Thursday, October 20, 2011

গদ্দাফির মৃত্যুঃ স্বৈরাচারের পতন পৃথিবী জুরে আসন্ন


(১)

গদ্দাফির লিবিয়া-হিরক রাজার দেশে

যেদিন লিবিয়াতে গণবিদ্রোহ শুরু হল, 15 ই ফেব্রুয়ারী। সবে টিউনিশিয়া এবং মিশরে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রায় সেই দিনই লিখতে যাচ্ছিলাম, এবার আরব বসন্ত লিবিয়াতে। সাদ্দাম হুসেনের পর মধ্যপ্রাচ্য বা উত্তর আফ্রিকার আরেকটা সব থেকে বড় নর-জানোয়ারের পতন আসন্ন।

তবে পতন এত সহজে আসল না। গদ্দাফি এবং তার পরিবার গত চল্লিশ বছরে লিবিয়ার সম্পদ এবং বাণিজ্য কব্জা করে বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। শুধু তাই না, লিবিয়ার লোকজন বিদ্রোহ করতে পারে এই আশঙ্কাতে তার পরিবার আফ্রিকান, পাকিস্তানী বাংলাদেশীদের নিয়ে এক বিরাট প্রাইভেট আর্মিও পুষত। ফলত ফেব্রুয়ারী মাসে লিবিয়ান সেনা বাহিনী যখন বিদ্রোহীদের ওপর গুলি চালাতে অসম্মত হয়, তখন এই সব ভারাটে সৈন্য দিয়েই নিজের দেশের লোক মেরেছে গদ্দাফি। ফলে গৃহযুদ্ধ ছিল আসন্ন, এবং সেই যুদ্ধে ন্যাটো যখন বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ায় তখন গদ্দাফির পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা। তৈল সমৃদ্ধ একটা দেশ-যাদের জিডিপি বেশ বেশী-কিন্ত সেখানে চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষি প্রায় সব ধ্বংস হয়েছে গদ্দাফি শাসনে।

যদিও অনেকেই সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে দেখাবে উত্তর আফ্রিকাতে শিক্ষা এবং জিডিপিতে লিবিয়া এগিয়ে, কিন্ত এটা ভুললে চলবে না, উত্তর আফ্রিকাতে মাথাপিছু তেলের সম্পদ লিবিয়াতেই সব থেকে বেশী। সুতরাং তেলের টাকার সদ্বাব্যবহার করলে, লিবিয়ার অবস্থা হওয়া উচিত ইউরোপের দেশগুলির সমগোত্র।

গদ্দাফি বিরোধিতা ছিল আইনত নিশিদ্ধ এবং মৃত্যুদন্ড ছিল তার সাজা!

হ্যা লিবিয়া ছিল সেই হিরক রাজার দেশ-যেখানে ইংরেজি এবং ফ্রেঞ্চ পড়ানো হত না সরকারি স্কুলে। বিদেশীদের সাথে কথা বলার জন্যে প্রশাসনের অনুমতি লাগত। সরকারি টিভি এবং নিউজপেপার ছারা অন্য কিছুর অনুমতি ছিল না লিবিয়াতে।
তবে গদ্দাফি একটা ছোট্ট ভুল করেছিলেন। স্যোশাল মিডিয়ার যুগে মেইন স্ট্রিমে সেন্সর করে কিছু হয় না। ফেসবুক, টুইটারের মাধ্যমে লিবিয়ানরা অনেকদিন থেকেই সংঘবদ্ধ হচ্ছিলেন।

গদ্দাফির হাতে অনেক সময় ছিল তৈল সম্পদ ব্যবহার করে লিবিয়ার ২০% বেকারত্বকে কমানো। চিকিৎসা, শিক্ষা কৃষির উন্নতি করা।

কিছুটা বুঝেছিলেন গদ্দাফি-উন্নয়নের কিছু কাজ শুরু করেছিলেন। বন্ধুবর সাদ্দাম হুসেনের মৃত্যুর পর, ওর মাথায় ঢুকেছিল, আমেরিকা আর বৃটেনকে হাতে রাখতেই পারলেই, মারে কে! ফলে আমেরিকাকে প্রায় আড়াই বিলিয়ান ডলারের ঘুঁষ আর বৃটেনকে দেড় বিলিয়ান ডলার খাইয়ে, আমেরিকা এবং বৃটেনকে হাত করে ফেলেছিলেন গদ্দাফি। আমেরিকা তার ওপর থেকে সন্ত্রাসবাদি তকমা তুলে নিয়েছিল। বৃটেন ও তাই। চিরকাল আমেরিকা বিরোধিতা করার পরে, যখন দেখলেন আর উপায় নেই, ঠিক টাকা দিয়ে ওয়াশিংটনের সাথে মাখো মাখো একটা সম্পর্ক তৈরী করে ফেলেছিলেন গদ্দাফি।

কিন্ত বিধি বাম! আরব বসন্তের জোয়ারে আমেরিকাও বাধ্য হল তার বিরুদ্ধে যেতে। বিশেষত প্যান এম বম্বিং এ যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদের পরিবার ওবামা প্রশাসনের ওপর নিরন্তর চাপ রেখেছিল গদ্দাফিকে হটানোর জন্যে। নইলে গদ্দাফি বাম হাতে আমেরিকাকে আরো পাঁচ বিলিয়ান ডলার দিতে রাজি ছিলেন ন্যাটোকে তুলে নেওয়ার জন্যে!

(২)
বিশ্বের সফলতম এবং বৃহত্তম গিরগিটীর জীবনী

গদ্দাফি চরিত্র নিয়ে লিখতে বসলে দস্তভয়েস্কিও হাত তুলে দিতেন। আমি অনেকদিন ধরেই ওর জীবনী পড়ছিলাম। সত্যিই এই চরিত্র বিশ্বইতিহাসে ইউনিক।

এই লোকটা একাধারে চূড়ান্ত রকমের ইসলামিক মৌলবাদি যে প্রকাশ্যে সর্বত্র বলে বেড়াত ইসলাম হচ্ছে একমাত্র ধর্ম এবং খ্রীষ্ঠান ধর্ম "ডাইল্যুটেড" -অন্যদিকে যখন ইসলামি মৌলবাদিরা আশির দশকে
তাকে হত্যার চেষ্টা শুরু করে-তখন থেকে পালটি খেয়ে এই লোকটাই হয়ে গেল ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধি। তার আগে পর্যন্ত সে নিজে ছিল ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের সব থেকে বড় টাকা জোগানদার!

আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিয়ার সাথে তার সম্পর্ক অদ্ভুত। সিয়া এত সাহায্য আর কারুর কাছ থেকে পায় নি! তাই আজ যখন কিছু কিছু বাম বাঙালী তাকে আমেরিকান সম্রাজ্যবাদ বিরোধি এক চরিত্র বলে হিরো বানানোর চেষ্টা করছে-তাদের দুটো তথ্য জানা উচিতঃ

এক -১৯৮০ থেকে প্যান এম বোম্বিং- সিয়া আফ্রিকা এবং ইউরোপের প্রচুর রাষ্ট্রনেতা এবং জার্নালিস্টদের হত্যা করেছে গদ্দাফির ঘাতক বাহিনী কাজে লাগিয়ে। গদ্দাফির অন্যতম বড় সমর্থক ছিল আমেরিকা। দীর্ঘদিন।
কেন গদ্দাফি-আমেরিকার সম্পর্ক ভেঙে শত্রুতা শুরু হল-সেটা লম্বা কাহিনী।

দুই-১৯৮৪ সালে তাকে খুন করার জন্যে বৃটিশ ইন্টালিজেন্সের ছক ও ভেস্তে দেয় সিয়া! কারন? কারন লিবিয়ার টাকা খাটত অনেক কমিনিউস্ট "বিপ্লবী" পার্টিতে। ব্রাজিল থেকে অস্ট্রেলিয়া-অনেক জায়গাতে কমিনিউস্ট আন্দোলনে টাকা ঢালতেন গদ্দাফি। মজার ব্যাপার হচ্ছে এগুলো গদ্দাফি করত সিয়ার নির্দেশে। কারন ওইসব পার্টিগুলিতে লিবিয়ান ইন্টালিজেন্সির মাথাগুলি ঢুকে যেত। আর খবর পাচার হয়ে যেত সিয়ার কাছে।

যাইহোক, রঙ বদলাতে এমন ওস্তাদ সার্কাসের খেলোয়ার বিশ্বে আর আসে নি।
গদ্দাফি শুরু করছিল প্যান আরব স্যোশালিজম প্রতিষ্ঠার জন্যে। সে খেলা জমলো না-আরব নেশন তৈরী হল না। তখন সে শুরু করল, প্যান আফ্রিকান জাতিয়তাবাদ। সেখানে অবশ্য গদ্দাফির কিছু সাফল্য আছে।

আরো মজার ব্যাপার হল, চাদ আক্রমন করে লিবিয়া যখন খুব একটা সুবিধা করতে পারল না-রাতারাতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে গদ্দাফি তাদের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। তাদের জন্য ঘরবারি বানানো থেকে অনেক কিছুই দিতে চেয়েছিলেন যাতে তার প্যান আফ্রিকান নেতার ইমেজে চোট না লাগে।

১৯৭০-১৯৮০, এক নাগাড়ে তিনি টাকা দিয়েছেন বিশ্বের অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদি সংস্থাকে। আবার যখন নিজের দেশের ইসলামিক মৌলবাদিরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, হঠাৎ করে পাশ্চাত্যের কাছে নিজের ইমেজ বানালেন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।

মোদ্দা কথা রং বদল করার ব্যপারে গদ্দাফি ছিলেন অদ্বিতীয়। ফলে যে আমেরিকা তার প্রাসাদ বম্বিং করেছিল এবং লিবিয়ার ওপর নিশেধাজ্ঞা আনে-শেষে বিরাট টাকার বিনিময়ে, তাদের সাথেই ঘনিষ্ট হবার চেষ্টা করেছেন। আবার একদম শেষের দিকে যখন তার মনে হয়েছে গণতন্ত্রকে বেশীদিন টুটি চিপে রাখা যাবে না-তখন ২০০৯ সালে তিনি ঘোষণা দেন কিছু কিছু মন্ত্রীর জন্যে নির্বাচন হবে! যদিও তা কোনদিনই হয় নি।
মোটামুটি হাওয়া মোরগ ছিলেন গদ্দাফি-ঠিক ঠাক সময়ে রং বদলাতে তার জুরি মেলা ভার।

গদ্দাফি এবং তার পরিবারের নিষ্ঠুরতা বা লালসা নিয়ে শব্দ খরচ করে লাভ নেই। তবে গিরগিটির শেষ রং টা নিয়ে না লিখে পারছি না।

গদ্দাফির দেশে অবৈধ সঙ্গমের শাস্তি হচ্ছে শরিয়া আইন অনুযায়ী ৫ বছরের জেল আর বেত্রাঘাত। আর এই গদ্দাফিই বিদেশে ভ্রুমন কালে বিদেশীনী সাংবাদিকদের সাথে শোয়ার ব্যপারটা রুটিন করে ফেলেছিলেন। তার ফর্মুলা ছিল সিম্পল-যদি আমার ইন্টারভিউ চাও, আমার সাথে শুতে হবে! শরিয়া আইন অবশ্যই তার জন্যে চলবে না। কারন এই সব সাংবাদিকদের সাথে শোয়ার ব্যপারটা তার কাছে এক সময় এমন প্রেস্টিজের ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়, বিদেশ সফর শেষে ফিরে এসে উনি গুনতেন এবার কজন হল এবং সেটা নিয়ে তার তাবুতে টোস্টিং ও হত!

যাইহোক হুগো শ্যাভেজ এবং ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন গদ্দাফির সমর্থক! কারন গদ্দাফি আমেরিকার বিরুদ্ধে এক সময় সন্ত্রাসের চেষ্টা করেছে। বেশ এক দশক আমেরিকা বিরোধিতা চালিয়েছিলেন গদ্দাফি এবং সাদ্দাম হুসেনের উৎখাতে পর বুঝেছিলেন আমেরিকা বিরোধিতা মানে নিজের কবর খোঁজা। সেই মত টাকা ঢেলে পালটিও খেয়েছেন ঠিক সময়ে। গুগো শ্যাভেজ বা ফিদেলের পিঠ চাপড়ানোতে পিঠ বাঁচবেনা-এটা বুঝতেন গদ্দাফি।

অধিকাংশ বাম বাঙালী এবং ইসলামিস্ট ন্যাটোর বিরুদ্ধে গদ্দাফির সমর্থক ছিল। ইসলামিস্টদের ব্যপারটা
বোধগম্য। তবে বামেদের সমর্থনটা আরেকটা বামপন্থী অগভীরতার ফল। গদ্দাফি লোকটা কে, সেটা জানার কোন চেষ্টাই তারা করে নি।


Saturday, October 15, 2011

ইসলাম এবং একটি কচলানো লেবুর গল্প

(১)

আমার এই প্রবন্ধটি মুক্তমনার পাঠক এবং যুক্তিবাদি গুরুভাইদের জন্যে। তাদের জন্যে একদম এক্সক্লুসিভ রচনা।

আজকাল নানান কারনে লেখার সময় প্রায় নেই-শুধু একটু আধটু ব্লগ পড়ি। কিন্ত সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশীর শিরোচ্ছেদকে কেন্দ্রকরে যেভাবে নানান বাংলাদেশী ব্লগে ইসলাম এবং ইসলাম বিরোধি গোষ্টর বিতর্ক হচ্ছে, তাতে দুটো জিনিস আমাকে ভীষন পীড়া দিল। তাই দুটো কথা লিখছি-

প্রথমত একদল মনে করে এর জন্যে ইসলাম দায়ী। আরেকদল মনে করে, ইসলামের এমন নিষ্টুর আইন বিধান সমাজের জন্যে ভাল।

দ্বিতীয়ত গোটা ঘটনাটা কেও ইতিহাস ধরে , ইতিহাসের প্রগতি থেকে বিচার করলো না। আরবে এক সময় বৃটিশরা ক্ষমতায় ছিল। তারা কেন সেখানে বৃটিশ আইন চালু করল না? কেন মধ্যপ্রাচ্য আদিম যুগে থেকে গেল? এর জন্যে কি শুধু ইসলাম দায়ী? যুক্তিবাদিদের দাবী সেই রকমই।

বিতর্ক লেখালেখি ভাল জিনিস। বিরক্ত হয়েছি অন্য কারনে। বর্তমান বিশ্বে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট, গ্রীস-ইটালিতে সরকার বিরোধি আন্দোলন, অর্থনৈতিক মন্দা, মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিক জাসমিন বিপ্লব, তীব্র খাদ্য সংকট এবং পরিবেশ বিপর্যয় চলছে। এইসব বর্তমান ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসের পরিবর্তন অনুঘটক। মুক্তমনা সমাজে এই নিয়ে খুব বেশী চিন্তা ভাবনা দেখি না। শুধু ইসলাম পেটানোতে লোকের উৎহাস বেশী।

ঢাকা এবং কোলকাতা দুটিই বসবাসের অযোগ্য শহর। এগুলোকে বসবাসযোগ্য করা নিয়ে কোন চিন্তাভাবনা ব্লগে দেখি না। শুধু ব্লগের পর ব্লগ ইসলাম নিয়ে। যতদোষ নন্দঘোষ টাইপের আনক্রিটিক্যাল লেখাতে ভর্ত্তি হচ্ছে মুক্তমনা।

(২)

ইসলাম কি?

ইসলাম প্রেমীদের কাছে তা সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, ইসলাম বিরোধিদের কাছে তা সর্ব নিকৃষ্ট ধর্ম।

তাতে অসুবিধা নেই। কিন্ত একজন যুক্তিবাদি, বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের কাছে "ইসলাম" কি তাহলে?

বিজ্ঞানে ধর্মের অস্তিত্ব নেই। সমাজ বিজ্ঞানে ধর্ম একটি বিবর্তিত সাংস্কৃতিক মিম। সেলফ অর্গানাইজেশন বা সমাজ/রাষ্ট্র গড়ার জন্যে কিছু নির্বাচিত মিম। সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্মের জন্যে এককালে ইহাদের দরকার ছিল। আজকে উন্নত যোগাযোগ এবং বাজারের যুগে তা অর্থহীন। কারন গোটা বিশ্বই একটি ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত হতে চলেছে। আজকে মানুষ সমাজ বদ্ধ হচ্ছে স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে-বাজারের মাধ্যমে। রাষ্ট্রর ধারণাটাই উঠে যেতে চলেছে। এবং আস্তে আস্তে রাষ্ট্রের সীমানা দুর্বল হচ্ছে বাজারের চাপে। ত্রিশ বছর আগেও ইসলাম নিয়ে মাতামাতি ছিল না। কারন আরবের তেলের পয়সা ছিল না। সবটাই একটা বাজারের প্রোডাক্ট। টাকা এল, মাদ্রাসা খুললো-কিছু গরীবের সংস্থান হল। তাহলে ইসলামে পেট চালাতে পারে-এমন ধারনা পেল সবাই। ফলে মধ্যযুগীয় আরবিক ধারনাও ফিরে এল। তেল শেষ হলে আরবের খাওয়ানোর ক্ষমতা চলে গেলে, এসব উৎপাত ও যাবে। যদি কোন হিন্দু গরীবকে খাওয়াতে পারে, তাহলে সেই সর্বহারা হিন্দুয়ানীতে বিশ্বাস করবে, ইসলাম খাওয়ালে সে ইসলামের ভক্ত হবে। কালকে যদি ২৫ লাখ বাংলাদেশী ভারতে আইন মেনে ভাল কাজ পায়, তারাও ভারতীয় সিস্টেমের দিকেই ঝুঁকবে। সুতরাং যেসব বাংলাদেশীরা আরবের টাকায় সংসার প্রতিপালন করে, তাদের আরবের প্রতি দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক।

ইসলামের বর্তমান উৎপাত খুব সাময়িক একটা এবারেশন। যা কিছু উন্নত উৎপাদন দিতে ব্যার্থ-তা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। যা করলে পেট চলে, বেঁচে থাকা যায়, মানুষ সেটাকেই ধর্ম হিসাবে নেয়। কলকাতার ঝি লোকাল ট্রেন গুলোতে দেখা যাবে দরিদ্র কবলিত অঞ্চলগুলি থেকে কপালে বিশাল সিন্দুর লাগিয়ে ঝিয়েরা বাবু-বিবিদের বাড়িতে কাজ করতে আসে। এদের অনেকেই মুসলমান-কিন্ত কাজের জন্যে হিন্দু সেজে এসে কাজ করে। দীর্ঘদিন কাজ করার পরে হিন্দুয়ানী রপ্ত ও করে ফেলে।

আমি কিছুক্ষণ আগেই একটা মুদির দোকান থেকে ফিরলাম। দুই পাকিস্তানি মহিলা এর মালিক এবং ভাল চালাচ্ছে। এরা যখন শুরু করেছিল, দোকানের দুদিকে মক্কা মদিনার ছবি, কোরানের আয়াত ইত্যাদি ছিল। কিন্ত কাস্টমাররা ত সব শিখ আর হিন্দু। টাকাও এদের পকেটেই বেশী। আর তার ওপর পাশেই একটা ভারতী মুদির দোকান। দুবছরে এই দুই মহিলা দোকানের ডেকরেশন সব বদলে দিয়েছে। আগে ঢুকলে বোঝা যেত এটা মুসলমানীদের দোকান-এখন সেসব চিহ্ন নেই। মালকিন কারা না জানলে, ঢুকলে মনে হবে এটা আরেকটা ভারতীয়র দোকান। এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা না- আমি এমন অনেক কেস দেখেছি।

ভারতে আমার বাড়ীর সামনে নদী পেরোলেই মুসলমান গ্রাম। সেখানে আগে ইসলামের গন্ধ ছিল না। সবাই হিন্দু শহরে এসে জীবিকা নির্বাহ করত। ১৯৯০ সাল থেকে আরবের টাকায় সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা হয়ে, তারা আর ভারতে থাকে না, নিজেদের বেশী আরবীয় বলেই মনে করে। যেদিন আরবের টাকাতে আর এসব চলবে না-সেদিন আবার আগের জায়গাতেই ফিরে যাবে।

সবর্ত্র আমি এটাই দেখছি, ধর্ম পেট চালানোর ক্ষমতা না দিলে, সেই ধর্ম এমনিতেই লোপ পায়। গুটিকয় শিক্ষিতলোকের ধর্মবিলাস দিয়ে ধর্ম নির্নীত হয় না। বাঙালী মুসলমানরা কি ধরনের মুসলমান? ১৮৮০ সালের আগে বাংলা ভাষাতে লেখা কোন কোরানই ছিল না। গিরীশ ভাই নামে এক হিন্দু প্রথম ফার্সী থেকে কোরানের বঙ্গানুবাদ করেন। এর কারন কি? আসলে অসংখ্য বাঙালী মুসলমানদের কাছে ইসলাম ছিল এক সহজিয়া ধর্ম- হিন্দু জাতিভেদ থেকে বাঁচার উপায়। কিন্ত আরবের সংস্কৃতিকে অত জড়িয়ে ধরার প্রয়োজন তাদের হয় নি। কারন সেই সংস্কৃতি থেকে তাদের বাঁচার উপাদান কিছুই ছিল না।

তাই আমরা দেখি ১৬০০ খ্রীষ্ঠাব্দ থেকে মুসলমান বাঙালী কবিরা হিন্দু উপাখ্যান নিয়েই সাহিত্য রচনা করেছে-কোরানের বঙ্গানুবাদ করে তারা সময় নষ্ট করে নি। কোরান হদিস তাদের র‍্যাডারেই ছিল না। হয়ত বিংশ শতাব্দির আগে অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান জানতই না কোরান বলে এক গ্রন্থের কথা। কারন তারা ছিল নিরক্ষর এবং বাংলা ভাষাতে কোরান তখনো কেও লেখে নি। তাদের কাছে ইসলাম ছিল এক সাম্যের ধর্ম-যেখানে জাতের কারনে তাদের সমাজে ছোট হয়ে থাকতে হত না। অর্থাৎ ইসলাম ছিল তাদের বাঁচার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এবং সেই বাঙালী ইসলামের সাথে কোরানের কোন সম্পর্ক ছিল না। থাকলে ১৬০০ সালের আগেই যখন আরাকানে বাঙালী মুসলমানরা কাব্য রচনা করছেন-তখনই বাংলাতে কোরান লেখা হত।

আমার বক্তব্য এটাই বিজ্ঞানে ধর্ম বলে কোন কিছু নেই। সমাজ বিজ্ঞানে যা আছে তা হচ্ছে "বেঁচে থাকার জন্যে সাংস্কৃতিক উপাদান" যা বিবর্তনের পথে নির্বাচিত ।

ইসলাম বা যেকোন ধর্মকে ধর্ম বলে মানা এবং দেখা হচ্ছে সব থেকে বড় অবৈজ্ঞানিক যুক্তি। সুতরাং একজন ধর্ম বিরোধি যখন ইসলামকে একটি ধর্ম হিসাবে দেখে এবং ধর্ম হিসাবে তার বিরোধিতা করে-তার যুক্তিও একজন ধার্মিকের সমান অবৈজ্ঞানিক।

(৩)

প্রতিটা মানুষের পরিধি সীমিত। মুক্তমনার অধিকাংশ লেখক বয়সে নবীন। তারা ইসলামিক সমাজের অবিচার, অনাচার এবং অত্যাচার দেখে বড় হয়েছে। এতে তাদের যুক্তিবাদি মন বিদ্রোহী হয়েছে এবং তারা মুক্তমনাতে ইসলাম বিরোধি লেখালেখি করছে। এমন ঘটনা হিন্দু ধর্মে ঘটেছিল ১৮২০-৩০ সালে ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে। কিন্ত তাদের যুক্তিবাদি চেতনাতে হিন্দু ধর্ম উঠে যায় নি। বড়জোর বিবর্তিত হয়েছে। এর কারন হিন্দু ধর্মের কিছু কিছু "এলিমেন্ট" এই দেশের মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে দরকার ছিল। এই প্রথম এলিমেন্টটার নাম হিন্দু জাতিয়তাবাদ যা বৃটিশ বিরোধি আধুনিক আন্দোলনের প্রথম ধাপ। ইতিহাস খুব ভাল ভাবে পড়লে বোঝা যাবে বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ সরস্বতীদের উত্থানের পেছনে একটা বড় কারন বৃটিশ বিরোধি আন্দোলন, বৃটেনের হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্খা।

তাহলে যুক্তিবাদি আন্দোলন শ্রেষ্ঠতর হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু ধর্মটা ডিরোজিওর শিষ্যদের হাত থেকে টিকে গেল কি করে?

এখানেও প্রথমে উঠে আসবে বেঁচে থাকার টেকনিক। মানুষ সমাজবদ্ধ ভাবে বেঁচে থাকে। ধর্ম সেই সামাজিক আইনগুলো - পিতা মাতার প্রতি কর্তব্য, সন্তানের প্রতি দ্বায়িত্ব, সমাজের প্রতি দ্বায়িত্ব-এই যুথবদ্ধতা শেখায়। যা গুরুত্বপূর্ন সাপোর্ট সিস্টেম তৈরী করে। বেঁচে থাকার জন্যে এগুলি দরকার। ধর্ম বিরোধি ঋণাত্মক আন্দোলনে এগুলি গুরুত্ব না দিলে, ধর্ম বিরোধিতা ফালতু। এই কারনে রিচার্ড ডকিন্স ফোরামে নাস্তিকদের মধ্যে পেরেন্টিং, স্যোশালাইজেশন ইত্যাদি বিষয়গুলির ওপর বেশী জোর দেওয়া হয়-এই সাপোর্ট সিস্টেম না তৈরী হলে ধর্মকে তোলা অসম্ভব।

এমন নয় যে এই সাপোর্ট সিস্টেম বা সামাজিক আইনগুলির জন্যে ধর্ম অপরিহার্য্য। মোটেও তা না। ধর্ম নিরেপেক্ষ আইনের ভিত্তিভূমি বৃটেনের ইউলিটেরিয়ান আন্দোলন। যা এই ধরনের যুথবদ্ধতার আইনগুলির ভিত্তিভূমি রচনা করেছিল। যদিও অনেকেই মনে করেন, তা খ্রীষ্ঠান ধর্মের সংস্কার আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া। তেমনই ইসলামের সংস্কার আন্দোলন থেকে ইউলেটেরিয়ান ধরনের ধর্ম নিরেপেক্ষ আইনের জন্ম হতে পারে উন্নততর সমাজের জন্যে। সবটাই সেই উন্নততর উৎপাদনের প্রয়োজনে বিবর্তিত হয়।

(৪)

তাহলে উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্যে ইসলাম বদলাচ্ছে না কেন? খ্রীষ্ঠানরা বদলেছে, হিন্দুরা ধর্ম থেকে আস্তে আস্তে সরে আসছে-মুসলমানরা বদলাচ্ছে না কেন?

আসলে মধ্যপ্র্যাচ্যের তেল ইসলামি বিশ্বের আধুনিক অগ্রগতির দারুণ ক্ষতি করেছে। যদ্দিন মধ্য প্রাচ্যে তেলের আবিস্কার হয় নি তদ্দিন মিশর, ইরান, ইরাকে সর্বত্র আধুনিক বাম ভাবধারার রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সাল থেকেই যা উপনিবেশ বিরোধি আন্দোলন থেকে উদ্ভুত। কিন্ত মধ্য প্রাচ্যে তেলের আবিস্কারের সাথে সাথে মুসলিম বিশ্বের তিনটি ক্ষতি হয় যা মুসলিমদেরকে আজও মধ্যযুগে আবদ্ধ করে রেখেছে-

এক- বৃটেন এবং আমেরিকা এই সব প্রগতিশীল আন্দোলনগুলিকে ছুড়ি মারে-কারন এগুলি ছিল জাতিয়তাবাদি আন্দোলন যা তৈলখনিগুলির জাতিয়তকরন চেয়েছিল। এতে বৃটিশ এবং আমেরিকার তেলের কোম্পানীগুলি নিজেদের ব্যবসা হারাবার আকাঙ্খায় এই প্রগতিশীল আন্দোলন ধ্বংস করে,সেখানে বশংবদ ডিক্টেটরিয়াল শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে।

দুই- এইসব প্রগতিশীল আন্দোলনের উৎস ছিল দুটি-পেটের ক্ষিদে এবং উপনিবেশ থেকে মুক্তির আকাঙ্খা। ইসলাম দিয়ে পেটের ক্ষিদে মিটবে না-এটা ১৯৩০-১৯৬০ অব্দি এই সব আন্দোলনের নেতারা বুঝেছিলেন। তারা বুঝেছিলেন, চাই আধুনিক রাষ্ট্র। হোসেন মুবারক থেকে বার্থ পার্টি-সব এই চিন্তাধারার ফসল। কিন্ত তেলের ডলার আসতেই আসল সহজ জীবন-খাবার বিলাস ব্যসন সব সস্তায় এবং সুলভে পেয়ে গেলে-লোকে জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে বেশী ভাবার সময় পায়। ফলে ধর্ম আবার চেপে বসল এদের ঘারে।

তিন- এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে জন সংখ্যাও বাড়তে থাকে গুনিতক প্রগতিতে। ফলত সেই সমৃদ্ধি তারা ধরে রাখতে পারে নি। ইরান এবং মিশরে -বিশেষত উত্তর আফ্রিকাতে খাবারের তীব্র সংকট শুরু হয়েছে। সেই সংকট থেকে, আজকের জাসমিন বিপ্লব ছিল আসন্ন।

মোদ্দা কথা লোকজনকে খাওয়াতে না পারলে কোন ধর্ম, কোন রাজনৈতিক সিস্টেম টেকে না। তেলের টাকায় ইসলামিক বিশ্ব তাদের জনগণকে খাওয়াচ্ছিল-এখন আস্তে আস্তে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। যা ফলশ্রুতি স্বরূপ সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিপ্লব হচ্ছে। এবং নিজেদের বাঁচাতেই তাদের শ্রেষ্ঠতর সিস্টেম বেছে নিতে হবে।

পেটের আগুনই তাদের ঠিক পথের সন্ধান দেবে।

(৫)

আমার শুধু একটাই অনুরোধ -ইসলাম নামে এই কচলানো লেবুর চর্চা মুক্তমনাতে কমালে ভাল হয়। পরিবেশ, নগর ব্যাবস্থা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বেকারত্ব, শ্রমিক শোষন-ইত্যাদি বিষয়গুলি ইসলামের থেকে অনেক বেশী জ্বলন্ত। এই বিষয় গুলি নিয়ে বেশী চর্চা হৌক।

নইলে মুক্তমনা ব্লগটি কচলানো লেবুতে পরিণত হবে।

সেই চিন্তাধারাই টেকে, যে চিন্তাধারা উন্নততর উৎপাদনের জন্ম দিতে সক্ষম। এটিই বিবর্তন বিধাতার আইন।