Thursday, August 4, 2011

আরেকটি বিশ্বমন্দার সামনে আমরা দাঁড়িয়ে?


[১]

আমি অর্থনীতিবিদ নই। কিন্ত নিয়তি এতই নিঠুর, অর্থনীতির চোরাবালিতে হাঁটতে থাকা নশ্বর জীব আমরা। না বুঝলে, যেকোন মুহুর্তে চোরাবালিতে শেষ হয়ে যেতে পারে সমস্ত জীবনের সঞ্চয়। এই বাজার অর্থনীতিতে আমরাও পণ্য। যত তাড়াতাড়ি এই উপলদ্ধি মাথার মধ্যে ঢোকে, ততই ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। বাজারের সাপলুডোর সাথে আমাদের সবার ওঠানামা।
২০০৮ সালের সাবপ্রাইম ক্রাইসিস কিভাবে গোটা বিশ্বে থাবা ফেলেছিল, সেই আতঙ্ক কাটতে না কাটতে খুব সম্ভবত আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে আমরা ঢুকতে চলেছি। আজ বিশ্বের বৃহত্তম স্টক এক্সচেঞ্জ ডাওজোন্স পড়েছে ৫০০ পয়েন্ট। মাত্র তিন দিনে গোটা বছরের আয় উড়ে গেছে শেয়ার বাজারের ইনভেস্টরদের। কিন্ত কেন শেয়ার বেচছেন ইনভেস্টরা রা? বাজার কেন আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে?

[২]
এবার সমস্যার শুরু ওয়েলফেয়ার ইকনমিক্স বা জনকল্যানকারি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নামক টাইমবোমটি থেকে। প্রতিটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় এসে স্যোশাল ওয়েলফেয়ার বা নানান সামাজিক স্কীম এবং সামরিক খাতে দেদার ব্যায় করে, যা তাদের আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। বাকী টাকা মেটানো হয় ধার করে। এই করতে গিয়ে আমেরিকার দেনা প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ান ডলার যা তার জিডিপির সমান। ব্যাপারটা এভাবে ভাবা যেতে পারে। আমেরিকার জিডিপি ১৪ ট্রিলিয়ান ডলার এবং ট্যাক্স ও অন্যান্য বাবদ সরকারের উপায় প্রায় ২ ট্রিলিয়ানের কাছে। মানে একটি পরিবারে ধরুন উপায় এক লাখ টাকা, কিন্ত তার দেনা 7 লাখ টাকা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, সেই পরিবারটি দেনা শোধ দেবে কি করে? কারন ৭ লাখ টাকার সুদই অনেক। যদি ৫% হারেও সুদ দিতে হয়, তাহলেও সরকারের উপায়ের ৩৫% চলে যাবে সুদ মেটাতে-এবার তার সাথে মূল আমানত মেটানোর দায় যোগ করলে, উপায়ের ৭০-৮০% চলে যেতে পারে শুধু ধার শোধ করতে!

তবে আমেরিকান সরকারের সুদের সমস্যা কম-কারন এই মন্দার বাজারেও সবাই আমেরিকান সরকারের বন্ড কিনতে চায়, যেহেতু সবাই মনে করে, আমেরিকান সরকার দেওলিয়া হতে পারে না। সেই জন্যে আমেরিকাকে ১ বা ২ % সুদে পৃথিবীর সব দেশ এবং সেই দেশের ব্যঙ্করাও ধার দেয়। আমেরিকান সরকারি বন্ড হচ্ছে অধুনা পৃথিবীর সিন্দুক। যেখানে টাকা রাখলে সব "সেফ"-পতনের সুযোগ নেই।

আর এই জায়গাটাতেই সমস্যা। আমেরিকান আইন অনুযায়ী আমেরিকান সরকার একটি লিমিটের বাইরে ধার করতে পারে না। এবং সেই লিমিট বাড়াতে হলে কংগ্রেস ও সেনেটের অনুমতি লাগে। আমেরিকান সরকার জনস্বাস্থ্য খাতে এমন হারে টাকা খরচ করছিল, যে হুহু করে বাড়ছিল দেনা। ফলে এদেশে টিপার্টি বলে একটি রক্ষণশীল আন্দোলণের জন্ম হয়। যাদের বক্তব্যই হল, এই ভাবে চললে সরকার দেওলিয়া হয়ে যাবে এবং বেহিসাবী সরকারি খরচ চলবে না। গত ২০১০ সালের কংগ্রেস নির্বাচনে তারা ৬০ জনকে জেতাতে সমর্থ হয় এবং যার ফলে কংগ্রেসে ডেমোক্রাটরা সংখ্যালঘু। ফলে, গত সপ্তাহে ডেটলিমিট বা ধারের পরিসীমা বাড়াতে গিয়ে ওয়াশিংটনে চলে টানা দুই সপ্তাহের নাটক। এবং মোটামুটি ধারের লিমিট বাড়ালেও ঠিক হয়, সরকার খরচ কমাবে প্রথম ধাক্কায় প্রায় ৯০০ বিলিয়ান ডলার, দ্বিতীয় ধাক্কায় ১২০০ বিলিয়ান ডলার।

[৩]
এই মন্দার বাজারে আমেরিকান সরকার যদি এত খরচ কাটে তার ফল কি হবে?
এমনিতে আমেরিকাতে ৯% চাকরি সরকারি বা সরকারের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। কিন্ত এর প্রভাব আমেরিকান অর্থনীতির ওপর হবে দীর্ঘস্থায়ী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গবেষণা, ডিফেন্স সর্বত্র এর প্রভাব পড়বে। সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে স্বাস্থ্য বা বায়ো রিসার্চে। উচ্চশিক্ষার জন্যে যারা আমেরিকাতে আসতে চাইছে, তাদের আসা খুব কঠিন হয়ে যাবে। কারন তারা আসে টিচিং এসিস্টটেন্ট হিসাবে এবং সেই টাকাট আসে হয় সরকার থেকে বা ছাত্রদের টিউশন থেকে। আর ছাত্রদের টিউশন আসে স্টুডেন্ট লোন থেকে। এখন সর্বত্রই কাটছাঁট।

আমি ওয়াশিংটন ডিসির খুব কাছে থাকি এবং এখানে সরকারি ছাঁটের প্রভাব হবে আরো বেশী। শুধু ৯০০ বিলিয়ান ছাঁটাইতেই এই রাজ্যের ২৫০,০০০ লোক কাজ হারাবে যেহেতু এই রাজ্যে সরকারি কর্মচারী বা সরকারি অনুদানে চলা চাকরি সব থেকে বেশী। যা এই রাজ্যের মোট কর্মক্ষম লোকের সংখ্যার প্রায় ১৫-২০%।

ফলে আমেরিকার সামনে কি দিন আসছে বলার অপেক্ষা রাখে না।

[৪]

কিন্ত প্রশ্ন উঠবে, কেন তাহলে সরকারি অনুদানে ছাঁটাই হচ্ছে? সবাই একমত, আয়ের সাথে ব্যয় মেলাতে হবে। কিন্ত তাহলে বড়লোকদের ওপর বেশী ট্যাক্স না কেন? পৃথিবীর ৪০% ধনী আমেরিকাতে! তাদের ওপর বর্ধিত কর না চাপিয়ে কেন ছাঁটাই করা হবে সরকারকে?
এই বিতর্কই এখন আমেরিকান রাজনীতির সর্বত্র জুরে। প্রতিদিন টিভি খুললে এই বিতর্কের ট্রেন চলতেই থাকে, স্টেশনের দেখা মেলে না!

রিপাবলিকানদের দুটি মূল বক্তব্য,

(১) টাক্স বাড়ালে অর্থনীতি এবং চাকরির বৃদ্ধি কমবে। কারন আমেরিকাতে ৭০% চাকরি দেয় ছোট ব্যবসা। তাদের ওপর বর্ধিত কর, অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে।

(২) ইউরোপে ট্যাক্স বাড়িয়েও, লোন ডিফল্ট আটকানো যাচ্ছে না। গ্রীসকে অক্সিজেন দিয়ে চালানো হচ্ছে। ইটালী এবং স্পেন প্রায় লোন ডিফল্টের পথে। সুতরাং সরকারি খরচ ছাঁটাই এর বিকল্প নেই।
বলাই বাহুল্য (১) এর সপক্ষে কোনদিন কোন সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রমাণ আমি দেখি নি।

(২) এর যুক্তিতে সারবত্তা আছে। খরচ ছাঁটাই কিছুটা করতেই হবে। খরচে রাশ না কমালে, শুধু ট্যাক্স বাড়িয়ে এই বিপদ এড়ানো যাবে না, তা সত্য। এটা নিয়েও কোন বিতর্ক নেই। বিতর্ক এখানেই যে ট্যাক্স না বাড়িয়ে শুধু সরকার ছেঁটে কি এই কাজ করা ঠিক? বিশেষত এমন মন্দার সময় এখন।

তাহলে রিপাবলিকানদের বক্তব্য কেন শুনতে হচ্ছে? যেখানে আমেরিকার ৬০% লোক সরাসরি বলছে বড়লোকদের ওপর ট্যাক্স বসুক?

এটি আসলেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দুর্বলতা। দু বছর আগে ডেমোক্রাটদের হাতেই ছিল সেনেট এবং কংগ্রেস। তখন বড়লোকদের ওপর বর্ধিত কর বসাতেই পারত তারা। সেটা না করে, গত ৮০০ দিনে কোন বাজেটই পাশ করে নি তারা। তার বদলে শুধু সরকারি খরচ বাড়িয়ে গেছে।

ডেমোক্রাটদের এই ডবল স্টান্ডার্ড বা দ্বিচারী বা দ্বিমুখী আচরন, আজকের ক্রাইসিসের জন্যে অনেক অংশে দায়ী। ডেমোক্রাটদের ভোটার বেস হচ্ছে গরীব অংশ-যাদের সরকারি চিকিৎসা এবং শিক্ষা দরকার। ফলে তারা সরকারি খরচ বাড়িয়েছে, তাদের ভোট বেস অক্ষুণ্ণ রাখতে। তাতে আপত্তি নেই। কিন্ত সেই বর্ধিত খরচের জন্যে বর্ধিত আয় দরকার। তার জন্যে বড়লোকদের ওপর ট্যাক্স বসানো নিয়ে কোন বিল তারা আনলো না। ফলে সরকারের সংকট শুরু হল এবং সেটা দেখিয়ে রিপাবলিকানরা জিতে গেল।

কিন্ত ধণীদের ওপর কেন কর বসালো না ডেমোক্রাটরা? তারাত ডেমোক্রাটদের ভোট দিচ্ছে না! তাহলে ? রহস্যটা কি?

এটা আমেরিকান রাজনীতির কালো দিক। নির্বাচনী ফান্ড এই দেশে মূলত ধনীরাই দিয়ে থাকে এবং নির্বাচনে লড়তে গেলে ডেমোক্রাট বা রিপাবলিকান পার্থীদের সেই ধনী শ্রেনীর কাছেই হাত পাততে হবে। এবং প্রতিটি ধনী ব্যক্তি এই দেশে দুই পার্টির নির্বাচনী তহবিলে টাকা দেয়। তাদের টাকাতেই লড়তে হয় নির্বাচন। তাদের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা আসলেই নেই ডেমোক্রাটদের। তারা ধণী শ্রেনীর বিরুদ্ধে বড় বড় ডায়ালোগ দিয়েই খালাস-যা তোকে ছেরে দিলাম টাইপের ঢপবাজি ওবামাও অনেকদিন চালাচ্ছেন। আসল সত্যি কথাটা আমেরিকান জনগণও জানে।

[৫]
আমেরিকান বাজেট ছাঁটাই আসু মন্দার একমাত্র কারন না। এর সাথে গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া-- ইটালি লোন ডিফল্ট করতে পারে। গ্রীসের মতন ছোট দেশকেই বাঁচানো যাচ্ছে না-এর ওপর তার থেকে প্রায় দশগুন বড় একট অর্থনীতি দেওলিয়া হলে, ইউরোপের ব্যাঙ্কিং সিস্টেম ধ্বসে যাবে। ইউরোপে ওয়েল ফেয়ার অর্থনীতির দিন শেষ। সরকার সেখানে আরো বেশী ছাঁটাই করবে। ইউরোপে শিক্ষা,স্বাস্থ্য এসব আর বিনামূল্যে কেও পাবে না। সেদিন শেষ।

তবে মন্দের ভাল এই যে বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানীগুলি লাভজনক এবং সেখানে মন্দা নেই। মন্দার সময় তারা প্রচুর ছাঁটাই করেছে-ফলে মন্দার পরবর্তী বাজারে প্রতিটা প্রাইভেট কোম্পানীর অবস্থা বেশ ভাল এখন। বর্তমানের মন্দা মূলত বেহিসাবী রাজনীতির জন্যে। রক্ষণশীল বা উদারপন্থী-কেওই একটি মধ্যম গ্রাউন্ডে আসতে চাইছে না। কিছুটা সরকারি খরচ ছাঁটাই, এবং কিছুটা কর বৃদ্ধি-এই ভাবেই এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। ডেমোক্রাটরা এখন তাই বলছেন-কিন্ত যখন তাদের হাতে ক্ষমতা ছিল-তখন বিল পাশ করেন নি কেন?
তবে অবস্থা যেদিকেই যাক, আমেরিকার খারাপ অর্থনীতি মানে গোটা বিশ্বের নাভিশ্বাস উঠবে।

Monday, August 1, 2011

সংশোধিত বামপন্থী



৩০,০০০ ভোটে হারার পর গৌতম বাবুর উপলদ্ধি, এই বাম বাজারে খাবে না।
বাজারে চালাতে নতুন প্রোডাক্ট- সংশোধিত বাম। সেটি পেটে দেয় না পাতে খায়, উনিই জানেন-কিন্ত রাজ্যবাসী প্রশ্ন করতেই পারেন, সংশোধিত বাম মানে আরো বাম না ডান দিক? কোন দিক সেটি?

পশ্চিম বঙ্গে বামপন্থী তিন প্রকার।
বামাদর্শে বিশ্বাসী কিন্ত মাঠে নেমে রাজনীতি না করে, ধনতন্ত্রের সেবাদাস হয়েই জীবন কাটাবেন। এদের বামপন্থা মৃণাল সেনে আটকিয়ে। এরা অনেক আগেই সিপিএম ছেরে তৃনমূলে।
পারিবারিক আদর্শের কারনে বাম রাজনীতি করেন বা বিশ্বাস করেন-সিপিএমের তথাকথিত বাম এই গোষ্ঠির। এদের বাম সিপিএম এবং গণশক্তির আঠাতে আটকে আছে।
বামাদর্শে বিশ্বাসী এবং জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করেন-এরা খ্যাপাটে নক্সাল। সিপিএমের ঘোর শত্রু।
তাহলে গৌতমবাবু যে বামেদের সংস্কারের কথা বলছেন-তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর বাম-মূলত পারিবারিক ঐতিহ্যে বাম। কিন্ত এদের মূল সমস্যা -এরা স্বাধীন চিন্তার মালিক নন। পলিটখুড়োরা পাঁজি দেখে যা ব্যখ্যা দেবে, সেটাই এরা মানে। পলিটখুড়ো যখন বলেছিল টাটার পা চাটতে-এরা তখন সেটাকেই সঠিক এবং বাস্তববাদি বাম বলে ঊদবাহু নেত্য করেছে।
এই অধঃপতিত বামেদের একটাই সংস্কার সম্ভব। স্বাধীন চিন্তা এবং যুক্তির বিকাশ যাতে দল বেঁধে পলিটখুরোরা বখলেসে টান খেয়ে ঘেও ঘেও না করে। চিন্তা এবং যুক্তিশক্তির বিকাশ হলে, মানুষ সাধারনত বিচক্ষন হয়-ডান বা বাম হয় না-সোজা পথে চলে। তবুও বাম সংস্কারের এটাই একমাত্র পথ। বকলেস বাঁধা কুকুরগুলিকে মানুষ হতে হবে-নইলে সিপিএমের সমর্থক এবং সিপিএম মানে পশ্চিম বঙ্গের জনগণের কাছে ঘেও ঘেও করা হার্মাদ কুকুরের ইমেজই ভেসে ওঠে।