Saturday, June 24, 2017

বাঙালী ব্যবসা বিমুখ-দায়ী রবীন্দ্রনাথ ?

বাঙালী ব্যবসা বিমুখ।  সমস্যাটা সবাই স্বীকার করে-বিবাদ এর কারন নির্নয়ে। কে দায়ী?

       প্রবাসী এবং এলিট বাঙালীদের মধ্যে একটা চালু ধারনা ( মানে ওই উইকেন্ড প্রবাসী পার্টি ) -বাঙালীর ব্যবসার গুষ্টি উদ্ধার করেছেন দুজন- রবীন্দ্রনাথ এবং কার্ল মার্ক্স!

      প্রথমজন বাঙালীকে এমন ভাবে গান, কবিতায় মজিয়েছেন -তার থেকে বাঙালী জাতির উদ্ধার নেই! অনেকেই আমাকে বলেন যদ্দিন ওই দাড়িওয়ালা বাঙালীর দ্বিতীয় ঈশ্বর, এই জাতিকে উদ্ধার করা প্রথম ঈশ্বরের পক্ষেও অসম্ভব।

       দ্বিতীয় জন "নাকি" শিখাইয়াছে  পুঁজি এবং ব্যবসা চৌর্য্যবৃত্তি!  বাঙালীর বামমনোবৃত্তিতে লক্ষ্মী চঞ্চলা।

  অধিকাংশ পার্টিতেই  ব্যবসার জগতে বাঙালীর ব্যর্থতা নিয়ে আলোচন হয়- মূল নির্যাস- এই দুজন বাঙালীর জীবনে আফিং এবং হিরোইন!! এর থেকে নাকি উদ্ধার নেই!

        মুশকিল হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ এবং মার্ক্সকে বুঝতে ব্যর্থ হওয়াটা বাঙালীর জীবনের সব থেকে বড় ঐতিহাসিক ট্রাজেডি।

    প্রথমে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আসি।

    রবীন্দ্রচর্চা কি ব্যবসা চর্চার অন্তরায়?
 
     আমি মনে করি উল্টোটা।  ব্যাবসার সব থেকে গুরুত্বপূর্ন ফাংশান মার্কেটিং। যেখানে একটা গুছিয়ে গল্প বলতে হয়।  গুছিয়ে গল্প বলার ক্ষমতা না থাকলে, কারুর ব্যবসাতে আসাই উচিত না। ক্লায়েন্টের মাথার মধ্যে গল্পের মাধ্যমে ঢুকতে, বেশ ভালোই কমিউনিকেশন লাগে।  সাহিত্যচর্চা সেই কাজের সহায়ক। অন্তরায় কেন হবে?

    আসলে বাঙালীর সমস্যা দুটো ক্ষেত্রে।
   
    প্রথমে তারা দেখে সফল ব্যবসায়ী মানেই মারোয়াড়ি। যাদের রবীন্দ্রসংগীত নেই, কবিতা নেই। এতে অনেক বাঙালীর বদ্ধমূল ভূল ধারনা ব্যবসায়ী হতে গেলে সংস্কৃতি বিরোধি হনুমান চল্লিশা হতে হইবে।

খুব ভুল ধারনা। ব্যবসা দু ধরনের-ডিস্ট্রিবিউটশন বা ট্রেডং এবং প্রোডাউসার বা যারা কোন প্রোডাক্ট বানায়।  যারা শাড়ি তৈরী করছে, বা কিছু তৈরী করছে-তারা সবাই শিল্পী। ডিজাইন সেখানে মুখ্য। প্রযুক্তি জাস্ট একটা টুল।  শিল্প সংস্কৃতি যা বাঙালীর রক্তে, তা ব্যবসার সহায়ক। ভুলে গেলে চলবে একদা বাঙলার মসলিন গোটা পৃথিবীতে যেত।

  পেশার প্রয়োজনেই আমেরিকাতে মাঝারি বা ছোট ব্যবসায়ীদের সাথে আমার ওঠাবসা বেশি। তাদের অধিকাংশই বেশ ভাল লেখক-এবং তাদের শিল্প চেতনাও উন্নতমানের।

  সাহিত্য, শিল্পচর্চার সাথে ব্যবসার বিরোধ নেই।

  আসলে প্রিন্স দ্বারকানাথের নাতিপুতিরা ব্যবসায় ব্যর্থ হওয়ার কারন নির্নয় করতে গিয়ে অনেকেই বলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ  একদিকে ব্যবসা অন্যদিকে নাটক করতে গিয়ে ব্যবসা ডুবিয়েছেন।  এটাও ভুল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আসলে জাহাজ ব্যবসায় আসাটাই উচিত ছিল না।  হ্যা, এই প্রশ্ন উঠবেই যে যে ফ্যামিলির প্রতিষ্ঠাপুরুষ ভারতের প্রথম আন্তারপ্রেনার প্রিন্স দ্বারকানাথ, সেই ঠাকুর ফ্যামিলি টাটা হাউস না হয়ে ঠাকুরবাড়ি কেন হল ? দেবেন্দ্রনাথের কোন ছেলে কেন জামসেদজি টাটা হল না?

  এর উত্তর দেবেন্দ্রনাথ নিজে। প্রিন্স দ্বারকানাথ যেখানে ভারতে আধুনিক ব্যবসার সূচনা করেছেন। প্রথম কয়লাখনি, স্টীমার এমন কি স্টিম ইঞ্জিন তৈরীর ফ্যাক্টরী করছেন হাওড়াতে, দেবেন্দ্রনাথ যেকোন কারনেই হৌক আধ্যাত্মিক মোহে চালিত হয়ে বাবার স্পিরিট পান নি।  সংসার তাকে টানে নি। ফলে দ্বারকানাথের কোন নাতির মধ্যেই, তার ব্যবসায়িক দূরদৃষ্টি ছিল না। থাকলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জাহাজ ব্যবসায় নামতেন না। সেই সময় স্টিল, টেক্সটাইল, জুট্মিল আস্তে আস্তে প্রসার লাভ করছিল। আচার্য্য প্রফুল্ল রায় প্রায় বিনা সম্বলে বাড়ির বারান্দায় বেঙ্গল কেমিক্যাল দাঁড় করিয়েছেন তখন।  জ্যোরিরিন্দ্রনাথের যদি দেবেন্দ্রনাথের মতন ব্যবসায়িক বুদ্ধি থাকত, উনি ব্যবসাটা ঠিক ঠাক নির্বাচন করতেন।

   এবার আসি মার্ক্স প্রসঙ্গে।

   মার্ক্সবাদের চর্চা কি বাঙালীর ব্যবসার সব থেকে বড় কালাপাহাড়? যাদবপুরে কাছে আজকে যেখানে সাউথ সিটি মল-একদা সেখানে ছিল উষামার্টিন। তার চারপাশে ছিল আরো চারটে বিখ্যাত ফ্যাক্টরী। যার মধ্যে ছিল সুলেখা কালি।  জ্যোতিবসুর সিটুর শ্রমিক আন্দোলনের দাপটে ওই এলাকার সব ফ্যাক্টরীর গঙ্গাপ্রাপ্তি হয় ১৯৯০ সালের আগেই!

  সুতরাং মনে হতেই পারে কার্লমার্ক্সই সেই কালাপাহাড় যার চর্চা  বাঙালীর শিল্প, ব্যবসাকে ধ্বংস করেছে!!

  আসল সমস্যাটা মার্ক্সবাদ চর্চার না-মার্ক্সের লেখার বদ হজমে। বাঙালী কমরেডদের মার্ক্স পড়ার মতন বিদ্যা পেটে নাই।  মার্ক্সের লেখা সবটাই ধনতন্ত্রের বিশ্লেষনে-মার্কেটের বিশ্লেষনে-পুঁজির বিশ্লেষনে। বরং মার্ক্স পড়লে ব্যবসা এবং মার্কেট কিভাবে চলে, তা আরো ভাল করে বোঝা উচিত। সেটা ব্যবসা বুঝতেই সাহায্য করে।

  বদহজম হলে অবশ্য অন্যকথা। কমিনিউজম বলতে যা বাজারে চলে, তা লেনিনবাদ-যিনি অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ন ক্ষেত্রে মার্ক্সের একশো ডিগ্রি বিপরীতেই ছিলেন। সব থেকে বড় কথা তার লেখায় দ্বান্দিক বস্তুবাদ, বা মার্ক্সিয় বিশ্লেষন কিছুই পাওয়া যায় না। হ্যা তার লেখার মধ্যে মার্ক্স এবং দ্বান্দিক বস্তুবাদের প্রচুর জার্গন পাবেন- কিন্ত পদ্ধতিটা পাবেনা। পাতি ইন্টেলেকচুয়াল ডিজহনেস্টি।

 যার জন্য আমেরিকার একাডেমিক সার্কলে  লেনিনকে কেউই মার্ক্সিয় রাজনীতির ধারক বলে মনে করেন না। বরং চমস্কি সরাসরিই লিখেছেন লেনিন বামপন্থী আন্দোলনের কলঙ্ক।  আরেক ধরনের ফ্যাসিবাদ।

সুতরাং মার্ক্সীয়চর্চা না, মার্ক্স চর্চার অভাবের কারনেই বঙ্গজ বামেরা লেনিনবাদের খপ্পরে পরে ব্যবসা বিরোধি অবস্থান নেয়।  মার্ক্স ও মালিক শ্রেনীর বিরোধি ছিলেন-ধর্মঘটের পক্ষেও ছিলেন। কিন্ত সেই মার্ক্স এক্টিভিস্ট মার্ক্স-যিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন, তার এই এক্টিভিস্ট পজিশন, তার বিশ্লেষনের সাথে খাপ খায় না। এক্টিভিস্ট মার্ক্স নিজেই স্বীকার করতেন-তিনি মার্ক্সবাদি নন!!  কমিউনিস্ট এক্টিভিস্ট মার্ক্সকে তার সমাজবিজ্ঞানএর সাথে মেশালে ঐতিহাসিক মুশকিল আছে-মার্ক্সের ভূত তাতে সায় দেবে না।


কিন্ত মার্ক্সবাদের অন্যধারাও আছে ইউরোপে। যাদের কাউন্সিল কমিনিউস্ট বলে। এরা কিন্ত কমিউনিটি ভিত্তিক ব্যবসার কথা বলেন, যেখানে ফ্যাক্টরি কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনার কথা বলা হয়। চীনের অনেক বড় বড় ব্যবসা ফ্যাক্টরি কাউন্সিল অর্থাৎ ইলেক্টেড শ্রমিক মেম্বারদের দিয়েই চলে।
 
 মোদ্দা কথা ফ্যাক্টরী অচল করে দিলে যে শ্রমিক শ্রেনীই টিকবে না-এই টুকু বাচ্চাদের বুদ্ধিও যাদের মাথায় নেই, তাদের যদি দেওয়া হয় রাজার রোল -তাহলে কি দুর্দশা হতে পারে-সেটা পশ্চিম বঙ্গ দেখেছে ৩৪ বছর।

 সারবক্তা। আসলে অলসতাই মূল কারন ব্যবসাতে না আসার ।


























 
             

No comments: