অঙ্কে কাঁচা-তাই সায়েন্স নিয়ে পড়ব না? গণিতে দুর্বল হলে কেরিয়ার চয়েস কি কি? ঃ জীবন ও জীবিকা-পর্ব ১২
বিপ্লব পাল, ২১ শে মে, ২০২৩
অনেকেই আমাকে ইনবক্সে মেসেজ রেখেছেন। আপনাদের সন্তানদের কেরিয়ার চয়েসে সাহায্য চাইছেন। সবাইকে ধন্যবাদ। কিন্ত এইসব মেসেজ পড়েই বুঝলাম ( কমেন্টেও এই ধরনের মেসেজ প্রচুর পড়ছি-)- আসলে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হচ্ছে-কারন অধিকাংশ অভিভাবক অনেক ভুল ধারনার নিয়ে চলেন। এবং সেটাই তার সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে, তাদের কেরিয়ারের বারোটা বাজাচ্ছেন। আমি এই পর্বে শুধু, একটা ভুল ধারনা ভাঙার চেষ্টা করব – এরপরের পর্বগুলিতে আরো অনেক অনেক এই ধরনের ক্ষতিকর ধারনাগুলি নিয়ে লিখব ( আর আমার অনুরোধ, আপনারা আমার আগের ১১ টা পর্ব পড়ুন , তারপর মন্তব্য বা ইনবক্স করবেন। সব লেখা আমার টাইম লাইনেই আছে একেক করে। আর আগামী লেখাগুলো পেতে, প্রফাইলে গিয়ে ফলোতে ক্লিক করুন।।)
#১ আমার ছেলেটা/মেয়েটা অঙ্কে কাঁচা-ওকে সেই জন্যে ইংরেজি অনার্স নিতে বল্লাম -বা হিউম্যানিটি সাবজেক্টে বা যেখানে অঙ্ক লাগবেনা এমন সাবজেক্টে দিলাম ----[ ইনফ্যাক্ট , কালকে আমি প্রায় ৫ টা এই মেসেজ পেয়েছি। তাই ভাবলাম, আগে এই ভুল টা ভাঙানোর চেষ্টা করি [
রাজা রামমোহন রায়ের আমলে সতীদাহের অগ্নিকুন্ডে প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার নারী হত্যা হত। আর মেয়েরা অঙ্কে কাঁচা, এই ধারনার ফাঁদে পরে প্রতি বছর বাংলায় অন্তত কয়েক লাখ মেয়ের কেরিয়ারের দফারফা হচ্ছে। কার্সি- তাদের বাবা-মা, তাদের পন্ডিত শিক্ষক সমাজ।
প্রথমত, কেউ অঙ্কে কাঁচা, এটাই প্রচন্ড ভুল ধারনা। অঙ্ক সব সাবজেক্টের মধ্যে সহজতম। যদি এটি কারুর কঠিন লাগে, তার মানে তার অঙ্কের শিক্ষক ভাল না। তাকে কেই ঠিকভাবে শেখায় নি। আগেই বলেছি, ইউটিউবে অঙ্কের খুব ভাল টিউটিটোরিয়াল আছে। সেখান থেকে ঠিক ভাবে শিখতে বলুন।
দ্বিতীয়ত আরো গুরুত্বপূর্ন- অঙ্ক মানে একটা “প্রবলেম”। অঙ্কের সমাধান মানে, সেই প্রবলেম বুঝে ধাপে ধাপে ভেঙে সমাধান করা। আপনি অঙ্কই করুন, আর আইন নিয়েই পড়ুন, অঙ্ক এড়াতে বায়োলজি পড়ুন। এই প্রবলেম এবং সল্যুউশন – এই যে ধাপে ভাঙা পদ্ধতি -এটা না শিখলে ত কেরিয়ারে পিছিয়ে যাবে।কারন পেশাগত জীবনে, শিক্ষকতার চাকরি বাদ দিলে, সর্বত্রই তা সমাধান নির্ভর। সুতরাং অঙ্কে দুর্বলতা থাকলে, তাকে নতুন ভাবে শেখান। অঙ্কে দুর্বল হলে ৯৫% ভাল কেরিয়ার চয়েস নষ্ট হবে।
আমি হিউম্যানিটি সাবজেক্ট পড়ার বিরোধি নই। কিন্ত সেখানে জীবিকার স্কোপ সীমিত। খুব মেধাবী না হলে দর্শন বা ইতিহাস নিয়ে পড়া উচিত না। আর ইংরেজিতে এম এ করে , কেরিয়ার চয়েস বেশী নেই। মাস মিডিয়া, কনটেন্ট রাইটিং, ইংরেজি টিচিং -এই সব ফিল্ডেই চাকরি আছে। কিন্ত মাইনে খুব কম। ওঠার স্কোপ ও কম।
যাইহোক, ২০১৬ সালে এই অঙ্কে কাঁচা ভুল ধারনা কিভাবে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি করে, সেই নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। আবার পোষ্ট করছি—
“শিশু এবং কিশোর মনের সর্বাধিক সাংঘাতিক যে ক্ষতিটি সমাজ এবং শিক্ষকরা করে থাকেন-সেটি হচ্ছে বাচ্চাদের মনে একটা ধারনা ঢুকিয়ে দেওয়া- এর দ্বারা অঙ্ক হবে না। অঙ্ক করার মাথা নেই। পড়াশোনাতে ভাল না। ঐ ছেলেটা পড়াশোনাতে ভাল। মোদ্দা কথা সমাজ এবং শিক্ষকদের কাছে -কোন ছাত্র মেধাবী, কোন ছাত্র মেধাবী না। ছোটবেলা থেকে আমি এমনটাই দেখে আসছি।
মেধাবী ছাত্রর ধারনা সম্পূর্নই অবৈজ্ঞানিক। কেউ ভাল, বা কেউ খারাপ ব্রেইন নিয়ে জন্মায় না। গত কুড়ি বছরে প্রচুর গবেষনা হয়েছে এই নিয়ে-যত এম আর আই স্টাডি হয়েছে বাচ্চাদের মাথা নিয়ে-তাতে কোথাও কেউ প্রমান করতে পারে নি- মেধাবী ছাত্রদের মাথা আলাদা।
তাহলে দুজন ছাত্রের পার্ফম্যান্স আলাদা কেন হয়? কেউ অঙ্ক সহজে করে ফেলছে-কেউ পারছে না। কেন এমন হয়?
ব্রেইন সবার সমান হলেও, ব্রেনের খুব অংশই আমরা কাজে লাগাচ্ছি। অঙ্ক বা চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়াতে গেলে, আরো বেশী করে আমাদের নিউরনগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। নিউরোসায়েন্টিস্টরা যেটা দেখেছেন ব্রেনের ম্যাগনেটিক রেজোনান্স স্টাডি থেকে- মানুষ যখন ভুল করে, সেই ভুল থেকে যে শিক্ষা পায়, সেটা সব থেকে সলিড। ইনফ্যাক্ট, এক ছাত্র যখন বোঝে এটা ভুল করছি-সেটা সব থেকে বেশী ব্রেইন সেলকে সচল করে।
অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা এমন, একজন শিশু ভুল করলে তাকে ধমকানো হয়। তাকে বলা হয় তার দ্বারা অঙ্ক হবে না। এর ফলে সে আরো সহজ অঙ্ক করতে যায় যাতে ভুল না হয়-এবং আস্তে আস্তে সে সেই সাবজেক্টে পিছিয়ে পড়ে।
অথচ এপ্রোচটা হওয়া উচিত ছিল উলটো। তাকে আরো কঠিন সমস্যা দাও। আরো ভুল করতে দাও। ভুলের মাধ্যমে শিখতে দাও।
অর্থাৎ একটা সহজ অঙ্ক ঠিক করে যতটা শেখা যায়, তার থেকে বহুগুন শেখা সম্ভব একটা কঠিন অঙ্ক ভুল করে ।
অথচ ছোটবেলা থেকেই আমরা একজন শিশুকে অঙ্ক বা বানান ভুল করার জন্য অপরাধী বানাচ্ছি। ফলে সে ভয়ের চোটে আরও সহজ অঙ্ক করতে চাইবে-বা আরো সহজ বাক্য লিখতে চাইবে। শব্দ বা নাম্বার কোনটা নিয়েই সাহস করে নতুন কিছু করার চেষ্টা করবে না। এখানেই তার শিক্ষার সব থেকে বেশী ক্ষতি করা হচ্ছে।
মুশকিল হচ্ছে শিশুশিক্ষা নিয়ে যেসব আধুনিক মেডিক্যাল পরীক্ষানিরিক্ষা হচ্ছে, তার কোনকিছুই শিক্ষাক্ষেত্রে আপ্লাই করার কোন স্কোপ নেই। ভারতের কথা ছেড়ে দিলাম, আমেরিকাতেও নেই।
নিদেন পক্ষে শিক্ষক এবং সমাজ এইটুকু অন্তত করতে পারেন-ছাত্রদের সাহস দিন ভুল করার জন্য। কঠিন অঙ্ক করার জন্য। বলুন কঠিন অঙ্ক করতে গিয়ে ভুল করাটা ভাল। কিন্ত সাহস যোগান যে তারাও পারে। ছাত্রদের মনে আত্মবিশ্বাস ফিরুক তারাও পারে। কখনো যেন তারা না ভাবে, তারা মাথা ভাল না-ফলে এসব কঠিন অঙ্ক তার জন্য না।
এতদিন শিক্ষা নিয়ে এতকিছু ভাবার দরকার হয় নি। কারন ৯৯% চাকরিতে মাথা খাটাতে হত না। কিন্ত দিনকাল বদলাচ্ছে। যেসব চাকরিতে মাথা খাটানোর দরকার নেই-সেসব কম্পিউটার করে দিচ্ছে-সেসব চাকরি আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। ফলে সেই সব চাকরিই টিকবে যেখানে মাথা খাটানোটাই কাজ। অথচ শিক্ষাক্ষেত্রে সেই বার্তা পৌঁছাচ্ছে না।“
আপনারা আপনাদের ছেলেমেয়েদের সমস্যা নিয়ে আমাকে লিখতে থাকুন। আমি ছাত্রছাত্রীদের মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে একটা বড় লেখা শীঘ্রই দিচ্ছি। কিন্ত যারা তাদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত, সমস্যায় আছেন-তারা আগে এই সিরিজের পর্ব ৮ এবং ৯ পড়ে নিন। তাহলে বাকি পর্বগুলির সুবিধা হবে। এবং হ্যা অবশ্যই কমেন্টে বা ইনবক্সে আমাকে আপনার সন্তানের সমস্যা নিয়ে মেসেজ করতে পারেন।
তবে অবশ্যই প্লিজ সিরিজটা ১-১৩ পর্যন্ত পড়ুন। আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবেন। আর আগামী পর্বগুলো পাওয়ার জন্য প্রোফাইলে ফলো ক্লিক করে যান। নইলে, আগামী পর্বগুলো মিস করে যাবেন-সেখানে পড়াশোনা নিয়ে আরো গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে আলোচনা করব।
No comments:
Post a Comment