Saturday, August 18, 2012

জৈন ধর্ম- ভারতীয় নাস্তিক দর্শনে অহিংসার সন্ধানে



 নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ধর্ম শব্দটা উচ্চারন করলে, যেকোন যুক্তিবাদি বা পর্যবেক্ষকের বা সাধারন লোকের কাছে যে চিত্রটা উঠে আসে-তা হচ্ছে প্রতিটা ধর্মেই ধর্মগ্রন্থ, ধর্মপ্রতিষ্ঠাতা, আচার বা রিচ্যুয়াল এবং পার্থনাগৃহের সন্ধান পাওয়া যাবে। জৈন ধর্মকে ওপর থেকে দেখলে, অন্য পাঁচটি ধর্ম থেকে আলাদা করা মুশকিল-বিশেষত যেহেতু জৈনরা খাদ্য, উপবাস এবং আচার আচরনের ওপর অনেক কঠিন বিধি নিষেধ আরোপ করে। কিন্ত জৈন গ্রন্থে ও ইতিহাসে ঢুকে যে জৈন দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়, তাতে এমন  এক ধর্মর ঠিকানা আছে,  যার উৎপত্তি, মূল দর্শন এবং লক্ষ্য অন্য ধর্ম থেকে বিশেষ ভাবে আলাদা, আদি এবং অকৃত্রিম।

                  ঈশ্বরের অবিশ্বাসী বা নাস্তিকতা থেকে প্রাচীন ভারতে যে কটি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে, তার মধ্যে জৈন ধর্মেই এথেইজিমের ( নাস্তিকতা শব্দটা এখানে ব্যাবহার করা যাবে না কারন এথেইজম শব্দটি নাস্তিকতার সুপারসেট বা অনেক ব্যাপৃত অর্থে ব্যাবহৃত) চূড়ান্ত বিকাশ বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত।  জৈন ধর্মই আমার জানা একমাত্র ধর্ম, যা এথেইজিম বা নাস্তিকতার  প্রথম প্রতিপাদ্য মেনে চলে। এই প্রথম প্রতিপাদ্য হচ্ছে পরম সত্যের ( এবসল্যুটিজম) অস্ত্বিত্ব নেই এবং সেই জন্যেই বহুত্ববাদই ( জৈন পরিভাষায় বহুকান্তবাদি) একমাত্র গ্রহনীয়। জৈন দর্শনের শুরুই হচ্ছে  সেই পরম সত্যের অনস্তিত্ব থেকে এবং বলা হচ্ছে বাস্তববে সব সত্যই আপেক্ষিক এবং একই বাস্তবতাকে নানান আপাত সত্যদিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বস্তুত পোষ্ট মর্ডানিজমের এই মূল সূত্রগুলি জৈন ধর্মে তথা ভারতে বহুকাল থেকেই ছিল। পাশ্চাত্য দর্শন বিংশ শতাব্দিতে যে উপলদ্ধি এবং সিদ্ধান্তে এসেছে, আদিম ভারতের নাস্তিক্য দর্শনে তার প্রায় সবটাই পাওয়া যাবে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে ঈশ্বরভিত্তিক ধর্মের অত্যাচারে ভার‍তীয় নাস্তিক্য দর্শনের অনেকটাই লোপাট-তবুও যেটুকু টিকে আছে, তার অধিকাংশই পাওয়া যাবে জৈন ধর্মের মধ্যে।

 পৃথিবীতে জৈন ধর্ম বাদ দিয়ে সব ধর্মই ঈশ্বর, আল্লা, কৃষ্ণ বা কোন না কোন ( যেমন বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে ঈশ্বর না থাকলেও দুঃখ এবং দুর্দশার চার পরম সত্য আছে)  পরম সত্যর ওপর দাঁড়িয়ে যা সেই ধর্মগুলির সেন্ট্রাল ক্যানন বা কেন্দ্রীয় আইনের কাজ করে।  এর কারন হচ্ছে, সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে-সব ধর্মর জন্ম হয়েছে কোন না কোন ঐতিহাসিক সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনে যার সেলফ অর্গানাইজেশন বা বিপ্লবের সংগঠনের জন্যে এই ধরনের পরম সত্যর ধারনা লোকেদের মধ্যে ঢোকাতে হত।  এই স্থানেই জৈন ধর্ম আলাদা। কোন ধর্ম ঠিক ঠাক বুঝতে গেলে, সব থেকে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে সেই ধর্মের উৎপত্তিকে বোঝা-সমসাময়িক ইতিহাসকে বোঝা।  এটা বুঝলে বোঝা যাবে জৈন ধর্ম কেন আলাদা।
কেন আলাদা, সেটা ভারতের ইতিহাস থেকে বোঝা সম্ভব।  আমাদের ইতিহাসে পড়ানো হত জৈন ধর্ম ভারতে ব্রাহ্মন্যবাদের প্রতিবাদে সংগঠিত সানাজিক বিপ্লব যা মহাভীর দ্বারা স্থাপিত।  আমিও জৈনধর্ম নিয়ে ওপর ওপর জেনে এটাই মনে করতাম। এটা সম্পূর্ন ভুল। জৈন ধর্মের ইতিহাস সব থেকে বেশি ইন্টারেস্টিং, অজ্ঞাত এবং অন্য ধর্ম থেকে সম্পূর্ন আলাদা।  জৈনধর্মে ২৪ জন তীর্থঙ্কর বা গুরুর সন্ধান আছে বটে-কিন্ত বুদ্ধ বা মহম্মদ এর ন্যায় এরা কেওই ধর্মএর প্রতিষ্ঠাতা নন। এরা ছিলেন ধর্মের সংকলক এবং আদর্শ অনুসারী যাদের আচরন দেখে জৈনরা নিজেদের দর্শন ঠিক করে। ২৩ তম তীর্থঙ্কর বা পর্শভা প্রথম ঐতিহাসিক জৈন ধর্মগুরু যার সময়কাল ৮শ খৃষ্টপূর্বাব্দ।  কিন্ত হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর খনন কার্য্য থেকে যে আদি ভারতীয় ধর্ম উঠে আসে, তা সম্পূর্ন অষ্ঠাঙ্গিক যোগ নির্ভর ছিল। ঐতিহাসিক হেনরি মিলার এবং জন মার্শাল মহেঞ্জোদারোর যোগী মূর্তিগুলির ওপর গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এগুলি জৈন ধর্মের কায়সর্গর ( একটি বিশেষ যোগভংগী যা জৈনরা অনুসরণ করে) পূর্বসূরী। একাধিক ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তে এসেছন এই ব্যাপারে।  মহেঞ্জোদারো সভ্যতার ধর্ম জৈন ধর্মের আদিরূপ। এবং হরপ্পা মহেঞ্জাদারোর ধর্মই আজ অব্দি টিকে গেছে জৈন ধর্মের মধ্যে দিয়ে।
       এবং জৈনরাও সেটাই বিশ্বাস করে যে তাদের ধর্ম সম্পূর্ন “ন্যাচারিলিস্টিক ধর্ম” যা মানব বিবর্তনের পথে প্রথম ধর্ম  বা মানুষের আদি ধর্ম। ঐতিহাসিক এবং সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই ধারনার যথেষ্ট ভিত্তি আছে। এর কারন জৈন ধর্মের মূল নীতিগুলি কোন বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে জড়িত না যা অন্য সব ধর্মের জন্যেই সত্য। যেমন ভাগবত গীতার জন্ম মহাভারতের যুদ্ধ-কোরানের জন্মে মহম্মদের ইতিহাসের সাথে সম্পূর্ন ভাবে যুক্ত।  জৈন দর্শন কি সে ব্যাপারে পরে আসছি-তার আগে এটা বোঝা যাক যে কি ভাবে হোমো ইরেক্টাস থেকে হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাবের সাথে সাথে “সামাজিক রিচ্যুয়াল বা আচার আচরনের জন্ম হয়েছে ( রিচ্যুয়াল অবশ্য হোমিনিড দের অন্যান্য স্পেসিসদের মধ্যেও ছিল যারা হোমোস্যাপিয়েন্সের সমসাময়িক ভাবে পৃথিবীতে কিছুদিন ছিল)।  হোমো স্যাপিয়েন্সদের গত ২০০,০০০ বছরের ইতিহাস বিতর্কিত এবং অষ্পষ্ট।  তবে যেসব ব্যাপারে একমত হওয়া যেতে পারি আমরাঃ
    [১] হোমো স্যাপিয়েন্সদয়ের আবির্ভাবের সাথে সাথে সামাজিক তথা গোষ্ঠি আচরন সুস্পষ্ট রূপ নেয় ৭০,০০০ বছর আগে থেকে।
    [২] হোমো স্যাপিয়েন্সরা পৃথিবীর যেখানেই গেছে, ১০,০০০ বছরের মধ্যে সেই স্থানে বন এবং ৯০% প্রানীকূল ধ্বংশ করেছে-কারন এরা ছিল সব থেকে কৌশলী শিকারি
   [৩]  এদের মধ্যে আদিতে আচারের অস্তিত্ব ছিল-কিন্ত কোন গুহাচিত্রেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। অর্থাৎ এদের আদি আচারন-যা ধর্মের মতন একটা গোষ্ঠি মানতে বাধ্যছিল-তা একধরনের নাস্তিক ধর্ম হতে বাধ্য। কারন হোমো স্যাপিয়েন্স দের গুহাচিত্রে পশুপাখী ব্যাতিত আর কোন ঈশ্বর জাতীয় এবস্ট্রাকশ্ নের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং ভারতে তথা গোটা পৃথিবীতেই ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মের পূর্বসূরী ছিল নাস্তিকতা বা ঈশ্বর বর্জিত সম্পূর্ন একধরনের দর্শন নির্ভর ধর্ম যা প্রকৃতি, প্রানী এবং পরিবেশের সার্বিক মঙ্গলকামনা থেকে উদ্ভুত। কারন এমনটা না করলে সেকালে সীমিত খাদ্য এবং প্রানীকূলের ধ্বংশ, মানব সভ্যতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করত। বিবর্তনের প্রয়োজনে মানব সভ্যতায় জৈন ধর্মের মতন নাস্তিক অথচ অহিংস এবং ত্যাগী ( বা ব্রতবদ্ধ-অর্থাৎ মানব ও প্রাণীকূলের স্বার্থ রক্ষায় আমি এই এই কাজ করব না) ধর্মের উৎপত্তি ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মের অনেক আগে আসার কথা। এবং জৈন ধর্মের মধ্যে আমরা সেটাই দেখি।
আমার উপোরোক্ত ধারনা আরো বদ্ধমূল এই জন্যে যে গোটা জৈন ধর্মে ঈশ্বর কি, তিনি আছেন কি নেই এসবের কোন অস্তিত্ব নেই। ফলে নেই কোন স্রষ্ট্রার ধারনাও। যেখানে বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধ বারংবার ঈশ্বর আছেন কি নেই-এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন এবং তার উত্তর ছিল ঈশ্বর অপ্রাঙ্গিক হাইপোথিসিস। কিন্ত জৈন ধর্ম নিয়ে পড়লেই বোঝা যায় এই ধর্মের উৎপত্তি প্রাক-ঈশ্বর  যুগে -যখন,  বিবর্তনের পথে ঈশ্বর মানবসভ্যতায় অজ্ঞাত।   এবং মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্যে, সভ্য মানুষের প্রতিষ্ঠার জন্যে এদের ধাপগুলি অসম্ভব যৌত্বিক ।  তা বিশ্বাসের ওপর না বরং দার্শনিক যুক্তি ও তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত।  এই ধর্মের প্রধান উপপাদ্য- মানুষের প্রকৃতি-অর্থাৎ মানুষকে, নিজেকে জানা এবং নিজের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ককে জানা।  এবং এই মহাবিশ্বে ও বাস্তবতায় আমাদের অবস্থান থেকে, সবার মঙ্গল কামনায় কিছু আচার আচরনের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা।   
অনেকেরই ধারনা ঈশ্বর তথা ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস নৈতিকতার মূল উৎস। নাস্তিকতা মানে নৈতিকতা উচ্ছন্নে যাবে।  এই ধারনা ভাঙার সব থেকে ভাল উপায় জৈন ধর্ম অধ্যয়ন-এটি সম্পূর্ন ঈশ্বর এবং পরম সত্য বর্জিত দর্শন । এই দুইকে বর্জন করেই ( কারন তখনও বিবর্তনের পথে আজকের ঈশ্বর এবং ধর্মগুলি আসে নি) জৈন ধর্মে অত্যন্ত যুক্তিবাদি একটি নৈতিক দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে যা মানবিকতা, সততা এবং প্রেমে অন্য ধর্মগুলির অনেক ওপরেই থাকবে।  এবং যদি ধর্মে অমানবিকতা, অত্যাচারের ইতিহাস দেখা যায়, তাহলে একমাত্র জৈন ধর্মই সেই দাবি করতে পারে যে তাদের ধর্মের ইতিহাস কখনোই হিংসায় রাঙা হয় নি। কোন রক্তপাত ঘটে নি। নৈতিকতার ঐতিহাসিক, বাস্তব এবং তাত্বিক মানদন্ডে এই নাস্তিক পরম সত্য বর্জিত ধর্ম তুলনাহীন। অন্য ধর্মের ইতিহাস যেখানে ক্ষমতা এবং ধর্মীয় আধিপত্যবাদের রঙে রাঙা-জৈন ধর্মের ইতিহাস ত্যাগের উদাহরণে সমুজ্জ্বল।  যারা ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মকে নৈতিকতার উৎস বলে মনে করেন, তাদের ভুল ভাঙার প্রকৃষ্ট উপায় জৈন ধর্ম।  
এবার আমি সংক্ষেপে জৈন ধর্মের মূল জীবন দর্শন আমার নিজের উপলদ্ধি থেকেই ব্যাখ্যা করব।
 জৈন ধর্মের চারটি স্তম্ভ। অর্থাৎ জৈন ধর্মের অনুসারীরা এই চারটি মূল জীবন দর্শনকে জৈন আচরনের ভিত্তি বলে জানেনঃ
অহিংসাঃ  জৈন ধর্মের মূল নীতি অহিংসা। কাওকে কোন ভাবে দৈহিক বা মানসিক ভাবে আঘাত করা যাবে না।  এবং তা পশুপাখী উদ্ভিদ সবার ওপরই ।  নিজে বাঁচার জন্যে অন্যের মৃত্যু, অন্য প্রাণের মৃত্যু-এই ধর্মে স্বীকৃত না।  হিন্দু এবং ইসলামের সাথে এখানেই জৈন ধর্মের বিরাট পার্থক্য। অনেকে প্রশ্ন করবেন, তাহলে আত্মরক্ষার জন্যে হিংসা কেন স্বীকৃত না?  এর মূলকারন জৈন ধর্মে মানুষকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করে দেখা হয় না। সে প্রকৃতির অংশ। তার মৃত্যু-জীবনের পরম নিয়তি, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া  এবং সেই পরম নিয়তিকে দুদিন দূরে পাঠানোর জন্যে হিংসার কোন জাস্টিফিকেশন নেই।  বরং অহিংসার জন্যে নিজের প্রাণত্যাগ সমাজের পক্ষে অনেক বেশী মঙ্গলকর।
এই নীতির অবাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ হতেই পারে। কিন্ত বাস্তবত এটাই যে হিন্দু, খ্রীষ্ঠান বা মুসলমানরা মানব সভ্যতাকে এই ধর্ম যুদ্ধ, ক্রসেড বা জিহাদে নামে এক সম্পূর্ন অমানবিক এবং অস্থিতিশীল রাজনীতির জন্ম দিয়েছেন। আজকের সভ্যতা অনেকটাই বৃটিশ ইউলেটেইয়ান দার্শনিকগণের অবদান কারন আমাদের সভ্য আইনগুলি সেখান থেকেই এসেছে যা ধর্মীয় আইন থেকে মানুষকে অনেকটাই মুক্ত করেছে।  ইউলেটেরিয়ান আইনগুলির সাথে জৈন ধর্মের অনেক মিল আছে।
 সততাঃ
  জৈন ধর্মের দ্বিতীয় পিলার সততা। জৈন মতে একজন পুত্র যেমন মাকে বিশ্বাস করতে পারে,  মানুষের সততা সেই পর্যায়ের হওয়া উচিৎ যাতে তোমাকে সবাই মায়ের মতন বিশ্বাস করবে। আর যদি সততার জন্যে হিংসার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে, জৈন নীতি অনুযায়ী নির্বাক থাকায় শ্রেয়।
 লোক ঠকানো যাবে নাঃ
       জৈন ধর্মের নির্দেশ ঃ
                  ১। কারুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে শোষণ করা যাবে না-কারুর আর্থিক বা অন্য দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা, চুরির সমান
                  ২.  কেও স্বেচ্ছায় দিলেই-তবেই তা গ্রহণ করবে। বলপূর্বক বা ছলপূর্বক কিছু নেওয়া নিশিদ্ধ। এখানে হিন্দু বা ইসলামের সাথে বিরাট পার্থক্য। এই দুই ধর্মেই ধর্মের জন্যে বল বা ছল প্রয়োগ স্বীকৃত।
                  ৩। কারুর ভুলের, অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে, লাভ করা যাবে না।
                  ৪. চুরি করা বস্তু বা যে লাভ অনৈতিক কাজ থেকে আগত, তা গ্রহণযোগ্য না।
     ভারতে পার্শীদের ছারা জৈনরাই সব থেকে বড় ব্যাবসায়ী। এর মূল কারন এই নীতিগুলির জন্যে জৈন ব্যাবসায়ীরা সব থেকে বেশী বিশ্বাসযোগ্য। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা, সফল সৎ ব্যাবসায়ী হওয়ার প্রথম ধাপ।


ব্রহ্মচৈর্য্যঃ
জৈন ধর্মে স্ত্রী ছারা আর কারুর সাথে সহবাস স্বীকৃত না।  তবে জৈন ধর্মের মূলনীতি এক্ষেত্রে হচ্ছে, যা কিছু নেশার বস্তু, যা কিছু আসক্তির জন্ম দেয়, তার সব কিছুই পরিত্যাগ করতে হবে। আসক্তি থেকে মুক্তি, তা মদ্যপান থেকে ভাল খাবার অনেক কিছুই হতে পারে –তা পরম কাম্য। ফলে এই ধর্মে মদ্যপান, নেশাভাং সম্পূর্ন নিশিদ্ধ।

অপরিগ্রহঃ
  বিষয় সম্পত্তি, অর্থ, গৃহ, গাড়ী-বাড়ি, পোশাক-ইত্যাদির ওপর আমিত্ব কমাতে হবে।  আমার সম্পত্তি, আমার বাড়ি, আমার লেখা, আমার কৃতিত্ব-ইত্যাদি বিজাতীয় বন্ধন এবং  আসক্তি ভ্রুম-এই ধরনের ভুল ধারনা মানুষের অহঙ্কার বাড়ায় এবং বিপথে পরিচালিত করে। আজ যে সম্পত্তি আছে, কাল নাও থাকতে পারে।  সুতরাং এই সব কিছুর ওপর থেকে নিজের স্বামীত্ব বা অধিকারিত্বসুলভ মনোভাব থেকে মুক্তি পেতে হবে। সম্পত্তি থাকা অন্যায় না-কিন্ত সম্পত্তির ওপর আসক্তি একধরনের মানসিক ভ্রুম।

 এবার আসব জৈন ধর্মে পুনঃজন্ম এবং আত্মার অস্তিত্ব প্রসঙ্গে। এগুলি জৈন ধর্মের  ভিত্তি কারন আদর্শ জৈন আচরনের মূল লক্ষ্য মোক্ষ। যাতে আর আবার জন্মাতে না হয়।  এবং যেহেতু যুক্তিবাদি সমাজে এগুলি গ্রহণযোগ্য জ্ঞান না সেহেতু ঐতিহাসিক, সামাজিক দৃষ্টিতে আমরা জানব বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মে এই পুনঃজন্ম এবং আত্মা নামক দার্শনিক বস্তুটির উৎপত্তিস্থল কি?
হোমো স্যাপিয়েন্স দের আদিম গুহাচিত্র ও ফসিল থেকে এটা পরিস্কার, যে মৃত্যুর জন্যে বা মৃতকে সমাধিস্থ করার জন্যে আচার আচরনের মূলভিত্তি এই মানব বিশ্বাস যে মৃত্যুর পর জীবন আছে। মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস-মানব সভ্যতায় ঈশ্বরের জন্মের আগে এসেছে। স্বর্গের সাথে যেহেতু ঈশ্বরের ধারনা সংপৃক্ত,এটা অনুমান করা শক্ত না, যে ঈশ্বরের ধারনার জন্মের আগে,  হোমো স্যাপিয়েন্সরা যেসব রিচুয়াল করত, তার উদ্দেশ্য ছিল পরের জন্ম বা পুঃনজন্ম। স্বর্গলাভ না।  কারন ঈশ্বরের ধারনা যেহেতু তাদের মধ্যে ছিল না-স্বর্গের ধারনাও থাকতে পারে না। সুতরাং প্রাক-ঈশ্বর পর্বে ধর্ম ও রিচ্যুয়ালের ভিত্তিই ছিল পুঃনজন্মে বিশ্বাস। জৈন ধর্মের মতন প্রাক ঐশ্বরিক ধর্ম -তাই পুনঃজন্মের ধারনার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এবং বৌদ্ধ ধর্ম মূলত জৈন ধর্ম থেকেই এই ধারনাটি গ্রহণ করে।

কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে হোমো স্যাপিয়েন্স দের আচরনে কেনই বা মৃত্যুর পর বাঁচার বিশ্বাসের জন্ম নিল? মনে রাখতে হবে  বিবর্তনের পথে, মানব সভ্যতায় সব বিশ্বাসের আগমন হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার সারভাইভাল স্ট্রাটেজিকে উন্নত করতে।  জীবনের উদ্দেশ্য যেহেতু বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদ দিয়ে বার করা সম্ভব না এবং এটি একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন- সেহেতু এটা অনুমান করা যায় যে শুধু একজন্মে বিশ্বাস মানুষের মনে হতাশার এবং উদ্দেশ্যহীনতার জন্ম দিতে সক্ষম। যা থেকে মানুষ উদ্দেশ্যহীনতায় ভুগে ভোগবাদি আসক্তিতে ডুবে যেতে পারত যা তৎকালীন সমাজের সারভাইভালের জন্যে কাম্য ছিল না।  যা আধুনিক সমাজের স্থিতিশীলতার জন্যেও কাম্য না।  সুতরাং জৈন ধর্ম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, এই ধরনের বিশ্বাস হোমোস্যাপিয়েন্সদয়ের মধ্যে আরো স্থিতিশীল সমাজের জন্ম দিচ্ছিল-তাই এই পুনঃজন্মে বিশ্বাসটিকে কেন্দ্রকরেই প্রথম সামাজিক নৈতিকতা এবং ধর্মীয় আচার আচরনের জন্ম হয়।

          সেকালে যেখানে ধর্মের উদ্দেশ্যই ছিল মানব সমাজে শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা,  এটা বোঝা শক্ত না, ঈশ্বরপূর্ব যুগে, যখন ঈশ্বরের রক্তচক্ষু এবং পাপের জন্ম হয় নি, পুনঃজন্মের আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নৈতিকতার ভিত স্থাপন করা ছিল একমাত্র পথ। সেটাই জৈন ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম করে থাকে।
       এবার আত্মার প্রশ্নে আশা যাক। পুনঃজন্ম মানেই একটা আত্মার ধারনাকে স্বীকার করে নিতে হয়, যা বার বার জন্মাচ্ছে। এটাও আসছে সেই আগের কারনটা থেকেই।  এগুলি অবিচ্ছেদ্দ্য ধারনা।
জৈন ধর্ম নিয়ে, আরো বেশী কিছু লিখতে পারলে, ভাল লাগত। কিন্ত যেটুকু নিজের দৃষ্টিতে বুঝেছি, সেটুকুই লিখলাম। এই জন্যেই লিখলাম, যে জৈন ধর্মকে বোঝার মাধ্যমে প্রাক-ঐশ্বরিক ধর্মকে বোঝা সম্ভব। ধর্মের বিবর্তন বোঝা সম্ভব। ঈশ্বরের জন্মের আগে যে ধর্মর অস্তিত্ব ছিল সেটা বোঝা যায়। এবং সে নাস্তিক ধর্মদর্শন যে ঈশ্বরভিত্তিক ধর্মর থেকে উন্নত ছিল, সেটাও আমরা দেখছি।  জৈন ধর্ম মানব সভ্যতার সম্ভবত আদি্মতম এবং আধুনিকতম ধর্ম যার দর্শন সম্পূর্ন ভাবেই ঈশ্বর বর্জিত, শাশ্বত ও চির আধুনিক।