জীবন এবং জীবিকা-৮ ঃ কিভাবে স্মৃতি শক্তি বা মেমরী পাওয়ার বাড়াবেন
বিপ্লব পাল, ১৫ই মে, ২০২৩
[ আগের পর্বগুলোতে আলোচনা করেছি মূলত স্ট্রাটেজি। কি পড়বেন, কোথায় পড়বেন, কোথায় শিখবেন ইত্যাদি। এই পর্ব থেকে শুরু করছি, আরো গুরুত্বপূর্ন আলোচনা-কিভাবে মানসিক এবং শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে পারে ছাত্রছাত্রীরা। যা অতীব গুরুত্বপূর্ন। প্রথমেই শুরু করব মানসিক দিকগুলি নিয়ে। তারপরে শারীরিক সক্ষমতার প্রশ্নে। কারন মানসিক এবং শারীরিক সক্ষমতা না বাড়ালে, অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার চাপ, সফল হওয়ার চাপ, সামাজিক চাপ-ইত্যাদি নিতে পারবে না। ভারত/বাংলাদেশের এক বিপুল অংশের ছাত্রছাত্রীরা অলরেডি ডিপ্রেশনে ভোগে বা ভুগছে। এই ধরনের বিপর্যয় যাতে ছাত্রছাত্রীদের জীবনে না আসে-তারজন্য একাধিক স্টেপ আগে থেকেই নেওয়া উচিত। সেইগুলি নিয়েই এই পর্ব এবং আগামী পর্বগুলিতে আলোচনা চালিয়ে যাব। ]
পৃথিবীর ইতিহাসে যত সফল নেতা বা প্রতিভাবান ব্যক্তির নাম আপনি জানেন-তাদের সবার অসাধারন স্মৃতিশক্তি ছিল। তাই নিয়ে প্রচুর গল্পও আছে বাজারে।
শার্লক হোমস বা বোমকেশ বক্সী কাল্পনিক চরিত্র হতে পারে-কিন্ত তারা যেভাবে জটিল সমস্যার সমাধান করেন- একজন বিজ্ঞানী বা সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার ও কিন্ত একই পথে সফলতা পান।
সেটা কিরকম ?
হোমস বা ব্যোমকেশ দুজনেই ক্রাইম নিয়ে ভাবেন। ক্রাইম সিন নিয়ে গভীরে ভাবেন। এবং দেখবেন, অধিকাংশ গল্পেই ক্রাইম সিনে কোন ক্ল পাচ্ছেন তাদের চিন্তায়- যা থেকে প্রমানিত হয়, তারা খুবই ডিটেলেস এ ক্রাইম সিনটা "মনে রেখেছেন"। একজন বিজ্ঞানীও ঠিকই একই পথে, একই রকম ডিটেলেস মেমেরী থেকে উপকৃত হন। থমাস আলফা এডিসন-তিনি আমাদের ইলেক্ট্রিক লাইট/বাল্ব, চলচিত্র, ডায়ানামো থেকে মাইক্রোফোন- সব দিয়েছেন- তার ছিল ফটোগ্রাফিক মেমরী। শার্লক হোমসের মতন প্রতিটা ব্যর্থতা তিনি দেখতে পেতেন। তার থেকেই সন্ধান পেতেন সঠিক পথের।
সুতরাং সফল হতে গেলে সুস্থ এবং ফটোজেনিক মেমরী খুব দরকার। এমনিতেও আমার বলার কিছুই নেই-যেহেতু ভারত এবং বাংলাদেশের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের এতগুলি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে হয়-সেগুলি বুদ্ধির পরীক্ষা না। মূলত মেমোরাইজেশন- বা কে কত মনে রাখতে পারে তার প্রতিযোগিতা।
কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে আমরা স্মৃতিশক্তি ভাল রাখতে পারি? বা বাড়াতেও পারি?
মূলত তিনটে দিকে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। এই নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষনা কি বলছে, তাও লিখছি।
প্রথম হচ্ছে, কিভাবে ইনফর্মেশন আমরা ব্রেইনে ঢোকাচ্ছি। যেমন যদি গল্পএর ছলে, লিখে বা এঁকে ইনফর্মেশন মাথায় ঢোকে- তা অনেক ভালভাবে দীর্ঘদিন মেমরীতে থাকে। অর্থাৎ কিভাবে পড়াশোনা করলে, তা মনে রাখা সহজ?
দ্বিতীয় হচ্ছে, লাইফস্টাইল। ঘুম, মেডিটেশন বা ধ্যান করা, স্মার্টফোন বা ভিডিও দেখা লিমিটের মধ্যে রাখা-ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিত-যাতে মেমরী পাওয়ার ভাল থাকে।
তৃতীয় - বাজারে যেসব সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায়, মেমরী এবং ফোকাস বাড়ানোর জন্য-তা আদৌ কাজের কি না? বিজ্ঞান কি বলে?
ইনফর্মেশন ব্রেইনে ঢোকানোর পদ্ধতি-অর্থাৎ কিরূপে আপনি পড়াশোনা মনে রাখবেন?
এটা তিনটে সিস্টেমেটিক ধাপে করতে হয়।
প্রথমে, বোঝার চেষ্টা করুন আপনার ব্রেইন, নতুন কিছু ঢোকানোর অবস্থায় আছে কি না। রাত ১২ টার সময় যখন ঘুম পাচ্ছে তখন ব্রেইনে কিছু ঢোকে? নাকি সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে রাখা ইজি? আপনার জীবনে শেখার সব থেকে ভাল সময় ঘুম থেকে ওঠার পর। শুধু ঘুম হলেই হল না, ঘুম গভীর হওয়াও দরকার, মেমরী ঠিক রাখার জন্য। ঘুমের দুটো স্টেজ আছে। র্যাপিড আই মুভমেন্ট ( রেম), নন রাপিড আই মুভমেন্ট ( নারেম) বা গভীর ঘুম!!
আমাদের আছে শর্টটাম মেমোরী-যা থাকে ব্রেইনের হিপোক্যাম্পাসে। আর লংটার্ম মেমরী- থাকে নিওকর্টেক্সে। গভীর ঘুমে ( নারেম), আমাদের শর্টটাম মেমরী, হিপোক্যাম্পাস থেকে লংটার্ম মেমরীতে চলে যায়। এই প্রসেস প্রতিদিন সম্পূর্ন না হলে, হিপোক্যাম্পাস, নতুন তথ্য নেওয়ার জন্য রেডি থাকে না। গভীর ঘুমের পর হিপোক্যাম্পাস অনেক বেশী রেডি থাকে নতুন তথ্যের জন্য। সেইজন্য সব সময় ঘুম থেকে উঠে যে সময়টা পাওয়া যায়, সেটা আড্ডা/খেলা/টিভি দেখার জন্য না দিয়ে, নতুন কিছু শেখার জন্য ব্যবহার করা উচিত। কারন ওই সময়টাই ব্রেইন নতুন কিছু নেওয়ার জন্য সব থেকে বেশী রেডি থাকে। আমি তাই করি বহুদিন।
দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, ইনফর্মেশন যেটা মাথায় ঢোকাতে যাচ্ছেন-সেটা ভেঙে ভেঙে বুঝতে হবে। দরকার হলে লিখে সামারি করে নোট করেও নিতে পারেন। কিন্ত বোঝায় ক্লারিটি থাকা দরকার।
তৃতীয় ধাপ সব থেকে গুরুত্বপূর্ন। সেটা হচ্ছে, এই যে দ্বিতীয় ধাপটি করলেন খাতায় -লিখে বা এঁকে-এটিই সরাসরি মনে মনে করে ফেলুন। যেন চোখ বন্ধ করে সিনেমা দেখছেন। প্রতিটা ধাপ যেন মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। খাতা পেনের সাহায্য ছাড়া।
তৃতীয় ধাপ খুব গুরুত্ব। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা দ্বিতীয় ধাপ পর্যন্ত করে-কিন্ত তৃতীয় ধাপে যায় না। যারা এই থার্ড স্টেপটা করতে পারে, তারাই সব থেকে বেশী সফল। পরীক্ষা এবং কাজেও।
আমার নিজের জীবনের গল্প বলি। আমি উচ্চমাধ্যমিকে নরেন্দ্রপুরে পড়েছি। মাধ্যমিক পর্যন্ত গ্রামশহর করিমপুরের স্কুলে পড়ে, নরেন্দ্রপুরে ঢোকা। মাধ্যমিক পর্যন্ত ওই দ্বিতীয় ধাপে আটকে ছিলাম। আমার অধিকাংশ বন্ধুরাও তাই। নরেন্দ্রপুরের বাই মান্থলিগুলোতে প্রচুর কঠিন প্রশ্ন হত। প্রথম বাই মান্থলিতে প্রচুর ছেলেরা ফেল করল। যাদের অনেকেই মাধ্যমিকে ১-২০ এর মধ্যে র্যাঙ্ক করা। আমি পাশ করলাম বটে-কিন্ত এত বাজে নম্বর পেতে অভ্যস্থ ছিলাম না। ভাবছি কি করা যায়। কারন পড়াশোনায় ত্রুটি ছিল না- প্রচুর সময় দিচ্ছিলাম। যারা ফেইল করেছিল-তারাও সময় দিয়েছে। এদিকে দেখলাম বেশকিছু ছেলেপুলে, একদম খুব কম সময় দিয়েও ভাল রেজাল্ট করেছে। তাদের স্টাডি করে বুঝলাম, তারা ওই স্টেপ-৩ টা করছে-অর্থাৎ একদম ফোটোজেনিক মেমরী দিয়ে ধ্যান করে ওই ইনফর্মেশনটা ধাপে ধাপে ভেঙে মাথায় ঢোকাচ্ছে।
এই আবিস্কারটুকু আমার জীবন বদলে দিয়েছিল। এরপর আমাকে কোন ইনফর্মেশন মাথায় ঢোকানোর ব্যাপারে কষ্ট করতে হয় নি। এবং আগে মাধ্যমিকে যেখানে দিনে ৮-১০ ঘন্টা পড়াশোনা করতে হত-উচ্চমাধ্যমিকে ১-২ ঘন্টাও দিনে লাগত না। বাকী জীবনেও আমাকে কখনোই দিনে ১-২ ঘন্টার বেশী পড়াশোনা করতে হয় নি। কারন ওই তৃতীয় ধাপের সফল ব্যবহার।
এবার আসি লাইফস্টাইলের প্রশ্নে। মেমরী ঠিক রাখতে গেলে আট ঘন্টা এবং গভীর ঘুম ভীষন ভাবেই দরকার। কারনটা আগেই লিখলাম। নন রাপিড আই মুভমেন্ট স্টেজেই একমাত্র মেমরী শর্টটার্ম থেকে লংটার্মে ট্রান্সফার হয়। ওটা না হলে, নতুন কিছু শেখা প্রায় অসম্ভব।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের সবার হাতেই স্মার্টফোন,। এরা এত ভিডিও গেমস, চ্যাট করছে- অনেকেই প্রায় ঘুমাচ্ছে না। ফলে তাদের শেখার ক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। খুব সাধারন পড়াশোনাও মাথায় ঢোকাতে পারছে না। বাজে রেজাল্ট থেকে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে।
সাথে সাথে শরীর চর্চাও দরকার, যাতে ব্রেইনে অক্সিজেন সার্কুলেশন ভাল থাকে। এই নিয়ে পরের পর্বে লিখব। ভাল ঘুমের জন্য, গভীর ঘুমের জন্য শরীর চর্চা, ঘাম ঝড়ানো খুবই জরুরী।
এবার দেখি, বাজারে কোন সাপ্লিমেন্ট আছে কি না-যা মেমরী পাওয়ার বাড়ায়।
ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড- এই ব্যপারে কোন স্টাডি কনক্লুসিভ না। তবে এটা ঠিক, কিছুটা কগনিটিভ এবিলিটি এটি বাড়ায়।
জিঙ্কো বিলোবা- হার্বাল সাপ্লিমেন্ট। বহুদিন থেকে এশিয়ানদের বিশ্বাস যে ইহা, মেমোরি পাওয়ার বাড়ায়। কিন্ত বৈজ্ঞানিক স্টাডি নেই।
বাকোপা মনেইরি- যারা ব্রেনোলিয়া খান-এটিই থাকে। কিন্ত এটিও আদৌ কাজ করে কি না, কোন প্রমান নেই।
ভিটামিন -ই - হ্যা, ভিটামিন ই, মেমোরি পাওয়ার বৃদ্ধিতে কার্যকর। এর অনেক প্রমান আছে। তবে না ঘুমালে ভিটামিন ই ও বাঁচাবে না।
সোজা কথা আপনার ছেলেমেয়েটি যেন যথেষ্ট ঘুম এবং শরীরচর্চা করে তার দিকে আগে নজর দিন। মানসিক এবং শারীরিক সুস্বাস্থ্য সবার আগে।
( যারা আগামী পর্বগুলো পড়তে চান, তারা প্লিজ প্রোফাইলে গিয়ে ফলো করুন। )
[ কাল আমাকে অনেকে ইনবক্স করেছেন, চ্যাট জিপিটি দিয়ে কোডিং শেখার কোন পেশাদার কোর্স আছে কি না। আপনারা সুদীপ পাঁজার সাথে যোগাযোগ করুন 9851773526 -ওরা সামারে এই ধরনের কোর্স অর্গানাইজ করছে ]
No comments:
Post a Comment