Thursday, June 29, 2017

গোলাম সারোয়ারের বামপন্থি কুসংস্কার

রিবিউটাল ঃ https://istishon.com/?q=node%2F24424
প্রথমেই গোলাম ভাইকে ধন্যবাদ জানাই। কারন আমার পনেরো মিনিটে লেখা ব্লগের বিরুদ্ধে উনি চারটি ব্লগে আমার লেখার নিবিড় পাঠ করেছেন। এই ফেসবুকের যুগে কোন লেখকের লেখা যদি এত গভীর ভাবে কেউ পড়ে, এমন দুর্লভ পাঠককে প্রশংসা না করে উপায় নেই। শুধু সমস্যা হচ্ছে গোলাম সারোয়ার এখনো বামপন্থী চিন্তার গোলামিতেই গোসল করছেন-কেন করছেন, তার ক্রনিকলটা সাজিয়ে দিচ্ছিঃ
(১) আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ নগ্ন, এবং তার বিরুদ্ধে আমি মুক্তমনাতেই দশটা আর্টকলের সিরিজ লিখেছিলাম। এখানে দেখতে পারেন গোলাম ভাইঃ https://sites.google.com/site/biplabpal2000/home
শুধু তাই না। আমেরিকাতে আদিবাসিদের ওপরে কিভাবে অত্যাচার চলেছে-সেই সুদীর্ঘ ইতিহাস ও লিখেছি বিস্তারিত এই ব্লগে
https://blog.mukto-mona.com/2016/02/18/48489/
শুধু আমি কেন, আমেরিকানরাও আমেরিকার বিদেশনীতিকে গালাগাল দিয়ে থাকে। গোলাম ভাই কি ঢাকায় বসে হাসিনার স্বৈরচারের বিরুদ্ধে লিখতে পারবেন? আমরা আমেরিকাতে বসে আমেরিকার বিরুদ্ধে লিখতে পারি। আর সেই জন্যেই আমেরিকাতে থাকাই পছন্দ।
শুধু বাংলাদেশ কেন। পশ্চিম বঙ্গ বা ভারতের সমস্যা নিয়েও খোলাখুলি লিখতে ভয় হয়। ওখানে বাবা মা আত্মীয় স্বজন আছে। ওখানে, কমিনিউস্টদেশে সবাই আমরা "বোবা সমুদ্রের নোনাজলে" সখ্যাত সলিলে ( একজন কবির থেকে শব্দগুলো ধার করলাম)।
বামপন্থীদের সমস্যা অন্যত্র-অবাস্তব জগতের সন্ধানে তারা। মঙ্গল গ্রহে ত কেউ থাকে না। মার্ক্স কথিত কমিনিউস্ট রাষ্ট্রও কোথাও নেই। সুতরাং শত দোষ থাকা সত্ত্বেও আমেরিকাতে থাকাই শ্রেয় বলে মনে করি।
(২) সাম্রাজ্যবাদের ও কি সবটাই বাজে?আলেক্সজান্ডারের সাম্রাজ্যবাদ ছাড়া গ্রীক জ্ঞান বিজ্ঞান কিভাবে ছড়াত বিশ্বে? ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদ না এলে আরবে বিজ্ঞান চর্চা হত কিভাবে? আর সেটা না হলে কোপার্নিকাস , নিউটনের জন্ম হত কি ভাবে? এই যে ইন্টারনেটের এত সুবিধা নিচ্ছেন গোলাম ভাই, সেটার জন্মও আমেরিকার মিলিটারির প্রয়োজনে (আরপানেট প্রজেক্ট) ।
সাম্রাজ্যবাদের সাফাই গাইছি না। কিন্ত মুক্তমনের পরিচয়, যতই অপ্রিয় হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকুক না কেন, লোকের মন রাখতে লেখা উচিত না। নিষ্ঠা থাকা উচিত সত্যের প্রতি। সেই জন্যেই আমি এই লেখায় দেখিয়েছি কি ভাবে সাম্রাজ্যবাদের জন্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি এগিয়েছে।
দেখুন নিজেকে মহান দেখানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদকে অজস্র গালাগাল দেওয়া যায়। যা আমি ওই ১১ টা খন্ডে দিয়েওছি। কিন্ত সাম্রাজ্যবাদের জন্য যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি-সেটাও সমান সত্য। সেটা লেখার জন্য যদি আমাকে কেউ বলে আমি সাম্রাজ্যবাদের সাফাই গাইছি, তাহলে আমি পাত্তা দেব না। কারন এগুলো বাঙালী সুল্ভ নিম্নগোত্রের চুলকানি।
৩) বিজ্ঞানের গবেষনা এবং প্রযুক্তির মধ্যে গুলিয়েছেন গোলাম ভাই। উদাহরন দিচ্ছি । ইলেক্ট্রিসিটি। হ্যা মাইকেল ফ্যারাডে থেকে গ্যাল্ভানিক সেল-সব কিছুই ছিল ল্যাবেটরিতে। কিন্ত এডিসন এবং টেসলার দ্বৈরথেই আমেরিকার মানুষ প্রথম জেনারেটর পায়।কর্মাশিয়াল ভাবে ইলেক্ট্রিক কারেন্টকে কাজে লাগানো হয়। একটা ছোট্ট তথ্য দিই । বিজ্ঞানের গবেষনা লদ্ধ ফলের ১% ও প্রযুক্তির কাজে আসে না। কারন টা এই যে ল্যাবেটরি থেকে প্রোডাকশনে আনতে বিপুল ইনভেস্টমেন্ট লাগে। এবং তার জন্যে দরকার ইনফ্রাস্ট্রাকচার -বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ব্যঙ্কার, ভিসি-অনেক কিছু এক করলে একটা ল্যাবেটরী প্রোডাক্ট মার্কেটে আসে। এই ইনফ্রাস্টাকচার বহুদিন শুধু আমেরিকা, বৃটেন এবং জার্মানিতেই ছিল-এখন ভারত, চীন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়াতে ও আছে। কিন্ত আমেরিকার তুলনায় তা কিস্যু না। ধরুন স্যোশাল মিডিয়া। ১৯৯০ সাল থেকেই কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে পেটেন্ট ফাইল করেছেন, প্রচুর পাবলিশ করেছে। কিন্ত সোশাল মিডিয়া বলতে আজকে- ফেসবুক, ইউটিউব এং টুইট্যার। তিনটিই আমেরিকার।
ভারতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব টেকনোলজীতে প্রচুর ভাল গবেষনা হচ্ছে। আমি নিজের ব্যবসার খাতিরেই গত পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করছিলাম যদি কোন গবেষনালদ্ধ কাজকে প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতে বা বিশ্বে আনা যায়। কিন্ত বিধি বাম। ভারতে সেই ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই।
বই আর ল্যাবেটরির মধ্যে আবদ্ধ বিজ্ঞানে কিজনগনের কোন উপকার হয়? কিস্যু হয় না। যতক্ষন না পর্যন্ত তা মানবকল্যানে ব্যপকভাবে কাজে আসছে। আর সেই প্রসেসটা বহুদিন যাবত শুধু আমেরিকাতেই ছিল। যার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ান বিজ্ঞানের জন্য আমেরিকার থেকেও বেশী খরচ করেছে ঠিকই-কিন্ত তার পরেও তাদের দেশের লোক অনাহারে থেকেছে। কি লাভ সেই বিজ্ঞান খরচায়, যা করার পরেও দেশের লোক অনাহারে থাকে, কারন সেই বিজ্ঞান জনগণের কাছে পৌঁছায় না?
৪) সোভিয়েত ইউনিয়ানে সাহিত্য? অক্টবর বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়া সাহিত্য ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। চেকভ, টলস্টয়, ডস্টভয়েস্কি। ১৯১৭ সালের পরে সেই মানের সাহিত্য কোথায় রাশিয়াতে? ছিলেন গোর্কি। তাও স্টালিনের ভয়ে বিশেষ কিছু লেখেন নি বিপ্লব পরবর্তি রাশিয়াতে। সোভিয়েত থেকে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন বরিস পাস্তারনেক । তিনি তা পেয়েছেন কমিনিউজমের সমালোচনা করেই। পেয়েছেন আলেক্সান্ডার সলজেনিস্তিন। যাকে গুলাগ বা লেবার ক্যাম্পে পাঠিয়েছিলেন কমিনিউস্টরা। অভিজিত রায়ের লেখা আছে তার ওপরে-কিভাবে কমিনিউস্টরা হত্যা করতে চেয়েছিল শতাব্দির এক সেরা প্রতিভাকে। আর নোবেল পেয়েছেন মিখাইল সকোলভ। ইনিই একমাত্র স্টালিনের সুনজরে ছিলেন, ১৯৩৭ সালে সুপ্রিম সোভিয়েতের সদস্যও ছিলেন।
৫) সোভিয়েত ইউনিয়ানের বিজ্ঞান ? গোলাম ভাই লিখেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ান থেকে ১০০ জন বিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন! বাস্তবে নাম্বারটা ৭। এদের মধ্যে অনেকের কাজের সাথে আমি বিস্তর পরিচিত ( ল্যান্ডাউ, চেরেনকভ, ক্যাপিসজা, প্রিগোনিন )। ল্যান্ডাউএর লেখা থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স পড়েই ছাত্র অবস্থায় বড় হয়েছি। উনি আমার প্রিয় বিজ্ঞানী। কিন্ত গোলাম ভাই কি জানেন এই অসামান্য প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে সাইবেরিয়াতে গাছ কাটটে পাঠিয়েছিল স্টালিন জমানা? নেহাত, লান্ডাউ এর বস কোন রকমে এক বছর বাদে, অর্ডার রভার্সাল করতে সক্ষম হন। এরকম কত শত ল্যান্ডাউ স্টালিনের পার্জে মারা গেছেন তা কি গোলাম ভাই জানেন?
ল্যান্ডাঊ একবছর সাইবেরিয়াতে গাছ কাটার পরে, মস্কোতে ফিরে শোনা যায় মৌনব্রত পালন করতেন। কারুর সাথে কথা বলতেন না। পাছে তাকে আবার সাইবেরিয়াতে পাঠানো হয়!
বাই দ্যা ওয়ে গোলাম ভাই-আরেকটা ছোট তথ্য জানুন। নোবেল প্রাইজ দেওয়া শুরু হয়েছে ১৯০১ সাল থেকে। অক্টবর বিপ্লব ১৯১৭ সালে। এই ১৬ বছরের মধ্যেই, প্রাক বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় ( যা কমিনিউস্টদের মতে নাকি কিছুই ছিল না), তিনজন নোবেল পেয়েছেন বিজ্ঞানে। ইভান পাভ্লভ (১৯০৪-মেডিসিন), মেটচিনকভ ( মেডিসিন ১৯০৮), অস্টোয়াল্ড ( কেমিস্ট্রি, ১৯০৯)। আর সোভিয়েত বেঁচেছিল ৭৪ বছর। সেই ৭৪ বছরে এসেছে ৭ টি নোবেল।
বিপ্লবের আগে যে রাশিয়াতে মেন্ডেলীভ, পাবল্ভ, ওস্টোওয়াল্ড, টলস্টয়, চেকভ, ডস্টভয়েস্কিরা জন্মেছে -সেই রাশিয়া খুব অনুন্নত ছিল? আরেকটু পড়াশোনা করুন। ১৮৬৫ সাল থেকে কিভাবে আস্তে আস্তে সংস্কারের মাধ্যমে ১৯০৫ সালের মধ্যেই রাশিয়া বৃটেন, জার্মানির সমকক্ষ শিল্প শক্তি হয়ে ওঠে সেসবের ইতিহাস ত কিছু জানেন না। শুধু লালমার্কা চটি বই ভিত্তি করে বিতর্ক হয়?
৬) আসলে গোলাম ভাই এর সমস্যা অন্যত্র। উনিও সেই রূপকথায় বিশ্বাস করেন লেনিনের অক্টবর বিপ্লবের ( পড়ুন প্রতিবিপ্লব -কেন ? সেটাও লিখেছি এখানে https://blog.mukto-mona.com/2008/11/08/136/) এর আগে রাশিয়ার অবস্থা ছিল পুরাই দুরাবস্থা!
অহ কি অসাধারন গল্পই না ফেঁদেছিলেন কমিনিস্টরা? গোলাম ভাই কি জানেন ১৯১৭ সালের বিপ্লবের আগে রাশিয়া শিল্প উৎপাদনে ছিল বৃটিশ,জার্মানী এবং ফ্রান্সের পরেই? আর কি গল্প জানেন গোলাম ভাই? যাই হোক কমিনিউস্টরা যে রাশিয়ার ইতিহাস একদম পড়ে নি-সেটা আমি ভাল করেই জানি। আর সেই জন্যেই তারা যেসব গালগল্পে বিশ্বাস করে তার লিস্ট ও একটা দিয়েছিলাম (https://blog.mukto-mona.com/2009/12/10/3648/)
রাশিয়া এতই পিছিয়েছিল যে বিপ্লব পূর্ব রাশিয়াতে টলস্টয়, চেকভ এবং ডস্টভয়েস্কি জন্মাল? কোন ধরনের ব্রেইন ওয়াশড কমিনিউস্টরা এই টাইপের ঢপে বিশ্বাস করবে?
এই রিবিউটাল দীর্ঘ করার কোন ইচ্ছা নেই। কারন এটা আমার কাছে পরিস্কার গোলাম ভাই সোভিয়েত ইউনিয়ানের ইতিহাস বা রাশিয়ার ইতিহাস নিয়েই কিছুই পড়েন নি। প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের মধ্যে গুলিয়েছেন।
৭) এই বার কিউবার প্রসঙ্গে আসি। সবাই কিউবায় যায় হয় হেলথ ট্যুরিজমের জন্য , নইলে সেক্স টুরিজমের জন্য। এটা ওপেন সিক্রেট। প্রশ্ন হচ্ছে যে সিস্টেমে একজন মেয়ে অভাবের তাড়নায় বেশ্যাবৃত্তি নেয়, সেই রাজনৈতিক সিস্টেম কি ভাল? বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গের অসংখ্য মেয়ে দারিদ্রের কারনে দেহ ব্যবসাতে আসে। মুম্বাই, কলকতার ব্রথেলে বাঙালী মেয়ে গিজগিজ করছে।
কেন সেখানে গুজরাটি, মারাঠী নেই? কারন তাদের অর্থনীতি ভাল।
আমি জানি কমিনিউস্টরা ছেঁড়া জাঙিয়ার বুক পকেট বানানোর চর্চা করে। কিন্ত এইটুকু সামান্য জিনিস বুঝতে কি সেক্সিস্ট ইত্যাদি আজগুবি তথ্যের অবতাড়না করতে হয়?
একটা দেশ এবং সিস্টেম-শুধ্য কিছু পুঁথি দিয়ে জানা যায় না। তার জন্যে সেই দেশে যেতে হয়। সেই দেশের লোকেদের সাথে কথা বলতে হয়। তাদের সাহিত্য সংস্কৃতিকে জানতে হয়।
রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ানকে নিয়ে আমার অবশেসন আছে । কারন আমি রাশিয়ান সাহিত্যের ভক্ত। রাশিয়ান বিজ্ঞানের ভক্ত। প্রচুর রাশিয়া বিজ্ঞানী আমার বন্ধু, যারা ওই সিস্টেমে বড় হয়েছেন কিন্ত তারপরেও আমার লেখাটির প্রতিটা কথা সত্য। কারন সব বাজেট যেত অস্ত্র এবং মহাকাশ গবেষনাতে। লোকে খেতে পাচ্ছে না-অথচ কৃষিবিজ্ঞানের গবেষনাতে বাজেট থাকত না। আরো অনেক লিখতে পারি-হয়ত লিখতাম এইসব নিয়ে একদিন। কিন্ত পশ্চিম বঙ্গে এখন আর বামেরা নেই । ৫৩% ভোট, এখন ১৪% এ। ফলে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।
কারনটা বুঝতে গোলাম সারোয়ারকে এখনো অনেক পড়াশোনা করতে হবে।

No comments: