Saturday, September 5, 2015

যেসব শিক্ষকদের ভুলি নাই

 আজ শিক্ষক দিবস।  ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে শিক্ষকদের ভূমিকাকে স্বরণ করার দিন।

  আমার বাবা মা দুজনেই হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন। দাদুওশিক্ষক। সেই হিসাবে, আমার ও শিক্ষক হওয়ার কথা। সেই দিকেই এগোচ্ছিলাম। কিন্ত হঠাৎ করে একাডেমিক্সে মোহভঙ্গ হওয়ায়, লাইফে সব ঘেঁটে যায়।  যাইহোক এই লেখা শুধুই ঋণ স্বীকার করার চেষ্টা মাত্র।

 ক্লাস টু থেকে সিক্স পর্যন্ত আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন অশ্বিন বাবু। উনি প্রাইমারী স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক -কিন্ত উনার সব থেকে বড় পরিচয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী।  একঘন্টা পড়াতেন।  কখনোই প্রথাগত  পাঠ না-উনার মুখে শুনতাম স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের গল্প। উনাদের ছেলেবেলা, স্কুল বেলার গল্প।   কতশত বীরেদের গল্প। কোনদিন স্কুলের সিলেবাসে কি আছে পড়ান নি। উনি বলতেন তোমার জীবনে শিক্ষকের  দরকার নেই-দরকার অনুপ্রেরণার। এইভাবেই অজান্তে ইতিহাসের প্রতি এক  নিবিড় ভালোবাসা উনি গড়ে দিয়েছিলেন।

 আমি মাধ্যমিকে ছিলাম করিমপুর জগন্নাথ হাইস্কুলে। আমাদের সময়ে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতার মান বেশ উঁচুই ছিল। গ্রামের স্কুলে সব থেকে বড় সুবিধা এই যে, ওখানে জীবনে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এসবের চাপ ছিল না। সহপাঠিদের অধিকাংশের বাবারা ছিল করিমপুর শহরের ব্যবসায়ী। ছোট বড় মাঝারী। ফলে খেলার সময় ছিল অফুরন্ত- পড়াশোনা ভাল লাগলে কর। না করলে বাবার দোকানে বসবে। এই ছিল বন্ধুদের এটিচুড!   এই স্কুলের যেসব শিক্ষকের কথা না বলেই না-তাদের মধ্যে বাংলার শিক্ষক অরুন চ্যাটার্জি, ইতিহাসের পার্থ রুজ এবং বিজ্ঞানের শ্যামল বাবু। অরুনবাবু কোনদিন সিলেবাসে কি আছে দেখতেন ও না। উনি ক্লাস নিতে ঢুকলেই স্যার আজ শনিবারে চিঠি নিয়ে হয়ে যাক এই হত আমাদের আবদার। বা রবীন্দ্রনাথ কেন শেষের কবিতা লিখতে বসলেন। সাহিত্য যে নিছক বইএর বাঁধন না, অপার সম্ভাবনা, তা উনার কাছেই শেখা। পার্থ রুজ যখন যোগ দেন আমরা ক্লাস নাইনে পড়ি। ক্লাস নাইনে তখন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস পড়তে হত-উনি বিশ্বভারতীতে পি এই চ ডি করছিলেন। সেই প্রথম আমরা বুঝি যে ইতিহাস যে গল্প বলে তার পেছনে কত নথি, কত গবেষনা থাকে। উনি উনার ভান্ডার উজার করে পড়াতেন। শ্যামল বাবুর স্পেশালিটি অঙ্ক ক্লাসে। উনি ভীষন জটিল অঙ্ককেও সহজ ভাবে দেখতেন। উনার কাছ থেকে লাইফে প্রথম শিক্ষা পাই যে কোন অঙ্ক জটিল লাগছে মানে, আসলেই অঙ্কটাই ঠিক ঠাক ভাবে বুঝি নি। আগে বোঝ, তারপরে সমাধানে হাত দেবে। এর ভিত্তিটা উনিই গড়ে দিয়েছিলেন।

 নরেন্দ্রপুরে দুবছরের উচ্চমাধ্যমিক আরেকটা অভিজ্ঞতা।  মাধ্যমিকে প্রথম হওয়া ছেলেটি বাদ দিয়ে বাকী প্রায় সব র‍্যাঙ্কাররাই একসাথে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুলে অত চাপ ছিল না। কিন্ত এন ডিপিতে সবাই আই আই টি জয়েন্টের জন্য দৌড়াচ্ছে। নরেন্দ্রপুরে আমাদের সময়ে কতগুলো দুর্দান্ত শিক্ষক ছিলেন। প্রথমেই ইনঅরগানিক কেমিস্ট্রিতে আরোগ্য সাহার [ এভিএস]  কথা আসবে। উনি আবার কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি এস সি পান। এটমিক স্টাকচার পড়াতেন। সম্পূর্ন বই ছাড়া- ইতিহাস থেকে একেকটা এক্সপেরিমেন্ট কি করে এটমিক স্টাকচারের দিক খুলে দিল-পূরোটা একদম ম্যাজিক রিয়ালিজম। স্টাটে ছিলেন প্রবাদপ্রতিম পি গিরি। সংখ্যা যে কথা বলে, সেটা উনিই হাতে নাতে শিখিয়ে ছিলেন।  ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট ছিল বেশ খাজা। নরেন্দ্রপুরে সেরা শিক্ষক ছাত্ররাই। আমরা এ ওর কাছ থেকে শিখতাম। শেখানোর চেষ্টা থেকেই নিজে সব থেকে ভাল শেখা যায়, এটাই নরেন্দ্রপুরে শেখা। পাশাপাশি সত্যাদা বা স্বামী সূপর্নানন্দের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ন থাকবে। উনি ব্রহ্মানন্দে নিজের রুমে রাত দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত ভারতীয় দর্শনের ক্লাস নিতেন। অপশনাল। মাত্র ছ সাত জনই থাকত। মাঝে মাঝে হত। হিন্দু দর্শনের প্রায় সবকিছুই উনার ওই ক্লাসগুলো থেকেই শেখা। এখন ত উনি গোলপার্কের অধিকর্তা। মাঝে সাঝে পেপারে উনার ছবি দেখি।

আই আই টি খরগপুরের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে পাঁচ বছরে ভালো শিক্ষক হাতে গুনে ছিল চারটি।  অধ্যাপক জিপি শাস্ত্রী এবং ডি বসু অসাধরন। যেমন মাপের মানুষ, তেমন মেধা।   উনারা যেভাবে ছাত্রদের ইন্টেলেকচুয়ালি চ্যালেঞ্জ করতেন, সেটা আমাদের জীবনের সেরা ক্লাসরুম অভিজ্ঞতা।  ভাল শিক্ষক ছাত্রদের ইন্টেলেকচুয়ালি চ্যালেঞ্জ করবেন-এটা ছাত্রদের ডেভেলেপমেন্টের জন্যই দরকার। এছাড়া এইচ এন আচার্য্যর কথা লিখব। উনি ইলেকট্রনিক্স এর পেপারগুলো নিতেন। উনার একটা শিক্ষা ভোলার না-যে প্রথমেই তালগাছের মতন ন্যারো ডোমেনে নিজেকে টেনো না। পৃথিবীতে অনেক কিছুর বেসিক শেখার আছে। যেকোন ফিল্ডে ভাল কাজ করতে গেলে সব সাবজেক্টের বেসিক গুলো শেখা অনেক বেশী কাজের।

 আই আই টিতে ইলেকট্রনিক্স এবং টেলিকম ডিপার্টমেন্টে পি এই চ ডির সময় দুজনের কথা না বলেই না। প্রথমজন এন বি সি বা এন বি চক্রবর্ত্তী। আমি যখন পি এই চ ডিতে ঢুকি উনার বয়স সত্তর।  উনি আমার গাইডের গাইড। পি এই চ ডির সময় আমাকে প্রচুর পার্শিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইকোশেন সলভ করতে হত। উনাকে কোন কিছু প্রবলেম বল্লেই বলে দিতেন , ওই বেল সিস্টেম টেকনিক্যাল জার্নালে ওমুকের ১৯৩৪ সালের পেপারটা দেখ!! পুরো ফটোজেনিক মেমোরি। ভারতে ইলেকট্রনিক্স গবেষনার ইতিহাসে এন বি সি একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। উনার কাছে অনেক শিখেছি। আরেকজন প্রফেসর অজয় রায়। অজয়দা এখন শিবপুরে ভিসি।  কিন্ত উনি ছাত্রদের সাথে নানান টাইপের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। তাতে সিস্টেম থেকে পলিটিক্স সব কিছুই থাকত।

 নিউ জার্সিতে, জীবনের প্রথম চাকরীতে একজন অসাধরন লোককে মেন্টর এবং শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলাম। প্রফেসর এডেল সালে। অরিজিন্যালি ইজিপ্টের লোক।  এম আই টির ইলেক্ট্রিক্যালের অধ্যাপক ছিলেন-আমাদের কোম্পানীটা ছিল উনার দ্বিতীয় স্টার্টাপ। উনি বলতেন আর এন্ডিতে ভুল হবেই, তাই বুক চিতিয়ে গর্ব করে ভুল স্বীকার করবে। নইলে পুরো ডেভেলেপমেন্টটাই মাখাবে। এডেল লোক হিসাবেও অসাধারন ছিলেন। জীবনে এত খ্যাতি, টাকা-কিন্ত সম্পূর্ন নিরাহঙ্কার। উনার শর্ট ফ্রেজ ছিল-ক্যান বি ডান-ইউ হ্যাভ টু উইশ ফর ইট!

 জীবনে শিক্ষক কে? শিক্ষক সেই, যে অনুপ্রেরণা যোগায় নতুন কিছু শেখার জন্য। সবার কাছ থেকে সব পরিস্থিতি থেকেই শিখে যেতে হয় এই জীবনে। শেখাটা এক চলমান প্রবাহ। কাজের মাসি থেকে প্রফেসার সালে-আমার সারাজীবনই মনে হয়েছে সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু শেখার আছে।



No comments: