Tuesday, September 1, 2015

শ্রমিক ধর্মঘট-অচল নয়া পয়সা

                                                                                   (১)
আবার আরেক কর্মনাশা সর্বনাশা শ্রমিক ধর্মঘট আজকে।

 আসুন -ইতিহাস থেকে কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন করি। দুধ এবং জল আলাদা হোক। সত্য হচ্ছে ইতিহাসে কোন নজির নেই যে শ্রমিক ধর্মঘট থেকে শ্রমিকরা আদৌ কিছু পেয়েছে কোনদিন। পেলেও তা থেকেছে সাময়িক। আমেরিকাতে শ্রমিকরা মূলত লাভবান হয়েছে কড়া এন্টিট্রাস্ট আইন থেকে। অর্থাৎ যে আইনের বলে মার্কেটে মনোপলি বন্ধ করে অনেক প্রতিযোগী কোম্পানী তৈরী করার সুযোগ দেওয়া হয়।একজন শ্রমিকের কাছে অপশন যদি শুধু একটাই মাত্র ফ্যাক্টরীতে কাজ করা হয়, তার শোষন হাজার আইন করেও কেউ আটকাতে পারবে না। একজন শ্রমিকের অবস্থার তখনই উন্নত হয় যখন (১) তার কাছে একাধিক কোম্পানীতে কাজের সুযোগ থাকে (২) তার দক্ষতার একটা মার্কেট ভ্যালু থাকে।
(১) এর জন্য দরকার কড়া এন্টিট্রাস্ট রেগুলেশন-যা ভারতে নেই। (২) এর জন্য দরকার সরকারী স্কিল মিশন। সেটার আওতাই কজনকে ভারতে আনা গেছে জানি না। তবে আমেরিকাতে ওবামা সরকার প্রভুত কাজ করেছে ২ নাম্বার পয়েন্টের ওপরে।


 শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির জন্য ইতিহাস বলে ট্রেড ইউনিয়ান কোন ভূমিকা কোনদিনই রাখে নি।  সেই জন্য আমেরিকাতে ১৯৫৮ সালে ৪০% শ্রমিক ইউনিয়ানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজ সেটা ৭% এ এসে দাঁড়িয়েছে। ভারতে সমস্ত শ্রমিকদের ২% ও সংগঠিত ইউনিয়ানের অন্তর্ভুক্ত না।  ক্রমাগত অটোমেশন এবং ইনোভেশনের জন্য ফ্যাক্টরী শ্রমিকের সংখ্যা আমেরিকাকে গত তিন দশকে কমেছে ৭০%।  আরো কমবে।  ভারতে আরো দ্রুত কমবে।  যন্ত্রের সামনে শ্রমিক শ্রেনীর অস্তিত্বই যেখানে বিপন্ন, সেখানে ট্রেড ইউনিয়ান নামক অক্সিজেন কোমার রূগীকে দিলে,  কিছুই হবে না। রুগীর মৃত্যু যন্ত্রনা আরো বাড়বে।
                                                                     
                                                                                               
                                                                     (২)

আমেরিকাতে শ্রমিক আন্দোলন সব থেকে বেশী হয়েছে ১৮৮০-১৯০৫ সালের মধ্যে। এর মধ্যে ৩৪,০০০ শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত হয়। হে মার্কেটের ঘটনা এই পিরিয়ডেই। হে মার্কেটের চেয়েও আরো অনেক বড় ধর্মঘট এই সময়ে হয়েছে-রেলরোড ওয়ার্কারদের ধর্মঘট, কার্নেগী স্টীল ফ্যাক্টরী ধর্মঘট-হে মার্কেটের চেয়েও অনেক ভয়াবহ ছিল। এসব ক্ষেত্রে মিলিটারী মেশিনগান দিয়ে রীতিমত শ্রমিক মিলিটারী যুদ্ধ হয়। রেল ধর্মঘটে অন্তত ১৮ জন শ্রমিক মারা যান সেনাবাহিনীর গুলিতে। এই শ্রমিক অশান্তির মূল কারন ছিল, এই সময়টাতে তিনটে বিজনেস ফ্যামিলি আমেরিকাতে মনোপলি চালাচ্ছিল। এরা হচ্ছে তৈল শিল্পে রকফেলার, স্টিলে এন্ড্রু কার্নেগী এবং ফ্যাইনান্সে মর্গান ফ্যামিলি। ৬৫% শ্রমিক কোন না কোন ভাবে এই তিন ফ্যামিলির কারখানাতেই কাজ করতে বাধ্য হত। ফলে উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে এসে আমেরিকান শ্রমিকদের উপার্জন হ্রাস পায়। ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন যেখানে একটি ফ্যামিলির বাঁচতে সাপ্তাহিক ২৫ ডলার দরকার হত, মাইনে ছিল ১৭ ডলারের কম। ফলে বিক্ষোভ স্বাভাবিক।

 আমি এই প্রসঙ্গে আসছি -কারন আজ ভারতেও এই অবস্থা। আজকের ধর্মঘটের একটা দাবী এই যে শ্রমিকদের নুন্যতম মাসিক মাইনে ১৫,০০০ টাকা করতে হবে। এই দাবীটি ন্যায় সঙ্গত-কারনে এর নীচে মাইনে পেলে একজন শ্রমিকের বেঁচে থাকাই অসম্ভব। অথচ  আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি ভারতে টাটা আম্বানীদের ফ্যাক্টরী গুলোতে ঠিকা শ্রমিকদের মাইনে ৮০০০-১০,০০০ টাকা বা তারো কম।  কিন্ত ধর্মঘট করে এটি শ্রমিকরা আদায় করতে পারবে না। আমি আমেরিকার লেবার হিস্ট্রি এই জন্য আনছি-যে বুঝতে কি করে আমেরিকান শ্রমিকরা তাদের অবস্থান বদলাতে সক্ষম হল।

 যাইহোক, ৩৪,০০০ ধর্মঘটের পরেও ওই শ্রমিক টার্বুলেন্স পিরিওডে, ত্রিশ বছরে শ্রমিকদের মাইনে বেড়েছিল সতেরো ডলার ষাট সেন্স থেকে বাইশ ডলার ( প্রতি সপ্তাহে )। যা স্বাভাবিক বৃদ্ধির সমান। কিন্ত আমেরিকান ইতিহাসে সব থেকে বেশী মাইনে বেড়েছে ১৯১৫-২৩ ( ডিপ্রেশনের আগে ) আর  ১৯৫০-৬০। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দুটোই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। এর মূল কারন এই যে ওই দুই সময়ে -বিশেষত ১৯১৫-২৩ এর মধ্যে প্রচুর এন্টিট্রাস্ট আইন এনে রকফেলার সহ অনেক বিজনেস মনোপলীর অবসান ঘটানো হয়। ফোর্ড প্রথম সপ্তাহে ৪০ ডলার দেওয়া চালু করেন ১৯১২ সালে। যা ছিল, প্রচলিত মাইনের দ্বিগুন। কারন অটোমোবাইল শিল্পে স্কিল্ড লেবার দরকার ছিল-আর কোন কোম্পানী স্কিলড লেবার হারাতে চাইত না। এর আগে হত উলটো। একদম বেসিক প্রডাকশন সিস্টেমের জন্য শ্রমিকের স্কিল বলতে কিছু লাগত না। ফলে কোন কারখানাতেই শ্রমিক ধরে রাখার কোন তাগিদ ছিল না।

 সুতরাং ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দুটো জিনিস পরিস্কার হওয়া উচিত। এক, ট্রেড ইউনিয়ান মুভমেন্টের জন্য শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি হয় নি।  দুই শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির পেছনে মূলত কাজ করেছে মার্কেট রেগুলেশন-যার দৌলতে মনোপলি ভেঙ্গে প্রচুর কোম্পানীকে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিযোগিতার মার্কেটে দক্ষতার চাহিদা থাকবেই। সেই ভাবেই বেড়েছে মূলত শ্রমিকদের মাইনে। ভারতে সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের মাইনে বেশী কেন? কারন তাদের কাছে হাজারটা কোম্পানীর অপশন। এবং স্কিলের ভ্যারিয়েশন প্রচুর।  অন্যদিকে ভারতে ট্রাডিশনাল ইঞ্জিনিয়ারদের মাইনে কম। কারন তাদের হাতে অপশন ও কম। স্কিল ও লাগে কম।

প্রশ্ন হচ্ছে সাধারন শ্রমিকের কি স্কিল লাগে? আধুনিক ফ্যাক্টরীতে লাগে।

                                                         (৩)

 এবার ভারতের প্রসঙ্গে আসি। ভারতে এই মুহুর্তে মেজর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কি করে আইন করে শ্রমিকদের নুন্যতম মাইনে ১৫,০০০ টাকা করা যায়। যাতে তারা অন্তত নুন্যতম মাইনেটা পায়।

 নিজের ব্যবসা চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নুন্যতম মাইনে বৃদ্ধি কোম্পানী এবং শিল্পের জন্য ভাল। কারন মাইনে বাড়লে কোম্পানী লাভের জন্য মূলত ইনোভেশন, স্ট্রাটেজি, হাই ভ্যালু এডিশন, অটোমেশনের ওপরে জোর দেয়। এই জিনিসগুলো একটা কোম্পানীকে আরো সক্ষম করে তোলে-কারন তাকে আরো কম শ্রমিকে বেশী উৎপাদন দিতে হয়।

 সস্তায় শ্রমিক খাটিয়ে যে ব্যবসা , তা সাময়িক, চিরকালীন হতে পারে না। কারন তাতে কোম্পানী কোন কম্পিটিটিভ এডভ্যান্টেজ গেইন করে না এই প্রযুক্তির যুগে।

এটা করতে গেলে যেটা করতে হবে-তা হচ্ছে রিয়ালেন্স টাটা এদের মনোপলী ধ্বংস করতে হবে কড়া এন্টিট্রাস্ট আইন এনে। এগুলো না করে, শ্রেফ সাধারন লোকের পেটে পেটোয়া মারলে শ্রমিক শ্রেনী জনগণ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন হবে।

 সে যাইহোক , ট্রেড ইউনিয়ান ঐতিহাসিক ভাবেই ব্যর্থ একটি প্রচেষ্ঠা। যার জন্য পশ্চিম বঙ্গে ১৯৪৮ সালে ভারতে শিল্পে এক নাম্বারে ছিল-আজ পেছনের দিক থেকে এক নাম্বারে।  দরকার শ্রমিক এবং সাধারন মানুষের মিলিত সিভিল রাইট মুভমেন্ট যাতে মার্কেটের সংস্কার এবং আইনগুলি মানবিক হয়। ঐতিহাসিক ব্যর্থতাকে নকল করলে, আরো কষ্টের দিন আসবে।








No comments: