Sunday, August 14, 2022

স্বাধীনতার ৭৫ বছর - "ভারত" বিশ্বের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পরীক্ষা

 যখন ছোট ছিলাম, ভারতে ছিলাম, ভারতের ইতিহাস বই পড়তাম, তখন এক ভারতকে চিনতাম। 

  এখন বয়স হল, ভারতের বাইরে আছি দীর্ঘদীন। পৃথিবীকে যত চিনছি, যত বিশ্বের ইতিহাস আর ভূগোলকে জানার সুযোগ হচ্ছে, অন্য ভারতকে আবিস্কার করছি প্রতিদিন।  হতে পারে সেটা আমেরিকার লেন্সে, দর্শনের  মাইক্রোস্কোপে আর ইতিহাসের দূরবীক্ষনে ।  কিন্ত প্রতিনিয়ত এক অদ্ভত দেশকে আবিস্কার করি! সত্যিই,  এমন দেশটি কোথাও গেলে পাবে নাকো তুমি!

ভারত বা যেকোন দেশই একটা "স্যোশাল কনট্রাক্ট"- বিবাহের মতন জুটি বাঁধা। বিয়ে টেকাতে যেমন প্রতিনিয়ত সবাই কিছুটা  নিজেদের  ব্যক্তিস্বাধীনতা বিসর্জন দিই, নিজস্ব স্বত্ত্বা বিসর্জন দিচ্ছি,  নানাবিধ কম্প্রোমাইজ করে থাকি-  এবং তার বিনিময়ে বিবাহ থেকে অনেক কিছুর নিরাপত্তা পাই।   দেশের সাথে তার জনগনের সম্পর্ক ও তাই। কিন্ত আরো অনেক জটিল স্কেলে।  একটা দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কের চুক্তি।  দেশের জন্য সবাইকেই কিছু না কিছু ত্যাগ করতে হয়। বিনিময়ে দেশ দেবে। কিন্ত এই দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে ফাঁকিবাজি বড্ড বেশী। 

ঐক্যবদ্ধ অখন্ড ভারতের ধারনা মহাভারতে বারংবার উচ্চারিত। কেন? কারনটা মহাভারতের লেখক বারংবার বলেছেন। এক, তাতে রাজ্যগুলির মধ্যে যুদ্ধ হবে না। শান্তি বজায় থাকলে,  দেশে সমৃদ্ধি আসবে। বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে ভারত নিরাপদ থাকবে। এই প্রয়োজনেই ভারতের উৎপত্তি এবং বর্তমান অস্তিত্ব। ভারতের মিলিটারি বাজেট জিডিপির ২%।  আজ ভারতের প্রতিটা রাজ্য যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হয়, তাহলে প্রতিটা রাজ্যকে আলাদা মিলিটারি রাখতে হবে। এবং তাতে সামরিক বাজেট হবে জিডিপির ১০%+ । কিন্ত তাতেও নিরাপত্তা অনেক অনেক বেশী কমবে। ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রমান করে দিয়েছে, বড় শক্তিশালী দেশের নাগরিক না হলে, ছোট দেশের নাগরিকরা নিরাপদ না।  ইউ এন এক ঠুটো জগন্নাথ দর্শক। কোন ছোট রাষ্ট্রকে বড় রাষ্ট্রের আগ্রাসন থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। 

কিন্ত মহাভারত এক উপন্যাস। অখন্ড ভারত ইতিহাসে প্রথম বার তৈরী হল আলেক্সান্ডারের আক্রমন থেকে শিক্ষা নিয়ে।  আলেক্সান্ডারের আক্রমন প্রমান করে দিল, বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে বাঁচতে অখন্ড ঐক্যবদ্ধ ভারত দরকার। ফলে গোটা এশিয়াতে গ্রীক সাম্রাজ্য রাজত্ব করেছিল আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পরও দুশো বছর। কিন্ত ভারতে রইল ভূমিপূত্রদের মৌর্য্য সাম্রাজ্য। কারন চানক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত বুঝেছিলেন ভারত নিজে "সাম্রাজ্য" না হলে, এই ভূখন্ড অন্য সাম্রাজ্যের অধীন হবে। 


চানক্যের রাজনৈতিক শিক্ষার আরেক সফল প্রয়োগ দেখায় চীনের কুইন সাম্রাজ্য। ২৪৭ খৃঃপূর্বাব্দে তারা বাকি পাঁচটি রাজ্যকে হারিয়ে গোটা চীনকে একটি অখন্ড রাষ্ট্রের আওতায় আনে।  ফলে চীন দীর্ঘদিন পর্যন্ত-  ইউরোপিয়ানদের আগমনের আগে পর্যন্ত পৃথিবীর সব থেকে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসাবে টিকে থাকে। এবং তারা আবার পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হিসাবে নিকট ভবিষ্যতে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। 

কিন্ত ভারত ভুলে যায় বিষ্ণুগুপ্তকে। ফলে চানক্যের ভবিষ্যতবানী সফল করে উত্তর-পশ্চিমের দুর্ধ্বষ্ব পাহাড়ি যোদ্ধারা  ইসলামের ধর্মজয়ে ধ্বজ্জা উড়িয়ে ভারত আক্রমন করে। সফল ভাবে তারা ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে।  বিচ্ছিন্ন ভারতের ক্ষমতা ছিল না-সেই শক্তিকে রুখে দেওয়ার। ফলে প্রথমে মধ্য এশিয়ার উপজাতি, পরে ইউরোপিয়ান বনিকদের হাতে এই অঞ্চলের লোকেরা দীর্ঘদিন পদানত ছিল।  যেমন অধিকাংশ মুসলমান শাসকরা  বিদ্রোহের ভয়ে স্থানীয় লোকেদের ঘোড়া, অস্ত্র এবং সৈনিক রাখতে দিত না। বা দিলেও অনুমতি সাপেক্ষে দিত। বৃটিশরা ভারতের লোহ শিল্পকে ধ্বংস করে যাতে অস্ত্র তৈরী না হয়। আর স্থানীয় রাজরাজাদের সেনাবাহিনী তুলে দেওয়া হয় প্রোটেক্টারেট স্টেটের নামে।  

বলতে গেলে বর্তমান এই ভারতের শুরু মুঘলদের হাত দিয়ে যারা মধ্য এশিয়ার থেকে আগত। বৃটিশরা মুঘলদের ভারত নামক পরীক্ষাটাই এগিয়ে নিয়ে গেছে।  সাথে যোগ হয়েছে ইউরোপিয়ান লিব্যারাল ডেমোক্রাসির আদলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। 

মুঘল আমলেই ভারতের স্থানীয় সংস্কৃতিগুলি- যেমন বাংলা বা তামিল বা মারাঠি জাতিগোষ্ঠিগুলি দিল্লীর অধীনে আসে। দিল্লী থেকে আগত গর্ভনররা ভারতের রাজ্যগুলি শাসন করতে থাকেন। বৃটিশ আমলে সেই ট্রাডিশনই বজায় ছিল-শুধু দিল্লীর বদলে লন্ডন থেকে গর্ভনর আসত।  স্বাধীনতার পর, স্বয়ত্ব শাসনের পরিধি বাড়াতে রাজ্যগুলির হাতে "কিছু" ক্ষমতা দেওয়া হয়-গর্ভনরের পজিশনটা টিটুটেলার হেড হিসাবে থেকে যায়। 

একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। এই শতকে পৃথিবীর যে তিনটে দেশ বৃহত্তম এবং সব থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে চলেছে- ইউনাইটেড স্টেটস, চীন এবং ভারত- তাদের ভিত্তি বিশাল দেশের বিপুল অর্থনীতি।  জাপান, জার্মানী, বৃটেন, ফ্রান্সের মতন উন্নত দেশগুলিও ভারতের সাথে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পেরে উঠবে না। 

এটা এক ধরনের মির‍্যাকল। ম্যাজিক।  ১৯৪৭ সালে ভারত ছিল গরীব একটা দেশ। এখনো তাই আছে। কিন্ত এখন দেশে গরীবের সাথে সাথে বিরাট বড় বড় পুঁজি রয়েছে। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মধ্যবিত্ত শ্রেনীটি আছে।  বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে শিক্ষিত দ্বিতীয় বৃহত্তম মানব সম্পদ রয়েছে। এখন মার্ক জাকারবার্গ বা জেফ বেজোসকেও ভারতে আসতে হয়। ভারতের কথা ভাবতে হয়। ভূরাজনীতি ভারত ছাড়া ভাবা যায় না। 

কোন সন্দেহ নেই, এ এক উদীয়মান ভারত। অদ্ভুত দেশ। এত জাতি, এত ভাষা, এত ধর্ম সত্ত্বেও দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। 

 কিন্ত আমি সম্পূর্ন নিশ্চিত না। স্কেপ্টিক্যাল। কারন একটাই। 

 একটা দেশকে ধ্বংস করতে আজকাল পরমানু বোমার দরকার হয় না। ট্যাঙ্ক গোলাবারুদ, বায়োওয়েপন, ভাইরাস কোন কিছুই ভারতকে ধ্বংস করতে পারবে না। বিচ্ছিন্নবাদি আন্দোলন ও পারবে না। 

তাও ভারত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পৃথিবী যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে মানুষের শিক্ষা সব থেকে গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে।  শিক্ষা বিষয়টি ভারতের শাসকেরা কখনোই সিরিয়াসলি নেয় নি। ভারতের স্কুলে যে মুখস্থ বিদ্যা নির্ভর শিক্ষা চলছে- তা বর্তমানে সম্পূর্ন অকার্যকরী। অদরকারি। এতে এক বিকালঙ্গ নাগরিক সমাজ তৈরী হচ্ছে, যারা চিন্তা করতে জানে না।  এরা দেশ দেশ বলে লাফাতে পারবে, কিন্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।

ভারতকে যদি কোন কিছু ধ্বংস করে, সেটা হবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অবহেলা। উদাহরন দিই? গরমকালে ভারতের সব শহরে জল কষ্ট।  পাম্প খারাপ হয়। ভূগর্ভে জল থাকে না। অথচ ভারতে এখনো বহুতল বানানোর পারমিশন অকাতরে দেওয়া হচ্ছে।  বহূতল মানেই খুব অল্প জায়গায় বিপুল জল মাটি থেকে টেনে, সেখানকার ভূর্গভস্থ জল সম্পূর্ন ধ্বংস করবে। যা ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, পুনেতে হয়েছে। বহুতল বানানোর পারমিশন শুধুমাত্র কোন অশিক্ষিত জাতিই দিতে পারে। 

আরো উদাহরন দিচ্ছি। ভারত পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা। এখানে বহুদিন ধরে জনগন যেসব ফসল ফলাত-যেভাবে সেই ফসল থেকে খাদ্য হত-তা আজ লুপ্ত।  বহুদিনের এই সুস্থ থাকার শিক্ষা আজ লুপ্ত। তার বদলে ভারতের মেনুতে ঢুকেছে অগুন্তি অস্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকা।  সুস্থ থাকার শিক্ষাটাই স্কুলে পড়ানো হয় না ঠিক করে। 

 আমি নানাবিধ বিষয়ে পড়াশোনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি- ভারতকে তার হৃদ্গৌরব ফিরে পেতে গেলে, সুস্থ এবং বুদ্ধিমান জনগোষ্ঠির দরকার। ১৪০ কোটি অসুস্থ, নাবালক নাগরিক নিয়ে সবার সেরা আমার সে দেশ হবে না।  আর সেটা করতে গেলে, অতীতে তাকানো প্রয়োজন। যখন ভারতে একটি বাড়ি বানালে, সে বাড়ির পেছনে একটা পুকুর থাকত।  একটা শহর বানাতে গেলে একাধিক হ্রদকাটা হত।  ভোগ না, ত্যাগই ছিল পরম আদর্শ। লোভ না, সেবাই ছিল পরম ধর্ম।  প্রকৃতি ছিল পরম গুরু এবং মাতা।  এসব ভারত থেকে হারিয়ে গেলে,  সে শুধু নামেই ভারত হবে। পৃথিবীর শিক্ষক এবং গুরু হতে পারবে না। 







Thursday, August 11, 2022

ভারতীয় আইনে বাকস্বাধীনতা নেই!

 ভারতীয় আইনে বাকস্বাধীনতা নেই!


-বিপ্লব পাল, ১২ই আগষ্ট, ২০২২

বাংলাপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা নেতা গর্গ চ্যাটার্জি, আসাম সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। এখন ট্রান্সিট জামিনে। তার অপরাধ -তিনি তার টুইটে একটি প্রশ্ন তুলেছিলেন । বিজেপি যদি বাবর সহ মুঘলদের বহিরাগত তকমা দেয়, তাহলে অহম সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুকাপাকে কেন বহিরাগত বলা হবে না?

কারন সুকাপা চীনের মং মাও (বর্তমানে উন্নান প্রভিন্সের) রাজ্যের রাজকুমার ছিলেন। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তিনি এসেছিলেন পাটকাই পর্বত পেরিয়ে ১২২৮ সালে। প্রায় ন হাজার সৈন্য নিয়ে।

এটা খুব সহজ একটা ঐতিহাসিক প্রশ্ন। এর জন্য আসামের জনগোষ্ঠির অনুভুতিতে আঘাত লেগেছে-এই ধারাতে গর্গ কেস খেয়েছেন, এবং গ্রেফতার হয়েছেন। যেকেউ এটা শুনলেই অবাক হবেন যে   স্বাধীন ভারতে ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আপনি গ্রেফতার হতে পারেন। কিন্ত কেন?

এখানে চারটি পয়েন্ট বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ন। আমি সেগুলো ব্লগে লিখছি। কারন ইদানিং ফেসবুকে এসব যতই তথ্যসহকারে লিখিনা কেন, ফেসবুকের ডিজফাংশনাল এই আই প্রযুক্তি আমাকেই ধরে ব্যান করে দেবে। ভারতের আইনের থেকেও গোলমেলে ফেসবুকের তথা কথিত এই আই রিভিউ!

 যে বেসিক প্রশ্নগুলো সবার তোলা দরকার --

(১)  ভারতের সংবিধানে কি তাহলে বাক স্বাধীনতা নেই? আছে এবং যদি গর্গ কেসটা লড়েন, সংবিধানের সেই রক্ষাকবচের জন্য জিতে আসবেন। কিন্ত   এই কোর্ট থেকে ওই কোর্টে দৌড়ে তার ভোগান্তি হবে বিশাল। আসামের বিজেপি সরকার সেটাই চাইছে। এটার মূল কারন, ভারতের সংবিধান রচনা হয়েছে ১৯৪৯ সালে। কিন্ত ভারতের সংবিধান অনুসারে ভারতের পেনাল কোডের আইন বদলায় নি।  ভারতের পেনাল কোডের আইন বৃটিশ আমলের। যেখানে এইসব ব্লেস্ফেমি ( ধর্মীয় অনূভূতির অবমাননা), সিডিশন (দেশদ্রোহী) ধারায় কেস চলে। যা কোন উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্রে নেই। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ীও থাকা উচিত না। কিন্ত ভারতীয় পেনাল কোডে এই ধারা গুলি রয়ে গেছে। কারন ১৯০৯ সালের পর ভারতের পুলিশ আইনে বিশেষ সংশোধন হয় নি। ফলে ভারতের যেকোন রুলিং পার্টি, খুব বিধিবদ্ধ রুটিন ঐতিহাসিক প্রশ্ন তোলার জন্যও যাকে খুশী, তাকে গ্রেফতার করতে পারে এইসব ভুল্ভাল আইনি ধারায়। 


(২) সুকাপা কিভাবে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই ইতিহাস বাবরের মতন পরিস্কার না। স্থানীয় উপজাতিদের সাথে তার যুদ্ধের শুধু দুটো ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্ত অহম সাম্রাজ্য যে দীর্ঘ ৬০০ বছর টিকে ছিল-তাদের নিজেদের ঐতিহাসিক ভাষ্য হচ্ছে সুকাপাকে স্থানীয় লোকজন ভালবেসে রাজা হিসাবে গ্রহন করেছিল। কারন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বানভাসি জমিতে কিভাবে ধান চাষ করতে হয়, সেই চাষের প্রনালী সুকাপা চীন থেকে এনেছিলেন। ফলে তাদের চৈনিক প্রযুক্তিতে স্থানীয় অধিবাসীরা খুব উপকৃত হয় এবং তারা সুকাপাকে রাজা হিসাবে গ্রহন করে।

 কোন সন্দেহ নেই এই অহম রাজ্য একটি উন্নত প্রজাপালক রাজ্য ছিল। নইলে ৬০০বছর টেকার কথা না। আর তারা মুঘলদের প্রায় ১৭ বার পরাজিত করে। 
 
 কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে অহম রাজ্যের ঐতিহাসিকদের লেখা ভাষ্য কতটা ঐতিহাসিক সত্য? মনে রাখবেন পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, সেখানে বাবর, মহম্মদ ঘোরি, বখতিয়ার খিলজি- এরা উন্নত সভ্যতার বীর। পাকিস্তান বাংলাদেশের ইতিহাসে ইসলাম ভারতে আসার আগে স্থানীয় হিন্দু সংস্কৃতি এবং সভ্যতা ছিল নিম্নমানের। তার উদাহরন হিসাবে তারা দেন যে মুঘল আমলে যে এডমিনিস্ট্রিটিভ এবং ল্যান্ড রেভিনিউ স্ট্রাকচার তৈরী হয়েছিল-সেটাই কিন্ত বৃটিশ আমলেও রয়ে গেছিল। সুতরাং বিজয়ীদের ঐতিহাসিক ভাষ্যে সর্বদা এটাই থাকে, তারা উন্নত সভ্যতা এনেছিল বল, এই জাতিটা বেঁচে গেছে!

 যেমন ইংল্যান্ডে যে ভারতের ইতিহাস পড়ানো হয়, তাতে ছাত্ররা এটাই শেখে, বৃটিশদের আগে ভারত ছিল বর্বর অসভ্য লোকেদের সভ্যতা। বৃটিশরা এসে ভারতীয়দের পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি দিয়ে সভ্য করেছে! 
 
অহম রাজ্যের নিজস্ব ইতিহাস ও সেইভাবে লেখা-যাতে সুকাপা সেই জাতির পিতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।

 সেই ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করলে, ভারতে জেলে যেতে হবে?  তাহলে সংবিধানে বাক স্বাধীনতার রক্ষাকবচ কোথায়?

(৩)  বাংলাপক্ষের সবাই এটাকে বিজেপির প্রতিহিংসা হিসাবে দেখছেন। কিন্ত আরো গভীরে ভাবা উচিত। বিজেপির নুপুর শর্মাও  ক্রিমিন্যাল কেস খেয়েছেন একটি ঐতিহাসিক সত্যকে টিভিতে বলার জন্য। 

গর্গ হার্ভাড, এম আই টির প্রাত্তনী। নুপুর শর্মা লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের প্রাত্তনী। এদের মতন প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা ভারতীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে-এটা অত্যন্ত আশার কথা।  গণতন্ত্রে মতের বিরোধ থাকবেই। গর্গের সাথে আমি কোলকাতায় আড্ডা মেরেছি অনেক। ওর সাথে অনেক ব্যপারে আমি একমত। আবার উগ্র জাতিয়তাবাদের প্রশ্নে আমি ওর সাথে দ্বিমত পোষন করি। নুপুর শর্মার হিন্দুত্ববাদের ভার্সনের সাথেও আমি তীব্রভাবেই দ্বিমত। কিন্ত এদের মতন উন্নত মেধার ছেলে মেয়েরা  ভারতীয় রাজনীতিতে এসেছেন। জন আন্দোলন করছেন।  এ বড় আশার কথা।  

প্রশ্ন হচ্ছে,  ভারতের আইন যদি, আসল অপরাধি রাজনীতিবিদ-যারা জনগনের হাজার কোটি টাকা মেরে দেয়-খুন করে ভোটে জেতে-তাদেরকে বিলকুল ছাড় দেয়- আর গর্গ বা নুপুর শর্মার মতন মেধাবী ছেলেমেয়েদের জেলে ঢোকাতে তৎপর হয়-  যে শুধু তারা ঐতিহাসিক সত্যটাকে তুলে ধরেছেন ! 

 তাহলে ভারতের মেধাবী ছেলেরা কেন রাজনীতিতে যোগ দেবে? ভারতের রাজনীতি সেক্ষেত্রে শুধুই চোর ডাকাত ধান্দাবাজদের আখড়া হয়ে যাবে। 

 আমি বিজেপি-কং-তৃনমূল এসব পাঁকে ঢুকব না। কারন শাসক শ্রেনীর চরিত্র সর্বত্র এক। ভারতের দুর্বল আইনি কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে বিরোধিদের হেনস্থা করা।  এর কারন ও আমি আগেই বলেছি। ভারতের সংবিধান এবং পুলিশি আইনকে অত্যাধুনিক করতে হবে।  বৃটিশ আমলের আইন কারা চালাচ্ছে? কাদের দ্বায়িত্ব ছিল বৃটিশ আইন বদলে ভারতকে নতুন পুলিশ আইন দেওয়ার? 

কংগ্রেস সেটা করে নি। কারন তারা বরাবর বৃটিশ আইনের সুবিধা নিয়ে বিরোধিদের দমন করেছে। তার জন্যই ১৯৭৭ সালে জনতা সরকার, প্রথম, ভারতের পুলিশ আইন বদলানোর জন্য , স্বাধীন ভারতের প্রথম পুলিশ কমিশন বসায়। কিন্ত তদ্দিনে তারাও ক্ষমতা স্বাদ পেয়েছেন।  প্রবাদ, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ফলে সেই কমিশন যে সুপারিশ করেছিল-সেগুলি তারা বদলানোর জন্য উদ্যোগ নিল না। এদিকে জনতা সরকারের পতন হয় ১৯৮০ সালে।  ফলে কমিশন চলেগেল হিমঘরে। 

 ১৯৮৯ সালের ভিপি সিং সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী  ইন্দ্রজিত গুপ্ত ভারতের পুলিশ কমিশনের সুপারিশ গুলি চালু করার শেষ চেষ্টা করেন। উনি সব মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লিখলেন, যে একটা সর্বভারতীয় ঐক্যমত দরকার পুলিশ কমিশনের সুপারিশ গুলি চালু করার জন্য।  স্বয়ং জ্যোতিবসু সেই চিঠির উত্তর দেন নি। কোন মুখ্যমন্ত্রীই দেন নি। কেন দেবেন? ভারতের আইন শাসক শ্রেনীর স্বৈরাচারের বড় সহায়!

ফলে ভারতে সেই বৃটিশরাজ বা তার থেকেও আরো বেশী জঘন্য অপ্রেসিভ পুলিশ এডমিস্ট্রেশন চলছে।  যাদের কাজ শাসক শ্রেনীর লাঠিয়াল হয়ে, বিরোধিমতকে জেলে ঢোকানো।  বৃটিশ আমলেও বোধ হয়, বৃটেনের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য কেউকে জেলে যেতে হয় নি। 

Tuesday, August 2, 2022

ক্ষুধিত ড্রাগন ---

 ক্ষুধিত ড্রাগন ---

বিপ্লব পাল, দোশরা আগষ্ট , ২০২২
তাইওয়ান। কেরালার মতন আয়তনের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র। আড়াইকোটি লোকের বাস। পৃথিবীর ৫৪% সেমিকন্ডাক্টর চিপ এখানেই তৈরী হয়, শুধু একটি কারখানায়। জনপ্রতি ইনকামে দেশটি ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের ওপরে।
এখন গোটা পৃথিবীর প্রশ্ন, ইউক্রেনের পর কি তাইওয়ান?
তাইওয়ান স্বাধীন রাষ্ট্র কি না- সেটা কেউ ঠিক করে বলতে পারবে না। কারন তাইওয়ান এবং চীন-দুটি দেশের সংবিধান বলে চীন আসলে একটিই! তাইওয়ান বলে বৃহত্তর চীন আসলে আমাদের অংশ। চীন বলে তাইওয়ানের অস্তিত্ব নেই-তারা আমাদের অংশ। শুধু তাই না। ভারত, আমেরিকা-বা যেকোন বহুজাতিক কোম্পানি-যারাই চীনের সাথে ব্যবসারত সবাইকে এই মর্মে সাইন করতে হয়-তারা ওয়ান চীন পলিসি স্বীকার করতে বাধ্য!
এত জটিল পরিস্থিতি কি করে হল? ১৮৯৪ সালের আগে তাইওয়ান ছিল, চীনের চেং সাম্রাজ্যের অংশ। ওই বছর জাপান দ্বীপটি দখল করে, নাম দেয় ফরমোসা আইল্যান্ড। কিন্ত ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারার পরে, জাপান দ্বীপটি আবার চীনকে ফিরিয়ে দেয়। তখন চীনের জেনারেল চিয়াং কাইসেক। মাও এবং চিয়াং কাইসেক দুজনেই চীনের পিতা সান ইয়াত সেনের শিষ্য। মাওএর রেড আর্মি, চীনের ন্যাশানাল আর্মিকে কোনঠাসা করা শুরু করলে, চিয়াং কাইসেক তাইওয়ানে আশ্রয় নেন (১৯৪৯) এবং ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশটিকে শাসন করেন। চিয়াং কাইসেক এবং আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের দেশগুলি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দাবী করে এসেছে, এই তাইওয়ানই হচ্ছে আসল রিপাবলিক অব চাইনা। কিন্ত সোভিয়েতের সাথে চীনের সম্পর্ক খারাপ হতেই, আমেরিকা সুযোগ বুঝে, চীনকেই আসল রিপাবলিক অব চাইনা বলে স্বীকৃতি দেয়। ভারত এই কাজটি করে সিকিএমের অন্তর্ভুক্তির সময়। সিকিমের অন্তর্ভুক্তি কে চীন মেনে নেয়। বিনিময়ে ভারতকে স্বীকার করতে হয় ওয়ান চিন পলিসি।
কিন্ত আমেরিকা, তাইওয়ান্কে মিলিটারি প্রোটেকশন দিতে থাকে। কারন সাউথ চাইনা সি। দক্ষিন চীনের এই সমুদ্র দিয়ে ৩০% গ্লোবাল বানিজ্য চলে। তিন ট্রিলিয়ান ডলারের। তার সাথে সেমিকন্ডাক্টর চীপ। যার লিডার তাইওয়ানের ন্যাশানাল সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানী বা টি এস এম সি। পৃথিবীর সব স্মার্টফোনের চিপ এখানেই তৈরী হয়। ফলে তাইওয়ান চীনের হাতে হাতছাড়া হলে, আমেরিকার দুকুল যাবে। গোটা পৃথিবী চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবে।
চীন হঠাত করে এত তাইওয়ান নিয়ে লাফাচ্ছে কেন? কারন তাইওয়ানের বর্তমান লিডার- তাই জেন ওয়াং। এই মহিলা, বলে দিয়েছেন, এই ওয়ান চাইনা খেলা বন্ধ করতে হবে। তাইওয়ান আলাদা দেশ, চীন আলাদা দেশ। তাইওয়ানের কোন ইচ্ছা নেই নিজেদের আসল রিপাবলিক অব চাইনা বলে দাবী করার ( যা তাইওয়ান পাসপোর্টে লেখা থাকে)। মুশকিল হচ্ছ ১৯৯৪ সালে চুক্তি অনুযায়ী তাইওয়ান এবং চীন- অহিংসভাবে, চুক্তির মাধ্যমে ধীরে ধীরে মিশে যাওয়ার কথা-কারন উভয় দেশের নেতৃত্ব স্বীকার করত- তারা এক এবং অখন্ডচীনে বিশ্বাসী। এই ভদ্রমহিলা বলছেন-ঐতিহাসিক রোম্যান্টিসিজম বাদ দিয়ে বাস্তবে নেমে আসুন। তাইওয়ানের কোন অখন্ড চীনের খোয়াব নেই।
তাই জেন ওয়াং হচ্ছেন তাইওয়ানের জেলেনাক্সি। ইউক্রেন এবং রাশিয়ার পিতা- ভ্লাদিমির দ্য গ্রেট। তাতে কি? দুটো দেশ এখন আলাদা, সেটাই বাস্তব। তাই জেন ও তাই বলছেন। দুই দেশের পিতা সান ইয়াত সেন। কিন্ত দুটো দেশ এখন আলাদা।
এই অখন্ড চীন ব্যপারটা গোলমেলে। এর মানে চেং সাম্রাজ্যের সময় চীনের সীমানা। যার মধ্যে লাদাখ, অরুনাচল-ইত্যাদি ভারতের অঞ্চলগুলোও আসে। সুতরাং অখন্ড চীনের এই খোয়াব ভারতের জন্যও ভাল না।
আমেরিকা চীন যুদ্ধ কি লাগবে? লাগতে পারে। তাইওয়ান ইউক্রেন না। আমেরিকাকে প্রোটেকশন দিতেই হবে। চীনের মিলিটারি ক্ষমতা বেড়েছে অপ্রতিরোধ্য ভাবে। কিন্ত এখনো চীন আমেরিকার সমান না। আজ না হলে কাল, চীন যুদ্ধে যাবে। কিন্ত এখন না। আমিরিকাও সেটা জানে। সুতরাং চীনকে থামাতে হলে এখনই থামাতে হবে। কিভাবে? যদি চীন উস্কানিতে পুতিনের মতন স্টেপ নিয়ে বসে। সুতরাং এখন ন্যান্সি পলোসি গেছেন। কাল বাইডেন যাবেন। উস্কানি আনলিমিটেড চলতে থাকবে। চিন ও পেশী দেখাবে।
সব মিলিয়ে জিওপলিটিক্স গোলমেলে। ড্রাগন এখন ক্ষুদার্থ। সে অরুনাচল থেকে তাইওয়ান-যা কিছু চেং ডাইন্যাস্টির ছিল-সব কিছু খেতে চাইছে। ভারত, আমেরিকা, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া-এই রাষ্ট্রগুলির একসাথে চীন বিরোধি জোট করা ছাড়া উপায় নেই।
আশা ভরসা আছে। চীন কোরাপ্ট অলিয়ার্গিতে চলে না। কমিনিউস্ট পার্টির নেতারা সাধারন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা। নীল রক্তের বাহক নন। এরা যুদ্ধ চান না। নিজেদের সন্তানরা ব্যবসা বানিজ্য করে বিলিয়ানার হলেই এরা খুশী। সেটাই এদের মোক্ষ। যুদ্ধবাজ এরা নন। এরা ধান্দাবাজ কমিনিউস্ট। সুতরাং ফোঁস করবে। কিন্ত কামরাবে না।