্র মেনে অনেকে পুজো করেন-আমেরিকায় যে এতটা হিন্দু রয়েেন, সেই নিয়েও অনেকে গর্ব করেন। আমি হাঁসি। হ্যাঁ বা না বলি না। কি বলব? এসব অনর্থক তর্কে জড়ানো অর্থহীন। এত ধেড়ে বয়সে যাদের বুদ্ধি হয় নি, তার বুদ্ধি কোনদিন হবে বলে আমার মনে হয় না। সে যদি তার তিথি নক্ষত্র নিয়ে সুখে থাকে, থাকুক। সুখী থাকাটাই যখন জীবনের ধর্ম, তথন কেও বোকামো করে সুখে আছে না বুঝে সুখে আছে-তা দেখে কি হবে? শুধু তার সুখের কারনে অন্যের দুঃখ না হলেই হল।

তবে হ্যাঁ কেও যদি তার ধর্ম পৃথিবীর সেরা বলে গর্ব করে, আনন্দ পেয়ে থাকে, তাতেও আমার আপত্তি নেই। যতক্ষন সেই আনন্দ, ব্যাক্তিটি নিজের মনের মধ্যে রাখতে পারবেন। যখন সে নিজের ধর্ম সেরা-এইসব নিয়ে বলতে আসবে, তাকে পরিস্কার বলা উচিত, আপনার বিষ্টার গন্ধ শুঁকে আপনি সচ্চিদানন্দ হোন-সেই দুর্গন্ধ আর বেশী ছড়াবেন না, তাহলেই হল। আমার ধর্ম আপনার ধর্মের চেয়ে ভাল-এই ধরনের যুক্তিগুলোর ভিত্তি আমার বিষ্ঠা আপনার থেকে ভাল-এই স্তরের। এইসব অর্থহীন সময় নষ্ট না করে, ধর্ম বা বিজ্ঞান, বিষয় যাই হোক না কেন-তা কি করে আরো মানব কল্যানে লাগানো যায়, সেই নিয়েই চর্চা করা উচিত।

Wednesday, September 2, 2009

দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্বের আলোকে ধর্মগ্রন্থ সমূহের ব্যাখ্যা!

(১)
খ্যাপা রামকৃষ্ণ বলতেন যত মত তত পথ। আজকের দুনিয়াই টিভি, ইউটিউব এবং ইন্টারনেটের নানান ধর্মীয় বিতর্কে যোগ দিলে বিলক্ষন মনে হতে পারে সফটওয়ার প্রোডাক্ট ভার্সনের ন্যায় কোরান-গীতা-বাইবেল ইত্যাদি গ্রন্থ সমূহের 700.0, 800.0....1900.0., 2000.0 ইতাদি ভার্সন সহজলভ্য। যেমন যুগ, যেমন জ্ঞান, তেমন ভার্সান! আবার একই যুগে নানান প্রকৃতি এবং দেশের ওপর নির্ভর করে কোরানের কোন ভার্সন চলবে! হিন্দু ধর্মগ্রন্থ এবং বাইবেলের ক্ষেত্রে এই ট্রেন্ড আবার অনেক দিনের পুরানো ইতিহাস।

ইউ টিউবে 'জোকার' জাকিরের কোরানিক ভার্সান ইংরেজী শিক্ষিত মুসলিমদের জন্যে, সৌদি আরবে আবার অন্য রকম-আমেরিকার চাপ খেয়ে পাশ্চাত্যে কোরান অনেক লিব্যালার-সেখানে পন্ডিতরা যুক্তি খোঁজেন উদারতান্ত্রিক ভার্সনের কমপ্যাটিবল কোরান কিভাবে রচনা করা যায়! গীতা বা বাইবেল বা হিন্দু ধর্ম গ্রন্থগুলির ও একই বেহাল অবস্থা!

বই সেই একটাই-আল কোরান। মহম্মদ নিজের কুকীর্তি বা সুকীর্তি, অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞান সুপার মাফিয়া আল্লার নামে চালিয়ে কোরান রচনা করেন। মহম্মদের ইতিহাস আর কোরান পাশাপাশি রেখে পড়লে, যেকোন বুদ্ধিমান লোক খুব সহজেই বুঝবে কোরানে কি এবং কেন লেখা হয়েছিল। অবশ্য সে যুক্তিবাদের পথে ধার্মিকরা হাঁটবেন না-কারন অতটা হাঁটার কষ্ট নিতে জানলে, তারা ধার্মিক হবেন ই বা কেন!

হজরত মহম্মদ যা করেছেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। ৪০০ খৃষ্টপূর্বাব্দের অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য উপদেশ দিয়েছিলেন রাজন্যবর্গ দেশ শাসন করতে, নিজের আইনকে ঈশ্বর কতৃক স্বপ্নে প্রদত্ত আইন বলে চালাবে। রাজাকে রাজ্য শাসন এবং বিস্তারের জন্যে নিজের আদেশকে ঈশ্বরের আদেশ বলে চালানোর সুচতুর কৌশল কৌটিল্য মহম্মদের জন্মের ১০০০ বছর আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন। কৌটিল্যসুত্র মেনেই ভারত ও ইউরোপের রাজন্যবর্গ নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবেই রাজত্ব করেছে পৃথিবীর সর্বত্র। তবুও মহম্মদ কৌটিল্যের সেরা ছাত্র হিসাবে ইতিহাসে আবির্ভূত হলেন-কারন অন্যান্য রাজন্য বর্গ ঈশ্বরকে কাজে লাগিয়েছেন নিজেদের পারিবারিক রাজত্ব কায়েম করতে। সেখানে হজরত মহম্মদ সেই ঐশ্বরিক স্কীমকে হাতিয়ার করে মানব সমাজের আরো পূর্নাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। লক্ষ্য - মানব সাম্যের ওপর ভিত্তি করে গরীব দরদী এবং একটি শক্তিশালী সমাজের বিকাশ। তবে হ্যাঁ সেখানেও দাশ প্রথার বিলোপ, নারীর জন্যে সমানাধিকার তিনি আল্লার নামে নামালেন না। কারন সেই যুগে যখন শিশু মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশী, নারীর গর্ভে ছয় থেকে সাতটি সন্তান না এলে, জনসংখ্যার বিলোপ ছিল অবসম্ভ্যাবী-তখন নারীকে প্রজননের মেশিন ছাড়া অন্য কিছু ভাবা ছিল অসম্ভব। কোরান এবং হিন্দু গ্রন্থ সমূহে তাই একই কারনে নারী সেই প্রজনন মেশিন । যাইহোক, এই ইসলামের ওপর ভিত্তি করেই আরবের প্যাগান সমাজ পরবর্ত্তী তিন শতকে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী এবং জ্ঞানী সমাজে পরিণত হল। কারন ইসলাম তৎকালীন সময় অনুসারে আরো উন্নত সামাজিক আইন এবং চিন্তা বলবৎ করতে সক্ষম হয়।

মনে রাখতে হবে নৃতত্ত্ববিজ্ঞান এবং বিবর্তনের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের উৎপত্তির মূল কারন গোষ্ঠিবদ্ধ জীবন। প্রকৃতির ভয় থেকে ঈশ্বরের উৎপত্তি অতিসরলীকরন। পশু পাখীরাও ঝড় বাদলাকে ভয় পায়-কিন্ত তাদের ঈশ্বর নেই। ঈশ্বর আদিম সমাজে গোষ্ঠিবদ্ধ জীবনের জন্যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ন প্রয়োজন হিসাবেই বিবর্তিত হয়েছে। একটি সমাজ কিছু আইনের ভিত্তিতে গোষ্টিবদ্ধ হয়-সেই আইন গুলির উৎপত্তিকে সমাজ বিজ্ঞানে বলে 'সেলফ অর্গানাইজেশন'। অর্থাৎ কিছু অনু পরামানু যেমন নিজেদের আনবিক শক্তিক্ষেত্রের আওতাই এসে আস্তে আস্তে একটি শক্তিশালী ক্রীস্টাল তৈরী করে-তেমন ই মানুষ নিজেদের মধ্যে পারস্পারিক আইন তৈরীর মাধ্যমে একটি গোষ্ঠিবদ্ধ সমাজের জন্ম দিয়ে থাকে। এই আইন যত সমাজের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেসের উপযোগী হয়, সমাজ তত শক্তিশালী হয়। অর্থাৎ যেসব সমাজের আইনগুলিতে সামরিক শক্তি বা মিলিটারিজম, পরোপকার বা আলট্রুইজম এবং প্রজননের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়-সেই সমাজ বিবর্তনের শক্তিতে ভবিষ্যতে সব থেকে প্রসার লাভ করে। মিলিটারিজম, আলট্রুইজম এবং রিপ্রোডাকশন -যেকোন প্রানীকূলের মূল সারভাইভার স্ট্রাটেজি। যদি ভিনগ্রহের কোন মানুষ আমাকে কোরান বা গীতাকে এক কথায় প্রকাশ করতে বলে-আমি লিখব এই বই গুলি মানব সমাজের সারভাইভাল স্ট্রাটেজির ম্যানুয়াল ছিল মধ্যযুগে।

কোরান বর্নিত সামাজিক নির্দেশাবলী এক শক্তিশালী আরব সমাজের জন্ম দিয়েছিল। কিন্ত ১২০০ শতাব্দি থেকে সেই সমাজ দুর্বল হতে শুরু করে। কেন? আরবরা বিজ্ঞানে যখন এত এগিয়ে ছিল, তখন তাদের মধ্যে থেকেই গ্যালিলিও বা কোপার্নিকাসের জন্ম হওয়া উচিত। কেন এমন হল না? এ প্রসঙ্গে স্যার কার্ল পপারের একটি বক্তব্য প্রাণিধানযোগ্য--যেকোন দর্শনের সব থেকে শক্তিশালী দিকটিই তার দুর্বলতম অধ্যায়। অর্থাৎ ইসলামের দর্শনের সব থেকে শক্তিশালী দিক- এক অভূতপূর্ব সামাজিক শক্তি যা কঠোর সামাজিক আইন এবং সমাজের জন্যে ব্যাক্তির আত্মত্যাগের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ভিত্তিক সমাজের ভিত্তি হতে পারে না। সেখানে উদার নৈতিক ব্যাক্তি কেন্দ্রিক ভোগ্য সমাজ দরকার। ১৫০০-১৮০০ সালের ইউরোপের দিকে তাকালে দেখা যাবে, শিল্প বিপ্লব এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির পেছনে-সামরিক এবং বাজারের ( মূলত উপনিবেশিক) ভূমিকা ছিল মূখ্য। ওই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিস্কারক, লিও নার্ডো দ্যা ভিঞ্চি, তৎকালীন নগর সম্রাজ্যের অধীশ্বর দের চিঠি লিখতেন -তার আবিস্কার দিয়ে আরো উন্নত অস্ত্র বানানো সম্ভব, তাই তাকে অর্থ দেওয়া হৌক সেসব বানাতে। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত আবিস্কার গুলির পেছনে ( বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের কথা বলছি না) , বাজার থেকে ফয়দা তোলার ব্যাক্তিগত লোভ সেকালেও আবিস্কারদের ছিল-একালেও আছে। রেডীও থেকে ইন্টারনেট -বাজার ভিত্তিক সমস্ত প্রযুক্তির আবিস্কার এবং তার ব্যাপক বাজারীকরন আবিস্কারকদের ব্যাক্তিগত লোভ থেকেই উদ্ভুত। বাজারের অনুপস্থিতির কারনেই ভুতপূর্ব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি মারণাস্ত্র এবং মিলিটারি প্রযুক্তি ছাড়া আর কিছুই বিশ্বকে দিতে পারে নি। কোন জীবনদায়ক্ ঔষুধ সেখানে আবিস্কার হয় নি-সব হয়েছে আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে বা জার্মানীতে।

অর্থাৎ আমি যেটা বলতে চাইছি, ইসলামে সামাজিক শক্তির ব্যাপক চাপ থাকার জন্যে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি সত্ত্বেও আরব সমাজ সামন্ততান্ত্রিক থেকে ধনতান্ত্রিক সমাজে বিকশিত হল না। সেই ঘটনা ঘটল ইউরোপে-কারন সেখানকার রাজন্য বর্গ নিজ স্বার্থেই পোপ হতে মুক্ত হতে এবং উন্নত তর অস্ত্র ও উৎপাদনের জন্য ধর্মের ডানা ছেঁটে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগোলেন। আরবে শিল্প বিপ্লবের জন্যে ইসলামের ডানা ছাঁটা দরকার ছিল দ্বাদশ শতাব্দিতে। কিন্ত তা সম্ভব হল না ইসলামের দুর্বার সামাজিক শক্তির জন্যে। ফলে শিল্প বিপ্লব এবং বিজ্ঞানের উন্নতির সামনে ইসলামের সব থেকে শক্তিশালী ফিচারটিই তাদের পিছিয়ে পরার মূল কারন হিসাবে উদ্ভুত হচ্ছে ক্রমাগত ভাবে সেই দ্বাদশ শতাব্দি থেকে।

কিন্ত ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইছি কেন? কারন মুসলমান সমাজের বিদ্বান ব্যাক্তিরাও বোঝেন প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর সমাজ না গড়ে তোলার জন্যে আজ পৃথিবীর ৫১ টি মুসলিম দেশই পাশ্চাত্যের থেকে অনেক বেশী পিছিয়ে পড়েছে। সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রের উত্তোরন একমাত্র তুরস্ক ছাড়া কোথাও সেই ভাবে হয় নি। মিশর, ইন্দোনেশিয়া এবং মালেশিয়ার সাফল্য আংশিক। ফলে মুসলিম সমাজে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটাতে গিয়ে এক অদ্ভুত সার্কাসের চলছে। সেখানে বিজ্ঞানের প্রসারের বদলে ইসলাম ধর্ম কত বৈজ্ঞানিক, সেটা প্রচার করতে রাষ্ট্র এবং মিডিয়া "স্ব কিছুই কোরানে আছে" টাইপের অপবিজ্ঞানের জন্ম দিচ্ছে। এমন নয় যে হিন্দু বা খ্রীষ্ঠান ধর্মে এটা হচ্ছে না। ব্যাপক ভাবেই হচ্ছে। কিন্ত তার পেছনে রাষ্ট্রের মদত নেই। কিন্ত ইসলামের ক্ষেত্রে এই অপবিজ্ঞান রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় এক ভয়ংকর দূষনের রূপ নিয়েছে। আমি এই প্রবন্ধে দেখাবো কি ভাবে এই কুকীর্তি সাধিত হয় । কিভাবে একই আয়াত যা সপ্তম শতাব্দির আরবে ছিল রূপকথা, তা অপবিজ্ঞানীদের হাতে পড়ে, "বৈজ্ঞানিক সত্যের" দাবী করে।

(২)

একটি বাক্যের অর্থ কত প্রকার হতে পারে, এবং তা নিয়ে কি কি ঢপবাজি করা যায়, সেটা বুঝতে জ্যাকুস দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্ব খুবই উপযোগী।

ডিকনস্ট্রাকশন পাঠ করার একটি পদ্ধতি। দেরিদা দেখান

  • প্রতিটা বাক্যের একাধিক অর্থ হতে পারে
  • সেই অর্থগুলি পরস্পর বিরোধী হতে পারে
  • একই বাক্যের নানা ব্যাখ্যা গুলির পরস্পর বিরোধিতা কমানোর কোন উপায় নেই
  • তাই ব্যাখ্যা মূলক পাঠের সীমাবদ্ধতা আছে-এটাকে এপোরিয়া বলে
ডিকনস্ট্রাশনের মুলে আছে ডিফারেন্স (Différance)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী
  • একটি শব্দের নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই-এক টি শব্দের অর্থ তার কাছাকাছি সে সমার্থক শব্দগুলি আছে, তার সাথে পার্থক্য করে নির্নয় করতে হয়। বাড়ি শব্দটির অর্থ নির্নয় করতে আমদের দেখতে হবে কি করে এই শব্দটি ঘর, গৃহ, বাটিকা, প্রাসাদ, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দের থেকে আলাদা।
  • যেহেতু প্রতিটি শন্দ একটি ইমেজ বা ছবি ( আসল বা এবস্ট্রাক্ট) কে প্রতিনিধিত্ব করে সেহেতু বাড়ির সাথে গৃহ, বাটিকা, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দগুলির পার্থক্য নিরূপন করতে, একই সাথে সমার্থক শব্দগুলির ইমেজ, সামাজিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেও ভাবতে হবে ।

একটি বিতর্কিত সুরা ধরে উত্তর দিচ্ছিঃ

9:5 But when the forbidden months are past, then fight and slay the Pagans wherever ye find them, an seize them, beleaguer them, and lie in wait for them in every stratagem (of war); but if they repent, and establish regular prayers and practise regular charity, then open the way for them: for Allah is Oft-forgiving, Most Merciful.

এই আয়াতে সমস্ত গন্ডোগলের উৎপত্তি প্যাগান শব্দের অর্থ থেকে। আলি সিনা এটিকে বিধর্মীদের বি্রুদ্ধে যুদ্ধ বলেও ঘোষনা করতে পারেন-কারন কনটেক্সটুয়ালি মানেত তাই। আবার কেও ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও বলতে পারে, প্যাগান মানে তখনকার মক্কাবাসী ্যারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত ছিল। তাই বর্তমানে আয়াতটির কোন মূল্য নেই। সেটাও ঠিক। আবার কেও প্যাগান বলতে অমুসলিম ধরেও অর্থ করতে পারেন। আবার প্যাগান বলতে এখানে ইসলামের শত্রুও বোঝানো যেত পারে। ব্যাখ্যাগুলি পরস্পর বিরোধি অর্থের জন্ম দিচ্ছে-কিন্ত কোন ব্যাখ্যাকেই ভুল বলা যাবে না । এটার কারন প্যাগান শব্দটার "ডিফ্যারান্স"। কনটেক্সটুয়ালি শব্দটির একাধিক পরস্পর বিরোধি অর্থ হতে পারে-যার কোনটিকেই অস্বীকার করা যাবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে ধর্ম গ্রন্থগুলিকে যখন আমরা ব্যাখ্যা করছি-সেই ব্যাখ্যামূলক অর্থের কোনটি ঠিক-আর কোন টি বেঠিক কে নির্নয় করবে? দেরিদার ডিকনস্টাকশন অনুযায়ী-এই ঠিক না বেঠিক ব্যাখ্যা এই প্রশ্নটিই অর্থহীন। কারন বাক্যের বাখ্যার সীমাবদ্ধতা আছে এবং একাধিক ব্যাখ্যাই কনটেক্সুয়াল কারনে ঠিক হতে পারে। একই বাক্য কখনোই একটিই মাত্র অর্থ বহন করে না।

এবার ত তাহলে বিশাল গেরো হল। দেরিদার মূল কথা হল একটি বাক্য দিয়ে একটি না একাধিক অর্থ পাঠকের কাছে সব সময় পৌছে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কোরানের ১২০০ ইন্টারপ্রেটেশন থাকলে ১২০০ টিই ঠিক হতে পারে। তাহলে কি সিদ্ধান্তে আসা যায়?

অ) আল্লা বা ঈশ্বরকে যত্ই বুদ্ধিমান ভাব না কেন-একটি গ্রন্থের মধ্যে দিয়ে তার বক্তব্যকে পৃথিবীতে পাঠানোর মতন বোকামী আর হতে পারে না! কারন সেই বই এর হাজার হাজার ভাবার্থ হতে পারে, ফলে আল্লা বা ঈশ্বর ঠিক কি চাইছেন, তা কোনদিনই জানা সম্ভব না। অর্থাৎ হীরক রাজার দেশের অবস্থা--ব্যাখ্যার কোন শেষ নাই-ব্যাখ্যার চেষ্টা বৃথা তাই। সুতরাং একজন চোর, ডাকাত, মাস্টারমশাই, ব্যাবসায়ী, যোদ্ধা-একই বই পড়লেও এদের কাছে কোরানের ব্যাখ্যা হবে আলাদা। মোদ্দাকথা ১৫০০ মিলিয়ান মুসলিম কোরান পড়ে ১৫০০ মিলিয়ান ব্যাখ্যা তুলে নিয়ে আসতে পারে-যার অনেক গুলিই পরস্পর বিরোধি হবে-কিছু মিল থাকবে। এবং সেটাই বাস্তব। আল্লা বা ঈশ্বর বুদ্ধিমান হলে বই এর মাধ্যমে, ইনস্ট্রাকশন পাঠানোর রামপাঁঠামো কাজটি করতেন না। উনি ত সৃষ্টির মা-বাপ। একদম মানুষের মস্তিস্কের মধ্যে কোরানটাকে জেনেটিক্যালি ওয়ারড করে পাঠিয়ে দিলেই লেঠা চুকে যেত! আল্লা কি চান? তার আইনের সাম্রাজ্য! সেটা ত মানুষের জেনেটিক কোডে ঢুকিয়ে দিলেই অনায়াসেই হয়ে যেত! উনিই ত মানুষ তৈরী করেছেন! সেটা না করে বই এর মাধ্যমে তার ইচ্ছা বা আইনের কথা জানানোর গাধামো কেন তিনি করলেন তা সত্যই খুব গোলমেলে! একবার ভেবে দেখুন। একটি প্রতিষ্ঠিত আইনের ও হাজার ব্যাখ্যা হয়-আইন বাক্যটি কিন্ত বদলায় না। সুতরাং কিছু আইন সংকলন করে ছেড়ে দিলেই আইনের সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয় না-সামাজিক বিবর্তনের সাথে সাথে সেই একই আইনের ব্যাখ্যাও বদলে যায়। সুতরাং একটি গ্রন্থের মাধ্যমে সর্বকালীন সার্বজনীন একটি ধর্মের প্রতিষ্টা করার ধারনাটাই ডাঁহা ভুল। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা আল্লার যদি সত্যিই অস্তিত্ব থাকত -ধর্ম রাজ্য বানাতে ধর্ম গ্রন্থ বাজারে ছাড়ার মতন বোকামি তিনি করতেন না। জেনেটিক কোডে সামান্য রদ-বদল করে তিনি তার ধর্ম রাজ্য বানাতে পারতেন! ধর্মগ্রন্থ বাজারে ছেড়ে ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্টার খোয়াব মানবিক ক্রিয়া-কলাপ, যা এই বান্দা বর্তমান প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে করে চলেছে। কারন মানুষের জেনেটিক কোড বদল করার ক্ষমতা আমার হাতে নেই!
আ) ধর্মের ব্যাখ্যা মূলক বিতর্কগুলি অর্থহীন জঞ্জালের সৃষ্টি করছে। কারন কোন ব্যাখ্যাই আসলে বেঠিক না। যে কোরানে বিজ্ঞান পাচ্ছে সেও ঠিক ব্যাখ্যা করছে-যে পাচ্ছে না-বা উলটো পাচ্ছে সেও ঠিক ব্যাখ্যা করছে। কারন ওই রকম দুর্বল বাক্যের একটি মাত্র ভাবার্থ থাকতে পারে না। সুতরাং যারা কোরানে বিষ্ঠা এবং মূত্র পাচ্ছে তারাও যেমন ঠিক-আবার যারা ফুল ফলের শোভিত গন্ধ পাচ্ছে তারাও ঠিক। দেরিদার কথা মানতে গেলে ব্যাখ্যা মূলক বিতর্ক সম্পূর্ন অর্থহীন-একাধিক পরস্পর বিরোধি ব্যাখ্যা থাকাটাই বাক্যের ধর্ম!

(৩)

তাহলে কি আমরা জাকির নায়েকের এই ধরনের ধরনের ধাপ্পাবাজির সামনে অসহায়? মোটেও না। আসল সমস্যার মুলেই আঘাত করতে হবে। ডিকনস্ট্রাকশন জনিত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধর্মকে মানবিক বা যুগোপযোগী করে তোলার চেষ্টাকে বলে "উইক থিওলজি" বা "দুর্বল ধর্মতত্ত্ব"। এটাই ধর্মতত্ত্বের পোষ্টমডার্নিজম-যে কোন ধর্মতত্ত্বের একটি ই মাত্র ব্যাখ্যা থাকতে হবে তার মানে নেই। কারন ধর্মের টেক্সট বা বাক্যগুলির গঠন খুব দুর্বল। গোদের ওপর বিষফোরার মতন মধ্যযুগীয় শব্দ। ফলে আইসক্রীমের বা চালের যেমন গার্ডেন ভ্যারাইটি প্রোডাক্ট লাইন থাকতে পারে-ইসলাম বা হিন্দু ধর্ম মানেও যে একটিই মাত্র ধর্ম বোঝাতে হবে, তারই বা মানে কি আছে? আসল সত্য ত এটাই ১৫০০ মিলিয়ান মুসলমান ১৫০০ মিলিয়ান রকমের ইসলাম ধর্ম পালন করে। হিন্দু দের মধ্যেও তাই-এক বিলিয়ান হিন্দুর জন্যে এক বিলিয়ান হিন্দু ধর্ম। ভারতে বা পাকিস্থানে যে ধরনের ইসলাম পালন করা সহজ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, আমেরিকাতে তাত হবে না। তাই এখানে, আমেরিকাতে ইসলামের বিবর্তন বা হিন্দু ধর্মের বিবর্তন ও অন্যভাবে হবে। এবং এই ভাবেই ধর্মের উদারনৈতিক ব্যাখ্যাগুলি ক্রমশ গোঁড়া বা রক্ষনশীল ব্যাখ্যাকে কোনঠাসা করতে সক্ষম হবে, সেই বিবর্তনের পথেই। এই ভাবেই ত হিন্দু সংস্কার আন্দোলন সফল হয়েছে। তাই ইসলামের যত বেশী ব্যাখ্যা বাজারে আসবে ধর্মটার বিবর্তন হবে তত দ্রুত-কারন মানুষ তার যুগোপযোগী ব্যাখ্যাটাই খুঁজে নেবে। এই ভাবে বিবেকানন্দের হিন্দু ধর্ম সংস্কার আন্দোলন কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। ভারতের ইসলাম আর আরবের ইসলাম এক না। বাংলার ইসলাম, বাংলার মাটির সাথে কথা বলেই তার ভাবার্থ খুঁজেছিল এক সময়-এখন আবার আরবী হওয়ার চেষ্টা করছে। যা অতীব হাস্যকর কারন বাংলার ইসলামও এই ধরনের উইক থিওলজি থেকে বাংলা সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিবর্তিত ধর্ম। সেই বিবর্তনকে উপেক্ষা করে, আরবের ইসলাম বাংলায় চালাতে গেলে, বাংলা ভাই টাইপের চরিত্রই ভবিষ্যত।

আবার ধর্মীয় মৌলবাদিরা ডিকনস্ট্রাকশনের ভাষায় স্ট্রং থিওলজিস্ট-কারন তারা বিশ্বাস করে ধর্মীয় বাক্যের একটিই মাত্র ব্যাখ্যা আছে -যা তারা মানে। কিন্ত আমরা দেখালাম, তা অবৈজ্ঞানিক ধারনা। ধর্মীয় বাক্যের একাধিক অর্থ থাকাটাই বাস্তবে সত্য। মূলত এদের জন্যেই মৌলবাদি জঞ্জালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবী।

কিন্ত ধর্মে বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়া অপবিজ্ঞানীদের কি হবে? ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কির মতে এই ধরনের উৎপাতের কারন ধর্মগ্রন্থগুলির বাক্য উইক টেক্সট বা দুর্বল ভাবে গঠিত বাক্য যা বিজ্ঞানের ভাষা হতে পারে না। রিচার্ড ডকিন্স ও এই ব্যাপারে সহমত। অর্থাৎ নিউটনের তৃতীয় সূত্র বিজ্ঞান যে ভাষায় লেখে, সেখানে একটি বাক্যের একাধিক মানে নেই। বিজ্ঞান ভাষ্যে বাক্যকে ভীষন ভাবে অবজেক্টিভ হতে হবে যাতে একটিই মাত্র অর্থ হয় এবং সেই অর্থ অনুসরন করে তার পরীক্ষামূলক অনুসন্ধান সম্ভব। কোন বাক্যের একাধিক পরস্পর বিরোধি অর্থ থাকলে, সেই বাক্যকে আমরা বলব উইকটেক্সট ( দুর্বল বাক্য) এবং সেই বাক্যটি বিজ্ঞানের জগতে গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। সুতরাং আমাদের স্ট্যান্ডার্ড উত্তর হওয়া উচিত-কোরান বা গীতায় বিজ্ঞান আছে কি নেই-তাই নিয়ে ধার্মিক রা যত খুশী মাথা ঘামাক। তাতে বিজ্ঞানীদের কিছু যায় আসে না-কারন ওই গ্রন্থ গুলির টেক্সট এত দুর্বল -তা একাধিক অর্থ বহন করে, তাই তা বিজ্ঞানের বিবেচ্য নয়। কেও যদি কোরানে বিজ্ঞান আছে বলে গর্বিত বা খুশী হয়। তাতে কি যায় আসে। হিরোইন বা কোকেন খেয়েও লোকে আপাত ভাবে খুবী উজ্জীবিত থাকে। সেটা তাদের চয়েস-কিন্ত বিজ্ঞানী মহলে তা অর্থহীন প্রলাপ ছাড়া কিছুই না।

মোদ্দা কথা আল্লা নিজের ভেলকি বা কেরামতি দেখাতে চাইলে, মানুষের জেনেটিক কোডেই সেটা করতে পারতেন-বই এর মাধ্যমে সমাজ পরিবর্ত্তনের চেষ্টাটা আমাদের মতন নশ্বর মানুষের কাজ!