Tuesday, December 28, 2010

স্টিফেন হকিং এর "মৃত" দর্শনের সন্ধানে


গ্রান্ড ডিজাইন বইটির প্রথম পাতায়, হকিং দর্শন শাস্ত্রকে মৃত ঘোষনা করে, লেখা শুরু করেছেন। কারন হিসাবে উনি বলেছেন দার্শনিকরা বিজ্ঞানের নব আবিস্কার এবং তত্ত্বের সাথে আর পাল্লা দিতে পারছেন না। পরে বিশ্ববিখ্যাত কিছু দার্শনিক গালাগাল দেওয়া শুরু করলে, উনি বোধ হয় একটি বিবৃতি দেন উনাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উনি বলতে চেয়েছিলেন, দর্শন শাস্ত্রে বিজ্ঞানের আরো ব্যাপক প্রয়োগ হওয়া উচিত। যদিও কোথায় উনি এটা বলেছেন, সেটা গুগল করে পেলাম না।


যাই হোক কেও দর্শন শাস্ত্রকে মৃত ঘোষনা করলে, দর্শনের ইতিহাস নিয়ে অবগত যে কেও হেঁসে ফেলবেন। কারন দর্শনকে মৃত ঘোষনা করার ইতিহাস ৩০০০ বছরের পুরানো এবং ধারাবাহিক। তাই দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক পল থ্যাগাড, হকিং এর উক্তি শুনে প্রথমেই মন্তব্য করেন ঃ


But those who ignore philosophy are condemned to repeat it. And those who disparage philosophy are usually slaves of some defunct philosopher.


দর্শনকে মৃত ঘোষনা করার ইতিহাস এত দীর্ঘ ( যা গ্রীকদের আমল থেকে শুরু হয়েছে) -যে "দর্শন মৃত" সেটাও দর্শনের একটি বিশেষ শাখা হওয়ার যোগ্যতা রাখে বলে বিট্রান্ড রাশেল মন্তব্য করেছিলেন। "দর্শন মৃত" র ইতিহাস নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার নেই -যারা "দর্শনকে মেরে ফেলার" এই তিন হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে জানতে চান-এই লেখাটা পড়তে পারেন।

http://www.earlham.edu/~peters/writing/endphilo.htm


আমরা স্টিফেন হকিং এর কথায় ফিরে আসি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী সন্দেহ নেই। কিন্ত দর্শন নিয়ে তিনি যে কটি কথা বলেছেন, সেগুলি ঠিক কি এবং তাই নিয়ে দর্শন শাস্ত্রের লোকেরা কি ভাবে এটাও জানা দরকার। জানা দরকার, ঠিক ৩০০ বছর আগে বিখ্যাত দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্টের ভুলেরই তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন।


হকিং এর দর্শন নিয়ে বক্তব্যের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক প্রবন্ধ লিখেছেন-আমি এর মধ্যে থেকে সব থেকে ভাল যেটি মনে হয়েছে-সেটির ওপর ভিত্তি করেই লেখাটি লিখছি। তাই তার রেফারেন্সও আগে দিয়ে রাখিঃ


http://www.psychologytoday.com/blog/hot-thought/201011/is-philosophy-dead


এবার বিচার শুরু করা যাক। প্রথমে অধ্যাপক পল থ্যাগাডের (http://en.wikipedia.org/wiki/Paul_Thagard)
সমালোচনাটির ভাবানুবাদ করি। বঙ্গানুবাদ করলে দর্শনের অনেক টার্মের জন্যে অনেকেই বুঝবে না। তারপরে নিজের বিশ্লেষনে আসব।


******************
স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্ড মিনলোর বাস্তবতা নিয়ে অনুকল্পগুলি নিম্নরূপঃ
.
ক) " বাস্তবতা" তত্ত্ব নিরেপেক্ষ হতে পারে না

খ) একটি মডেলকে "বাস্তবতার" ভাল মডেল বলা যাবে
যদি তা

১) সুন্দর হয়
২) যদি এম্পিরিক্যাল ফিটিং প্যারামিটার কম থাকে
৩) পরীক্ষালদ্ধ সব রেজাল্টের সাথে মিলে যায়
৪) পরীক্ষাগারের রেজাক্ট ভবিষ্যতবানী করতে পারে বা টেস্টেবিলিটির ক্রাইটেরিয়া মানে

গ) একটি ভাল মডেল একটি নিজস্ব "নিরেপেক্ষ" বাস্তবতা

ক) মানা যায় যদি আমরা মেনে নেই-তত্ত্বর ভিত্তি ধারনা।
খ) বিজ্ঞানের দর্শন-নতুন কিছুর বলার নেই।
গ) এই অনুকল্পটি আপত্তিকর। কারন মডেল যে বাস্তবতাকে ধরে, তা সর্বদা আংশিক এবং আপেক্ষিক। তবে এটাকেও আমরা জ্ঞান এবং বাস্তবতার জন্যে একটি দার্শনিক অনুকল্প হিসাবে ধরতে পারি।


এরপর হকিং তার এই দার্শনিক অনুকল্পটিকে বৈজ্ঞানিক উপসংহার হিসাবে চালিয়ে দিলেন। ( ভুলের শুরু এখান থেকেই) ।
তার সিদ্ধান্ত গুলি আদৌ বৈজ্ঞানিক না দার্শনিক?

হকিং এর বক্তব্যগুলি বিশ্লেষন করা যাকঃ

D. "The universe does not have just a single existence or history, but rather every possible version of the universe exists simultaneously."
( এই মহাবিশ্বের কোন একক অস্তিত্ব নেই-বা একক ইতিহাস নেই। অসংখ্য মহাবিশ্ব একসাথে আছে।)

E. "The universe itself has no single history, nor even an independent existence."
( এই মহাবিশ্বের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই- নেই কোন একক ইতিহাস)

F. "We now have a candidate for the ultimate theory of everything, if indeed one exists, called M-theory."
( এম তত্ত্ব থিওরী এভ্রিথিং এর যোগ্য দাবীদার)

G. "M-theory predicts that a great many universes were created out of nothing"
( এম তত্ত্ব শুন্য থেকে বহুবিশ্বের উৎপত্তির ভবিষ্যতবাণী দেয়)
H. "The universe, according to quantum physics, has no single past, or history."
( কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী মহাবিশ্বের কোন একক অতীত বা ইতিহাস নেই)
I. "The universe doesn't have just a single history, but every possible history, each with its own probability."
( মহাবিশ্বের প্রতিটি ইতিহাসেরই কিছু না কিছু সম্ভাবনা আছে।)

হকিং এর দাবী- যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রচুর প্রমান পাওয়া গেছে, সেহেতু উপোরক্ত উপসংহারগুলি সত্য।
কিন্ত এখানে একটা ভুল হল। হকিং এর দাবীগুলি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি বিশেষ ব্যাখ্যা মেনে-এবং মনে রাখতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অসংখ্য ব্যাখ্যা আছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্য ব্যাখ্যা ধরে এগোলে বহুবিশ্ব নিয়ে সিদ্ধান্তগুলি আলাদা হবে। এবং এম তত্ত্ব টেস্টেবেলিটি মানে না। অর্থাৎ সেটিকে ভাল মডেল আমরা বলতে পারি না ( (খ) এর ৪ দেখুন-ভাল মডেল হতে গেলে কি হতে হয়)। সুতরাং মহাবিশ্ব নিয়ে হকিংসের সিদ্ধান্তগুলি যত না বৈজ্ঞানিক, তার থেকে অনেক বেশী "দার্শনিক"।

তাহলে আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে বিজ্ঞান এবং দর্শনের সীমারেখা এবং সম্পর্ক কি ভাবে নির্নীত হবে।

এই ব্যাপারে দর্শনের দুটি ভাগ।

একটি হচ্ছে ন্যাচারালিস্টিক দর্শন। এরিস্টটল, লকে, মিলস, হিউম, ডিউ, কুইন থেকে সব বিজ্ঞানের দার্শনিক এই পর্যায় ভুক্ত। এখানে মূল বক্তব্য হচ্ছে-প্রকৃতি, জ্ঞান, বাস্তবতা, নৈতিকতা এবং ব্যাখ্যার ভিত্তি হবে বিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং পর্যবেক্ষন। অর্থাৎ হকিংস যা দাবী করেছেন, তা নতুন কিছু না-সেটি ন্যাচারিলিস্টিক দর্শনের মধ্যে পরে। কিন্ত এখানে দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের পার্থক্য হচ্ছে বিজ্ঞানের সীমানা "কি হচ্ছে" এবং "কেন হচ্ছে" তার মধ্যে বাঁধা। দর্শন তার বাইরে গিয়েও কি হওয়া উচিত সেই প্রশ্ন করে। যেমন " জীবনের উদ্দেশ্য কি",
"ঈশ্বর থাকা উচি্ত না অনুচিত" -ইত্যাদি প্রশ্নের উৎপত্তি দর্শন থেকে। কিন্ত এর উত্তর বিজ্ঞান দিয়ে দিতে হবে। এটা হচ্ছে ন্যাচারালিস্টদের বক্তব্য।

এন্টি-ন্যাচারালিস্টরা এই বক্তব্য মানেন না। তাদের বক্তব্য দর্শন এবং বিজ্ঞান এক না, কারন দর্শনে জ্ঞানের ভিত্তি হতে পারে অনেক কিছু, যা বিজ্ঞানের সীমানাতে পড়ে না-

শুধু যুক্তি ( যেমন ভারতীয় দর্শনের একটি উপপাদ্যঃ মহাবিশ্ব অনন্ত কিন্ত মানুষ সীমাবদ্ধ-সুতরাং অনন্ত মহাবিশ্বকে সম্পূর্ন ভাবে কোনদিন জানা সম্ভব না)

ভাষা এবং যুক্তি ( দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন একটি উদাহরন। যেমন "দর্শন মৃত" শুধু এই দুই শব্দের অসংখ্য মানে হতে পারে। )

অভিজ্ঞতা বাইরেও যে সত্য আছে সেখানে চর্চা করা ( যেমন সব ধর্মীয় দর্শন এই ক্যাটেগরীতে পড়ে। অর্থাৎ ঈশ্বর কি, তার স্বরূপ কি, ঈশ্বর আছেন না নেই-...)

প্রয়োজন ( বা প্রয়োজন এবং যুক্তি) -যেমন ধরুন ঐশ্বরীয় দর্শনের প্রয়োজনীয়তা আছে না নেই? আত্মহত্যার প্রয়োজন আছে না নেই? জীবনের কোন অর্থ আছে না নেই?

অথবা শুধু ধারনা-বহুবিশ্ব বা মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্স এর ভাল উদাহরন। এগুলোর খুব দুর্বল মডেল-দার্শনিক চিন্তা বেশী। সুতরাং এগুলোকে বিজ্ঞান বলা যাবে না-বিজ্ঞানের ডিমার্কেশন অনুযায়ী। কিন্ত টেস্টেবিলিটির ফলে যখন আস্তে আস্তে এগুলি ভাল মডেল হতে থাকবে, ধারনাগুলি দর্শন থেকে বিজ্ঞানের সীমানাতে ঢুকে যাবে।

হকিং বাস্তবতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই ত বলে দিলেন-কিন্ত কোন "জ্ঞানের" ভিত্তিতে বললেন? সেই জ্ঞান বৈজ্ঞানিক না দার্শনিক? আমরা দেখলাম সেই জ্ঞান অনেক বেশী দার্শনিক, যত না বৈজ্ঞানিক।

হকিং এর "মডেল" নির্ভর বাস্তবতা দর্শন শাস্ত্রে ৩০০ বছরের পুরানো। বাস্তবতা যে "মন" নির্ভর-এই ধারনা প্রথম আনেন ইম্যানুয়েল কান্ট। হকিং তার জেলি ফিসের যে উদাহরন দিয়েছেন বাস্তবতা কে বোঝাতে-যে বাস্তবতা অভিজ্ঞতা নির্ভর-সেটি প্রথম বলে যান ইম্যানুয়েল কান্ট। প্রায় ৩০০ বছর আগে।

কিন্ত আমরা বিজ্ঞান থেকে কি জানি? মানুষের মনের উদ্ভব অতিনবীন ঘটনা। এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব মানুষের জন্মের অনেক আগে থেকেই ছিল। মডেল টা এম থিওরী না এন থিওরী, তার ওপর নির্ভর করে এই মহাবিশ্বগুলি চলছে না। তত্ত্ব উন্নত হতেই থাকবে, বদলাবে, বাতিল হবে। সুতরাং এই মহাবিশ্বের একটি স্বাধীন অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। সেই জন্যে দর্শন শাস্ত্রে বাস্তবতার অনেক ভাগ আছে । কান্টিয়ান বাস্তবতা বা হকিং যে বাস্তবতার কথা বলেছেন, সেটাকে বলে ফেনোমেনোলজিক্যাল বাস্তবতা। এর বাইরেও দর্শন শাস্ত্রে আরো ৩০ রকমের বাস্তবতা আছে। এবং বাস্তবতার সাথে মন এবং মহাবিশ্বের জটিল সম্পর্কের সমস্যাটি বিজ্ঞানের সীমানাতে পড়ে না।

মার্ক টুইন মারা গেছেন বলে একবার মিথ্যে রটেছিল। উনি সেটা শুনে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুসংবাদটি বড় বেশী রকমের অতিরঞ্জন।

*****************************************************
প্রবন্ধটি লেখার আমার কোন দরকার ছিল না। বাস্তবতা বা রিয়ালিজম নিয়ে সামান্য জ্ঞান থাকলে বা একটু ওয়াকি ঘাঁটলেই বোঝা যেত হকিং এর দর্শন নিয়ে পড়াশোনা মারাত্মক রকমের কম এবং তিনি চাকা পুনরাবিস্কার করেছেন মাত্র। আমি সেটা মুক্তমনাতে লিখতেই, বিশিষ্ট কিছু সববোদ্ধার দল গালাগাল দেওয়া শুরু করল। আরেকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক দাবী করলেন দর্শনের আলোচনাতে নাকি আজকাল বিজ্ঞানীদেরই ডাকা হয়! অবশ্য ভারতে যেকোন লোকের কাছে তার গুরুদেব হচ্ছে সব থেকে বড় দার্শনিক। অনেক হিন্দু বাঙালি বিশ্বাস করে বিবেকানন্দ বা রামকৃষ্ণর মতন দার্শনিক আর কোনদিন জন্মায় নি। আবার অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথের মতন বড় দার্শনিক জন্মায় নি। আরেক বিশিষ্ট বোদ্ধা, দর্শন এবং ধর্মকে এক করে বোঝাতে চাইল বিজ্ঞান যেভাবে ধর্মের শেষ ঘোষনা করেছে, সেই ভাবে দর্শনের শেষ ঘোষনা করবে!

যাইহোক এস্ট্রলজার এবং এস্ট্রনমার যেমন এক না -তেমন ধর্মীয় গুরুদেব বা বিজ্ঞানী বা রবীন্দ্রনাথ -এদের সাথে প্রথাগত শিক্ষিত দার্শনিকদের পার্থক্যটা ততটাই।

আসলে সমস্যা হয়েছে এই, আমাদের দেশে একদম শেষের বেঞ্চের অগা-মগা ছেলেরা দর্শন, ইতিহাস এই সব পড়তে যায়। আমাদের ধারনা জন্মেছে দর্শন হচ্ছে একদম সোজা ব্যাপার-কারন লাস্ট বেঞ্চাররা পড়ে এবং পাশ ও করে! বাস্তব হচ্ছে আমি যত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তার মধ্যে সর্বাধিক কঠিন এবং গভীর হচ্ছে দর্শন। এটি এমন একটি বিষয় যা পড়ে বোঝা যায় না-প্রশ্ন এবং দ্বন্দ তৈরী করে বুঝতে হয়। এবং তারপরেও অধিকাংশ প্রশ্ন এবং দ্বন্দ অমীমাংসিত থাকে। এবং সেটাই দর্শনের আসল শক্তি।

Saturday, December 25, 2010

বিনায়ক সেনের বিচার এবং একটি ভারতীয় প্রহসন


পৃথিবীতে মাথা নীচু করে শ্রদ্ধা পাওয়ার মতন মানুষ ক্রমশ লুপ্ত।

কে জানে মানুষ ব্যাপারটাই হয়ত আস্তে আস্তে লুপ্তপায় প্রানী হবে যাদের দেখা পাওয়া যাবে শুধু জেল হাজতে। যেমনটা গান্ধী বলেছিলেন।

ভারতে ব্যাবসায়ী, রাজনীতি, পুলিশ বিচার ব্যাবস্থা-সব কিছুই তাদের দখলে! এই তাহাদের বিরুদ্ধে ছত্রিশগড়ে যে লোকটি গরীবদের ঘূরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাতো-তাদের চিকিৎসা করে গেল বিনা পয়সায়, ছত্রিশ গরের দুই মহামান্য ছাগল বিচারক, যারা সিস্টেমের কাছে সব কিছু বিকিয়ে দিয়েছন-তারা যাবজ্জীপন কারাদন্ড দিলেন বিনায়ক সেন কে।


তার বিরুদ্ধে মাওবাদিদের সাহায্য করার অভিযোগ।
তেহেলকার এই লিঙ্ক দেখলেই বোঝা যাবে কোন অভিযোগের কোন প্রমাণ বা সারবত্তা নেই।
' তার বিরুদ্ধে আদালতে পেশ করা প্রমানগুলি এতই হাস্যকর যে এটা পরিস্কার বিচারকরা সম্পুর্ন একটি পক্ষপাতপূর্ন রায় দিয়েছেন।

এই রকম একটা গল্প ফেঁদে রাষ্ট্র, নাগরিক অধিকারের দাবীতে যারা আন্দোলন করেন, তাদের কাছে একটা বার্তা পাঠালো।

বার্তাটা সামান্য- ডঃ বিনায়ক সেনের মতন একজন আন্তর্জাতিক ভাবে বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মীকে আমরা জেলে পাঠানোর ক্ষমতা রাখি। তাই সাধু সাবধান। তোমরা ত চুনোপুঁটি।

মাওবাদি ইনসার্জেন্ট কেন -সেই প্রশ্নে রাষ্ট্রের রাজপুত্র এবং রাজমাতা একমত যে মানুষের বঞ্চনা এবং সবুজ ধ্বংশের বিরুদ্ধে ওরা বন্দুক ধরেছে। বন্দুক না ধরে, গান্ধীর পথে যারা গরীবদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলণটা করতে চাইছিলেন সেই হিমাংশু এবং বিনায়ক সেনের যা অবস্থা করে রাখল ছত্রিশগড় পুলিশ এবার বন্দুক ধরা আটকাবে কি করে??

রাষ্ট্র একটি নিপীড়নের যন্ত্র-একটি নেসেসারী এভিল। যার সাথে আমাদের বাস করতে হয়। কিন্ত রাষ্ট্রের অত্যচারের বিরুধে যেকটি অহিংস গণতান্ত্রিক ব্যাক্তি দাঁড়িয়েছে, তাদের যদি প্রশাসন জেলে ভর্তি করে-তাহলে বন্দুক তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তিটা কি পড়ে রইবে? এটাত পরিস্কার হল, রাষ্ট্রের প্রতিটা যন্ত্র যারা সবুজকে ধ্বংশ করে ওখানে মাইনিং করতে চাই তাদের পক্ষে। বিনায়ক সেনের মতন লোককে না আটকাতে পারলে, ওখানে যেসব হাজার হাজার কোটি টাকার মৌ সাক্ষরিত হয়েছে , তার থেকে সকাকারী দালালরা টাকা লুঠবে কি করে? সেই বখরার টাকাযে মহামান্য বিচারপতি পান নি সেটাই বা কে নিশ্চিত ভাবে বলবে?

বিনায়ক সেনের কেসে রাষ্ট্র এবং তাদের দালালরা জিতে গেলে ভারতের মানুষের পরাজয় হবে। বিনায়ক সেনের ওপর এই আরোপিত দন্ড ভারতের আন্তর্জাতিক লজ্জা। ভারতের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমন চত্রিশগড়ের এই রায়। এর বিরুদ্ধে আপনারা সবাই সরব হোন। বিক্রি হওয়া বিচারপতিরা বুঝুক, ভারতে এখনো মানুষ বাস করে।

Wednesday, December 22, 2010

বিনিয়োগবঙ্গ


বাঙালী আত্মঘাতি কালিদাস বলিয়া ইতিহাসে সমাদৃত। মহাভারত হইতে লর্ড ক্লাইভ-বাঙালী জাতির গুণগান করিয়াছে-ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বোর্ডে লিখিয়াছিলেন বাঙালীর ন্যায় পরশ্রীকাতর জাতি তিনি দুনিয়াতে দেখেন নাই। তাই ইহাদের মধ্যে বিবাদ ঘটাইয়া, মুর্শিদাবাদের মসনদ তিনি অচিরেই দখল করিবেন। ক্লাইভ বুঝিয়াছিলেন বাঙালী সেই জাতি যাহারা নিজেদের বাগানের কলা লইয়া ঝগড়া করিতে বেশী পছন্দ করে। হনুমান আসিয়া কলা খাইয়া গেলেও বাঙালী প্রতিবেশীর সহিত ঝগড়া করিবে-হনুমান তাড়াইবে না।


ক্লাইভের দিন অতীত হইয়াছে-সিরাজদৌল্লা, মিরজাফরদের দল ইতিহাস হইয়াছে-কিন্ত বাঙালী জীবন্ত ফসিল হইয়া আজও বাঁচিয়া আছে। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে প্রথমে বিনিয়োগের বিরুদ্ধে আগুন জ্বলিল-মমতার দল ইহাতে ঘি ঢালিলেন। টাটা সেলিমের দল পালাইল। বাম বাঙালী উচ্ছ্বাসিত হইল-এবং খেত মজুর পিতা কাজ না পাইয়া তাহার কন্যাকে মুম্বাই পাঠাইতে থাকিলেন। জনগণের অধিকার রক্ষা হইয়াছে ইহা আহ্লাদের কথা-গর্বের কথা-কিন্ত শিল্পস্থাপন না হইলে ঘণবসতিপূর্ন বাংলাতে লোকেরা খাইবে কি? সিঙ্গুরে জমি গ্রহণ প্রক্রিয়া ঠিক হয় নাই-ইহা সত্য। কৃষক জমি দিতে বাধ্য নহে। ইহাও মানিতে হইবে। কিন্ত তাহা হইলে, জমি গ্রহনের জন্যে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সর্বদলীয় ফর্মূলা নির্নিত হৌক?


তাহাতে কাহারও উৎসাহ নেই। উৎসাহ শুধু, কাঠি করিতে।


টাটা সেলিম পালাইয়াছে, তাহাতে কিছু ক্ষতি হইলেও তৃণমুল এবং কংগ্রেসের লোকসভা বিজয়, বাংলার সামনে আবার সুযোগ আনিয়াছিল। এবার মমতার রেল প্রকল্পে কাঠি করিতে বুদ্ধ মাঠে নামিলেন।


বাস্তবে অবস্থা দাঁড়াইল এই- বাংলার রাজনীতি দুই নেংটি পাগলের লড়াই এ পর্যবাসিত হইতেছে। দুই পাগল নেংটি পড়িয়া নাচিতেছে-আর একজন অন্যজনের নেংটি ধরিয়া টানিয়া বলিতেছে-তোকে ন্যাংটো করিয়া ছাড়িব।



Tuesday, December 21, 2010

একলা চলোরে ! একটি তৃণমূলী এং কংগ্রেসী নাটক


কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনে মানসদা এবং দীপাবোদি গাহিলেন-

একলা যাব, একলা যাব
তবে সাধিলেই গাইব।

মমতা কহিলেন লে পচা! রাজ্যে আমার পোষ্যরা মরিতেছে, আমি দিল্লীতে দরবার করিতেছি, আর তোরা আসনের জন্যে ভিক্ষাপাত্র ঝনঝনাইতেছিস! কান ঝালা করিসনে, করিলে মুলিয়া দিব। জোট সঙ্গী থাকিব না-তবে ভোট সঙ্গিনী থাকিলেও থাকিতে পারি। সাধিতে হইবে কিন্ত-দাবী করিলে হইবে না। যাহা ভিক্ষাপাত্রে দান করিব, তাহাই গুরুমার আশীর্বাদ বলিয়া মাথায় ছোঁইয়াইতে হইবে। দশ পয়সার দিন নাই বলিয়া হাইকমান্ডের কাছে ট্যাঁ ফোঁ করিলে-খেলিব না। উহা ফাউল বলিয়া গণ্য হইবে।

দীপা বৌদি বলিলেন প্রিয়দা নাই বলিয়া কি আমি নাই ভাবিতেছে মমতা? শঙ্কর সিং বলিলেন-আমি কি নদীয়ার ঘাস খাইয়া পার্টি করিতেছি? মমতা শুনিয়া কহিলেন, মাটিই নাই-আর ইহারা ঘাসের গল্প করিতেছে। আফিঙখোরের দল।

পার্থদা নিশ্চুপ ছিলেন। দিদি কহিলে ভাইদের ও কহিতে হয়। উনি তৃণমূলী আম্পলিফায়ার-দিদির কথাকে আরো উচ্চস্বরের বলিয়া থাকেন এবং পাখি সব, কর রব ডাক ছাড়িতে থাকেন। দিদি কহিতেই পার্থর হুঙ্কার বাহির হইল-কংগ্রেস অস্তিত্বহীন হইয়াছে-আমরা একলাই লড়িব। এই সব কংগ্রেস ভিখিরীর সহিত লাড্ডু ভাগ করিয়া খাইতে তৃণমূলীরা নারাজ।

ইহার পেছনে কিঞ্চিত বোধ বুদ্ধিও কাজ করিতে ছিল। জোট না হইলে ক্ষীরের স্বাদ পাইবার লোভে, কংগ্রেস আরো ভাঙিবে। তাহাতে লাভ তৃণমূলের। ফলে পার্থর হুঙ্কার বাড়িতে থাকিল। আর মানস বিপদ বুঝিয়া মিডিয়ার সামনে গাইতে শুরু করিলেন- দুপয়সা দে না-দে- পঁয়ত্রিশ বছর না খাইয়া আছি-মরিবার পূর্ব একবার লালবাতির গাড়িতে উঠিব-তাহাও তোদের সহ্য হইতেছে না?

জনদেবতা পশ্চিম বঙ্গের ভাগ্যললাট লিখিয়া দিয়াছে-ইহার পরেও তৃণমূলী এবং কংগ্রেসীরা সিপিএমকে বঙ্গোপসাগরে না ডুবাইতে পা্রিলে-জনগন ইহাদের হিমালয়ের নির্বাসনে পাঠাইবে।

Monday, December 20, 2010

জাফর পানাহির জন্যে দুকলম


ইরাণের বিশ্ববরেণ্য পরিচালক জাফর পানাহিকে ছ বছরের জন্যে জেলে পাঠানো হল। সাথে সাথে আগামী ২০ বছর তিনি কোন সিনেমা বানাতে পারবেন না। পারবেন না লিখতে , পারবেন না ইন্টারভিঊ দিতে।

পানাহির সাথে আমার পরিচয় দুটো সিনেমা দিয়েঃ সার্কল আর অফসাইড। দুটিই নারীবাদি নিওরিয়াল সিনেমা। মোল্লাতন্ত্রের শরিয়া আইনে ইরাণে মহিলাদের দুরাবস্থার বাস্তব চিত্র। সেদেশের মায়েরদের অধিকার নেই সস্তানের ওপর। তিনি তালাকের জেরে যেকোন মাকে সন্তান ছেরে চলে যেতে হয়। সেই ধরনের বর্বর শরিয়া আইন ইরানে- যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেলে আছেন ইরানের ৬৪ জন নারীবাদি নেত্রী। কিছুদিন আগেও মোল্লা এবং তাদের স্যাঙাত আহমেদাঞ্জিদের হাত থেকে উদ্ধার পেতে উত্তাল হয়েছে ইরাণ। সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করেছে ইরানের পুলিশ। গ্রেফতার হয়েছে হাজার হাজার বিরোধি, নিহত শতাধিক।

একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার পানাহির মতন একজন মানবিকতাবাদিকে জেলে পুরবে এটাই স্বাভাবিক। গান্ধী অনেকদিন আগেই বলে গেছেন, স্বৈরতন্ত্রে একমাত্র জেল হাজতেই মানুষ পাওয়া যায়। স্বৈরতান্ত্রিক একটা সিস্টেম নিজেকে বাঁচাতে পানাহির মতন স্বাধীন চিন্তার অধিকারী মানুষদের খুন করবে-জেলে দেবে এটাই স্বাভাবিক।
এই নিয়ে আমি ব্লগ লিখছি না। প্রতিবাদও করছি না। পানাহির বিরুদ্ধে অভিযোগ হাস্যকর। সরকার বিরোধি ফিল্ম বানাচ্ছিলেন! স্বৈরতন্ত্রের কার্যকলাপ হাস্যকরই হয়। লিউ জিয়াবোকে আটকাতে চীনের কার্যকলাপও আমরা দেখেছি। সেই নিয়েও আমি চিন্তিত না।

আমি এই ব্লগ লিখছি কিছু বাঙালী বামপন্থীদের উদ্দেশ্যে। যারা আহমেদাঞ্জী এবং ইরানের সমর্থক।

ইরানের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের ওপর যখন গতবছর অত্যাচার শুরু হল-আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম কিছু বাঙালী বামপন্থী-এটাকে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিয়ার চক্রান্ত বলে চালানোর চেষ্টা করছে।

একজন মা তার সন্তানের ওপর নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে-এবং সেই আন্দোলন যদি বাঙালী বামপন্থীরা সিয়ার আন্দোলন বলে মনে করে, আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি, কেন বাংলার বামপন্থী আন্দোলন আজকে সম্পূর্ন জনবিচ্ছিন্ন। আমেরিকার বিরোধিতা করেছে মানে, তাকে বামপন্থীদের সমর্থন করতে হবে-এই ধরনের ছাগলামি করতে করতে বাঙালী বামপন্থীরা আস্তে আস্তে লুপ্তপ্রায় প্রানীতে পরিণত হয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রো বা হুগো শাভেজ, আহমেদেনিঞ্জাকে সমর্থন করছেন-তাই বাঙালী বামপন্থীরা ইরাণের মোল্লাতন্ত্রের সমর্থক হয়ে যায়। কি হাস্যকর! আহমেদনিঞ্জা একটি কাঠমোল্লা সে হিসাব মাথায় থাকে না। মাথায় থাকে না ইরানে মায়েরদের অধিকার নেই সন্তানের ওপর।

ক্ষমতা লাভের জন্যে সব দেশেই শাসক শ্রেনী মানবিকতাবাদিদের পেছনে লাগবে। চীনের আসল মুখ আমরা দেখলাম। ইরানের দেখলাম। ওয়াকিলিকসের সুবাদে আমেরিকার শাসক শ্রেনীদের মুখোস ও খসে গেল। এবং আমরা নিশ্চয় চাইব না এদের যেসব ক্লোন আমাদের ভারতে আছে -যেমন কমিনিউস্ট বা ধর্মীয় জাতিয়তাবাদি পার্টিগুলি একটুও ক্ষমতার কাছাকাছি যাক। ধর্ম, জাতিয়তাবাদ বা গরীবদের জন্যে কুম্ভীরাশ্রু ক্ষমতা দখলের জন্যে "মিডিয়া ম্যাজিক"। আহমেদাঞ্জি এই তিনটি জিনিস নিয়েই যৌন সুরসুড়ি দেন। ধর্ম আর জাতিয়তাবাদ ত ছিলই-তার সাথে তিনি জুরেছিলেন ইসলামিক বামপন্থা। তেলের টাকায় সরকারি খরচ বাড়িয়ে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তেলের দাম কমে যেতেই, সব ম্যাজিক শেষ-বেকারত্বের তীব্র বৃদ্ধি এবং জনগণের বিক্ষোভের শুরু। হুগো শাভেজ ও সেই এক পথের পথিক-তেল বেচে ওয়েল ফেয়ার স্টেট বানাতে গেছেন। আর তেলের দাম কমতেই, তার সব পরিকল্পনা বাতিল। এর বিপরীতে অবস্থানে কাতারের প্রিন্স ওয়ালেদের। যিনি তেলের টাকায় কাতারে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প গড়ছেন দোহাতে-মোদ্দা কথা তেলের টাকা বিকিয়ে না দিয়ে, সেই টাকায় দেশকে শিল্প উন্নত করা উচিত। যারে আরো চাকরী সৃষ্টি হয় এবং দেশের অর্থনীতি তেল নির্ভর না হয়। আহমেদেনিঞ্জা এবং শাভেজ দুজনেই পপুলিস্ট-তেলের টাকা দেদার সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ারে বিলিয়ে এখন তেলের দাম বসে যেতেই, দেশকে সমস্যার মুখে ফেলেছেন। এই দেশগুলিতে বেকারত্ব বাড়ছে সাংঘাতিক ভাবে। ফলে জনগণ বিক্ষুব্ধ। তবুও শাভেজের জনপ্রিয়তা আছে-কিন্ত ইরানে গনতন্ত্র নেই। ফলে জনগনের বিক্ষোভ যাবে কোথায়?

ফলে ইরানে আরো বেকারত্ব বাড়বে এবং মোল্লাতন্ত্রের আরো উৎপাত আমরা দেখব। এবং সেই মোল্লাদের সমর্থক বাঙালী বামপন্থীদের আরো অনেক সার্কাসও দেখার জন্যেও তৈরী হৌন।

Monday, December 6, 2010

মননে, সদা গোপনে!






আমি যেটা লিখতে যাচ্ছি-সেটাকে ব্লগ হিসাবে না দেখে আলোচনা হিসাবে দেখুক সবাই। আমি এখানে বারো জনকে নিয়ে আলোচনা করব, যাদের জীবন এবং দর্শন আমার চিন্তাকে সব থেকে বেশী প্রভাবিত করেছে। আমি চাইব, বাকীরাও লিখুক কিভাবে তারা প্রভাবিত হয়েছে। শুধু বারোজনের মধ্যেই চিন্তা ধারাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, তারও কোন মানে নেই।

স্যার কার্ল পপারঃ সত্যি কথা হচ্ছে, স্যার পপারের লেখাগুলো পড়া এবং বোঝার আগে, দর্শন নিয়ে আমি পড়েইছি শুধু। বুঝেছি অল্প। স্যার পপারের বিজ্ঞানের দর্শন গভীরে জানার পর, দর্শনের দরজা প্রথম চওড়া হয়ে খুলে যায় আমার মনে। বিজ্ঞানের দর্শন বা ফলসিফিকেশনের পেছনে কাজ করে "ইনডাকশনিজমের" সীমাবদ্ধতা। যা ঢাকতে ফলসিফিকেশন দর্শনের জন্ম। শুধু এই শেষের দুটিবাক্য গভীরে বুঝলেই বাজারে চালু সব দর্শনকে অতি দ্রুত বোঝা সম্ভব। এবং সেই ফলসিফিকেশন ফিল্টার দিয়ে তাকালে বাম, ডান, মৌলবাদি, কমিনিউস্ট, প্রগতিশীল, ধার্মিক-সবার সীমাবদ্ধতা এবং গন্ডী একদম পরিষ্কার ভাবে প্রতিভাত। তাই আমার জীবনে দুটো অধ্যায়-প্রিপপারিয়ান, যেখানে পড়েইছি শুধু, বুঝেছি কম। এবং পোষ্ট পপারিয়ান-যেখানে প্রচলিত দর্শনগুলি জলভাতের মতন সোজা হয়ে গেছে।

মোহন দাস গান্ধীঃ গান্ধীর সাথে পরিচিতি অতুল্য ঘোষের গান্ধীর জীবনী দিয়ে। খুব ছোট বেলায়। তখন খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম তা না। কারন অধিকাংশ বামপন্থী পরিবারেই একটা গান্ধীবিরোধি এন্টাগনিজম কাজ করে। গান্ধীবিরোধিতা অনেক বাম-বাঙালী বালখিল্যতার অন্যতম আরেকটি। কোন সন্দেহ নেই গান্ধী চূড়ান্ত ভাববাদি-কিন্ত নিজের জীবনে গান্ধীবাদ অভ্যেস না করলে গান্ধীকে বোঝা মুশকিল। শত্রুকে হিংসা করা খুব কঠিন কাজ কি? শত্রুকে ভালবাসতে কজন পারে? গান্ধীর ধারাপাত পড়ে বা বলে কিছু হয় না। নিজের জীবন দিয়ে, নিজের জীবনে প্রয়োগ করে বুঝতে হয়। তবেই বোঝা যায়, শত্রুকে জয় করার কত সহজ পথ গান্ধী দিয়ে গেছেন। গোটা পৃথিবীতে যখনই কোন বিদেশীর সাথে দেখা হয়, তারাও গান্ধীকে নিয়ে উদ্বেলিত। হয়ত আমরা সবাই আশাবাদি। তাই সারভাইভাল স্ট্রাটেজিতে আলটুইজম প্রাণী জগতে আখছার দেখা গেলেও, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত মানব সমাজের সামনে, গান্ধী চিরকাল পথ দেখাবেন।

লালন ফকিরঃ আউল, বাউলের দেশ এই বাংলা। বাউল সঙ্গীত ছোট বেলায় যে বুঝতাম- তা না। বাউল দর্শন ও না। সোরেন কিয়ার্ডগার্ডের অস্তিত্ববাদ পড়ার পর এবং নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারি, আসলে মানুষের ওপর কোন দর্শন নেই। মানুষ হচ্ছে সব দর্শনের সিঙ্গুলার পয়েন্ট। কমিনিউজম, ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদের পতন এবং পচনের একটাই কারন- এরা বোঝে না-এ সব কিছুই মানুষের জন্যে। তাই মানবতাকে দমন করে, মানবতার শবের ওপর যখন কমিনিউজম, ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে, তার থেকে মৃতদেহের পচা গন্ধ বেড়োয়। মানুষ যে সব দর্শনের সিঙ্গুলার পয়েন্ট-এটাই বাউল কথা। এই অন্তর্মুখী দর্শনই পারে আমাদের এই সব ভুলভাল কমিনিউজম, হিন্দুত্ববাদ, ইসলাম থেকে মুক্তি দিতে।

কার্ল মার্ক্সঃ এটা আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যে মার্ক্সবাদ বুঝেছি পপার পড়ার পর। তাই লেনিনবাদি মুর্খদের কবলে পড়তে হয় নি। সমাজ বিবর্তনের যে রূপরেখা মার্ক্স দিয়েছিলেন, সেটাকে আমি সঠিক বলেই মনে করি। কিন্ত লেনিনবাদিরা তার যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেটা ভুল। মার্ক্সবাদে কোন বিপ্লব নেই-সবটাই সামাজিক বিবর্তনের সায়েন্স ফিকশন। মার্ক্স যেভাবে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র এবং তার থেকে কমিনিউজম আসবে বলে হিস্টরিসিজম করেছিলেন, সেটাকে আমি ঠিক বলেই মনে করি। স্যার পপার এই ধরনের হিস্টরিসিজমকে অবাস্তব বলেছেন। সেটাও ঠিক হতেই পারে-কারন কমপ্লেক্স সিস্টেমে ডেটারমিনিজম না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্ত তবুও মানুষের নির্মান শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক না। কিছু বিশ্বাস, তা ক্ষীণ হলেও থাকতেই পারে। সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে অনেকেই মার্ক্সবাদ সঠিক কি না, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন-কিন্ত বাস্তবত এটাই যে পৃথিবীতে যেসব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি প্রতিষ্ঠা হয়েছে-সেগুলোতো আসলেই ফ্যাসিস্ট ন্যাতসি রাষ্ট্র। মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যে আন্তর্জাতিকতা বাধ্যতামূলক। আরো একটা ব্যাপার লেনিনবাদিরা সম্পূর্ন গুলিয়েছে। সেটা হচ্ছে মার্ক্স খুব পরিস্কার ভাবে লিখে গিয়েছিলেন, উৎপাদন ব্যাবস্থার উন্নতি বা উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থায় ধনতন্ত্রের মাধ্যমে না পৌঁছালে, সমাজতন্ত্রের আগমন সম্ভব না। এখন কতটা উন্নতি বা কি ধরনের উন্নতি দরকার বা ধনতন্ত্রের কি ধরনের সংকট দরকার, যা সমাজতান্ত্রিক বিবর্তন সূচিত করবে, সেই ব্যাপারে তার বক্তব্য বা তত্ত্ব ভুল ছিল। ধনতন্ত্র সমস্ত সংকট কাটিয়েছে উন্নত আবিস্কারের মাধ্যমে। এখন আস্তে আস্তে সেই আবিস্কার করাটাও একটা বিশাল জটিল পদ্ধতি হয়ে যাচ্ছে। আগে দু একজন মিলে আবিস্কার করতে পারত-এখন আস্ত কয়েক বিলিয়ান ডলারের কোম্পানী গুলোও আবিস্কার করতে পারছে না-কারন প্রযুক্তি আরো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অর্থাৎ আবিস্কার করার ক্ষমতা ধনতন্ত্র হারাচ্ছে। আমার মতে এটাই আসল সংকট। মন্দা সাময়িক-একটা সার্কলে আসে যায়। কিন্ত আবিস্কারের পদ্ধতি বন্ধ হয়ে গেলে ধনতান্ত্রিক ব্যাবস্থা মুখ ধুবরে পড়বে। এবং আস্তে আস্তে সেই দিকেই আমরা এগোচ্ছি, যা সমাজতন্ত্রের সহজাত বিবর্তন ত্বরান্বিত করবে। কোন বিপ্লবী তত্ত্ব না -এই গণতান্ত্রিক ক্রমবিবর্তনই মার্ক্সবাদ! বাকীটা বিকৃতি!

ফ্রেডরিক নিৎসেঃ যদি আমাদের জীবনের সমস্ত অতীত সিদ্ধান্তকে বিশ্লেষন করি কি দেখব? প্রতিটা সিদ্ধান্তের পেছনে "ভয়" এর দীর্ঘ করাল ছায়া। কতকিছুর ভয়! সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা হারানোর ভয়, অর্থনাশের ভয়, চাকরি হারানো অনিশ্চিত জীবনের ভয়- ভয়ের সুদীর্ঘ লিস্টের সমষ্টি আমরা। শুধু ধর্মভীরুদের দোষ দিয়ে কি হবে? ঈশ্বরকে ভয় না করলে কি হবে, বাকী হাজার হাজার জিনিস হারানোর ভয় আমার মতন নাস্তিকদের। আমি লেখক না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার কেন? ইঞ্জিনিয়ারিং এর থেকে লিখতে আমার একশোগুন ভাল লাগে। তবুও আমি লেখক নই, ইঞ্জিনিয়ার। কারন দারিদ্র্যের ভয়। তাই নিৎসে বলছেন, প্রতিটা মানুষ তার নিজের কাছে একটা বিরাট "এমব্যারাসমেন্ট"। ভয়ের চোটে মানুষ বাধ্য হয় নানান কম্প্রোমাইজ করে-যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেকে অপমান করা। এটা প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা সাশ্বত সত্য। নিৎসের নিহিলিস্ট দর্শন বা মরালিটির ভক্ত আমি না। কিন্ত ভয়কে জয় করতে পারলে, আরো উন্নত মানুষ হওয়া সম্ভব। ভয় আমার সিদ্ধান্তকে কতটা প্রভাবিত করছে-এটা বুঝতে নিৎসে ছারা উপায় নেই।

মেঘনাদ সাহাঃ বিজ্ঞানী হয়ে সমাজের জন্যে কি করা উচিত? এই ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। থাকতেই পারে। তবে বিজ্ঞানীকুলে এই ব্যাপারে মেঘনাদ সাহা আমার প্রথম পছন্দ। বাল্যের সুকঠিন দারিদ্রই তাকে বাধ্য করেছিল সমাজ সচেতন হতে। তার নাম নোবেল প্রাইজের জন্যে ৬ বার বিবেচিত হয়েছে-স্যার রমনের আগেই তার নাম দুবার নোবেলের জন্যে উঠেছে। উনি নোবেল প্রাইজ পান নি। তাতে কি? ভারত যাতে বিজ্ঞানযজ্ঞে পিছিয়ে না পড়ে তার জন্যে নিজে হাওড়ার ওয়ার্কশপ থেকে এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন বানিয়েছেন। যেখানেই ছিলেন, নিজেই ছুতোরের কাজ করে যন্ত্র বানাতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ভারতের নদীপরিকল্পনাও তার কীর্তি। ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন আকুতোভয়। উনার লেখা বাংলা বই ছোট বেলায় পড়েছি। ত্রিকোনিমিতি উনার বই পড়ে শেখা-এবং সেটাও অদ্ভুত ছিল। এমন সমাজ সচেতন বিজ্ঞানী বিরল।


এন্টন চেকভঃ চেকভের ছোট গল্প প্রিয় বলে, চেকভকে এই লিস্টে রাখি নি। আর কোন সাহিত্যিকের সাথে আমার নাড়ির যোগ এত তীব্র না। যে শ্লেষ এবং মাইক্রোস্কোপ দিয়ে চেকভ আমাদের খুঁটিনাটি দেখেছেন-প্রতিটা সম্পর্কই আমার কত চেনা।
আমার চেনা জানা পৃথিবী, বাস্তবতা একটা পেঁয়াজের মতন। যত ছাড়াবে, তত ঝাঁজ। প্রতিদিনের সম্পর্ক কত সার্বজনীন, কত অসাধরন সুন্দর হতে পারে, সেই ছোট ছোট অনুভুতির মণিমুক্তগুলো চেকভ থেকেই কুড়িয়েছি।


রবীন্দ্রনাথঃ রবীন্দ্রনাথ কেন? অনেক বাঙালী আমার লিস্টে ১-১০ সবকটাতেই রবীন্দ্রনাথ বসাতে পারলে খুশী হবেন। আমি অবশ্য সেই কারনে রবীন্দ্র প্রভাবিত না। রাশেলের মতন আমিও রবীন্দ্রদর্শনে নতুন কিছু পাই নি। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ মহৎ-কিন্ত অমন সাহিত্যিক বাংলায় না আসলেও বিশ্বে অনেকেই আছেন। আমি রবীন্দ্রপ্রেমী শুধু দুটো কারনে- গান আর তার ভাষাকৌশল। গান নিয়ে কিছু বলার নেই। আমার কাছে রবীন্দ্র সংগীত ভাষা, সুর এবং ছন্দে বিশ্বশ্রেষ্ঠ। সেটা অবশ্য আমার অভিমত। তবে রবীন্দ্রনাথের ভাষা নিয়ে আমার বলার আছে অনেক কিছু। ভাষার শৈল্পিক প্রয়োগ সব সাহিত্যকর্মীর প্রাথমিক কর্ম হতে পারে-তবে রবীন্দ্রনাথের হাতে তা যে পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে-সেখান থেকে ভাবপ্রকাশের সময় একটা বিশ্বাস মনে সব সময় কাজ করে। ভাষাই আসল ভাবব্রহ্ম!

গৌতম বুদ্ধঃ আমার পিএইচডি থিসিস গৌতম বুদ্ধকে সমর্পিত। জীবনে ওঠা নামা থাকে। পাওয়া না পাওয়ার অসংখ্য বেদনার বলয়ের বৃত্তে আমাদের কিৎ কিৎ খেলা। আমার জীবনে আনন্দ এবং দুঃখ দুটোই কম। প্রথম কারন, প্রত্যাশা নেই। দ্বিতীয় কারন জেন দর্শন। সব কিছুরই দুটোদিক দেখতে পাই। জীবনের ব্যালান্স শিটে নিট লাভ বা নিট লোকসান বলে কিছু নেই। কিছু পেলে, কিছু হারাতে হয়। আমি আমেরিকাতে বসে "উন্নত" জীবনে উনুনের শিক কাবাব হচ্ছি না শিক কাবাব খাচ্ছি-সবটাই জীবনের দিকে কিভাবে তাকাচ্ছি, তার ওপর নির্ভরশীল। যদি ভাবি ভাল ভাল খাচ্ছি, ঘুরছি-তাহলে লাভে আছি। আবার যখন দেখি চারিদিকে শুধুই "আমি"-ছোটবেলার মাঠ, নদী, বন্ধু, তুতো আত্মীয়রা হারিয়ে গেছে-"আমি" নামে এক তালগাছ তেপান্তরের মাঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে-তখন কিছুটা বেদনা হয় । হারানোর চাপ। এই উভচর পৃথিবীকে বুঝতে জেন দর্শনই শ্রেষ্ঠ।


জালালুদ্দিন রুমিঃ লালন ফকিরের পূর্বসূরী রুমি। মানবতার দর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রচারক কে জানতে চাইলে, আমি একবাক্যে রুমিকেই বেছে নেব। প্রেমিকের কোন ধর্ম নেই-প্রেমই তার একমাত্র ধর্ম অথবা, আমি পূবের না, পশ্চিমের না, ইসলামের না, খ্রীষ্ঠের না--- জাতি ধর্ম ভুলে যে মানব ধর্মের সাধনার ডাক, তার পথিকৃত তিনিই। পরবর্ত্তীকালে শ্রী চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, ররীন্দ্রনাথ বা লালনের মধ্যেও রুমির বাণীই আমরা একাধিবার শুনবো। জাতিশুন্য, ধর্মীয় পরিচয়শুন্য যে ভবিষ্যতের পৃথিবীর স্বপ্ন আমি দেখি, রুমি সেই স্বপ্নের প্রথম এবং প্রধান কান্ডারী।

স্বামী বিবেকানন্দঃ ক্লাস সেভেনে বিবেকানন্দ রচনাবলীর সাথে আমার পরিচয়। প্রাচ্যের দর্শন জানতে হলে বিবেকানন্দ রচনাবলীর বিকল্প নেই। কিন্ত প্রশ্ন উঠবে প্রাচ্য দর্শন কেন? সম্প্রতি স্টিফেন হকিংস বলেছেন, দর্শনের মৃত্যু হয়েছে-বিজ্ঞান তার স্থলাভিষিক্ত। কথাটি যতটা সত্য, ততটাই ভুল। সত্য এই জন্যে যে জ্ঞানের প্রতিটি আনাচে কোনাচে বিজ্ঞান যেভাবে হানা দিয়েছে, তাতে জ্ঞান ভিত্তিক যেকোন এম্পিরিক্যাল দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। কিন্ত পরিপূর্ন জ্ঞান বা বিজ্ঞানের সাহায্যেও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না। এমন একটি প্রশ্ন -জীবনের উদ্দেশ্য কি ? বিন্দু হতে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি, আবার বিন্দুতেই মহাবিশ্বের মৃত্যু হবে। এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য যে এই সভ্যতা, মহাবিশ্বের মৃত্যু হবেই। এর মধ্যে খানে আমরা যাই কিছু করি না কেন-কিছু যায় আসে না। সবার পরিণতি সেই বিন্দুতেই শেষ। তাহলে কোন জীবন দর্শন ঠিক-কোনটা বেঠিক আমরা কি করে বলবো? সেই উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। এখান থেকেই দর্শনের শুরু। ইসলাম বা একেশ্বরবাদি ধর্ম গুলো আমি এই জন্যেই পছন্দ করি না-এদের অজ্ঞতা এদের বুঝতে দিচ্ছে না, কোন জীবন দর্শন ঠিক , আর কোনটা বেঠিক, এটা বইভিত্তিক, বা জ্ঞান ভিত্তিক হতে পারে না। ভারতীয় দর্শন এটাই শিক্ষা দিয়েছে, জীবন দর্শন আত্মোপলদ্ধি বা রিয়ালাইজেশন থেকে আসে। নিজের প্রতি ডিসিপ্লিনড অনুসন্ধানই, জীবন দর্শনের জন্ম দেয়। এবং সেই জন্যে প্রত্যেকের আলাদা জীবনদর্শন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই আমরা বলি যতমত, তত পথ। নিজের জীবনদর্শন খোঁজার এই স্বাধীনতা শুধু ভারতীয় দর্শনেই দেয়। প্রতিটা একেশ্বরবাদি ধর্মের কি করিতে হইবে টাইপের জীবনদর্শন, আদিমকালের ছেলেমানুষ দর্শন এবং সমাজে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়। তবে ভারতীয় দর্শনেও কি করিতে হইবে টাইপের ঢাউস বই আছে-সেগুলো একেশ্বরবাদি ধর্মগুলোর মতন বিপজ্জ্বনক। ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানকে "ইসলামাইজেশন অব হিন্দুজিম" বলে ভাবা যেতে পারে। ভারতীয় দর্শনের সাধনায় রুলবুকের স্থান নেই-তা স্থান কাল নিরেপেক্ষ আত্মোপলদ্ধির জগৎ।

ভ্লাদিমির লেনিনঃ আমি ঘোর লেনিন বিরোধি। ১৯১৮-১৯২১ পর্যন্ত লাল সন্ত্রাসের মাধ্যমে লেনিন যত কৃষক শ্রমিক এবং রাজনৈতিক কর্মী খুন করেছেন, তার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকাও অসম্ভব। তার লেখাও আহামরি কিছু না-পান্ডিত্যের বদলে নির্বুদ্ধিতা এবং ওপর চালাকি আমার বেশী চোখে পড়ে। কিন্ত তবুও সমাজ বদলের জন্যে রাজনৈতিক সংগঠন করতে গেলে, লেনিনের জীবন এবং কর্মের দিকে বারবার তাকাতে হবে। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে বলশেভিক পার্টি যখন সম্পূর্ন ধ্বংশ, তখন শুধু মাত্র জনরোষকে কাজে লাগিয়ে মাত্র ছমাসের মধ্যে রাশিয়া দখল করে নিলেন। তার সাথে কিছুই ছিল না। শুন্য থেকেই ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন। কি করে সম্ভব হল? একটা ছোট ঘটনা। তখন বলশেভিক মুখপত্র প্রাভদাতে প্রবন্ধ বেশী ছাপা হত না।শ্রমিকরা নিজেদের দুর্দশার কথা চিঠি লিখে জানাত। এক অর্থে সেটাই পৃথিবীর প্রথম স্যোশাল মিডিয়া।
আজকের ভারতে মিডিয়ার এত চাকচিক্য-অথচ অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রান্ত্রিক শ্রমিক কৃষকদের অবরুদ্ধ কথাকে জন সমকক্ষে আনার জন্যে কোন মিডিয়া নেই। লেনিন যেটা ১৯১৭ সালে পেরেছিলেন, আমাদের দেশ তা আজও পারে নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সফল হতে গেলে লেনিনের জীবনকে ভালভাবে জানা জরুরী।

মিখাইল বাকুনীনঃ ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের অমানবিক দিক গুলো দেখলে প্রথমেই যার কথা মনে পড়ে তিনি বাকুনীন। স্টালিন এবং ধনতন্ত্রের অত্যাচারের একটাই যোগসূত্র। সেটা ক্ষমতা। স্টালিন তখন ও জন্মান নি-কিন্ত বাকুনীন বলে গিয়েছিলেন কোন মহান বিপ্লবী যদি অত্যাচারী জ়ারের সিংহাসনে বসে, সে এক বছরের মধ্যে জারের চেয়েও শতগুন অত্যচারী হবে।স্টালিন তার বিশুদ্ধ প্রমান। জারের আমলে স্টালিন রাজনৈতিক কর্মের জন্যে তিনবার সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হন। একবার গৃহকত্রীর পেট করে দিয়ে আসেন। পরের বার এক ত্রয়োদশী কন্যাকে বিয়ে করেন। আর স্টালিনের আমলে, বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম উজ্জ্বল নেতাদের সবাইকে খুন করা হয়েছে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতার কারনে। শুধু স্টালিন কেন, বাকুনীনের বক্তব্য ছিল অর্থ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষের মন এবং হৃদয়কে বিকৃত করে। ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের পচনের কারন এই ক্ষমতা-তার উৎস অর্থ বা রাজনীতি যাই হোক না কেন। পশ্চিম বঙ্গের মানুষ বাকুনীনকে চেনে না। তারা দেখেছে খালি পায়ে হাঁটা সত্তর দশকের কমরেডরা আজ গাড়ি হাঁকিয়ে ঘোরে। ঠিকাদারিতে আঘাত করলে মানুষ খুন করে। বাকুনীনের কথা জানলে, তারা বুঝত, এটা বাকুনীন অনেক দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরন ছারা যে কোন সিস্টেমই অমানবিক বা অত্যচারী হতে বাধ্য।

চে গুয়েভেরাঃ চে কে কি আমি কমিনিউস্ট বলবো? আমি নিজে ১০০% কমিনিউস্ট বিরোধি। তবুও কেন চে? কারন সাধারন এবং অত্যচারিত মানুষের প্রতি "আজন্ম" এবং অকৃত্রিম ভালবাসাতে চে অদ্বিতীয়। গান্ধীও ক্ষমতার প্রতি লালায়িত ছিলেন-চে ছিলেন না। চে কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-এক জন আদর্শ বিপ্লবী কে? চে জানিয়েছিলেন, যে মানুষকে ভালবাসতে পারে। চে বলেন নি পার্টির প্রতি আনুগত্যের কথা। বলেন নি নন্দীগ্রামে যখন মানুষকে খুন বা ধর্ষন করছে ভারতীয় কমিনিউস্ট পার্টির লোকেরা, শুধু সেই পার্টির লোক বলে, আনুগত্যের কারনে, সেই অমানবিক ঘটনা সমর্থন করতে হবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই একজন বিপ্লবীর প্রথম এবং প্রধান পরিচয়। অনেকেই হয়ত সেটা বলে। তারপর লেনিন, স্টালিন, মাওদের মতন অত্যচারী শাসকে পরিণত হয়। চে কিন্ত কিউবার ক্ষমতার ক্ষীর খেলেন না। আফ্রিকাতে গেলেন বিপ্লব করতে। সেখান থেকে বলিভিয়াতে। সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন যখন কাস্ত্রো সোভিয়েত প্রভুদের বুট চাটতে ব্যাস্ত ছিলেন। এমন অকৃত্রিম মানব প্রেমিক বিশ্বইতিহাসে বিরল।

আমি বাকীদের ও অনুরোধ করব, তারাও তাদের জীবনের অনুপ্রেরণাদের নিয়ে লিখুন। আমরা তাদের দেখেও অণুপ্রাণিত হই।

Tuesday, November 30, 2010

উষা্লোক

অনেক আশাহত অন্ধকার দিনগুলোর মধ্যেও কিছু কিছু খবর আসে, যা সত্যই আশাব্যাঞ্জক। আমাদের বড় বড় ধর্ম নিরপেক্ষ নেতারা যেভাবে "ধর্ম নিরেপেক্ষতার" নামে সংখ্যালঘু নারীদের অধিকার বিরোধি কিছু মৌলবাদি ভাঁড়ের পায়ে নিজেদের আত্মসমর্পন করেছেন-সেই শ্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বেঙ্গল ফোরাম ফর মুসলিম উইমেন্স রাইট এন্ড এম্পাওয়ারমেন্ট-খুব পরিস্কার ভাবেই মুসলিম মহিলাদের ওপর অত্যাচার রুখতে মুসলিম সমাজেও ধর্মনিরেপেক্ষ আইনের দাবী তুলেছেন। আইন হলেই যে অত্যাচার আটকায় তা না। ভারতে মহিলাদের প্রতি অত্যাচার সর্বাধিক এবং তা আইন দিয়ে কিছু মাত্রায় কম করা সম্ভব হলেও, প্রতি বছর আট হাজার বধূ হত্যা সর্বভারতীয় লজ্জা। ভারতীয় সমাজে মেয়েদের এই করুন অবস্থার জন্যে সনাতন হিন্দু ধর্মের দায় একশো ভাগ। তবুও সমাজসংস্কার এবং আইনের জন্যে, আস্তে আস্তে হলেও ভারতে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। কিন্ত এই অধিকার থেকে বঞ্চিত মুসলিম মেয়েরা। শাহবানু মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পরে, মুসলিম মেয়েদের সামনে শরিয়া আইন ছারা ধর্ম নিরেপেক্ষ পারিবারিক আইন খোলা নেই। বলা যায় তথাকথিত ধর্ম নিরেপেক্ষ রাজনীতির(?) শিকার ভারতের মুসলিম নারী-যাদের জন্যে মধ্যযুগীয় আইন প্রনয়ন হচ্ছে "ভারতীয় ধর্ম নিরেপেক্ষতা"। বাংলাদেশ, মালেশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াতে মুসলিম নারীদের যেটুকু অধিকার আছে-ভারতীয় মুসলিম নারীদের তার ছিঁটেফোটাও নেই। কারন ভারতে ধর্ম নিরেপেক্ষতার সংজ্ঞা হচ্ছে সংখ্যালঘু তোষন এবং
তার জন্যে মুসলিম মেয়েদের অধিকার জাহান্নামে গেলে যাক। মুসলিম মেয়েদের ওপর সামাজিক অত্যাচারের যজ্ঞে ঘৃতাহুতি দেওয়ার লাইনে রাজীব গান্ধী থেকে মানস ভুইজ্ঞা সবাই আছেন।

মানবসমাজ বিবর্তনের সর্বশক্তিমান প্রোডাক্টটির নাম ঈশ্বর। তিনি আবার পুরুষ-কেন না তা না হলে, সন্তান বেশী জন্মাত না। যাইহোক, এই পুরুষ ঈশ্বরটির হাতে সব ধর্মেই মেয়েদের অবস্থান নাকাল। হিন্দু ধর্মে তা গাভীবৎ-ইসলামে দাসীবৎ। সুতরাং ধার্মিক আইন প্রচলন করলে হিন্দুধর্মে মেয়েদের অবস্থান হবে গৃহপালিত গাভীর চেয়ে কিছু কম-আর শরিয়া আইনে চললে, মেয়েদের অবস্থান হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রথমটি আইন দিয়ে দূর করা সম্ভব হলেও, দ্বিতীয়টি বিদ্যমান। ফলে ধর্ম নিরেপেক্ষতার সার্কাস বজায় রেখে ধর্মীয় আইন চালু রাখার পক্ষে যারা-তাদের একটাই শ্রেনী- সুবিধাবাদি রাজনৈতিক ভাঁড়।

ইদানিং কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি মানস ভুইজ্ঞা এবং সইফুদ্দিন চৌধুরী মুসলিম ভোট পাবার আশায় যে পার্টির লেজ ধরেছেন তার নাম জামাই ই ইসলামি হিন্দ। তাদের আমীর এই নারীবাদি সংগঠনের বিরোধিতা করবে বলে জানিয়েছে কারন তার মতে মুসলমান মেয়েদের শরিয়া মেনে চলতে হবে ( আনন্দবাজারে রহমত আলির বক্তব্য দ্রষ্টব্য)!!! এবার বুঝুন কংগ্রেস এবং পিডিএসের "ধর্ম নিরেপেক্ষ" জোটসঙ্গীতে কারা আছে। এবং ধর্মনিরেপেক্ষতা কারে কয়।

সমস্যা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদিরা মাথাচারা দিয়ে উঠছে। এর একটা বড় কারন এই ধরনের ভ্রান্ত ধর্ম নিরেপেক্ষতার সার্কাস। এই একবিংশ শতাব্দিতে এসে মুসলমানদের জন্যে আলাদা পারিবারিক শরিয়া আইন ভারতবর্ষের জন্যে লজ্জাত বটেই-মুসলিম মেয়েদের বিরুদ্ধে তা মুসলিম পুরুষদের শোষন এবং নিপীড়নের যন্ত্র। এবং মেয়েদের বিরুদ্ধে সেই শোষন অব্যাহত রাখার পেছনে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকাও খুব উজ্জ্বল।

জেনেটিক্সের এই যুগে যখন আমরা জানি দুজন যেকোন মানুষের মধ্যে জেনেটিক পার্থক্য এক ভাগের একলক্ষ ভাগও না-এবং সেই সূত্রে খুব জোর দিয়েই বলা যায় হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য অবৈজ্ঞানিক, কল্পনাপ্রসূত এবং ফালতু, তখন দেখা যাচ্ছে শুধু কিছু রাজনৈতিক সুবিধাবাদি নেতাদের মদতে এই পার্থক্য টেকানো হচ্ছে। সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস-সব পার্টিই এই বিভাজনের তাস খেলে। তবে এতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ভারতের মুসলিম মেয়েরা।

Sunday, November 28, 2010

আদর্শবাদি মহানুভব না ছাগলামি?

বাঙালি হিসাবে আদর্শবাদের সাথে পরিচয় ছেলেবেলা থেকে। মহান নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ ইত্যাদির শ্রদ্ধাবাসর সম্পন্ন করে কৈশোর থেকে যৌবনে, জীবনযুদ্ধে নামতেই বাঙালী বাবা-মা রা স্বপরিচয়ে আবির্ভূত হন। ঘুঁশ না নিলেও, তখন দেখা যায় ঘুঁশ দেওয়া থেকে জীবনের নানা রকমারী কম্প্রোমাইজে তাদের আপত্তি ত নেই-বরং উনারা এটাকে স্বীকৃত সারভাইভাল গেম হিসাবে মেনে নেন। তারপরেও অনেকেই অনেক কিছু মানতে পারেন না-এবং বাঙালী মানস আদর্শবাদের ব্যাপারে একটা অদ্ভত দ্বিচারিতায় ভোগে। আমেরিকা বিরোধিতা, ইসলাম বিরোধিতা, হিন্দুত্ববাদ বিরোধিতা, গান্ধীবাদ বিরোধিতা, কংগ্রেস বিরোধিতা, বাম বিরোধি, এসি ঘরে বসে বাম ছাগলামি-অনেক কিছুই বিশুদ্ধ বাঙালী আদর্শবাদের লক্ষণ । এই মিমগুলো নিয়ে আমার আপত্তি নেই-মানুষের যৌত্বিক নির্মান বলতে কিছু হয় না। মানবিকতা ব্যাপারটা অনেকটাই সারভাইভাল স্ট্রাট্রেজি। আপত্তি শুধু একটা ব্যাপার নিয়ে- সেটা হচ্ছে এরা সবাই এদের নিজেদের পজিশনটাকে খুব যৌত্বিক ভাবেন-এবং মনে করেন এই বিরোধিতা না করলে পৃথিবী রসাতলে যাবে। বাপ্যারটা এমন-আমেরিকা, মুসলমান, বিজেপি, টাটা, সিপিএম, তৃণমূল, ইউনুসের মাইক্রোক্রেডিট-সবাই বাঙালীর পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা আছোঁলা বাঁশ নিয়ে।

কিছুদিন আগে একটা ভাল খবর শুনলাম। সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণাতে জানা গেছে বামেরা দুশ্চিন্তা করতে "ভালবাসে"। মানে যেখানে দুশ্চিন্তা নেই-সেখানেও দুশ্চিন্তা করাটা নাকি বামেরদের মাথাতে ইনবিলট। আর দক্ষিন পন্থীরা ফিল গুড ফ্যাক্তরে বিশ্বাসী। মানে আমেরিকা রসাতলে গেলেও উনারা মনে এটা ভেবে খুশী এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ। ভারতের ৭০% লোক ঠিক ঠাক না খেতে পেলেও ইনারা শাইনিং ইন্ডিয়াতে বিশ্বাসী।

বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থীদের যারা বিলক্ষণ চেনেন-বা এদের হাতে ভুগেছেন-তারা নিশ্চিত ভাবে অবগত আছেন, এদের জগতের সাথে বাস্তবতার দূরত্ব বিস্তর কয়েক আলোকবর্ষ। বাস্তবতা বা রিয়ালিজমের সংজ্ঞায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে পারসেপশন-বা জাগতিক অনূভুতি। সেই অনুভূতিটা যদি সত্যিকারের ভালোবাসার হয়, মানুষ আদর্শবাদের পাঁক থেকে এমনিতেই মুক্তি পায়। কিন্ত তার বদলে হাজারটা ভুল তথ্য এবং তত্ত্ব জোগার করে, নিজেদের পজিশনকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাগলামি।

Monday, November 8, 2010

ওবামার ভারত সফর এবং আমরা


আমি টিভি প্রায় দেখিই না-শুধু ট্রেডমিলে উঠে সি এন এন চালিয়ে দিই। গত তিনদিনে কত আশা করেছিলাম, সি এন এন প্রেসিডেন্টের ভারত ট্যুর নিয়ে কত কিছু দেখাবে। আফটার অল ওবামা ভারতে এমন তেল মারা শুরু করলেন, আমি ত ভাবছিলাম আমেরিকায় হার নিশ্চিত জেনে, উনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্যে ইলেকশন লড়ছেন! তার সাথে মিশেল ওবামার বাচ্চাদের সাথে কিছু অসাধারন নাচের দৃশ্যত ছিলই। ধুস আমেরিকান মিডিয়া কিছুই দেখাল না। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জানালেন ভারত এখন পৃথিবীতে গণতন্ত্রের জন্যে নেতৃত্ব ও অনুকরনীয় দেশ-ভারতের থেকেই শেখা উচিত একটা দেশ কি করে শিক্ষায় বিনিয়োগ করে ভবিষ্যত তৈরী করে। গোটা পৃথিবীতে যখন মন্দা-তখনো ভারত বেড়েছে ৭-৮% হারে। ভারত নিয়ে উনি এত ভাল ভাল কথা বললেন, আমি নিশ্চিত আদবানীজি শুধু বলতে বাকী রেখেছিলেন দাদা এবার বিজেপির হালটাও ধরুন-আমাদের নেতা নেই!

তবে ভারতের ছাত্রদের সামনে ওবামাকে বেশ বেসামাল লাগল। পাকিস্তান নিয়ে চেপে ধরতে উনি এদিক ওদিক দিয়ে পালাচ্ছিলেন। ভাল লাগল আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে দেখে না ঘাবরিয়ে ওরা জিজ্ঞেস করল, পাকিস্তান নিয়ে আপনারা চোর পুলিশ খেলেন কেন? আমাদের সিংজীর যদি এতটুকু সাহস ও থাকত। এদিকে ওবামা যা তেলমাস্টার উনি সিংজীকে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক নেতা বানানোর ঘি খাইয়েছেন। সিংজী নাকি ওবামার অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা এটা ওবামা অনেকবার বলেছেন! এতেই সিংজী কাত-উনি কৃতজ্ঞতা বশত পাকিস্তানের ন্যায় অসস্তিকর ব্যাপারে আলোচনা করতে ভুলে যান-অথচ ১৯-২০ বছরের ছেলে মেয়েদের সামনে পাকিস্তান নিয়ে ওবামার ঘুরি ভোকাট্টা!

ওবামার ভারতীয় পার্লামেন্টে ভাষন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই দুর্লভ সন্মান খুব কম রাষ্ট্রপ্রধানের ভাগ্যেই জুটেছে। তাই ওবামা সুযোগটা ভালোই কাজে লাগালেন। মহত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ( উনি উচ্চারন করলেন, ঠান্ড ), আম্বেদকর-অধুনা ভারতের রূপকারদের কেও তার ভাষন থেকে বাদ গেল না। উনাকে উনার স্ট্রাটেজিস্ট নিশ্চয় জানিয়ে দিয়েছে যে ভারতীয়দের সাথে কানেক্ট করার জন্যে এই নামগুলোর একটা একটা করে উদ্ধৃতি দিতে হবে। ভারতের ইতিহাস ভূগোল সব কিছুতেই গোল দিয়ে ওবামা লক্ষ্য করেন নি কয়েকটা গোল সেমসাইডেও খেয়েছেন।

প্রথমত উনি এসেছিলেন বাণিজ়্য সফরে। ভারত সফর থেকে আমেরিকাতে ৫০,০০০ চাকরি সৃষ্টিই তার আসু উদ্দেশ্য ছিল। শোনা যাচ্ছে উনি সফল-বোয়িং , লকহীড থেকে সব যুদ্ধবাজ কোম্পানীগুলি অনেক কনট্রাক্ট সাইন করেছে। অথচ আমেরিকার কাছ থেকে ভারতের দরকার ছিল সবুজ প্রযুক্তি এবং নিউক্লিয়ার পাওয়ার। তার বদলে ফাইটার প্লেন কেনাতেই দেখছি আগ্রহ বেশী। তাতে ভারতের জনগনের কি লাভ?
আমেরিকান জনগনের ও লাভ নেই। শুধু দালালদের লাভ। আমেরিকা আর ভারতে দালালরা ছারা আর কেও বাস করে না নাকি?

Tuesday, October 19, 2010

এত রক্ত কেন?

দুহাজার এগারোর নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, রক্তসিক্ত হচ্ছে বাংলার মাটি। শাসন থেকে সল্টলেকে লাশ পড়া অব্যাহত। এসব কোন ঘটনাই অপ্রত্যাশিত না। সিপিএম হারার আগে মরন কামড় দেবে-সেটা সবাই ধরেই নিয়েছে। শুধু একটাই পার্থনা, যাতে লাশ কম পড়ে! যদি সত্যই হিংসা এই ভাবে বাড়তে থাকে-তাহলে প্রেসিডেন্ট রুল বাংলাতে জারি করা শ্রেয়। কারন আইন শৃঙ্খলার ব্যাপারে পুলিশের ওপর বুদ্ধদেবের আর কোন নিয়ন্ত্রন নেই-সেটা এখন প্রকাশ্য। ফলে সামনের এই কটা মাস, গুন্ডা বদমাইশদের জন্যে বরাদ্দ। তাদের বাজারদর বাড়বে। জনসাধারনের ভাগ্যে কি আছে কে জানে।

যারা এত দিন রাজ্যসরকার নামক সাদা গাভীটির দুধ দুইয়ে বেঁচে আছে, তারা ক্ষমতা থেকে এত সহজ এ যাবে না। কিন্ত তার জন্যে গ্রামে গ্রামে অস্ত্রাগার গড়তে হবে-এধরনের তৃণমুলী নীতিও ঠিক না। বরং তারা চেষ্টা করুক প্রেসিডেন্ট শাসন জারি করে, পশ্চিম বঙ্গের গ্রামে গ্রামে তল্লাশি করে সব অস্ত্র উদ্ধার করা হৌক। আইন শৃঙ্খলার এই পরিস্থিতিতে সিপিএমকে আর রাজ্য চালাতে দিলে, গোটা পশ্চিম বঙ্গেই গৃহযুদ্ধ লাগবে। চিদাম্বরম এখন কার কথা শুনবেন-এসব নিয়ে ভাবা অবান্তর। সিপিমের ভোট কংগ্রেসের ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে-এই ধারনা বর্জন করা উচিত। এই মুহুর্তে কাল বিলম্ব না করে-প্রেসিডেন্ট শাসন পশ্চিম বঙ্গে চালু হোক-এবং তার সাথে সাথে সব অস্ত্র উদ্ধার করা হোক। তারপর দুমাসের মধ্যে ভোট হলেই সব স্থিতু হবে।

Sunday, October 10, 2010

মন্দাকাহন


(১) টেলিকম নিউক্লিয়ার উইন্টার / ২০০১-২০০৩

আমেরিকাতে "রিশেসন" টার্মটার ব্যাবহার লোকের মুখে মুখে। সব কিছুর কনভার্জড উত্তর-রিশেসন ম্যান রিশেসন। এটি কোন এক্সপেশন না-প্রত্যেকটি খেটে খাওয়া আমেরিকানদের উপলদ্ধি থেকে উঠে আসা গভীর "বোধ"।

আমার আমেরিকাতে পদার্পন ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। ন্যাসডাক তখনো সাড়ে তিন হাজারে দাঁড়িয়ে-প্রতিদিনই প্রায় শ খানেক করে নামছে। ব্যাঙ্করাপ্সি ফাইলিং নিত্য অভিজ্ঞতা। আর যেসব ভারতীয়রা জলের মতন আমেরিকাতে ঢুকে ছিল ভাগ্যের সন্ধানে, অনেকেই তাদের নতুন কেনা গাড়িটিকে সানফ্রান্সিকো এয়ার পোর্টে চিরতরে পার্ক করে দেশে ফিরে গেছে!

আমেরিকাতে টেলিকমের সব থেকে দুর্দিনে টেলিকম স্টার্টআপে চাকরি দিয়ে আমার পেশাদার জীবন শুরু। তবে তখনো মন্দার গোলমরিচ রোদ গায়ে লাগে নি। তার আগের বছর অপটিক্যাল নেটওয়ার্কে প্রায় ছ বিলিয়ান ডলার ঢালা হয়েছিল নানা স্টার্ট আপে। অধিকাংশ কোম্পানীতেই ঠিক ঠাক লোক ছিল না, শুধু টাকা ছিল। আমাদের ম্যানেজমেন্ট ছিল লুসেন্ট এর অবসরপ্রাপ্ত লোকেরা। সুতরাং সেই অর্থে বরং আমি ভাগ্যবান যে ঠিক ঠাক লোকেদের সাথেই ছিলাম এবং যার জন্যে পথে বসতে হয় নি। অন্য অনেক ভারতীয়দের কপালে সেই সোভাগ্যটুকুও ছিল না। ফেব্রুয়ারী মাসে আমার সাথে অনেকেই যারা এসেছে, তাদের বেশ কিছু লোক এখানে এসে দেখে তাদের চাকরী নেই। ভাল কোম্পানী হলে রিটার্ন টিকিট দিয়ে দিয়েছে-আর অধিকাংশের ভাগ্যে সেটাও জোটে নি।

তবে সেই শীতে নিউজার্সি তখনো আপবিট। আমার সঙ্গীরা যেহেতু সবাই লুসেন্টের প্রাত্তনী-এদের অনেকেই রিয়ারমেন্টের টাকা লুসেন্টের স্টকেই ঢেলে ছিলেন। প্রায় সবার রিটারমেন্ট বেনিফিট আমার সামনেই সাফ হয়েছে। তবে এরা এক সময় আমেরিকাতে অনেক কামিয়েছেন-বাড়ির লোন শোধ করা হয়ে গিয়েছিল। তাই তাদেরকে খুব বেশী চিন্তা করতে দেখিনি। শুধু ওরা হেঁসে বলত প্রতি ছমাসে ওদের রিটারমেন্ট সঞ্চয়ে একটা করে শুন্য কমছে! তবে সেই সোভাগ্যত আর ভারত থেকে আসা সদ্য সফটওয়ার কর্মীদের ছিল না। তাদের অবস্থা এত খারাপ হয় আপার্টমেন্ট থেকে মল সর্বত্র ভারতীয় দেখলেই জিজ্ঞেস করত " দাদা আপনাদের কোম্পানীতে কর্মখালী আছে? আমরা সব পারি-জাভা, ডটনেট-যা বলবেন সব কিছু। একটু দেখুন প্লিজ -গত ছমাস বেঞ্চে বসে আছি"।

আমি যে আপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতাম-সেখানে প্রায় সবাই লুসেন্টের হোমডেল ভবনে চাকরী করত। আমি যখন আসি, তখন দুমাস বাদে এপার্টমেন্ট পেয়েছিলাম। তারপরে জুন মাসের মধ্যে কমপ্লেক্স খালি হতে শুরু করে। লুসেন্টে তখন প্রতি ১৫ দিনে তিন চার হাজার করে ছাঁটাই হচ্ছে। আমি শুধু দেখছি পার্কিং লটে গাড়ির সংখ্যা কমছে। আগে জম জমাট থাকত সুইমিং পুল টেনিস কোর্ট- আস্তে আস্তে সেখানেও লোক কমছে। ২০০২ সালের মধ্যে ওই কমপ্লেক্সে লুসেন্টের একটি বন্ধুও রইল না। সবাই ছিটকে গেল নানা কোনে। আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিবার যিনি লুসেন্টের খুব বিখ্যাত গবেষক ছিলেন-কোপ তার ওপর ও পড়ল! কেও বাদ রইল না! আই আই টি, প্রিন্সটনের ডিগ্রি, বছরে ২০ টি করে পেপার-কিছুই তাকে বাঁচাতে পারল না! আমার সেই বন্ধুটি যিনি এখন কম্পুটার সায়েন্সের একজন বিখ্যাত অধ্যাপক-তিনিও বেকার ছিলেন প্রায় একবছর।

২০০১ সালের আগষ্ট মাসে মন্দার প্রথম উত্তাপ টের পেলাম। তখন কোম্পানীতে ছিল ৭০ জন। হঠাৎ একদিন দেখি আমার পাশের ঘরের ছেলেটি নেই। ভাবলাম ছুটি নিয়েছে। লাঞ্চের সময় জানলাম কোম্পানী ১০ জনকে লে অফ করেছে। মাইল্ড শক। সি ই ও ইমেল করে জানালো দ্বিতীয় দফার ফান্ডিং এখন আসতে দেরী আছে-তাই ক্যাশ বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত।

খেয়াল রাখতে হবে আমেরিকার স্টার্টআপ কালচারে আমি যখন ঢুকেছি-আমার সহকর্মীদের অনেকেই মিলিয়ানার। স্টার্ট আপ করেই। আমি ওই কোম্পানীর প্রথম দশজন কর্মীর একজন ছিলাম-আমাকেও প্রচুর স্টক দেওয়া হয়েছিল। আশে পাশের মিলিয়ানারদের দেখে যারা বেঞ্জ বা বি এম ডব্লু তে করে আসতেন এবং প্রাসাদসম বাড়িতে থাকতেন-আমার ও ধারনা হল, আগামী তিন চার বছরের মধ্যে আমিও মিলিয়নার হতে চলেছি। উচ্ছাসে ভাবী স্ত্রীকে জানিয়ে দিলাম-চিন্তা করোনা, আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকীকে তোমাকে একটা বেঞ্জ উপহার দিচ্ছি!! কারন আমাকে এর বেশী স্টক দেওয়া হয়েছে, আই পি ও হওয়ার পর, আমি বেশ কয়েক মিলিয়ানডলারের মালিক হতে চলেছি। সেই আশাতেই সবাই সপ্তাহে সাত দিন কাজ করত। তবে কাজ করে মজা ছিল-শেখার ছিল অনেক কিছু-শিক্ষকরাও ছিলেন সেরা-তাই বাজে লাগে নি। দরকার হলে রাত দুটো তিনটে অব্দি কাজ করতাম। ভাবটা ছিল-মোটে তিন চার বছরের ব্যাপার। তারপরে মিলিয়নার হয়ে দেশে ফিরে বাকী জীবন স্ফূর্তি করব।

"আশা" বস্তুটি এতই নিরেট-নিরাশাকে সে মানতে চাইত না। ২০০২ সালের গ্রিষ্মেও যখন সেকন্ড রাউন্ড ফান্ডিং এলো না, সবার মাইনে কমানো হল, চাকরী গেল ৩০ জনের। চোখের সামনে এতজনকে ফায়ারড হতে দেখে, রাতে ঠিক ঠাক ঘুম হত না। আমদের পরিশ্রম আরো বাড়ল। তখনো হাল ছাড়ার প্রশ্ন নেই। প্রোডাক্ট প্রায় রেডি। ভারিজন ট্রায়াল নেবে-এবং ট্রায়ালে সফল মানে টাকা অনেক আসবেই!

হায়রে ধণতন্ত্র! আমাদের ক্ষুদে টিমটা যে আপটিক্যাল ট্রান্সপোর্ট প্ল্যাটফর্ম তখন বানিয়েছিল-সেটি সময়ের থেকে অনেক এগিয়েছিল। ভারিজনের ট্রায়াল সফল হল। কিন্ত টাকা এলো না। কারন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কাররা অপটিক্যাল নেটোয়ার্কে এত টাকা হারিয়েছে, কেও এক ডলার ও দেবে না। ২০০৩ সালে ছাঁটাই করতে করতে কোম্পানী যখন মোটে ১২ জনে দাঁড়িয়েছে, সিই ও বললেন এবার ফুলস্টপ!

তার পরের দিনটা ভুলতে পারব না। সবাই যে যা পারছে খুলে নিয়ে যাচ্ছে। ল্যাবে তখন প্রায় ত্রিশ কোটি টাকার ওপরে বাক্স টাক্স আছে। সেগুলোর মার্কেট ভ্যালু একদিনে শুন্য। ফাইবার এম্পিফায়ার ইত্যাদি দামি বেশ কিছু জিনিস আমিও খুলে নিই যা পরে মাদ্রাস আই আই টিতে ছাত্রদের জন্য পাঠিয়ে দিই। যার জন্যে এত লড়াই, এত মারামারি, এত ঘাম, এত বিনিদ্র রজনী-একদিনে শেষ! আমাদের আড়াই বছরের সবার পরিশ্রম শুন্যে এসে ঠেকল। কারন মার্কেট আমাদের চাইছে না। বিশ্বাস করতেও চাইছে না। মার্কেটই আমাকে আমেরিকাতে এনেছে-সন্মান অর্থ সবই দিয়েছে-আবার সেই মার্কেটই আমাদের জীবনের তিনটে বছর মুছে দিল। আমাদের বড় বড় রথী মহারথিরা চাকরী না পেয়ে সরকারি কেরানীর চাকরি নিলেন। আর আমাদের মতন তরুনদের ভাগ্যে পড়ে রইল কঠিন জীবন সংগ্রাম।

এর পরবর্তীতে তিন মাসে আমি প্রায় ১৯ টি ইন্টারভিউ দিই চাকরির জন্যে। এর মধ্যে ১৭ টি ছিল আমার নিজের ফিল্ডে। বাকী দুটি অন্য এলাকাতে যাতে আমার জ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা। সেই ১৭ টি ইন্টারভিউ এর একটিতেও চাকরি হল না নিজের ফিল্ডে-কারন তখন ইন্টারভিউ ও প্রহসন বা ভবিষ্যতের জন্যে। বাকী যে দুটো ফিল্ডে চাকরি পেলাম, সেটি আমার দুনিয়া না-অভিজ্ঞতাও ছিল না। তবে ভাসাভাসা জ্ঞান ছিল।

আরেকবার প্রনাম করলাম বাজার সরকারকে। কি অপূর্ব তার মহিমা। তিন বছর আগে, আমি যখন পি এই চ ডি শেষ করছি , কিন্ত অভিজ্ঞতা অল্প, আমার বাজার দর উঠেছে চর চর করে। কারন ন্যাসডাক বিলিয়ানস অব ডলার ঢেলেছে টেলিকম শিল্পে। ১৯৯৭-২০০০ ছিল টেকনোইউটোপিয়ার যুগ। প্রযুক্তিই একমাত্র সমৃদ্ধি আনবে এই বিশ্বাসে প্রতিটা আমেরিকান জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে সর্বশ্রান্ত হয়েছে। বলা যায় তাদের টাকার জোরেই শুধু আমেরিকাতে থেকেই তিনটি চাকরি পেয়েছিলাম ভারতে পি এই চ ডি শেষ করার আগেই এবং দুটিতে স্যালারি ছিল ছয় অঙ্কের ওপরে। থিসিস জমা দেওয়ার পরের দিনই আমি আমেরিকা আসি এবং তার পরের দিন থেকেই কার্যত কাজে। কারন তখন অপটিক্যাল ট্রান্সমিশনে এক্সপার্ট লোক প্রায় ছিল না। আর তিন বছর বাদে- বাজারই আমাকে তুলেছিল-আবার যথাস্থানে নামিয়েও দিল। তখন আমার আট বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতার কোন মূল্য নেই। আমি ত ছার। আমার বসের মতন লোকেরা যিনি এম আই টির প্রাত্তন অধ্যাপক এবং ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা -তার ও দুর্দিন গেছে।

এর নাম বাজার। জীবনের শুরুতেই এর যে অপূর্ব মহিমা আমি দেখেছি-তারপরে ধনতন্ত্রের প্রতি আস্থা আমার উবে গেছে।
এর মানে এই নয় যে লেনিনিজমে বা সমাজতন্ত্রে আমার বিশ্বাস এসেছে-বরং আমার চিন্তাধারা সিস্টেম এগনস্টিক হয়েছে।
আমি পর্যবেক্ষক মাত্র। খুব অদ্ভুত এই বাজার। এখানে যুক্তির স্থান নেই-সবাই লাস ভেগাসের স্লট মেশিনের মতন ফাটকা খেলছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হত-আস্তে আস্তে নিজেকে বোঝাকে সমর্থ হয়েছি ধনতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়াতে জ্ঞান এবং কোন সাবজেক্টের প্রতি ডেডিকেশনের কোন মূল্য নেই-শেষ কথা ডলার। বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতেও এই ভাইরাস এখন সংক্রামিত। সব প্রফেসরটা চাকরি টেকাতে যেভাবে টাকা আনার পেছনে ছুটছে বড় বাজারের মারোয়ারীরা ওদের দুহাত তুলে প্রনাম করবে।

রিশেসনের আরেকটা গল্প না বললে এই অধ্যায় শেষ হবে না। আমার কোম্পানীতে বাহাত্তর বছরের এক বৃদ্ধ রবার্ট হাউসেন ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
রেড ব্যাঙ্ক নদীতে ও আমাকে সেইলিং করতে শিখিয়েছিল। হার্ভাড ইলেক্ট্রিক্যালের পি এচ ডি এবং টি ওয়ান প্রযুক্তি যা পৃথিবীর প্রথম ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তি- তার আবিস্কারক এই হাউসন সাহেব। ২০০২ সালে তার ক্যান্সার ধরা পরে। প্রস্টেট ক্যান্সার। আমি বল্লাম তুমি রেস্ট নাও। ও বললো তাহলে আমার চিকিৎসা কে করবে? রিয়ারমেন্টের সব টাকা, পেটেন্টের সব টাকা টিস্যু পেপার এখন!

ওর মতন একজন কৃতবিদ্য লোককে শুধু মেডিক্যাল ইন্সোরেন্সের জন্যে ক্যান্সার নিয়ে প্রতিদিন অফিসে আসতে হচ্ছে-আমার খারাপ লাগত। ও বলত এই বেশ ভাল আছি। আর কদিনই বাঁচাবো! বরং কাজ করেই বাঁচি। হাউসন আমার বাবার সম বয়সী। আমার বাবা গ্রামের হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন-তার ও পেনসেন আছে। তিনি অবসর জীবন নিশ্চিন্তেই কাটাচ্ছেন। আর হাউসন সাহেবের মতন একজন বিখ্যাত প্রযুক্তিবিদ ধনতন্ত্রের জাঁতাকলে চিরকারই তেল বার করে গেলেন! কে জানে-এই মানবিকতাটুকু নেই বলেই হয়ত ধনতন্ত্র কাজ করে-সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে লালবাতি জ্বলছে!

তবে কিছু "জেন" উপলদ্ধিও হয়েছে ওই তিন বছর। আমেরিকা কেন উদ্ভাবন করে , আর বাকীদের গবেষনা কেন ল্যাবেরাটরীতেই পড়ে থাকে, সেই সমীকরণ পরিস্কার হয়েছে। জীবনত একটাই-আমি কৃতজ্ঞ যে ধনতন্ত্রের হৃদপিন্ডতে বসে তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। যেদিন দেখলাম চ্যাসিগুলো থেকে সবাই যেযার মতন দামী দামী আম্পলিফায়ার খুলে নিয়ে যাচ্ছে -নিজেকে বোঝালাম আমি বাজারের ক্রীতদাস। বাজার মহারাজ যা চাইবে-আমি তার বাইরে একচুল কিছু করার সামর্থ্য রাখি না।

(২) মিডিয়া রিশেসন-২০০৭ এবং পরবর্তী

নিউজার্সিতে স্টার্টআপ গেমে এত মগ্ন ছিলাম-ক্যালিফোর্নিয়াতে নতুন চাকরিতে জয়েন করার পর, ঠিক করলাম -অনেক হয়েছে। এবের খাব স্ফূর্তি করব -আর ঘুরবো। এটা ছিল জার্মান কোম্পানীর রিসার্স এন্ড ডেভেলেপমেন্টের কাজ। ইউরোপে প্রায় ৪৫ দিন লোকে ছুটি পায়। ওদের সাথে কাজ করতে হত বলে, আমেরিকাতে কাজের চাপ ছিল অনেক কম। তাছারা ইউরোপিয়ানরা ব্যাবসা এবং শিল্পের ব্যাপারে রক্ষনশীল। ওদের কাজের প্রতি একটা এটাচমেন্ট আছে-যা আমেরিকানদের নেই। যেমন আমাদের এন্ড্রেস হাউসার মোটামুটি ৮০ বছর ধরে ইনস্ট্রুমেন্টেশন শিল্পেই ছিল। ওরা ওটাই করে-এবং তাতেই বিশ্বসেরা। আর কোন ব্যাবসা তারা করে না। আমেরিকাতে এবং তার দেখাদেখি ভারতে, কারুরই প্রায় শিল্পের প্রতি সেই টান নেই। সবাই ফরেদার। একটা ব্যাবসাতে সফল হলে রিয়াল এস্টেট থেকে প্লেইন কেনা সব কিছুই করে বসে। যার জন্যে আমেরিকানরা উদ্ভাবনে সফল হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাবসার ব্রান্ডিং এ জার্মানী থেকে পিছিয়ে। আমার অবাক লাগত ওখানে সবাই ১৫-২৫ বছর ধরে চাকরি করছে। ওরা হায়ার ও খুব বেশী করে না-ফায়ার ও করে নি। আস্তে আস্তে সর্বোৎকৃষ্ট প্রযুক্তি বানাতে থাকে।
একটা ফিল্ডে বহুদিন কাজ না করলে, উৎকর্ষতা আসে না। আমেরিকানরা অবশ্য উৎকর্ষতা, প্রযুক্তির প্রতি প্যাশন এসব নিয়ে চিন্তিত না-তাদের কাছে বোতলে জল ভরে ব্যাবসা করা আর ন্যানোটেকনোলজিতে কাজ করা -সব কিছু মাপার একটাই নিমকাঠি- ডলার।

যাইহোক এখানে দুর্দান্ত তিনটে বছর কাটালাম। এই বছরগুলি আমেরিকানদের জন্যেও বেশ ভাল-রিয়াল এস্টেটে সবাই টাকা বানাচ্ছে। কাজের চাপ নেই। আমেরিকা ঘুরতে হত কাজের জন্য। ইউরোপিয়ান কোম্পানীগুলিতে খানা পিনা ঘোরা এসব বেশী হয়। লেখার অবসর ছিল-লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ এখান থেকেই। মোটামুটি ভাবে বড়লোক হব সেই স্বপ্নও নেই-তাই দৌড়ঝাঁপ ও নেই। টাকার পেছনে না দৌঁড়ালে জীবনটা অনেক সহজ । এন্ড্রেস হাউসারে অধিকাংশ কর্মী সারাজীবন কাজ করে ওখানেই রিটায়ার করে। মোটামুটি নচিকেতার এই বেশ ভাল আছি গেয়ে আর লেখালেখি করে কাটিয়ে দিচ্ছি-এমন সময় একটা অপ্রত্যাশিত ফোনকলে আবার জ়ীবনের ধারা বদলে গেল।

হলিউড থেকে এক ভদ্রলোক ফোন করে জানাল সে আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। আমি তখন স্টার্টাআপের প্রতি এত বীতশ্রদ্ধ আর একটা ভালো কোম্পানীতে এত আরামে আছি-ওই ভদ্রলোকের স্টার্টাআপে জয়েন করার প্রশ্নই আসে না। উনি বললেন একবার হলিউডে আমার কোম্পানীতে এসে ঘুরে যাও-আমার কিছু প্রশ্ন আছে-তোমার রেজুমে দেখে মনে হল, এর উত্তর তুমি দিতে পারবে। আমি কোন প্রযুক্তিবিদ না-গায়ক। এখন এই কোম্পানীটা খুলেছি। আমার ধারনা মিডিয়া এখন প্রযুক্তির হাতে-শিল্পীদের হাতে আর নেই।

ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল। জীবনত একটাই-দেখাই যাক আরেক বার স্টার্টআপ স্লট মেশিনে কয়েন ফেলে। যদি শিকে ছেঁড়ে। তাছারা আমি যা মাইনে চাইলাম -উনি আমাকে তার দেড়গুন দিলেন। ফলে না বলার আর উপায় থাকলো না। তাছারা তদ্দিনে আমি আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা-তাই নতুন চাকরি পেতে অসুবিধা হবে না জেনে, এবার জীবনে দ্বিতীয়বারের মতন ঝাঁপালাম।

২০০৭ সালে আমেরিকান মিডিয়াতে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গেছে। মূল কারন সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ইউটিউব এবং ক্রেগ লিস্ট। লোক্যাল প্রিন্ট মিডিয়ার সব থেকে বড় ইনকাম সোর্স ক্ল্যাসিফায়েড বিজ্ঞাপন। ক্রেগলিস্ট বিনা পয়সাতে সে সুযোগ দেওয়াতে আমেরিকাতে লোক্যাল নিউজ পেপার বলে কিছু থাকল না। সাংবাদিকদের আঁতুর ঘরই ধ্বংশ তখন। হলিউড এবং টিভি মিডিয়া ইউ টিউবের চাপে দিশে হারা। সব সিনেমা, সব ডিভিডি পাইরেটেড হয়ে ইউ টিউবে দেখা যাচ্ছে। হলিউডের পর্ণ শিল্পও ২০০৬ সালেই শেষ-পাইরেসি এবং হোম মেড পর্নের কৃপায় লোকে আর টাকা দিয়ে নগ্নতা কিনছে না! এমন দুর্দিনে আমার হলিউডে পদার্পন। আমার কলিগরা এক সময় প্রচুর টাকা কামাত। কিন্ত ২০০৫ সাল থেকে ওরা প্রায় বেকার বসে আছে। আসলে হলিউডে দুটো ক্লাস আছে-যার একদম ওপরে তারা ডিজনি বা ফক্সে কাজ করে। হলিউডের অধিকাংশ জীবিকা সংস্থান হয় সফট পর্ন নির্ভর বি গ্রেড সিনেমাগুলিতে।

মিডিয়ার শোবিজনেসে আসলে সবাই নানা প্রকৃতির ম্যাজিশিয়ান। বাস্তবতা থেকে ইনারা অনেক দূরে থাকতে ভালোবাসেন-স্বপ্ন তৈরী করাই তাদের কাজ। সেটা করতে গিয়ে বাস্তবটাকে এরা বেমালুম ভুলে যায়। ফলে ২০০৪-৫ সালে যারা বছরে মিলিয়ান ডলার রোজগার করত, তাদের উপায় যখন শুন্যে গিয়ে ঠেকল-তারা বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কি! এটা বুঝতে পারছিল, মিডিয়া আস্তে আস্তে প্রযুক্তির হাতে চলে যাচ্ছে।ফলে অনেকেই আমাদের কোম্পানীতে টাকা ঢালতে লাগলো -এবং এখানে লোকের প্রত্যাশাটাও সিনেমাতে টাকা লাগানোর মতন। হলিউডের ছোট সিনেমাগুলোতে ছোট ছোট ইনভেস্টররা টাকা খাটায়-এই ভাবেই তারা এতদিন করে খাচ্ছিল। ইউ টিউব সহ ভিডিও শেয়ারিং সাইটের জন্যে দুর্দিন তাদের সামনেও। তারাও এবার টেক স্টার্টআপে টাকা ঢালা শুরু করল। এবং এই ধরনের প্রত্যাশা থাকলে যা হয়, তাই হল। সেই হাজারটা নতুন প্রজেক্ট শুরু করে-কোনটাই শেষ না করার জন্যে লালবাতি জ্বলা শুরু হল।

হলিউড সত্যই এক অদ্ভুত সৃষ্টি- অনেক লোকের পকেটে এক পয়সা নেই-অধিকাংশ নায়ক নায়িকাই বেকার-অড জব করে দিন কাটে-এদিকে তাদের দেখাতে হবে তারা বড়সর অভিনেতা। ফলে একাধিক নায়ক নায়িকা একসাথে বেভারলি হিলসে মাত্র একটা ঘর ভাড়া করে-লোককে দেখানোর জন্যে। পোষ্টাল এড্রেসের জন্যে। নিজেরা থাকে বারব্যাঙ্কের বস্তিতে।
হয়ত ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করে-দু একটা টিভি সিরিয়ালে মুখ দেখিয়েছে-কিন্ত পেপারে বা টিভিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় এমন ম্যাজিক ক্রিয়েট করবে যেন মনে হবে এ বোধ হয় সত্যই বেভারলি হিলসে থাকা কেও কেটা অভিনেতা।
আগে ছোট খাট লো বাজেটের সিনেমা অনেক হত হলিউড থেকে-ক্রমশ ইউটিউব আর টরেন্টের পাইরেসির দৌঁড়াত্বে তা কমতে থাকে-ফলে এদের হতাশাও ক্রমশ আরো বাড়তে থাকে। সাথে সাথে টাউটগিরি এবং ঠকানোর প্রবনতাও।

সবাই মিডিয়া ম্যাজিক সৃষ্টি করতে গিয়ে, নিজেরাই ম্যাজিকের শিকার হয়। এই ব্যাপারে সাংবাদিকদের নিয়েও দুকথা বলা দরকার। আমেরিকাতে সাংবাদিক পেশাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়, এই চাকরির সৌজন্যে। এর আগে অব্দি সাংবাদিকদের প্রতি আমার বিশাল শ্রদ্ধা ছিল। আস্তে আস্তে বুঝলাম এরা ওই ম্যাজিকে ম্যাজিকশিয়ানদের জাদুদন্ড। এবং অধিকাংশই নিজেদের পাতা মাইনে আহত সৈনিক। সিনেমা জগতের অধিকাংশ সংবাদই টাকা দিয়ে তৈরী হয়-সুতরাং নিরেপেক্ষ সাংবাদিকতা বলতে কিছু নেই-সব খবরই টাকার কাছে নাকখঁত দিয়ে বসে আছে। কর্পরেট জগতের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে, সম্পাদক মোটেও সেটি ছাপাবেন না-কারন বিজ্ঞাপন বিভাগ সম্পাদকের চাকরি খাবে। বেসিক্যালি সংবাদ বলতে যেটি আমাদের পরিবেশন করা হয়-সেটি সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন দাতা ও রাজনৈতিক লবির দাদাদের সেন্সর করা একটি রসগোল্লা। যেকারনে সোশ্যাল মিডিয়া আসার সাথে সাথে মূলধারার সংবাদ পত্রগুলি একদম শুয়ে পড়েছে। এই ধরনের ধাপ্পাবাজি আর কদিন জনগণ মেনে নেবে? ফলে আমেরিকাতে প্রায় ৯০% সাংবাদিকই বেকার। সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্লগ লিখে দুপয়সা রোজগার করছে। ভারতে এই দিন এখনো আসে নি-কারন ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রচলন এখনো হয় নি। আস্তে আস্তে সেটা আসছে-এবং আগামী দশ বছরের মধ্যে ভারতেও সাংবাদিকরা বেকার ঘুরবে। ওটা কোন পেশা বলেই গণ্য হবে না। ব্লগার বলে একটা নতুন পেশার জন্ম হবে। সাংবাদিক পেশাটাকে যেটুকু কাছ থেকে দেখেছি-এটিকে একধরনের বুদ্ধিজীবি বেশ্যাবৃত্তি বলেই গণ্য করব।


(৩) সাবপ্রাইম ক্রাইসিস -২০০৮-২০১০ (!)

আমেরিকার সাবপ্রাইম সংকট যেভাবে গোটা বিশ্বর অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিল-তাতে নিশ্চয় আজকাল আর কেও অবাক হবে না। বাড়ির দামের এত অযৌত্বিক বৃদ্ধি আমি দেখেছি-এতে কোন সন্দেহই নেই ব্যাঙ্কের ঢালা টাকায় খুব সুপরিকল্পিত ভাবে এই বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০০৪ সালে যখন ক্যালিফোর্নিয়াতে পৌঁছালাম, তখন এনাহেমের মতন শহরে যেখানে লোকেদের গড় উপায় ৪৪ হাজার ডলারের কম-অধিকাংশই মেক্সিকানদের বাস-সেখানেও একটা তিন বেডরুমের বাড়ির দাম ৭০০ হাজার ডলার। এনাহেম ডিজনিল্যান্ডের জন্যে খ্যাত। তার পাশেই থেকেছি তিন বছর। যে জিনিসটা অবাক করেছে-ঐ এলাকাতে ডিজনিকে কেন্দ্র করে বছরে দু বিলিয়ান ডলারের ব্যাবসা হয়-অথচ ডিজনির এলাকা বাদ দিলে শহরটাতে বস্তির সংখ্যাই বেশী। এই শহরের অধিকাংশ কর্মীই ছিল ডিজনিল্যান্ডের -যারা ঘণ্টায় ১৪-২০ ডলার রোজে কাজ করে। বা হোটেলে কাজ করে। কিন্ত এই দুই বিলিয়ান ডলার যাদের হাতে পৌঁছাত, তারা থাকত বিলাস বহুল নিউপোর্ট বিচে বা আরভাইনের মতন বড়লোকদের শহরে। এই ধনতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক উন্নতির বৈষম্য দেখতে হলে দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে আসুন। কোন জায়গায় শিল্প স্থাপন হলেই যে সেই শহরটির ভাল কিছু হবে-এই ধরনের অতি সরল অর্থনৈতিক ধারনা, আনাহেমে থাকলে উড়ে যাবে।

এবার ভাবুন এমন এক বস্তিময় শহরে যদি বাড়ির দাম ৭০০ হাজার ডলার হয়-তাহলে বাকী ভালো জায়গা গুলোর কি অবস্থা ছিল? আরভাইন, ডেনা পয়েন্ট, হানটিংটন বিচের মতন শহর গুলিতে বাড়ির দাম ছিল আরো বেশী। এমন নয় ক্যালিফোর্নিয়াতে সরকারি চাকুরেররা ভাল মাইনা পায়। বরং উলটো। ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুলে ৪০% শিক্ষক নেই। সেসব নিয়ে এখানের লোকের মাথা ব্যাথা খুব দেখি নি। সবাই বাড়ি বেচাকেনা করে পয়সা করতে দৌঁড়াচ্ছে। বাড়ি বেচা কেনা করে সবাই নাকি মিলিয়নার হয়েছে। ধণতন্ত্রের অদ্ভুত সৃষ্টি এই দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়া।

সাবক্রাইম ক্রাইসিসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চল। বাড়ির দাম এত বাড়ছিল ২০০১ সাল থেকে শহর থেকে অনেক দূরে, ১০০ মাইল দূরের ছোট ছোট মরূশহর গুলিতে লোকে অবাধে বাড়ি বানাচ্ছিল-এবং তার থেকে কখনো দ্বিগুন, কখনো চারগুন লাভ করেছ। কিন্ত এই এলাকাতে লোকের ইনকাম বলতে শুধু হলিউড, কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প আর পর্যটন। তার ওপর ভিত্তি করে এত বড় অর্থনীতি আর বাড়ির দাম কি করে সম্ভভ? হলিউডে খুব বেশী হলে ১৫০,০০০ লোকের কর্ম সংস্থান হয়। পর্যটন শিল্পে ২০০,০০০। আর ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে ধরে নিচ্ছি খুব বেশী হলে ৩০০,০০০ এর মতন। এদিকে লোকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ। যাদের অধিকাংশ কর্মরত ছিল গৃহশিল্পে। ফলে সাবক্রাইম ক্রাইসিস ২০০৮ সালে শুরু হলেও ২০০৫ সাল থেকেই এখানে বাড়ির দাম পড়তে শুরু করে। অসংখ্য বেকার দেখেছি ওই তিন বছর যারা এই নির্মান শিল্পের সাথে জড়িয়ে ছিল। কোন কোন পাড়াতে ১০ টি বাড়ির মধ্যে সব কটিই ফোরক্লোজারে গেছে-সেটাও দেখেছি। নতুন নির্মিত শহরে এই প্রাদুর্ভাব ছিল অনেক বেশী। মর্টগেজ দিতে না পারার জন্যে বাড়ি ছেরে লোকে গাড়ি শুয়ে জীবন কাটাচ্ছে এই দৃশ্যও বিরল ছিল না সান বার্নেডেনোর মতন গরীব এলাকাতে। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতি সত্যই আমার কাছে মিরাকল! লোকের মাইনা যেখানে অতি সাধারন, সেখানে কি করে বাড়ির দাম এত উঠতে পারে ব্যাঙ্কের দুর্নীতি ছারা?

এই একই ভয় পাচ্ছি কোলকাতা রিয়াল এস্টেট নিয়ে। কোলকাতাতে লোকের মাইনার মিডিয়ান খুব বেশী না-বাড়ির দাম এদিকে আকাশ ছোঁয়া। কোন না কোন দিন এই বাবল বার্স্ট হবেই। প্রবাসীরা অধিকাংশ বাড়ির মালিক বলে, হয়ত খুব শিঘ্রী এখানে ফাটকাবাজি ফাটবে না। কিন্ত ব্যাপার হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করার টেন্ডডেন্সি শুরু হলেই, কয়েক মাসের মধ্য সহজেই বোঝা যেত যে শহরের উপায় এত কম, সেখানে বেশী বাড়ির দাম ফাটকাবাজি ছারা কিছু না।

নিজেকে এই ব্যাপারে সৌভাগ্যবানই ভাবি। ২০০৫ সালে কোম্পানী লোন দিতে চেয়েছিল বাড়ি কেনার জন্যে। আমি অনেক বাড়ি দেখে এবং মোটামুটি সাধারন বুদ্ধি লাগিয়ে বুঝেছিলাম, মার্কেট সম্পূর্ন বাস্পের ওপর। বার্স্ট হল বলে। ফলে আরো দু বছর দেখার সিদ্ধান্ত নিই। এবং সেটা না করলে আজকে বিশাল দেনার দায়ে ডুবে যেতাম। ওখানে অধিকাংশ এলাকাতে বাড়ির দাম কমেছে ৫০% করে। ৭০% দাম কমতেও দেখেছি। আসলে ব্যাঙ্কের ঋন সাপ্লাই এ দাম বেড়েছিল এত। আসলে ত অধিকাংশ লোক কাজ করে ঘন্টায় ২০ ডলার রোজে-তাদের পক্ষে সম্ভব না ওই মর্টগেজ দেওয়া। তবুও তারা বাড়ি কিনেছিল-কারন ব্যাঙ্ক টাকা ধার দিচ্ছিল-প্রথম বছর শুধু ইন্টারেস্ট দিতে হবে। আর এক বছর বাড়ি রাখতে পারলেই শুধু একটা বাড়ি থেকেই ১০০-২০০,০০০ ডলার লাভ হচ্ছিল। ফলে এক বছর বা ছমাস বাদে বেচে দিয়ে অনেকেই অনেক লাভ করে বেড়িয়ে গেছে। এবং সেই লাভের টাকায় আরো বেশী যখন ইনভেস্ট করতে গেছে, সম্পূর্ন ডুবে গেছে।

কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাঙ্ক ত এসব কিছুই জানত। এনালিস্টরা সাবধান করে নি কিন্ত। পরে তাদের কাছ থেকেই জেনেছি ম্যানেজাররা তাদের রিপোর্ট চেপে যেত বলত। কারন তা না হলে বিশাল বোনাস হারানোর ভয়। অর্থাৎ পরিস্কার ভাষায় প্রতিটা ব্যাঙ্কের কতৃপক্ষ ডাকাতি করেছে। কোটি কোটি আমেরিকানকে দেনার দায়ে ডুবিয়েছে। এবং পরে সরকারি টাকায় নিজেদের উদ্ধার করেছে। ডাকাতি করার জন্যে সরকারি পুরস্কার। এটা এই সমাজ ব্যাবস্থাতেই সম্ভব। আবার এটাও ঠিক ফি বছর আমেরিকাতে যতজন সি ই ও জেলে ঢোকে-কোলকাতা পুলিশ সারা বছর ততজন ডাকাত ধরতে পারে কি না সন্দেহ।

(৪) আমেরিকান অভিজ্ঞতা

এবার আমেরিকানদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলা দরকার।

আমেরিকানরা ছোটবেলা থেকেই পুতুল প্রিয়। গাড়ি, ভিডিও গেমস-গ্যাজেট-বিপুল খাওয়া দাওয়া। বাচ্চারা যেমন নিজেদের ছোটবৃত্তের মধ্যে পুতুল নিয়ে খুশী-আমেরিকানরাও তাই। প্রায় সবাই অর্থনীতি এবং রাজনীতির ব্যাপারে বিগ বেবী। আমি রাজনীতিতে নেই-জীবনটা উপভোগ করে কাটাব-চার্বাক দর্শনে বিশ্বাসী। এবার তাদের ওপর যখন মন্দার খাঁড়া নেমে আসে, প্রায় সবাইকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখি। আমার অনেক কলীগকে চোখের সামনে ফায়ারড হতে দেখেছি। একবারের জন্যেও এরা রাজনৈতিক সিস্টেমকে গালাগাল দিয়েছে দেখিনি-সবাই কোম্পানী ম্যানেজমেন্টকে গাল পেড়ে নতুন চাকরি খুঁজতে নামে। অবস্থা যখন নিদারুন কঠিন-এক বছর চাকরি না পেয়ে বেকারভাতায় বসে আছে-তখন বাজারকে গালাগাল দেয়। আমার এক কলীগ আমার কোম্পানীতেই তিন বার ফায়ারড হয়েছে-আবার হায়ারড ও হয়েছে।তার কোন হোলদোল দেখি না। বড়জোর ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাকে গালাগাল দিয়ে ছেলেকে ডাক্তারী পড়াতে চাইছে। আমেরিকান জীবনের মিউজিক্যাল চেয়ার তার কাছে স্বাভাবিক।

তবে সবার সব কিছু স্বাভাবিক যায় না। লস এঞ্জেলেসে এক মেকানিকের কথা মনে পড়ল-সারাদিন একা একা ক্যাফেটেরিয়াতে কাটাত। একদিন আলাপে বুঝলাম, সদ্য ডিভোর্সী। তার বৌ নাকি খুব সুন্দরী ছিল। তিনমাস চাকরি না থাকায়, দারিদ্র সহ্য করতে না পেরে পালিয়েছে।" নো হানি উইথদাউট মানি"-কথাটা বিরবিড় করে সারাদিন বকত। মন্দার কোপে ডিভোর্স আরো প্রচুর দেখেছি। ছাঁটাই এর জন্যে মর্টগেজ দিতে পারে নি-ফলে দশ বছরের বসত বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়েছে-এমন দৃশ্যও আমেরিকানদের মধ্যে অনেক। আসলে ভারতীয়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাল পারফর্মার বলে, মন্দার আঁচ, খুব একটা এখানকার ভারতীয় কমিউনিটির গায়ে লাগে না। বড়জোর অজান্তে কাজের চাপ বাড়তে থাকে।

নিউজার্সির সেই প্রবল রিশেসনে একবার এক আমেরিকান ট্যাক্সিড্রাইভারের সাথে কথা বলছিলাম। সফটোয়ার থেকে ছাঁটাই হয়ে ট্যাক্সি চালাচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম নিউ জার্সির এই অবস্থার জন্যে ম্যাকগ্রিভি ( তৎকালীন গভর্নর) দায়ী?
ও পরিস্কার বললো -কে ম্যাকগ্রিভি? আমি রাজনীতির মধ্যে নেই। বুঝুন ঠেলা। এই ছেলেটার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিউ জার্সিতেই। ভাবুন আমাদের কোলকাতায় কোন বাঙালী সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার বুদ্ধর নাম শোনে নি। এটা আমেরিকাতে সম্ভব। ছোটবেলা থেকে গাড়ি আর গার্লফ্রেন্ডের বাইরে এরা কিছু জানে না।

তবুও এর মধ্যে পরিবর্তন আসছে। সেই নিউজার্সিতেই এ বছর স্কুলের ছাত্ররা স্কুলের মাস্টারমশাইদের ছাঁটাই এর প্রতিবাদে বনধ করেছে। ফেসবুকে এই স্ট্রাইক অর্গানাইজ করেছিল ষোল বছরের এক কিশোরী। মাত্র তিনদিনের ডাকে হাজার হাজার ছাত্ররা পথে নেমেছিল।

কি অবস্থা এই আমেরিকার রাজনীতির। স্কুলের কলেজের শিক্ষকদের মাইনে দিতে পারে না। আমার অধ্যাপক বন্ধুদের প্রায় ফার্লো ( মানে বিনাবেতনে কয়েকদিন চাকরি) নিতে বাধ্য করাচ্ছে-আর ইরাকে আফগানিস্থানের পেছনে বছরে দেদারসে টাকা ঢালছে। ক্যালিফোর্নিয়াতে ৪০% স্কুলের শিক্ষকদের ছাঁটাই হয়েছে। যদিও সাময়িক-তবুও প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা যদি আমাদের ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্যে ব্যয় না হয়ে-ইরাকে আমেরিকান কনট্রাক্টরদের উদরপূর্তিতে যায়-নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে, আমেরিকান রাজনৈতিক সিস্টেম একটি বিকল ব্যাবস্থা।

তবুও মন্দার ভাল দিকটাও দেখছি। মন্দার ধাক্কায় আমার বিগত এক দশকের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম আমেরিকানরা জিজ্ঞাসা করছে কেন এই মন্দা? রাজনৈতিক সিস্টেমের সমস্যাটা কোথায়। যদিও সি এন এন এবং ফক্স নিউজ, আপ্রান চেষ্টা করছে আসল সমস্যাটাকে ঢেকে সন্ত্রাসবাদ থেকে ভূতবাদ ইত্যাদি জেনোফোবিয়া ছড়িয়ে মানুষের মনকে ঘুরিয়ে দিতে- এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে-তা প্রায় অসম্ভব।



Friday, October 8, 2010

লিউ জিয়াবো-নোবেল শান্তি প্রাইজ এবং কমিনিউস্টদের গালে বিরাশি সিক্কা!


সকালে উঠে প্রথমেই যে খবরটার প্রত্যাশায় ছিলাম-বলাই বাহুল্য দেখেই অত্যন্ত খুশী হলাম। দলাই লামা, ডেসমন্ড টুটু চীনের মানবাধিকার নেতা লিউ জিয়াবোকে এবারের নোবেল শান্তি প্রাইজের জন্যে বেছে ছিলেন-এবং নরওয়ের নোবেল কমিটি চীনের বিদেশ মন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন হুমকি উপেক্ষা করে লিউ জিয়াবোকেই বিজয়ী ঘোষনা করে। আগের বারে ওবামাকে নোবেল দেওয়া বেশ বিতর্কিত ছিল-এবার বলা যায় সুদে আসলে সেই খেদ মেটালো নোবেল কমিটি। চীনের গান্ধীকে যথাযোগ্য সন্মান দিয়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার বহুদিন বাদে গেল তার কাছে, যিনি সত্যিই এর যোগ্য দাবিদার।

সাথে সাথে দুনিয়া দেখলো কমিনিউস্টদের বাঁদরামো। আমি চীনা কমিনিউস্টদের আলাদা করছি না-কারন পশ্চিম বঙ্গেও কমিনিউস্টদের অসভ্যতা, বাঁদরামো এবং গুন্ডামো দেখতে দেখতে আমরা বিরক্ত। বিংশ শতাব্দিতে অসভ্যতা, অত্যাচার এবং মানবিকতার দলনের ইতিহাসে কমিনিউস্টদের কেও হারাতে পারবে না ( এই নিয়ে আমার বিস্তারিত লেখা এই লিংকে পাবেন)। নোবেল প্রাইজ ঘোষনা করা মাত্র চীনে সি এন এন বন্ধ করে দেওয়া হয়। টুইটার ও বন্ধ হয়। লিউ জিয়াবো নামে সার্চ দিলে চিনের কোন সাইটে কিছু যাতে না আসে তা সিদ্ধ করা হয়। খবর পাচ্ছি একদিনে অন্তত ১০ টি চীনা ব্লগকে বন্ধ করা হয়েছে। কিন্ত তাতেও টুইটারকে আটকানো যায় নি-প্রক্সি সাইট দিয়ে চিনারা ভালো ভাবেই খবর পেয়েছেন। তারাও আজ গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে ভাবাবেগে আপ্লুত। টুইটারে বাঁধন ভাঙা জলের মতন ছড়িয়ে পড়ছে চীনে গণতন্ত্রের দাবী।

তবে লিউ জিয়াবো এখনো সম্ভবত তার বিজয় খবর জানেন না। হয়ত তিনি এখনো জেলে পাথর ও ভাংছেন। তার স্ত্রী লু জিয়াকে চীনা পুলিশ গতকালই তুলে নিয়ে গেছে যাতে তিনি মিডিয়ার সাথে কথা বলতে না পারেন। সাথে সাথে নরওয়েকে শাসাচ্ছে চীনা মিডিয়া এবং সরকার। প্রকাশ্যেই।

কি করেছেন লিউ জিয়াবো? যার জন্যে তিনি এই নিয়ে চতুর্থবারের জন্যে জেলে? ১৯৮৯ সালে তিয়েমান স্কোয়ারের বিক্ষোভের সময় তিনি আমেরিকাতে পড়াচ্ছিলেন। দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেখে বিদেশে স্থির থাকতে পারেন নি বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের এই অধ্যাপক। জেল অবধারিত জেনেও চীনে ফিরে আসেন শুধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্যে। এবং দু বছরের জন্যে তাকে জেলে পাঠানো হল। মনে রাখতে হবে, তিনি কোন আইন ভাঙেন নি। শুধু গনতন্ত্রের দাবিতে লিফলেট ছড়িয়েছিলেন। অবশ্য কমিনিউস্টদের চোখে সেটাই অপরাধ। এর পর আবার জেল ১৯৯৫ সালে ছমাসের জন্যে-সেই গণতন্ত্রের দাবিতে। ১৯৯৬ সালে চীনা সরকার তাকে তিন বছরের জন্যে "কমিনিউস্ট রিহ্যাবিলেটশনে" পাঠায়। যেহেতু তিনি কমিনিউজমের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্যে সোচ্চার দাবিদার- তাকে লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হয় কমিনিউম বুর্জোয়া গণতন্ত্রের থেকে কত মহান তা পাথর ভেঙে শিক্ষা দিতে। তাতেও তাকে দমানো যায় নি। লিউ জিয়াবো পন্ডিত লোক। তিনি জানেন এবং বলেন, পৃথিবীতে যারাই স্বৈরাচারি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে-সবার ভাগ্যেই জুটেছে মৃত্যু বা জেল। তিনিই বা ব্যাতিক্রম হবেন কেন? এই বিশ্বাসেই তিনি হাঁসিমুখে জেলে গেছেন বারংবার-যার তুলনা শুধু মহত্মা গান্ধী। শেষ জেল যাত্রা ২০০৯ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর। মাত্র দুঘন্টার বিচারে তাকে ১১ বছরের জন্যে জেলে পাঠানো হল। অবশ্য তিনি ভাগ্যবান। তার আরেক ডেমোক্রেটিক সাগরেদকে মাত্র দশমিনিটের বিচারেই তিন বছরে জেলে পাঠানো হয়েছে। তার স্ত্রী বা অন্য কোন ইন্টারন্যাশাল অবর্জাভারকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি কোর্টরুমে।

তার অপরাধ?

চার্টার ০৮

চীনে গনতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে একটি সনদ লিখে সেটি ব্লগ সাইটে প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল তার। চীনে বিশিষ্ঠ ৩০০ জন বুদ্ধিজীবী তাতে সাক্ষর করেন ( এদের মধ্যে ৬০ জন জেলে বাকিদের ভাগ্যে জুটেছে নানা রকমের হেনস্থা) । এই চার্টার প্রকাশের আগেই তাকে তুল নিয়ে যায় পুলিশে। কি বক্তব্য ছিল চার্টারে?

This year is the 100th year of China's Constitution, the 60th anniversary of the Universal Declaration of Human Rights, the 30th anniversary of the birth of the Democracy Wall, and the 10th year since China signed the International Covenant on Civil and Political Rights. After experiencing a prolonged period of human rights disasters and a tortuous struggle and resistance, the awakening Chinese citizens are increasingly and more clearly recognizing that freedom, equality, and human rights are universal common values shared by all humankind, and that democracy, a republic, and constitutionalism constitute the basic structural framework of modern governance. A "modernization" bereft of these universal values and this basic political framework is a disastrous process that deprives humans of their rights, corrodes human nature, and destroys human dignity. Where will China head in the 21st century? Continue a "modernization" under this kind of authoritarian rule? Or recognize universal values, assimilate into the mainstream civilization, and build a democratic political system? This is a major decision that cannot be avoided.[7]


খুব সুন্দর বক্তব্য-এই একবিংশ শতাব্দিতে পৃথিবীর কোন রাজনৈতিক সিস্টেমই বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে চলতে পারে না। অথচ চীনের স্বৈরাচারী কমিনিউস্ট সরকার ঠিক তাই করে চলেই চলেছে। এমনকি প্রাইজ পাওয়ার পরেও বোকার মতন মিডিয়া সেন্সরশিপের বাঁদরামো করে পৃথিবীতে সবার সামনে হাস্যস্পদ হচ্ছে। ভাবা যায় চীনের কোন মিডিয়াতে এই খবর প্রকাশ করা হয় নি? যে কটি ব্লগ সাইট তা করার সাহস করেছিল-তাদেরকে বন্ধ করা হয়েছে। টুইটার নিশিদ্ধ -সি এন এন এবং সব আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ওপর সম্পূর্ন ব্ল্যাক আউট।

লিউ জিয়াবোর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার গোটা পৃথিবী। আমআদমি থেকে ওবামা একই সুরে কথা বলছেন। চীনের অবশ্য তাতে রক্ত চক্ষু দেখানো কমে নি। তারা নোবেল কমিটি একজন "অপরাধি" কে কি করে প্রাইজ দিতে পারে সেই নিয়ে
বোকা বোকা প্রশ্ন তুলছে! চীনা বিদেশমন্ত্রীর কি এটুকু পড়াশোনাও নেই যে তিনি জানেন না নেলসন ম্যান্ডেলা বা মহত্মা গান্ধী কবার জেল খেটেছেন? তারা কি জানেন না গান্ধী বলে গেছেন স্বৈরাচারীদের তৈরী জেল গণতন্ত্র প্রেমীদের পবিত্র মন্দির?

আমি বারবার যে কথাটা লিখতে চাই-সেটা ইতিহাসের সহজতম সত্য। ক্ষমতাই পচনের মূলে। কমিনিউজম তাত্বিক দিয়ে খুব খারাপ কিছু না হলেও, লেনিন যেভাবে ভোটে হেরে, গণতন্ত্রকে খুন করে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন করার স্কীম করে গেছেন, সেটাই কমিনিউস্টদের পৃথিবীর সব থেকে অত্যাচারী ঘৃণিত জীব বানিয়েছে। সিস্টেমের নাম ক্যাপিটালিজমই হোক বা কমিনিউজম হোক-সর্বত্র সমস্যার সূত্রপাত "ক্ষমতা"থেকে-সে ক্ষমতার উৎস টাকাও হতে পারে- আবার লেনিনিজমও হতে পারে ( আমি কমিনিউজম না বলে লেনিনিজম লেখাই ঠিক মনে করি-চমস্কির সাথে আমিও সহমত -আসলেই লেনিনিজম কমিনিউজমের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস)। মার্কেটের মনোপলি বা রাজনৈতিক ক্ষমতার মনোপলি দুটোই খারাপ-এবং কারনটাও সেই এক-ক্ষমতার পুঞ্জীভবন। লেনিন, স্টালিন বা মাওদের মতন অমানবিক নরদানবদের তান্ডবলীলা যে সোভিয়েতের পতনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় নি-লিউ জিয়াবোর নোবেল প্রাইজ আবার তা স্বরণ করালো।

আমাদের বঙ্গজ কমিনিউস্টরা লিউ জিয়াবোর নোবেল প্রাইজকে সহ্য করতে পারছেন না-আমি তাতে আনন্দিত। ওদের মুখোস আরো খসে পড়ছে। লিউ জিয়াবোর বিচারের কমিনিউস্ট তামাসা আজকে পৃথিবী ডিটেলসে জানল-কিন্ত আমাদের মতন যারা কমিনিউজমের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছে-তারা বিলক্ষন জানেন, কমিনিউজমে বিচার মানে, বিচারক অপরাধ পড়ে শোনায়। কয়েদি তা স্বীকার করে। খাতা কলমে তাই লেখা থাকে। ঠিক যেমন ভাবে বুখারীন তার "অপরাধ" স্বীকার করেছিলেন ৩০ মিনিটের বিচারে-এবং তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল-ঠিক তেমন ভাবেই লিউ জিয়াবো "অপরাধ" স্বীকার করেছেন। যেমন গান্ধী করেছিলেন। স্বরাজ যদি অপরাধ হয়, গান্ধী সেই অপরাধে বার বার জেল খাটতে রাজী ছিলেন। লিউ ও একই দর্শনের পথিক। গণতন্ত্রের দাবি যদি অপরাধ হয় লিউ বার বার জেলে যেতে রাজি। সেটাই তার স্বৈরাচারী কমিনিউস্ট শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-যা কমিনিউস্ট বাঁদরদের মানুষের মুখোস আরেক বার খুলে নিল।

Thursday, September 30, 2010

অবাক অযোধ্যা, নির্বাক করলে তুমি


বহু দুঃস্বপ্নের রাতের পর, রাম জন্মভূমি বনাম বাবরি মসজিদ মামলারা রায় আমরা পেলাম। গত দুদিন গোটা ভারত ছিল থমথমে- সর্বত্র পুলিশ মিলিটারি-এস এম এসে নিশেধাজ্ঞা-সব কিছু লাফিয়ে, অযোধ্যা মামলার রায় দিল লখণৌ হাইকোর্ট।
(রায়টি অনলাইন এখান থেকে সবাই দেখে নিন।)

বিতর্কটি কি? খুব সিরিয়াসলি পলিটিক্যালি কারেক্ট ভাবে বললে ১৯৯২ সালে হিন্দুত্ববাদিদের হাতে ধ্বংশ প্রাপ্ত বাবরি মসজিদটির জমি নিয়ে গত ১৫০ বছর ধরে ধারাবাহিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। বৃটিশরা বুদ্ধিমান জাত-তাই দাঙ্গা ঠেকাতে ১৮৫৯ সালে ফৈজাবাদের কালেক্টর মসজিদের জমিতে প্রাচীর দিয়ে হিন্দু আর মুসলিমদের উপাসনা স্থান পৃথক করেন। এই ভাবেই নিরুপদ্রব ভাবে চলেছে নব্বইটি বছর-যদিও মাঝে মাঝেই মন্দিরওয়ালা এবং মসজিদওয়ালাদের মধ্যে গন্ডোগল এবং কোর্ট কাছারি লেগেই থাকত। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আসল ঘটনা শুরু। কিছু হিন্দুত্ববাদি সংগঠন হঠাৎ করে রাতের বেলায় মসজিদের মধ্যে রামলীলা ঢুকিয়ে দিয়ে এলাহাবাদ কোর্টে মামলা করে, ঐ স্থল হিন্দুদের উপাসনার জন্যে খুলে দিতে হবে। নেহেরু এই সব উটকো ধার্মিক মালগুলোকে একদম পাত্তা দিতেন না। ফলে উনি কালেক্টরকে বললেন ঐ জায়গাটাই তালা ঝুলিয়ে দাও। কাউকেই উপাসনা করার নামে বাঁদরামো করতে দেবে না সরকার। ফলে সবাই ভুলেই গিয়েছিল বাবরি মসজিদের কথা। কিন্ত নেহেরুর নাতি রাজীব গান্ধী দাদুর মতন বিচক্ষন ছিলেন না। শাহবানু মামলায় কংগ্রেস মুসলিম মৌলবাদিদের নির্লজ্জ তোষন করাতে হিন্দুরা যখন অসন্তুষ্ট, তাদের মন টানতে ১৯৮৬ সালে উনি মসজিদের তালা খুলে দিলেন, হিন্দুদের উপাসনার জন্যে। কোন দরকার ছিল না-এই মরা সাপটিকে জ্যান্ত করার। কিন্ত রাজীবের অভিজ্ঞতা ছিল না নেহেরুর মতন-ফলে আধুনিক ভারতের সব থেকে কলঙ্কময় নদর্মার জলকে খালকেটে উনিই নিয়ে আসলেন। এবং এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত্বও করলেন-বিজেপি
১৯৮৪ সালে দুটী আসন থেকে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ৯০ টি আসন পেল। বাঘের পিঠে চাপতে গিয়ে, বাঘই খেল রাজীবকে-উনি গদিচ্যুত হলেন। বিজেপি ক্ষমতা পেল আংশিক ভাবে। ভারতের কমিনিউস্ট-হিন্দুইস্ট সরকার একজোটে চলল ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। উত্তর প্রদেশে কন্যান সিং সরকার ক্ষমতায় এল-পরিস্কার হল বাবরি মসজিদ ভাঙার কাজ। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে করসেবকরা যখন মসজিদ ভাঙছে-কল্যানের পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। তার পরেই এই জমিটা নিয়ে নিল সরকার এবং এই মামলার সূত্রপাত। এই দুই একর জমি কার?

রামের কোন ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নেই। স্পাইডার ম্যান, ফ্যান্টমের মত তিনি এক পৌরানিক সুপার ম্যান, যাকে হিন্দুরা খুব মানে। রামের জন্মস্থান অযোধ্যা বলা আর স্পাইডারম্যানের জন্মস্থান নিউয়ার্ক বলার মধ্যে পার্থক্য নেই। আমেরিকার অনেক শিশু যেমন মানে স্পাইডারম্যান ম্যানহ্যাটনে থাকেন-থাকতেই হবে-হিন্দুরাও মানে রামের জন্ম অযোধ্যায় কারন রামায়ন অযোধ্যাকে কেন্দ্র করে।

এবার ধরুন কোন স্পাইডারম্যান ভক্ত দাবি করে বসল নিউইয়ার্কের এই বাড়িটিতে স্পাইডারমানের জন্ম, তাই বাড়িটি ভারা দেওয়া যাবে না, স্পাইডার ম্যান ভক্তরা সেখানে পুজো দিতে আসবেন। দাবি করলে ক্ষতি নেই-ধরুন মামলা করল। এবার কোর্ট কি করবে?

ঘাবরাবেন না। এর উত্তর ভারতের মহামান্য বিচারপতিরা গতকালই দিয়েছে-সেটা নিয়ে হাঁসাহাসি একটু পরে করব। তার আগে আমরা জানতে চাইব-হিন্দুদের অত রাগ কেন ঐ মসজিদের ওপর?

মসজিদটি কে বানিয়েছিল কেও জানে না-বাবারনামায় তার উল্লেখ নেই। কালকের রায় ও স্বীকার করেছে মসজিদটির জন্ম রহস্যর উদ্ঘাটন হয় নি। কিন্ত হিন্দুদের দাবী ওটিই ছিল রামজন্মভূমি মন্দির-অর্থাৎ ওখানেই রাম জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। ঠিক ওইখানেই। এবং বাবরের সাগরেদ ঐ মন্দির ধ্বংশ করে মসজিদ স্থাপন করে। এর উৎস জেসুইট পাদ্রী জোসেফ স্টিফেন ফেলারের ভ্রুমন কাহিনী যা প্যারিসে তিনি ছাপিয়েছিলেন ১৭৬৮ সালে।

২০০৩ সালে পুরাতাত্ত্বিক খননে পরিস্কার হয় ওখানে একটি বিরাট মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। তারা যা হাইকোর্টকে জানিয়েছেন তা এই রকমঃ

Period 1000BC to 300BC:

The findings suggest that a Northern Black Polished Ware (NBPW) culture existed at the mosque site between 1000 BC and 300 BC. A round signet with a legend in Asokan Brahmi , terracotta figurines of female deities with archaic features, beads of terracotta and glass, wheels and fragments of votive tanks have been found.[6]

Sunga Period. 200 BC:

Typical terracotta mother goddess, human and animal figurines, beads, hairpin, pottery (includes black slipped, red and grey wares), and stone and brick structures of the Sunga period have been found.[6]

Kushan period. 100-300 AD:

Terracotta human and animal figurines, fragments of votive tanks, beads, bangle fragments, ceramics with red ware and large-sized structures running into twenty-two courses have been found from this level.[6]

Gupta era (400-600 AD) and post-Gupta era:

Typical terracotta figurines, a copper coin with the legend Sri Chandra (Gupta), and illustrative potsherds of the Gupta period have been found. A circular brick shrine with an entrance from the east and a provision for a water-chute on the northern wall have also been found.[6]

11th to 12th century:

A huge structure of almost fifty metres in north-south orientation have been found on this level. Only four of the fifty pillar bases belong to this level. Above this lied a structure with at least three structural phases।

কতগুলো ব্যাপার প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষনে পরিস্কারঃ

১। ওখানে নানান মন্দির ছিল খৃষ্টপূর্বাব্দ হাজার সাল থেকেই। কিন্ত কোনটাই রাম মন্দির না-বিষ্ণু শিব ইত্যাদি জনপ্রিয় হিন্দু দেবদেবীর মন্দির ওখানে ছিল। সুতরাং ওখানে রাম জন্মভূমির মন্দির ছিল, এই দাবী টিকছে না।

২| যেটা পরিস্কার না-সেটা হচ্ছে মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ হয়েছে না, ধ্বংশাবশেষের ওপর মসজিদ হয়েছে। কোন প্রমান্য ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে না।

তা বিচারকরা [২] পয়েন্ট নিয়ে কি বললেন?

মুসলিম বিচারক খান সাহেব বললেন, মন্দির ভেঙে মসজিদ হয় নি। দুই হিন্দু বিচারক লিখেছেন, প্রমানাদি ঘেঁটে তারা নিশ্চিত, মন্দির ভেঙেই মসজিদ হয়েছে। বিচারকরা এত সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস হচ্ছে না? রায়টি পড়ে নিন।

যেখানে আদালাতের মহামান্য বিচারকরাই এত সাম্প্রদায়িক, সেখানে সাধারন জনগনের কাছ থেকে কোন অসাম্প্রদায়িকতা আশা করব?

এবার আসুন সব থেকে মজার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করি। আসলে সেই জন্যেই এই লেখা।

হিন্দুরা যে দাবী জানাল ঐ বাবরি মসজিদ, তাদের প্রাণপ্রিয় রামের জন্মস্থল, সেটা নিয়ে মহামান্য বিচারকদের বক্তব্য কি?
জাস্টিস ভীর শর্মার বক্তব্য শুনুনঃ

1. Whether the disputed site is the birth place of Bhagwan
Ram
?
The disputed site is the birth place of Lord Ram. Place of
birth is a juristic person and is a deity. It is personified as the
spirit of divine worshipped as birth place of Lord Rama as a
child.
Spirit of divine ever remains present every where at all
times for any one to invoke at any shape or form in accordance
with his own aspirations and it can be shapeless and formless
also.

পরিস্কার হচ্ছে না?
তাহলে উদাহরন দিচ্ছি। ধরুন স্পাইডারম্যান ফ্যান ক্লাব দাবী করল ম্যানহাটনের ওমুক স্ট্রীটে ৬৭৮ নাম্বার বাড়িটাতে স্পাইডারম্যানের জন্ম। তাহলে জাস্টিস শর্মার রায়টা এরকম-

এই দাবি না মানার কোন কারন নেই। কারন স্পাইডারম্যান সর্বভূতে বিরাজমান এবং বিশ্বাসীরা যদি সেই বাড়িটিকেই বিশ্বাস করে, তাহলে সেটিই সত্য!

আমি উনার রায়টা পড়ে হাঁসতে হাঁসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। যদিও কোর্ট বিতর্কিত জমিকে তিন ভাগে ভাগ করে হিন্দু মুসলিম এবং এক সেবাইত সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দিচ্ছে- কারন উনারা বলছেন জমির ওপর কারুর দাবীই আইন সম্মত না। কেওই তাদের দাবী প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি-তাই মন্দের ভাল হিসাবে মিলেমিশে চল। অর্থাৎ ১৮৫৯ সালে বৃটিশদের রায়ই বজার থাকল। জামি ভাগ করে "উপভোগ" কর।

তাহলে ব্যাপারটা কেমন হল? স্পাইডারম্যান ( রাম) এবং সুপারম্যান ( আল্লা) এর ফ্যান ক্লাবরা একটা জমি নিয়ে মারামারি করছিল-যে ওই জমিতে সঙ্গত অধিকার তাদের। কোর্ট বললো, জমিতে কারুরই আইনত অধিকার নেই-তাই জমিটা ভাগ করে স্পাইডারম্যানের পূজো কর আর সুপারম্যানের জন্য নামাজ পড়। বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করলে বড়রা যা করে আর কি!

কিন্ত রাম আর রহিমের এই নাবালকদের ছেলেমানুষিতে মাথা হেঁট হচ্ছে ভারতের বা ভারতবাসী হিসাবে আমাদের। ভারতে পৃথিবীর সব থেকে বেশী নিরক্ষর, গরীব এবং ভিখিরী বাস করে। এর পরেও গত দুই দশকে অসংখ্য তরুন ভারতবাসীর প্রচেষ্টায় প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং ব্যাবসাতে ভারতের অগ্রগতি অভাবনীয়-এবং বিশ্বের এই মুহুর্তে তৃতীয় শক্তিশালী দেশ হিসাবে ভারত স্বীকৃত। প্রতিটি তরুন ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার যত পরিশ্রম করে এই দেশটাকে উচ্চাসনে টেনে নিয়ে চলেছে , আমাদের সুবিধাবাদি রাজনীতির ঘা খেয়ে দেশটা ততটা পেছনেও হাঁটছে। আজকের রায় তার প্রমান।

যে দেশে খাদ্যের বিশাল সংকট-পরিবেশ প্রায় ধ্বংশ -সে দেশের রাজনীতি যদি খাদ্য বা পরিবেশের বদলে স্পাইডারম্যান এবং সুপারম্যান ফ্যানক্লাবের মারামারি নিয়ে বিবর্তিত হয়, আমাদের কপালে দুঃখ আছে।

Sunday, September 26, 2010

রাজা সেনের বনাম রবীন্দ্রনাথের ল্যাবেরেটরী-সিনেমা রিভিউ


ল্যাবেরেটরি রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের লেখা। ল্যাবেরেটরীর রবীন্দ্রনাথ একটু অচেনা-গল্পটিতেও একাধকি দ্বন্দের উপস্থিতিতে মূল বক্তব্য বেশ জটিল। এ গল্পটাই এমন যে দশজন পরিচালক দশটি ল্যাবেরেটরি বানালে দশটিই আলাদা সিনেমা হবে। নির্ভর করবে পরিচালক কোন রবীন্দ্রনাথকে গ্রহন করেছেন।

রাজাসেন যে এই দুর্বোধ্য অথচ চিত্তাকর্ষক গল্পটিকে চিত্রায়নের দ্বায়িত্ব নিয়েছেন, তাতে তাকে প্রথমেই সাধুবাদ জানাই। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা এবং চিত্রায়ন ও খুব ভাল। বাংলা সিনেমাতে এত উন্নত টেকনিক্যাল কাজ আগে হয় নি। রঞ্চিত মল্লিক, সব্যসাচী চ্যাটার্জী, অর্পিতা, রবীনা ট্যান্ডন চরিত্রগুলির সাথে মিশে গেছেন-সাহেব চ্যাটার্জি চরিত্রটি বুঝেছেন কি না, সেই নিয়ে একটু সমস্যা আছে। তবে খুব খারাপ কিছু না-রেবতীভূষন হিসাবে তাকে পাশ মার্কই দেব।

এবার সিনেমার প্রসঙ্গে আসি। প্রতিটি সাহিত্য সৃষ্টির একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা আছে। ল্যাবেরেটরির পটভূমিকা বিংশ শতাব্দির প্রথম দিকের কোলকাতা-যখন সেখানে বিজ্ঞান চর্চার জোয়ার এসেছিল। মেঘনাদ সাহা, সত্যেন বোস, স্যার রামনদের মতন বিজ্ঞানীরা কোলকাতার ওয়ার্কশপ থেকে যন্ত্র বানিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানে সেরা স্থান দখল করেছিলেন। সেই বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে পরাধীনতার গ্লানি দূর করার এক বিশাল জাতিয়তাবাদি মনোভাব কাজ করেছে। নন্দকিশোর সেই বিজ্ঞান সমাজের উজ্জ্বল প্রতিনিধি। রাজাসেনের নন্দকিশোরের সাথে রবীন্দ্রনাথের নন্দকিশোরের পার্থক্য নেই। কিন্ত সমস্যা আছে গল্পের নায়িকা সোহিনীর চিত্রায়নে।

এই সোহিনী চরিত্রটি রবীন্দ্রনাথের ইন্টেলেকচুয়াল মানস কন্যা। সে জানে ধর্ম পুরুষতান্ত্রিক-সে আমাদের লোকায়েত সংস্কৃতির পুরুষতান্ত্রিকতা নিয়ে সজাগ-অথচ তার বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ করবে না। বরং দরকার হলে সেও ধর্মকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধি করবে। এই বিধবাটির দায়বদ্ধতা তার প্রয়াত স্বামীর জীবনাদর্শের প্রতি-তার সৃষ্ট ল্যাবেরেটরী যার মূর্ত প্রতীক।
সোহিনীর চরিত্রের শেষের দিকটি রাজাসেন ঠিকই ধরেছেন-কিন্ত সমাজ সংস্কার এবং ধর্ম নিয়ে যে রবীন্দ্র সোহিনী,
তা আরো বেশী জটিল। রাজাসেন সেই জটিলতা কাটিয়ে চরিত্রটিকে কিছুটা সরল করেছেন হয়ত মার্কেটের কথা ভেবেই। বিশেষত গল্পটিতে আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা , ধর্মের নানান রূপ নিয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য ডায়ালোগ আছে-পরিচালক সেসব বিতর্ক এরিয়ে গেছেন। গিয়ে সোজা ফোকাস টেনেছেন মা বনাম মেয়ের দ্বন্দে-সেই দ্বন্দটার ভিত্তি কিন্ত একটা অযৌত্বিকতা-তা হচ্ছে সোহিনীর কাছে ঐ ল্যাবেরটরীটাই তার জীবনের একমাত্র খুঁটি। কবির কাছে এটি অস্তিত্ববাদি বনাম যুক্তিবাদি দ্বন্দ। রাজা সেন এটি সোহিনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। যদিও গল্পটিতে এই ব্যাপারে অধ্যাপক মম্মথ চৌধুরীর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক।

রবীন্দ্রনাথের গল্পে দুটো ফ্লো আছে-একটি অধ্যাপক চৌধুরী বনাম সোহিনী, অন্যটি সোহিনী বনাম নীলা। রাজাসেন দ্বিতীয়টি নিয়ে যত্নবান -প্রথমটিতে গল্পের অনেক ডায়ালোগ কেটেছেন। হয়ত সময়ের জন্যে। তবে এই জন্যে রবীন্দ্রানুরাগীরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন।

তবে বলিউড শরৎচন্দ্রের উপন্যাস গুলোর যে ভর্ত্তা বানায় রাজা সেন তা করেন নি। এটা যথেষ্ট সিরিয়াস সিনেমা।
আমি সস্ত্রীক ভালোই উপভোগ করেছি। সিনেমাটিক লিবার্টি রাজাসেন যে খুব একটা বেশী নিয়েছেন তাও না। আসলেই গল্পটা এত জটিল অতগুলো ডাইমেনশন একটা সিনেমাতে নিলে অনেকের ভাল নাও লাগতে পারত। সেই অর্থে বাজার এবং রবীন্দ্রনাথ এই দুই ব্যালান্সিং বিমের ওপর টিপে টপে পা রেখে রাজা সেন উৎরেছেন। এবং আমার বেশ ভালোই লেগেছে।

সিনেমাটি গোটা বিশ্বের দর্শক ডিঙ্গোরাতে ( www.dingora.com) দেখতে পারেন। অনলাইন নেটফ্লিক্সের চেয়েও ভাল ভিডিও কোয়ালিটি ডিঙ্গোরাতে। বাংলা সিনেমার এত ভাল অনলাইন ভিডীও ডিঙ্গোরা দেখাচ্ছে-আমি বাঙালী হিসাবে কৃতজ্ঞ।

Friday, September 10, 2010

যাদবপুরের ছাত্র রাজনীতির কুনাট্য


পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র রাজনীতিতে আবার একটি ফলক-মাইল ফলক না হলেও একটি বিচ্ছিন্ন পালক-যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্লোস সার্কিট টিভি বসানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র বিক্ষোভ, ঘেরাও, ঘেও ঘেও ইত্যাদি। এগুলো গা সওয়া জিনিস-তাই এসব নিয়ে লেখার ইচ্ছা ছিল না। মাথা গরম হল ছাত্রদের লম্বা কুযুক্তির বহরে। কারন নাগরিকদের সুষ্ঠ সচেতন যুক্তিবাদি মনই দেশের আসল ভবিষ্যত। সেটা যদি ভুল পথে চালনা করা চলতেই থাকে, এই বঙ্গের সলিল সমাধি যেমন চলিছে, তেমন চলিবেই। সেই জন্যেই দুকলম লিখতে বসলাম।

ছাত্রদের যুক্তি যাদবপুর ক্যাম্পাসে পানীয় জলের ব্যাবস্থা নেই, সুচিকিৎসার কোন বন্দোবস্ত নেই-নেই আরো অনেক কিছু। সেব কাটিয়ে সিকিউরিটির ওপর নজর কেন? কেন লাখ লাখ টাকার সিকিউরিটি মনিটর বসানো হবে?

প্রশ্নটি আপাত দৃষ্টিতে যৌত্বিক সন্দেহ নেই। কিন্ত আসুন এবার কিছু পালটা প্রশ্ন করি

১] ভারতের অধিকাংশ গ্রামেই পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত নেই-চিকিৎসার ব্যাবস্থাও নেই। তবুও ভারতের ডিফেন্স বাজেট ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ওপরে। যার ভগাংশ খরচেই গ্রামের উন্নতি সম্ভব ছিল। তাহলে কেন এই গণতন্ত্র মেনে নিচ্ছে ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ডিফেন্স বাজেট?

আদর্শবাদি দৃষ্টিতে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা অপচয়। বাস্তবে কি তাই? ভারতীয় মিলিটারির জন্যেই দেশটা অখন্ড হয়ে টিকে আছে। আসলে বাজে মানুষের অভাব নেই। এবং আমাদের সবাইকেই বাঁচতে হবে আগে। এবং সেই জন্যেই খাদ্য বা স্বাস্থ্য নিরাপত্তার সাথে সার্ভিলেন্স নিরাপত্তাও একটি অত্যাবশক প্রয়োজন হিসাবেই মানা হচ্ছে উন্নত বিশ্বে। নিরাপত্তার দরকার নেই-কারন পৃথিবীতে কোন বাজে লোক নেই-এই ধরনের ইউটোপিয়ান চিন্তায় মানুষের হাততালি পাওয়া যেতে পারে। ঘরির কাঁটা চলে না-তাতে দম থাকে না।

২] ছাত্ররা যদি কতৃপক্ষের দ্বায়িত্ববোধের প্রশ্ন তোলে-তাহলেও প্রশ্ন উঠবে এইসব তথা কথিত ছাত্রদের প্রায় অনেকেই বিদেশে পাড়ি দেবে উন্নত জীবনের জন্যে। তারাও আগে তাদের নিজের ক্যারিয়ারের কাছে দ্বায়বদ্ধ। তাতে অন্যায় কিছু নেই। কিন্ত এটাও তাহলে বুঝতে হবে কতৃপক্ষের প্রথম দ্বায়িত্ব হচ্ছে ক্যাম্পাসকে বহিরাগত উৎপাত থেকে রক্ষা করা। ওখানে যে মাওবাদিদের দৌরাত্ম তলায় তলায় অনেক বেড়েছে এব্যাপারে সন্দেহ আছে কি? কতৃপক্ষ কিংবা ছাত্রদের বাবা মায়েরাই বা কেন চাইবেন তাদের সন্তানদের মগজ ধোলাই দিয়ে জঙ্গল মহলে কেও পাঠাক? ছাত্র ছাত্রীদের প্রায় সবাই বাবা মায়ের হোটেলে
খাওয়া বিপ্লবী। জীবন সংগ্রামে তারা এখনো নামে নি।

ছাত্র জীবনে বিপ্লবী থেকে বহুজাতিক কোম্পানীর চাকুরে এই ত এদের কক্ষপথ। আজ যারা বিরোধিতা করছে, বছর দশ বাদে তারাই নিজেদের এই সব বাওয়ালী নিয়ে হাঁসাহাঁসি করবে। মধ্যেখান থেকে ক্যাম্পাসে আরো মাওবাদি ঢুকবে। এদের মধ্যে কিছু বোকা গাধা জঙ্গলমহল হয়ে পুলিশের জেল খেটে বাকি জীবনে " কিছুই হইলনা ঠিক" টাউপের এনজিও বিপ্লবী থেকে যাবে। এই ত হবে। এর বেশী কিছু ত না।

৩]
প্রযুক্তির গতিকে আটকানো যায় না। ইন্টারনেট কম্পিউটারের মতনই এখন ক্লোস সার্কিট মনিটরিং অপরিহার্য্য। নিজেদের নিরাপত্তার জন্যেই। এটা ভুক্তভোগী না হলে বোঝা যায় না। ছমাস আগে পার্কিং লটে আমার গাড়িকে পেছন থেকে কেও মেরে বিশাল ড্যামেজ করে পালিয়েছিল। সিকিউরিটি ক্যামেরা থেকে এক ঘন্টার মধ্যে সেই গাড়ির নাম্বার বার করে, আমি ক্ষতিপূরন পেয়ে গিয়েছিলাম। আবার সিকিউরিটি ক্যামেরা না থাকার জন্যে আমার গাড়ি ভাংচুর হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ এসেও কিছু করতে পারে নি। আমি অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝেছি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রথম এবং প্রধান স্তম্ভ মোটেও পুলিস না। এই সব টিভি ক্যামেরাগুলিই বর্তমানে সব থেকে বেশী নিরাপত্তা দানে সক্ষম। সভ্যতার গতি সেই দিকেই। টিভি ক্যামেরা না বসানো মানে প্রায় দাবি করা আমাদের সমাজে পুলিশ লাগবে না। কারন নিরাপত্তার জন্যে পুলিশের থেকে ক্যামেরা অনেক বেশী কার্যকরী। পুলিশ ঘুঁশ খায়। ক্যামেরা খায় না। আসলে অভিজ্ঞতা ছারা এগুলো বোঝানো মুশকিল। আমেরিকাতে সর্বত্র পাবলিক প্লেসে ক্লোস সার্কিট টিভি থাকে। সুতরাং মাওবাদিদের প্রভাবিত একটি ক্যাম্পাসে এটির দরকার ছিল আরো বেশী।

৪]
ছাত্ররা এ প্রশ্নও তুলেছে, তাদের সাথে আলোচনা না করে কি করে কতৃপক্ষ টিভি ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত নিল?
এটাও ঠিক বুঝলাম না। আমাদের আই আই টিতে সেনেটে ছাত্র মেম্বার থাকত। আমিও ছিলাম সেনেটে কিছুদিন। সব সিদ্ধান্ত ছাত্র প্রতিনিধিদের সামনেই নেওয়া হত ( সম্মতিতে না)। তবে নিরাপত্তার মতন একটা বিষয়ে কেন ছাত্রদের মত নিতে হবে সেই যুক্তি আমার কাছে ক্লিয়ার না যখন খুব নিশ্চিত ভাবেই ক্যাম্পাসে মাওবাদিরা ঢুকেছে এবং সেক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের সিকিউরিটির ক্ষেত্রে রাজ্যবাসীর নিরাপত্তার প্রশ্নটিও জড়িত।

যাইহোক পশ্চিম বঙ্গের ছাত্র রাজনীতি বহুদিন ধরেই পুতুল নাচের ইতিকথা। পুতুলের সুতোগুলো থাকে রাজনৈতিক পার্টির দাদাদের কাছে। এক্ষেত্রে সামান্য ব্যাতিক্রম হচ্ছে, এদের নাচাচ্ছে কিছু মাওবাদি সহানুভূতিশীল সুশীল-যারা নিজেদের আখেরটি ঠিকই গুছিয়ে কিছু ছেলের ভবিষ্যত ধ্বংশ করতে উদ্যত।

ছাত্র বন্ধুদের কাছে আমার অনুরোধ কিছু মাওবাদি ঘেঁসা সুশীলের এই সব হুজুগে প্ররোচনায় পা দেবেন না। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কেন-পৃথিবীর সব ক্ষেত্রেই কতৃপক্ষের সাথে মতের বিরোধ থাকবে-কতৃপক্ষও ক্ষমতা দেখানোর জন্যে অবিচার করবে-এসবই আমাদের পাওয়ার স্ট্রাকচারে বাস্তব। কারন আসল গণতন্ত্র এখনো আসে নি। কিন্ত সময় বদলাচ্ছে। উন্নততর মিডিয়া এবং প্রযুক্তির জন্যেই গণতন্ত্রের উন্নততর বিবর্তন সর্বত্র হচ্ছে। এই ভাবেই আস্তে আস্তে কতৃপক্ষ নামক অতীতটি আস্তাকুঁড়েতে নিক্ষেপিত হবে। কিন্ত তার জন্যে এখন থেকে কিছু মাওবাদিদের হাতের জিম্মি হওয়াটা আমার কাছে অর্থহীন বলেই মনে হয়। শোষনহীন উন্নততর সমাজ চাইলে নিজেকে আরো প্রস্তুত করতে হবে-অন্যলোকের কথায় নাচলে ভবিষ্যতে "কিছুই হইলো না ঠিক টাইপের" পস্তানো ছারা কিছুই পাবে না।

Wednesday, September 8, 2010

৯/১১ - কোরান পোড়ানোর স্বাধীনতা বনাম অসভ্যতা


আমেরিকা এবং ইসলাম। কেমেস্ট্রি অব রিলেশন।

গ্রাউন্ড জিরো বিতর্কের মধ্যেই আরেকটি সিভিল বিতর্কে উত্তাল হচ্ছে আমেরিকা। এবার
ডিবেট আরো চমকপ্রদ। ফ্লোরিডার রেভারেন্ড টেরি জোন্স 9/11 এর প্রতিবাদ জানাতে চান কোরান পুড়িয়ে। ব্যাস গোটা বিশ্ব উত্তাল। ইন্দোনেশিয়া থেকে আফগানিস্থানে মুসলিমরা উত্তাল ক্ষোভে-হিলারী ক্লিনটন কাতর আমেরিকার টলারেন্স ইমেজে ( কি সুন্দর বললেন মাত্র ৫০ জনের চার্চের জন্যে বদনাম হবে ত্রিশ কোটি আমেরিকানের!)। আর আফগানিস্তানে আমেরিকার জেনারেল ডেভিড পেট্রাস চিন্তিত আমেরিকান সৈন্যদের নিরাপত্তা নিয়ে। আফগানিস্তানের এক মোল্লা রাজনৈতিক পার্থী জানিয়ে দিয়েছে আমেরকাতে কোরান পোড়ালে সব জায়গায় তারা আমেরিকান মারবে। কিছু যায় আসে না যদি ৫০ জন আমেরিকান কোরান পোড়ায় এবং বাকীরা তার বিরোধিতা করে! গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ বিতর্কে যিনি মুসলমানদের সমর্থন করেছিলেন, সেই নিউ ইয়ার্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ ও কোরান পোড়ানোর বিরোধিতা করছেন না। কারন আমেরিকার সংবিধানের প্রথম ও মূল বক্তব্য-ব্যাক্তিগত স্বাধীনতাতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

আমেরিকা তার ফার্স্ট এমেন্ডমেন্ট এতটাই মেনে চলে, আমেরিকান সুপ্রীম কোর্ট পর্যন্ত মানতে বাধ্য হয়েছে, কেও ব্যাক্তিগত সম্পত্তিতে আমেরিকান পতাকা পোড়ালে, রাষ্ট্রের কিছু করার নেই। কারন তা ব্যাক্তিস্বাধীনতার বিপক্ষে যাবে। বিতর্কিত পাদ্রী টেরি জোন্সও স্বীকার করেছেন কোন মুসলিম তার প্রাইভেট এলাকাতে বাইবেল পোড়ালে তার কোন বক্তব্য নেই।

টেরিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যতই ধমকি দিক-তার যুক্তিও অখন্ডিত। সে যদি মনে করে কোরান এভিল এবং তার জন্যে সে কোরান পোড়াবে-সেই স্বাধীনতা আমেরিকান সংবিধান দিয়ে থাকে। ঠিক যে আইনে মুসলিমরা আমেরিকাতে ইসলাম পালনের স্বাধীনতা পাচ্ছে, ঠিক একই আইনে আমেরিকাতে আরেকজনের ইসলামের মুন্ডপাত করার ও স্বাধীনতা আছে।

এবার আসি মূল বিতর্কে কি ভাবে দেখবো এই কোরান পোড়ানো খেলা?

ব্যাক্তিগত ভাবে আমি মনে করি পান্ডুলিপি পোড়ানো যায় না। একটা বই পোড়ানোর অর্থ আমার কাছে পরিস্কার না। কোরান পোড়ালে কি আয়াতগুলো নষ্ট হবে?

সুতরাং টেরি দেখাতে চাইছেন, ইসলামকে তিনি ঘৃণা করেন। কারন বইটা নাকি অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণায় ভর্ত্তি। সেটা যদি হয়েও থাকে আমি পরিস্কার ভাবেই বলব ঘৃণা দিয়ে ঘৃণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় না। ইসলামে অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা এবং হিংস্রতাকে কেও যদি সভ্যতার শত্রু বা অসভ্যতা বলে মনে করে-এবং সেটি প্রকাশ করার জন্যে নিজে অসভ্যতা এবং ঘৃণার আশ্রয় নেয়- তার উদ্দেশ্য ও পন্থা ভুল। অন্যের অসভ্যতা ধরাতে নিজেদের সভ্য হতে হয়। অন্যের ঘৃণাটা দেখাতে নিজেকে ভালোবাসা দেখাতে হয়। অনেকে বলবেন-সেটাকে মুসলমানরা অমুসলমানদের দুর্বলতা বলে মনে করে এবং ইউরোপের মতন পেয়ে বসবে। আমি কিন্ত মনে করি ইউরোপ মুসলমানদের কখনোই ভাই হিসাবে মেনে নেয় নি-তারা ঘৃণা এবং বৈষম্যেই পেয়েছে। তাই তারাও ঘৃণাই উগরে দিয়েছে জাতিদাঙ্গাতে। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গের দেভাঙ্গাতে গত দু দিন ধরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লেগেছে। তাতে মিলিটারি নামাতে হয়েছে পুরো এক ব্যাটেলিয়ান। বেশ কিছু হিন্দু দোকান ভাংচুর হয়েছে মুসলিম প্রধান দেভাঙ্গাতে। আশে পাশে সবাই ফিস ফাস করছে, যেখানেই মুসলমান সেখানেই দাঙ্গা।

কিন্ত সত্যিই কি তাই ? এর পেছনে বস্তুবাদি কারন খুব সিম্পল। মুসলিমদের মধ্যে জন সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ে-কারন তারা অশিক্ষার কারনে ধর্মের মাদকে জন্ম নিয়ন্ত্রন করে না। ফলে একটা লিমিটেড রিসোর্স শেয়ার করার জন্যে সর্বত্র একটা কঠিন পরিস্থিতে তাদের বাঁচতে হয়। এমন পরিবেশে তারা বড় হয় তাদের বঞ্চনার জন্যে অন্যদের দোষ বিক্রি করা সহজ। তারপরে সেই অন্যদের চোখে যখন ঘৃণা ছারা কিছু দেখে না-তখন তারা আরো বড় মৌলবাদি হয়ে ওঠে।

শুধু কিছু মিডিয়া এটেনশন টেনে অন্য ধর্মকে অপমান করে কি লাভ আছে আমি জানি না। কোরান যদি কেও এভিল বলে মনে করে, সে সেটা যুক্তি দিয়ে প্রমান করলেই সব থেকে ভাল করবে। অনেকেই তাই করছে। এবং তার বিরুদ্ধে মুসলমানরাও যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে। এই দ্বন্দটাই কাম্য। কারন দ্বন্দের ফলেই উন্নতি বা অগ্রসরতা আসে।

বহুদিন ধরে ইসলাম এবং তার রাষ্ট্রীয় রক্ষকরা ধর্মের সমালোচনার এই স্বাধীনতা দেয় নি। আজ ইন্টারনেটের যুগে যখন সেন্সরশিপ অচল-সেখানে তাদের যুক্তিবুদ্ধি দিয়েই ইসলামকে ডিফেন্ড করতে হচ্ছে। এটা খুব ভাল। কারন সেক্ষেত্রে অবস্থার তাগিদেই তারা কোরানের উন্নততর ব্যাখ্যাগুলি আনতে সমর্থ হবে। ভারতে হাজার হাজার বছর আগে উপনিষদিক চিন্তা এই ভাবেই এসেছিল। বৌদ্ধদের চ্যালেঞ্জ খেয়ে, বেদকে বাঁচাতে বেদান্তের বা উপনিষদের জন্ম হয়। যা সেই বেদের উন্নততর ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়েই এসেছে।

সুতরাং ধর্মের সমালোচনা পুরো মাত্রায় চলুক। কিন্ত ধর্মের বিরুদ্ধে আমার অবস্থানটাকে যেহেতু আমি অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তোরন-অসভ্যতা থেকে সভ্যতায় যাত্রা বলে মনে করি-সেহেতু ধর্মের সমালোচনার ক্ষেত্রে আমি মোটেও অসভ্যতাকে সমর্থন করতে পারি না। সদালাপ বলে একটি মুসলিম মৌলবাদি সাইট যুক্তিবাদিদের বিরুদ্ধে যে অসভ্যতা করে-তাতে আমাদের বক্তব্য আরো জোরালো হয় যে-ধর্ম আসলেই লোকেদের অসভ্য করে। কিন্ত যুক্তিবাদিরা বা সভ্যতার দাবিদার কেও যদি, সেই অসভ্যতাই করে, তাহলে পার্থক্যটা কোথায় রইল?