রাজনৈতিক হিংসা, শুধু রাজনীতির কারনে খুনোখুনি ভারতে জলভাত, কিন্ত আমেরিকাতে "কিছুটা" বিরল। আজ সকালে এক বার্নির এক চরমপন্থী ভক্ত, রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যানদের বেসবল প্রাক্টিসে গুলি চালায়। গুলি চালানোর সময় সে জিজ্ঞেস করছিল-রিপাবলিকান না ডেমোক্রাট? গুলিতে অনেকেই আহত, রিপাবলিক্যান কংগ্রেসম্যান স্টিভ স্ক্যালিজ গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুমুখে। রাজনৈতিক খুনোখুনি সত্তরদশকের আগে এখানে ভালোই ছিল-কিন্ত আস্তে আস্তে আমেরিকার রাজনীতি গুন্ডামোমুক্ত হয় সত্তরের দশক থেকে।
আমি আমেরিকাতে আসি ২০০১ সালে। আমাকে ড্রাইভিং শেখাত এক বেকার আইনজীবি। নিউজার্সিতে সেই ভদ্রলোক, রাজ্যের গর্ভনরের নাম পর্যন্ত জানত না। অধিকাংশ আমেরিকানদের সেই সময় রাজনীতিতে কোন উৎসাহ ছিল বলে দেখি নি।
আমেরিকাতে জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা যত বেড়েছে, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এদেশেও রাজনীতি ততই উত্তপ্ত হতে দেখেছি। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়, আমেরিকাতে প্রথম রাজনৈতিক জনজাগরনের সাক্ষী হই-ওবামাকে ভোট দিতে সেইদিন রেকর্ড সংখ্যক লোকেরা বুথে হাজির হয়। ওইদিন বুথে বুথে গিয়ে অনেক ভিডিও তুলে ছিলাম। রাত আটটার সময় ও অনেক বুথে লোক উপচে পড়ছিল।
ওবামার শপথ গ্রহণের দিন ওয়াশিংটন ডিসিতে পা দেওয়ার জায়গা ছিল না-নিমন্ত্রন পত্র থাকা সত্ত্বেও ত্রিশ লাখ লোকের ভীরে ক্যাপিটল এরেনাতে ঢুকতেই পারি নি। সেই দিন শপথ গ্রহনের পরে, বাড়ি ফিরছিলাম মেট্রো ধরে। স্টেশনে ঢুকতেই পারছি না। পাশে মিসিসিপি থেকে আসা এক স্কুল শিক্ষক । সাথে বছর দশকের যমজ ভাইবোন। ওবামা না জিতলে সে নাকি আমেরিকা ছেড়ে কানাডায় চলে যেত!! আমেরিকাতে এই ধরনের তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরন কিছুদিন আগেও অপ্রত্যাশিত ছিল।
ওবামার আট বছরে রাজনৈতিক মেরুকরন কিছু কমে নি। বেড়েছে। কারন জনগণের দুর্দশাও বেড়েছে। একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে ভারত এবং চীনে আউটসোর্সিং এর যুগ্ম যাঁতাকলে আমেরিকাতে ভাল চাকরির সুযোগ কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে-ফলে এখানের শিক্ষিত শ্রেনী রাগে ফুঁসছিল। ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট করে , আসলেই তারা দেশের পলিটিক্যাল ক্লাসকে সজোড়ে থাপ্পর মারে। জনগনের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারনে বার্নির নেতৃত্বে বামপন্থী উগ্রপন্থা এবং ট্রাম্পের নেতৃত্বে দক্ষিনপন্থার উত্থানের সাক্ষী হয় ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্টিয়াল ইলেকশন।
আমেরিকাতে কিন্ত মোটেও অর্থনৈতিক মন্দা নেই। বরং আমেরিকান কর্পরেট-আমাজন, গুগল, ফেসবুক, আপল, নেটফ্লিক্সের মুনাফা রেকর্ড হারে বেড়েছে। এর মূল কারন অবশ্য মোটেও শ্রমিকদের ওপর শোষন না- এই সমস্ত কোম্পানীগুলিই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে যুগান্তকারী কাজ করেই মুনাফার পাহাড় গড়েছে। সমস্যা হচ্ছে সেই যে আমাজনের জন্য আমেরিকাতে অন্তত লাখে লাখে ছোট ব্যবসা লাটে উঠেছে। এবার আমাজনের যে মুনাফা সেটা যাচ্ছে কোথায়? আমাজন সেটা আরো উন্নত প্রযুক্তি তৈরীতে ঢালছে। ফলে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করে তাদের মাইনে বেড়েছে সাংঘাতিক- কিন্ত সাধারন জনগনের ইনকামের পথ রুদ্ধ।
এর ফলে আমেরিকাতে মধ্যবিত্ত শ্রেনী আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে- যারা বুদ্ধিমান তাদের ইনকাম বেড়েই চলেছে, যারা প্রযুক্তিতে পিছিয়ে, তারা একই সাথে তিনটে চাকরি করেও সংসার চালাতে পারছে না। সোমবার নিউজার্সিতে এক ভদ্রমহিলা ছিল আমার উবের ড্রাইভার। সে ভোর পাঁচটা থেকে দুপুড় বারোটা পর্যন্ত উবেরের ড্রাইভার। দুপুর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বার্ন্স ন্ড নোবেলে কাজ করে। উইকেন্ডে আরেকটা কাজ করে। শুধুমাত্র মা আর মেয়ের সংসার চালাতে তাকে তিনটে কাজ করতে হয়! এত কিছু করার পরেও ভদ্রমহিলার দুঃখ মেয়েকে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার সামর্থ্য নেই! এটাই আসল আমেরিকা!!
সাধারন জনগনের এই দুর্দশা থেকেই ট্রাম্প এবং বার্নির দক্ষিনপন্থী এবং বামপন্থী পপুলিস্ট মুভমেন্টের উদ্ভব। দুজনার কাছেই কোন সমাধান নেই-আছে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি। যাতে আসল সমস্যার কোন সমাধান নেই। মূল সমস্যা অটোমেশন এবং প্রযুক্তি। অথচ ট্রাম্প গালিগালাজ দিচ্ছেন চাকরি খাচ্ছে ভারতে এবং চীনে। আর বার্নি দুষছেন কর্পরেটকে। যেখানেই যুক্তির অভাব, আবেগ বেশী সেখানেই উগ্র সমর্থক তৈরী হবেই। এবং আজকে যে বার্নি সমর্থক ( জেমস হার্ডকিন্স ) গুলি চালালো , সেও আসলেই ব্রেইন ওয়াশড। অটোমশন হচ্ছে অলীক শব্দ-রাজনীতির বাজারে খাবে না। বরং ভারতীয়, মেক্সিকান, চৈনিক, কর্পরেট এদের দেখা যায়। এদের এনিমি লাইনে দাঁড় করলে ভোট বাক্স ভাসে!!
আমি আগেও বহুদিন থেকে লিখছি, প্রযুক্তি অগ্রগতির সাথে সাথে ধণবৈষম্য তীব্র আকার নিচ্ছে। উদ্ভ্রান্ত জনগন কখনো খ্রীষ্ঠান, কখনো মুসলমান, কখনো হিন্দু কখনো বাম সন্ত্রাসবাদি।
যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থের নতুন প্রাসাদে সেদিন কুরুবংশের সবাই আমন্ত্রিত। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বল্লেন, যাও বিদুরের কাছ থেকে রাজনীতির পাঠ নাও। বিদুর ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে বিদায় কালে যুধিষ্ঠিরকে প্রথম যে রাজনৈতিক শিক্ষা দেন- রাজার সর্বপ্রথম কাজ প্রজাদের মধ্যে যেন ধনের প্রবল অসাম্য তৈরী না হয়। কারন ধনের অসাম্য থেকেই প্রজাবিদ্রোহ হয় এবং তা রাজা ও রাজবংশকে ধ্বংশ করে। এতেব হে রাজন, সর্বপ্রথম যে রাজকর্তব্য, তা হচ্ছে ট্যাক্স চাপিয়ে, দান করে ধনবৈষম্য কম করা। মহাভারতের যুগেও এইটুকু রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল যে অসম ধনবৈষম্যে কোন রাজত্বই টেকে না।
No comments:
Post a Comment