Tuesday, December 29, 2020

লাভ জিহাদ, লাভ ম্যারেজ এবং পিছিয়ে যাওয়ার রাজনীতি

                                                                             (১) 

আজ মধ্যপ্রদেশে লাভ জিহাদ বিরোধি আইন পাশ হল ( যদিও খাতা কলমে নাম "ফ্রিডম অব রিলিওজিওন" বিল)। এর আগে আইন পাশ করেছে উত্তর প্রদেশ। আসাম, হরিয়ানা, কর্নাটক সহ বিজেপির শাসনাধীন সব রাজ্যই বলছে, তারাও আইন আনবে । পোষাকি নাম " ধর্মান্তকরন বিরোধি" বা "ধর্ম পালনের স্বাধীনতা" বিল। 

  আপাত দৃষ্টিতে বিলটি ধর্ম নিরেপেক্ষ যেহেতু তা সব ধর্মের লোকেদের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। বক্তব্য হচ্ছে,  কাউকে বিয়ে করে, ধর্মান্তকরন করা চলবে না।  আমি নিধার্মিক , ধর্ম তুলে দেওয়ার পক্ষের লোক। সুতরাং এই আইনে খারাপ কিছু দেখি না। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে উত্তর প্রদেশে গত কয়েক সপ্তাহে এই নতুন আইনটি বহু মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করার কাজে লাগানো হয়েছে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাত্রীর ধর্মান্তকরন হয় নি বা হলেও তারা স্বেচ্ছায় করেছে বলে পুলিশের কাছে জানিয়েছে।  অর্থাৎ ভারতের আইনের ক্ষেত্রে যা হয়- ৯৯% ক্ষেত্রেই অপপ্রয়োগ -যেমন বধূ অত্যাচার নিবারন  আইন, আদতে বর অত্যাচার আইনে দাঁড়িয়েছে-এটিও সেই দিকেই যাচ্ছে। 


 লাভ জিহাদ ব্যাপারটা শ্রেফ গোয়েবেলিয় লেভেলের মিথ্যাচার। কেরালার খৃষ্ঠান, পাঞ্জাব, লন্ডনের সর্দার এবং কর্নাটকের হিন্দু সংগঠন গুলির যাবতীয় অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ বা নানান ইনভেস্টিগেশন থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা নেহাতই বিন্দুতে সিন্ধু। শুধু দুটো কেসের লাভ জিহাদ সাবস্টান্স আছে। প্রথমটা কেরলের     হাদিয়া কোর্ট কেস (২০১৭) । কেরালার ভাইকমের হোমিওপাথি ছাত্রী হাদিয়াকে ইসলামিক স্টেট   ব্রেইন ওয়াশ করে জেহাদি প্রেমিকা হতে।   গোটা বিশ্ব জুরেই নাবালিকাদের ভালনারাবিলিটি এক্সপ্লয়েট করেছে আই সিসিস। কিন্ত সেটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ-এবং তাতে ভারতের কিছু মুসলমান ও জড়িত ছিল। কিন্ত তার সাথে প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া হিন্দু-মুসলমানের প্রেম ঘটিত বিবাহের কেসের কোন সম্পর্ক নেই।  দ্বিতীয়কেস টি জাতীয় শুটার তারা সহদেহর (২০১৮)। রাঁচিতে  রাকিবুল হাসান নামে এক মুসলমান যুবক  রঞ্জি কোহলি  হিন্দু নাম নিয়ে, তাকে বিয়ে করে। যা প্রতারনা।  এরকম কেস আরো কিছু থাকতে পারে। কিন্ত ভারতে ঘটে যাওয়া হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান বিবাহে যা ১% কেস ও না। 

কোন মুসলমান যুবক যদি হিন্দু নাম ভাঁড়িয়ে বিয়ে করে-তাহলে বর্তমান আইনের তিনটে ধারাতে তাকে জেল খাটানো যায়। আলাদা করে নতুন আনার কোন দরকার নেই। আনা হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক আরো খারাপ করতে। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে। 


                                                           (২)

এবার আসি আসল সমস্যায়।  রাজনীতি সমাজের প্রতিফলন। রাজনীতিবিদরা সেটাই করবেন, যাতে তারা ভোটারদের মন পান। তারাত মন জুগিয়ে চলার অভিনেতা।   ভারতবর্ষের অধিকাংশ হিন্দু মুসলমান পিতা মাতা, তাদের সন্তানদের অন্য ধর্মে বিয়ে দিতে চান না। কোন হিন্দু ছেলে যদি মুসলমান মেয়ে বিয়ে করে-বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার শশুরবাড়ির লোক সেই ছেলেটি এবং মেয়েটিকে মেরে ফেলেছে হনার কিলিং হিসাবে।  একজন মুসলমান বাপ হনার কিলিং করে জেলে গিয়ে গর্ব বোধ করে যে সে ইসলামের সেবা করছে।  হিন্দু বাপেদের খুন করে জেলে যাওয়ার সাহস নেই -কিন্ত বিজেপির উত্থানে এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে এসেছে। ফলে তারা আইন করে মুসলমান ছেলের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে আটকাচ্ছে।  এটা হচ্ছে সোজা সাপ্টা সত্য। 

 প্রশ্ন হচ্ছে এইভাবে আইন করে কি প্রেমের বিয়ে আটকানো যাবে না তা উচিত?

 ইতিহাসে তাকানো যাক।  

 প্রেম, সেক্স , বিয়ে- এই তিনটি আলাদা, সম্পূর্ন আলাদা শব্দ। 

 সেক্স হচ্ছে ইন্ট্রিগ্রাল বায়োলজিক্যাল প্রসেস-যা কালচারাল, বা লিগ্যাল না-প্রানীর সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। 

 বিয়ে হচ্ছে লিগ্যাল কনস্ট্রাক্ট-ইতিহাসে যার জন্ম মেসোপটেমিয় সভ্যতায় ৪০০০ বছর আগে।  বিয়ের উতপত্তির কারন প্রাইভেট প্রপার্টি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্থান।  ঐতিহাসিক ভাবে এবং আজ থেকে দুশো বছর আগেও বিয়ে করার একমাত্র কারন ছিল সন্তানের জন্ম-যে হবে উত্তরাধিকারি। বিয়ের সাথে প্রেমের কোন সম্পর্কই ছিল না।  বিয়ে ছিল একটা সামাজিক ডিউটি বা কর্তব্য। স্বামী স্ত্রীর প্রেম নেহাত আধুনিক ধারনা। 

  এখনো অনেক আদিবাসি সমাজ, যাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই-সেইসব সমাজে বিয়ে বলে কোন প্রথা নেই। 

 প্রেম হচ্ছে সাংস্কৃতিক কনস্ট্রাক্ট।  প্রেম হচ্ছে অনুভূতি এবং ফুলফিলমেন্ট-অনেকটাই ডোপামিনের মোহ। প্রাচীন সাহিত্যে প্রেম পাওয়া গেলেও- " প্রেম করে বিবাহ" ব্যাপারটা গোটা পৃথিবীতেই আধুনিক ধারনা। জন্মস্থল ইংল্যান্ডের উনবিংশ শতক। তার আগে পর্যন্ত ধরা হত, প্রেম এবং বিবাহ হচ্ছে তেলে জলে। প্রেম বিবাহের ভার বইতে অক্ষম! 

 প্রেম করে বিবাহ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের দান। এর তিনটে কারন আছে। শিল্প বিপ্লবের ফলে তিনটে পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। এক, টেক্সটাইল শিল্পে মেয়েরা শ্রমিক হিসাবে যোগ দেওয়াতে তারা পরিবার থেকে কিছুটা হলেও স্বাধীনতা পায়-যাতে তারা পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পায়।  দ্বিতীয় হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জন্ম।  নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য অনেক বেশী সময় পায়। ফলে আগে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে সপ্তাহে এক ঘন্টাও পেত না। দরকার ও হত না।  বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের ভার সামলাতেই তার সময় চলে যেত। কিন্ত নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির উত্থানে নারী-পুরুষ উভয়েরই সেই পার্টনারের দরকার হল, যার সাথে তাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে।  তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন বিবর্তন-শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে মানুষের জীবন সংগ্রাম কমে। শিল্প বিপ্লবের আগে প্রতিটা সাধারন মানুষকে প্রতিটা দিন প্রকৃতির সাথে, লোকাল ট্যাক্স কালেক্টরের সাথে , যুদ্ধের সাথে ঝুঝতে হত। প্রায় পশুর মতন ছিল বেঁচে থাকা। সেখানে প্রেম ঢোকা মুশকিল। সন্তান এবং সেক্স ছাড়া কিছু ছিল না। কিন্ত শিল্প বিপ্লবের ফলে যে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর উদয় হল, তাদের জীবন অনেক ইজি। তারা সাহিত্য সঙ্গীত শিল্পে জীবনকে স্পর্ষ করছে যা আগে  এক্সক্লুসিভ ছিল শুধু ধনী এবং রাজউজিরদের। ফলে জীবনে পশুর মতন বেঁচে থাকা ছাড়াও "ফুলফিলমেন্ট" বা "পূর্নতার" ধারনার সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরী হয়। 

জেন অস্টিনের রোম্যান্টিক উপন্যাসগুলির এটিই প্রেক্ষাপট। এই উনবিংশ শতাব্দিতে শুধু উপন্যাসেই না, বাস্তবেও ইংল্যান্ডে মেয়ের বাবারা, প্রেমে  খাপ্পা হয়ে জামাইকে পিটিয়েছে, মেরে ফেলেছে, তার বিস্তর উদাহরন আছে।  সুতরাং আজ যা ভারতে দেখছেন, পাকিস্তানে আফগানিস্তানে যা ক্যান্সারের মতন আছে, সেই অনার কিলিং বা লাভ জিহাদ আইন আসলে একটা প্রাচীন রক্ষনশীল সংস্কারের প্রতিফলন। যেখানে "সন্তানেরা"  পরিবারের  সম্পদ এবং তাদের "বিবাহ" সামাজিক অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করা ( ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যবসা, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে রাজনীতি) । প্রাক শিল্প বিপ্লবের সমাজে এটাই হত- কারন বিবাহে প্রেমের দরকার হত না।  


                                                               (৩)

অধিকাংশ ভারতীয় উচ্চশিক্ষিত উচ্চপ্রতিষ্ঠিত মুসলমান ছেলেরা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে। সেটা মোটেও লাভ জিহাদ না। প্রাক্টিক্যাল ইস্যু। কারন ভারতীয় মুসলমান বাপেরা মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত উদার আধুনিক করে গড়ে তোলে না। ফলে অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত মুসলমান ছেলেদের মধ্যে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করার  প্রবনতা আছে। কারন একজন পি এই চ ডি করা মুসলিম ছেলে কি করে স্কুল ড্রপ আউট একটা মুসলমান মেয়ের সাথে সারা জীবন কাটাবে????  ফলে এই বিবাহগুলি তাদের এবং  তাদের হিন্দু প্রেমিকাদের জন্য প্রাক্টিক্যাল কনসিডারেশন। এর মধ্যে দু একটি কেসে হয়ত মেয়েটিকে ইসলাম গ্রহনের জন্য শশুর বাড়ি থেকে চাপ দেয়। তবে আমার বন্ধু সার্কেলে এমন কেস দেখিনি। সুতরাং কত % কেসে ইসলাম গ্রহনের জন্য চাপ দেওয়া হয়, আমার জানা নেই। % খুব কম হবে বলেই মনে হয়। 

এখন আপনি বলবেন ইসলামিক আইনে মুসলমানরা অমুসলমানকে বিয়ে করতে পারে না। ফলে অনেক হিন্দু ছেলে বা মেয়ে ইসলাম কবুল করে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তবে ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্ত স্পেশাল ম্যারেজ এক্টেই বিয়েটা হয়।  আমিও খুব পরিস্কার ভাবেই বিয়ের জন্য ধর্ম বদলানোর বিরোধি। ধর্ম জিনিসটাই আমার কাছে বলদের খাটাল। এবার কেউ যদি বলে এক খাটাল থেকে অন্য খাটালে নাম লেখাচ্ছি-সেটা শ্রেফ নির্বুদ্ধিতা। 

এখানে ইসলাম কি বলে, হিন্দু কাস্ট সিস্টেম কি বলে তাই দিয়ে বিচার করলে সর্বনাশ।  ভারত পিছিয়ে ছিল। তাই থাকবে। পার ক্যাপিটা জিডিপিই বলুন বা হিউম্যান ডেভেল্পমেন্ট ইন্ডেক্স- ভারতের স্থান ১৮৮টা দেশের মধ্যে ১৩০-১৫০ এর মধ্যে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত পিছিয়েছে। এগোয় নি। কংগ্রেস-বিজেপি-এদের সবাই ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ। বেসিক্যালি দেশটা ধর্ম জাতের পাঁকে আটকে। মার্কেট ইকনমি ছাড়া ভারতের এগোনোর কোন পথ নেই। 

মার্কেট ইকনমি ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের জন্য নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি দরকার-আর নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জন্য লাভ ম্যারেজের সংখ্যা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাবেই।  প্রেম এবং পকেট দেখেই বিয়ে হবে। ডিভোর্স ও বাড়বে। একটা দেশের অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, হিউমান ইন্ডেক্স এগোলে- এগুলো হবেই।  লাভ ম্যারেজ একটা মার্কেট ফোর্স। একজন কর্মী এখন বাবা-মায়ের সাথে থাকে না। সে যদি মনের মতন সঙ্গী সঙ্গীনি না পায়-তার লাভ লাইফ, তার সেক্স লাইফ আনফুলফিল্ড থাকে- তার প্রোডাক্টিভিটি ক্রিয়েটিভিটি কমতে ব্যর্থ। 

আমি জানি এই লেখার জন্য প্রচুর হিন্দু আমাকে গালাগাল দেবে। বচন -আপনি মুসলমানদের চেনেন না ( মানে তারা কিরকম গোড়া, গলাকাটার জাত ইত্যাদি ইত্যাদি)। 

 তাদের জানাতে চাই -আমি ইতিহাসের পড়ে অতীতকে জানার চেষ্টা করি। আর প্রযুক্তিবিদ হিসাবে ভবিষ্যতটা দেখতে পাই। ভবিষ্যতের ছেলে মেয়েরা এইসব ইসলাম হিন্দুত্ব মানবে না। কারন গান, নাচ, সাহিত্য, সিনেমা, শিল্প মানুষকে যে জীবনের পূর্নতা দেয় -ধর্ম তা পারে না-ওটা নেহাতই মধ্যযুগীয় কনস্ট্রাক্ট। এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে ধর্মের  কৃত্রিম  বাঁধ সর্বত্র ভাংছে।  আগামী প্রজন্ম ওই কট্টর ধর্মে থাকবে না।  আমেরিকাতে হিন্দু এবং মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রজন্মে কট্টর ধার্মিক পাওয়া মুশকিল।   আগামী দিনের প্রজন্ম সবাই মিলে একসাথে দিওয়ালি, ইদ, ক্রীসমাস  পালন করবে-ধর্মর অনুশাসন খুব হাল্কা মানবে। কারন সেই "মার্কেট"।  আপনারা চাইলেও হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্ঠান বিবাহ আটকাতে পারবেন না। কারন আপনি নিজেকে মুসলমান, হিন্দু, খ্রীষ্ঠান মনে করেন। আপনার ছেলে মেয়েরা গুগুল জেনারেশন । তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচিতি মানবে না। কারন তারা গ্লোবালাইজেশনের সন্তান।

তাই আপনারা লাভ জিহাদ প্রতিরোধ আইনে যতই খুশী হোন-ইতিহাস এটাই বলবে -ভারত একসময় সৌদি আরব, পাকিস্তান হওয়ার চেষ্টা করেছিল। 






Monday, December 21, 2020

সান জু, প্রশান্ত কিশোর এবং ২০২১ এর বঙ্গ বিধানসভা যুদ্ধ

 

সান জু, প্রশান্ত কিশোর এবং ২০২১ এর বঙ্গ বিধানসভা যুদ্ধ

          -বিপ্লব পাল,  ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২০

                                                                        (১)

চীনে ঝাও সাম্রাজ্যের অবসানে গোটাদেশে সাতটা নতুন রাজ্য তৈরী হয়। সেটা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। রাজ্য এবং রাজা মানেই আধিপত্যকামী। ফলে রাজ্যগুলোর মধ্যে  যুদ্ধ লেগেই থাকত। এর মধ্যে চীনের পূর্বে উই প্রদেশের রাজা হেলু,  সান জু ( মাস্টার সান)  নামে এক উচ্চভিলাসী স্ট্রাটেজিস্টকে “হায়ার” করলেন। আসলে উই ছিল একটা ছোট রাজ্য। তার পাশেই বিশাল রাজ্য চু। যার সামরিক শক্তি উই এর দশগুন! চু কোন না কোনদিন উইকে আক্রমন করে, গিলে খাবে-এই দেওয়াল লিখন রাজা হেলু জানতেন। ফলে সারা চীন দেশ খুঁজে তিনি এমন একজন ধুরন্দর “স্ট্রাটেজিস্ট”কে নিয়ে আসলেন, যিনি রণকৌশলে নিপুন। সামরিক শক্তি ১ঃ ১০ হলেও ভয় পান না- সেই অনুযায়ী স্ট্রাটেজি নামান!  ইনিই হচ্ছে আর্ট অব ওয়ার গ্রন্থের লেখক সান জু। যার নাম এখন গোটা বিশ্ব মানে, আর্ট অব ওয়ার গ্রন্থের লেখক হিসাবে।

 

রাজা হেলু ভাবলেন , মাস্টার সান কেমন বিখ্যাত স্ট্রাটেজিস্ট পরীক্ষা নেওয়া যাক। হেলু বললেন, আমার প্রায় ৩৪০ জন রক্ষিতা আছে। তুমি তাদের ট্রেনিং দিয়ে সেনা বাহিনীর মতন সুশিক্ষিত ডিসিপ্লিনড আর্মি বানাতে পারবে?

 

মাস্টার সান জু বললেন পারব। তবে শর্ত হচ্ছে, আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে। আপনি “ইন্টারফেয়ার” করতে পারবেন না।  রাজা হেলু মেনে নিলেন।

 

  সান জু সমস্ত প্রাসাদ রক্ষিতাদের দুটো দলে, দুই প্ল্যাটুনে ভাগ করে দাঁড় করালেন। দুই দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন, রাজার প্রিয়তমা দুই নারীকে। তাদেরকে করা হল প্লেটুন অফিসার। প্রথমে তাদের সেনা বাহিনীর ড্রিল শেখানো হল। যে বাদ্যের তালে তালে এই ভাবে পা ফেলতে হবে।

 

 ড্রিল শেখানোর পর বাদ্য বাজানো হল। দেখা গেল কোন রক্ষিতাই সামরিক তালে পা ফেলছে না। তারা হেসে কুটোকুটি। আর তাদের অফিসার -রাজার প্রিয় দুই রক্ষিতার ভ্রুক্ষেপ নেই। তারাও হাসছে।

 

  সান জু রাজার দুই প্রিয় মহিলাকে  বল্লেন, দেখ প্রথম বারের ব্যর্থতা -আমার ব্যর্থতা। যে হয়ত আমি শেখাতে পারি নি। পরের বার ও যদি এই ৩৪০জন সামরিক কায়দায় পা ফেলতে ব্যর্থ হয় সেটা হবে তোমাদের ব্যর্থতা।

 

 আবার সামরিক বাদ্য বাজল। এবারও মেয়েরা হেসেই আকুল।  দুই মহিলা অফিসার হাসি ঠাট্টাতেই মেতে রইলেন।

 

 সান জু, পেয়াদাকে বল্লেন তলোয়ার দিয়ে দুই মহিলা অফিসার তথা রাজার প্রিয় রক্ষিতাদ্বয়ের মাথা কেটে ফেলতে। রাজা হেলু মহা খাপ্পা। বলে, আরে মাস্টার সান কর কি। অবলার জীব। এরা মারা গেলে আমার শৃঙ্গার  প্রেমের কি হবে বাছা? আমি ত এমনি মস্করা করছিলাম। মেয়েদের দিয়ে কি আর সামরিক ড্রিল হয়?

 

  সান জু বল্লেন মহারাজ, আপনার কি মনে হয় আপনার দশ হাজার সেনা, চু এর এক লাখ সেনাকে হারাতে পারবে?  মেয়েরা সেনানী হতে পারার মতন সেটাও ত অবিশ্বাস্য না? আপনি যখন আমাকে দ্বায়িত্ব দিয়েইছেন, কাজটা করতে দিন।

 

 রাজা হেলু দেখলেন সান জুর কথায় ধক আছে। রাজার প্রিয়তমা দুই রক্ষিতার গর্দন নেওয়া হল। এবার নতুন দুজন ডেপুটিকে আনা হল নেতৃত্বের জন্য-যারা পুরো ঘটনাটা দেখেছে। আবার সামরিক বাদ্য বেজে উঠল। এবার কোন মেয়ের সামরিক তালে ভুল হল না।

 

 সান জু দেখালেন যাদের দিয়ে যুদ্ধ হবে না মনে হচ্ছে, তাদের দিয়েও সেরা সেনানী বানানো যায়, যদি “স্টাটেজি” ঠিক থাকে। বোজুর যুদ্ধে রাজা হেলুর মাত্র ২০ হাজার সেনা, চু এর দু লাখ সেনা বাহিনীকে কচুকাটা করে।

 

                                                             (২)

প্রশান্ত কিশোর এক বিংশ শতাব্দিতে ভারতের সান জু। ভোট যুদ্ধে জিততে যাকে স্ট্রাটিজিস্ট হিসাবে ভাড়া করা হয়। প্রশান্ত কিশোর ২০১৪ সালে মোদির বিজয়, ২০১৫ সালে বিহারে নীতিশ, ২০১৯ সালে জগন এবং কেজরিওয়ালকে জিতিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমান দিয়েছেন। কিন্ত তিনি উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস-সমাজবাদির জোটের হয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ। কারন, কংগ্রেসের মাঝারি নেতৃত্ব তার কথা শোনে নি। ডিসিপ্লিনহীন পার্টিতে তিনি কিছুই করতে পারেন নি।

 

 এবার দেখুন। যারা বিজেপিতে যাচ্ছে তারা পিকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। এবং তৃনমূলে যারা টিকে আছে তাদের অনেকেই পিকের কাজকর্মে অখুশী। কেন? কারন তাদের রিপোর্ট কার্ড, দুর্নীতি, ভালকাজ, গ্রহনযোগ্যতা সব কিছুই পিকের আইপ্যাকের মাধ্যমে দিদির কাছে পৌছে যাচ্ছে। পিকের টিম দ্বায়িত্ব নেওয়ার পর, সামান্য সার্ভে করেই বুঝেছিলেন সীমাহীন দুর্নীতির কারনে তৃনমূলের মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে তিনি তৃনমূলের নেতাদের গোপন এসেসমেন্ট চালু করেন। তাতেই নেতারা ক্ষাপ্পা।

 

পিকের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জি অনেক অভিযোগ পেয়েছেন। কিন্ত শুনলেন না কেন? কেন শুভেন্দুর সাথে একবারও দেখা করলেন না? একটু কেমন ঠেকছে না? মমতা ব্যানার্জি এবং প্রশান্ত কিশোর একটা নির্দিষ্ট স্ট্রাটেজি নিয়ে না চললে, এমনটা হওয়ার কথা না। সান জুর মতন নিশ্চিত পিকেও শর্ত রেখেছেন, যতই প্রিয়তম হোক, স্ট্রাটেজি অনুযায়ী ঘ্যাঁচাত করতে হলে করতে হবে। শুভেন্দুকে পিকের পরিকল্পনা মাফিক ঘ্যাঁচাত করা হয়েছে। নইলে শুভেন্দুকে রাখতে ম্যাডাম নিজে মাঠে নামতেন। বাকীদের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য। কারন এরা দলে থাকা অবস্থায় পিকের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ করেছে। কিন্ত ম্যাডাম পাত্তা দিচ্ছেন না। এবং তারা দলত্যাগ করছে। ম্যাডাম কি এতই বোকা যে এর পরেও পিকের ওপর জেতার জন্য ভরসা রাখছেন?

 

এবং পিকেও হুঙ্কার ছাড়ছেন বিজেপি ১০০ পেরোতে পারবে না? ১০০ ছাড়ালে পিকে আর কোনদিন স্ট্রাটেজিস্টদের কাজ করবেন না!

 

 দাবা খেলায় জিততে হলে বোরে, নৌকা ইচ্ছা করেই অনেক সময় খাওয়াতে হয়।

 

 কিন্ত এক্ষেত্রে পিকে এবং দিদির চালটা কি সেটা বোঝা যাচ্ছে না। পিকের টিম  জেলায় জেলায় ঘুরে প্রতিটা কেন্দ্রে ভাল পার্থী খুঁজেছেন। বামেদের কাছেও গেছেন। কিন্ত ভাল পার্থী পেয়েছেন এমন জানা নেই।

 

 সব ক্যাম্পেনেই পিকের তিনটে স্ট্রাটেজি থাকে

-       ভোটের মুখ। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জি-ফলে সমস্যা নেই। উলটো দিকে এখনো শুন্য। লোকে মমতা ব্যানার্জিকে দেখেই ভোট দেবে বা দেবে না।

 

-        দুই ডিসিপ্লিন। পার্টর মধ্যে দ্বন্দ কমিয়ে কর্পরেট স্টাকচারে আনা। নেতাদের ইগো দিয়ে পার্টি না চালানো। লক্ষ্য করলে দেখবেন পিকে আসার পর তৃনমূলে গোষ্টিদ্বন্দ মিইয়ে গেছে। কারন দিদি কোন গোষ্টির কথাই শুনছেন না। শুনছেন পিকের টিমের ফিডব্যাক। ফলে অনেক গোষ্টির লোকেরা বিজেপিতে জয়েন করছে। এতে আখেরে তৃনমূলের সুবিধাই হচ্ছে। টিম ছোট হচ্ছে-কিন্ত ইউনিটি ডিসিপ্লিন -একটা কমন টার্গেটে কাজ করার ক্ষমতা বাড়ছে। এটাও সান জুর শিক্ষা।

 

-       জন সংযোগের প্রোগ্রাম। সেটাতে পিকে যথেষ্ট সফল।

 

 কিন্ত উলটো দিক ও আছে। শোভন, মুকুল , শুভেন্দু- এরা তৃনমূলের আসল মুখ। যতই দুর্নীতিপরায়ন হোক না কেন , এদের কর্মকুশলতা নিয়ে অভিযোগ নেই।  রাজনৈতিক কর্মী এবং কর্পরেট কর্মী এক না। একজন রাজনৈতিক কর্মী দলটাকে ভালোবেসে করে। একজন কর্পরেট কর্মী কোম্পানীকে ভালবেসে কাজ করে না-করে মাইনের জন্য।  সুতরাং একজন রাজনৈতিক কর্মীর আবেগ-ইগো থাকবেই,। সেটাকে অস্বীকার করে, তারা সবই পিকের কর্পরেট স্টাইল মেনে মাইনে করা চাকরের মতন কাজ করবে, এমনটা ভাবা কি ঠিক? আবার এটাও ঠিক-এই ভালোবাসা আবেগ এবং তার সাথে কিঞ্চিত উপরিপাওনার আশাতেই কিন্ত দলে গোষ্টী দ্বন্দ তৈরী হয়।

 

 দিদিকি তা জানেন না ? তাহলে পিকের কথা মেনে নিচ্ছেন কেন? কেন মেনে নিচ্ছেন দলের রক্তক্ষরন?

আমার ধারনা  সান হু, রাজা হেলুকে যে যুক্তি দিয়েছিলেন, সেটাই মমতা ব্যানার্জিকে দিয়েছেন পিকে। বিজেপির এখন লোকবল অর্থবল অনেক বেশী। দশগুন। সুতরাং বিজেপির হাতে পশ্চিম বঙ্গের পতন প্রায় নিশ্চিত। কেবল মাত্র একটা স্ট্রাটেজিই এক্ষেত্রে তৃনমূলের পক্ষে খাটবে। যদি গোটা তৃনমূল একটা ঐক্যবদ্ধ ডিসিপ্লিন্ড  পার্টী হিসাবে স্ট্রাটেজি অনুযায়ী খেলে যেতে পারে।  বিজেপিতে এত এত নেতা ঢোকা মানেই বিজেপি শক্তিশালী হচ্ছে এটা বলা যাবে না। এমনিতেই রাজ্য বিজেপিতে অনেক দল। যত বেনোজল ঢুকবে তাতে গোষ্ঠিদ্বন্দ বাড়বে। একত্রে কাজ করার ক্ষমতা কমবে । আর্ট অব ওয়ার বলে, বড় দল না , ঐক্যবদ্ধ দলই জেতে।

 

পশ্চিম বাংলা এখন ভারতের কুরুক্ষেত্র। একদিকে ভোট চানক্য অমিত শাহ। অন্যদিকে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। লড়াই জমবে। আমরা খেলা দেখি।

Saturday, December 12, 2020

ভারতীয় গণতন্ত্রে মধ্যবিত্তের ভবিষ্যত

 

ভারতীয় গণতন্ত্রে মধ্যবিত্তের ভবিষ্যত

    -বিপ্লব পাল, ১২/১২/২০২০

 

 ভারতের কৃষিবিল, কৃষি আন্দোলন, রেল/এয়ার ইন্ডিয়া/ পাবলিক কোম্পানীর বেসরকারিকরন, জিএসটি, ডিমনেটাইজেশন, অধুনা বেসরকারি কর্মচারীদের বেসিক বেঁধে তাদের ইনকামে বাঁশ দেওয়া – এই সব কিছুর মধ্যেই একটা প্যাটার্ন আছে।  সেই প্যাটার্নটা ধরতে পারলেই বুঝতে পারবেন, ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ভবিষ্যত কোন দিকে এগোচ্ছে।  বেসিক্যালি কৃষি বিল কি? সরকার বর্তমানে যে ১০০ হাজার কোটি টাকার কৃষি ভর্তুকি দিতে বাধ্য হচ্ছে- তার সিংহ ভাগ যাচ্ছে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষকদের হাতে। এবং যারা বর্তমানে বিজেপির বড় ভোট ব্যাঙ্ক না। বরং ভর্তুকি তুলে দিলে, ওতে আরো তিনটি স্কিম হয়ে যাবে যাতে অনেক বেশী ভোট কেনা যাবে। ফলে লে আও কৃষি বিল। সিম্পল ভোটগণিত।

 

বেসিক্যালি যেটা পরিষ্কার – বর্তমান কেন্দ্রীয় মোদি সরকারের উদ্দেশ্য দুটো। সরকারের আয় বাড়ানো। খরচ সাবসিডি কমানো।  এবং সরকারের এই আয় দিয়ে, দুটো শ্রেনীকে খুশী করা।

 

  এক, গরীব ভোটার-যারা ভোট দিয়ে রাজশাহী টেকাবে। তাদেরকে চিকিৎসা, বাথরুম, ইলেক্টিসিটি ইত্যাদি নানান যোজনার মাধ্যমে সরাসরি টাকা দেওয়া। অর্থাৎ ভোটারদের ঘুঁশ দেওয়া। কিন্ত ডেমোক্রাসিতে এটাই হওয়া উচিত।

 

  দুই, আম্বানী, আদবানী সহ গুটিকয় বৃহৎ ব্যবসায়ীদের জন্য বিরাট ব্যবসাক্ষেত্রে প্রস্তুত করা। কারন এই শ্রেনীটির টাকায় পার্টি চলবে। বিধান সভায় হেরেও ঘোড়া বেচাকেনার টাকা যোগাবে এরাই।

 

 অর্থাৎ ডেমোক্রাসির ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং।

  এক, নাম্বার ব্যপারটাই ক্ষতি নেই। কিন্ত তাতে টাকা যোগাবে কে?  সরকারের বিরাট টাকা যায় কৃষি, এয়ার ইন্ডিয়া, রেলে ভর্তুকি দিতে। সুতরাং সরকার প্রথমেই ওইতিনটে যায়গায় হানা দিয়েছে। এই পর্যন্তও ঠিক ছিল। যে ট্যাক্সের টাকা গরীবদের কাছেই যাক। তাতে মার্কেট বাড়বে।

 

 এরপর আছে জি এস টির মাধ্যমে ইনকাম বাড়ানো। বেসরকারী কোম্পানী গুলি একটা বড় টাকা বাঁচায়, তাদের কর্মচারীদের বেসিক কম দেখিয়ে, আলায়ান্স বেশী রাখে। কারন বেসিকের ওপর এম্পয়মেন্ট ট্যাক্স দিতে হয়। সেখানেও হানা দিয়েছে মোদি সরকার। ফলে, অধিকাংশ বেসরকারি কর্মচারীদের টেকহোম ইনকাম কমবে। কারন কোম্পানীগুলিকে ট্যাক্স ব্যালান্স করতে হবে।

 

  এই টাকার পুরোটা ঐ গরীবদের স্কিমে গেলে বা আদানী আম্বানীর পদসেবায় গেলে, ঘোরতর মুশকিল আছে। কারন আপনি আমার ব্যবসা থেকে ১৮% ট্যাক্স তুলছেন। সেটা ব্যবসার জন্য তখুনি ভাল যখন ঐ ট্যাক্সের টাকাটা ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারনে সরকার লাগাবে। কিন্ত সেটা সরকার করছে না। চীনে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার নিজে ব্যবসা শুরু করতে গেলে কিভাবে নানান দিক থেকে সরকারি সাহায্য পায় সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। এই জিসটির টাকায় সরকার যদি ছোট ছোট ব্যবসা, ম্যানুফাকচারিং ইউনিট গুলিকে সাহায্য করত, যা চীন আমেরিকাতে করে-তাহলে ১৮% কেন ৩০% জি এস টিও ব্যবসার বৃদ্ধিতে সাহায্য করত।  কিন্ত বর্তমানে কি অবস্থা? ১৮% জি এস টি পে করে, ভারতের টেক্সটাইল বাংলাদেশের কাছে ১০০% হেরে বসে আছে।একেই ভারতের ম্যানুফাকচারিং ইউনিটগুলোর মারোয়াড়ী গুজরাটি মালিক।  আধুনিকরন, রিসার্চে টাকা লাগায় না।  ফলে যেসব ক্ষেত্রে ভারত আগে এক্সপোর্ট করত- ইলেক্ট্রিকাল গুডস, টেক্সটাইল সর্বত্রই ভারতের ইনকাম পড়তির দিকে।  এক দিকে মারোয়ারী, অন্যদিকে মোদি ট্যাক্স। ফলে ভারতে ম্যানুফাকচারিং এর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।

 

 এবার মধ্যবিত্তর ভবিষ্যত দেখুন। মধ্যবিত্ত চাকরি প্রেমী বা ছোট ব্যবসা করে খায়। ট্যাক্সের চোটে ছোট ব্যবসার হাল আগেই লিখেছি।  মধ্যবিত্তের চাকরির তিনটে সেক্টর

 

   -সরকারি। এখানে সংকোচন চলছে। আরো চলবে। কারন সরকার যত কম সরকারি নিয়োগ দেবে, তত বেশী টাকা বাঁচবে স্কীমের জন্য-মানে ভোট ঘুঁশের জন্য। এখানে স্কোপ জিরো হতে চলেছে বা প্রায় তাই এখন

  

   -বেসরকারি  আই টি/ সফটোয়ার । এটা ভারতের মধ্যবিত্তকে এদ্দিন বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্ত কদ্দিন? অটোমেশনের ফলে, আই টি মার্কেট এখন তুখোর ছেলে মেয়েদের দরকার। সরকারি শিক্ষা আমূল ভাবে সাজানোর দরকার। সেসব কিস্যু হয় নি। চীনের শিক্ষার মানের সাথে ভারতের শিক্ষার মানের কোন তুলনা হয় না। ভারত এখন যোজন যোজন পেছনে।  এছাড়া আমেরিকা বর্তমানে নিজেই প্রচুর সফটোয়ার কর্মী প্রডিউস করার জন্য স্কুল লেভেল থেকেই সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্পেশালিজেশন দিচ্ছে। আগামী দশ বছরে, এই ক্ষেত্রে ভারতের ছেলে মেয়েদের স্কোপ বিরাট কমবে

 

 -ম্যানুফাকচারিং।  এক্ষেত্রে ডবল প্রবলেম। মাড়োয়ারী মালিকরা মাইনে ভাল দেবে না, রিসার্চে ইনভেস্ট করবে না। আর গোদের ওপর  বিষফোঁড়া মতন মোদিট্যাক্সে এরা কাহিল। মেইড ইন্ডিয়া জাস্ট বুলি। একটা রাইফেল ও আমেরিকা থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। রাফাল বা এফ-১৬ এর যন্ত্রাংশ ভারতে এসেম্বলি হবে-তাতে চাড্ডিরা লাফাচ্ছে বটে কিন্ত এটা ভুলে যাচ্ছে, আগে কোলকাতা, পুনেতে তৈরী মটোর গোটা বিশ্বে রপ্তানী হত। বর্তমানে ওই মার্কেট সম্পূর্ন চীনের। মাত্র ত্রিশ বছরে এই হাল কি করে হয়?

 

 আর বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রের কথা বাদ দিলাম। ওখানে শিক্ষকদের যা মাইনে দেয় তার থেকে অনেক বেশী ইনকাম করে হাওড়ার কুলিরা। তাদের দরিদ্র ক্লাসে ফেলা ছাড়া উপায় নেই।

 

 তাহলে মধ্যবিত্ত কি করবে? ওয়েল তৃনমূল ও একই ফর্মুলাতেই রাজ্য চালাচ্ছে। কারন এটাই বর্তমান গণতন্ত্রের উইনিং ফর্মুলা।  বিজেপি, তৃনমূলের মধ্যে স্ট্রাটেজিগত কোন পার্থক্য নেই, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রশ্নে।  এমন কি কংগ্রেসের সাথেও নেই। সুতরাং মধ্যবিত্তর স্বার্থের প্রশ্নে মধ্যবিত্তের পাশে কোন দলই নেই।  অথচ ফেসবুক হোয়াটসাপে এদের ছেলেমেয়েরাই  এইসব পার্টিগুলোর হয়ে বুক চিরে হনুমান হচ্ছে।

 

 পরে রইল বামেরা। ভারতের বামেরা কিন্ত কৃষক-শ্রমিকদের পার্টি না- মধ্যবিত্তদের স্বার্থ, সরকারি চাকরির স্বার্থ রক্ষা করা পার্টি। কিন্ত তারা ভারতে হেরে ভুত। কারন তারা বাকী পার্টিগুলোর মতন গরীব ভোটারদের ঘুঁশ দিতে ব্যর্থ। তারা মূলত মধ্যবিত্তের স্বার্থ দেখতে গিয়ে গরীবদের থেকে বিচ্ছিন্ন।  এছাড়া তাদের নেতাদের বালখিল্যের ন্যায় চলছে না চলবে নার ফলে, ম্যান্যফাকরিং ব্যবসার প্রচুর ক্ষতি হয়। সুতরাং তাদের নেতৃত্ব, স্ট্রাটেজি সব কিছুই কোন শ্রেনীর কাছেই ( সরকারি চাকুরিজীবি ছাড়া) গ্রহণযোগ্য না। তারা প্রমানিত ব্যর্থ।

 

  তাহলে উপায় কি?

 

 ইনফ্যাক্ট উপায় দেখাতে পারত পশ্চিম বঙ্গ।  যেটা বুদ্ধদেব শুরু করেছিলেন , ডেং জিয়াও পঙের মতন সরকারি নিয়ন্ত্রনে সরকারি সাহায্যে ম্যানুফাকচারিং বাড়ানো। তথ্য দেখলেই পরিস্কার হবে ডেং জিওয়াও পং বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ নেতা। একটা ১৪০ কোটির দেশে, যার ১০০% দরিদ্র, সেই দেশের ৯০% কে মধ্যবিত্ত স্তরে নিয়ে এসেছেন মাত্র কুড়ি বছরে। পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ এটা পারে নি।  কিন্ত বুদ্ধকে বোঝার মতন কেউ ছিল না। না উনার পার্টিতে। না ভারতে। না পশ্চিম বঙ্গে।

 

 কোন পার্টি এটা করবে জানি না। কিন্ত ভারতে ডেং বা পুতিনকে দরকার।  বর্তমান গণতান্ত্রিক ধারা চলতে থাকলে,  ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর কোন ভবিষ্যত নেই। তারা ব্যাঙাচির মতন বিজেপি, তৃনমূল সিপিএম কংগ্রেসের পক্ষে ফেসবুক হোয়াটসাআপে লিখে যাবে। কিন্ত বাস্তব হচ্ছে তাদের জন্য আর কেউ নেই।

 

Saturday, November 28, 2020

কোভিড ভ্যাকসিন- আর কদ্দিন ? কোন ভ্যাকসিন বেশী প্রমিসিং?

 

কোভিড ভ্যাকসিন- আর কদ্দিন ? কোন ভ্যাকসিন বেশী প্রমিসিং?

   -বিপ্লব পাল, ১১/২৮/২০২০

 এই মুহুর্তে  সব থেকে বড় চিন্তা কোভিড ভ্যাক্সিনের কদ্দুর ? কখন আসছে ভ্যাকসিন? কোন ভ্যাক্সিন ভাল বা এফেক্টিভ হবে? ভ্যাক্সিন নেওয়ার পর কতদিন বাদে আবার নিতে হবে?  বুস্টার ডোজ লাগবে কি না?

ভ্যাক্সিনের কাজ কদ্দূর এগোচ্ছে-সেটা নিয়ে নানান খবর বা বিজ্ঞানের জার্নাল ঘাঁটলেও  এই সাবজেক্টটা  গভীরে গিয়ে বোঝার ক্ষমতা আমার নেই।  বায়োলজি নিয়ে আমার জ্ঞান নেহাতই সীমিত। তবুও যেটুকু জেনেছি, সেটাই সহযে বোঝানোর চেষ্টা করছি-সাধারন মানুষের জন্য। যা লিখছি তা নেহাতই যেটুকু খবরে জেনেছি তার ভিত্তিতে।

 

 ৩২১ রকমের ভ্যাকসিন আবিস্কারের প্রক্রিয়াতে রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৫ টি ভ্যাকসিন শেষ ধাপের ট্রায়ালে।

 

আমি এই প্রবন্ধে মূলত পাঁচটি ভ্যাকসিন নিয়ে আলোচনা করব।  এই পাঁচটি ভ্যাকসিনে ফেজ-৩ ট্রায়ালের কিছু কিছু রেজাল্ট আসতে শুরু করেছে এবং আগামী মাসের মধ্যেই হয়ত স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়ার জন্য এমার্জেন্সি অথোরাইজেশন এরা পেয়ে যাবে। বা অনেকে পেয়েও গেছে। এই জন্যে এই ভ্যাক্সিনগুলি নিয়ে জানা থাকলে সুবিধা কারন খুব সম্ভবত এরাই মার্কেটে আসতে চলেছে দ্রুত।

 

 (১) অক্সফর্ড ভ্যাক্সিন বা এস্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন – ADZ 12222

(2)  রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাক্সিন – SPUTNIK-5

(3) মর্ডানা ভ্যাক্সিন – Moderna 1273

(4)  বায়ো এন টেক ফাইজার ভ্যাক্সিন -   BNT162B2

(৫) সিনোফার্ম (চাইনা) -করোনাভ্যাক

 

                                                   (১) অক্সফর্ড ভ্যাক্সিন

এটি তৈরী হয়েছে শিম্পাঞ্জীর এডেনোভাইরাস থেকে ( একধরনের কোল্ড ভাইরাস, যারাও করোনা ভাইরাসের মতন ) ।  এডেনোভাইরাস-এক্ষেত্রে ভেক্টরের (বাহকের) কাজ করে কারন এই ভাইরাসটি নিরীহ। এর মধ্যে ঢোকানো হয়েছে কোভিড-১৯ এর স্পাইক প্রোটিন সিকোয়েন্স। অর্থাৎ ব্যাপার হচ্ছে এই ভ্যাকসিনটি এক ধরনের কৃত্রিম করোনা ভাইরাস-যার গায়ে করোনা স্পাইক থাকবে, কিন্ত ভেতরের নিউক্লিওটাইডটি নিরীহ এডিনো ভাইরাসের- যা কোভিড-১৯ এর মতন মারাত্মক না। ফলে এই ভ্যাক্সিন শরীরে প্রবেশের সাথে  সাথে করোনা স্পাইকের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি রেসপন্স তৈরী হবে।   ভ্যাক্সিন নেওয়ার ২৮ দিন বাদে এন্টিবডি তৈরী হচ্ছে। কিন্ত নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি -যা কিনা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে একমাত্র ঢাল -সেটি তৈরী করতে ৫৮ দিনের মাথায় আরেকটি বুস্টার ডোজ নিতে হচ্ছে।

 

যেহেতু সর্দিজ্বরের ভাইরাস দিয়ে এই ভ্যাক্সিন তৈরী-সেহেতু ভ্যাক্সিন নেওয়ার সাথে সাথে জ্বর আসবে। প্যারাসিটামল টাইপের মেডিসিন নিতে হতে পারে।

 

 ২৪,০০০ লোকের ওপর ( বৃটেন, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা) ট্রায়াল চলেছে। ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালে ৫০% লোককে ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়, বাকীদের দেওয়া হয় প্লাসিবো-মানে তাতে শুধু জল থাকে। কিন্ত তারা মনে করে তাদের ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে!  এদের সুবিধা হল, বোঝা যায়, যারা এই ভ্যাক্সিন নিয়েছে বনাম নেয় নি, সেই দুই গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য কি।

 এক্ষেত্রে ১২,০০০ লোক -যারা সত্যিই দুই ডোজ ভ্যাক্সিন পেয়েছিল, তাদের মধ্যে ৩২ জন কোভিড-১৯ এর আক্রান্ত হয়েছে। বাকী ১২,০০০ লোক যাদের প্লাসিবো দেওয়া হয়েছিল, তাদের ১০১ জন আক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং এই ভাইরাসে এভেক্টিভ রেট ৭০%।

 

 তবে বিজ্ঞানীরা এই প্রকাশিত তথ্যের সাথে একমত না। তারা বলছেন গোঁজামিল আছে। কারন দেখা যাচ্ছে যারা ডোজ কম পেয়েছে, তাদের সাফল্য বেশী।  এই ভ্যাক্সিনের সাথে সংম্পৃক্ত বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রথমে ১/২ ডোজ নিয়ে পরে বুস্টার ডোজ ফুল দিলে, ৯০% সাফল্য রেট হবে। কিন্ত কেন হবে-কোন ব্যখ্যা নেই। ফলে বিজ্ঞানীরা বা যারা এই ভ্যাক্সিন এপ্রুভ করবেন, তারা মানছেন না।

 

  অক্সফর্ড ভ্যাক্সিনের ভাল দিক হল- এটি দামে কম । ২-৩ ডলার বা ১০০-২০০ টাকা ডোজ প্রতি। এবং এর তৈরীর পদ্ধতি বহুদিন ধরে স্বীকৃত-অর্থাত সাইড এফেক্টের চান্স কম। এছাড়া এই ভ্যাক্সিনের ১০ কোটি ডোজ তৈরী আছে।  স্টোরেজ টেম্পারেচার ২-৮ সেন্টিগ্রেড। সাধারন ফিজারে রাখলেই চলবে। সুতরাং এর ডিস্ট্রিবিউশন এবং ট্রান্সপোর্টেশন ও খুব সহজ।

 

 কদিন বাদে আবার ভ্যাক্সিন নিতে হবে? সেই তথ্য এখনো বোঝা যাচ্ছে না!

 

  আরেকটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার-এই ভ্যাক্সিন নিলে কি এসিম্পটোটিক বা যাদের খুব কম লক্ষন দেখা যাচ্ছে তাদের ইনফেকশন কমবে ? কারন এরাই রোগটা ছড়াচ্ছে । সেই ব্যাপারে ডেটা কম-মনে হয় তাদের ক্ষেত্রেও এই ভ্যাক্সিন এফেক্টিভ হবে।

 

                                                       (২) মর্ডানা এবং ফাইজার   ভ্যাক্সিন

মর্ডানা এবং ফাইজার ভ্যাক্সিন ম্যাসেঞ্জার আর এন এ প্রযুক্তিতে তৈরী। যা অত্যাধুনিক।  তাই এই দুই ভ্যাক্সিনের আলোচনা একসাথে করছি। মর্ডানা সম্পূর্ন আমেরিকা ভিত্তিক। ফাইজার আমেরিকা এবং জার্মানি ভিত্তিক কোম্পানী।

 

 ম্যাসেঞ্জার আর এন এ ভাক্সিন  কিভাবে কাজ করে? এক্ষেত্রে যে আর এন এ চেইনটি করোনা ভাইরাসের গ্লাইকোপ্রোটিন স্পাইক তৈরী করে, আর এন এর সেই অংশটুকু, লিপিড ন্যানোপার্টিকলের সাহায্যে একদম শরীরের কোষে সরাসরি ঢেলে দেওয়া হয়।  আর এন এ শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই দেহকোষের বাইরে গ্লাইকোপ্রোটিনে স্পাইক তৈরী করে ফেলে। আর যেহেতু এই গ্লাইকোপ্রোটিন স্পাইক গুলিকে দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম বিদেশী আক্রমনকারী হিসাবে চিহ্নিত করে, সেহেতু,  দেহ নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি তৈরী করা শুরু করে দেয়। যারা ভবিষ্যতে কোভিড-১৯ এর শত্রু হিসাবে কাজ করবে।

 

ম্যাসেঞ্জার আর এন এ ভাক্সিনের কিছু সুবিধা আছে। এগুলো আবিস্কার এবং ফ্যাক্টরিতে  তৈরী করা খুব সহজ। এছারা এক্ষেত্রে সেলুলার এবং হিউমরাল ( অর্থাৎ ব্লাড সিরামে)-দু ধরনের প্রতিরক্ষাই তৈরী হয়।  অক্সফোর্ড ভাক্সিন অবশ্য ট্রাডিশনাল হলেও , জিন এডিটিং এর সাহায্যে, তাদের ভাইরাসেও দুই ধরনের প্রতিরক্ষা তৈরী হবে। এম আর এন এ ভাইরাসের আরেকটা সুবিধা-সাইড এফেক্ট অনেক কম। শুধু যে জায়গায় ( সাধারনত বাহুর ওপরে ) দেওয়া হয় শুধু সেই জায়গাটা একটু ফুলবে। জ্বর আসার চান্স আছে তবে কম।

 

কিন্ত এম আর এন এ ভাক্সিনের অসুবিধাও অনেক।  আর এন এ খুব আন্সটেবল। এক মিনিটের কম টেকে (  নির্ধারিত টেম্পারেচারের তলায় না রাখলে)। যেমন ধরুন মর্ডানা ভাক্সিনকে  -২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে স্টোর করে রাখতে হয়। ফাইজার ভ্যাক্সিনকে-৭০ ডিগ্রি। এবার স্টোরেজ থেকে বার করে, দেহে ইঞ্জেকশন দিতে হবে ৫-১০ সেকেন্ডের মধ্যে। তবে দেহকোষে আর এন এ ন্যানোপার্টিকল হয়ত ত্রিশ সেকেন্ড থাকার সুযোগ পাবে ভেঙে যাওয়ার আগে। তবেই দেহকোষে গ্লাইকোপ্রোটিন তৈরীর সুযোগ হবে।

 

 মর্ডানা ভ্যাক্সিনের ফেজ থ্রি টায়ালে দুটো ডোজ নেওয়ার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। খুব দ্রুত নিতে হয়।  ফ্রিজ থেকে বার করে মুহুর্তের মধ্যে ইনজেকশন দেওয়া হয়।

 

 এই ধরনের ভ্যাক্সিন আমেরিকা, জার্মানিতে চলতে পারে। ভারতে চলবে না। -২০ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেডে ভ্যাক্সিন ট্রান্সপোর্ট এবং স্টোরেজ করার মতন ক্ষমতা অনেক জায়গায় নেই। তাছাড়া ফ্রিজ থেকে বার করে  ৫-১০ সেকেন্ডের মধ্যে ইনজেকশন দেওয়াও বেশ কঠিন ।  দামও পড়বে ৪০-৫০ ডলারের মতন।

 

 ফাইজার দাবী করছে ৯০% সাকসেস রেট, মর্ডানা দাবী করছে ৯৫%। কিন্ত কোন ডেটাই এখনো বাইরের বিজ্ঞানীরা দেখেন নি। তারা এই সাকসেস রেট মানতেও রাজী না সব কিছু খুঁটিয়ে না দেখে। কারন এর আগে এম আর এন এ যেকটি ভ্যাক্সিন তৈরী করার চেষ্টা হয়েছিল-সেগুলো সফল হয় নি। সেখানে হঠাত করে ৯০% সাকসেস রেট মামার বাড়ির আবদার নাকি?    আমি অবশ্য অন্য কারনে এই তথ্যে বিশ্বাস করছি না। কারন মর্ডানার ফেজ থ্রি ট্রায়ালেও যথেষ্ট বেছে বেছে লোক নেওয়া হয়েছে । কারন এই ট্রায়ালে যারা চান্স পেয়েছে ( আমিও পেয়েছি বলেই বলছি) তাদের গত ছমাসে কোভিড-১৯ হয় নি এবং যারা রেগুলার আফিস ফ্যাক্টরিতে যাতায়াত করে। প্লেনে যাতায়াত করছে। অর্থাৎ এক্সপোজার বেশী। এক্সপোজার বেশী, কিন্ত তাও  ছমাস  কোভিড-১৯ হয় নি, এটা মানে  যে ট্রায়াল গ্রুপকে সিলেক্ট করা হচ্ছে, তাদের বেসিক ইমিউনিটি অনেক বেশী।  এবার  ইমিউনিটি যাদের এমনিতেই বেশী তাদের মধ্যে  ৯০% সফল মানে বৃদ্ধ বা যাদের ইমিউনিটি কম তাদের ক্ষেত্রে সাফল্য ৬০-৭০% হবে না কে বলতে পারে ?

 

 লক্ষ্যনীয় এই ঘোষনার পরপরই দুই কোম্পানীর পরিচালন গোষ্টির লোকেরা নিজেদের স্টক বেচে কেউ কেউ ১০০০ কোটি টাকার বেশী মালিক হয়েছে। অথচ বিজ্ঞানীদের অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই।  তবে ফাইজার এবং মর্ডানা ডিসেম্বরেই এমার্জেন্সি অথোরাইজেশন পাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের টিকা দেওয়ার জন্য।

 

 অনেকেই এম-আর এন এ ভ্যাক্সিন এর দীর্ঘ মেয়াদি সাইড এফেক্ট নিয়ে চিন্তিত। যে ক্যান্সার হতে পারে ভবিষ্যতে। তবে এটা প্রমানিত আর এন এ এত ক্ষন ভঙ্গুর এরা দেহকোষের নিউক্লিয়াসে ঢুকে ডি এন এ পরিবর্তনের সুযোগ পায় না। তার আগেই অনুগুলি ভেঙে যায়।  সুতরাং ক্যান্সারের চান্স তাত্ত্বিক ভাবে এখনো অমূলক।

                                                       

                                                        (৩)

   রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ এবং চীনের সিনোভ্যাক গোষ্টীর করোনা ভ্যাক

 প্রথমে স্পুটনিক-৫ এ আসি। এগুলি সবই ট্রাডিশনাল ভ্যাক্সিন। অর্থাৎ কোভিড-১৯ এর স্পাইক প্রোটিন তৈরীর জেনেটিক অংশের সাথে এডিনোভাইরাসের মতন নিরীহ ভাইরাসের সংমিশ্রনে তৈরী। অক্সফর্ড ভ্যাকসিন এদের থেকে স্লাইটলি বেটার কারন তাতে আরো বেশী জেনেটিক মডিফিকেশন করে, তার সেলুলার এবং হিউমরাল ইমিউনিটি তৈরী করে যা এই দুই ভ্যাক্সিনে নেই।

 

 স্পুতনিক-৫ ফেজ-৩ ট্রায়াল না করেই, পুতিন সরাসরি রাশিয়ার জনগনের জন্য চালাতে গেছিলেন। তার রাজনীতি সফল হয় নি। কারন রাশিয়া এবং বিশ্বের সব বিজ্ঞানীরাই এই ধরনের হটকারি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কলুষিত কাজের প্রতিবাদ করেছেন। এখনো পর্যন্ত যেটুকু ডেটা বাজারে এসেছে, তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সুতরাং স্পুটনিক-৫ যতই সস্তা হোক, রিলায়েবল ডেটার অভাবে রাজনীতির চাপে পিছিয়ে গেছে।

 

সে তুলনায় চাইনার করোনাভ্যাকের রেজাল্ট অনেক ভাল। প্রায় ৪০,০০০ ফেজ থ্রি ট্রায়াল হয়েছে। ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া , চিলি, চাইনাতে। ৯২-৯৮% সাফল্য দাবী করেছেন বিজ্ঞানীরা।

 

 কিন্ত সব ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রেই দুটো প্রশ্নের কোন জবাব এখনো নেই

 

 (১) একবার ভ্যাক্সিন নেওয়ার পর কমাস বাদে ইমিউনিটি আর থাকবে না। মানে দ্বিতীয়বার টিকা নিতে হবে?

 (২) বৃদ্ধ এবং যুবকদের ওপর এফেক্টিভনেস একই রকম হবে কি না। কারন কোভিড-১৯ বৃদ্ধদের জনই ভয়ংকর বেশী

 এখনো যথেষ্ট ডেটা কারোর কাছেই নেই।

                                     (৪)

 

ভারতে ভারত বায়োটেক কোভ্যাক্সিন ( BBV152) তৈরী করছে। 

 ভারতের ভ্যাক্সিনের কোয়ালিটি কি হবে-সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারন ভারতে বিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক চাপে, মালিকদের চাপে ডেটা ম্যানুপুলেট করবেন না-তার গারান্টি নেই। এর আগে ভারতে র‍্যানবক্সী সহ   অনেক ফার্মাই ডেটা ম্যানুপুলেশনের জন্য কুখ্যাতি পেয়েছে। যেহেতু ভারতে লিগ্যাল অন্তত দুর্বল। এবং রেগুলেটরি সংস্থা আই সি এম আর ভারতের অন্যান্য সংস্থার মতনই দুর্নীতিগ্রস্থ অপদার্থ। নইলে আই সি এম আরের ছাড়পত্র পাওয়া টেস্টকিট কিকরে ১০০% ভুল রেজাল্ট দেয়?  ভ্যাক্সিন তৈরীর ক্ষেত্রে ডেটাই সব। ভারতের মতন আদ্যপান্ত কোরাপ্ট দেশে  ভূত বিহীন ডেটা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

 

মোটামুটি যেটুকু বুঝেছি অক্সফোর্ড এবং সাইনোভ্যাকের করোনাভ্যাক এখনো পর্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য বেশী। যদিও আমি নিজে মর্ডানা ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল নিয়েছি, কিন্ত এম-আর এন এ  ভ্যাক্সিনের সফলতা নিয়ে আমার ভরসা কম। কারন এর আগে কোথাও এম আর এন এ ভ্যাক্সিন সফল হয় নি। তাছাড়া যে দ্রুততা এবং এফিসিয়েন্সিতে এখন এটা দিতে হয়, তা নিখুত ভাবে সত্যিই দেওয়া সম্ভব কি না আমার সন্দেহ আছে। স্টক মার্কেট ফুলিয়ে লাভ করা আর বৈজ্ঞানিক  সত্যের মধ্যে আসমান জমিনের ফারাক।  

 

 

Friday, November 27, 2020

মারাদোনা বনাম মেসি-জনপ্রিয়তার রহস্য সন্ধানে

 মারাদোনা বনাম মেসি-জনপ্রিয়তার রহস্য সন্ধানে

- ১১/২৭/২০২০ বিপ্লব পাল
মারাদোনার মৃত্যুতে যেভাবে গোটা পৃথিবী শোকাচ্ছন্ন-তার উদাহরন কি সাম্প্রতিক, কি সুদূর ইতিহাস-কোথাও পাওয়া যাবে না। দেশ, রাজনীতি, জাতি, ধর্মের ওপরে উঠে, এত ভালবাসা পৃথিবীর কোন ব্যক্তি কোনদিন পেয়েছে কি না, আমার জানা নেই।
কিন্ত এই আকুন্ঠ ভালবাসার উৎস কি? শুধুই তার পায়ের ম্যাজিক?
এটা মানা মুশকিল। যদিও ফুটবল অত বুঝি না-কিন্ত মেসির ড্রিবলিং বা পাশিং দেখতে ততটাই ভাল লাগে। ম্যাজিক্যাল “গোল” দেখতে হলে ইব্রাহমোভিচের অদ্ভুত সব ব্যাককিক গুলো আরোই মনমুগ্ধকর। পেলে ব্রাজিলকে তিনবার বিশ্বকাপ দিয়েছেন। গোটা দলকে খেলানোর প্রশ্ন হলে, জিনেদিন জিদান বা প্ল্যাতিনি যেভাবে গোটা দলকে খেলাতেন, তার তুলনাই বা কোথায়? মেসি অনেক বেশী ট্রফি জিতেছেন। পেলে অনেক বেশী আন্তর্জাতিক গোল করেছেন।
শুধু ফুটবল , পায়ের জাদু মারাদোনার প্রতি গোটা বিশ্বের এত ভালবাসার উৎস হতে পারে না।
এই ভালোবাসার শুরু ১৯৮৪ সাল- ভেনু স্পেনের সর্বোচ্চ ফুটবল ফাইনাল কোপা ডেল রে। মারাদোনা তখন মেসির ক্লাবে-বার্সিলোনা। বিপক্ষে এথেলিটিক বিলবাও। সেদিন পরিকল্পনা করেই মারাদোনাকে মারা হচ্ছিল চোরাগোপ্তা। এই পর্যন্তও ঠিক ছিল। কিন্ত স্টেডিয়ামের দর্শক এবং বিল্বাওএর প্লেয়াররা মারাদোনাকে জাতিবিদ্বেশী কুতসিত গালাগাল দিতে থাকে। মারাদোনার শরীরে বইছে নেটিভ আমেরিকানদের মিশ্র রক্ত। তাই নিয়ে কুতসিত গালাগাল দিচ্ছিল বিপক্ষ। বার্সিলোনা তখন এক গোলে পিছিয়ে। মাঠে মারামারি শুরু হয়। মারাদোনা দেখছিলেন রেফারি কিছুই করছে না। এক লাখ দর্শকের স্টেডিয়ামে বসে আছেন স্প্যানিশ কিং কিং জুয়ান কার্লোস। মারাদোনাই আক্রমন শুরু করেন। মিগেল সোলা মারাদোনাকে বাজে ফাউল করে। কুতসিত গালাগাল দেয় জাতি তুলে। মারাদোনা তেড়ে গিয়ে মাথা ঠুকলেন বিপক্ষের মিডফিল্ডার মিগেল সোলাকে। মিগেল মাঠে পড়ে যেতে ছুটে আসে বাল্বোয়ার সব প্লেয়াররা। মারাদোনাকে পেটাবে। কিন্ত বার্সিলোনার প্লেয়াররা, মারাদোনাকে বাঁচাতে ছূটে যায়। ততক্ষনে গোটা স্টেডিয়ামে মারামারি শুরু হয়েছে। ৬৬ জন আহত।
এবার প্রশ্ন করুন মেসি এত ভদ্র- জীবনে এই ভাবে মাঠে রুখে দাঁড়াত কি না? মারাদোনা নিজেই বলেছেন মেসির সব আছে-কিন্ত প্রতিবাদ করতে জানে না। খুব ভদ্র।
এখানেই মারাদোনা আলাদা। ওই ঘটনার পর বার্সিলোনা যে তাড়িয়ে দেবে, সেটার রিস্ক আর কোন প্লেয়ার নিত? সব থেকে বড় কথা ওই ঘটনার পর ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোও নিতে যায় নি। নিল নেপোলি। যারা ইটালিয়ান লীগেই তখন বাইশ নাম্বারে! বার্সিলোনার মতন পৃথিবীর প্রথম সারির ক্লাব ছেড়ে, ইটালির দ্বিতীয় শ্রেনীর ক্লাবে যাওয়ার রিস্ক কজন ফুটবলার নিতে পারতেন শুধু মাত্র প্রতিবাদের জন্য?
ইটালিতে গিয়েও তিনি নেপলস শহরের রাজা। কেন? উত্তর ইটালি দক্ষিন ইটালিকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল করে। মারাদোনা তাদের হয়ে সেই অবহেলা, তাচ্ছিল্যের জবাব দিচ্ছেন মাঠে। মারাদোনার সাথে মেসির পার্থক্য এখানেই যে মারাদোনা খেললে, সেটা নিছক খেলা থাকে নি। মারাদোনার পায়ের প্রতিস্পর্ধায় পৃথিবীর নির্যাতিত শোষিত অবহেলিত লোকেরা পেয়েছে মুক্তির স্বাদ। যেন মারাদোনা তাদের হয়ে, তাদের জ্বালা যন্ত্রনার জবাব দিচ্ছেন।
আসলে পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই প্রান্তিক। তাদের কথা, তাদের দুঃখের কথা, বঞ্ছনার কথা কে শোনে? গণতন্ত্র ? বামপন্থা ? কেউ শোনে না। তারা জানে এই সিস্টেম তাদের কত অসহায় করে রেখেছে। মাঠে মাঠের বাইরে মারাদোনার প্রতিবাদ -সব কিছুর মধ্যেই তাদের মনে হয় মারাদোনা তাদের জন্যই বলছে, তাদের জন্যই মাঠের মধ্যে প্রতিশোধ নিচ্ছে। তিনিই একমাত্র ফুটবলার যিনি বুশের ইরাক আক্রমন, ইস্রায়েলে গাজা অধিগ্রহন থেকে পৃথিবীর সর্বত্র ঘটে যাওয়া অত্যাচার অবিচারের ঘটনায় শুধু স্লোগান দিয়ে খান্ত হন নি। মিছিলে পা দিয়েছেন। তবে সেটা করতে গিয়ে কিছু অতিবিপ্লবী কাজে ফেঁসেছেন। যেমন পাবলো এস্কোবারের মতন দুনিয়ার একনাম্বারের ড্রাগ ডিলার ও একদা তার বন্ধু ছিল!
ফলে ঢাকা পরে যায় মারাদোনার ৯ টি বেজন্মা সন্তানের কথা এবং তাদের প্রায় সাতজন মায়ের কথা যাদের প্রতি মারাদোনা সুবিচার করেন নি। এর মধ্যে অন্তত তিনজন মহিলার ক্ষেত্রে –( ইটালিয়ান ক্রিস্টিয়ান সিনাগ্রা ( দিয়েগো সিনাগ্রার মা), এবং দুজন কিউবান প্রেমিকা-যারা তার তিনটী সন্তানের মা )-মারাদোনা নিজ দ্বায়িত্বে পিতৃত্ব স্বীকার করেছেন এবং তাদেরকে অস্বীকার করার জন্য তিনি যে সারা জীবন অনুতপ্ত ছিলেন-তাও জানিয়েছেন।
মারাদোনা সঙ্গিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনেকটা চেয়ারম্যান মাও এর মতন। মেসি বা বর্তমান স্টার ফুটবলারদের গার্লফ্রেইন্ড হাইফাই ফ্যাশন মডেলরা। মারাদোনার স্বীকৃত বা গোপন সঙ্গিনীরা সাধারন, একদম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা খুব সাধারন মহিলা। এমন কি শেষ বান্ধবী ( যিনি মারাদোনার থেকে ত্রিশ বছরের ছোট) রোকিও ওলিভিয়া গরীব ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা জনপ্রিয় মহিলা ফুটবলার। এদিক থেকেও মারাদোনা বিদ্রোহী- সাধারন খেটে খেওয়া গরীবদের প্রতিনিধিত্ব তার বান্ধবী সিলেকশনে ও স্পষ্ট। অনেকেই বলবেন এটা পিতৃতান্ত্রিক এক্সপ্লয়টেশনকে বিপ্লবী স্ট্যাম্প মারা। কিন্ত ল্যাটিন আমেরিকান কালচারে গোপন প্রেম, অবৈধ সন্তান ব্যপারটা খুবই সাধারন ঘটনা। স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো নিজেই তার পিতার অবৈধ সন্তান। আর কোন মহিলাই বা চাইবে না দিয়েগো তার সন্তানের পিতা হোক? নেপলসের বন্ধু-বান্ধবীদের কাছেই শুনেছি, নেপলসের যুবতীরা স্টেডিয়ামে নগ্ন বুকে লিখে নিয়ে যেত - দিয়েগো তুমি আমার সন্তানের পিতা হবে? এতটাই ছিল মারাদোনা ক্রেজ!
আসলে ফুটবল, প্রতিবাদ, মিছিল, গোপন সঙ্গিনী- ম্যাটার যাইহোক না মারাদোনার সিলেকশন স্পষ্ট- আমি খেটেখাওয়া নির্যাতিত মার্জিনাল লোকেদের প্রতিনিধি! তবে আর যাইহোক তিনি ভুলেও খেটে খাওয়া মানুষদের মতন জীবন কাটান নি। লাক্সারী কার, প্রাইভেট জেট, ইয়াট- সঙ্গ দেওয়ার জন্য অসংখ্য বান্ধবী-এসব নিয়েই তিনি জীবন কাটিয়েছেন। কিন্ত সেইজন্যেই হয়ত তিনি জনপ্রিয়! খ্যাতি বৈভবের চূড়ায় বসেও যিনি আমআদমীর কথাই ভেবেছেন-তাদের কথাই বলেছেন!
তিনি সারাক্ষন সাধারন মানুষের কথাই বলেছেন। এমন কি দুদিন আগেও তিনি নিজের সন্তান, বান্ধবীদের নিয়ে এতটাই বিরক্ত ছিলেন-বলেছিলেন তার সব সম্পদ তিনি আর্জেন্টিনার গরীবদের দিয়ে যেতে চান। হয়ত সেই উইল করার সুযোগ পেলেন না।

Monday, November 23, 2020

বাঙালী নেতা এবং নেতৃত্ব- বাস্তব বনাম কল্পনা

 

বাঙালী নেতা এবং নেতৃত্ব- বাস্তব বনাম কল্পনা

   -বিপ্লব পাল, ১১/২৪/২০২০

 

()

বাঙালীদের মধ্যে নেতৃত্বের অভাব শুধু রাজনীতিতে না। ব্যবসা, খেলাধূলা, প্রশাসন সর্বত্রইতা প্রকট। ব্যতিক্রম কিছুটা বিজ্ঞান এবং গবেষনায়। সৌরভ গাঙ্গুলী বাঙালীদের মধ্যে নেহাতই বেমানান।

 

 নেতা কে?

 

 কেউ একজন সৎ, মহান দরদী মানুষ, আদর্শবাদি মানুষ হলেই মহান নেতা হন না। বরং ইতিহাস যারা বদলেছেন, একটা জাতিকে অন্ধকার থেকে তুলে বিশ্বের শ্রেষ্ট প্রভুর জাতে তুলেছেন, তারা অধিকাংশই ছিলেন নিষ্ঠুর, কঠোর। কিন্ত বুদ্ধিমান, সাহসী এবং দূরদর্শী।

 

যেমন ধরুন চেঙ্গিস খান। চীনের উত্তর-পূর্বের একটা ছোট জায়গা। ভারতের অরুনাচলের মতন। চেঙ্গিস খানের আগে ওদের না কেউ চিনত, না পুঁচত। কিন্ত এক চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা এশিয়া ইউরোপের অর্ধেক দখল করে বসল মাত্র পঞ্চাশ বছরে। আবার চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যে ইতিহাস থেকে মঙ্গোলরা হারিয়ে গেল। নেতা ছিল, তাই জাতিটা জাতে উঠে ছিল। চেঙ্গিস খান কোন মহান উদার লোক ছিলেন না। ছিলেন নিষ্ঠুর বুদ্ধিমান কর্মঠ দূরদর্শী।

 

অথবা আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেট। গ্রীসে ম্যাসেডোনিয়াকে কেউ চিনত না। স্পার্টা এবং এথেন্স ছিল শ্রেষ্ঠ সিটি স্টেট। কিন্ত সেই ম্যাসেডোনিয়ার এক ছোট রাজা ফিলিপ এবং তার পুত্র আলেক্সান্ডার একদিন গোটা বিশ্ব জয় করে বসলেন। আলেক্সান্ডার সামরিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে "গোল্ড" স্টান্ডার্ড। কাছাকাছি আসবেন জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ান, কার্থিজের সেনাপতি হ্যানিবল, খালিদ ইবন আল ওয়ালিদ ( রসিদুন খিলাফতের প্রবাদ সেনাপতি ), এডমিরাল সান সিন ( কোরিয়া) এরা সবাই ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিলেন।

 

এদের নিজেদের আদর্শ অবশ্যই ছিল- জীবনের সামনে একটা আদর্শ না থাকলে নেতা কেন, একজন সাধারন মানুষ পথ চলতে পারে না। কিন্ত তাই দিয়ে নেতা হওয়া যায় না। ইনারা নেতা হতে পেরেছিলেন, কারন জনগন এইসব নেতাদের জন্য নিজের প্রান দিতে প্রস্তুত ছিল। নেতৃত্বের এটা হচ্ছে প্রথম গুন যে তারা তাদের ফলোয়ার বেস তৈরী করতে পারেন, যারা রক্ত এবং ঘাম ঝরানোর জন্য তৈরী থাকে। পরের ধাপ হচ্ছে যে তিনি তার জাতি এবং দেশকে উন্নত শিখরে নিয়ে যান।

 

রাজনৈতিক নেতার মুল্যায়নের    ক্ষেত্রে "রাজনীতি" এবং "দেশ"-এই দুটি আলাদা। কেউ তার আদর্শের রাজনীতিতে সফল হলেই, ইতিহাস তাকে সফল নেতা নাও বলতে পারে, যদি তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হোন।

 

আমি এক্ষেত্রে চীনের উদাহরন সামনে আনব। চীনে গত একশো বছরের নেতৃত্ব ছিল চার প্রবাদ প্রতিম ঐতিহাসিক নেতার কাছে-

সান ইয়াত সেন

চিয়াং কাইসেক

মাও যে দঙ

ডেঙ জিয়াও পিং

 

এর মধ্যে সান ইয়াত সেন এবং দেঙ, দুজনে রাজনীতি এবং দেশনেতা হিসাবে সফল। মাও শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে সফল কারন তিনি চীনে কমিনিউস্ট বিপ্লবের জনক। কিন্ত রাষ্ট্রনেতা হিসাবে ব্যর্থ। তার কমিনিউস্ট পলিসির দরুন দুর্ভিক্ষে না খেতে পেতে পেয়ে অন্তত ৬০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ডেঙ জিয়াও পিং এর নেতৃত্বে, চিন আজ প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় বিশ্বনেতা। মাত্র ত্রিশ বছরে পৃথিবীর বৃহত্তম দরিদ্র জনগনকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত করে বিশ্বনেতৃত্বে টেনেছেন।  নিরেপেক্ষ বিচারে শুধু চীন না, দেং সম্ভবত বিংশ শতাব্দির সেরা নেতা। তার যেতৃত্বে চীন    বিশ্বের অনুন্নত দেশ থেকে,  শ্রেষ্ঠ উন্নত দেশ হিসাবে উঠে এল।

 

ভারতে নেতা নেত্রীদের নিমোর্হ বিশ্লেষন করার সুযোগ কম। আবেগের মুলো খাওয়ার জন্য এত গরুছাগলের চাষ হয়েছে ভারতের এডুকেশন সিস্টেমে , কটু নির্মোহ সত্য এদের পেটে হজম হবে না।

 

                                                    (২)

 

আলেক্সান্ডারকে গোল্ড স্টান্ডার্ড ধরলে ভারতে সিলভার স্টান্ডার্ড সামরিক নেতা খুব বেশী খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিবাজি, বালাজি বাজিরাও-, রঞ্জিত সিং, এরা ছিলেন। কিন্ত পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মিলিটারি লিডারদের লিস্টে প্রথম ১০০ এর মধ্যে কোন ভারতীয়র দেখা পাওয়া যাবে না। শিবাজি মহারাজ একটি লিস্টে দেখলাম ১০২ নাম্বারে, আরেকটিতে ৯৩ নাম্বারে। ভারত থেকে আর কেউ নেই। এগুলো আমার বানানো লিস্ট না-যারা মিলিটারি ইতিহাসের চর্চা করেন, আমার থেকেও সামরিক ইতিহাস অনেক ভাল জানেন, তাদের বানানো লিস্ট।

 

কিন্ত সামরিক নেতৃত্বে না হোক, ভারত আধ্যাত্মিক ধার্মিক নেতৃত্বে অবশ্যই এগিয়ে। গৌতম বুদ্ধ, শ্রী চৈতন্য এবং মহত্মা গান্ধীর ফলোয়ার গোটা বিশ্বে এবং তারা বর্তমান বিশ্বের এক বিশাল অংশের মানুষকে প্রভাবিত করেছেন।

 

মুশকিল হচ্ছে, আমি এই আধ্যাত্মিক ললিপপ গিলতে রাজী না। ভারত ইসলাম এবং বৃটিশদের হাতে পদানত হয়েছে তার কারন ভারতে সমর্থ মিলিটারি জেনারেল ছিল না। বাংলা মোঘল এবং বৃটিশদের হাতে পরাধীন ছিল -কারন বাংলায় সামরিক নেতা ছিল না। ভারত এবং বাংলাকে এর খেয়ারত দিতে হয়েছে প্রচুর।  এই কঠিন সত্যকে  স্বীকার না করলে,   বাঙালী জাতি একদিন নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলবে।

 

কেন বলছি? আকবরের সময়ে গোটা বিশ্বের ২৭% জিডিপি ছিল ভারতের। আবার ভারতের জিডিপির ২৫% আসত বাংলা সুবা থেকে।  বাংলা শিল্পে ইউরোপের থেকে উন্নত ছিল। গোটা বাংলার জিডিপি ছিল ইউরোপের বেশী।

 

তাহলে ইউরোপের শিল্প বিপ্লব বাংলায় হওয়ার কথা? এশিয়ার জার্মানি হতে পারত বাংলা। কেন হল না? কেন বাংলা জার্মানি হয়ে উঠল না? ইতিহাসে গতিতে সেটাই হওয়া উচিত ছিল ?

 

কিন্ত হয় নি। কারন কোন সামরিক নেতা, নেতৃত্ব সেকালেও আসে নি- আজও নেই। ফলে বাংলা র‍য়ে গেছে মোঘল এবং বৃটিশদের হাতে। একটা জাতির উন্নয়নের জন্য তার স্বাধীনতার দরকার হয়। প্রুশিয়াতে বিসমার্ক না জন্মালে, আজকে জার্মান রাষ্ট্রের বদলে, জার্মানির একেক টুকরো ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রের হত। বাংলায় বিসমার্কের মতন নেতা জন্মায় নি। ফলে বাঙালী জাতির ভাগ্য নিয়ে অন্যরা খেলা করেছে মাত্র। সেই ট্রাডিশন এখনো চলছে।

 

এই জন্যেই মুক্তমনে চিন্তার দরকার।  ভাবার দরকার কেন বাংলা নেতৃত্বের অভাবে ডুবে গেল। পরাধীন জাতির কোন ভবিষ্যত থাকতে পারে না। থাকেও নি।  

 

নেতাজি নেতা হিসাবে এক পর্যায়ে সফল যে উনার জন্য সবাই রক্ত দিতে তৈরী ছিল। আবার সফল নন -কারন বৃটিশ অধীনস্থ ভারতীয় সেনারা, তার ডাকে মোটেও বিদ্রোহ করে, আজাদ হিন্দ ফৌজে আসে নি। আগের দিন মাস্টারদা সূর্য্য সেনের প্রসঙ্গ উঠল। মাস্টারদা অসম্ভব সাহসী, জেদি, আদর্শবাদি দেশপ্রেমিক। এই নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্ত তাকে এবং তার দলবলকে বাঙালী গোয়েন্দা এবং দারোগারাই ধরেছিল। তার লং টার্ম প্ল্যানিং বা ভিশন -কোনটাই ছিল না। এটা ভগত সিং এর জন্যও সত্য। বাকী ভারতীয়দের সাথে ইনাদের যোগ ছিল সামান্যই।

 

সি আর দাশ, বি সি রায়-এরা আদর্শবাদি ভাল লোক। ব্যক্তি হিসাবে এরা তুলনাহীন। কিন্ত শুধু তাই দিয়ে নেতা হয় না। নেতা হতে সাহস লাগে। নিষ্ঠুর ভাবে লক্ষ্যের দিকে এগোতে হয়। স্বাধীনতার অগ্নিযুগের বাঙালী নেতাদের গুনগানে ভর্তি ইতিহাস বই পড়ে, বোঝা যাবে না বাঙালীর নেতৃত্বহীনতার ইতিহাস। তার জন্য পড়তে হবে বাঙালীর ব্যর্থতার ইতিহাস। তা হচ্ছে দেশভাগ।

 

এই প্রশ্নটা কেউ করে নাস্বাধীনতার সময় এত বড় বড় নেতা থাকতে বাংলা ভাগ হল কি করে??? কেউ বাঙালীর স্বার্থ দেখল না কেন? প্রায় এক কোটি বাঙালী হিন্দু এবং ১৫ লাখ বাঙালী মুসলমান এই বাংলাভাগে তাদের আদি ভিটেমাটি হারিয়ে ভিখিরি হল। বিসি রায়, জ্যোতিবোস- এরা ছিলেন !!! কিন্ত বাস্তব এটাই এইসব মহান নেতাদের সবাই ভৃত্যসুল্ভ নেতা। সাহস বা দম কারুর ছিল না। বৃটিশ ভাগকে মেনে নিল! এদের নেতৃত্বের পাশাপাশি ইস্রায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ানের জীবনী পড়ুন। বুঝবেন বাঙালীর এই সব মহান নেতারা কেন বেনগুরিয়ানের পায়ের যোগ্য না। প্যালেস্টাইনকে ভাগ বৃটিশরা করেছিল! কিন্ত বেনগুরিয়ান সেটা অগ্রাহ্য করলেন যুদ্ধ করেই। কারন তার কুড়ি বছরের প্রিপারেশন ছিল। বাংলার এইসব মহান নেতাদের ( পড়ুন জ্যোতি বসু, বিসিরায়) দেশভাগের বিরুদ্ধে কোন প্রিপারেশনই ছিল না!

 

            (৩)

 নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বাজপেয়ী, মনমোহন, নরেন্দ্রমোদি-এদের নেতৃত্ব বিচার করব কি করে?

 

  যদি রাজনৈতিক সফলতা দিয়ে বিচার করি, তাহলে মোদি সব থেকে বেশী এগিয়ে। কারন উনি গোটা ভারতে আর এস এসের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।  এক বিশাল ভারত তার ফলোয়ার। বাকীরা রাজনীতির ক্ষেত্রে মোদির কাছাকাছিও সফল নন।

 

  কিন্ত তারমানে কি উনি রাষ্ট্রনেতা হিসাবে সফল ?  ডেং এর সাথে তুলনা করলে বোঝা যাবে, মোদি বরং মাও এর সাথে তুলনীয়। যিনি দেশে নিজের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন-কিন্ত দেশকে টানতে পারেন নি। মোদি বিরাট বিরাট স্বপ্ন দেখেছেন-কিন্ত এটা বোঝেন নি ভারতের ইনফ্রাস্টাকচার দুর্বল। আমলাতন্ত্র, বেনিয়া পুজির রিফর্ম না হলে ভারতকে পেছনের সিটে বসতেই হবে। এখানেই ডেং তাকে বিরাট গোল দেবেন। ডেং এর রিফর্ম ছিল মৌলিক। উনি বুঝেছিলেন স্লোগান না- চীনকে বদলাতে হলে, গোড়ায় ধাক্কা দিতে হবে।

 

 অন্যদিকে মনমোহন সিং হয়ত রাজনীতিতে ব্যর্থ- রাজনৈতিক নেতা হিসাবে ব্যর্থ। কিন্ত ভারত আজকে যেটুকু এগিয়েছে, সেটা তার সংস্কারের জন্যই। রাষ্ট্র নেতৃত্বের প্রশ্নে মনমোহন এদের সবার থেকেই এগিয়ে থাকবেন। কিন্ত রাজনীতি বিহীন রাষ্ট্রনেত্বত্ব সোনার পাথর বাটি।

 

ভারতের বাম নেতৃত্বের কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। এরা রাজনীতি এবং রাষ্ট্র নেতৃত্ব দুই দিক দিয়েই ব্যর্থ। ভারতের মতন গরীব দেশের অন্তত ৩০% সিট বামেদের পাওয়ার কথা। ভারতের পার্লামেন্টে এদের সিটের সংখ্যা ১% ও না বর্তমানে। ঐতিহাসিক হায়েস্ট ১০% । ভারতের কমিনিউস্ট পার্টিতে আগেও নেতা ছিল না, এখনো নেই। আমি ভারতের কমিনিউস্ট পার্টির ইতিহাস যত পড়েছি, তত এই ধারনা আমার মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে, এরা চিরকালই নেতাবিহীন- র‍্যাডারলেস শিপ।

 

(৪)

 

নেতা এবং নেতৃত্বের ধারনা, একজন শিশু বা কিশোর তার ফর্মেটিভ এজে- কিভাবে পায়?

 

বাঙালীদের জন্য ( হয়ত সবার জন্য) মূলত পাঁচটা সোর্স

 

() খেলার মাঠে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া বা টিভিতে খেলা দেখার সময় নেতৃত্ব দিতে দেখা

 

() বাড়িতে বাবা কাকা জেঠা যদি নেতৃত্ব পজিশনে থাকে- সে অফিস, ব্যবসা বা রাজনীতি-যায় হোক না কেন-সেটা দেখে বড় হওয়া

 

() কলেজের ছাত্র রাজনীতি, জিমখানা, ক্লাব -ইত্যাদিতে জড়ানো

 

() টিভি, নিউজপেপারের সমকালীন রাজনৈতিক নেতা এবং নেতৃত্বকে দেখে শেখে তরুনরা

() ইতিহাসের নেতাদের দেখে শেখে।

 

পাঁচ নাম্বারটা গুরুত্বপূর্ন। বাম রাজনীতিতে অনেকেই আসতে পারেন, ফিদেল কিম্বা লেনিনের ইতিহাসে আকৃষ্ট হয়ে। আবার ডান রাজনীতিতে অনেকেই আসেন হেডগাউকরের আদর্শে আকৃষ্ঠ হয়ে।

 

সুতরাং স্কুলে ইতিহাস কিভাবে পড়াচ্ছে তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে, একজন শিশু বড় হয়ে নেতা বলতে কি বুঝবে।

 

ভারতে যেভাবে ইতিহাস পড়ানো হয়-তাতে একজন নায়ক, একজন ভিলেন। পুরোটাই বলিউডি একমাত্রিক ইতিহাস। ফলে ভারতের ইতিহাসে নায়ক কি ভিলেন, কারুরই নেতৃত্বের কাঁটাছাড়া হয় না। এর জন্য নেতৃত্ব নিয়ে আজন্ম ভুল ধারনা থেকে যায়। আমি শুধু দুটো উদাহরন দেব

 

লর্ড ক্লাইভ। ইনি ভারতে ভিলেন, ইংল্যান্ডে মহানায়ক। কিন্ত দুপক্ষই মানবেন তিনি একজন ঐতিহাসিক নেতা। ক্লাইভের ইতিহাস পুরো পড়লে, যে কেউ বুঝবেন এই একটা লোক তার বুদ্ধি সাহস দূরদর্শিতা দিয়ে সেইকাজ করেছিল যা আর কেউ করতে পারে নি। ইংল্যান্ডের মতন একটা ছোট দ্বীপের মাত্র কয়েক হাজার লোক, কোটি কোটি ভারতবাসীর রাজা হয়ে গেল! খুব মোটা দাগেও বোঝা যায় কাজটি খুবই কঠিন ছিল। এবং ক্লাইভ সেটা করেছিলেন। অথচ, ভারতের ইতিহাস পড়লে মনে হবে ক্লাইভ ছল চাতুরো করে ভোলামেলা সিরাজকে হারিয়ে দিলেন! ভারতের ৯০% ছাত্ররাই জানে না, পলাশীর যুদ্ধের আগে দুবার ক্লাইভ সিরাজকে হারান এবং সিরাজ আলি নগরের সন্ধী করতে বাধ্য হোন। উভয় ক্ষেত্রেই ক্লাইভের সেনার সংখ্যা ছিল হাজারের কাছেকাছি, আর সিরাজের ৫০ হাজারের বেশী। এবং দুই ক্ষেত্রেই ক্লাইভের মিরজাফরের প্রয়োজন হয় নি।    ৯৯% লোক এটা জানে না, কলকাতায় আসার আগে ক্লাইভ দাক্ষিনাত্যে দুটি বড় যুদ্ধ জিতেছেন এবং মাদ্রাসে বৃটিশ আধপত্য স্থাপন করেছেন ফ্রেঞ্চ এবং কর্নাটকের রাজাকে হারিয়ে ( প্রথম কর্নাটকের যুদ্ধ)।এবং সেখানেও ক্লাইভের হাতে বিপক্ষের তুলনায় মোটে ১০% সেনা ছিল!

 

মুষ্টিমেয় কিছু সৈনিক নিয়ে তার থেকেও দশগুন বেশী শক্তির রাজা নবাবদের কিভাবে হারাতে লর্ড ক্লাইভ? কারন বুদ্ধি। শত্রু পক্ষের প্রতিটি শক্তি দুর্বলতা, তার নখ দর্পনে থাকত। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন কঠিন সময়ে। মুর্শিদাবাদ থেকে কর্নাটক -সর্বত্রই মসনদের রাজনীতির সব কিছুর ডিটেলস দিতে তার গোয়েন্দারা। এর বিপরীতে ভারতের রাজা মহারাজা নবাররা ছিল নেহাত দুগ্ধপোষ্য শিশু। রাজনৈতিক সামরিক নেতৃত্ব শিখতে গেলে, ববার্ট ক্লাইভের কাছ থেকেই শেখা উচিত।  কারন ভারতের ইতিহাসে উনার সমতুল্য কেউ নেই। বালখিল্যএর মতন ইতিহাস চর্চা না করে- এই অপ্রিয় সত্যগুলো স্বীকার করার সময় এসেছে।

 

দুই,  মহম্মদ ঘোরি। সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করার জন্য ইনি ভারতের ইতিহাসের আরেক ফেবারিট ভিলেন। কিন্ত এই লোকটার ইতিহাস ভারতে ডিটেলেসএ কেউই পড়ে না। অথচ ভারতের মুসলমান শাসনের আদি পুরুষ ইনিই। ব্যপারটা খুব সহজ ছিল না। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে তখন চালুক্য এবং চৌহানদের শক্তিশালী রাজ্য। ঘোরি প্রথমে চালুক্যদের কাছে পরাজিত হোন কেয়াদারার যুদ্ধে তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর তরাইনের প্রথম যুদ্ধে, পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে ঘোরি আহত হয়ে প্রায় মরতে যাচ্ছিলেন।

 

দুবার ঘোহারা হারার পর কিভাবে মহম্মদ ঘোরি তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে জিতে ভারতে ইসলামিক শাসন শুরু করলেন?

 

না ভারতীয় রাজাদের বদান্যতা, উদারতায় ঘোরি বেঁচে যান নি। ঘোরিকে মারার জন্য তার পেছন পেছন দৌড়ে লাভ হয় নি। কারন তুর্কীর এই ট্রাইবরা ছিল দ্রুত ঘোরসোয়ার। এরা হিট এন্ড রান টাইপের যুদ্ধ করত। যুদ্ধে হারা শুরু হলেই এরা দ্রুত পালাত। আবার ফিরে আসত। কিন্ত বিপক্ষ হেরে গেলে এরা কচুকাটা করত। বিপক্ষ পালানোর সুযোগ পেত না। কারন ঘোরার পিঠে এরা ছিল দুর্ধস্ব দ্রুত। এই ধরনের লুঠেরা হিট এন্ড রান টাইপের ট্রাইবাল আক্রমনেই রোমান সম্রাজ্য ধ্বংস হয়। প্রথম তরাইনের যুদ্ধের পরই পৃথ্বিরাজের সাবধান হওয়া উচিত ছিল-তাদের সনাতন যুদ্ধ পদ্ধতি খুব বেশীদিন চলবে না। তিনি কোন সামরিক রিফর্ম করেন নি। এখানেই একজন মহান নেতার সাথে তার পার্থক্য। আলেক্সান্ডারের পিতা ফিলিপ, তার সেনাবাহিনীর দুর্বলতা বুঝে প্রথমেই সামরিক টাকটিস, অস্ত্রের পরিবর্তন করেন। ফলে ম্যাডিসনের সেনাবাহিনী গ্রীসের সেরা সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে।

 


 ইতিহাসে শিক্ষা এটাই বাংলা, ইউরোপের জার্মানী হয়ে উঠতে পারত। পারে নি কারন বাংলায় সামরিক নেতা এবং নেতৃত্ব ছিল না। কোন জাতি রাজনৈতিক ভাবে পরাধীন থাকলে তাদের পক্ষে জার্মান হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।  যাদেরকে বাঙালীর মহান নেতা হিসাবে মূলোর মতন ঝোলানো হচ্ছে ( এবং সেই মূলো খাবার মতন গরু ছাগলরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ) , ইতিহাসের একটু ভেতরে ঢুকলে বোঝা যাবে তাদের কেউই মহান নেতা নন। কারন তারা মহান হলে বাংলা ভাগ হত না। বাংলার ইতিহাস তারা বদলাতে পারতেন।

 

 এই কটু অপ্রিয় সত্যের সামনে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।