Tuesday, December 28, 2010

স্টিফেন হকিং এর "মৃত" দর্শনের সন্ধানে


গ্রান্ড ডিজাইন বইটির প্রথম পাতায়, হকিং দর্শন শাস্ত্রকে মৃত ঘোষনা করে, লেখা শুরু করেছেন। কারন হিসাবে উনি বলেছেন দার্শনিকরা বিজ্ঞানের নব আবিস্কার এবং তত্ত্বের সাথে আর পাল্লা দিতে পারছেন না। পরে বিশ্ববিখ্যাত কিছু দার্শনিক গালাগাল দেওয়া শুরু করলে, উনি বোধ হয় একটি বিবৃতি দেন উনাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উনি বলতে চেয়েছিলেন, দর্শন শাস্ত্রে বিজ্ঞানের আরো ব্যাপক প্রয়োগ হওয়া উচিত। যদিও কোথায় উনি এটা বলেছেন, সেটা গুগল করে পেলাম না।


যাই হোক কেও দর্শন শাস্ত্রকে মৃত ঘোষনা করলে, দর্শনের ইতিহাস নিয়ে অবগত যে কেও হেঁসে ফেলবেন। কারন দর্শনকে মৃত ঘোষনা করার ইতিহাস ৩০০০ বছরের পুরানো এবং ধারাবাহিক। তাই দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক পল থ্যাগাড, হকিং এর উক্তি শুনে প্রথমেই মন্তব্য করেন ঃ


But those who ignore philosophy are condemned to repeat it. And those who disparage philosophy are usually slaves of some defunct philosopher.


দর্শনকে মৃত ঘোষনা করার ইতিহাস এত দীর্ঘ ( যা গ্রীকদের আমল থেকে শুরু হয়েছে) -যে "দর্শন মৃত" সেটাও দর্শনের একটি বিশেষ শাখা হওয়ার যোগ্যতা রাখে বলে বিট্রান্ড রাশেল মন্তব্য করেছিলেন। "দর্শন মৃত" র ইতিহাস নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার নেই -যারা "দর্শনকে মেরে ফেলার" এই তিন হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে জানতে চান-এই লেখাটা পড়তে পারেন।

http://www.earlham.edu/~peters/writing/endphilo.htm


আমরা স্টিফেন হকিং এর কথায় ফিরে আসি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক বিজ্ঞানী সন্দেহ নেই। কিন্ত দর্শন নিয়ে তিনি যে কটি কথা বলেছেন, সেগুলি ঠিক কি এবং তাই নিয়ে দর্শন শাস্ত্রের লোকেরা কি ভাবে এটাও জানা দরকার। জানা দরকার, ঠিক ৩০০ বছর আগে বিখ্যাত দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্টের ভুলেরই তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন।


হকিং এর দর্শন নিয়ে বক্তব্যের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক প্রবন্ধ লিখেছেন-আমি এর মধ্যে থেকে সব থেকে ভাল যেটি মনে হয়েছে-সেটির ওপর ভিত্তি করেই লেখাটি লিখছি। তাই তার রেফারেন্সও আগে দিয়ে রাখিঃ


http://www.psychologytoday.com/blog/hot-thought/201011/is-philosophy-dead


এবার বিচার শুরু করা যাক। প্রথমে অধ্যাপক পল থ্যাগাডের (http://en.wikipedia.org/wiki/Paul_Thagard)
সমালোচনাটির ভাবানুবাদ করি। বঙ্গানুবাদ করলে দর্শনের অনেক টার্মের জন্যে অনেকেই বুঝবে না। তারপরে নিজের বিশ্লেষনে আসব।


******************
স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্ড মিনলোর বাস্তবতা নিয়ে অনুকল্পগুলি নিম্নরূপঃ
.
ক) " বাস্তবতা" তত্ত্ব নিরেপেক্ষ হতে পারে না

খ) একটি মডেলকে "বাস্তবতার" ভাল মডেল বলা যাবে
যদি তা

১) সুন্দর হয়
২) যদি এম্পিরিক্যাল ফিটিং প্যারামিটার কম থাকে
৩) পরীক্ষালদ্ধ সব রেজাল্টের সাথে মিলে যায়
৪) পরীক্ষাগারের রেজাক্ট ভবিষ্যতবানী করতে পারে বা টেস্টেবিলিটির ক্রাইটেরিয়া মানে

গ) একটি ভাল মডেল একটি নিজস্ব "নিরেপেক্ষ" বাস্তবতা

ক) মানা যায় যদি আমরা মেনে নেই-তত্ত্বর ভিত্তি ধারনা।
খ) বিজ্ঞানের দর্শন-নতুন কিছুর বলার নেই।
গ) এই অনুকল্পটি আপত্তিকর। কারন মডেল যে বাস্তবতাকে ধরে, তা সর্বদা আংশিক এবং আপেক্ষিক। তবে এটাকেও আমরা জ্ঞান এবং বাস্তবতার জন্যে একটি দার্শনিক অনুকল্প হিসাবে ধরতে পারি।


এরপর হকিং তার এই দার্শনিক অনুকল্পটিকে বৈজ্ঞানিক উপসংহার হিসাবে চালিয়ে দিলেন। ( ভুলের শুরু এখান থেকেই) ।
তার সিদ্ধান্ত গুলি আদৌ বৈজ্ঞানিক না দার্শনিক?

হকিং এর বক্তব্যগুলি বিশ্লেষন করা যাকঃ

D. "The universe does not have just a single existence or history, but rather every possible version of the universe exists simultaneously."
( এই মহাবিশ্বের কোন একক অস্তিত্ব নেই-বা একক ইতিহাস নেই। অসংখ্য মহাবিশ্ব একসাথে আছে।)

E. "The universe itself has no single history, nor even an independent existence."
( এই মহাবিশ্বের কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই- নেই কোন একক ইতিহাস)

F. "We now have a candidate for the ultimate theory of everything, if indeed one exists, called M-theory."
( এম তত্ত্ব থিওরী এভ্রিথিং এর যোগ্য দাবীদার)

G. "M-theory predicts that a great many universes were created out of nothing"
( এম তত্ত্ব শুন্য থেকে বহুবিশ্বের উৎপত্তির ভবিষ্যতবাণী দেয়)
H. "The universe, according to quantum physics, has no single past, or history."
( কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী মহাবিশ্বের কোন একক অতীত বা ইতিহাস নেই)
I. "The universe doesn't have just a single history, but every possible history, each with its own probability."
( মহাবিশ্বের প্রতিটি ইতিহাসেরই কিছু না কিছু সম্ভাবনা আছে।)

হকিং এর দাবী- যেহেতু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রচুর প্রমান পাওয়া গেছে, সেহেতু উপোরক্ত উপসংহারগুলি সত্য।
কিন্ত এখানে একটা ভুল হল। হকিং এর দাবীগুলি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি বিশেষ ব্যাখ্যা মেনে-এবং মনে রাখতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অসংখ্য ব্যাখ্যা আছে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্য ব্যাখ্যা ধরে এগোলে বহুবিশ্ব নিয়ে সিদ্ধান্তগুলি আলাদা হবে। এবং এম তত্ত্ব টেস্টেবেলিটি মানে না। অর্থাৎ সেটিকে ভাল মডেল আমরা বলতে পারি না ( (খ) এর ৪ দেখুন-ভাল মডেল হতে গেলে কি হতে হয়)। সুতরাং মহাবিশ্ব নিয়ে হকিংসের সিদ্ধান্তগুলি যত না বৈজ্ঞানিক, তার থেকে অনেক বেশী "দার্শনিক"।

তাহলে আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে বিজ্ঞান এবং দর্শনের সীমারেখা এবং সম্পর্ক কি ভাবে নির্নীত হবে।

এই ব্যাপারে দর্শনের দুটি ভাগ।

একটি হচ্ছে ন্যাচারালিস্টিক দর্শন। এরিস্টটল, লকে, মিলস, হিউম, ডিউ, কুইন থেকে সব বিজ্ঞানের দার্শনিক এই পর্যায় ভুক্ত। এখানে মূল বক্তব্য হচ্ছে-প্রকৃতি, জ্ঞান, বাস্তবতা, নৈতিকতা এবং ব্যাখ্যার ভিত্তি হবে বিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং পর্যবেক্ষন। অর্থাৎ হকিংস যা দাবী করেছেন, তা নতুন কিছু না-সেটি ন্যাচারিলিস্টিক দর্শনের মধ্যে পরে। কিন্ত এখানে দর্শনের সাথে বিজ্ঞানের পার্থক্য হচ্ছে বিজ্ঞানের সীমানা "কি হচ্ছে" এবং "কেন হচ্ছে" তার মধ্যে বাঁধা। দর্শন তার বাইরে গিয়েও কি হওয়া উচিত সেই প্রশ্ন করে। যেমন " জীবনের উদ্দেশ্য কি",
"ঈশ্বর থাকা উচি্ত না অনুচিত" -ইত্যাদি প্রশ্নের উৎপত্তি দর্শন থেকে। কিন্ত এর উত্তর বিজ্ঞান দিয়ে দিতে হবে। এটা হচ্ছে ন্যাচারালিস্টদের বক্তব্য।

এন্টি-ন্যাচারালিস্টরা এই বক্তব্য মানেন না। তাদের বক্তব্য দর্শন এবং বিজ্ঞান এক না, কারন দর্শনে জ্ঞানের ভিত্তি হতে পারে অনেক কিছু, যা বিজ্ঞানের সীমানাতে পড়ে না-

শুধু যুক্তি ( যেমন ভারতীয় দর্শনের একটি উপপাদ্যঃ মহাবিশ্ব অনন্ত কিন্ত মানুষ সীমাবদ্ধ-সুতরাং অনন্ত মহাবিশ্বকে সম্পূর্ন ভাবে কোনদিন জানা সম্ভব না)

ভাষা এবং যুক্তি ( দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন একটি উদাহরন। যেমন "দর্শন মৃত" শুধু এই দুই শব্দের অসংখ্য মানে হতে পারে। )

অভিজ্ঞতা বাইরেও যে সত্য আছে সেখানে চর্চা করা ( যেমন সব ধর্মীয় দর্শন এই ক্যাটেগরীতে পড়ে। অর্থাৎ ঈশ্বর কি, তার স্বরূপ কি, ঈশ্বর আছেন না নেই-...)

প্রয়োজন ( বা প্রয়োজন এবং যুক্তি) -যেমন ধরুন ঐশ্বরীয় দর্শনের প্রয়োজনীয়তা আছে না নেই? আত্মহত্যার প্রয়োজন আছে না নেই? জীবনের কোন অর্থ আছে না নেই?

অথবা শুধু ধারনা-বহুবিশ্ব বা মাল্টিভার্স বা প্যারালাল ইউনিভার্স এর ভাল উদাহরন। এগুলোর খুব দুর্বল মডেল-দার্শনিক চিন্তা বেশী। সুতরাং এগুলোকে বিজ্ঞান বলা যাবে না-বিজ্ঞানের ডিমার্কেশন অনুযায়ী। কিন্ত টেস্টেবিলিটির ফলে যখন আস্তে আস্তে এগুলি ভাল মডেল হতে থাকবে, ধারনাগুলি দর্শন থেকে বিজ্ঞানের সীমানাতে ঢুকে যাবে।

হকিং বাস্তবতার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই ত বলে দিলেন-কিন্ত কোন "জ্ঞানের" ভিত্তিতে বললেন? সেই জ্ঞান বৈজ্ঞানিক না দার্শনিক? আমরা দেখলাম সেই জ্ঞান অনেক বেশী দার্শনিক, যত না বৈজ্ঞানিক।

হকিং এর "মডেল" নির্ভর বাস্তবতা দর্শন শাস্ত্রে ৩০০ বছরের পুরানো। বাস্তবতা যে "মন" নির্ভর-এই ধারনা প্রথম আনেন ইম্যানুয়েল কান্ট। হকিং তার জেলি ফিসের যে উদাহরন দিয়েছেন বাস্তবতা কে বোঝাতে-যে বাস্তবতা অভিজ্ঞতা নির্ভর-সেটি প্রথম বলে যান ইম্যানুয়েল কান্ট। প্রায় ৩০০ বছর আগে।

কিন্ত আমরা বিজ্ঞান থেকে কি জানি? মানুষের মনের উদ্ভব অতিনবীন ঘটনা। এই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব মানুষের জন্মের অনেক আগে থেকেই ছিল। মডেল টা এম থিওরী না এন থিওরী, তার ওপর নির্ভর করে এই মহাবিশ্বগুলি চলছে না। তত্ত্ব উন্নত হতেই থাকবে, বদলাবে, বাতিল হবে। সুতরাং এই মহাবিশ্বের একটি স্বাধীন অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। সেই জন্যে দর্শন শাস্ত্রে বাস্তবতার অনেক ভাগ আছে । কান্টিয়ান বাস্তবতা বা হকিং যে বাস্তবতার কথা বলেছেন, সেটাকে বলে ফেনোমেনোলজিক্যাল বাস্তবতা। এর বাইরেও দর্শন শাস্ত্রে আরো ৩০ রকমের বাস্তবতা আছে। এবং বাস্তবতার সাথে মন এবং মহাবিশ্বের জটিল সম্পর্কের সমস্যাটি বিজ্ঞানের সীমানাতে পড়ে না।

মার্ক টুইন মারা গেছেন বলে একবার মিথ্যে রটেছিল। উনি সেটা শুনে বলেছিলেন, আমার মৃত্যুসংবাদটি বড় বেশী রকমের অতিরঞ্জন।

*****************************************************
প্রবন্ধটি লেখার আমার কোন দরকার ছিল না। বাস্তবতা বা রিয়ালিজম নিয়ে সামান্য জ্ঞান থাকলে বা একটু ওয়াকি ঘাঁটলেই বোঝা যেত হকিং এর দর্শন নিয়ে পড়াশোনা মারাত্মক রকমের কম এবং তিনি চাকা পুনরাবিস্কার করেছেন মাত্র। আমি সেটা মুক্তমনাতে লিখতেই, বিশিষ্ট কিছু সববোদ্ধার দল গালাগাল দেওয়া শুরু করল। আরেকজন বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক দাবী করলেন দর্শনের আলোচনাতে নাকি আজকাল বিজ্ঞানীদেরই ডাকা হয়! অবশ্য ভারতে যেকোন লোকের কাছে তার গুরুদেব হচ্ছে সব থেকে বড় দার্শনিক। অনেক হিন্দু বাঙালি বিশ্বাস করে বিবেকানন্দ বা রামকৃষ্ণর মতন দার্শনিক আর কোনদিন জন্মায় নি। আবার অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথের মতন বড় দার্শনিক জন্মায় নি। আরেক বিশিষ্ট বোদ্ধা, দর্শন এবং ধর্মকে এক করে বোঝাতে চাইল বিজ্ঞান যেভাবে ধর্মের শেষ ঘোষনা করেছে, সেই ভাবে দর্শনের শেষ ঘোষনা করবে!

যাইহোক এস্ট্রলজার এবং এস্ট্রনমার যেমন এক না -তেমন ধর্মীয় গুরুদেব বা বিজ্ঞানী বা রবীন্দ্রনাথ -এদের সাথে প্রথাগত শিক্ষিত দার্শনিকদের পার্থক্যটা ততটাই।

আসলে সমস্যা হয়েছে এই, আমাদের দেশে একদম শেষের বেঞ্চের অগা-মগা ছেলেরা দর্শন, ইতিহাস এই সব পড়তে যায়। আমাদের ধারনা জন্মেছে দর্শন হচ্ছে একদম সোজা ব্যাপার-কারন লাস্ট বেঞ্চাররা পড়ে এবং পাশ ও করে! বাস্তব হচ্ছে আমি যত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তার মধ্যে সর্বাধিক কঠিন এবং গভীর হচ্ছে দর্শন। এটি এমন একটি বিষয় যা পড়ে বোঝা যায় না-প্রশ্ন এবং দ্বন্দ তৈরী করে বুঝতে হয়। এবং তারপরেও অধিকাংশ প্রশ্ন এবং দ্বন্দ অমীমাংসিত থাকে। এবং সেটাই দর্শনের আসল শক্তি।

Saturday, December 25, 2010

বিনায়ক সেনের বিচার এবং একটি ভারতীয় প্রহসন


পৃথিবীতে মাথা নীচু করে শ্রদ্ধা পাওয়ার মতন মানুষ ক্রমশ লুপ্ত।

কে জানে মানুষ ব্যাপারটাই হয়ত আস্তে আস্তে লুপ্তপায় প্রানী হবে যাদের দেখা পাওয়া যাবে শুধু জেল হাজতে। যেমনটা গান্ধী বলেছিলেন।

ভারতে ব্যাবসায়ী, রাজনীতি, পুলিশ বিচার ব্যাবস্থা-সব কিছুই তাদের দখলে! এই তাহাদের বিরুদ্ধে ছত্রিশগড়ে যে লোকটি গরীবদের ঘূরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাতো-তাদের চিকিৎসা করে গেল বিনা পয়সায়, ছত্রিশ গরের দুই মহামান্য ছাগল বিচারক, যারা সিস্টেমের কাছে সব কিছু বিকিয়ে দিয়েছন-তারা যাবজ্জীপন কারাদন্ড দিলেন বিনায়ক সেন কে।


তার বিরুদ্ধে মাওবাদিদের সাহায্য করার অভিযোগ।
তেহেলকার এই লিঙ্ক দেখলেই বোঝা যাবে কোন অভিযোগের কোন প্রমাণ বা সারবত্তা নেই।
' তার বিরুদ্ধে আদালতে পেশ করা প্রমানগুলি এতই হাস্যকর যে এটা পরিস্কার বিচারকরা সম্পুর্ন একটি পক্ষপাতপূর্ন রায় দিয়েছেন।

এই রকম একটা গল্প ফেঁদে রাষ্ট্র, নাগরিক অধিকারের দাবীতে যারা আন্দোলন করেন, তাদের কাছে একটা বার্তা পাঠালো।

বার্তাটা সামান্য- ডঃ বিনায়ক সেনের মতন একজন আন্তর্জাতিক ভাবে বিখ্যাত মানবাধিকার কর্মীকে আমরা জেলে পাঠানোর ক্ষমতা রাখি। তাই সাধু সাবধান। তোমরা ত চুনোপুঁটি।

মাওবাদি ইনসার্জেন্ট কেন -সেই প্রশ্নে রাষ্ট্রের রাজপুত্র এবং রাজমাতা একমত যে মানুষের বঞ্চনা এবং সবুজ ধ্বংশের বিরুদ্ধে ওরা বন্দুক ধরেছে। বন্দুক না ধরে, গান্ধীর পথে যারা গরীবদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলণটা করতে চাইছিলেন সেই হিমাংশু এবং বিনায়ক সেনের যা অবস্থা করে রাখল ছত্রিশগড় পুলিশ এবার বন্দুক ধরা আটকাবে কি করে??

রাষ্ট্র একটি নিপীড়নের যন্ত্র-একটি নেসেসারী এভিল। যার সাথে আমাদের বাস করতে হয়। কিন্ত রাষ্ট্রের অত্যচারের বিরুধে যেকটি অহিংস গণতান্ত্রিক ব্যাক্তি দাঁড়িয়েছে, তাদের যদি প্রশাসন জেলে ভর্তি করে-তাহলে বন্দুক তুলে নেওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তিটা কি পড়ে রইবে? এটাত পরিস্কার হল, রাষ্ট্রের প্রতিটা যন্ত্র যারা সবুজকে ধ্বংশ করে ওখানে মাইনিং করতে চাই তাদের পক্ষে। বিনায়ক সেনের মতন লোককে না আটকাতে পারলে, ওখানে যেসব হাজার হাজার কোটি টাকার মৌ সাক্ষরিত হয়েছে , তার থেকে সকাকারী দালালরা টাকা লুঠবে কি করে? সেই বখরার টাকাযে মহামান্য বিচারপতি পান নি সেটাই বা কে নিশ্চিত ভাবে বলবে?

বিনায়ক সেনের কেসে রাষ্ট্র এবং তাদের দালালরা জিতে গেলে ভারতের মানুষের পরাজয় হবে। বিনায়ক সেনের ওপর এই আরোপিত দন্ড ভারতের আন্তর্জাতিক লজ্জা। ভারতের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমন চত্রিশগড়ের এই রায়। এর বিরুদ্ধে আপনারা সবাই সরব হোন। বিক্রি হওয়া বিচারপতিরা বুঝুক, ভারতে এখনো মানুষ বাস করে।

Wednesday, December 22, 2010

বিনিয়োগবঙ্গ


বাঙালী আত্মঘাতি কালিদাস বলিয়া ইতিহাসে সমাদৃত। মহাভারত হইতে লর্ড ক্লাইভ-বাঙালী জাতির গুণগান করিয়াছে-ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বোর্ডে লিখিয়াছিলেন বাঙালীর ন্যায় পরশ্রীকাতর জাতি তিনি দুনিয়াতে দেখেন নাই। তাই ইহাদের মধ্যে বিবাদ ঘটাইয়া, মুর্শিদাবাদের মসনদ তিনি অচিরেই দখল করিবেন। ক্লাইভ বুঝিয়াছিলেন বাঙালী সেই জাতি যাহারা নিজেদের বাগানের কলা লইয়া ঝগড়া করিতে বেশী পছন্দ করে। হনুমান আসিয়া কলা খাইয়া গেলেও বাঙালী প্রতিবেশীর সহিত ঝগড়া করিবে-হনুমান তাড়াইবে না।


ক্লাইভের দিন অতীত হইয়াছে-সিরাজদৌল্লা, মিরজাফরদের দল ইতিহাস হইয়াছে-কিন্ত বাঙালী জীবন্ত ফসিল হইয়া আজও বাঁচিয়া আছে। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে প্রথমে বিনিয়োগের বিরুদ্ধে আগুন জ্বলিল-মমতার দল ইহাতে ঘি ঢালিলেন। টাটা সেলিমের দল পালাইল। বাম বাঙালী উচ্ছ্বাসিত হইল-এবং খেত মজুর পিতা কাজ না পাইয়া তাহার কন্যাকে মুম্বাই পাঠাইতে থাকিলেন। জনগণের অধিকার রক্ষা হইয়াছে ইহা আহ্লাদের কথা-গর্বের কথা-কিন্ত শিল্পস্থাপন না হইলে ঘণবসতিপূর্ন বাংলাতে লোকেরা খাইবে কি? সিঙ্গুরে জমি গ্রহণ প্রক্রিয়া ঠিক হয় নাই-ইহা সত্য। কৃষক জমি দিতে বাধ্য নহে। ইহাও মানিতে হইবে। কিন্ত তাহা হইলে, জমি গ্রহনের জন্যে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সর্বদলীয় ফর্মূলা নির্নিত হৌক?


তাহাতে কাহারও উৎসাহ নেই। উৎসাহ শুধু, কাঠি করিতে।


টাটা সেলিম পালাইয়াছে, তাহাতে কিছু ক্ষতি হইলেও তৃণমুল এবং কংগ্রেসের লোকসভা বিজয়, বাংলার সামনে আবার সুযোগ আনিয়াছিল। এবার মমতার রেল প্রকল্পে কাঠি করিতে বুদ্ধ মাঠে নামিলেন।


বাস্তবে অবস্থা দাঁড়াইল এই- বাংলার রাজনীতি দুই নেংটি পাগলের লড়াই এ পর্যবাসিত হইতেছে। দুই পাগল নেংটি পড়িয়া নাচিতেছে-আর একজন অন্যজনের নেংটি ধরিয়া টানিয়া বলিতেছে-তোকে ন্যাংটো করিয়া ছাড়িব।



Tuesday, December 21, 2010

একলা চলোরে ! একটি তৃণমূলী এং কংগ্রেসী নাটক


কংগ্রেসের সর্বভারতীয় অধিবেশনে মানসদা এবং দীপাবোদি গাহিলেন-

একলা যাব, একলা যাব
তবে সাধিলেই গাইব।

মমতা কহিলেন লে পচা! রাজ্যে আমার পোষ্যরা মরিতেছে, আমি দিল্লীতে দরবার করিতেছি, আর তোরা আসনের জন্যে ভিক্ষাপাত্র ঝনঝনাইতেছিস! কান ঝালা করিসনে, করিলে মুলিয়া দিব। জোট সঙ্গী থাকিব না-তবে ভোট সঙ্গিনী থাকিলেও থাকিতে পারি। সাধিতে হইবে কিন্ত-দাবী করিলে হইবে না। যাহা ভিক্ষাপাত্রে দান করিব, তাহাই গুরুমার আশীর্বাদ বলিয়া মাথায় ছোঁইয়াইতে হইবে। দশ পয়সার দিন নাই বলিয়া হাইকমান্ডের কাছে ট্যাঁ ফোঁ করিলে-খেলিব না। উহা ফাউল বলিয়া গণ্য হইবে।

দীপা বৌদি বলিলেন প্রিয়দা নাই বলিয়া কি আমি নাই ভাবিতেছে মমতা? শঙ্কর সিং বলিলেন-আমি কি নদীয়ার ঘাস খাইয়া পার্টি করিতেছি? মমতা শুনিয়া কহিলেন, মাটিই নাই-আর ইহারা ঘাসের গল্প করিতেছে। আফিঙখোরের দল।

পার্থদা নিশ্চুপ ছিলেন। দিদি কহিলে ভাইদের ও কহিতে হয়। উনি তৃণমূলী আম্পলিফায়ার-দিদির কথাকে আরো উচ্চস্বরের বলিয়া থাকেন এবং পাখি সব, কর রব ডাক ছাড়িতে থাকেন। দিদি কহিতেই পার্থর হুঙ্কার বাহির হইল-কংগ্রেস অস্তিত্বহীন হইয়াছে-আমরা একলাই লড়িব। এই সব কংগ্রেস ভিখিরীর সহিত লাড্ডু ভাগ করিয়া খাইতে তৃণমূলীরা নারাজ।

ইহার পেছনে কিঞ্চিত বোধ বুদ্ধিও কাজ করিতে ছিল। জোট না হইলে ক্ষীরের স্বাদ পাইবার লোভে, কংগ্রেস আরো ভাঙিবে। তাহাতে লাভ তৃণমূলের। ফলে পার্থর হুঙ্কার বাড়িতে থাকিল। আর মানস বিপদ বুঝিয়া মিডিয়ার সামনে গাইতে শুরু করিলেন- দুপয়সা দে না-দে- পঁয়ত্রিশ বছর না খাইয়া আছি-মরিবার পূর্ব একবার লালবাতির গাড়িতে উঠিব-তাহাও তোদের সহ্য হইতেছে না?

জনদেবতা পশ্চিম বঙ্গের ভাগ্যললাট লিখিয়া দিয়াছে-ইহার পরেও তৃণমূলী এবং কংগ্রেসীরা সিপিএমকে বঙ্গোপসাগরে না ডুবাইতে পা্রিলে-জনগন ইহাদের হিমালয়ের নির্বাসনে পাঠাইবে।

Monday, December 20, 2010

জাফর পানাহির জন্যে দুকলম


ইরাণের বিশ্ববরেণ্য পরিচালক জাফর পানাহিকে ছ বছরের জন্যে জেলে পাঠানো হল। সাথে সাথে আগামী ২০ বছর তিনি কোন সিনেমা বানাতে পারবেন না। পারবেন না লিখতে , পারবেন না ইন্টারভিঊ দিতে।

পানাহির সাথে আমার পরিচয় দুটো সিনেমা দিয়েঃ সার্কল আর অফসাইড। দুটিই নারীবাদি নিওরিয়াল সিনেমা। মোল্লাতন্ত্রের শরিয়া আইনে ইরাণে মহিলাদের দুরাবস্থার বাস্তব চিত্র। সেদেশের মায়েরদের অধিকার নেই সস্তানের ওপর। তিনি তালাকের জেরে যেকোন মাকে সন্তান ছেরে চলে যেতে হয়। সেই ধরনের বর্বর শরিয়া আইন ইরানে- যার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জেলে আছেন ইরানের ৬৪ জন নারীবাদি নেত্রী। কিছুদিন আগেও মোল্লা এবং তাদের স্যাঙাত আহমেদাঞ্জিদের হাত থেকে উদ্ধার পেতে উত্তাল হয়েছে ইরাণ। সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করেছে ইরানের পুলিশ। গ্রেফতার হয়েছে হাজার হাজার বিরোধি, নিহত শতাধিক।

একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার পানাহির মতন একজন মানবিকতাবাদিকে জেলে পুরবে এটাই স্বাভাবিক। গান্ধী অনেকদিন আগেই বলে গেছেন, স্বৈরতন্ত্রে একমাত্র জেল হাজতেই মানুষ পাওয়া যায়। স্বৈরতান্ত্রিক একটা সিস্টেম নিজেকে বাঁচাতে পানাহির মতন স্বাধীন চিন্তার অধিকারী মানুষদের খুন করবে-জেলে দেবে এটাই স্বাভাবিক।
এই নিয়ে আমি ব্লগ লিখছি না। প্রতিবাদও করছি না। পানাহির বিরুদ্ধে অভিযোগ হাস্যকর। সরকার বিরোধি ফিল্ম বানাচ্ছিলেন! স্বৈরতন্ত্রের কার্যকলাপ হাস্যকরই হয়। লিউ জিয়াবোকে আটকাতে চীনের কার্যকলাপও আমরা দেখেছি। সেই নিয়েও আমি চিন্তিত না।

আমি এই ব্লগ লিখছি কিছু বাঙালী বামপন্থীদের উদ্দেশ্যে। যারা আহমেদাঞ্জী এবং ইরানের সমর্থক।

ইরানের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের ওপর যখন গতবছর অত্যাচার শুরু হল-আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম কিছু বাঙালী বামপন্থী-এটাকে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিয়ার চক্রান্ত বলে চালানোর চেষ্টা করছে।

একজন মা তার সন্তানের ওপর নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে-এবং সেই আন্দোলন যদি বাঙালী বামপন্থীরা সিয়ার আন্দোলন বলে মনে করে, আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারি, কেন বাংলার বামপন্থী আন্দোলন আজকে সম্পূর্ন জনবিচ্ছিন্ন। আমেরিকার বিরোধিতা করেছে মানে, তাকে বামপন্থীদের সমর্থন করতে হবে-এই ধরনের ছাগলামি করতে করতে বাঙালী বামপন্থীরা আস্তে আস্তে লুপ্তপ্রায় প্রানীতে পরিণত হয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রো বা হুগো শাভেজ, আহমেদেনিঞ্জাকে সমর্থন করছেন-তাই বাঙালী বামপন্থীরা ইরাণের মোল্লাতন্ত্রের সমর্থক হয়ে যায়। কি হাস্যকর! আহমেদনিঞ্জা একটি কাঠমোল্লা সে হিসাব মাথায় থাকে না। মাথায় থাকে না ইরানে মায়েরদের অধিকার নেই সন্তানের ওপর।

ক্ষমতা লাভের জন্যে সব দেশেই শাসক শ্রেনী মানবিকতাবাদিদের পেছনে লাগবে। চীনের আসল মুখ আমরা দেখলাম। ইরানের দেখলাম। ওয়াকিলিকসের সুবাদে আমেরিকার শাসক শ্রেনীদের মুখোস ও খসে গেল। এবং আমরা নিশ্চয় চাইব না এদের যেসব ক্লোন আমাদের ভারতে আছে -যেমন কমিনিউস্ট বা ধর্মীয় জাতিয়তাবাদি পার্টিগুলি একটুও ক্ষমতার কাছাকাছি যাক। ধর্ম, জাতিয়তাবাদ বা গরীবদের জন্যে কুম্ভীরাশ্রু ক্ষমতা দখলের জন্যে "মিডিয়া ম্যাজিক"। আহমেদাঞ্জি এই তিনটি জিনিস নিয়েই যৌন সুরসুড়ি দেন। ধর্ম আর জাতিয়তাবাদ ত ছিলই-তার সাথে তিনি জুরেছিলেন ইসলামিক বামপন্থা। তেলের টাকায় সরকারি খরচ বাড়িয়ে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তেলের দাম কমে যেতেই, সব ম্যাজিক শেষ-বেকারত্বের তীব্র বৃদ্ধি এবং জনগণের বিক্ষোভের শুরু। হুগো শাভেজ ও সেই এক পথের পথিক-তেল বেচে ওয়েল ফেয়ার স্টেট বানাতে গেছেন। আর তেলের দাম কমতেই, তার সব পরিকল্পনা বাতিল। এর বিপরীতে অবস্থানে কাতারের প্রিন্স ওয়ালেদের। যিনি তেলের টাকায় কাতারে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প গড়ছেন দোহাতে-মোদ্দা কথা তেলের টাকা বিকিয়ে না দিয়ে, সেই টাকায় দেশকে শিল্প উন্নত করা উচিত। যারে আরো চাকরী সৃষ্টি হয় এবং দেশের অর্থনীতি তেল নির্ভর না হয়। আহমেদেনিঞ্জা এবং শাভেজ দুজনেই পপুলিস্ট-তেলের টাকা দেদার সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ারে বিলিয়ে এখন তেলের দাম বসে যেতেই, দেশকে সমস্যার মুখে ফেলেছেন। এই দেশগুলিতে বেকারত্ব বাড়ছে সাংঘাতিক ভাবে। ফলে জনগণ বিক্ষুব্ধ। তবুও শাভেজের জনপ্রিয়তা আছে-কিন্ত ইরানে গনতন্ত্র নেই। ফলে জনগনের বিক্ষোভ যাবে কোথায়?

ফলে ইরানে আরো বেকারত্ব বাড়বে এবং মোল্লাতন্ত্রের আরো উৎপাত আমরা দেখব। এবং সেই মোল্লাদের সমর্থক বাঙালী বামপন্থীদের আরো অনেক সার্কাসও দেখার জন্যেও তৈরী হৌন।

Monday, December 6, 2010

মননে, সদা গোপনে!






আমি যেটা লিখতে যাচ্ছি-সেটাকে ব্লগ হিসাবে না দেখে আলোচনা হিসাবে দেখুক সবাই। আমি এখানে বারো জনকে নিয়ে আলোচনা করব, যাদের জীবন এবং দর্শন আমার চিন্তাকে সব থেকে বেশী প্রভাবিত করেছে। আমি চাইব, বাকীরাও লিখুক কিভাবে তারা প্রভাবিত হয়েছে। শুধু বারোজনের মধ্যেই চিন্তা ধারাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, তারও কোন মানে নেই।

স্যার কার্ল পপারঃ সত্যি কথা হচ্ছে, স্যার পপারের লেখাগুলো পড়া এবং বোঝার আগে, দর্শন নিয়ে আমি পড়েইছি শুধু। বুঝেছি অল্প। স্যার পপারের বিজ্ঞানের দর্শন গভীরে জানার পর, দর্শনের দরজা প্রথম চওড়া হয়ে খুলে যায় আমার মনে। বিজ্ঞানের দর্শন বা ফলসিফিকেশনের পেছনে কাজ করে "ইনডাকশনিজমের" সীমাবদ্ধতা। যা ঢাকতে ফলসিফিকেশন দর্শনের জন্ম। শুধু এই শেষের দুটিবাক্য গভীরে বুঝলেই বাজারে চালু সব দর্শনকে অতি দ্রুত বোঝা সম্ভব। এবং সেই ফলসিফিকেশন ফিল্টার দিয়ে তাকালে বাম, ডান, মৌলবাদি, কমিনিউস্ট, প্রগতিশীল, ধার্মিক-সবার সীমাবদ্ধতা এবং গন্ডী একদম পরিষ্কার ভাবে প্রতিভাত। তাই আমার জীবনে দুটো অধ্যায়-প্রিপপারিয়ান, যেখানে পড়েইছি শুধু, বুঝেছি কম। এবং পোষ্ট পপারিয়ান-যেখানে প্রচলিত দর্শনগুলি জলভাতের মতন সোজা হয়ে গেছে।

মোহন দাস গান্ধীঃ গান্ধীর সাথে পরিচিতি অতুল্য ঘোষের গান্ধীর জীবনী দিয়ে। খুব ছোট বেলায়। তখন খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম তা না। কারন অধিকাংশ বামপন্থী পরিবারেই একটা গান্ধীবিরোধি এন্টাগনিজম কাজ করে। গান্ধীবিরোধিতা অনেক বাম-বাঙালী বালখিল্যতার অন্যতম আরেকটি। কোন সন্দেহ নেই গান্ধী চূড়ান্ত ভাববাদি-কিন্ত নিজের জীবনে গান্ধীবাদ অভ্যেস না করলে গান্ধীকে বোঝা মুশকিল। শত্রুকে হিংসা করা খুব কঠিন কাজ কি? শত্রুকে ভালবাসতে কজন পারে? গান্ধীর ধারাপাত পড়ে বা বলে কিছু হয় না। নিজের জীবন দিয়ে, নিজের জীবনে প্রয়োগ করে বুঝতে হয়। তবেই বোঝা যায়, শত্রুকে জয় করার কত সহজ পথ গান্ধী দিয়ে গেছেন। গোটা পৃথিবীতে যখনই কোন বিদেশীর সাথে দেখা হয়, তারাও গান্ধীকে নিয়ে উদ্বেলিত। হয়ত আমরা সবাই আশাবাদি। তাই সারভাইভাল স্ট্রাটেজিতে আলটুইজম প্রাণী জগতে আখছার দেখা গেলেও, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত মানব সমাজের সামনে, গান্ধী চিরকাল পথ দেখাবেন।

লালন ফকিরঃ আউল, বাউলের দেশ এই বাংলা। বাউল সঙ্গীত ছোট বেলায় যে বুঝতাম- তা না। বাউল দর্শন ও না। সোরেন কিয়ার্ডগার্ডের অস্তিত্ববাদ পড়ার পর এবং নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারি, আসলে মানুষের ওপর কোন দর্শন নেই। মানুষ হচ্ছে সব দর্শনের সিঙ্গুলার পয়েন্ট। কমিনিউজম, ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদের পতন এবং পচনের একটাই কারন- এরা বোঝে না-এ সব কিছুই মানুষের জন্যে। তাই মানবতাকে দমন করে, মানবতার শবের ওপর যখন কমিনিউজম, ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে, তার থেকে মৃতদেহের পচা গন্ধ বেড়োয়। মানুষ যে সব দর্শনের সিঙ্গুলার পয়েন্ট-এটাই বাউল কথা। এই অন্তর্মুখী দর্শনই পারে আমাদের এই সব ভুলভাল কমিনিউজম, হিন্দুত্ববাদ, ইসলাম থেকে মুক্তি দিতে।

কার্ল মার্ক্সঃ এটা আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যে মার্ক্সবাদ বুঝেছি পপার পড়ার পর। তাই লেনিনবাদি মুর্খদের কবলে পড়তে হয় নি। সমাজ বিবর্তনের যে রূপরেখা মার্ক্স দিয়েছিলেন, সেটাকে আমি সঠিক বলেই মনে করি। কিন্ত লেনিনবাদিরা তার যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেটা ভুল। মার্ক্সবাদে কোন বিপ্লব নেই-সবটাই সামাজিক বিবর্তনের সায়েন্স ফিকশন। মার্ক্স যেভাবে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র এবং তার থেকে কমিনিউজম আসবে বলে হিস্টরিসিজম করেছিলেন, সেটাকে আমি ঠিক বলেই মনে করি। স্যার পপার এই ধরনের হিস্টরিসিজমকে অবাস্তব বলেছেন। সেটাও ঠিক হতেই পারে-কারন কমপ্লেক্স সিস্টেমে ডেটারমিনিজম না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্ত তবুও মানুষের নির্মান শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক না। কিছু বিশ্বাস, তা ক্ষীণ হলেও থাকতেই পারে। সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে অনেকেই মার্ক্সবাদ সঠিক কি না, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন-কিন্ত বাস্তবত এটাই যে পৃথিবীতে যেসব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি প্রতিষ্ঠা হয়েছে-সেগুলোতো আসলেই ফ্যাসিস্ট ন্যাতসি রাষ্ট্র। মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যে আন্তর্জাতিকতা বাধ্যতামূলক। আরো একটা ব্যাপার লেনিনবাদিরা সম্পূর্ন গুলিয়েছে। সেটা হচ্ছে মার্ক্স খুব পরিস্কার ভাবে লিখে গিয়েছিলেন, উৎপাদন ব্যাবস্থার উন্নতি বা উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থায় ধনতন্ত্রের মাধ্যমে না পৌঁছালে, সমাজতন্ত্রের আগমন সম্ভব না। এখন কতটা উন্নতি বা কি ধরনের উন্নতি দরকার বা ধনতন্ত্রের কি ধরনের সংকট দরকার, যা সমাজতান্ত্রিক বিবর্তন সূচিত করবে, সেই ব্যাপারে তার বক্তব্য বা তত্ত্ব ভুল ছিল। ধনতন্ত্র সমস্ত সংকট কাটিয়েছে উন্নত আবিস্কারের মাধ্যমে। এখন আস্তে আস্তে সেই আবিস্কার করাটাও একটা বিশাল জটিল পদ্ধতি হয়ে যাচ্ছে। আগে দু একজন মিলে আবিস্কার করতে পারত-এখন আস্ত কয়েক বিলিয়ান ডলারের কোম্পানী গুলোও আবিস্কার করতে পারছে না-কারন প্রযুক্তি আরো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অর্থাৎ আবিস্কার করার ক্ষমতা ধনতন্ত্র হারাচ্ছে। আমার মতে এটাই আসল সংকট। মন্দা সাময়িক-একটা সার্কলে আসে যায়। কিন্ত আবিস্কারের পদ্ধতি বন্ধ হয়ে গেলে ধনতান্ত্রিক ব্যাবস্থা মুখ ধুবরে পড়বে। এবং আস্তে আস্তে সেই দিকেই আমরা এগোচ্ছি, যা সমাজতন্ত্রের সহজাত বিবর্তন ত্বরান্বিত করবে। কোন বিপ্লবী তত্ত্ব না -এই গণতান্ত্রিক ক্রমবিবর্তনই মার্ক্সবাদ! বাকীটা বিকৃতি!

ফ্রেডরিক নিৎসেঃ যদি আমাদের জীবনের সমস্ত অতীত সিদ্ধান্তকে বিশ্লেষন করি কি দেখব? প্রতিটা সিদ্ধান্তের পেছনে "ভয়" এর দীর্ঘ করাল ছায়া। কতকিছুর ভয়! সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা হারানোর ভয়, অর্থনাশের ভয়, চাকরি হারানো অনিশ্চিত জীবনের ভয়- ভয়ের সুদীর্ঘ লিস্টের সমষ্টি আমরা। শুধু ধর্মভীরুদের দোষ দিয়ে কি হবে? ঈশ্বরকে ভয় না করলে কি হবে, বাকী হাজার হাজার জিনিস হারানোর ভয় আমার মতন নাস্তিকদের। আমি লেখক না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার কেন? ইঞ্জিনিয়ারিং এর থেকে লিখতে আমার একশোগুন ভাল লাগে। তবুও আমি লেখক নই, ইঞ্জিনিয়ার। কারন দারিদ্র্যের ভয়। তাই নিৎসে বলছেন, প্রতিটা মানুষ তার নিজের কাছে একটা বিরাট "এমব্যারাসমেন্ট"। ভয়ের চোটে মানুষ বাধ্য হয় নানান কম্প্রোমাইজ করে-যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেকে অপমান করা। এটা প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা সাশ্বত সত্য। নিৎসের নিহিলিস্ট দর্শন বা মরালিটির ভক্ত আমি না। কিন্ত ভয়কে জয় করতে পারলে, আরো উন্নত মানুষ হওয়া সম্ভব। ভয় আমার সিদ্ধান্তকে কতটা প্রভাবিত করছে-এটা বুঝতে নিৎসে ছারা উপায় নেই।

মেঘনাদ সাহাঃ বিজ্ঞানী হয়ে সমাজের জন্যে কি করা উচিত? এই ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। থাকতেই পারে। তবে বিজ্ঞানীকুলে এই ব্যাপারে মেঘনাদ সাহা আমার প্রথম পছন্দ। বাল্যের সুকঠিন দারিদ্রই তাকে বাধ্য করেছিল সমাজ সচেতন হতে। তার নাম নোবেল প্রাইজের জন্যে ৬ বার বিবেচিত হয়েছে-স্যার রমনের আগেই তার নাম দুবার নোবেলের জন্যে উঠেছে। উনি নোবেল প্রাইজ পান নি। তাতে কি? ভারত যাতে বিজ্ঞানযজ্ঞে পিছিয়ে না পড়ে তার জন্যে নিজে হাওড়ার ওয়ার্কশপ থেকে এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন বানিয়েছেন। যেখানেই ছিলেন, নিজেই ছুতোরের কাজ করে যন্ত্র বানাতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ভারতের নদীপরিকল্পনাও তার কীর্তি। ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন আকুতোভয়। উনার লেখা বাংলা বই ছোট বেলায় পড়েছি। ত্রিকোনিমিতি উনার বই পড়ে শেখা-এবং সেটাও অদ্ভুত ছিল। এমন সমাজ সচেতন বিজ্ঞানী বিরল।


এন্টন চেকভঃ চেকভের ছোট গল্প প্রিয় বলে, চেকভকে এই লিস্টে রাখি নি। আর কোন সাহিত্যিকের সাথে আমার নাড়ির যোগ এত তীব্র না। যে শ্লেষ এবং মাইক্রোস্কোপ দিয়ে চেকভ আমাদের খুঁটিনাটি দেখেছেন-প্রতিটা সম্পর্কই আমার কত চেনা।
আমার চেনা জানা পৃথিবী, বাস্তবতা একটা পেঁয়াজের মতন। যত ছাড়াবে, তত ঝাঁজ। প্রতিদিনের সম্পর্ক কত সার্বজনীন, কত অসাধরন সুন্দর হতে পারে, সেই ছোট ছোট অনুভুতির মণিমুক্তগুলো চেকভ থেকেই কুড়িয়েছি।


রবীন্দ্রনাথঃ রবীন্দ্রনাথ কেন? অনেক বাঙালী আমার লিস্টে ১-১০ সবকটাতেই রবীন্দ্রনাথ বসাতে পারলে খুশী হবেন। আমি অবশ্য সেই কারনে রবীন্দ্র প্রভাবিত না। রাশেলের মতন আমিও রবীন্দ্রদর্শনে নতুন কিছু পাই নি। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ মহৎ-কিন্ত অমন সাহিত্যিক বাংলায় না আসলেও বিশ্বে অনেকেই আছেন। আমি রবীন্দ্রপ্রেমী শুধু দুটো কারনে- গান আর তার ভাষাকৌশল। গান নিয়ে কিছু বলার নেই। আমার কাছে রবীন্দ্র সংগীত ভাষা, সুর এবং ছন্দে বিশ্বশ্রেষ্ঠ। সেটা অবশ্য আমার অভিমত। তবে রবীন্দ্রনাথের ভাষা নিয়ে আমার বলার আছে অনেক কিছু। ভাষার শৈল্পিক প্রয়োগ সব সাহিত্যকর্মীর প্রাথমিক কর্ম হতে পারে-তবে রবীন্দ্রনাথের হাতে তা যে পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে-সেখান থেকে ভাবপ্রকাশের সময় একটা বিশ্বাস মনে সব সময় কাজ করে। ভাষাই আসল ভাবব্রহ্ম!

গৌতম বুদ্ধঃ আমার পিএইচডি থিসিস গৌতম বুদ্ধকে সমর্পিত। জীবনে ওঠা নামা থাকে। পাওয়া না পাওয়ার অসংখ্য বেদনার বলয়ের বৃত্তে আমাদের কিৎ কিৎ খেলা। আমার জীবনে আনন্দ এবং দুঃখ দুটোই কম। প্রথম কারন, প্রত্যাশা নেই। দ্বিতীয় কারন জেন দর্শন। সব কিছুরই দুটোদিক দেখতে পাই। জীবনের ব্যালান্স শিটে নিট লাভ বা নিট লোকসান বলে কিছু নেই। কিছু পেলে, কিছু হারাতে হয়। আমি আমেরিকাতে বসে "উন্নত" জীবনে উনুনের শিক কাবাব হচ্ছি না শিক কাবাব খাচ্ছি-সবটাই জীবনের দিকে কিভাবে তাকাচ্ছি, তার ওপর নির্ভরশীল। যদি ভাবি ভাল ভাল খাচ্ছি, ঘুরছি-তাহলে লাভে আছি। আবার যখন দেখি চারিদিকে শুধুই "আমি"-ছোটবেলার মাঠ, নদী, বন্ধু, তুতো আত্মীয়রা হারিয়ে গেছে-"আমি" নামে এক তালগাছ তেপান্তরের মাঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে-তখন কিছুটা বেদনা হয় । হারানোর চাপ। এই উভচর পৃথিবীকে বুঝতে জেন দর্শনই শ্রেষ্ঠ।


জালালুদ্দিন রুমিঃ লালন ফকিরের পূর্বসূরী রুমি। মানবতার দর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রচারক কে জানতে চাইলে, আমি একবাক্যে রুমিকেই বেছে নেব। প্রেমিকের কোন ধর্ম নেই-প্রেমই তার একমাত্র ধর্ম অথবা, আমি পূবের না, পশ্চিমের না, ইসলামের না, খ্রীষ্ঠের না--- জাতি ধর্ম ভুলে যে মানব ধর্মের সাধনার ডাক, তার পথিকৃত তিনিই। পরবর্ত্তীকালে শ্রী চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, ররীন্দ্রনাথ বা লালনের মধ্যেও রুমির বাণীই আমরা একাধিবার শুনবো। জাতিশুন্য, ধর্মীয় পরিচয়শুন্য যে ভবিষ্যতের পৃথিবীর স্বপ্ন আমি দেখি, রুমি সেই স্বপ্নের প্রথম এবং প্রধান কান্ডারী।

স্বামী বিবেকানন্দঃ ক্লাস সেভেনে বিবেকানন্দ রচনাবলীর সাথে আমার পরিচয়। প্রাচ্যের দর্শন জানতে হলে বিবেকানন্দ রচনাবলীর বিকল্প নেই। কিন্ত প্রশ্ন উঠবে প্রাচ্য দর্শন কেন? সম্প্রতি স্টিফেন হকিংস বলেছেন, দর্শনের মৃত্যু হয়েছে-বিজ্ঞান তার স্থলাভিষিক্ত। কথাটি যতটা সত্য, ততটাই ভুল। সত্য এই জন্যে যে জ্ঞানের প্রতিটি আনাচে কোনাচে বিজ্ঞান যেভাবে হানা দিয়েছে, তাতে জ্ঞান ভিত্তিক যেকোন এম্পিরিক্যাল দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। কিন্ত পরিপূর্ন জ্ঞান বা বিজ্ঞানের সাহায্যেও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না। এমন একটি প্রশ্ন -জীবনের উদ্দেশ্য কি ? বিন্দু হতে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি, আবার বিন্দুতেই মহাবিশ্বের মৃত্যু হবে। এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য যে এই সভ্যতা, মহাবিশ্বের মৃত্যু হবেই। এর মধ্যে খানে আমরা যাই কিছু করি না কেন-কিছু যায় আসে না। সবার পরিণতি সেই বিন্দুতেই শেষ। তাহলে কোন জীবন দর্শন ঠিক-কোনটা বেঠিক আমরা কি করে বলবো? সেই উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। এখান থেকেই দর্শনের শুরু। ইসলাম বা একেশ্বরবাদি ধর্ম গুলো আমি এই জন্যেই পছন্দ করি না-এদের অজ্ঞতা এদের বুঝতে দিচ্ছে না, কোন জীবন দর্শন ঠিক , আর কোনটা বেঠিক, এটা বইভিত্তিক, বা জ্ঞান ভিত্তিক হতে পারে না। ভারতীয় দর্শন এটাই শিক্ষা দিয়েছে, জীবন দর্শন আত্মোপলদ্ধি বা রিয়ালাইজেশন থেকে আসে। নিজের প্রতি ডিসিপ্লিনড অনুসন্ধানই, জীবন দর্শনের জন্ম দেয়। এবং সেই জন্যে প্রত্যেকের আলাদা জীবনদর্শন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই আমরা বলি যতমত, তত পথ। নিজের জীবনদর্শন খোঁজার এই স্বাধীনতা শুধু ভারতীয় দর্শনেই দেয়। প্রতিটা একেশ্বরবাদি ধর্মের কি করিতে হইবে টাইপের জীবনদর্শন, আদিমকালের ছেলেমানুষ দর্শন এবং সমাজে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়। তবে ভারতীয় দর্শনেও কি করিতে হইবে টাইপের ঢাউস বই আছে-সেগুলো একেশ্বরবাদি ধর্মগুলোর মতন বিপজ্জ্বনক। ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানকে "ইসলামাইজেশন অব হিন্দুজিম" বলে ভাবা যেতে পারে। ভারতীয় দর্শনের সাধনায় রুলবুকের স্থান নেই-তা স্থান কাল নিরেপেক্ষ আত্মোপলদ্ধির জগৎ।

ভ্লাদিমির লেনিনঃ আমি ঘোর লেনিন বিরোধি। ১৯১৮-১৯২১ পর্যন্ত লাল সন্ত্রাসের মাধ্যমে লেনিন যত কৃষক শ্রমিক এবং রাজনৈতিক কর্মী খুন করেছেন, তার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকাও অসম্ভব। তার লেখাও আহামরি কিছু না-পান্ডিত্যের বদলে নির্বুদ্ধিতা এবং ওপর চালাকি আমার বেশী চোখে পড়ে। কিন্ত তবুও সমাজ বদলের জন্যে রাজনৈতিক সংগঠন করতে গেলে, লেনিনের জীবন এবং কর্মের দিকে বারবার তাকাতে হবে। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে বলশেভিক পার্টি যখন সম্পূর্ন ধ্বংশ, তখন শুধু মাত্র জনরোষকে কাজে লাগিয়ে মাত্র ছমাসের মধ্যে রাশিয়া দখল করে নিলেন। তার সাথে কিছুই ছিল না। শুন্য থেকেই ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন। কি করে সম্ভব হল? একটা ছোট ঘটনা। তখন বলশেভিক মুখপত্র প্রাভদাতে প্রবন্ধ বেশী ছাপা হত না।শ্রমিকরা নিজেদের দুর্দশার কথা চিঠি লিখে জানাত। এক অর্থে সেটাই পৃথিবীর প্রথম স্যোশাল মিডিয়া।
আজকের ভারতে মিডিয়ার এত চাকচিক্য-অথচ অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রান্ত্রিক শ্রমিক কৃষকদের অবরুদ্ধ কথাকে জন সমকক্ষে আনার জন্যে কোন মিডিয়া নেই। লেনিন যেটা ১৯১৭ সালে পেরেছিলেন, আমাদের দেশ তা আজও পারে নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সফল হতে গেলে লেনিনের জীবনকে ভালভাবে জানা জরুরী।

মিখাইল বাকুনীনঃ ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের অমানবিক দিক গুলো দেখলে প্রথমেই যার কথা মনে পড়ে তিনি বাকুনীন। স্টালিন এবং ধনতন্ত্রের অত্যাচারের একটাই যোগসূত্র। সেটা ক্ষমতা। স্টালিন তখন ও জন্মান নি-কিন্ত বাকুনীন বলে গিয়েছিলেন কোন মহান বিপ্লবী যদি অত্যাচারী জ়ারের সিংহাসনে বসে, সে এক বছরের মধ্যে জারের চেয়েও শতগুন অত্যচারী হবে।স্টালিন তার বিশুদ্ধ প্রমান। জারের আমলে স্টালিন রাজনৈতিক কর্মের জন্যে তিনবার সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হন। একবার গৃহকত্রীর পেট করে দিয়ে আসেন। পরের বার এক ত্রয়োদশী কন্যাকে বিয়ে করেন। আর স্টালিনের আমলে, বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম উজ্জ্বল নেতাদের সবাইকে খুন করা হয়েছে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতার কারনে। শুধু স্টালিন কেন, বাকুনীনের বক্তব্য ছিল অর্থ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষের মন এবং হৃদয়কে বিকৃত করে। ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের পচনের কারন এই ক্ষমতা-তার উৎস অর্থ বা রাজনীতি যাই হোক না কেন। পশ্চিম বঙ্গের মানুষ বাকুনীনকে চেনে না। তারা দেখেছে খালি পায়ে হাঁটা সত্তর দশকের কমরেডরা আজ গাড়ি হাঁকিয়ে ঘোরে। ঠিকাদারিতে আঘাত করলে মানুষ খুন করে। বাকুনীনের কথা জানলে, তারা বুঝত, এটা বাকুনীন অনেক দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরন ছারা যে কোন সিস্টেমই অমানবিক বা অত্যচারী হতে বাধ্য।

চে গুয়েভেরাঃ চে কে কি আমি কমিনিউস্ট বলবো? আমি নিজে ১০০% কমিনিউস্ট বিরোধি। তবুও কেন চে? কারন সাধারন এবং অত্যচারিত মানুষের প্রতি "আজন্ম" এবং অকৃত্রিম ভালবাসাতে চে অদ্বিতীয়। গান্ধীও ক্ষমতার প্রতি লালায়িত ছিলেন-চে ছিলেন না। চে কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-এক জন আদর্শ বিপ্লবী কে? চে জানিয়েছিলেন, যে মানুষকে ভালবাসতে পারে। চে বলেন নি পার্টির প্রতি আনুগত্যের কথা। বলেন নি নন্দীগ্রামে যখন মানুষকে খুন বা ধর্ষন করছে ভারতীয় কমিনিউস্ট পার্টির লোকেরা, শুধু সেই পার্টির লোক বলে, আনুগত্যের কারনে, সেই অমানবিক ঘটনা সমর্থন করতে হবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই একজন বিপ্লবীর প্রথম এবং প্রধান পরিচয়। অনেকেই হয়ত সেটা বলে। তারপর লেনিন, স্টালিন, মাওদের মতন অত্যচারী শাসকে পরিণত হয়। চে কিন্ত কিউবার ক্ষমতার ক্ষীর খেলেন না। আফ্রিকাতে গেলেন বিপ্লব করতে। সেখান থেকে বলিভিয়াতে। সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন যখন কাস্ত্রো সোভিয়েত প্রভুদের বুট চাটতে ব্যাস্ত ছিলেন। এমন অকৃত্রিম মানব প্রেমিক বিশ্বইতিহাসে বিরল।

আমি বাকীদের ও অনুরোধ করব, তারাও তাদের জীবনের অনুপ্রেরণাদের নিয়ে লিখুন। আমরা তাদের দেখেও অণুপ্রাণিত হই।