Saturday, February 16, 2013

তেহরির স্কোয়ার থেকে শাহবাগ

                                                                 (১)

  প্রথমেই বলে রাখি নৈরাজ্যবাদ শব্দটা খবরের কাগজের বদৌলতে এবং রাজনীতির দশচক্রে নেতিবাচক শব্দ হলেও, প্রকৃত অর্থে এটি একটি উন্নত রাজনৈতিক চেতনা। যা এই বস্তাপচা "রাষ্ট্র",  তার রক্ষক রাজনৈতিক পার্টি ওরফে রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তির চেয়ে অনেক উন্নততর আধুনিক ধারনা। কেন সে ব্যাপারে পরে আসছি।

                নৈরাজ্যবাদের ( এনার্কিজম) অর্থ রাষ্ট্রের  ( রাজ্যের)  প্রতি অনাস্থা। বাংলাদেশের  শাহবাগে বা দুবছর আগে ভারতের রামলীলা ময়দানে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধি আন্দোলনের মূল কারন সেটাই। রাষ্ট্র নামক এই সিস্টেম- যার মধ্যে আছে বিচার, আমলা আর সীমাহীন বস্তাবচা দূর্নীতি, তার প্রতি জনগণের বিশেষত তরুণ সমাজের সম্পূর্ণ অনাস্থা।

             রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থা-আর সাধারন মানুষের প্রতি ভরসা- প্রচলিত আইন তুলে দিয়ে পার্লামেন্ট , পার্টি  পলিটিক্স বর্জন করে স্বতস্ফূর্ত ভাবে জনগণ তৈরী করছে নতুন আইন। এমন স্বতস্ফূর্ত গঠন, যেখানে রাষ্ট্রের দরকার নেই-সেই আমরা সবাই রাজা আমাদের এই নতুন রাজত্বের প্রথম স্বপ্ন দেখেন একজন চৈনিক দার্শনিক।

    জুয়াংগি ঝাও।  গৌতম বুদ্ধ আর কনফুসিয়াসের সমসামিক। এই সময়টা দর্শনের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ।  চীনে তখন দুই দার্শনিক মতের লড়াই। একদিকে কনফুসিয়াস। যিনি শক্তিশালী রাষ্ট্রের এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রনীতির পক্ষে। তার ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে  জুয়াংগি ঝাও বললেন, ওরে বাপু সর্ষের মধ্যেই ত ভূত। রাষ্ট্র মানেই জনবিরোধি আইন হবে, জনগনের স্বাধীনতা যাবে এবং কিছু শোষক শ্রেনী লুঠে পুটে খাবে। যত শক্তিশালী রাষ্ট্র,  ততই ভয়ংকর হবে তার আইন । যদি জনগণের সত্যিকারের মুক্তি চাও-রাষ্ট্র তুলে দিতে হবে। ঝাও এর বিখ্যাত বাক্য আজ ভারত বাংলাদেশ সর্বত্র প্রযোজ্য- চোর হলে জেলে যাবে, আর ডাকাতি করতে পারলে, হবে দেশের রাজা।  আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে জুয়াংগি যা বলেগিয়েছিলেন, তা আজও সর্বসত্য।

       তাহলে আইন? কে কার কথা শুনবে? মৎসন্যায় কে আটকাবে? ঝাও বললেন, জনগণ নিজের স্বার্থে, নিজেরা ঠিক করে যে আইন বানাবে, সেই আইন রাষ্ট্রের চাপানো আইনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। স্বতস্ফূর্ত আইনই শ্রেষ্ঠ আইন। রাজা আইন বানাবে নিজের স্বার্থে। প্রজারা বানালে তবেই সে আইন হবে জনগণের।  আমেরিকা থেকে ভারত, ভারত থেকে বাংলাদেশ-গণতন্ত্র আসলেই ত হাইজ্যাকড।  ব্যাবসায়ী এবং কিছু রাজনৈতিক থাগদের কাছে।  বাংলাদেশের এ ব্যাপার অভিজ্ঞতা আরো করুন।  একের পর এক আইন পরিবর্তন করে,   স্বাধীনতাবিরোধি শক্তিই ক্রমশ রাজশক্তিতে রূপান্তরিত। ফলে রাষ্ট্র যন্ত্রের ওপর ভরসা মানুষ তদ্দিনই রেখেছে, যদ্দিন বিচার চলছিল। বিচারের হাস্যকর রায় দেখে ( আমার ধারনা ভেতরে বিরাট টাকার খেলা ছিল বা রাজনৈতিক খেলা আছে। এটা খুবই সম্ভব বর্তমানের আওয়ামী লিগ সরকারের সাথে সৌদি আরব তথা মুসলিমদেশগুলির একটা বোঝাপড়া হয়েছে যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে টাইপের রায় যায়। ) তরুণ সমাজ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি আস্থা হারায়।

  ঢাকার শাহবাগ বা দিল্লীর রামলীলা ময়দানে আজকের এই নৈরাজ্যবাদি আন্দোলনে আমরা সেটাই দেখছি। নতুন নেতৃত্ব, নতুন আইন-কোন রাষ্ট্রের চাপানো না। স্বতস্ফূর্ত ভাবে তৈরী হচ্ছে, নেতা, নেতৃত্ব এবং  নতুন আইন। আড়াই হাজার বছর আগে ঝাও এর দর্শনকেই ঘষামাজা করে তরী হয়েছে নতুন এনার্কিস্ট দর্শন। যার মূল কিন্ত সেই স্বতস্ফূর্ত  জনগণ।

                                                             (২)
কেন তরুণ প্রজন্ম ক্ষোভে ফেটে পরে? কেন তারাই  বিদ্রোহের বারুদে আগুন জ্বালায় ইতিহাসের সব আন্দোলনে?
 
 আসুন আমরা গত দুবছরের তিন সর্ববৃহৎ আন্দোলন বিশ্লেষন করি যার মূলে ছিল ছাত্র যুবকেরা।

  তাহরীর স্কোয়ার- ফেব্রুয়ারী, ২০১১
  রামলীলা ময়দান- আগস্ট, ২০১১
  শাহবাগ-ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

 এই তিন আন্দোলনের মধ্যে একটা স্ট্রাকচার বা সূত্র পাওয়া সম্ভব

  •  প্রথমত আন্দোলনের পুরোহিত এবং পুরধা-তরুণ শিক্ষিত ব্লগার। স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমেই দানা বেঁধেছে আন্দোলন 
  •   তাহরীর স্কোয়ার সিস্টেম বদলাতে সক্ষম হয়েছিল। অরভিন্ড কেজরিওয়াল এবং  আন্না হাজারে ভারতবাসীর সীমাহীন ক্ষোভ উতরে দিলেও সিস্টেম বদলাতে ব্যার্থ। বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলনের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। এর একটা বড় কারন বোধ হয় ভারত এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের উপস্থিতি যা মিশরে ছিল না।  তবুও অদ্ভুত মিল এই তিন আন্দোলনের মধ্যে।  আন্দোলন দানা বেঁধেছে বছরের পর বছর জমা হওয়া পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে। 
  •    সব আন্দোলনের পেছনেই অর্থনীতির বিরাট ভূমিকা থাকে। দুর্দশার ভূমিকা থাকে।  প্যারী কমীউন বা ১৯০৫ সালে জারের বিরুদ্ধে রাশিয়ার নৈরাজ্যবাদিদের উত্থানের পেছনে ছিল না খেতে পাওয়া শ্রমিক কৃষকরা।  এই তিনটি আন্দোলনের পেছনে ছিল শিক্ষিত তরুনরা যারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বঞ্চিত এমন বলা যাবে না।  ভারতের সীমাহীন অর্তনৈতিক বৈষম্যর বিরুদ্ধে আন্নার সৈনিকদের সোচ্চার হতে দেখি নি। শাগবাগেও দেখলাম না, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করা জ্যান্ত জতুরগৃহের শ্রমিকদের বঞ্ছনা নিয়ে কারোর কোন মাথা ব্যাথা আছে। এই ব্যাপারটাতেও আন্দোলন গুলির অদ্ভুত মিল। এবং  এটা খুব পরিস্কার করে দিয়েছে এই সব দেশের বামআন্দোলন কতটা জন বিচ্ছিন্ন ফালতু রাজনৈতিক গলাবাজিতে পরিণত।  লেনিন স্টালিনের বিষ্ঠা পরিস্কার করা বাস্তব বিবর্জিত এই দিশাহারা বামেদের এই দশা  যদি সময়ের লিখন হয়, তথোধিক দুর্ভাগ্য এই যে সামাজিক অসাম্য, শোষণ এবং পরিবেশের দুর্দশা যা ভারত, বাংলাদেশ মিশর সহ সব দেশের মূল সমস্যা, সেগুলির ভিত্তিতে আন্দোলন না হওয়া পর্যন্ত এই বিদ্রোহ তার মুল শিকড় খুঁজে পাবে না।
  •  আন্না হাজারে বা কেজরিওয়ালের ব্যার্থতা শাহবাগেও আসবে। আমি খুব আনন্দের সাথে এই ভবিষ্যতবানী করছি না। করছি খুব দুঃখের সাথেই। ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেই । আন্না বা কেজরিওয়ালের দুর্নীতি বিরোধি আন্দোলন জনগণের হৃদয়ে প্রহ্লাদসম পাশানকে হাল্কা করতে  পারে, শাহবাগের উত্থান বাংলাদেশের অগণিত স্বাধীনতাপ্রেমী,  ধর্ম নিরেপেক্ষ মানুষের ক্ষতের প্রলেপ -কিন্ত সিস্টেম চেঞ্জ? সে হবে কি করে?  সরকারটা ত কিছু ব্যাবসায়ী, আমলা আর রাজনীতিবিদদের লুটেপুটে খাওয়ার জায়গা। সবটাই নষ্টের দখলে।  কিন্ত ভারত এবং বাংলাদেশের মূল সমস্যা যার শিকরে বসে আছে অশিক্ষার অন্ধকার আর উঁইপোকার মতন নষ্ট করা ধণের অসাম্য, শাহবাগ বা রামলীলা ময়দান যদ্দিননা এই সূত্র খুঁজে পাবে, এই আন্দোলন জ্বলবে আর নিভবে।
  •  ঠিক এমনটাই কি আমরা দেখছি না তাহরীর স্কোয়ারে? গত দুবছরে বেশ কয়েকবার জমায়েত হয়েছে সেখানে। আজকে তাহরীর স্কোয়ারকে ভয় পায় মিশরের শাসক শ্রেনী। শাহবাগ বা রামলীলা ময়দানকে ভয় পাবে, বাংলাদেশ বা ভারতের শাসককূল, তবেই প্রকৃত  গণতন্ত্রের দিকে একটু একটু করে এগোবে দেশ। 
  •  ইতিহাসের কি অদ্ভুত পরিহাস। পৃথিবীর প্রথম গণতন্ত্র ছিল গ্রীসের এথেন্সে।   গণতন্ন্ত্রের অদ্ভুত রক্ষাকবচ বানিয়েছিল এথেন্সের জনগণ। তারা ইচ্ছা করলে, নির্বাসিত করতে পারত তাদের যেকোন রাজনৈতিক নেতা কে। কালো আর সাদা নুড়ি দিয়ে ভোট হত। এই ভাবেই এথেন্স একদিন তাড়িয়েছিল পারস্যের বিরুদ্ধে সালামিসের যুদ্ধে জিতে আসা জনপ্রিয় গ্রীস সেনাপতি থমিস্টক্লেসকে। কারন তার জনপ্রিয়তা যে এথেন্সের গণতন্ত্রের কাল হবে, তা বুঝতে পেরেছিল এথেন্সের নগরবাসী।  তাহরির স্কোয়ার তাড়িয়েছিল মুবারক ফ্যামিলিকে। 
  • শাহবাগের আন্দোলন রাজাকার তাড়ানো বা নির্মূল করা থেকে শুরু হলেও-যেদিন শাহবাগের এই আগুন,  বাংলাদেশ থেকে তাড়াতে সক্ষম হবে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার পরিবারকে, সেদিনই সম্পূর্নতা পাবে শাহবাগ। তার আগে সবটাই প্রস্তুতি পর্ব। 

এটাই ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম গণতন্ত্রের শিক্ষা।  গণতন্ত্রকে রক্ষা করার শিক্ষা। যে  শিক্ষা ভুলে আমরা দেখেছি গণনায়কদের গণদানবে অবনবন । শাহবাগ থেকে তাহরির স্কোয়ার গণতন্ত্রের সেই রক্ষাকবচ হয়ে উঠুক-এখন এটাই কাম্য।

 স্বপ্ন কখনোত সত্যি হয়। আর যদি তা না হয়, তাহলে কিসের জন্যেই বা বেঁচে থাকা? তাহরির স্কোয়ার আর শাহবাগের মধ্যে স্বপ্ন দেখুক আগামীদিনের তরুন প্রজন্ম। 



            বর্ষা আসে, দুকুল ভাসিয়ে।  ভাঙে গড়ে নদীর  গতিপথ। ধর্মীয় রাজনীতির খরা কাটিয়ে,  আজ চেতনার বর্ষা বাংলাদেশে। শাগবাগ  স্বপ্নের সেই নদী। তার ভাঙাগড়া দিয়েই গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ।