Thursday, June 25, 2015

কালবেলা ও অনিমেশ মিত্র

কালবেলা সিনেমাটা দেখলাম, মানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। সমরেশের উপন্যাসটা  পড়েছিলাম ছাত্রবেলাতে । অনিমেশ মিত্র চরিত্রটা দেখতে দেখতে বার বার মনে হচ্ছিল, কিভাবে একটা ভ্রান্ত আদর্শবাদ সমাজ রাষ্ট্র ব্যক্তির কালহন্তক হয়ে ওঠে। আরো মনে হচ্ছিল অনির লেভেলে না হলেও, ওই ভ্রান্ত লেনিনবাদের ফাঁদে পা দিয়ে আরো কত যুবক যুবতী সর্ব্বোনাশ আজও হচ্ছে।

  গরীবদের শোষন থেকে উদ্ধার এবং সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন আমিও দেখি।  সাম্যবাদি শোষনমুক্ত সমাজের প্রশ্নে বামেদের সাথে আমার কোন মত পার্থক্য নেই।  প্রশ্ন হচ্ছে কোন লেনিনবাদি বিপ্লব কি ইতিহাসে কোন শোষনমুক্ত সমাজের জন্ম দিয়েছে? যেখানেই কমিনিউজম, সেখানেই মৃত্যু, দুর্ভিক্ষ, শ্রমিক কৃষকশ্রনীর গণহত্যাটাই বাস্তব ইতিহাস। চেসেস্কু, কিম জঙের মতন রাজতন্ত্রের জন্ম হয়েছে । নক্সালবাড়ির দুর্ঘটনা একটা ছোট খাট ব্যপার।

  গরীবদের শোষনমুক্ত করতে, কমিনিউস্ট বিপ্লবের পথেই ভাবতে হবে কেন? কেন ল্যাটিন আমেরিকার বামপন্থা লেনিনবাদকে ১০০% মাইনাস করে মার্কেট, কোয়াপরেটিভ এবং মানুষের উদ্যোগী উপযোগকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে?  কেন আম আদমি পার্টি মাত্র এক বছরেই যা করে দেখাল, লেনিনবাদিরা আশি বছর ধরেও সেই জনভিত্তি পেল না ভারতে?

 একটা গল্প বলি।  তিন বছর আগে আগ্রা থেকে দিল্লী ফিরছিলাম। লম্বা পথে ড্রাইভারের সাথে খোশগল্প হচ্ছিল।  ওর মাইনে মোটে সাত হাজারটাকা, সাথে প্রতি ট্রিপের জন্য এক্সট্রা খাওয়ার খরচ। আর কিছু ওভার টাইম। পরিবার থাকে হরিয়ানার গ্রামে। মাসে একদিন ছুটি।  আমি বল্লাম গ্রাম ছেড়ে, এই কঠিন জীবনে কেন? বললো, সাব, সেখানে ত তাও খেতে পাই দুবেলা পেটভরে। তার মালিকের ৩৯ টা গাড়ি!  কথা প্রসঙ্গে ও জিজ্ঞেস করল, আমি কি করি। তখন ব্যবসা সবে শুরু করেছি। ড্রাইভারটা শুনে বললো ও নিজে গাড়ি কিনে চালাতে চায়। তাহলে ওর রোজগার সাত হাজারের জায়গায় ত্রিশ হাজার হবে। দিল্লীতে ভাড়ার গাড়ীর খুব ডিম্যান্ড। কিন্ত তার জন্য মিনিমাম দুলাখের ইনভেস্টমেন্ট। সেই টাকা ওর নেই। কিন্ত ওর বিশ্বাস ও একদিন গাড়ীর মালিক হবেই-গ্রামের জমি বেচেই হবে। কারন ওর যে মালিক-সেও ওর গাওয়ালী ভাই- একদিন দিল্লীতে গাড়ী চালাত। আজ কোটি টাকার মালিক।

 আমি যত গরীব মানুষের সাথে মিশেছি-সবার আকাঙ্খা মোটামুটি একরকম। একটু পুঁজি নিয়ে, তারা শ্রমিক থেকে মালিক হয়ে স্বাধীন ব্যবসা করতে চায়। দারিদ্রের মূল কারন দুটো- গরীবদের পুঁজি আর স্কিলের অভাব। মুশকিল হচ্ছে রাষ্ট্র আবার এই দুটোর দ্বায়িত্ব নিতে চায় না। বা নিলেও নমো নমো করে নেবে।  যে রাষ্ট্র এর দ্বায়িত্ব নেয়, সেখানে ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমেও গরীব প্রায় নেই। যেমন জাপান । জাপান ১৯৩০-৪০ সালের মধ্যেই দারিদ্র প্রায় সম্পূর্ন রূপে দূর করে।  সেই সময় জাপানের জিডিপি বেড়েছে ৩০-৫০% হারে।

 দারিদ্রমুক্ত সমাজ মার্কেট ছাড়া সম্ভব না। কমিনিউস্ট চীন ও মার্কেটের পথেই দারিদ্র দূর করেছে, লেনিনের লেজ ধরে বসে থাকে নি। প্রশ্ন হচ্ছে এই মার্কেটের মধ্যে কিভাবে গরীবদের হাতে পুঁজি এবং স্কিল দেওয়া যায়। ল্যাটিন আমেরিকার বামপন্থায়, ইভো মরালেস যেমন এই দুটি প্রশ্নের সমাধানে কোয়াপরেটিভ এবং কোয়াপরেটিভের মাধ্যমেই সরকারি পুঁজি ও স্কিলের ব্যবস্থা করেছেন প্রান্তিক লোকেদের জন্য। কিন্ত বেচার কাজটা ওই লোকেদের করতে হবে।  সরকার সেখানেও তাদের জন্য ভাল মার্কেট বানিয়ে দিয়েছে।

 ভারতের সমস্যা হচ্ছে এখানের বামেরা একদম নিম্নমেধার। অথবা ভারতের ক্রনিক সমস্যা হচ্ছে এরা শুধু ফলোয়ার হতে ভালোবাসে - নিজেদের সমস্যাকে যে নিজেদের মতন সমাধান করতে হবে তাতে এদের বিশ্বাস নেই। নক্সাল আন্দোলন ও ওইরকমের হঠকারিতাই ছিল। আমি বরাবর শুনে এসেছি নক্সালরা নাকি খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। যেটা মেলাতে পারি নি-সেটা হচ্ছে এত গুলো মেধাবী ছাত্রর কেও নাটের গুরু লেনিনের লেখা যে পুরো ঢপবাজি সেটা বুঝতে পারে নি? লেনিনের সর্বাধিক বিখ্যাত লেখা " সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর" -পড়লে যেকোনো সচেতন ব্যক্তির তিনটি প্রশ্ন তোলা উচিত (১) ওই লেখাটার থিসিসের ৮০% হবসন থেকে ঝাড়া, বাকী ২০%  শোধনবাদিদের বিরুদ্ধে লেনিনের গালাগালি (২) ওই লেখাতে কোন ডায়ালেক্টিক লজিকই নেই-থিসিসের বিরুদ্ধে এন্টিথিসিস সাজিয়ে কোন সিন্থেসিস নেই-পুরোটাই ইন্ডাক্টিভ লজিকে ভর্তি-যা মার্ক্সবাদের বিশ্লেষন পদ্ধতি না (৩)  হচ্ছে (২) এর কারনে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে লেনিন এবং মার্ক্সের বক্তব্যেও অনেক ক্ষেত্রে ১৮০ ডিগ্রী বিরোধ।

প্রশ্ন হচ্ছে সেই কালে প্রেসিডেন্সী কলেজের এতগুলো মেধাবী ছাত্র যারা নাকি মার্ক্সবাদ চর্চা করত, তাদের কাছে লেনিনের ঢপবাজি ধরা পড়লো না কেন?  তাদের কি মেধার অভাব ছিল?

 তা মোটেও না। আমার মনে হয় যেটা হয়েছে, প্রাক ইন্টারনেট যুগে সোভিয়েতকালে -যেটা কালবেলার সময়-তখন লেনিনবাদের ধাপ্পাবাজি ধরা কঠিন ছিল-কারন কমিনিউজম সংক্রান্ত সব তথ্য, উপাত্ত নিয়ন্ত্রন করত সোভিয়েত ইউনিয়ান। আমার বাড়ি, প্রতিবেশীদের বাড়িতে লেনিন মার্ক্সবাদের গাদা গাদা বই ছিল।  ওসব যতবার পড়ার চেষ্টা করেছি-কিস্যু বুঝি নি। মার্ক্সবাদ জলভাতের মতন বুঝতে শুরু করি এই সেদিন ২০০৩ কি ২০০৪ সাল থেকে-যবে থেকে উইকি এসেছে। কারন উইকির দৌলতে প্রথম অনেক দর্শন শাস্ত্রের আর্টিকল পেলাম, যেখানে অনেক ব্যাপার জার্গন ছাড়া জলভাতের মতন সহজ করে বোঝানো হয়েছে। কালবেলার অনির কাছে ওইসব আর্টিকেল ছিল না।

আমার ধারনা ইন্টারনেটের যুগ আগে এলে, নক্সালবাড়ির দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।

Saturday, June 20, 2015

প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং সাম্রাজ্যবাদ

অতীত থেকে না-বর্তমান থেকেই শুরু করি।

  আজকের এই আই টি বিপ্লব, ফেসবুক, গুগল, কম্পুটারের পেছনে, কাজ করে মূলত দুটো বেসিক প্রযুক্তি। প্রথমটা হচ্ছে সিলিকন টেকনোলজি-যা একটা কয়েনের মধ্যে এনেদিচ্ছে কোটি কোটি যন্ত্রগণকের শক্তি। আর দুই-ইন্টারনেটে বেসিক টেলিকম নেটওয়ার্ক-যা কোটি কোটি কম্পিটিং ডিভাইসকে কানেক্ট করছে।

   এই দূটি প্রযুক্তিই আমেরিকান মিলিটারি গবেষনার ফসল। ইন্টারনেট প্রযুক্তি শুরু হয়েছিল 1977 এ ডারপার আরপানেট প্রজেক্ট থেকে (https://en.wikipedia.org/?title=ARPANET)। ডারপা হচ্ছে আমেরিকাতে প্রতিরক্ষার জন্য ভবিষ্যতের প্রযুক্তির নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য তৈরী রিসার্চ গ্রান্ট এজেন্সি। শুধু ইন্টারনেট ই না- ডারপা দিয়েছে, আরো অনেক যুগান্তকারি প্রযুক্তি- যেমন মেমস-যে সেন্সর প্রযুক্তির জন্য আজ বদলে যাচ্ছে সার্জারি থেকে মেশিনপত্রের মেইনটেনান্স।

                 সিলিকন চিপের বাজারজাত করার পেছনে যে কোম্পানীটি ১৯৬০ সালে সব থেকে বড় ভূমিকা রেখেছিল-তারা হচ্ছে ফেয়ার চাইল্ড সেমিকন্ডার। এই কোম্পানীটিও মূলত শুরু হয়েছিল কোল্ড ওয়ারের সময় স্যাটেলাইট ও রকেট প্রযুক্তিতে সোভিয়েতকে টেক্কা দিতে নাসার জন্য । উইলিয়াম শকলে বেল ল্যাব থেকে বেড়িয়ে তৈরী করেন ফেয়ারচাইল্ড সেমিকন্ডার। উদ্দেশ্য সিলিকন চিপ -বা চিপের মধ্যে গোটা ইলেকট্রনিক্স সার্কিট পুরে দেওয়া। সুবিধা করতে পারেন নি প্রথমে। সুবিধা এনে দিল, ঠান্ডা যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে নাসার এপোলো প্রজেক্ট। এপোলোর গাইডেন্স সিস্টেমের সাইজ ছোট করতে, সিলিকন চিপস ছাড়া গতি ছিল না। নাসার বিরাট অর্থানুগ্রহ না পেলে, সিলিকন চিপ্স কবে যে সাফল্যের মুখ দেখত কেও জানে না। আর সিলিকন চিপসে জন্ম দশ বছর পেছলে, ইন্টারনেট আর ফেসবুকের জন্ম ও দশ বছর পিছিয়ে যেত।

 আমেরিকাতে অধিকাংশ নতুন কম্পুটার এবং ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তি আসে মিলিটারির অর্থানুগ্রহে। মূলত দুটি চ্যানেল আছে। একটা হচ্ছে ডারপা-যেখানে ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে রিসার্চ গ্রান্ট দেওয়া হয়। দ্বিতীয়টা হল এস বি আই র। এখানে ছোট ছোট স্টার্টাপ গুলোকে মিলিটারীর কাজে লাগে এমন উদ্ভাবনের জন্য গ্রান্ট দেওয়া হয়। এস বি আই আর, অন্য ফেডারেল এজেন্সিগুলোও দেয়-তবে সিংহ ভাগ আসে মিলিটারি থেকে। আমার কাছে  থাকা এস বি আই এরে তথ্য বলছে, গত দুই দশকের উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগুলির সিংহ ভাগ এসেছে এস বি আই এরে গ্রান্টে চলা রিসার্চ থেকে।


এবার অতীতের দিকে তাকানো যাক । সাম্রাজ্যবাদি শক্তির ঐতিহাসিক সিকোয়েন্সটা মোটামুটি এরকম -
পার্সিয়া-গ্রীক-রোমান- আরব-মোঙ্গল-অটোম্যান-স্প্যানিশ-বৃটিশ-আমেরিকা।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যারা যখন মাস্টার রেস হয়েছে-তাদের পেছনে দুটি শক্তি কাজ করেছে। প্রথমটা প্রযুক্তি-দ্বিতীয়টা শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা, আইনের শাসন। আজকের আমেরিকা তার ব্যতিক্রম না। কালকে চীন এবং ভারত যদি প্রযুক্তিতে এগোতে পারে, তারাই মাস্টার রেস হবে।

আলেক্সজান্ডারের সাম্রাজ্যবাদি শক্তির উৎস কি? অধিকাংশ যুদ্ধে কম সৈন্য নিয়ে কি করে বিপক্ষকে হারাতেন আলেজান্ডার ?  সেই ইতিহাস ঘাঁটলেও প্রযুক্তির মুখটাই দেখা যাবে। গাওয়ামুলের যুদ্ধে দারায়ুস-৩ এর বিপক্ষে  আলেক্সান্ডার জিতলেন কি করে? তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল অর্ধেক। দারায়ুসের হাতে ছিল ভয়ংকর পার্সিয়ান রথ, যার চাকাতে বন বন করে ঘুরত তলোয়ার।  পার্সিয়ান রথের আক্রমন ঠেকাতে গ্রীকরা আবিস্কার করে সারিসা-যা হচ্ছে একুশ ফুট লম্বা বর্শা।  বর্শা একুশ ফুট লম্বা হলেই সারিসা হত না-দূর থেকে রথ বা ক্যাভিলারি ঠেকাতে দরকার হত একুশ ফুটের একটা রড যা হবে হাল্কা এবং শক্তিশালী। রথ বা ঘোড়ার ধাক্কায় ভাংবে না। শুধু এই প্রযুক্তির জোরেই পারস্যের বিখ্যাত রথ এবং ঘোড়সোওয়ার বাহিনীকে কাহিল করে দেয় ম্যাসিডোনিয়ানরা। পারসিক সম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর শুরু হয়, গ্রীক সাম্রাজ্য।

 লিওয়ানার্ডো ভিন্সি থেকে রেনেসাস যুগে বিজ্ঞান প্রযুক্তির উত্থানের রহস্যটা কি? নিছক গবেষনা? সরি -ইতিহাস তা বলে না। লিওনার্ডো দ্যা ভিন্সি ফ্লোরেন্সের নগরপালকে একাধিক চিঠি লিখেছিলেন-যার সার সংক্ষেপ- অটোম্যানরা যখন খুশি শহরটা দখল করতে পারে-আর তাদের ঠেকাতে তিনি এমন সব অস্ত্রবানাবেন-যাতে নগর সুরক্ষিত থাকবে-তাই সেই সব অস্ত্র এবং প্রযুক্তি বানাতে তাকে অর্থ সাহায্য দেওয়া হৌক।

 পাথর থেকে ব্রোঞ্চ-ব্রোঞ্চ থেকে লোহা-সভ্যতার এই যে অগ্রগতি-সবই ত নতুন অস্ত্র বানাতে গিয়ে।

 এর পাশাপাশি চিকিৎসার অগ্রগতি অবশ্যই হয়েছে মিলিটারী কারন ছাড়াই।  কিন্ত যন্ত্র সভ্যতার অগ্রগতি সম্পূর্ন মিলিটারির জন্য। জেমস ওয়াট স্টিম ইঞ্জিন বানিয়ে ফেলতেই, স্টিম ইঞ্জিন গবেষনাতে সব থেকে বেশী খরচ করেছিল বৃটিশ নেভি। রাইট ভাই রা প্লেন বানাতেই, সেই প্লেন মানুষের যোগাযোগের অনেক আগেই , বোম ফেলার জন্য কাজে লাগাতে নেমে যায় ফেঞ্চ, বৃটিশ, জার্মান এবং আমেরিকানরা। ১৯১২-১৫ সাল পর্যন্ত বিমান বিদ্যায় সব কাজ হয়েছে কি করে প্লেনকে যুদ্ধবিমান হিসাবে গড়ে তোলা যায়।  এবং বিমান প্রযুক্তির প্রাথমিক সব আবিস্কার হয়েছে এই যুদ্ধবিমান বানাতেই। ট্রান্সপোর্টের প্রয়োজনে কাজে লাগানো হয়েছে অনেক বাদে। বিমান প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রয়োজনে।

 না, সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন জানাতে এই পোষ্ট না। এই পোষ্ট সেই সব বাল্যখিল্য জনগণের জন্য, যারা ফেসবুকে, ইন্টারনেটে দিনরাত সাম্রাজ্যবাদি আমেরিকাকে গালাগাল দিচ্ছেন-সেই সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে আবিস্কৃত প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েই!  প্রযুক্তির উন্নয়নে সাম্রাজ্যবাদের যা অবদান আছে, আর কোন কিছুর তা নেই। এটাই দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস। এটা যদি না জানেন-তাহলে ইতিহাসের প্রাথমিক জ্ঞান নিয়েই সন্দেহ উঠবে। 

Friday, June 19, 2015

উচ্চমাধ্যমিকের পর পেশাদারি জীবনে কি?

এই জুন জুলাই মাসটা বড় টেনশনের। যারা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল তারা ত বটেই-তাদের বাবা মায়েরাও উদ্বেগ বায়ুতে কাত।

  জীবনে কি করিতে হইবে, কি করিলে এই মার্কেটে মোক্ষ লাভ হইবে, এমন উপদেশ দেবার ধক বা ইচ্ছা আমার নাই। আমি এক্ষনে শুধু কিছু আশার কথা শোনাইব।

  প্রথমেই বলি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আই টির কথা।  যাদবপুর, আই আই টি, শিবপুর বা সরকারি কলেজে না পেলে, বেসরকারি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে আমি নিরুৎসাহিত করব। আমার অভিজ্ঞতা বলছে বেসরকারি কলেজগুলিতে শিক্ষক বা পরিকাঠামো কোনটাই নেই।  কিন্ত তাও এদ্দিন তারা চাকরি পেয়ে এসেছে -কারন ভারতে আই টি কর্মীর চাহিদা বেড়েছে বিপুল হারে। ফলে গরু গাধা সবাই গোয়াল পেয়েছে!  আগামী দিনেও এই চাহিদা থাকবে-কিন্ত ভালো ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথেমেটিক্স বেসিক ছাড়া, আই টিতে কেরানীগিরির চাকরি আর থাকবে না।  আই টি ফিল্ডে ব্যপকহারে অটোমেশন আসছে-যাতে প্রোগ্রামিং এর ক্ষেত্রে  হাই  এন্ড ম্যাথেমাটিকাল কোডিং এবং প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে এপ্লিকেশন ইমপ্লিমেন্টেশনের জন্য এস এম ই বা সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্টের দরকার বাড়বে।

 তাহলে যারা সরকারি কলেজে পায় নি, অথচ আই টি কর্মী হতে ইচ্ছুক-তাদের সামনে পথ কি?  আমি ত বলব তারা চোখকান বুঁজে ম্যাথেমেটিক্স বা ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে ঢুকে যাও।  এটলিস্ট কিছু বেসিক শিখবে-যেটা বেসরকারি কলেজে কিছুই শিখবে না।  ব্যাচেলর ডিগ্রি করার পর, একটা এম সিএ করে নিলেও হবে, এম স সি করলেও ক্ষতি নেই। তবে ভালো আই টি কর্মী হতে গেলে, ব্যাচেলর ডিগ্রির পাশাপাশি-যেকোন ছোট কোম্পানীতে পার্ট টাইমে কোডিং এর কাজে ঢুকে যাও। কোডিং স্কিল এবং চর্চার জিনিস। যত প্রাক্টিস করবে, নতুন প্রজেক্ট করবে তত হাত এবং মাথা খুলবে। একদিকে বেসিক ম্যাথ স্কিলের ডেভেপলপমেন্ট অন্যদিকে কোডিং স্কিলের চর্চা করলে, খুব সহজেই মাস্টার ডিগ্রির পরেই ভাল চাকরি বাঁধা-এবং দুপাঁচ বছরের মধ্যে বাৎসরিক সাত-দশলাখ টাকার চাকরি পেয়ে যাবে। ভারতে আই টি কর্মী অনেক-কিন্ত ম্যাথ এবং বেসিক ভাল থাকা কোডারের অভাব সাংঘাতিক। হাই এন্ড কোডার হতে পারলে, মধ্য কেরিয়ারে ভারতে বছরে কুড়ি থেকে ত্রিশ লাখের চাকরি জলভাত। কিন্ত বেসিক ভাল না হলে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারং কলেজ থেকে বিটেকের সার্টিফিকেট ঝোলালে কিছু হবে না। তবে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যদি একান্তই পড়তে হয়, পাশাপাশি যেকোন ছোট কোম্পানীতে ঢুকে যাও, যেখানে কোডিং শেখার চান্স আছে। কলেজকে গুলি মেরে কোডিং এ ডুবে থাক।

 এবার আসি ইলেকট্রনিক্স, মেকানিক্যাল ইত্যাদি ব্রাঞ্চগুলির কথায়। এই সব ব্রাঞ্চে চাহিদা ভারতে এখন ভালোই, মাইনেও অনেক বেড়েছে-কিন্ত  টপ আই টি কর্মীদের তুলনায় বেতন ৩০%।  ভারতে এই সব ব্রাঞ্চে সমস্যা হল পাবলিক কোম্পানী গুলি ছাড়া বাকী ইঞ্জিনিয়ারং কনসার্নগুলি মোটামুটি মারোয়ারীদের। সেখানে ডেভেলেপমেন্ট কিছু হয় না প্রায়- সবটাই রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এবং টাকা খাইয়ে তোলা প্রোজেক্টে কোন রকমে ডেলিভারি। মোদ্দা কথা এগুলো এখনো গ্লোবালাইজড হয় নি। ফলে এই সব ব্রাঞ্চে চাকরি থাকলেও, এগুলো স্যালারির দিক দিয়ে এখনো টপ আই টি জবের ধারে কাছেও নেই। এই সব ব্রাঞ্চে ঢুকলে চাকরি পাবে, তবে জব সাটিসফ্যাকশন নাও আসতে পারে। আর বিদেশ যাওয়ার সুযোগ কম-কারন একমাত্র আই আই টি ছাড়া এগুলোতে ভারতের যা স্টান্ডার্ড তাতে বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স বা পি এই চ ডি পাওয়া কঠিন। সব থেকে বড় ব্যপার হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার আলটিমেট গোল হওয়া উচিত ভাল করে  কর্মক্ষেত্রে শিখে ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম খোলা। ভারতে এই কোর সেক্টরে সেভাবে কাজ শেখার স্কোপ নেই।

 এবার আসি পিউর সায়েন্সের কথায়।  পিউর সায়েন্সের মধ্যে সব থেকে বেশী ডিম্যান্ড কেমিস্টদের-বিশেষত অর্গানিক বা বায়োঅর্গানিক কেমিস্টদের যেহেতু ভারতে ফার্মা শিল্প এখন বুমিং।  ফার্মাতে কেমিস্টদের বেতন ও বেশ ভাল-আই টির সমপর্যায়ে।  বায়োলজিস্টদের ডিমান্ড বাড়ছে বায়োটেক শিল্পের জন্য।  ম্যাথেমেটিক্স নিয়ে পড়ে ডেটা সায়েন্সে চলে যাওয়া যেতে পারে-যেখানে এখন খুব ভাল ডিম্যান্ড। একমাত্র বেকার সাবজেক্ট ফিজিক্স।  তবে যারা ইন্টেলেক্টুয়াল পারসিউটে বিশ্বাসী- ব্রেইনের চর্চায় বিশ্বাসী-তাদের জন্য ফিজিক্স ঠিক আছে। ভাল না লাগলে, ফিজিসিস্টদের জন্য ফাইনান্সিয়াল মডেলিং মার্কেট খোলা আছে-যেখানে বেতন আই টির ও অনেক বেশী। তবে খুব বেশী প্যাশনেট এবং নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস না থাকলে ফিজিক্সে না ঢোকায় ভাল।  বা ঢুকলেও কোডিং শিখে আই টিতে সুইচ করা বেটার।  সায়েন্সে যারা ঢুকতে চাইছ-তাদের জন্য একটাই উপদেশ। এখানে শেখার প্যাশন না থাকলে শুধু চাকরি বা ডিগ্রি করার জন্য ঢুকো না। আর মাস্টার মশাই হওয়ার পথ ত খোলাই আছে। তবে দেওলিয়া সরকার আর কদ্দিন শিক্ষকদের বেতন দিতে পারবে, তাই নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আদৌ, খালি হওয়া শিক্ষক পদ গুলি ভর্তি হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কারন সরকারের দুরাবস্থা।

রিসার্চ লাইফ নিয়ে রোম্যান্টিসিজমে আমি বিশ্বাসী না। ৯৮% রিসার্চের কাজ  হয় পেপার পাবলিকেশনের জন্য-এগুলো বেকার সময় নষ্ট। এতে না পাবে টাকা, না আছে কেরিয়ার-না সত্যিই কিছু আবিস্কার করবে। সবটাই প্রায় চর্বিত চর্বন। ২% রিসার্চ যা টপ বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ভালো ল্যাবে হয়, তাই একমাত্র কাজের। তবে ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং সায়েন্সের পি এই চ ডিএর জন্য এখন বাজার ভাল যেহেতু ভারতে অনেক মাল্টিন্যাশানাল ল্যাব তৈরী করেছে। রিসার্চকে স্কিল ডেভেলেপমেন্ট হিসাবে নিলে ঠিক আছে।

   ডাক্তার, ফার্মসিস্টদের ব্যপারে কিছু লেখার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ওই লাইনের লোক না। তবে ফার্মাসিস্টদের বাজার বরাবর ভাল।

 সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বাইরে ইকনোমিক্সের বাজারদর এখন ভাল। অনেক সংস্থা, ব্যাঙ্ক ইকোমিস্ট রাখে এখন। একাউন্টিং এর বাজার চিরকাল থাকবে।

 আর্টস নিয়ে যারা পড়তে ইচ্ছুক-তাদের জন্য ও অনেক পেশাদারি বাজার খুলেছে। আইনজ্ঞদের বাজার কোনদিন যাবে না-তবে ল এর পেশাতে ২% উকিলের হাতে ৯৮% বাজার। বাকিরা বেকার।  এর বাইরে হিউমান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এবং পাবলিক রিলেশনের ডিমান্ড ও বাড়ছে। মার্কেটিং , বিজ্ঞাপনের কাজে ডিমান্ড বাড়তেই থাকবে। তবে মিডিয়া সংক্রান্ত সাংবাদিকতার পেশাটা আর নেই। ওখানে না আছে মাইনে, না চাকরির নিশ্চয়তা। মিডিয়াতে নেশা থাকা ভাল, পেশা করলে জীবনে নিশ্চয়তা নেই।

 আরেকটা গুরুত্বপূর্ন কথা হচ্ছে-এই চার বছরের বিটেক ডিগ্রির পরে কেরিয়ার থেমে গেলে মুশকিল আছে। চাকরির বাজারে, পেশাদারি ক্ষেত্রে  সারাজীবন শিখে যেতে হবে। শেখার কোন শেষ নেই।  কোন নতুন চাকরিতে ঢুকলে কোম্পানি ব্রান্ড, মাইনের পাশাপাশি, সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ন ফ্যাক্টর হওয়া উচিত, নতুন কি কি স্কিল শেখার স্কোপ আছে। কারন মাইনে, কোম্পানী-ক্যাপিটালিজমে এইসব অনিত্য। নিত্য একমাত্র স্কিল, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা।

 যাইহোক আমি যেভাবে জীবনকে দেখি, সেভাবে যে সবাইকে দেখতে হবে তার কোন মানে নেই।  জীবনে যে কোন উদ্দেশ্য থাকতে হবে তার ও কোন মানে নেই। কেও কবিতা লিখে, গান গেয়েও জীবন কাটাতে পারে। মোদ্দা কথা জীবনের যেহেতু কোন পরম উদ্দেশ্য নেই, জীবনটাকে নিরোগ রেখে উপভোগ করাটাই সব থেকে বুদ্ধিমানের কাজ। আর সেটা করতে গেলে টাকা ছাড়া উপায় নেই। তাই চাকরি বাকরি ধান্দার একটা গল্প দিলাম।