কেরিয়ার বা পড়াশোনার জন্য ইচ্ছাশক্তি কোত্থেকে আসবে? জীবন এবং জীবিকা-১০
বিপ্লব পাল, ১৮ই মে, ২০২৩
আগের পর্বগুলোতে লিখলাম, কি পড়া উচিত, কিভাবে উচিত, কোন বিশ্ববিদ্যালয়- ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন হচ্ছে আমি কেন নিজেকে এত টানব? কেন সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করব? ভেতরের এই ড্রাইভিং ফোর্স কোত্থেকে আসবে?
নরেন্দ্রপুর হাইস্কুল এবং তারপর আই আইটি খরগপুরে পড়াশোনা করার জন্য, প্রচুর ছেলেপিলে চিনি, যারা ছাত্রজীবনে তুখড় মেধাবী ছিল। স্মৃতি শক্ত, বোঝা এবং বোঝানোর ক্ষমতা, বিশ্লেষন করার দক্ষতা অসাধারন। কিন্ত এদের অধিকাংশই ( আমার হিসাবে প্রায় ৯৫% হবে), জীবনে যাদবপুর বা শিবপুর বা অন্যান্য স্টেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ছাত্রদের থেকে বেশী কিছু করে উঠতে পারে নি। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে বা বি এস সি অনার্স করে বেশ কিছু ছেলেপিলে ( এরা হয়ত সেই ১% এর কমই হবে), আই আই টির ছেলেদের থেকে অনেক বেশীদূর এগিয়ে গেছে।
কেন এমন হয়? পার্থক্য কোথায়?
পার্থক্য হচ্ছে সেই নিজেকে টানার ক্ষমতায়। নিজেকে প্রতিটা দিন উদবুদ্ধ করে, ইন্সপায়ার করে এগিয়ে চলার ক্ষমতায়।
এই সেলফ ড্রাইভিং ফোর্স- যে প্রতিদিন আমাকে আরো এগিয়ে যেতে হবে-কেন এগিয়ে যেতে হবে- সেটা যার কাছে পরিস্কার-তারাই এগিয়ে যায়।
ফ্রেড্রিক নিৎসে এইজন্যে বলছেন, যারা জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ, অর্থাৎ মিনিং অব লাইফ খুঁজে পেয়েছে- তাদের কাছে জীবনের কোন সমস্যই সমস্যা না। কোন পরীক্ষাই বড় পরীক্ষা না।
প্রশ্ন হচ্ছে আপনার সন্তান কিভাবে এই ভাইটাল ড্রাইভিং ফোর্স, জীবনের অর্থ নিজের মধ্যে খুঁজে পাবে?
পেশদারি কারনে অনেক সিইও কে চেনার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। যারা নতুন ব্যবসা, নতুন ফ্যাক্টরি গড়েছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের চাকরি তৈরী করছে। নতুন প্রযুক্তি দিয়েছে পৃথিবীকে। হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। এদের সবার ড্রাইভিং ফোর্স আউটস্টান্ডিং। এর একটা কমন প্যাটার্ন আছে। আমি বোঝার চেষ্টা করেছি কোত্থেকে ইনারা পান কাজ করার এই অফুরন্ত শক্তি? জীবনে খুব ভাল ভাবে প্রচুর লাক্সারী নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য যা টাকার দরকার তার একশো, কখনো হাজারগুন টাকা এদের আছে। তাহলে এরা নিশ্চয় টাকার জন্য খাটছেন না। কেন এত পরিশ্রম করেন এরা? কোত্থেকে আসে তাগিদ? এর একটাই উত্তর। সবাই একটা লেগাসি রেখে যেতে চান। অর্থাৎ ইতিহাস, সমাজ রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দেবে তিনি একটা কিছু রেখে গেলেন আগামী প্রজন্মের জন্য। এছারা আরো কিছু ফ্যাক্টর আছে। সেটা হচ্ছে সবাই ক্ষমতা চান। টাকা উপার্জন অবশ্যই ক্ষমতার সোপান। কারন টাকা দিয়ে তারা রাজনীতি, কোম্পানী, মেধা সব কিছুই কিনতে পারেন। তবে বাঙালী বাবা-মায়েরা নিশ্চয় অদ্দূর ভাবছেন না। তারা চাইছেন তাদের ছেলেমেয়েরা যেনন একটা ভাল কোম্পানীতে ভাল মাইনের চাকরী পায়। উচ্চ প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্ত সেখানেও জল আছে। কারন সরকারি চাকরি আস্তে আস্তে আরো কমবে। আর কোন প্রাইভেট কোম্পানীতেই যত বড়ই হোক না কেন চাকরির নিশ্চয়তা নেই। সেখানে কিন্ত স্কিলড কর্মীদের ইনকামের নিশ্চয়তা আছে। এগুলো নিয়ে পর্ব ২-৬ তে আলোচনা করেছি। এই পর্বের আলোচনা সেটা নয়।
এই পর্বে আমাদের ফোকাস-একজন ছাত্রছাত্রী কেন, পড়াশোনা বা কেরিয়ার গড়তে উৎসাহ পাবে?
মুশকিল হচ্ছে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ৮-১০ টা মাস্টারমশাই এর কাছে টিউশনি পড়ছে। জেইইই নিটের জন্য স্পেশাল কোচিং নিচ্ছে। তাদেরকে আমরা একটা ফ্যাক্টরির মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তারা জীবনের অর্থ খুঁজে পাবে কি ভাবে? আর না পেলে কিন্ত হাজার টিউশনি দিয়েও তাদের কেরিয়ার তৈরী হবে না।
আলবার্ট কামু সাহিত্যে নোবেল জিতেছিলেন ১৯৫৭ সালে। তিনি বিখ্যাত তার এবসার্ডিজম নাম এক ধরনের এক্সিস্টেন্সিয়াল দর্শনের জন্য। আমি কেন তার কথা এখানে আনছি? কারন তার মূল কাজই হচ্ছে কিভাবে একজন জীবনে অর্থ খুঁজে পেতে পারে তাই নিয়ে। বিশেষত ছোটবেলা থেকে কিভাবে ছেলেমেয়েদের বড় করলে, তারা জীবনকে ভালবাসতে পারবে, অর্থ খুঁজে পাবে।
কামুর অবর্জাভেশন- এই পৃথিবী আসলে খুব নির্দয়। আমরা সব সময় মানবজীবনের অর্থ, বেঁচে থাকার কারন খুঁজছি, কিন্ত একটু বেশী ভাবলেই দেখা যাবে, আসলেই কোন অর্থ পাওয়া মুশকিল। কারন আমরা বেঁচে থাকলেই বা কি-মরে গেলেই বা কি। পৃথিবীর বয়স ৫০০ কোটি বছর। এই মহাবিশ্ব এত বড়। এর মধ্যে আমার অস্তিত্ব এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কারুর বাঁচা মরা সাফল্যে আসলেই কিছু যায় আসে না। এই অর্থহীনতাকে বলে নিহিলিজম। কিন্ত এইভাবে যদি কেউ ভাবে-সেত কালই আত্মহত্যা করবে। কিছু করতেই চাইবে না। সেই জন্যে কামু থেকে ফ্রেড্রিক নিৎসে বলছেন ধর্ম থেকে সব দর্শন একটাই কাজ করে-মানবজীবন যাতে অর্থবহ হতে পারে। আমরা যেন বেঁচে থাকার রসদ পাই। এটাকে নিৎসে বলছেন পজিটিভি নিহিলিজম। এটা নিয়ে আমার আগের লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন “ বিজ্ঞান এবং ধর্ম ঃ সংঘাত না সমন্বয়” । এটা লিখেছিলাম আগের বছর-টাইম লাইনে আবার শেয়ার করলাম, যাতে এই পোষ্টের পরে পোষ্টেই উৎসুক লোকজন এই নিয়ে আরো গভীরে জানতে পারে।
যাইহোক, কামু বলছেন বাচ্চা থেকে কিশোর বয়সে উত্তরোনের সময় বাচ্চারা যাতে আস্তে জীবনের অর্থ নিজেদের মতন করে খুঁজে বার করতে পারে- তার একটাই পথ। ছোটবেলা থেকে তাদের “ভালোবাসতে” শেখাতে হবে। খেলা, প্রকৃতি, গান, কবিতা-এগুলি ভালবেসে যাতে বাচ্চারা বড় হয়। আমাদের দেশে উল্টোটাই হয়। অধিকাংশ মূর্খ অভিভাবক ভাবে বাচ্চারা খেলাধূলা করছে তা সময় নষ্ট। আসলে উলটো। খেলাতে শরীর চর্চা ত হচ্ছেই-তার সাথে এই যে তারা খেলাটাকে ভালবাসতে শিখছে এটাও গুরুত্বপূর্ন। খেলা, গান, প্রকৃতি, কবিতা-ভাল লাগা কেন গুরুত্বপূর্ন? কেন না এই ভালোলাগার সাথে জড়িত দুটো হর্মোন। ডোপামিন এবং সেরাটনিন। ডোপামিনে ক্ষনিকের ভাললাগা, আর সেরাটনিন এক দীর্ঘ মানসিক সাটিসফ্যাকশন দেয়। নানান বৈজ্ঞানিক স্টাডিতে যা দেখা গেছে- বাচ্চারা যদি এই কবিতা গান ছবি আঁকা এসব ভালবাসতে থাকে-তাহলে “ এবস্ট্রাক্ট চিন্তা” থেকে যে আনন্দ -যার উৎস ডোপামিন-সেটি তাদের শরীর বৃত্তীয় পদ্ধতিতে ভালভাবে কাজ করে। এটা কিভাবে তাহলে ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনায় সাহায্য করবে?
ওয়েল, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, কোডিং, ম্যাথ, এগুলো ভাল লাগলে তবেই না ছাত্রছাত্রীরা এগুলো আরো ভাল করে শিখবে। কিন্ত এসব সাবজেক্ট এবস্ট্রাক্ট বা বিমূর্ত ধারনার ধারাপাত। সেখান থেকে এই যে ভালোলাগা, সেটা ছাত্রছাত্রীদের তখনই হবে যখন -এক শিক্ষক মশাই [ বা এখন ইউটিউব] সাবজেক্টটা এমন ভাল পড়াবেন-তাদের ওই এবস্ট্রাকশনটা দেখে শরীরে ডোপামিনের জোয়ার আসবে। যেটাকে আমরা ভাললাগা বলি। আর দুই হচ্ছে শরীরে ডোপামিনের ভাল রেগুলেশন এবস্ট্রাক্ট চিন্তা থেকে। যেটা বাচ্চারা পায় ছোটবেলায় ছবি, কবিতা , গান ইত্যাদি ভালো লাগা থেকে। অর্থাৎ বাচ্চাদের এই ভালোলাগাটা তৈরী করার ও পদ্ধতি আছে। তার সাথে বীচে যান। হাইকে যান। তাকে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য, কবিতায় শব্দের মাধুর্য্য, গানের সুর এবং লয় ভাললাগতে শেখান। যাতে তার ডোপামিন সাইকল তৈরী হয়। কারন এটাও একধরনের শরীরবৃত্তীয় অভ্যেস।
আমার ছোটবেলা থেকেই ফিজিক্স এবং ম্যাথ খুব ভাল লাগত। যখন ফিজিক্সের আরো ভাল বই পেলাম-ফেইনম্যান, ল্যান্ডাউ ইত্যাদি বিখ্যাত পদার্থবিদদের লেখা বইগুলো পড়ে অন্যরকম ভালোলাগা শুরু হয়। এখনো ফিজিক্সের নতুন কোন সাবজেক্ট বুঝতে পারলে, এক নতুন জগতের সন্ধান পেলে, তা আমার কাছে সেক্সুয়াল প্লেজারের থেকে অনেক বেশী ডোপামিন ঝড়ায়! কবিতা বা সাহিত্যের জন্য ও একই কথা বলব। কোন ভাল কবিতার শব্দজাদুতে অজানা জগতের সন্ধান পেলে, তা কোন সুন্দরী মেয়ের সাথে প্রেম করার থেকেও বেশী উত্তেজনা দেয়। যারা কবিতা ভালোবাসেন, ফিজিক্স ভালোবাসেন-আমি নিশ্চিত, তাদের অভিজ্ঞতা আমার মতন।
সুতরাং অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। যাতে পড়াশোনাটা বাচ্চাদের কাছে বোঝা না হয়। তারাযেন প্রতিটা সাবজেক্টে পড়ার মধ্যে, শেখার মধ্যে আনন্দ পায়। মার্কস পাওয়ার থেকে সেটা আরো বেশী জরুরী।
অবশ্য এটা নতুন কিছু না। প্লেটোর তার শিক্ষা সংক্রান্ত থিসিসে ঠিক এটাই লিখে গেছিলেন- খেলা, গান এর সাথে পড়াশোনার সমন্বয়। আদি গ্রীসের এথেন্সে শিক্ষা এমনই ছিল।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার। আজকালকার বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রতি যতটা সময় দেন, তারা “সামাজিক” হয়ে উঠছে কি না-সেই ব্যাপারে নজর কম। অধিকাংশ ফ্যামিলির একটিই মাত্র সন্তান। ফলে প্রায় সবাই স্বার্থপর দৈত্য হয়ে উঠছে। এতে সর্বত্র তাদের গ্রহনযোগ্যতা হ্রাস পাবে। কর্মস্থলে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠা কেরিয়ারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। আমি এর পরের এক পর্বে লিডারশিপ সংক্রান্ত আলোচনাতে এটি নিয়ে ডিটেলেসএ লিখব। শুধু একটা গল্পবলে এই পর্ব শেষ করছি—
এস্টার উজিকির দুই কন্যা বিখ্যাত সিইও। সুজান উজিকি ( ইউটিউবের প্রাত্তন সিইও) এবং এনে উজিকি। উনি একটি বেস্ট সেলিং বই এর লেখিকা- নাম How to Raise Successful People: Simple Lessons for Radical Results (কিকরে সন্তানদের সফল ভাবে মানুষ করবেন -সহজ পন্থা-কিন্ত দুর্দান্ত রেজাল্ট)।
এস্টার তার মেয়েদের স্কাউট, কমিউনিটি সার্ভিসে পাঠাতেন। যাতে তারা দারিদ্রের সাথে পরিচিত হয় এবং দরিদ্রমানুষদের জন্য কাজ করতে পারে। এতে তার মেয়েরা চারটে টি জিনিস একসাথে শিখেছিল।
হিউমিলিটি বা বিনম্রতা,কমপ্যাশন ( সহমর্মীতা-অন্যের দুঃখ কষ্ট অনুভব করা),দলবদ্ধ হয়ে কাজ করা বা গ্রুপে কাজ করার ক্ষমতা, সামাজিক সমস্যার সমাধানের চিন্তা -ভেতর থেকে মানুষের জন্য কাজ করার একটা ডিপ প্যাশন।
এস্টার লিখছেন, এর পরেও দরকার আরো চারটি জিনিস।
এক, ছেলেমেয়েদের উঁচু স্বপ্ন দেখান। রাজনীতি, শিক্ষা, খেলা, ব্যবসা, কর্পরেট-সর্বত্রই সে যেন নিজের ছাপ রাখতে নিজে থেকে ইচ্ছুক হয়।
দুই, দ্বায়িত্ব নিতে শেখান। ছোট ছোট দ্বায়িত্ব দিন। বাড়িতে এক দিন রান্না করুক। নাহলে একদিন বাথরুম বা বাড়ি পরিস্কার করুক। বাড়ির পুরো বাজার করুক দুদিন। যেদিন তারা দ্বায়িত্বে কি কিনবে, কি রান্না হবে, তাদেরই ঠিক করতে দিন।
তিন, তাদের কনফ্লিক্ট রিজল্যুউশন শেখান ছোটবেলা থেকে। ধরুন প্রতিবেশীর সাথে আপনার ঝামেলা হচ্ছে। দোকানির সাথে ঝামেলা হচ্ছে। নিজেদের ছেলেমেয়েদের দ্বায়িত্ব দিন ঝামেলা মেটানোর। লেট দেম গ্রো আপ। কর্মস্থলে ঝামেলা পলিটিক্স থাকবেই। বরং ছোটবেলা থেকেই তারা শিখুক কিভাবে এসব সন্মানের সাথে হ্যান্ডল করতে হয়।
চার, ছেলেমেয়েদের আনকন্ডিশনালি ভালবাসুন। তারা ভাল রেজাল্ট করলে, ভাল-খারাপ রেজাল্ট করলে গালাগাল এগুলো ছাড়তে হবে। সে যেন সব ক্ষেত্রেই আপনার ভালবাসা পায়। সাফল্য এবং ব্যর্থতায়। ভুল করলে ভুল ধরিয়ে দিতে হবে। বোঝাতে হবে। সেটা ভালোবেসেই করতে হবে। তার সমস্যাটা বুঝতে হবে আগে। এটা না করলে, সে তার সমস্যা নিয়ে আপনার সাথে খোলাখুলি আলোচনা করবে না।
এর পরের পর্বে (১১) ছাত্রছাত্রীদের মেন্টাল হেলথ বা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করব। যারা আগামী পর্বগুলি পেতে চান, তারা আমার প্রোফাইলে গিয়ে ফলো বাটনে ক্লিক করে রাখুন।
No comments:
Post a Comment