দীর্ঘদিন থেকেই লিখছি, প্রযুক্তি দ্রুত এগোচ্ছে, অথছ সেই অনুপাতে শিশুশিক্ষা বা স্কুল কলেজের পরিকাঠামো বা সিলেবাস কিছুই এগোচ্ছে না। এই মুহুর্তে পৃথিবীর প্রায় সব চাকরিই -জ্ঞান বা স্কিল ভিত্তিক। কিন্ত আমরা দ্রুত সেই দিনের দিকে এগিয়ে চলেছি, যেখানে "জ্ঞানের" জন্য না, কল্পনাশক্তির জন্যই মানুষের জীবিকা টিকে থাকবে। একটা ছোট সিঙ্গলবোর্ড কম্পিউটার রাসবেরীপাই এর মধ্যেই প্রায় গোটা উইকিপেডিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া যায়!
জ্ঞানে কম্পিউটারকে হারানো অসম্ভব-কিন্ত কল্পনাশক্তি?
মানুষের যা নিজস্ব-সেটা তার কল্পনাশক্তি-যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ কবিতা, গান, সাহিত্য, আঁকাতে। তাত্ত্বিক বিজ্ঞানে-যেখানে শ্রেফ লিফটে মানুষের ওঠা নামা দেখে আইনস্টাইন স্পেস-টাইমের বক্রতা অনুমান করতে পারেন । এই যে এত হাজার হাজার মোবাইল এপ প্রতিদিন বাজারে আসছে-এর মধ্যে শুধুমাত্র হাতে গোনা কয়েকটিই টিকে যায়। দেখা যাবে শুধু সেইগুলিই টিকছে, যেগুলির ডিজাইন খুব সুন্দর এবং সহজ। ইঞ্জিনিয়ারিং শুধু মাত্র টুলস। লোকে কিন্ত কেনে সেই ভাল ডিজাইনটাই-অর্থাৎ মানুষের কল্পনা।
খুব কম বাচ্চাই আজকাল কবিতা লেখে-কি আমেরিকাতে , কি ভারতে! কবিরা চিরকালই ঝোলাআউলা অকাজের ফেরিওয়ালা--্যেহেতু তাহা পেশা না, কবিতা শেখানোর কোন স্কুল নেই !!
স্কুলে বাচ্চাদের এইসব সৃজনশীল কাজে উৎসাহী করার বদলে বাবা-মায়েরা আটজন নজন করে টিউটরের কাছে পাঠাচ্ছে! যদি কোন রকমে জয়েন্টে একটা রাঙ্ক লাগিয়ে, প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কোন রকমে বিটেক ডিগ্রি নিয়ে-আইটিতে ঢুকে পরলেই মধ্যবিত্ত স্বপ্নের আলাদিনের প্রদীপ হাজির!!
মুশকিল এই যে, ওই ক্লার্ক গোত্রীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সুদিন শেষ-না তাদের আর কোন চাকরি নেই। এই নয় যে ইঞ্জিনিয়ারিং এ চাকরি নেই- আছে, অনেক আছে। তবে যারা সৃজনশীল। যারা কল্পনায় ডানা মেলে উড়ে যেতে পারে বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের কল্পরাজ্যে।
আমি কবিতা বা সাহিত্যের প্রশ্ন কেন তুললাম? সার্থক কবিতা বা সার্থক সাহিত্যের প্রথম লক্ষণ, শব্দের "নন-কনটেক্সুয়াল" ব্যবহার। অর্থাৎ ধরুন গোলমরিচ আমজনতার কাছে-শুধু ঝাল মশলা। কিন্ত একজন কবি যখন লেখেন " গোলমরিচ রোদ" -শুধু একটা শব্দের অপ্রচলিত ব্যবহারে নতুন দৃশ্যকল্প তৈরী-যা আমাদের নতুন একটা অনুভূতির জন্ম দিতে সক্ষম।
এটা কম্পিউটার পারবে না-কারন সে শুধু শব্দের কনটেক্সট মিনিংটাই জানে।
শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই নির্মম সত্য-আগামি দিনে চাহিদা থাকবে তাদের-যারা এই "নন-কনটেক্সসুয়াল" কল্পনায় এগিয়ে। আমি শুধু কবিতার উদাহরন দিলাম-কিন্ত এই আউট অব বক্স চিন্তা পদার্থবিদ্যা, কেমিস্ট্রি, ইঞ্জিনিয়ারিং সর্বত্রই লাগে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা দিক বিজ্ঞান, অন্যদিকটা কিন্ত আর্টস।
অথচ, বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থায়, শিশুমনের যে অসাধারন কল্পনা শক্তি-তাকে কবরে পাঠানোর সব আয়োজন পূর্ণ! বাচ্চাদের আরো বেশী করে কবিতার রাজ্যে, ঠাকুরমার ঝুলির রাজ্যে পাঠানোর বদলে, তাদেরকে বলা হচ্ছে যাও আলিপুর জেলে টিউটরের কাছে দুঘন্টা পাথর ভেঙে এস !
তবে সব রাষ্ট্রই মুর্খ না। ফিনল্যান্ড প্রথাগত শিক্ষার দুর্বলতা সবার আগে বুঝেছে। ওখানে এখন বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষা মানে সৃজনশীলতার পিকনিক। সিলেবাস তারা তুলে দিয়েছে। আমার হাসি পায় এই ভেবে যে বাংলা বা ইংরেজির ক্লাসে কোন গল্প বা কবিতা থেকে "প্রশ্ন" দেওয়া হত। প্রশ্ন উত্তর সবকিছুই ধরাবাঁধা! এখনো তাই চলছে!! তাহলে ছেলেমেয়েরা সাহিত্যের রসটাই বা পাবে কি করে-বা সাহিত্যের যে একটা বড় কাজ, মস্তিস্কের সৃজনশীলতা, কল্পনা বা অনূভূতিগুলোকে বাড়ানো- সেটাও হচ্ছে না। অথচ এটাই আগামীদিনের কেরিয়ারের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ন শিক্ষা।
এটাকে আমার আষাঢ়ে চিন্তা ভাববেন না। চীনের সরকার দুই দশক আগে সমীক্ষা করে- আমেরিকার সমতুল্য হতে গেলে, আমেরিকার মতন আবিস্কার ভিত্তিক সমাজ হতে গেলে, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কি পরিবর্তন দরকার?
সেই সৃজনশীলতা আসবে কোত্থেকে? চীন সরকার তাদের বিজ্ঞান, অঙ্ক বা ভূগোলের কোর্স বাড়ায় নি। তারা তাদের সাহিত্য শিক্ষাকে সম্পূর্ন অন্য লেভেলে নিয়ে গেছে। যাতে একদম ছোটবেলা থেকে, প্রাইমারী স্কুল থেকেই বাচ্চারা আউট অব কনটেক্স ভাবতে পারে। ইনফ্যাক্ট চীনারা এমনিতেই কবিতা ভালবাসে, কবিতার মধ্যে দিয়েই তারা বাচ্চাদের সৃজনশীলতার প্রসারে নেমেছে।
বাংলায় কবির অভাব নেই-কিন্ত কবিদের অভাব আছে। প্রাইভেট টিউটরের বদলে, আপনার সন্তানকে কবিদের কাছে পাঠালে-আখেরে কেরিয়ারের ক্ষেত্রেও কিন্ত আপনার সন্তানের লাভই বেশী।
No comments:
Post a Comment