জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে কি ভাল রেজাল্ট করতেই হবে? জীবন এবং জীবিকা, পর্ব-১৩
এটা রেজাল্টের মরশুম। কারুর ছেলে ৭০% ত কারুর মেয়ে ৯৫%। মাধ্যমিক, আইএসসি, সিবিএসি-সব বোর্ডের রেজাল্ট গত দুই সপ্তাহে আপনারা পেয়ে গেছেন। যাদের ছেলেমেয়েরা ৯০%+ পেয়েছে, তাদের উচ্ছ্বাসিত হবার কারন নেই। আবার যাদের ছেলেমেয়েরা ৬০-৭০% পেয়েছে, তাদের ও মুশড়ে থাকার কারন নেই। স্কুলের এইসব রেজাল্ট জীবিকার ক্ষেত্রে ১০% ও কাজে আসবে না। আর জীবনে সাফল্যের ক্ষেত্রে ১% ও না। নরেন্দ্রপুরে ১-২০ এর মধ্যে র্যাঙ্ক করা প্রচুর ছেলেরা পড়তে আসে। পরে প্রায় সবাই হারিয়ে যায়।
দেখুন আমি বলছি না রেজাল্টের একদম কোন গুরুত্ব নেই। কিন্ত এখানে দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নের আমি উত্তর দিতে চাইছি।
এক, তাহলে যারা বাজে রেজাল্ট করেছে, কম % পেয়েছে, তাদের ভবিষ্যত নেই? নাকি তাদের ভবিষ্যত "ভাল রেজাল্ট করা" ছাত্রছাত্রীদের থেকে খারাপ?
এক্ষেত্রে আমার উত্তর হচ্ছে, যারা কম % পেয়েছে, তারা যদি স্ট্রাটেজি নিয়ে ঠিক সাবজেক্ট সিলেক্ট করে, ঠিক ঠাক কোম্পানীতে হাতে কলমে ইন্টার্নশিপ নেয়, তাদের ভবিষ্যত যারা ভাল % পেয়েছে, তাদের থেকেও উজ্জ্বল হতে পারে। এবং এক্সাক্টলি তাই হয়। আমি প্রচুর উদাহরন নিজে দেখছি।
কেন? কারন গত দু বছরে আমেরিকা এবং ভারতের সব থেকে বড় আই টি কোম্পানীগুলি [ মাইক্রোসফট, আই বি এম, টিসিএস, ইনফোসিস ইত্যাদি ] তাদের জব ইন্টারভিউ বা রিক্রুট্মেন্ট পদ্ধতি ওপেন টু অল করে দিয়েছে। বেসিক্যালি, তাদের নিজস্ব পরীক্ষা এবং ইন্টার্নশিপ সিস্টেম আছে। সেই পরীক্ষাতে যারা ক্র্যাক করতে পারবে, তারাই চান্স পাবে। তারা কারুর ডিগ্রি সার্টিফিকেট, মার্কস এসব দেখছেই না। বেসিক্যালি আজকাল আরো কোন কর্পরেট মার্কস, সার্টিফিকেট, ডিগ্রি দেখে না। দেখে, কাজ শিখেছে কি না। ইন্টার্নশিপ আছে কি না [ জীবন এবং জীবিকা পর্বের ৬ নাম্বার এবং ২, ৩ নাম্বার লেখাটি প্লিজ দেখে নিন]।
দেখুন, আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে দুনিয়া আলাদা ছিল। সেটা ছিল সরকারি চাকরির সময়। সেখানে ভাল মার্কস, ভাল রেজাল্ট এসবের দরকার ছিল। সরকারি স্কুলে, সরকারি চাকরিতে ঢুকতে ওসব লাগত। এখন যা অবস্থা সরকার কি করে শিক্ষকদের, সরকারি কর্মচারিদের মাইনে দেবে তাই জানে না। তাও অধিকাংশ স্থলে, সরকারি চাকরি আগের থেকে অর্ধেক হয়ে গেছে। ভোটের মডেল বদলে গেছে। এখন সরকারি চাকরি না, যে সরকার যত ভোটারদের দান খয়রাতি করবে, সে ভোটে জিতবে। ফলে সরকারি চাকরির সংখ্যা তারা বকলমে কমাচ্ছে। এটা গোটা পৃথিবীর ট্রেন্ড। বঙ্গ ব্যতিক্রম নহে। আর সব থেকে বড় কথা, সরকারি চাকরি মাত্র ১% ছেলেমেয়েদের জীবিকার সংস্থান করে। সেখানে আই টি করে প্রায় ৬%। প্রাইভেট সেক্টর ১৪%।
দুই , যারা ভাল মার্কস পেয়েছে, তাদের ভবিষ্যত কি উজ্জ্বল? ভাল মার্কস কি প্রমান করে তারা মেধাবী?
এক্ষেত্রে আমার উত্তর হল, সবাই সমান বুদ্ধি নিয়েই জন্মায়। কিন্ত পরিবেশ, বাবা-মায়ের ভাল মেন্টরিং, গাইডেন্স এসবের ওপর নির্ভর করে ছেলে-মেয়েটির মানসিক বিকাশ কেমন হবে, সেলফ ড্রাইভ কেমন। আমি এই নিয়ে পর্ব-৯ তে লিখেছি। মেধা নিয়ে কেউ জন্মায় না। বাবা-মা-পরিবেশ-চাহিদা, তাদের মেধাবী করে তোলে।
কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করে এসে পরীক্ষায় বমি করার ক্ষমতাকে মেধা বলে না। বর্তমানে সব কর্পরেটে চাহিদা একটাই-কারা সেলফ লার্নার, কারা দ্রুত নিজেদের ভুল থেকে শেখে, কারা স্বাধীন ভাবে কাজ করতে সক্ষম। এর সাথে ভারতের কোন শিক্ষা ব্যবস্থার কোন সম্পর্ক নেই। যারজন্য, ভারতে নতুন শিক্ষানীতি আসতে চলেছে, যাতে এই পরিবর্তিত বিশ্বে ভারতীয় শিশুরা ঠিক ঠাক শিক্ষা পায়।
কিন্ত ওই যে ১৪% প্রাইভেট সেক্টর যেখানে ছেলেমেয়েটিকে চাকরি পেতে হবে, সেখানে কিন্ত মার্কসের গুরুত্ব নেই। তারা দেখে, সে "স্কিল্ড" কি না,। কাজ ভাল শিখেছে কি না। কতটা ইন্টার্নশিপ করেছে।
আমি আমেরিকা এবং ভারতে -দুটো দেশেই সংস্থা চালাচ্ছি। সেই সূত্রে প্রচুর সিভি প্রতিদিন আসে। আমেরিকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের রিসার্চ সেন্টারে গোটা বিশ্ব থেকে প্রতিসপ্তাহে ২০-৩০ টা রেজুমে আসে- সবাই তাদের দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পুটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্সে মাস্টার্স ব্যাচেলর করেছে। আমরা কেউ মার্কসের দিকে তাকাই না। দেখি ছেলে বা মেয়েটির রিসার্চ বা ওয়ার্ক এপ্টিচুড কি আছে- হাতে কলমে কাজ করার কি কি অভিজ্ঞতা আছে।
বরং লিডারশিপ স্কিল , অন্যকে সাহায্য করার প্রবনতা, পড়াশোনার একটা সাবজেক্টকে ভালোবাসা, নিজেকের সব সময় ভাল কাজে নিয়োজিত করার জন্য ইচ্ছা, মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদি বিষয়গুলো যা নিয়ে অভিভাবকরা একদম সময় দেন না- সেগুলোই জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সবার আগে দরকার। এসব নিয়েই লিখছি, জীবন এবং জীবিকা সিরিজ। আমার অভিজ্ঞতা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক রিসার্চ যা বলে, তাই লিখছি।
আমাকে অনেকেই ইনবক্স করছেন। যারা চেনেন তারা হোয়াটসআপ করছেন নিজের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আমি সব সময় বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কেরিয়ার, পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা পছন্দ করি। কিন্ত দুর্ভাগ্য যে হাতে সময় নেই। ফলে আপনারা যদি আমার ইনবক্সে বা কমেন্টে আপনার প্রশ্নটি লিখে যান, আমার ভাল হয়- জীবন এবং জীবিকার আগামী পর্বগুলোতে তা আলোচনা করব। অনেক ক্ষেত্রেই আপনাদের প্রশ্নের উত্তর জীবন এবং জীবিকার ১ থেকে ১০ পর্বের মধ্যেই আছে।
আমার টাইম লাইনে এখন শুধু- এই জীবন এবং জীবিকা সিরিজটাই রেখেছি-যাতে এই সিরিজের সবকটা লেখা একসাথে পান। আপনারা আমার টাইম লাইনে জীবন এবং জীবিকার সিরিজের ১৩ টা লেখাই পাবেন যেখানে আপনাদের ছেলেমেয়েদের কেরিয়ার নিয়ে অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর আমি দেওয়ার চেষ্টা করেছি । আর না পেলে, কমেন্ট বক্স বা ইনবক্সে জিজ্ঞেস করুন। আগামী পর্বে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। আর সেই উত্তরগুলো পেতে গেলে, প্রোফাইল লাইক বাটনে ক্লিক করে যান-যাতে আগামী পর্বের ফিডগুলো আপনার টাইম লাইনে আসে।
No comments:
Post a Comment