Wednesday, December 30, 2009

২০০৯ সালের সব থেকে বড় ঘটনা কি?

এই ধরনের ব্লগ খোলা উচিত না। তবুও একটা রেট্রোস্পেকশন চাইছি।

[১] বাংলাদেশের ভোটে ইসলামিক শক্তির 'কনক্লুসিভ' পরাজয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির পুনঃজাগরন
[২] ভারতের বিজেপি তথা হিন্দুত্ববাদি শক্তির শোচনীয় পরাজয়। হিন্দুত্ববাদ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে পরিতক্ত্য।
[৩] কর্পরেট আগ্রাসানের বিরুদ্ধে ফলশ্রুতি হিসাবে পশ্চিম বঙ্গে ৩৩ বছর কমিনিউস্ট শাসনের পর, ৩৩ বছরে প্রথম প্রতিটি নির্বাচনে কমিনিউস্ট শক্তির শোচনীয় হার। লালগরে কর্পরেট তথা রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে আদিবাসিদের সফল আন্দোলন।
[৪] অর্থনৈতিক মন্দা থেকে আমেরিকার ঘুরে দাঁড়ানো।
[৫] ল্যাটিন আমেরিকাতে সমাজতান্ত্রিক দলগুলির নির্বাচনী সাফল্য।
[৬] ইউরোপে ইসলামের বিরুদ্ধে তীব্র রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া।
[৭] তালিবানদের হাতে পাকিস্তানের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অবস্থা।
[৮] মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইরাণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন।
[৯] কোপেন হেগেনের কার্বন সার্কাস।
[১০] আরো তীব্রতর খাদ্য এবং শক্তি সংকট

কিছু কিছু ঘটনা আঞ্চলিক হলেও বিশ্বরাজনীতিতে এর প্রভাব আছে। পশ্চিম বঙ্গের নন্দীগ্রাম এবং লালগড়, নিও লিব্যারালিজমের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনে এখন আন্তর্জাতিক প্রতীক। কারন এত সফল ভাবে আর কোথাও রাষ্ট্র যন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায় নি । শয়ে শয়ে মৃত্যুর মিছিলের ওপরে মানুষের জয় ঘোষিত হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলামিক শক্তির চুড়ান্ত পরাজয়, নিঃসন্দেহে ইসলামিক বিশ্বে নতুন ট্রেন্ড। বাংলাদেশের মুসলমানরা প্রমান করেছেন, তারা একবিংশ শতাব্দিতে দৌড়াতে চাইছেন-সপ্তম শতকে আরবের উটের দুধ খাওয়ার ইচ্ছা তাদের নেই। যেটা মিশর, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এমন কি তুরস্কেও সম্ভব হয় নি। ভারতে সিপিএম এবং বিজেপির পরাজয় খুব পরিস্কার ভাবেই একবিংশ শতাব্দিতে অচল আদর্শবাদের বিরুদ্ধে মানুষের রায়।

বাকী সব বিষয়গুলি-পাঠকের হাতে তুলে দিলাম বিশ্লেষনের জন্যে। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে এর প্রভাব কি হবে?

Sunday, December 27, 2009

জেমস ক্যামেরুনের অবতারঃ শুধুই কল্পবিজ্ঞান আর থ্রিডির খেলা?

.
.
.


(১)
ক্রীসমাসের এই ছুটিতে আমেরিকা তথা বিশ্বে সবথেকে আলোচিত টাইটানিকের পরিচালক জেমস ক্যামেরুনের "অভতার" (বাংলা অবতার)। শুধু অত্যাধুনিক স্টিরিওগ্রাফিক ক্যামেরা বা থ্রি ডাইমেনশনার কম্পুটার গ্রাফিক্সের জন্যেই অবতার নিয়ে এত সোরগোল হচ্ছে তা ঠিক না। হলে গিয়ে মনে হল আমেরিকান বস্তুবাদি সভ্যতায় বিধ্বস্ত অনেকেই ফিরে যেতে চাইছে, ফিরিয়ে দাও সে অরণ্যের যুগে যেখানে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করেই বেঁচে থেকেছে মানুষ।

অভতারের এমন দুড়ন্ত ক্রেজ আমার গত দশ বছরের আমেরিকান জীবনে বিরল অভিজ্ঞতা। আমার বাড়িথেকে ১৫ মিনিটি দুরে দুটো মাল্টিপ্লেক্স। কলম্বিয়ার আই-ম্যাক্সে আছে ১২টা আর আরুনডেলের সিনেম্যাক্সে আছে ২৪ টা থিয়েটার। আই ম্যাক্সের ৫ টাতে আর সিনেম্যাক্সের ১২টা থিয়েটারে চলছে অভতার। এত শো দেখানোর পরেও যা ভীর দেখলাম, সেটা বহুদিন আগে হিন্দি সিনেমার ফার্স্ট ডে ফার্স্টশোতে ভারতে দেখেছি। এখানে সিনেমার জন্যে বিশাল লাইন, ধাক্কাধাক্কি কল্পনাতীত। সাধারনত শো শুরু হওয়ার ত্রিশ মিনিট আগে আমি যাত্রা শরু করি। কাঁটার মতন হিসাব মেলে প্রতিবার। হলে পৌঁছাব ১৫ মিনিটে, পার্ক করে টিকিট কেটে ঢুকে যাব শো শুরু হওয়ার ৫ মিনিট আগে । এখানে কদাচিৎ হলগুলি ৪০% ভর্তি থাকে। শেষ স্ল্যামডগ মিলিয়নারের মতন সুপারহিট সিনেমাতেও দেখেছি ৩০-৪০% মতন সীট প্রাইম টাইমে ভর্তি ছিল। ফলে পার্ক করে, মেশিন থেকে টিকিট কেটে ঢুকে যেতে কোন সময়, লাইন, হ্যাপা কিছুই লাগে না। এবার যথারীতি আই ম্যাক্সের সামনে ২-৪০ নাগাদ পৌঁছালাম। তারপর দেখি গাড়ি ঠেলে ঢুকতেই পারছি না। শেষে ১৫ মিনিট ধরে গাড়ি যখন এগোল না, সোজা আবার বাড়ির দিকে চলে এলাম। এবার ঠিক করলাম ৬টা শো তে ৫টার সময়ে যাব।

ও বাবা। সেখানেও বিধি বাম। এবার পার্ক করে পৌঁছলাম বটে, কিন্ত রাতের বাকী ১৪টা শোতে আই ম্যাক্সে টিকিট নেই।শেষে আরুনডেলের সিনেম্যাক্সে ছুটলাম। ওখানে অনেকগুলো থিয়েটারে চলছে বলে, প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর, অবতারের একটা নতুন শো শুরু হচ্ছে। সেখানে থ্রিডির শেষ শো-রাত দশটার টিকিট পেলাম। সাথে চার বছরের পুত্র সন্তান বলে প্রথমে রাজী হইনি। পরে দেখলাম, কালকেও এর থেকে ভাল কিছু হবে আশা নেই। ফলে চোখ কান বুঁজে ভাগ্যকে মেনে নিতেই হল।

গত সপ্তাহে অভতার, গোটা পৃথিবীতেই হাউসফুল। ৬১৫ মিলিয়ান ডলার তুলেছে এক সপ্তাহের বক্স অফিসে যা এক-কালীন রেকর্ড। কিন্তু কি ম্যাসেজ পাঠালেন ক্যামেরুন, যার জন্যে উত্তাল সারা পৃথিবী?

(২)
প্যান্ডোরা ২১৫৪ ঃ নাভিদের সমাজ এবং মানুষের সাম্রাজ্যবাদ

ক্যামেরুন তার সাক্ষাতকারে, কনফারেন্সে বারবার বলেছেন, অভতারের ম্যাজিক সিনেমার শিল্প বিপ্লবে না। দর্শক আসবে শুধু গল্পের জাদুতে। কিন্ত এ শুধু গল্প না-আমেরিকা তথা বস্তুবাদি সভ্যতার বিরুদ্ধে কিছু প্রশ্ন। যা আমরা ইদানিং করছি। কিন্ত অভতারের মতন এত শক্ত বক্তব্য একমাত্রেই শিল্পেই সক্ষম। শিল্পের দরকার ঠিক এই কারনেই - মানুষের নির্লিপ্ত স্তরকে অতিক্রম করে, চেতনার দরজায় ধাক্কা মারে।

আলফা সেঞ্চুরীর গ্রহ পলিফেমাসের উপগ্রহ প্যান্ডোরা। পৃথিবী সাদৃশ জলবায়ু এবং বায়োষ্ফিয়ার। ২১৫৪ সালে ঘটনার শুরু। মানুষ সেখানে পৌঁছে গেছে। পলিফেমাস নিয়ে মানুষের আগ্রহের কারন এই গ্রহে আনোবাটিয়ামের খনি। উনোবাটিয়াম এন্টি গ্রাভিটি ম্যাটেরিয়াল-পৃথিবীতে এর খুব দাম। আর ডি এ কর্পরেশন, যা পৃথিবীর একটি পাবলিক কোম্পানী, এখানে এসেছে আনোবাটিয়ামের খনি বানাবে বলে। কিন্ত সেটা করতে গেলে প্যান্ডোরার আদিবাসি নভিদের তাড়াতে হয় তাদের আদিভূমি থেকে। প্রথমে তারা নভিদের লোভ দেখিয়েছে অন্য জায়গায় পুনর্বাসন দেবে বলে। নভিরা রাজি হয় নি। ফলে আর ডি এক্স কর্পরেশন নিয়ে সেছে এক বিরাট প্রাইভেট সেনা বাহিনী। কিন্ত এখনো আক্রমন করছে না। হাজার হলেও মানুষ সভ্য! রেড ইন্ডিয়ানদের মতন নভিদের মেরে ফেললে "ব্যাড প্রেসের" জন্যে শেয়ার প্রাইসে ধ্বস নামবে। অনেকটা টাটা সেলিমদের নন্দীগ্রামে যেমন হয়েছিল আর কি। ওখানে সিপিএমের হার্মাদরা ছিল সেলিমদের প্রাইভেট আর্মি।

তাই নাভিদের বুঝিয়ে পটিয়ে পুনর্বাসন দেওয়ার জন্যে তৈরী হয়েছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মার্ভেল অবতার। এদের ডি এন এ মানুষ আর নভিদের সংকর। অভতারের বায়োলজিক্যাল দেহটা নভিদের কিন্ত তাদের মাথাকে পরিচালনা করে মানুষ। আর ডি এ কর্পরেশনের বেস স্টেশন থেকে। তবে সেই মানবই নভি অবতারের পরিচালক হতে পারবে, যে মানুষটির ডি এন এর সাথে নভির সংকরটি বানানো হয়েছে। অনেকটা কৃষ্ণ যেমন ছিলেন মানুষের দেহে বিষ্ণু অবতার। ক্যামেরুন ঠিক এই সাদৃশ্যের জন্যেই এদের নাম দিয়েছেন অবতার, যা সংস্কৃতে অভতার। নাভিদের দেহে মানুষ অবতার। যাদের আসল কাজ নাভিদের সংস্কৃতিকে ভাল করে জেনে বুঝে তাদেরকে পুনর্বাসনের জন্যে রাজী করানো!

প্যান্ডোরার নাভিরা বিবর্তনের প্যালিওলিথিক ধাপে আছে। কৃষিভিত্তিক সমাজে ঢোকার পূর্বে শিকারী মানুষেরা যেমন ছিল। প্যান্ডোরায় অভিকর্ষজ বল কম। তাই নাভিরা ১০ ফুট লম্বা। এখানকার উদ্ভিদ প্রজাতিও বিশাল লম্বা অভিকর্ষজ বলের অভাবে। আর সেই পরিবেশে বিবর্তনের জন্যে নাভিরা অনেকটাই বিড়াল মানুষ। ক্যাট ফ্যামিলির প্রিডেটরদের মতন ক্ষীপ্র তাদের গতি গাছ থেকে মাটিতে।

কিন্ত গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে নাভিদের সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। নাভিরা প্যাগান। আরো নিঁখুত ভাবে লিখলে প্যান্থেওনিক প্যাগান। অর্থাৎ হিন্দুদের মতন এদেরও বিশ্বাস, আশে পাশের সব পশু, পাখী, গাছ-পালা সবকিছুই ঈশ্বর। যদিও এদের সংস্কৃতি আফ্রিকার প্যালিওলিথিক আদিবাসিদের মতন। নভিদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে হিন্দু ধর্মকে আরো প্রবল ভাবে রূপকের আকারে ঢুকিয়েছেন ক্যামেরুন সুপার কনসাসনেশ বা বিশ্বচেতনার মধ্যে দিয়ে। নাভিরা বিশ্বাস করে সমগ্র প্রকৃতির সাথে তারা অবিচ্ছেদ্য-মানসিক এবং দৈহিক ভাবে। এই সিনেমাতে সেটা এসেছে নানা ভাবে। অভতার প্রজেক্টের লিড বিজ্ঞানী ডঃ গ্রেস আগাস্টাইনের বিশ্বাস প্যান্ডোরার বৃতৎতম বটবৃক্ষটির শিকড়গুলি আসলেই নিউরাল নেটওয়ার্ক। যার সাহায্যে সমস্ত নাভিরা একটি সামগ্রিক চেতনার যাথে যুক্ত। শুধু তাই না। নাভিদের ঘোড়া বা উড়ন্ত বিশাল পাখী তারুক সবার সাথেই তারা চুলের মাধ্যমে 'চেতনার' বন্ডিং করে তাদেরকে ব্যাবহার করে। এই সামগ্রিক বিশ্বচেতনা বা সুপার কনসাসনেস এর ধারনা শ্রী অরবিন্দের লেখাতে বারবার এসেছে-যাকে অরবিন্দ বলেছেন সুপার মাইন্ড।

"To be in the being of all and to include all in one's being, to be conscious of the consciousness of all, to be integrated in force with the universal force, to carry all action and experience in oneself and feel it as one's own action and experience, to feel all selves as one's own self, to feel all
delight of being as one's own delight of being is a necessary condition of the integral divine living."
— Sri Aurobindo, The Life Divine

(৩)
বস্তুবাদ বনাম প্যাগানিজমঃ

প্যাগানিজম এই গল্পে প্রকৃতি মায়ের ধারক এবং বাহক। আধুনিক বস্তবাদি তথা একেশ্বরবাদি চিন্তায় প্যাগানিজম হচ্ছে কুসংস্কার। প্যান্থেওনিক প্যাগান হিন্দুদের ইঁদুর বিড়াল গরু পূজা ইত্যাদি বস্তুবাদি বা একেশ্বরবাদি দৃষ্টিতে হাস্যকর। যার জন্যে ইতিহাসে আমরা দেখব হিন্দু বা মায়ান বা রেড ইন্ডিয়ান প্যাগান সভ্যতার ওপর উন্নত মিলিটারীর অধিকারী খ্রীষ্ঠান বা ইসলামিক সভ্যতা বারবার আক্রমন চালিয়েছে। খ্রীষ্ঠান বা ইসলামিক ইতিহাসে এই সব আক্রমনকে দেখা হয় অসভ্য প্যাগানদের সভ্য করার ইতিহাস। এখানেও মানুষ নভিদের সভ্য করতে চেয়েছে বলে দাবী করছে। কিন্ত এই দাবীর অন্তসার শুন্যতা প্রমান হয় প্যান্ডোরাতে আর ডি এ কর্পরেশনের হেড পার্কার সেলফ্রিজ এর কথাবার্তায়। কর্পরেট অফিসার পার্কার এই গল্পে ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি এবং এন্টাগনিস্ট। সে এই ব্যাপারে খুবই পরিষ্কার যে আসল মোটিভেশন হচ্ছে 'লাভ'। সভ্য করার কথাটা সুগারকোট। অথচ বাবরনামা থেকে লর্ড ক্লাইভ-সবার লেখাতেই পার্কারের বক্তব্য পাওয়া যাবে-সেটা হচ্ছে নেটিভ হিন্দু প্যাগানরা সাপ ব্যাঙ পূজ়ো করা অসভ্য-তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অনুন্নত। তাই এদের সভ্য করতে ঈশ্বর তাদের পাঠিয়েছেন। অথচ এদের সবার তলপেটেই ছিল পার্কারের মতন সম্পদের জন্যে লোভ।

কিন্তু এই বস্তবাদি বা একেশ্বরবাদি সভ্যতা যেটা বোঝে না-সেটা হচ্ছে প্যান্থেওনিক প্যাগানিজম কিন্ত একেশ্বরবাদি ধর্মগুলো বা অধুনা বস্তবাদি সভ্যতা থেকে আরো হাজার হাজার বছর পুরানো। হাজার হাজার বছরের বিবর্তন তাদের শিখিয়েছে প্রকৃতি বান্ধবতা। তারা জানে প্রকৃতিই তাদের ঈশ্বর। প্রকৃতি ধ্বংশ হলে তারাও বাঁচবে না। অথচ আজকের বস্তুবাদি মানুষ, এত উন্নত মানুষ কোপেনগেহেনে যে তামাশা আর সার্কাস চালালো, তাতে এটা পরিষ্কার বস্তুবাদি মানুষ প্যাগানদের থেকে বেশী জানতে পারে, কিন্ত বিচক্ষনতায় অনেক পিছিয়ে। আমরা কি চাই? জ্ঞানী না বিচক্ষন মানুষ?

বহুদিন আগে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনির সাথে আলাপে আমি বলেছিলাম, বুদ্ধের আকাঙ্খামুক্ত জীবনাদেশ বস্তুবাদি উন্নতির পরিপন্থী। তিনি হেসে বলেছিলেন, আরো একশো বছর দেখ বাছা-এই রেকলেস গ্রীড বা সীমাহীন লোভ হচ্ছে বাঘ। যখন খাবার পাবে না, সে তোমাকেই খাবে। আধুনিক সভ্যতার বাঘ হচ্ছে বিজ্ঞান। আমি সেই সন্ন্যাসীনিকে দেখে হেঁসেছিলাম। আজ কোপেনহেগেন সম্মেলনের পরে সেই হাঁসি আমাকেই ঠাট্টা করছে।

তবে ক্যামেরুনের গল্পে বিজ্ঞান মোটেও এন্টাগনিস্ট না। বরং সেও প্রকৃতি রক্ষার পক্ষে প্রটাগনিস্ট। কিন্ত ধণতন্ত্রের সেবাদাস যে বিজ্ঞান, সে এক অর্থে বন্দিনী! সেটাই আমরা দেখবে অভতার প্রকল্পের বিজ্ঞানী ডঃ গ্রেসের চরিত্রে। ডঃ গ্রেসের সাথে কর্পরেট অফিসার পার্কার সেলফরিজের কথাবার্তাই বিজ্ঞান বনাম ধণতন্ত্রের সংঘাত বারবার এসেছে। বিজ্ঞানী গ্রেস ও নভিদের দলে-তিনিও চাইছেন না কিছু খনিজের জন্যে এই উপগ্রহের সবুজকে ধ্বংশ করতে। কিন্ত পার্কার তাকে মনে করাচ্ছেন, গ্রেসের স্যালারী তথা অভতার প্রজেক্টের টাকা আসছে শেয়ার হোল্ডারদের টাকায়। যাদের অভতার বা প্যান্ডোরার জৈব বৈচিত্র নিয়ে কোন উৎসাহ নেই। তারা চাইছে উনোবটিয়াম। তারা চাইছে বস্তবাদি সভ্যতার জারজ সন্তান 'লাভ'। অর্থাৎ অবতার গল্পে খুব পরিস্কার ভাবে বলেছে বিজ্ঞান মোটেও অভিশাপ না। তাকে অভিশাপ বানিয়েছে মানব সভ্যতা। যদিও এই গল্পে বিজ্ঞানকে অভিশাপ বানানোর জন্যে ধণতন্ত্রকেই দোষারোপ করা হয়েছে, বাস্তব সত্য হচ্ছে বিংশ শতাব্দির কমিনিউস্ট দেশগুলিও বিজ্ঞানকে কম অভিশাপ বানায় নি। সেই অর্থে যেকোন বস্তুবাদি সভ্যতাই বিজ্ঞানকে রাজনৈতিক কারনে ব্যাবহার করে তাকে মানব সভ্যতার অভিশাপ বানিয়েছে।

তবে এই গল্পের ভিলেন অবশ্যই আমেরিকান মেরিন। আমেরিকান সেনাবাহিনীর সব ধরনের অসভ্যতাকেই ব্যাঙ্গ করেছে অভতার। দেখিয়ে দিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের সাথে ধনতন্ত্রের পার্টনারশিপ। ক্যামেরুন সাক্ষাৎকারে খুব পরিষ্কার করেই বলেছেন, এ হচ্ছে আমেরিকার হটকারি বিদেশনীতির বিরুদ্ধে হলিউডের প্রতিবাদ। বৃহত্তর অর্থে অবশ্য আমার মনে হয়েছে সামগ্রিক বস্তুবাদি মানব সভ্যতাকেই দুষেছেন ক্যামেরুন।


(৪)
সভ্যতা বনাম সংস্কৃতিঃ

সভ্যতা বনাম সংস্কৃতির লড়াই হলিঊডে এই প্রথম না। ক্যামেরুন নিজেই অভতারেও ওপর " Dancing with Wolves" এর প্রভাব স্বীকার করেছেন। যেখানে বস্তবাদি সভ্যতায় উন্নত এক মানুষ আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে বুঝতে পারে, আদিবাসীরা সভ্যতার বিচারে পিছিয়ে থাকলে কি হবে, সংস্কৃতির বিচারে অনেক এগিয়ে।

আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি বোঝাতে, স্বামী সূপর্ণানন্দর উদাহরনটি প্রানিধানযোগ্য। উনি বলতেন তাজমহলের ইমারতটা হচ্ছে সভ্যতা-আর তাজমহলে কবর দেওয়া সাহাজাহানের মমতাজের প্রতি যে ভালোবাসা সেটা হচ্ছে সংস্কৃতি। একটা মাথার সম্পদ, অন্যটা হৃদয়ের।

এখানেও নভি অভতার তথা গল্পের প্রটাগনিষ্ট জ্যাক সুলি নভিদের বাগে আনতে এসে, নিজেই নভি সভ্যতার প্রেমে পড়লেন। কারন নভিরা বস্তবাদি সভ্যতায় অনুন্নত হলে কি হবে, তাদের সংস্কৃতি অনেক উন্নত। সেই সংস্কৃতি হচ্ছে প্রকৃতি আর মানুষকে ভালবাসা। সেই জন্যে মানুষরা যখন নাভিদের শিক্ষিত করতে চাইল-নাভিরা বলে পাঠালো মানব সংস্কৃতি থেকে তাদের শেখার কিছু নেই। ওই হানাহানি বা লোভের সংস্কৃতি থেকে কি শিখবে তারা?

অবশ্য ক্যামেরুনের এই চিন্তা আবেগের দিক দিয়ে যতটা ঠিক, বিবর্তনের দিক দিয়ে ঠিক না। হিংসা এবং অহিংসা, লোভ এবং স্বার্থবিসর্জন, এই সব বৈপরীত্যের মিশ্রনই আমাদের রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস বাড়িয়ে থাকে। হিংসা আর লোভ আমাদের মধ্যে এমনি এমনি আসে নি। এসেছে বিবর্তনের পথে আমাদের টিকিয়ে রাখতেই। আবার সেই লোভই আমাদের ধ্বংশের পথ দেখাচ্ছে।

থ্রিডিতে প্যান্ডোরাকে যেভাবে মূর্ত করেছেন পরিচালক, তা সত্যিই অনবদ্য। আমারত মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিল প্যান্ডোরাতে ঝর্ণার ধারে বসে আছি। অভতারের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে সত্যই অভূতপূর্ব। পরিচালকের মতন আমিও চাই অরবিন্দর সুপার মাইন্ড মানব সভ্যতাতেও আসুক। তবে তা বোধ হয় বৈজ্ঞানিক দিয়ে খুব সঠিক চিন্তা না।

Monday, December 21, 2009

এত রক্ত কেন?

কিন্ত যেভাবে হিংসাতে সারা পশ্চিম বঙ্গ উত্তাল, তাতে চুপ করে থাকা গেল না।

রাজনৈতিক পরিবর্তন এলে কিছু লাশ পড়বে-এসব বিপ্লবী বিশ্বাস। পরিতক্ত্য ধারনা। উন্নত বিশ্বে রাজনীতির জন্যে এই ভাবে মানুষ খুন হয় না।

রাজনৈতিক খুন এবং হিংসার পেছনে কারন গুলো নিম্নরুপঃ

(১)
নিউ ম্যালথেসিয়ান তত্ত্ব ঃ
জমি কম, লোক বেশী। সীমিত সম্পদ নিয়ে পশুর মতন খেওখেয়ি। তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক হিংসা নিয়ে যত কাজ দেখেছি, তাতে এই নিউ ম্যালথেসিয়ান তত্ত্বটা বার বার এসেছে। কেও কি অস্বীকার করতে পারে কেশপুর থেকে নন্দীগ্রাম থেকে সিঙ্গুরে, এই সীমিত সম্পদ নিয়ে মারামারি করার ভূমিকা? ১৯৭৭ সালে এক একর জমির ওপর কজন জীবিকা নির্বাহ করত? এখন কজন করে?

জন সংখ্যা চীনের মতন কড়া হাতে নিয়ন্ত্রন করতেই হবে।

(২)
গণতন্ত্রের অভাবঃ

নানান লেভেলে। সব লেভেলেই ব্যাবসায়ীরা কব্জা করতে চাইছে গন-নিয়ন্ত্রন ব্যাবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। প্রতিটা রাজনীতিবিদই এখন ব্যাবসায়ীদের
বোরে মাত্র। গণতন্ত্রের এই ব্যাবসা বন্ধ করতে দরকার রাজনৈতিক সংস্কার। সিপিএম বাস্তঘুঘু জন্মের পেছনে, এটাই কারন। যা কংগ্রেসের ও বহুদিনের রোগ

(৩)

সমাজ জীবনের ওপর সরকারী নির্ভরতা বড্ড বেশী। যার জন্যে যে ভোটে জিতবে, তার সামনে অসংখ্য ব্যাবসা। এটা বন্ধ করতে হবে।
সরকারী সব ডিপার্টমেন্ট গুলো মন্ত্রীদের হাতে না থেকে বিধান সভার একটা কমিটির হাতে থাক যাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং কিছু গুনী ব্যাক্তি থাকুন। ঘুঘু এত খাবার পেলে, অনেক ডিম ত পাড়বেই। আর সীমিত সম্পদ থাকলে খেয়োখেয়িও শুরু হবে

(৪)
পুলিশ যেন কোন মন্ত্রীর হাতে না থাকে। এতে পুলিশ একটা রাজনৈতিক দলের সেবাদাসের পরিনত হচ্ছে।ফলে লোকে পুলিশের ওপর ভরসা হারিয়ে নিজেরাই অস্ত্র তুলে নিচ্ছে। পুলিশ থাকুক বিচারপতি এবং বিধান সভার কোন কমিটির হাতে।

******************
সমস্যা অনেক। সমাধান চাই।

সমস্যা একটাই-সেটা হচ্ছে রাজনীতির ব্যাবসা। এটাকে বন্ধ না করলে, আরো লাশে লাল হবে এই বঙ্গের মাটি।

Thursday, December 17, 2009

খাদ্যদ্রব্যের দাম-শেষের সেদিন অন্ধকার

ভারতে খাবারের দামে আগুন নেভানো যাচ্ছে না। অনেক কারন আছে-জলবায়ু এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাবারের দামের উর্দ্ধগতি তার অন্যতম। আনন্দবাজার সেটাই লিখেছে।

এমনটা হবে আমি ২০০৭ সালের এক প্রবন্ধেই ব্যাখা করেছিলাম।

সমস্যা হচ্ছে ভারতে সমস্যা সমাধানের জন্যে আমরা প্রযুক্তির দিকে না তাকিয়ে-রাজনৈতিক দলাদলি করি বেশী। একদিকে সুবিধাবাদি দক্ষিনপন্থী ঘুঘু, অন্যদিকে নির্বোধ বামপন্থী-আর মধ্যেখানে নিধিরাম সর্দার কংগ্রেস। ২০-২০ ম্যাচ খেলছে। লংটার্ম কোন প্ল্যানিং নেই! অথচ প্রযুক্তি ছাড়া, স্ট্রাটেজি ছাড়া ভারতীয় কৃষিকে বাঁচাবে কার সাধ্য?

ভেবে দেখুন

(১) কৃষিক্ষেত্র থেকে ফসল আর আগের মতন হচ্ছে না। অজৈব চাষ করে মাটি শেষ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর আরো বেশী জল, সার লাগছে।

(২) ব্যাপক নগরায়নের জন্যে চাষযোগ্য জমিও ক্রমহ্রাসমান।

(৩) অথচ লোক সংখ্যা বেড়েই চলেছে-যেখানে সবাইকে পেট পুরে খেতে দিতে হলে, এমনিতেই ভারতে খাদ্যাভাব থাকে। গুদামে গম পচার কথা না।

(৪) ভূর্গভস্থ জল কমে চলেছে। আর চাষে আরো বেশি করে জল লাগছে। ফলটা কি হবে? সেচের খরচ সাংঘাতিক! ফলে উৎপাদিত শষ্যের দাম বেশী হবেই!

এসব আমরা সবাই জানি! তাহলে ব্যাবস্থা নিচ্ছি না কেন?

(১) কেন ইস্রায়েল থেকে শিখছি না কি করে শুধু আদ্রতা রেখে চাষে জলের ব্যাবহার ৯০% কমানো যায়?
(২) কেন সেচে সোলার বিদ্যুত ব্যাবহার করা হচ্ছে না? এতে খরচ অনেক কমত।
(৩) সমবায় গড়ে তুলতে কোন পার্টির কোন আগ্রহ নাই।
(৪) খাদ্য সংরক্ষনের জন্যে সোলার চালিত আধুনিক হিমঘর কোথায়?
(৫) দেশের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য বিনপনের ও দুরাবস্থা। একটু বেশী উৎপাদন করলেই আলু ২ টাকা কিলোদরে রাস্তায় পচে! চাষিরাই বা নিজেদের আত্মহত্যার পথা কেন চওড়া করে খুলবে?

আসল ব্যাপারটা কি? গণতান্ত্রিক কোন কাঠামোতে ভোট নিয়ে ফোকাসটাই মুখ্য। টি-২০ গেম। জনগনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোন পরিকল্পনা নেই। খাবারের দামের যে বিষ্ফোরন হবে ভারতে বহুদিন থেকে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। আমি ত দুবছর আগে আমেরিকাতে প্রকাশিত প্রবন্ধের ভিত্তিতে এই নিয়ে লিখেও ছিলাম। গনতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের কথা শোনে নি কেন? আমার দেখলে হাঁসি পায় যেখানে রোগ এত গভীরে এই ইউ সি আই এই নিয়ে বন্ধ ডাকছে!

রুগী মুমুর্ষ। দরকার চিকিৎসা। প্রযুক্তি আর স্ট্রাটেজি। সেই নিয়ে কারুর হুঁস নেই। সবাই সবাইকে দোষারোপ করতেই ব্যাস্ত।

কেন এমন হয়? আমেরিকাতে ২০০৭ সালে খাবারের দাম বাড়তেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি গবেষনা শুরু করে-এবং তার ভিত্তিতে কিছু আসু পরিবর্তন ও আসে আমেরিকার কৃষিক্ষেত্রে। ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কি শুধু ডিগ্রি দেওয়ার জন্যে আছে? তারা কি আদৌ দেশের সমস্যাগুলো নিয়ে গবেষনা করে? সেসব না করলে চেতনাটাই বা আসবে কি করে?

সমাধানের আসল পথ হচ্ছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং গবেষনা। স্বাধীনতার ৬০ বছর বাদেও এই বোধটাই আমাদের জন্মালো না। শুধু খাদ্য আন্দোলনের রোমমন্থন-নইলে রাজনীতি।

এই ভাবে একবিংশ শতাব্দিতে কোন দেশ চালানো যায় না।

Thursday, December 10, 2009

কমিনিউজম নিয়ে ভুল ধারনার তথ্য তালিকা

কমিনিউজম নিয়ে কমিনিউস্ট এবং এন্টি-কমিনিউস্টদের ভুল ধারনা সর্ববিদিত। নানান ফোরামেই আমরা বাঙালী কমিনিউস্টদের দেখা পাব যাদের অধিকাংশের পড়াশোনা বেশ সীমিত। আবার যারা কমিনিউস্টদের গালাগাল দেন, তাদের লেখাপড়া আরো বেশী সীমাবদ্ধ। তাই বাঙালী কমিনিউস্ট এবং তার বিরোধিদের ভুল ধারনার একটা তথ্য তালিকা তৈরী করলাম। ভুল ধারনার জন্মসূত্র অবশ্যই কমিনিউজম নিয়ে বলশেভিকদের ভুল প্রচার। লেনিনিজম কত ভ্রান্ত, সেটা বুঝতে মার্ক্সের প্রতিটা লেখা বুঝতে হবে এবং তার সাথে ১৯০০-১৯৫০ সালের মধ্যে আমেরিকান এবং বৃটিশ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে লেনিনবাদ বনাম মার্ক্সবাদ নিয়ে যে বিস্তর গবেশণা হয়েছে, সেগুলি দেখা দরকার। সোভিয়েতের পতনের সাথে সাথে, রাশিয়ান ঐতিহাসিকরা স্বাধীনতা পেয়েছেন এবং আরো অনেক নথিপত্র তাদের হাতে এসেছে-যার ভিত্তিতে বলশেভিক বিপ্লবের ইতিহাস ও রাশিয়াতে নতুন করে লিখতে হচ্ছে। ১৯৫০ সালের পর এবং অধুনা কম্প্যুটার সিম্যুলেশনের উন্নতিতে স্যোশাল ফিল্ড থিওরী, সোশাল থার্মোডাইনামিক্স, ইত্যাদি নব নব সমাজবিজ্ঞানের গবেষনায় এবং গবেষনায় নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কারে, সামাজিক বিবর্তন আরো ভাল ভাবে বোঝার চেষ্টা চলছে। পরিশেষে ডারুইনিয়ান ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বলে সমাজ বিজ্ঞানে একটি নতুন শাখার জন্মে হয়েছে যা মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে উৎসাহী। এতকিছু লেখা একটা ব্লগে সম্ভব না। এই ব্লগ শুধু একটা সংক্ষিপ্ত সামারী।

(১) কমিনিউজম, মার্ক্সিজম, লেনিনিজম, সমাজতন্ত্র সব এক। বাস্তব হচ্ছে, এদের মধ্যে পার্থক্য- আপেল বলাম ওরেঞ্জ। কমিনিউজম বলতে আমরা মূলত লেনিনিস্ট কমিনিউজমকে বুঝি কিন্তু ধর্মীয় কমিনিউজমের অস্তিত্ব বিংশ শতকে বিস্তর ছিল। আমেরিকা আইন করে তাদের বন্ধ করে। নানান ধর্মীয় আন্দোলন মানুষকে কমিউন করে থাকতে উৎসাহিত করেছে। বাস্তবে এগুলি সবই ধণতন্ত্র যে ভাবে মানুষের মধ্যে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদকে প্রশয় দিয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদি আন্দোলন।

(২) বস্তুবাদি সমাজতন্ত্র বনাম আদর্শবাদি সমাজতন্ত্রঃ মার্ক্স যদিও এই ভাবেই ভাগ করতেন-আদতে মার্ক্সিস্ট সমাজতন্ত্রও সেই হিন্দু বা ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মতনই গাড্ডায় আছে। দায়ী লেনিন। মোটামুটি ১৮৭০ সাল থেকেই মার্ক্সবাদ আস্তে আস্তে বৈজ্ঞানিক পথ ছেড়ে, আদর্শবাদি পথে সরে আসতে থাকে। সেই পতন তরান্বিত করেন লেনিন।

(৩) মার্ক্সিজম এবং সমাজতন্ত্র এক, মার্ক্সিজম মানেই কমিনিউজম ঃ বিজ্ঞানে নিউটনিস্ট বা আইনস্টানিস্ট হয় না। দুর্ভাগ্য বশত মার্ক্সিজমে হয়! মার্ক্সিজম আদৌ কোন আদর্শবাদকে নির্দেশ করে না। এটি আদি সমাজ বিজ্ঞানের পদ্ধতি-বা ঐতিহাসিক বিবর্তনকে বস্তুবাদ দিয়ে বোঝার চেষ্টা। কমিনিউজম সমাজের বিবর্তনের শেষ ধাপ। বস্তুত এটাই সত্য মার্ক্স কোন আদর্শবাদের নির্দেশ দিয়ে যান নি-দিয়ে গেছেন একটা পদ্ধতি। সেটাকেই ইসলাম বা খ্রীষ্টানদের মতন আদর্শবাদি তত্ত্বে পরিণত করেন লেনিন।

(৪) মার্ক্সিজমই একমাত্র বলে সমাজ বিবর্তনের শেষ ধাপ কমিনিউজম। ঠিক না। সমাজ বিজ্ঞানের যাবতীয় উল্লেখযোগ্য তত্ত্বই বলে সমাজ বিবর্তনের শেষ ধাপ কমিনিউজম। তবে লেনিনের মতন মারধোর চোট্টামি করে না। সোশ্যাল থার্মডাইনামিক্স বলে একটা সাবজেক্ট আছে। সেখানে যেখা যায়, সব সিস্টেম ক্যাওস কমিয়ে ক্রিষ্টালাইজ করতে থাকে-এবং মোটামুটি এটা নিশ্চিত কমিনিউজম মানব বিবর্তনের শেষ ধাপ। তবে এই সব কমিনিউস্টদের বিপ্লব করে কমিনিউজম আনার রোম্যান্টিসিজম বেঢপ ঢপবাজি। এগুলোর সাথে মোল্লাদের বিশুদ্ধ ইসলামিক রাষ্ট্রের ধারনার কোন পার্থক্য নেই। সমাজের যেভাবে বিবর্তন হচ্ছে, যেভাবে প্রযুক্তি এগোবে, তাতে স্যোশালিজম থেকে কমিনিউজম এমনিতেই আসবে।

বর্তমান পৃথিবীকে একটা আনস্টেবল স্টেট ধরা যেতে পারে-যখন জল থেকে বরফ হচ্ছে-কিছু কিছু বরফ খন্ড-তার মধ্যে মধ্যে জল। বরফ গুলোকে ধরা যেতে পারে স্টেট। তারপরে সেই স্টেট গুলো একসাথে জমাট বেঁধে সব বরফ হল-মানে রাষ্ট্রের পতন হল। পৃথিবীর যে সমস্যাগুলোর সমাধান না করলে, আমরা সবাই মারা যাব বা প্রযুক্তি লুপ্তহবে-তা একা কোন রাষ্ট্রের পক্ষে করা আর সম্ভব হচ্ছে না। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বেশ দ্রুত লুপ্ত হবে।

যেটা আমাদের কমি বন্ধুরা বুঝতে চাইছে না-একদেশে কমিনিউজম বা সমাজতন্ত্রও করা সম্ভব না। সামান্য তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলেই বোঝা যায়।
বিপ্লব করেও কমিনিউজম আসবে না। কমিনিউজম আসবে শুধু মাত্র উন্নত, আরো অনেক অনেক উন্নত উৎপাদন শীল সমাজের মধ্যে দিয়ে। এই ধরনের নিম্ন উৎপাদনশীল সমাজে কমিনিউস্ট বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা ব্যার্থ ত হবেই-শুধু শুধু অসংখ্য লোক মারা যাবে। অধিকতর উন্নত উৎপাদন শীলতার ডিমান্ডই উৎপাদনের ওপর শ্রমিকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করবে-যা সফটঅয়ার বা অত্যাধুনিক টেলিকম বা বায়োটেক শিল্পে আস্তে আস্তে আসছে। এগুলো জ়োর করে লাঠি মেরে করতে গেলে, হিতে বিপরীত হবে। যা এদ্দিনে হয়েছে।

(৫) মার্ক্সই প্রথম শোষন এবং ধনের অসাম্যের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রের কথা বলেন-ডাঁহা ভুল। সব ধর্মীয় আন্দোলনই ( ক্রীষ্ঠান, ইসলাম, বৈষ্ণব) একধরনের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন -শোষন এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে। সেকালে বস্তুবাদ জানাছিল না। তাই ধনের অসাম্যের বিরুদ্ধে সব ধর্মীয় আন্দোলনই সোচ্চার হয়েছে। এই লেখাটা দেখা যেতে পারে।


(৬) মার্ক্সবাদ এবং লেনিনবাদ এক-লেনিনবাদ মার্ক্সবাদের এক্সটেনশনঃ এটাও মস্ত ভুল বহুদিন ধরে বলশেভিকরা রটিয়ে আসছে। বাস্তব হচ্ছে লেনিনই মার্ক্সবাদের সর্বাধিক ক্ষতি করেছেন। বুঝে এবং না বুঝে। এই নিয়ে অনেক লেখা আছে। লেনিনের কাছে মার্ক্সের মুস্টিমেয় লেখা ছিল।কারন সেযুগে মার্ক্সের লেখা সহজলভ্য ছিল না। লেনিনঞ্ছিলেন জার্মানীতে-সেখানেও মার্ক্সের সব লেখা পাওয়া যেত না।
দ্বান্দিক বস্তুবাদের টেকনিকগুলো একটু রপ্ত করলেই দেখা যাবে, মার্ক্সের লেখায় ডায়ালেক্টিক্স প্রচুর-লেনিনের লেখায় তা অনুপস্থিত। এই সব কারনে মার্ক্স কমিনিউজম এবং কমিনিউস্ট বলতে ঠিক যা যা বলতে চেয়েছিলেন-তার সবটাই লেনিন ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।

লেনিনিজম মার্ক্সিজম থেকে সম্পূর্ন আলাদা। ইসলামি সমাজতন্ত্রের সাথে মার্ক্সিজমের যতটা যোগসুত্র-লেনিনিজমের সাথে মার্ক্সিজমের যোগ ঠিক ততটাই। প্রায় অনেক গুরুত্বপূর্ন বিষয়-আন্তর্জাতিকতা, জাতীয়তাবাদ, পুঁজির বিবর্তন-ইত্যাদি নিয়ে মার্ক্স এবং লেনিনের ধারনা ১৮০ ডিগ্রি বিরোধি।

(৬) ১৯১৭ সালে রাশিয়াতে অক্টবর বিপ্লব সাধিত হয়! সত্য আসলে এটাই, নির্বাচনে সমাজতন্ত্রীদের কাছে হেরে, লেনিনের দলবল রেড আর্মি দিয়ে বিরোধিদের মেরে ধরে কনস্টিটুয়েন্ট এসেম্বলী ভেঙে দেন এবং এক দলীয় শাসন চালু করেন। শুধ তাই নয় এটাও রটানো হয়, রাশিয়া ছিল সেই সময় অনুন্নত কৃষিপ্রধান দেশ। বাস্তবে শিপ্লু উৎপাদনে সেই সময় রাশিয়া ছিল পঞ্চম-এবং দ্রুতহারে বাকি ইউরোপের সাথে তাল মিলিয়ে সেখানে শিল্পোন্নয়ন হচ্ছিল। বলশেভিকদের বেসও ছিল শ্রমিকদের মধ্যে, কৃষকদের মধ্যে না। বেসিক্যালি ওটা ছিল গনতন্ত্র ধ্বংশ করার বিপ্লব।

(৭) কমিনিউজমে সবাই খেতে পাবে-লক্ক্যনীয়-এখানে কমিনিজম বলতে আমি জোর করে চাপানো লেনিনিজম বলছি-যা ফ্যাসিজমের আরেকটা ভ্যারিয়েশন। বাস্তব এটাই পৃথিবীর সব থেকে বড় দুর্ভিক্ষ গুলি, লেনিনিস্ট কমিনিউস্ট জমানাগুলোতেই হয়েছে

(৮) কমিনিজম এলে সবাই শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা পাবে। এটা ঠিক। কিন্ত সেই সুরক্ষা মুসলোলিনীর ইটালি বা হিটলার ও দিত। আরো ভাল ভাবেই দিত। যেকোন ফ্যাসিস্ট এবং আইডিওলজ্যিক্যাল অটোক্রাটিক শাসকরা ( আদর্শবাদি স্বৈরাচারিরা- সবার কথা-আদিল আমিন বা এরশাদের কথা বলছি না) শিক্ষা ক্ষেত্রে সব থেকে ভাল কাজ করে। যেমন এখন ইরান করেছে। এর সাথে কমিনিউজমের যোগ নেই-ন্যাশানাল সোশ্যালিস্টরা [ এবং তাদের ভ্যারিয়ান্টরা ] সবাই এই কাজে সফল হয়েছে। কিন্ত ব্যাক্তি স্বাধীনতা বর্জন করে-এই ধরনের উন্নতি কাম্য না। জাপান বা যেকোন স্ক্যন্ডেনেভিয়ান দেশই ১০০% সাক্ষর বা শিক্ষার মান ওখানেও অনেক উঁচু-তাদের এই ধরনের স্বৈরাচারের সাহায্য নিতে হয় নি কিন্ত।

(৯) কমিনিউজম মানে অগনতান্ত্রিক স্বৈরাচার।

সঠিক বাক্য হবে লেনিনিজম মানে অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচার।

মার্ক্স কমিনিউজিম এর ব্যাখ্যায়, ডিক্টেটর অব প্রলেতারিয়েত মানে এক দলীয় শাসন হবে-গণতন্ত্র ধ্বংশ করতে হবে-বিরোধিদের শুলে চড়াতে হবে-এটা কোথাও বলেন নি।

ক্ষমতা দখলের জন্যে স্বৈরাচারী কমিনিউজমের সম্পূর্ন দায়ভার লেনিনের। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ঢপবাজিও আর এক দলীয় স্বৈরতন্ত্র ও তার নিজস্ব আবিস্কার। বস্তুত মার্ক্সবাদ নামক দুধে যত জল ঢালা আছে, তার সব জলই এই মহান তাত্ত্বিক ধাপ্পাবাজটির।

(১০) পুজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ-এটি লেনিনিজম। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে মার্ক্স কখনো সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে দেখেন নি-দেখেছেন সমাজ বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ন ধাপ হিসাবে যাতে আন্তর্জাতিকতার শুরু হতে পারে। সাম্রাজ্যবাদ এই জন্যেই ধাপ্পাবাজি যে রাষ্ট্রের উৎপত্তির মধ্যেই এর বীজ রয়েছে-এবং আন্তর্জাতিকতা না এলে তা যাবে না-এবং সেই আন্তর্জাতিকতার আগমনের জন্যে আন্তর্জাতিক বানিজ্য হচ্ছে সর্বাধিক গুরত্বপূর্ন ক্যাটালিস্ট-যার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল দেশের শ্রমজীবি মানুষ একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাবে-কারন রাষ্ট্রের বাউন্ডারী শিথিল হবে।
সেখানে লেনিনের তত্ত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক বানিজ্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ । আর আন্তর্জাতিকতা হচ্ছে- সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল শ্রমজীবি মানুষ একত্রিত হও! এটা হচ্ছে লেনিনিস্ট আন্তর্জাতিকতা-যা ঘোড়ার গু এবং গরুর গবর ছাড়া কিছু না। কেন না, রাষ্ট্রের সীমানা শিথিল না হলে, সমস্ত দেশের শ্রমজীবি মানুষ একত্রিত হতে পারে না-এসব তাত্বিক কল্পনা প্রসূত শ্লোগান। আন্তর্জাতিকতা নিয়ে মার্ক্সীয় ভাবনায় জল কম-কারন তা আমদের চোখের সামনে দেখছি-একবিংশ শতাব্দিতে। কিন্ত লেনিনিস্ট আন্তর্জাতিকতা-"সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক"- কোলকাতার লেনিন সরনির ব
দ্ধ নর্দমার জল।

(১১) কমিনিউস্ট বিপ্লব এলেই নারী মুক্তি আসবে-নারী পুরুষ সমান হবেঃ

কমিনিউস্টরা দাবি করে, একমাত্র সমাজতন্ত্রের পথেই নারী মুক্তি সম্ভব-ধনতন্ত্রে তা সম্ভব না। বুর্জোয়া ফেমিনিজম শ্রেনী দ্বন্দের বিকৃত রূপ।

এবার আসুন আমরা আমাদের কমি বন্ধুদের ইতিহাস থেকে কিছু প্রশ্ন করিঃ

(১) কমিনিউজমের ইতিহাসে কোন দেশে-কোন কালে কোন মহিলা কি জেনারেল সেক্রেটারী হতে পেরেছেন?
(২) কমিনিউমের ইতিহাসে কোন গঠিত পলিটবুরোতে-কোন দিন কি পাঁচ জন মহিলা ( পলিটবুরোর ৩০%) থাকতে পেরেছেন ? ( ভারতের পলিটবুরোতে একমাত্র বৃন্দা কারাত আছেন। তাও তাকে রাখা হয়েছিল না। পলিটবুরোতে কেন মহিলা নেই, সেই নিয়ে তিনি কান্নাকাটি শুরু করলে তাকে শান্তনা পুরস্কার দেওয়া হয়)।
(৩) কমিনিউমের ইতিহাসে কোন সেন্ট্রাল কমিটিতে কোনদিন কি ২৫% এর বেশী মহিলা মেম্বার ছিল?

বন্ধুগন-সোভিয়েত, চিন, ভারত, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, কিউবা-সর্বত্র এই প্রশ্ন গুলি খুঁজতে থাকুন। দেখবেন-কমিনিউজম আসলেই পুরুষতন্ত্রের বস্তুবাদি রূপ। গোল্ডবার্গ তার বইতে ( Why Men Rule)যে লিখেছিলেন-যে রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরকালই পুরুষের হাতে ছিল-কমিনিউজমে তার ব্যাতিক্রম হয় নি।


উপসংহারে কিছু বলা উচিত। কমিনিউস্ট এবং কমিনিউস্ট বিরোধিরা আসলেই না বুঝে একটা ভুল রাজ়নৈতিক দিশা দিচ্ছেন জনগনকে। জনগন বাঁচতে চাইছে-চাইছে তাদের সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। সেটা বাজার অর্থনীতি বা কমিনিউস্ট বিপ্লব দিয়ে হবে না -তা আমরা অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছি। বাজার অর্থনীতি যাও বা কিছুটা সফল-কমিনিউস্ট বিপ্লব সর্বত ভাবেই ব্যার্থ। দরকার নতুন রাজনৈতিক পথের। যা উৎপাদন ব্যাবস্থাকে আরো বেশী মজবুত করবে। এবং তা সম্ভব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি বিনিয়োগ অনেক অনেক বেশী বৃদ্ধি করে।