বাঙালীর ব্যবসা বিমুখতা নিয়ে কাল লিখেছিলাম। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দুটো প্রশ্ন উঠে এসেছে-
১) লক্ষী এবং স্বরস্বতীর সাধনা একসাথে করা সম্ভব কি না-অথবা-জ্ঞান না অর্থ ? কিসের সাধনাতে জীবন সার্থক ?
২) সংস্কৃতিচর্চার সাথে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির বিরোধিতা আছে কি না। বাঙলার ব্যবসা বিমুখতার পেছনে বাঙালী সংস্কৃতির ভূমিকাটা ঠিক কি?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর সহজ। এই একবিংশ শতাব্দিতে, আমরা এখন নলেজ ইকোনমিকর যুগে। "জ্ঞান" ই এখন মূল "পুঁজি"। স্বরস্বতী ছাড়া লক্ষীর সাধনা এই যুগে আর সম্ভব না। ট্রেডিং বলে যেটা ছিল, আস্তে আস্তে সব ইকমার্সে চলে আসছে। যেকোন আধুনিক ব্যবসাতেই প্রচুর জ্ঞানের প্রয়োজন। আমেরিকাতে যত সফল ব্যবসায়ী দেখেছি-প্রত্যেকেই নানা বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন। ভারতেও দিনকাল বদলাচ্ছে। আগেকার মতন বাঁহাতে টাকা গুনছে, ডানকানে ফোন ধরে বসে থাকা মারোওয়ারী, আস্তে আস্তে বিরল প্রজাতি হবে। সুতরাং জ্ঞানের সাথে ব্যবসার বিরোধ নেই।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা বিতর্কিত। সংস্কৃতির চর্চার কারনে বাঙালী ব্যবসাবিমুখ কি না। আমি মনে করি, কিছুটা তাই। অনেক কারন আছে এমনটা ভাবার। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে ব্যবসায়ী হওয়া যায় না-এমন দাবী আমি করছি না। তবে নাটক গান নিয়ে মত্ত আবার একাধারে সফল ব্যবসায়ী এমনটা হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারন সব সাফল্যই ফোকাস দাবী করে। ব্যাবসা, নাটক বা সাহিত্য-কোন উৎকর্ষতাই ফোকাস ছাড়া আসে না। একটা লেভেলের পরে লোকে টাকার জন্য ব্যবসা করে না-নাটক বা সাহিত্যের মতন-ওটাও একটা প্যাশন হয়ে দাঁড়ায়।
বাঙালী কেন ব্যবসা বিমুখ হল-এর অনেক কারন আছে। প্রথম ধাক্কা, বৃটিশ এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। অষ্টদশ শতকের শেষ ভাগে, বাঙালীর ক্রাফটসম্যানশিপ সম্পূর্ন ধ্বংস করে কোম্পানীর ট্যাক্সেশন ব্যবস্থা। জুট এবং টেক্সটাইল মিলের মালিকানা মূলত গুজরাতি এবং মারোয়ারীদের হাতে এল কেন-কেন বাঙালী জমিদাররা ওই ব্যবসাই গেলেন না-সেটা বিতর্কিত ইতিহাস। বাঙালী জমিদাররা কেওই কৃষিজ পুঁজিকে শিল্পে ঢালেন নি। বরং তারা কোলকাতায় বাইজি, গান সাহিত্য চর্চাতেই নিমগ্ন ছিলেন। ব্যবসাকে তারা ঘৃণা করতেন।
একটা উদাহরন দিই। রবীন্দ্রনাথে লেখা থেকেই। জগদীশ বোস, মাইক্রোওয়েভ নিয়ে তার কাজের যে প্রচুর ব্যবসায়িক সম্ভাবনা আছে, তা বৃটেনে গিয়েই টের পান। বৃটেনের ব্যাবসায়ীরা জেসি বোসকে ইংল্যান্ডে এসে তার গবেষনার পেটেন্ট নিয়ে, বাণিজ্যিকরনের প্রস্তাব দেন। মূলত সলিড স্টেট রিসিভারের ক্ষেত্রে, তার কাজ ছিল যুগান্তকারী। জেসি বোস সেই প্রস্তাবের কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ উপদেশ দেন একজন স্বাধীন বিজ্ঞানীর গবেষনা বেনিয়াদের হাতের পুতুলে পরিনত হবে তাতে তিনি নারাজ। বরং জেসি বোসের গবেষনার টাকার জন্য তিনি ত্রিপুরা কোচবিহারের মহারাজাদের কাছে ভিক্ষা করবেন।
অথচ নিকোলা টেসলার মতন পদার্থবিদ, একজন জগৎবিখ্যাত উদ্ভাবক -তিনিও কিন্ত জানতেন, তার গবেষনাকে সমাজের কাছে পৌছাতে গেলে বাণিজ্যকরন করতেই হবে। টেসলার সাথে ওয়েস্টিং হাউসের চুক্তি না হলে, আজকের বিদ্যুৎ প্রযুক্তি অনেক দিন পিছিয়ে যেত। ইনফ্যাক্ট বাণিজ্য করে কি হবে, নিরন্তর নিভৃত্বে জ্ঞানের সাধনা করেই মোক্ষ লাভ-এটা করতে গিয়ে জগদীশ চন্দ্র বোস এবং বিজ্ঞান-দুই জগতেরই ক্ষতি হয়েছে। স্যার জেসি বোস যদি, তার মাইক্রোয়েভ ইনভেনশনগুলি পেটেন্ট করার কথা ভাবতেন বা ইংল্যান্ডের কোম্পানীটি-যারা তার গবেষনার বাণিজ্যকরনের প্রস্তাব দিয়েছিল তাদের প্রস্তাবে সারা দিতেন, মাইক্রোয়েভ এবং সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে দিনের আলো দেখত। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ স্যাল নেভিল মট লিখেছিলেন, জেসি বোস সেমিকন্ডার ডায়োড আবিস্কারের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। কিন্ত তারপরে তার গবেষনা আর সেই দিকে চালান নি। ফলে সেমিকন্ডাক্টএর জন্ম প্রায় পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যায়।
আমি যেভাবে বাঙালীর ইতিহাস দেখি-বাঙালীর মধ্যে অত্যন্ত আধুনিক আন্তারপ্রেনার প্রিন্স দ্বারকানাথের জন্ম হল-কিন্ত ঠাকুর পরিবার টাটা বিড়লা ফ্যামিলি না হয়ে সাংস্কৃতিক রেঁনেসাসের অংশ হয়ে রইলো। স্যার জেসি বোসের মতন একটি বিরল প্রতিভা-যিনি হতে পারতেন টেসলা বা এডিসনের সমোগোত্রিয় একজন ঐতিহাসিক আবিস্কারক, ব্যবসা বিমুখতার দরুন, বাঙালীর ঐতিহাসিক লেগাসী হয়েই রইলেন। টেসলা বা এডিসনদের মতন ইম্প্যাক্টফুল হতে পারলেন না।
১) লক্ষী এবং স্বরস্বতীর সাধনা একসাথে করা সম্ভব কি না-অথবা-জ্ঞান না অর্থ ? কিসের সাধনাতে জীবন সার্থক ?
২) সংস্কৃতিচর্চার সাথে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির বিরোধিতা আছে কি না। বাঙলার ব্যবসা বিমুখতার পেছনে বাঙালী সংস্কৃতির ভূমিকাটা ঠিক কি?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর সহজ। এই একবিংশ শতাব্দিতে, আমরা এখন নলেজ ইকোনমিকর যুগে। "জ্ঞান" ই এখন মূল "পুঁজি"। স্বরস্বতী ছাড়া লক্ষীর সাধনা এই যুগে আর সম্ভব না। ট্রেডিং বলে যেটা ছিল, আস্তে আস্তে সব ইকমার্সে চলে আসছে। যেকোন আধুনিক ব্যবসাতেই প্রচুর জ্ঞানের প্রয়োজন। আমেরিকাতে যত সফল ব্যবসায়ী দেখেছি-প্রত্যেকেই নানা বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন। ভারতেও দিনকাল বদলাচ্ছে। আগেকার মতন বাঁহাতে টাকা গুনছে, ডানকানে ফোন ধরে বসে থাকা মারোওয়ারী, আস্তে আস্তে বিরল প্রজাতি হবে। সুতরাং জ্ঞানের সাথে ব্যবসার বিরোধ নেই।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা বিতর্কিত। সংস্কৃতির চর্চার কারনে বাঙালী ব্যবসাবিমুখ কি না। আমি মনে করি, কিছুটা তাই। অনেক কারন আছে এমনটা ভাবার। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে ব্যবসায়ী হওয়া যায় না-এমন দাবী আমি করছি না। তবে নাটক গান নিয়ে মত্ত আবার একাধারে সফল ব্যবসায়ী এমনটা হওয়া প্রায় অসম্ভব। কারন সব সাফল্যই ফোকাস দাবী করে। ব্যাবসা, নাটক বা সাহিত্য-কোন উৎকর্ষতাই ফোকাস ছাড়া আসে না। একটা লেভেলের পরে লোকে টাকার জন্য ব্যবসা করে না-নাটক বা সাহিত্যের মতন-ওটাও একটা প্যাশন হয়ে দাঁড়ায়।
বাঙালী কেন ব্যবসা বিমুখ হল-এর অনেক কারন আছে। প্রথম ধাক্কা, বৃটিশ এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। অষ্টদশ শতকের শেষ ভাগে, বাঙালীর ক্রাফটসম্যানশিপ সম্পূর্ন ধ্বংস করে কোম্পানীর ট্যাক্সেশন ব্যবস্থা। জুট এবং টেক্সটাইল মিলের মালিকানা মূলত গুজরাতি এবং মারোয়ারীদের হাতে এল কেন-কেন বাঙালী জমিদাররা ওই ব্যবসাই গেলেন না-সেটা বিতর্কিত ইতিহাস। বাঙালী জমিদাররা কেওই কৃষিজ পুঁজিকে শিল্পে ঢালেন নি। বরং তারা কোলকাতায় বাইজি, গান সাহিত্য চর্চাতেই নিমগ্ন ছিলেন। ব্যবসাকে তারা ঘৃণা করতেন।
একটা উদাহরন দিই। রবীন্দ্রনাথে লেখা থেকেই। জগদীশ বোস, মাইক্রোওয়েভ নিয়ে তার কাজের যে প্রচুর ব্যবসায়িক সম্ভাবনা আছে, তা বৃটেনে গিয়েই টের পান। বৃটেনের ব্যাবসায়ীরা জেসি বোসকে ইংল্যান্ডে এসে তার গবেষনার পেটেন্ট নিয়ে, বাণিজ্যিকরনের প্রস্তাব দেন। মূলত সলিড স্টেট রিসিভারের ক্ষেত্রে, তার কাজ ছিল যুগান্তকারী। জেসি বোস সেই প্রস্তাবের কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ উপদেশ দেন একজন স্বাধীন বিজ্ঞানীর গবেষনা বেনিয়াদের হাতের পুতুলে পরিনত হবে তাতে তিনি নারাজ। বরং জেসি বোসের গবেষনার টাকার জন্য তিনি ত্রিপুরা কোচবিহারের মহারাজাদের কাছে ভিক্ষা করবেন।
অথচ নিকোলা টেসলার মতন পদার্থবিদ, একজন জগৎবিখ্যাত উদ্ভাবক -তিনিও কিন্ত জানতেন, তার গবেষনাকে সমাজের কাছে পৌছাতে গেলে বাণিজ্যকরন করতেই হবে। টেসলার সাথে ওয়েস্টিং হাউসের চুক্তি না হলে, আজকের বিদ্যুৎ প্রযুক্তি অনেক দিন পিছিয়ে যেত। ইনফ্যাক্ট বাণিজ্য করে কি হবে, নিরন্তর নিভৃত্বে জ্ঞানের সাধনা করেই মোক্ষ লাভ-এটা করতে গিয়ে জগদীশ চন্দ্র বোস এবং বিজ্ঞান-দুই জগতেরই ক্ষতি হয়েছে। স্যার জেসি বোস যদি, তার মাইক্রোয়েভ ইনভেনশনগুলি পেটেন্ট করার কথা ভাবতেন বা ইংল্যান্ডের কোম্পানীটি-যারা তার গবেষনার বাণিজ্যকরনের প্রস্তাব দিয়েছিল তাদের প্রস্তাবে সারা দিতেন, মাইক্রোয়েভ এবং সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি অন্তত পঞ্চাশ বছর আগে দিনের আলো দেখত। নোবেলজয়ী পদার্থবিদ স্যাল নেভিল মট লিখেছিলেন, জেসি বোস সেমিকন্ডার ডায়োড আবিস্কারের খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন। কিন্ত তারপরে তার গবেষনা আর সেই দিকে চালান নি। ফলে সেমিকন্ডাক্টএর জন্ম প্রায় পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে যায়।
আমি যেভাবে বাঙালীর ইতিহাস দেখি-বাঙালীর মধ্যে অত্যন্ত আধুনিক আন্তারপ্রেনার প্রিন্স দ্বারকানাথের জন্ম হল-কিন্ত ঠাকুর পরিবার টাটা বিড়লা ফ্যামিলি না হয়ে সাংস্কৃতিক রেঁনেসাসের অংশ হয়ে রইলো। স্যার জেসি বোসের মতন একটি বিরল প্রতিভা-যিনি হতে পারতেন টেসলা বা এডিসনের সমোগোত্রিয় একজন ঐতিহাসিক আবিস্কারক, ব্যবসা বিমুখতার দরুন, বাঙালীর ঐতিহাসিক লেগাসী হয়েই রইলেন। টেসলা বা এডিসনদের মতন ইম্প্যাক্টফুল হতে পারলেন না।
No comments:
Post a Comment