Tuesday, June 6, 2017

প্রযুক্তি, অটোমেশন এবং সাম্প্রদায়িকতার ভবিষ্যত


   ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদিদের উত্থানে সবাই আতঙ্কিত। দেখেশুনে মনে হতেই পারে প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে কোথায় ধর্ম সম্প্রদায় উবে যাবে-কিন্ত বাস্তবে হচ্ছে উলটো। সাম্প্রদায়িকতা, জাতিবিদ্বেশ কমার লক্ষন নেই-বরং ফেসবুকের মাধ্যমে ফেক নিউজ ছড়িয়ে আরো বেশী করে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে।

  প্রশ্ন হচ্ছে এমনই চলবে? নাকি আরো বিশ বছর বাদে ভালো কিছুর আশা আছে?

 না কোন আশাবাদ না, একদম নির্মোহ দৃষ্টিকোন থেকে যদ্দূর অদূর ভবিষ্যত দেখা যায়-তাতে পরিস্কার দেখছি, এই ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতার জঞ্জাল দূর হল বলে।  প্রযুক্তিই একমাত্র সমাজ বদলাতে সক্ষম- সেই মার্ক্সীয় মোক্ষম বাণী এখানে না খাটার কোন কারন নেই।


  মূলত তিনটে কারনে ভবিষ্যতে ধর্মীয় পরিচয় এবং সাম্প্রদায়িকতা লোপ পাবে।

 প্রথম কারন নতুন প্রযুক্তির সামনে মিথ বা ধর্মভিত্তিক রূপকথার অবসান।  প্রতিটা ধর্মের ভিত্তিই রূপকথা ।  মহম্মদ, কৃষ্ণ, যীশু এরা সবাই রূপকথার চরিত্র। যদিও যীশু এবং মহম্মদকে তাদের ধর্মের লোকেরা ঐতিহাসিক  চরিত্র বলে মানে, ঐতিহাসিকরা কিন্ত মানেন না-কারন সত্যিকারের ঐতিহাসিক প্রমান বলতে যা বোঝায়, তা নেই। না দয়া করে আকাশ থেকে পড়বেন না-গুগলে হিস্ট্রিসিটি অব জেসাস বা মহম্মদ বলে সার্চ দিলেই সব তথ্য পেয়ে যাবেন, কতটা রূপকথা গুলে খাওয়ালে ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। শুধু ইসলাম বা খ্রীষ্ঠান ধর্ম না। কমিনিউস্ট সম্প্রদায় ও সোভিয়েত বিপ্লব নামক এক রূপকথা প্রসবের মাধ্যমেই প্রচুর বাচ্চা এবং যুবার মাথা খেয়েছে।  প্রশ্ন হচ্ছে এসব সত্য না রূপকথা,  ইন্টারনেট জমানায় এখনই তা পাওয়া যায়। তাহলে বর্তমানে কেন নিধার্মিকদের সংখ্যা বাড়ছে না? বরং হিজাব, বোরখা, দাড়ি, শনির মন্দির সবই বাড়ন্ত!

 আসলে একটা নিঃশব্দ বিপ্লব এসেছে ইন্টারনেটের হাত ধরে -সেটা ভারতে এখনো না এলেও পাশ্চাত্যে খুব ভাল ভাবেই এসেছে। ইউরোপে অনেক উন্নত দেশেই নাস্তিকদের সংখ্যা বর্তমানে খৃষ্ঠানদের থেকে বেশী। আমেরিকাতে ১৯৮০ সালে নাস্তিকদের সংখ্যা ছিল মোটে ৮%।  বর্তমানে আমেরিকাতে ২০ বছরের নীচে নাস্তিকদের সংখ্যা ৪০% বা তার বেশী। অর্থাৎ যে জেনারেশন ইউটিউব, গুগল, উইকি দেখে ছোটবেলা থেকে বড় হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই উন্নত বিশ্বে নির্ধামিক। ইনফ্যাক্ট সবথেকে গোঁড়া ধার্মিক বলে পরিচিত আমেরিকান মুসলিমদের ছেলে মেয়েদের মধ্যেও সংখ্যাধিকই নাস্তিক বা আজ্ঞেয়বাদি বা মানবতাবাদি।  ভারতে এই ব্যপারটা আসে নি দুটো কারনে। এক, এখানে ছেলেমেয়েদের স্বাধীন চিন্তা করার অবকাশ কম। দুই,  এখানে ছেলেমেয়েদের ওপর তাদের বাবা মায়ের খবরদারি বেশী। ফলে ভয়ে অনেকেই উলটো দিকে হাঁটে না।

দ্বিতীয় বড় কারন সাম্প্রদায়িকতার চালিকা শক্তি-রাজনীতির ভোলবদল হতে চলেছে।  সবাই "কেজো" নেতাকে দেখতে চাইছে।  নরেন্দ্রমোদি বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের মধ্যে লিব্যারালরা সাম্প্রদায়িকতার ধাবার গন্ধ পেলেও বাস্তব এটাই এদের লোকে ভোট দিয়েছে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশায়। যাতে ধান্দা, চাকরি বাকরি ভাল হয়।  যদ্দিন লিব্যারালরা নরেন্দ্রমোদিকে সাম্প্রদায়িক, ট্রাম্পকে রেশিস্ট বলে গালাগাল দেবেন -কিস্যু হবে না। এরা জিততেই থাকবেন। ইনফ্যাক্ট কংগ্রেসের সোল্কড সংখ্যালঘু তোষনের রাজনীতিই অনেক বেশী সাম্প্রদায়িকতার জন্মদাত্রী।  মমতা ব্যার্নাজির জেতার মূল কারন তার কাজ, সাম্প্রদায়িক তোষন না। লিব্যারাল রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম যদি "কেজো" নেতার জন্ম দিত, তারাই জিতত।  গোটা বিশ্ব জুরে আজ যাদের নেতৃত্ব-পুতিন, ট্রাম্প, মোদি-এদের লিব্যারালরা ঘৃণা করেন বটে-কিন্ত বাস্তব হচ্ছে এরা কাজের লোক। এবং অটোমেশনের দৌলতে যত চাকরির সংস্থান কমবে, ততই জনগন সেই ধরনের নেতা চাইবেন যারা চাকরি সৃষ্টিতে সক্ষম। ভাল অর্থনীতি দিতে সক্ষম।  লিব্যারাল প্ল্যাটফর্ম যদি সেই আশা দিতে পারে, তারাই জিতবেন। মুশকিল হচ্ছে এই ধরনের নেতারা জাতিয়তাবাদি প্ল্যাটফর্ম থেকেই আসছেন-ফলে জাতিবিদ্বেশের প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।  কিন্ত এটা যতটা জাতিয়তাবাদি রাজনীতির সাফল্য, তার থেকে বেশী লিব্যারাল রাজনীতির ব্যররথতা-তারা জনগনের পালস বুঝতে ব্যর্থ।  আমার ধারনা লিব্যারাল রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলি দ্রুতই বুঝবে, তাদের রাজনীতি আর লোকে খাচ্ছে না-এবার কাজের গপ্পো লোকে শুনতে চাইছে-তারাও বদলাবেন।

তৃতীয় কারন-অর্থনৈতিক । অর্থাৎ একজন ধার্মিক ব্যক্তি অর্থনৈতিক ভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য হবেন। ভবিষ্যতে। খেয়াল রাখতে হবে, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে বা টিকিয়ে রাখতেই অধিকাংশ লোক ধর্মকম্ম দেখান। উন্নত বিশ্বে আমরা ধার্মিক লোকেদের পেশাদারি ক্ষেত্রে এখুনি এড়িয়ে চলি। কারন সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে অসুবিধা। আউটলুক মেলে না।  পেশাদারি ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে ধার্মিক লোকেদের গ্রহনযোগ্যতা কমবে। ইনফ্যাক্ট কাজের ক্ষেত্রে সবাই "গর্বিত ধার্মিক" দের ভয় পায়। আমি কত বড় হিন্দু বা মুসলমান-এই বিজাতীয় আইডেন্টি ক্রাইসিসে ভোগা মানসিক রুগীরা, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাতিল হলে-সেটা দেশ এবং দশের মঙ্গল।

অবশ্য এর মানে এই না, যা মানুষের সার্বিক খোঁজ, বা নিজের প্রতি নিজের অনুসন্ধান-সেটা আধ্যাত্মিকতাই বলুন বা বিশ্বমানব মাঝে নিজের সন্ধানই বলুন-সেটা বদলাবে। আমি কি বা আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি সেই চিরন্তন প্রশ্ন থেকেই যাবে। শুধু এইসব প্রশ্নের "মেইড ইজি উত্তর" আছে মার্কা গুরু এবং ধর্মগুলোর উৎপাত কমবে।  তবে সেটাও ভারতে নতুন কিছু না। চন্দ্রগুপ্ত মোর্য্য বিয়াল্লিশ বছর বয়সে জৈন ধর্মে সন্ন্যাস নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন জীবনের উত্তর খুঁজতে। সেই অতীতে কোন ধর্ম, দর্শন, গুরুবাবারা জীবনের এইসব গুরুতর প্রশ্নের উত্তর দিত না। প্রত্যেকটা লোককে তার নিজের মতন করে উত্তরটা খুঁজতে হত সারাজীবন। গীতা, কোরান, বাইবেলের মেইড ইজি সেখানে পাওয়া যেত না।  সেইখানেই আমরা ফিরছি দ্রুত।





         

No comments: