Wednesday, December 30, 2015

বর্ষ শেষের বেদনা

                                                                   (১)
আমার বাংলা বানান এবং গঠন রীতি সত্যই এট্রোসিয়াস। যাকে বলে যাতা।

 ভাল লিখতে গেলে যত্ন আত্তি করতে হয়-শুধু লেখার আবেগে হাওয়া খেয়ে ফুরফুরে লিখতে গেলে, লেখাগুলোর অবস্থা যে ফকিরবাবার ছেঁড়া ফতুয়ার বেশী কিছু হবে না-তা বিলক্ষণ সত্য।  আবার এটাও সত্য সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়াতে -কমিউনিকেশন স্টাইলটাই মুখ্য।

      বানান বা ভাষার বিশুদ্ধরীতি পান্ডিত্য দেখানোর নাট্যমঞ্চ হতে পারে-কিন্ত পাঠকের সাথে হৃদয় বিনিময়ের অন্তরায়।  স্যোশাল মিডিয়ার সাথে মেইন স্ট্রিমের পার্থক্য হচ্ছে-এখানে পাঠকের রেসপন্সটা সব থেকে বেশী জরুরী। পাঠককে কমেন্ট করতে উৎসাহিত করে লেখাটিকে সমৃদ্ধ করা লেখকের মূল দায়িত্ব। লেখক যদি বিশুদ্ধ ভাষাচর্চা এবং অন্তহীন গবেষনা করে সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখা নামান-পাঠকের ভূমিকা হয় গৌণ। সেটা মেইন স্ট্রিমে চলে-সোশ্যাল মিডিয়াতে চলে না। স্যোশাল মিডিয়াতে লেখকের মূল কাজ হচ্ছে নতুন চিন্তার জন্ম দেওয়া- বাকীটা লেখাটা গড়ে উঠুক পাঠকের হাতে।

 অভিজিত রায় এবং তার মুক্তমনা এই কাজটা খুব সাফল্যের সাথে করেছে। তার ফলও আমরা পেয়েছি হাতে নাতে। ২০১৫ সালে মুক্তমনার পাঁচজন ব্লগার খুন বা আক্রান্ত। এই নাড়া দিতে গিয়ে অভিজিত নিজেও শহীদ। মেইন স্ট্রিমের লেখকরা আছে বহাল তবিয়তে।
 
      বহুদিন আগে থেকেই লিখে এসেছি-স্যোশাল মিডিয়ার আগমনের ফলে রাজনৈতিক পার্টি এবং ক্ষমতাসীনদের বিছানাসঙ্গী হওয়া ছাড়া মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার আর  বিশেষকিছু করনীয় নেই। তাদের বহুমূল্য পত্রিকার সাজগোজ, লে-আউট-গ্রাফিক্স-সবকিছুই সোনাগাছির রঙচং মাখা মেয়েগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। হ্যা-প্রকারভেদত আছেই- কেউ হাই সোশাইটি কলগার্ল-কেও সরাসরি রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আনন্দবাজারের সাথে ৩৬৫ দিনের পার্থক্য ওইটুকুই।

                                                         (২)
তবুও এটা ধ্রুব সত্য আমার বাংলা খুব খারাপ। আশ্চর্য্য নই। কারন প্রতিভাতে বিশ্বাসী নই। চর্চায় আস্থা। যা চর্চা করি না-তার স্টান্ডার্ড খুব ভাল হওয়ার কথাও না।

আমি যে বাংলায় দুলাইন লিখতে পারি-সেটা আমার কাছে পরম আশ্চর্য্যের। কেন সেই গল্পটাই লিখি। কারন অনেকেই দেখে আমি দিস্তার পর দিস্তা ভুল বানানে ভর্তি বাংলা লিখে চলেছি। অবিরাম, অফুরন্ত। কিন্ত কেউ এখনো জানে না-আমি কে-কোন পরিস্থিতিতে লিখি।  কেনই বা লিখি।

ছোটবেলায় বাংলা, সাহিত্য বা লেখালেখি-এসবে উৎসাহ ছিল না। কবিতা লাগত দুর্বোধ্য। বই প্রচুর কিনতাম। সব অঙ্ক বা বিজ্ঞানের বই। পরীক্ষার জন্য সেসব বই না। নিখাদ বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই কিনতাম সেসব বই। আর বাবা ছিল ব্যার্থ রিটার্ড রাজনীতিবিদ। নিজে বাম রাজনীতিতে ব্যর্থ হয়ে, বোধ হয় মনে কোথাও আশাছিল ছেলে রাজনীতিতে কিছু করবে। ফলে বাবা ছোটবেলাতে এনে দিত অনেক ইতিহাসের বই।  বিজ্ঞানের পাশাপাশি ইতিহাসেও তৈরী হয় গভীর অনুরাগ। সাহিত্য, লেখালেখির ধারে কাছ দিয়ে যাই নি কোনদিন। বড়জোর শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলেছিলাম গরমের ছুটিগুলোতে।

          শরৎচন্দ্র ত বেশ একঘেঁয়ে লাগত। সেই শালার পাঠশালা আর ক্ষেতক্ষামারিতে বাল্যপ্রেম-জাত ফাতের সমস্যা-ফলে প্রেমিকার বিয়ে বয়স্ক লোকের সাথে-আর তারপরে বিধবা হয়ে ফিরে এসে- দেহহীন, পাপবিদ্ধ পরকীয়া। বিধবাকে নিয়ে পালালেও বেশ রোমাঞ্চকর কিছুর সম্ভাবনা থাকে-কিন্ত সেসব কিছু নেই-শুধু জোলো ঘ্যানঘেনে প্লেটোনিক মনকষাকশি।

          উচ্চমাধ্যমিক যখন শেষ করলাম নরেন্দ্রপুর থেকে তখন একটাই সাহিত্যগ্রন্থ কিছুটা ভালো লেগেছিল-রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী। সেই কৃতিত্বটাও সত্যদার ( স্বামী সূপর্নানন্দ মহারাজ) প্রাপ্য। উনি উপনিষদ দর্শন এত সুন্দর বুঝিয়েছিলেন, গীতাঞ্জলীর প্রতিটা লাইন মাথায় রেজোনেট করত।

  তাছাড়া আশেপাশেও যে খুব একটা বাংলা সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের ভীর তাও না। গ্রামে দুএকজন সাহিত্যপ্রেমী কাকু ছিল-তাদের বাড়িতে দেশ পত্রিকা আসত। আধুনিক সাহিত্য বা বুদ্ধিচর্চার সাথে যোগ ওই ছোট্টা পাক্ষিকটা দিয়েই। তাও বুঝতাম খুব সামান্য।  নাটক গাণ বাজনার চর্চা ভালোই ছিল করিমপুরে-কিন্ত ওভারওল ওই ভাবে গভীর সাহিত্যপ্রেমী বন্ধু ছিল না। থাকার কথাও না।

        বাল্যবন্ধুদের অধিকাংশের বাবারই করিমপুর বাজারে বিজনেস। ক্লাস এইটে উঠতেই দেখলাম, অনেকেই বাবার দোকানে বসছে নিয়মিত।  ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার সাহিত্যিক বিজ্ঞানী হওয়ার এস্পিরেশন আশেপাশে ছিল না। তবে ক্রিকেট নাটকে সবার প্রবল উৎসাহ।  আমার বড় হয়ে ওঠা ইন্টেলেকচুয়াল সেন্টার থেকে অনেক অনেক দূরে।

           আর নরেন্দ্রপুরে উচ্চমাধ্যমিকে যখন ভর্তি হলাম,  চারিদিকে কেরিয়ারিস্ট ছেলেপুলে। সবাই আই আই টি বা বেঙ্গল জেইইতে ভাল র‍্যাঙ্ক করতে চব্বিশঘন্টা খাটছে। বন্ধুদের সাথে অধিকাংশ সময় আলোচনা-ওই ইরোডভের প্রব্লেমটা হল কি না -এই ইঙ্ক্যোয়ালিটিটার সল্যুউশন কেউ জানে কিনা! সবাই সোনামাণিকের মতন অঙ্ক আর ফিজিক্সের প্রব্লেমের সল্যুউশন খুঁজছে। সাহিত্য ফাহিত্য ছায়াপথের জিনিস। পরীক্ষার দুদিন আগে বাংলা নোটমুখস্থ করে উচ্চমাধ্যমিকে উৎরাতে হবে-ওই নোট সাহিত্যই সার জীবনে। নরেন্দ্রপুরের স্পেকট্রামটা হল মফঃশহর থেকে আসা গাঁতানো কেরিয়ারিস্ট পাব্লিক। জনতা জি এই এই জনার্দন।

                                                         (৩)
 উচ্চমাধ্যমিকের পর যখন আই আই টি খরগপুরে ঢুকছি-তখন আমি সাহিত্যে বেশ অশিক্ষিত।  তখনো মাথার মধ্যে বিজ্ঞানী হওয়ার উদোম ইচ্ছা। যদিও আই আই টি খরগপুরে সাহিত্য অনুরাগী ছাত্র ছিল অনেক-তবে বাংলা সাহিত্যে নয়।

সাহিত্যানুরাগের শুরু সেকেন্ড ইয়ার থেকে। থাকতাম আজাদ হলে। এটা আই আই টির প্রাচীনতম হোস্টেল।  আজাদ হলের লাইব্রেরীতে বিশ্বসাহিত্যের বিরাট ভান্ডার। সমৃদ্ধ কালেকশন।

           বাংলা নাটকের প্রতিযোগিতা হত বছরে দুবার। সেই সূত্রেই একবার  হলের নাটকের গ্রুপের ছাত্ররা মিলে ঠিক করলাম-নিজেরা স্ক্রিপ্ট নামাবো। অন্যহলে তখন বাদল সরকারের ভোমা বনাম এবং ইন্দ্রজিত। বাদল সরকারে মগ্ন প্রায় সব হলের ছেলেরা। আমার উইঙ্গের পাবলিকগুলো একটু এন্টি বাম। বলে দুঃশালা -বাংলা নাটক মানেই বাম। ফলে সিদ্ধান্ত- নিজেরাই লিখব।

        মুশকিল হচ্ছে আমাদের উইংটা ছিল কোলকাতার বাঙালীতে ভর্তি। যারা শুক্কুর বার হলেই ট্রেন ধরে কোলকাতার বাড়িতে ফেরে প্রেমিকাদের সাথে দেখা করার জন্য। আমিই একমাত্র গ্রাম থেকে আসা ছেলে। বাড়ি হোস্টেল থেকে অন্তত নঘন্টার পথ। ফলে উইকেন্ডে হোস্টেলেই থাকতে হয়। ওরা বলল্লো-এই তুই ত উইকেন্ডে কোথাও যাস না- তুই একটা স্ক্রিপ্ট নামিয়ে দে।

  আমি ভাবলাম দেখি ট্রাই মেরে।  নিজে নতুন লিখব-এমন ক্যাপা নেই। ফলে একটা বিদেশী নাটকের ভাবানুবাদ নামানোটা হবে সেফ খেলা। কিন্ত কার নাটক নামানো যায়?

  সাহিত্যে তখনও আমার জ্ঞান খুব লিমিটেড। উচ্চমাধ্যমিকে বাংলায় মার্কস তোলার জন্য ছোটগল্প প্রসঙ্গে চেকভের নামটা ঠুকতে হত। ওই বাঙালীর দুচারটে নাম ড্রপ না করলে-মার্কস ওঠে না আর কি। ভাবলাম বাংলা ছোট গল্প থেকে স্ক্রিপ্ট নামালে ত চোতা ধরা খেয়ে যাব। ফলে চেকভের কোন গল্প থেকে নামিয়ে দিই। হলের লাইব্রেরীতে চেকভের পাঁচটা ভল্যুমের সম্পূর্ন কালেকশন।

 লেখক সিলেকশন ?  ডান। কিন্ত কোন গল্প? চেকভের কোন গল্পই পড়ি নি কোনদিন । অগত্যা এক হপ্তা ধরে চেকভ পড়ি। এই একটা সপ্তাহ-আমার জীবনের গতিপথটাই বদলে যায়। ফরেভার। কোন গল্পটা এখন নাম মনে আসছে না-কিন্ত গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এক কিশোর-সকাল থেকে বিকেল জানালার দিকে তাকিয়ে। জানালা দিয়ে বাইরে ছোট্ট নদী বন্দর। চাষীরা মাল নামাচ্ছে-ফরেরা নৌকা থেকে মাল নামা মাত্র হাঁকডাক করছে নিলামে সেগুলি তক্ষুনি কিনে নেবে।

আমি তখন ঘোরে মধ্যে। করিমপুরে আমার বাড়ির সামনে খড়ে নদী-সামনে বক্সীপুরের ঘাট। নদীটা তখনো বেঁচে- কত নৌকার আনাগোনা। কতদিন গেছে বই খুলে শুধু নদীর সামনে তাকিয়ে নৌকা থেকে মাল ওঠা নামা দেখেই কাটিয়ে দিয়েছে আমার ভাবুক কৈশোর।  একজন লেখক -যে ভারতীয়ও না-জন্মেছে আমার দেড়শো বছর আগে কত দূরে রাশিয়াতে-সে যে আমার শৈশবকে ওমন নিঃখুত ভাবে টাচ করে যাবে-এসব কোনদিন কল্পনাতেও ছিল না।

 ওই যে চেকভ থেকে শুরু হল-আস্তে আস্তে গোর্কি, টলস্টয়, ডস্টভয়েস্কি সব কিছুতেই ডুব দিতে থাকলাম। রাশিয়ান সাহিত্য ছাড়াও  ইটালিয়ান, জার্মান, ল্যাটিন সাহিত্যে হাতখড়ি হল। ইটালিয়ান লেখক আলবার্টো মোরাভিয়া বিরাট ভালো লেগে গেল। কাফকার মেটামরফোসিস সম্পূর্ন অন্য অভিজ্ঞতা। ওক্টোভিও পাজ এবং পাবলো নেরুদার লেখাতে অন্য স্বাদ। আবার স্ক্যান্ডেনেভিয়ান সাহিত্যর গভীরতা মনোমুগ্ধকর । ইবসেন, হামসান, গুস্টাফ ফ্রডিং এরা অন্য জগতের বাসিন্দা। নো ওয়ান্ডার স্ক্যান্ডেনেভিয়ান সাহিত্য সব থেকে বেশী নোবেল প্রাইজ পেয়েছে।

 ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত ফিজিক্সটাও মোটামুটি সিরিয়াসলি পড়ছিলাম। ব্যাচের বাকী সবাই এর মতন জি এর ই, টোয়েফেল দিয়ে পি এই চ ডি করতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়-এই ছিল আমাদের বিশ্ববিভূবন।

 যদ্দিন ফিজিক্স পড়তে হয়েছে, মাথা তাও ঠিক ছিল। আমাদের ব্যাচটাও ছিল খুব ভাল। আমার ডিপার্টমেন্টের ব্যাচমেটদের প্রায় সবাই আমেরিকা বা ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত নামকরা ডাকসাইটে অধ্যাপক এখন। নিজেদের মধ্যে নানান বিষয়ের চর্চা ছিল ব্যপক। ফিজিক্স পড়ার ওই একটা পজিটিভ সাইড-ব্যাচমেটরা ছিল বিজ্ঞানের জন্য ডেডিকেডেড প্রাণ।

   কিন্ত যেই আমেরিকা যাওয়ার সময় এগিয়ে আসে- ফাইনাল ইয়ার থেকে বিজ্ঞান চর্চা বাদ দিয়ে জি আর ই তে পারফেক্ট স্কোরের পেছনে ছুটতে হল, কিছুতেই ফোকাস করতে পারলাম না।  কোন ইন্টারেস্ট পেলাম না।

 ফাইনাল ইয়ারে- সব বিষয়ে ইন্টারেস্ট হারিয়ে  ঝেঁটিয়ে বিশ্বসাহিত্যের নেশায় পেয়ে বসল। জি আর ই র দুদিন আগেও আমি চুটিয়ে ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট পড়ছি। আমেরিকা, ফিজিক্সের নেশা গেছে কেটে।  এক অদ্ভুত ঘোরের দুনিয়ায়  কাটিয়েছি ফাইনাল ইয়ারে। ইনফ্যাক্ট আমি তখন ঠিক করেই ফেলেছি-আর নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। ইনকাম করাটা ফ্যাক্টর না-যেহেতু আই আই টি জেইই এর জন্য ফিজিক্স এবং ম্যাথ আমি পড়াতাম।  আই আই টির টিউটোরিয়াল গুলোতে পড়ালে, ইঞ্জিনিয়ারিং এর থেকেও বেশী ইনকাম।  ফলে আরো সাহিত্যের নেশা পেয়ে বসল। তবে আমি কিছু লিখছি না তখনো। শুধুই পড়ছি-আর প্রত্যেকটা লেখক এক অজানা অচেনা দুনিয়া খুলে দিচ্ছে।

    বাড়িতে জানালাম-আমি আমেরিকাতেও যাচ্ছি না-পি এই চ ডিও করছি না। আই আই টির জন্য টিউটোরিয়াল খুলে পড়াব। কারন ও কাজটা আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকে করছি-আর ফালতু ঝামেলা করে কি হবে!  বাবা মা এসব শুনে ভীষন আপসেট।

  এমন সময় এস বি আই ব্যাঙ্কের কাউন্টারে প্রফেসার রঞ্জন গাঙ্গুলীর সাথে দেখা। উনি আমার বন্ধু সম্রাটের বাবা। টেলিকম ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। বল্লেন -কোন ইউনিভার্সিটিতে পি এই চ ডি করতে যাচ্ছ!

 খাইছে কাজ। আসলেই আমি ওসব কিছু করছি না। করার ইচ্ছাও ছিল না। শুধু বল্লাম এখনো কিছু প্ল্যান করি নি।

 ফলে উনি বল্লেন উনার কাছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের একটা প্রজেক্ট আছে-যাতে অপটিক্স ভাল জানা একজন দরকার। টেলিকমটা উনি শিখিয়ে দেবেন।  অপটিকাল কমিনিউকেশন সেই ১৯৯৬ সালে উঠতি একটা ইঞ্জিনিয়ারিং এরিয়া- সর্বত্র ইন্টারনেট আসছে-আর অপটিক্যাল কমিউনিকেশন ছাড়া ইন্টারনেট সম্ভব না। ভাল ফিউচার।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার প্ল্যান ছিল না। কোন কালেই ছিল না। সাহিত্য চর্চার জন্য কোলকাতায় ফিরব। টিউশন করতে গেলেও থাকার একটা জায়গা চাই।   আই এই এস আই তে কম্পু সায়েন্সের এম টেকের এডমিশন টেস্টটা উতরে গেছি। ভাবছিলাম ওখানেই এডমিশন নিই।  এমন অবস্থায় স্যারের অফারটা নিয়ে ভাবলাম। মোদ্দা কথা যেটা টানল-এদ্দিন ফিজিক্স যা শিখেছি-তা ফেলে দিতে হবে না-আবার ফিজিক্স নিয়ে পি এই চ ডিও করতে হচ্ছে না-অপটিক্যাল কমিনিউকেশন সাবজেক্টটা তখন টপ গিয়ারে। আই আই টির হোষ্টেল ছাড়তে হচ্ছে না। আর টিউটোরিয়ালের জন্য হলদিয়ার মতন উঠতি টাউনশিপ থেকে অফার খোলা। ফলে সব ভেবে দেখলাম, খরগপুরেই থেকে যায়। সাহিত্যের বই টই ও এখানেই পাওয়া অনেক সহজ!

   পি এই চ ডি শুরুর প্রথম ছমাস কেটেছে রাজকীয়। শুধুমাত্র রোব্বারে আই আই টির জন্য পড়িয়ে, ফেলোশিপের থেকে তিনগুন ইনকাম । আর হাতে কাঁচা টাকা আসলে প্রেমিকাও জুটবে। ফলে প্রেমিকা, নাটক, কবিতা, টিউটোরিয়াল-ইত্যাদি নিয়ে রিসার্চের কাজ হয়ে গেল গৌন। আর স্যারও থাকতেন প্রজেক্টের কাজে ইটালিতে। ফলে প্রথম ছমাস প্রেম, প্রেমের কবিতা আর নাটকটাই হল বেশী।

  এবার ছমাস বাদে স্যার দেখলেন কাজ এগোয় নি। যেহেতু আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট-ছমাস অন্তর অন্তর লন্ডন,  ইটালির পার্মা শহর আর খরগপুরে মিটিং বসত- নিজেদের অগ্রগতি নিয়ে ডিটেলেসএ আলোচনা, আদন প্রদান ইত্যাদি। উনি বল্লেন এইভাবে কাজ করলে পি এই চ ডি ছেড়ে দাও। আমিও দেখলাম-বড্ড ফাঁকি মারছি। এখন যেভাবে লেখালেখি করি আর কি।

 তবে প্রেমিকাকে ত আর ছাড়া যায় না, বাকী এক্টিভিটি গুলোই ছাড়তে হল। বহুদিন বাদে আবার সিরিয়াসলি অঙ্ক, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে ব্যাক। পরবর্তী দুই বছরে আমি দুটো গুরুত্বপূর্ন কাজ করি-যার থেকে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পেপার হয়ে গেল সহজেই।  ইটালিয়ান কাউন্টারপার্টরা বললো ওদের দেশে এসে পি এই চ ডির বাকী কাজ করতে। তবে সেটা হয় নি। কিন্ত ইটালিতে একটা কোম্পানী যারা আমার ফিল্ডেই সফটোয়ার বানাচ্ছিল-তারা ইন্টার্নশিপ দেয়। যেহেতু আমার নিজের ফিল্ডেই কাজ- ইটালির তুরিন শহরে চলে গেলাম ১৯৯৯ সালে। ওখানেই প্রথম ইন্ড্রাস্টি এক্সপোজার। বুঝালাম একাডেমিক্স এবং ইন্ডাস্ট্রি পুরো আলাদা। পি এই চডির শেষের কাজগুলো করি তুরিন শহরেই-তুরিন পলিটেকনিকের পাইরোলুইজি ছিলেন আমার লোক্যাল গাইড-এই লোকটা শুধু বিখ্যাতই না-মানুষ হিসাবেও ছিলেন অসাধারন।

 কিন্ত যা হয়-একটা ভাল পেশাদারি বৃত্তে ঢুকলে-চারিদিকে লোকজন ভীষন সিরিয়াস। দারুন সব কাজ করছে। ফলে তাল রাখতে নিজেকেও ফোকাসে রাখতে হয়। ফলে আস্তে আস্তে কবে সাহিত্যের নেশাটা ঘুচে গেছে টের পাই নি। আসলে তখন অপটিক্যাল কম্যুনিকেশনে বিশাল ইনভেস্টমেন্ট-বিরাট সম্ভাবনা।  সিকামোর, সিয়েনা, করভিসের মতন কোম্পানীগুলো-কোনরকমে প্রযুক্তি বার করে একটা ফিল্ড ট্রায়াল দিয়েই বিলিয়ানার হতে শুরু করে। আর যেখানে টাকা সেখানে প্রতিযোগিতাও  তীব্র।

 পি এই চ ডি শেষ করার আগেই আমেরিকাতে দুটো চাকরি পেলাম। দুটোই সিক্স ডিজিট স্যালারি। আমাদের সময় ইন্ডিয়াতে পি এই চ ডি করে এসব ভাবা যেত না। এখন অবশ্য গুগলে বিটেকের ছেলেরাও ওই ধরনের অফার পাচ্ছে।  আমাদের ফিল্ডে প্রচুর টাকা- ব্যাঙের ছাতার মতন স্টার্টাপ-কিন্ত ট্রেইন্ড লোক নেই।  এবং প্রত্যেকের দাবী পরের দিন যোগ দিতে হবে। যাইহোক, আমি থিসিস সাবমিট করে পরের দিন বিয়ে করি। সেই দিন রাতেই আমেরিকার প্লেনে।

    ভাববেন না উপন্যাস লিখছি। তখন সবাই টেলিকম স্টার্টাপ খুলে ভাবছে মিলিয়ানার বিলিয়ানার হবে। অনেকে হয়েও গেছে। আমি ইটালির আর্টিস কোম্পানীটার হয়ে যাদের জন্য সিমুলেশন মডেলিং করতাম-তাদের অনেকেই আমেরিকান স্টার্টাপ এবং স্টকঅপশনে মিলিয়ানার । আমি তখন অন্য ঘোরের জগতে। ভাবছি এরা যদি আমেরিকান স্বর্গরাজ্যে মিলিয়ান কামাতে পারে স্টার্টাপে-আমিও পারি!! ফলে রেজিস্ট্রি বিয়েটা সেরে, সেই রাতেই আমেরিকান স্টার্টাপে দৌঁড়  ইস্টকোষ্টে ফেব্রুয়ারী মাসের ঠান্ডায়।

    তখন কোথায় সাহিত্য! সপ্তাহে সাতদিনই খাটি।  বারো থেকে চোদ্দঘন্টা। আশা আগামী বছরেই স্টার্টাপটা কেউ কিনে নেবে বা আই পি ও হবে। ইনফ্যাক্ট একদম প্রথম দিকের কর্মী হওয়াতে প্রচুর স্টক অপশন ছিল আমার। সাকসেসফুল হলেই লটারী টিকিট-কয়েকশোকোটি টাকার স্বপ্ন ।  আর সেই  লোভে প্রচুর গাধার খাটুনি।

   ঘোর ভাংল ২০০২ সালেই। কোম্পানীর অর্ধেক লোক ছাঁটাই-কারন সেকেন্ড রাউন্ড ইনভেস্টমেন্ট তুলতে পারল না।  তখন সব টেলিকম স্টক গাধার ঘারে। মোহভঙ্গের বৃত্ত সম্পূর্ন হয় ২০০৩ সালের এপ্রিলে।  আমাদের কোম্পানিটা সেকেন্ড রাউন্ডের অভাবে ভেরাইজনে ট্রায়ালে যেতে পারল না। মিলিয়ান ডলার দিয়ে যেসব সুইচ বানানো হয়েছিল-সেসব লোকেরা খুলে নিয়ে চলে গেল! কি অদ্ভুত ঘটনা। একেকটা অপ্টিক্যাল আমপ্লিফ্যায়ারের দাম দশ বিশ লাখের ওপরে। বেমালুম যে যা পারছে খুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে।  আমি অবশ্য দুটো সিস্টেম তুলে নিয়ে গিয়ে আই আই টি চেন্নাইকে দান করে দিয়েছিলাম। এত খেটে যেগুলো বানিয়েছি-অন্তত কিছু ছাত্ররা তার থেকে উপকার পাক।

 দুশো কোটি টাকা দিয়ে বানানো একটা সিস্টেম লোকে আস্তে আস্তে খুলে নিয়ে যাচ্ছে-ওই দৃশ্য কোনদিন ভুলবো না। ক্যাপিটালিজম কত নিষ্ঠুর হতে পারে -তার ফার্স্টহ্যান্ড অভিজ্ঞতা। ওটাত শুধু দুশোকোটি টাকার গল্প না- গত দুই বছরে আমি এবং আমার চল্লিশজন কলিগের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গড়ে উঠেছিল সেটা। রাত চারটে পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করতাম কজনে মিলে।  ওটাই ছিল আমাদের কোটি কোটি টাকার স্বপ্নের সৌধ। একদিনে  দুঘন্টায় সব শেষ। আমি যেন উপনিষদের গল্পের নারদ। নারায়ণ আমাকে দেখাচ্ছেন-একদিন আমি সম্রাট -পরের দিন  যুদ্ধে হেরে হঠাৎ ভিখিরি-সবটাই স্বপ্নে।   " মায়া" কি বস্তু-সেই শিক্ষা দিতে নারদকে স্বপ্নের জগতের সম্রাট বানিয়েছিলেন নারায়ন।

বুঝলাম ধণতন্ত্রে সবই মায়া।  আবেগ, প্যাশন এসব থাকা ভাল-কিন্ত শেষ কথা বলবে মার্কেট। ধণতন্ত্র আসলেই জঙ্গল। শিকার উঠতেও পারে। আবার শিকার করতে গিয়ে জঙ্গলের নিয়মে লাশ হওয়াটাও বিচিত্র না।

                                                                 (৪)
 ভগ্ন হৃদয়ে নতুন চাকরি নিয়ে আসি ক্যালিফোর্নিয়াতে ২০০৩ সালের শেষে। ক্যালিফোর্নিয়া স্বর্গরাজ্য। প্রকৃত অর্থেই। তখন আর মিলিয়ান বিলিয়ানের স্বপ্ন দেখি না। বহুদিন গান সাহিত্য প্রকৃতি কোন কিছুই উপভোগ করি্নি। স্টার্টাপ আসলে প্রেসারকুকার । ওখানে শুধু সিদ্ধ হয়েছি।

   নতুন চাকরিটা সেই সুযোগ করে দিল। চাকরি সূত্রে গোটা ক্যালিফোর্নিয়া ঘুরতে হত। ফলে কোম্পানীর পয়সায় ঘোরার এলাহি সুযোগ।  ক্যালিফোর্নিয়া এমন এক রাজ্য-যার প্রতিটা কর্নারে আমি ঘুরেছি কর্মসূত্রে।  ক্যালিফোর্নিয়ার অপার সৌন্দর্য্য এবং আবহাওয়াতে আবার একটু একটু করে নিজেকে ফিরে পাচ্ছিলাম।

 জীবনের এই সন্ধিক্ষণে অভিজিত রায় এর সাথে অনলাইনে দেখা। আসলে বড় কোম্পানী-প্রায় মনোপলি-প্রচুর লাভ-কাজের চাপ কম-হাতে অঢেল সময়-বৌ দেশে গেছে মাস্টার্স কমপ্লিট করতে-এমন সুলুক্ষুনে সময়ে আমার জীবনে এল অভি।  দেখলাম ছেলেটা অনলাইনে লড়ে যাচ্ছে। কখনো ইসলামের বিরুদ্ধে, কখনো কমিনিউস্টদের বিরুদ্ধে, কখনো হিন্দুত্ববাদিদের বিরুদ্ধে। ওদের একটা ছোট ওয়েব সাইট ও আছে।

 ১৯৯১ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে ২০০৪ সালে অভির সাথে দেখা হওয়ার আগে কবার বাংলা লিখেছি -বোধ হয় হাতে গুনতে পারি। সেই পি এই চ ডির প্রথম বছরে যে নাটক লিখেছিলাম-সেটাই আমার শেষ লেখা। এরপরে দীর্ঘ আট বছর বাংলায় একটা শব্দও লিখি নি। বাংলা সফটোয়ার গুলো বিধঘুটে লাগত। ফলে মুক্তমনাতে প্রথম বছরে ইংরেজিতেই লিখতাম।  অভি আমাকে বর্নসফট বলে একটা সফটোয়ার দিল। বললো ওটাতে চেষ্টা করে দেখ।

 ফ্রাংকলি স্পিকিং আমি ভাবিও নি-এত দীর্ঘদিনের অনভ্যাস কাটিয়ে কি করে বাংলায় লিখব। আদৌ লিখতে পারব কি না। দেখলাম লিখতে পারছি। কিন্ত বানানের বাবা মা এক করে দিয়েছি । অভিকে বল্লাম এই অবস্থা। ও বললো-আরে ছাড় ত-বাংলায় আমরা লিখছি-এটাই আসল কথা। সোশ্যাল মিডিয়াতে যারা বানানের খুঁত ধরে তাদের ধান্দা অন্য। যাদের মধ্যে জ্ঞান পিপাসা আছে, তারা নিশ্চয় পড়বে। এইভাবে আমার বানান ভুলে ভরা একটা প্রবন্ধ ও মুক্তমনা সাইটে ছেপে দিল।

 ব্যস সেই শুরু। বানানের চাপ নেই দেখে, প্রাণ খুলে লিখতে লাগলাম। তখন হাতে সময় ছিল- ফলে অনেক পড়াশুনো করে পি ডি এফ গুলো নামাতাম। বানান ভুল থাকত। তবে এখনকার মতন ফাঁকিবাজি ছিল না। ইনফ্যাক্ট ২০০৫-২০০৬ পর্যন্ত মুক্তমনাতে সব থেকে বেশী লিখেছি আমি। অভির থেকেও অনেক বেশী। ও ঠাট্টা করে বলত তুমিই মুক্তমনা চালাচ্ছ। ওর ওটা পি এই চ ডি শেষ করার বছর। ও খুব একটা বেশী লিখত না তখন পি এই চ ডি শেষ করার চাপে। আমাকেই লিখতে বলত নানান ইস্যুতে।

  এই সময় আরেকটা ঘটনা -জনাব কুদ্দুস খানের সাথে পরিচয়। উনি ক্যালিফোর্নিয়ার বাংলাদেশীদের জন্য ভিন্নমত নামে একটা পাক্ষিক প্রিন্ট ম্যাগাজিন চালাতেন। একটা ওয়েব এডিশন ও ছিল। ২০০৫ সালের সেপটেম্বর মাসে উনি প্রস্তাব দিলেন চল দুজনে মিলে এটা চালায়-আরো বড় করি। তখন বাংলা লেখার এক বছর পূর্ন হয়েছে-ভরপুর কনফিডেন্স -আমিও লিখতে পারি।  ফলে আমরা দুজনে মিলে ভিন্নমতকে ভারতীয় বাঙালী এবং বাংলাদেশীদের জন্য পাক্ষিক ম্যাগাজিন হিসাবে গড়ে তুলি। ক্যালিফোর্নিয়া, এরিজোনা এবং নেভাদার প্রতিটা বাঙালী গ্রসারি স্টোরেই পাওয়া যেত। ৩২ পাতার নিউজ ট্যাবলয়েড। কুড়ি পাতার বিজ্ঞাপন -সব বাংলাদেশ গ্রসারীর। তিন হাজার কপি ছাপাতাম।  লাভ হত না। আবার লস ও হত না।

এ এক বিরল অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ কমিউনিটিকে ক্লোজ থেকে জানার। আমি দেখেছি বেশ কিছু বাংলাদেশী মুদিখানার দোকানী এবং রিয়াল এস্টেটের এজেন্ট সাধ্যের বাইরে গিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহায্য করেছেন-যে প্রবাসে একটা বাঙালী নিউজ পেপার টিকে থাকুক। আবার লস এঞ্জেলেসের বাংলাদেশী মসজিদে ভিন্নমত ম্যাগাজিন পোড়ানো হয়েছে,  মহম্মদ আসগার কোরান নিয়ে প্রশ্ন তোলায়।

সব বিজ্ঞাপন আসত বাংলাদেশীদের কাছ থেকে। ফলে প্রশ্ন উঠল-তাহলে পশ্চিম বঙ্গ বা ভারতের জন্য ৫০% পেজ ছাড়া হবে কেন? ভারতীয় বাঙালীরাত সব চাকরিজীবি।  জনাব খান হাই হাই করে উঠলেন। বল্লেন আরে ওটাই ত ইউ এস পি। আমাদের প্রতিযোগী ছিল নিউয়ার্ক থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশী ম্যাগাজিন ঠিকানা। তারা ১০০% বাংলাদেশী ফোকাস। ১০,০০০ সার্কুলেশন।  কিন্ত আমাদের যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, সেই বাংলাদেশী গ্রসারদের কাস্টমার আবার ভারতীয় বাঙালীরা। তারা ত চাইছে এমন পেপার যা দুই দিকের বাঙালীদের কাছেই যাক।

আমি সেই দিন বুঝেছিলাম একমাত্র মার্কেটই পারে জাতি ধর্মকে মেশাতে! ব্যবসার একমাত্র জ্ঞাতি, জাতি, ধর্ম হচ্ছে কাস্টমার।

ইনফ্যাক্ট সেখান থেকেই আমার সখের জার্নালিজমের শুরু। সম্পাদকের নেশা বড় নেশা।  বাংলাদেশীদের মধ্যে আমি অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠি। আসলে ওরা হিন্দু বলতে বুঝত-রক্ষণশীল কিছু লোক-যারা বাংলাদেশী মুসলমানদের সামনে চুপসে থাকে-পেছনে গালি দেয়-গরু খায় না। সব বাংলাদেশী প্রোগ্রামে আমার আমন্ত্রন ছিল-এগুলো কভার করার কথা ছিল কুদ্দুস ভাই এর। কিন্ত উনি বল্লেন, এদের মধ্যে এত দলাদলি-আমি লিখলে সমস্যা আছে। তুমি বাইরের লোক। তোমার রিপোর্টিং হবে সেফ। সম্পাদক হিসাবে খাতির, পার্টি-খাওয়া দাওয়া-বৌদিদের কাছে এক্সেস। তাদের আবদার যেন তাদের সেরা ফটোটা যায় ম্যাগাজিনে।  এসব বৌদি সুন্দরীদের মধুময়ী হাঁসি কি আর স্টার্টাপ করে পাওয়া যায়?  বৌদিদের জীবনের চাইচাপা যৌবনের আগুন সম্পাদক না হলে থোরিই না বুঝতাম!

সত্যিই এ এক অন্য জীবন। করিমপুর ছাড়ার পর থেকে একাডেমিক এলিটদের আশেপাশেই জীবন কেটেছে। আবার ব্যাক টু নর্মাল।

 তবে আসল যে শিক্ষাটা পেলাম সেটা হচ্ছে এই যে মুসলমান -হিন্দু সম্প্রদায়ের মিলন সম্ভব। কিন্ত দুটো সম্প্রদায়ের লোকজনকেই উদার হতে হবে। আমেরিকাতে আমার অধিকাংশ বন্ধুই কিন্ত বাংলাদেশী মুসলমান।

 কুদ্দুস খানে স্ত্রীর অসুস্থতা শুরু হলে নানান কারনে ভিন্নমত চালানো কঠিন হয়ে ওঠে। উনিই ছিলেন আসল কম্পোজার। আমার বানান আর বাংলা উনিই ঠিক করে দিতেন। তাছারা আমি আস্তে আস্তে অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিনেই মন দেওয়া শুরু করি। আমার মনে হয়েছিল প্রবাসে প্রিন্টের ভবিষ্যত নেই।

                                                       (৫)

মিডিয়া এমন ভাবে আমাকে টানতে থাকল, মিডিয়া প্রযুক্তি আরো ভাল করে শেখার জন্য ২০০৭ সালে হলিউডের একটা স্টার্টাপে যোগ দিই। বারবাঙ্কে ডিজনি স্টুডিওর পাশেই ছিল আমাদের অফিস। প্রযুক্তিবিদ হিসাবেই কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এখানে প্রথম ভিডিও অডীও এডিটিং শিখি ভাসা ভাসা। কাজ করতাম সেই প্রযুক্তিবিদ হিসাবে-কিন্ত কাজের ফাঁকে ফাঁকে এডিটরদের লাঞ্চ খাইয়ে শেখার চেষ্টার করতাম। যার ফলশ্রুতি ইউটিউবে আমার আমেচ্যার ভিডিও ব্লগিং।  একই সাথে আমি দুটি মিডিয়া স্টার্টাপ খুলি। একটা বিনোদন টিভি-যেটা বাংলা সিনেমা স্ট্রিমিং এর জন্য। অন্যটা ফসাক টিভি-ভারতীয়দের জন্য ইন্টারনেট টিভি। প্রথমটা তিনমাস বাদেই বন্ধ করে দিতে হয়-কারন সেই সময় বাংলা সিনেমার ইন্টারনেট ডিস্ট্রিবিউশন রাইট বলে কিছু ছিল না। ফলে মুভি চাইতে গেলে লোক এবসার্ড টাকা চাইত। যেটা কোন বিজনেস মডেলই হতে পারে না।তাছাড়া ইউটিউবে সব পাইরেটেড মুভি পাওয়া  যেত। ফলে ওই স্টার্টাপের কোন ভবিষ্যত ছিল না। আমি এবং জনাব খান, প্রচুর টাকা লস করে মাস তিনেকের মধ্যেই বন্ধ করে দিই।


ফসাক টিভির ভাল ফাইন্সান্সিয়াল ব্যাকাপ ছিল প্রথমে।  ভারতীয় ধনী ব্যবসায়ীর অভাব নেই দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে। তারা বিজ্ঞাপন, টাকা নিয়ে সাপোর্ট করতে এগিয়ে এসেছিল। মূল প্যাট্রন ছিলেন একজন দক্ষিন ভারতীয় হেজ ফান্ড ম্যানেজার। ২০০৮ এর রিশেশন শুরু হতে সব ব্যবসায়ীরা এত লস করা শুরু করল- সব স্পনসর গায়েব। ফলে ফসাক টিভি বন্ধ করা ছাড়া উপায় ছিল না।

 ২০০৮ এর রিশেসন শুরু হয় ২০০৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে। হলিউডের স্টার্টাপটাও রাউন্ড টু ফান্ডিং পাবে না এটাও বুঝে গেছিলাম। ফসাক টিভির স্পন্সরদের বিজনেসে ভরাডুবি।   নতুন চাকরিতে জয়েন করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না।

 এই ভাবেই মেরীল্যান্ডের সিয়েনাতে চলে আসি ২০০৮ সালের প্রথমে। সেই রিশেশনের বাজার অত ভাল অফার ফেরানো সম্ভব ছিল না।

ইনফ্যাক্ট সিয়েনা আমাদের লাইনে টপ কোম্পানী। এখানে আর এন্ডিতে যোগ দিয়ে আবার বিজ্ঞান প্রযুক্তির কাজে মন দেওয়ার সুযোগ পেলাম বহুদিন বাদে।  হাতে লেখার সময় ও এল কিছুটা। ২০০৬-২০০৭ এ লিখেছি খুব অল্প। সিয়েনাতে যোগ দেওয়ার পরে আবার লেখালেখির সেকেন্ড ফেজ শুরু।

কিন্ত ধণতন্ত্রে কি কোন কিছুর নিশ্চয়তা আছে? সিয়েনাতে বেশ ভাল চলছে-প্রমোশন পেয়ে হায়েস্ট ইন্ডিভিজ্যুয়াল র‍্যাঙ্কে পৌছে গিয়েছি -সব চেয়ে জটিল নেটওয়ার্ক ডিজাইনের কাজ আমার কাছেই আসত।  এমন সময় সিয়েনা কিনে বসল নর্টেলের লসে চলা অপটিক্যাল নেটোয়ার্ক ডিভিশনকে। যার কর্মী সংখ্যা সিয়েনার তিনগুন। হেলেসাপের খোরগোশ খাওয়ার গল্প। তখন থেকে আমরা সবাই জানতাম এক বা দুবছর বাদে মেরীল্যান্ডে আমাদের আর এন্ডি আর থাকবে না।

     সামনে দুটো অপশন । চাকরি চেঞ্জ বা নিজেই স্টার্টাপ খোলা। আমি অন্য চাকরি পেলাম-সিয়েনারা প্রতিযোগী কোম্পানী চিনের হুয়েই এর কাছ থেকে। ওরা অনেক বেশী টাকা দিয়ে ডাকল টেক্সাসে। ইনফ্যাক্ট হুয়েই আমেরিকার সিটিও আমার প্রাত্তন বস।  অফার পেয়ে একবার ভাবলাম। এইভাবে ধণতন্ত্রের বোরে হয়ে আর কতদিন?  বয়স তখন আটত্রিশ। কদ্দিন আর ভলি বলের মতন এ কোর্ট থেকে ওই কোর্ট? এটা কি জীবন হতে পারে? কর্পরেট লাইফের অন্তসার শুন্যতায় বেশ ক্লান্ত -অথচ কি করবো ঠিক নেই।

ধনতন্ত্রই যখন সমস্যার কারন-হাতের সামনে দুটো অপশন থাকে। ধণতন্ত্রকেই সমাধান হিসাবে ব্যবহার করা। অথবা ধণতন্ত্রকে গালি দিয়ে বামেদের দলে নাম লিখিয়ে এক্টিভিস্ট হওয়া। ক্যাপিটালিজমের জন্যই আমার জীবনের সব দুর্দশা-কারন দাবার বোর্ডে রাজা মন্ত্রী হয়েও লাভ নেই। যে খেলছে সে ভুল খেললে পতন কেউ আটকাতে পারবে না। ফলে ধনতন্ত্রে খেলোয়ার হতে হবে-গুটি হয়ে লাভ নেই। আমার কাছে সেটাই সমাধান। ফলে ধনতন্ত্রকেই আমি ব্যবহার করছি, উত্তোরনে জন্য।

দুহাজার বারোসালের জানুয়ারী মাসে সিয়েনা মেরিল্যান্ডের আর এন্ডি সেন্টার প্রায় তুলে দেয়। ওই দিন আসবে আগেই জানতাম। তার  এক বছর আগে থেকেই প্রথম বিজনেসটা দাঁড় করিয়েছি। ইনফ্যাক্ট তখনই বিজনেস থেকে সংসার চালানোর টাকা আসছে। ফলে চাকরি খোঁজার প্রয়োজন হল না। যদিও ওটাই আমার জীবনের সব থেকে সাহসী সিদ্ধান্ত। তবে সাফল্য আসবে জানতাম। ইন্ড্রাস্টিয়াল সেন্সর মার্কেট চিনি তালুর মতন। ওই  মার্কেটে একটা আউটসোর্সিং মডেল দাঁড় করাতে পারবো সেই বিশ্বাস ছিল।

                                               (৬)

ব্যবসার প্রথম আড়াই বছর মোটেও ভাল কাটে নি। ভুলভাল পার্টনার, কাস্টমার, স্ট্রাটেজি, যথেষ্ট পুঁজি নেই-অনেক কিছু নিয়ে ভুগেছি। আস্তে আস্তে ভুলভাল পার্টনার সরিয়ে, ঠিক ঠাক কাস্টমার এবং ইনভেস্টর পেতে আমার বছর আড়াই লেগেছে।  ২০১৪ সালের আগস্টের পরে অবশ্য আমাকে ফিরে তাকাতে হয় নি।  ইনফ্যাক্ট ২০১৫ আমার সেরা বছর । এই বছরেই সেক্টর ফাইভে দুটো দুহাজার স্কোয়ার ফিটের অফিস, ব্যাঙ্গালোরে দুহাজার স্কোয়ার ফিটের অফিস এবং জয়পুরে আরেকটা অফিস খুলেছি আমরা। হেড কাউন্ট পৌঁছেছে চল্লিশে। সবচেয়ে আনন্দের কথা আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা এ বছর প্রায় বারোটা ইউ এস পেটেন্ট ফাইল করেছে।  রেভিনিউ বেড়েছে তিনগুন।  আশা করছি ২০১৬ তেও একই গতি বজায় রেখে হেড কাউন্ট একশো ছাড়াবে।

 কিন্ত এতকিছু ত এমনি এমনি হয় নি। এই বছর একটা দিনের জন্যও ছুটি নিই নি। কোথাও বেড়াতেও যায় নি। আমার কোন শনি রবিবার নেই। রিক্রিয়েশন বলতে মাঝে সাঝে একটু ঝাঁট জ্বালানো বাংলা লিখি। একদম ফ্রি মাইন্ডে। বানানের চাপ নেই।

আগে অনেক কিছু পড়াশোনা করে, গবেষনা করে লিখতাম। ইনফ্যাক্ট রাজনৈতিক নেতা না অভিনেতা সিরিজটা লেখার জন্য অনেক কিছু রিসার্চ করেছি। কিন্ত লেখার সময় নেই। কাজের ফাঁকে, কনফারেন্সের ফাঁকে দুচার লাইন লিখে হাল্কা হওয়া।  বছরে শ দুয়েক সিনেমা বা ডকু ফিল্ম দেখার অভ্যেস। এবছর চারটে ভালো সিনেমা দেখেছি কি না মনে নেই।  কিছু পেতে গেলে কিছু হারতে হবে-এটাই মহাজাগতিক নিয়ম।

 এর মধ্যেই ২০১৫ সালে অভিকে হারানো। সাথে আরো পাঁচজন সহব্লগার।  দুঃখ ক্ষোপ আক্ষেপ সব ঢাকা পরে যায় কাজের চাপে। অভিকে খুব মিস করি। বাঙালীদের মধ্যে সত্যিকারের মুক্তমনের ত কেউ নেই যার সাথে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়। ২০১৬ সালের রং মশালগুলোর মধ্যে কোথাও না কোন অদৃশ অন্ধকার।









 

   










Friday, December 25, 2015

ক্রীসমাস ও পাপার গল্প

আমাদের গ্রামের দিকে নব্বই এর দশকে ক্রীসমাস বলতে কিছু ছিল না। একটা দিন ছুটি। রাস্তায় সারি সারি কেকের পসার। হলদে কাহজে মোরা -সস্তা কেক। কেক ফেক গ্রামের দিকে অন্য কোনদিন কেউ খেত না। শুধু জানত ওটা বড়দিনের ডেলিকেসি। আমাদের করিমপুরে আবার কোন চার্চ ও ছিল না। কাছাকাছি চার্চ বলতে চাপড়া-না হলে কৃষ্ণনগরে । কৃষ্ণনগরে অবশ্য খুব ঘটা করে বড় দিন হত।

খ্রীষ্ঠান ইভ্যাঞ্জেলিক্যালরা মাঝে মাঝে আসত বড়দিনে। রাস্তার মোরে প্রোজেক্টর ফেলে যীশুর সিনেমা দেখাত।

বড়দিন প্রথম বিরাট আকারে পালন করি নরেন্দ্রপুরে এসে-ক্লাস ইলেভেনে। এই দিনটাই স্পেশাল খাওয়া দাওয়া, বাইবেল থেকে পাঠ হত।  মহারাজরা যীশুর বানী নিয়ে গুরু গম্ভীর আলোচনা করতেন। সেটা শেষ হলেই অবশ্য প্রাচীর ডিঙিয়ে এক্স রেটেড সিনেমা বা প্রফেসার কোয়ার্টারে ঝাড়ি মারত সদ্য গোঁফ ওঠা ছাত্রদের দল।

 আমার সেরা ক্রীসমাস  ১৯৯৯ সালে ইটালিতে। তুরিন শহরে।  ওই সময় একটা ক্যাথোলিক হোস্টেলে থাকতাম । দক্ষিন ইটালী থেকে আসা  পলিটেকনিক ডি তুরিনোর ছেলে মেয়েরাই মূল বাসিন্দা। কোয়েড হোস্টেল-কিন্ত ছেলে মেয়েদের জন্য আলাদা বিল্ডিং।  ইটালিয়ান কিছু বুঝি না। কিন্ত ওই দিন হোস্টেলেরই বিরাট চার্চে বিরাট উৎসব। ভালো ভালো ইটালিয়ান ওয়াইন।  মিউজিক, ওর্কেস্ট্রা-ওপেরা। না জানি ইটালিয়ান, না মিউজিক--

এমন অবস্থায় সুন্দরী ইটালিয়ান মেয়েগুলোকে দেখে ঝাড়ি মারা ছাড়া আর  সময় কাটানোর বিকল্প নেই। সাথে টুক টুক করে ওয়াইন, নাও, খাও।

 রাত বারোটার সময় হোস্টেলের ওয়ার্ডেন-যিনি নিজেও পাদ্রী-তিনি এবং আমি দুজনেই প্রচুর ওয়াইন খেয়ে আউট। তিনি যীশুর দুঃখে, আমি ভাল মাল খাওয়ার আনন্দে। উনার পাশেই ছিল আমার রুম। তারপরেই শুরু হত মেয়েদের উইং। মেয়ে গুলোকে ওই অফিসের সামনে দিয়ে হেঁটে ঘরে ঢুকতে হোত।

 উনি আমাকে ডাকলেন-পুরো আউট। বোঝাচ্ছেন

-এই জন্যেই আমি খৃষ্ট ধর্মে। মাল খাওয়ায় বাধা নেই। ইসলামে বা তোমাদের হিন্দু ধর্মে এই সুযোগ নেই-

বলে খ্যাঁক খ্যাঁক উচ্ছাস।

 আমি বল্লাম
 -পাপা ( ফাদারকে ইটালিয়ানে পাপা বলে ), হিন্দু ধর্মেও সন্ন্যাসীদের ওয়াইন খাওয়াতে বাধা ছিল না। উদাহরন ঋকবেদ।  কিন্ত গরম ওয়েদার ত- মাল খেয়েই মাগীদের পেছনে ছুটে সব কেলেঙ্কারী বাধাত। ফলে আস্তে আস্তে হিন্দু সন্ন্যাসীরা নির্জলা নীরস হতে থাকে।
 এমন বড় দিনের ঠান্ডায় খেলে, ঠিক হজম করে ফেলত!

 হোস্টেলের মেয়েগুলো তখন টসকাতে, টলকাতে টলকাতে পাপার অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা দুজনেই ফ্যালফেলে চোখে তাকিয়ে।

Saturday, November 28, 2015

প্রাচীন ভারতের গণিত- মিথ বনাম বাস্তব

হিন্দুদের অতীত আদৌ গৌরবের কি না-তাই নিয়ে কয়েকদিন আগে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম। চাড্ডিদের এমন পোষ্ট ভালো লাগার কথা না-কারন তারা একদমই পড়াশোনা করে না-আর এই অতীতের ইতিহাসটাও গোলমেলে। তবে আমার পোষ্টটাও ছিল বেশ দুর্বল। অনেক কিছুই পরিস্কার করে না লেখার জন্য, অনেকেই সঠিক মেসেজটাই ধরতে পারে নি। 

  প্রথম কথা হচ্ছে-প্রাচীন হিন্দু ভারত, বিশ্বমানব সভ্যতাকে এমন কিছু কি দিয়েছে, যা সভ্যতার গতিপথ পাল্টেছে? বা মানব সভ্যতায় ব্যাপক অবদান রেখেছে ?

  আমি সেইসব প্রাচীন ভারতের আবিস্কার খুঁজছিলাম-যাদের ইম্প্যক্ট ফ্যাক্টর খুব বেশী গোটা বিশ্বে। সব খুঁজে পেতে মোটে দুটো জিনিস পেলাম- যেটা বলা যেতে পারে, প্রাচীন ভারতের অবদানে হাই ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর । কিন্ত এইসবের পরেও সামগ্রিক বিচারে দেখা যাবে ইজিপ্ট, চীন,  সুমেরিয়ান বা গ্রীস সভ্যতার অবদান সভ্যতার ইতিহাসে সামগ্রিক ভাবে অনেকটাই বেশী। এর একটা বড় কারন এই যে বৈদিক ধর্ম বস্তুবিমুখ ছিল। সেখানে চীনের দর্শন বস্তু বা সমাজমুখী। ফলে গানপাউডার, কম্পাস, পেপার, প্রিন্টিং, মেটালার্জিক্যাল ফার্নেস এর মতন প্রায় সব গুরুত্বপূর্ন  প্রযুক্তির জন্মস্থান প্রাচীন চীনে।

    সভ্যতার ইতিহাসে ভারতের সব থেকে বড় অবদান দশমিক পদ্ধতি। গোটে বিশ্বে যে দশমিক নাম্বার পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়-তা হিন্দু-আরবিক নিউমেরাল বলে পরিচিত। যদিও এটা ভারতের আবিস্কার এবং পরে পার্সি-আরবিক বণিকের মাধ্যমে, তা ইউরোপের আসে।

 গণিতে ভারতের বাকী অবদানগুলির স্ক্রুটিনি দরকার।

  যেমন শুন্যের আবিস্কার। প্রচলিত ধারনা এটি ভারতের আবিস্কার। যা সম্পূর্ন ভুল। মিশরে খৃপূঃ ১৭০০ সাল থেকেই শুন্যের ব্যবহার চালুছিল।  মেসোপটেমিয়া, রোমান, গ্রীস সব সভ্যতাতেই শুন্যের ব্যবহার ছিল।

  ভারতের অবদান এই যে শুন্যকে কাজে লাগিয়ে দশমিক পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং তার ব্যপক ব্যবহার। যদিও দশমিক পদ্ধতি ইজিপ্টেও জানা ছিল-কিন্ত ব্যবহার ছিল না।

  অনেকেই মনে করেন নেগেটিভ নাম্বার এবং বীজগণিতের ব্যবহার ও ভারতে প্রথম হয়। এই দাবীটি সর্বসম্মত নয়।
 
  দুশো খৃষ্ঠাব্দেই চীনে ঋনাত্মক নাম্বার এবং বীজগণিতের প্রাথমিক প্রয়োগ দেখা যায়। ভারতে আর্য্যভট্ট এবং মূলত ভাস্করাচার্য্যের কাজেই ঋণাত্মক নাম্বার এবং বীজগণিতের প্রয়োগ দেখা যায়। কিন্ত  তা চীনের কয়েক শতক পরে । 

  দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় গণিতবিদেরা মূলত "নিউমেরিক্যাল" নির্ভর ছিলেন। বীজগণিতে সিম্বলের ব্যবহার বা জ্যামিতিতে চিত্রের ব্যবহার এবং গ্রীস ইন্ডাক্টিভ বা ডিডাক্টিভ লজিক-এই তিনটে গুরুত্বপূর্ন জিনিসের ব্যবহার তারা জানতেন না। ফলে তাদের কাজ সেই অর্থে পরবর্তীকালে আর কোথাও প্রভাব ফেলে নি। 

 আরেকটা মিথ, ভাস্কারা-২ নিউটন বা লেইবিঞ্জের অনেক আগেই ক্যালকুলাস আবিস্কার করে ছিলেন। এর ভিত্তি হিসাবে তারা দেখান ভাস্করের কাজে  (১)  গ্রহগুলির ম্যাক্সিম্যাম অবস্থানে যে ডিফারেন্সিয়াল শুন্য হওয়ার ধারনা (২) ভ্রাম্যমান পথের ম্যাক্সিমাম অবস্থানে রেট অব চেঞ্জ শুন্য হওয়ার ধারনা -তার ট্রিটিজে পাওয়া যায়।

   সমস্যা হল, ক্যালকুলাসের ভাষা হয় জ্যামিতিক ( যা নিউটনের প্রিন্সিপিয়াতে আমরা দেখি) না হলে এলজেব্রিক। এর কোনটাই ভাস্করের জানা ছিল না-যেহেতু ভারতে এদুটি জনপ্রিয়তা লাভ করে নি। ফলে ক্যালকুলাস নিয়ে তার প্রাথমিক সিদ্ধান্তগুলি নিউটন বা লেইবিঞ্জের মতন গণিতের কোন শাখার জন্ম দিতে পারে নি।


   ভারতে গণিত প্রতিভা অবশ্যই ছিল-আর্য্যভট্ট, হলায়ুধ, ভাস্কর -এরা সম্পূর্ন স্বাধীন ভাবেই গণিতের উচ্চ গবেষনা করেছেন। কিন্ত তিনটি কারনে প্রাচীন  ভারতের গণিত গবেষনা- গণিতের  বা মানব সভ্যতার ইতিহাসকে প্রভাবিত করে নি 

    (১) ভারতের গণিত গবেষনা ছিল অন্যদেশের গণিতজ্ঞদের থেকে বিচ্ছিন্ন । আরবেরা যেমন গ্রীস, ভারত, চীন সব দেশের জ্ঞান সিঞ্চন করে, গণিত গবেষনাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন-ভারতের গণিতজ্ঞরা ছিলেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। ফলে প্রাচীন ভারতে জ্যামিতির প্রসার হয় নি যাতে গ্রীকেরা পারদর্শী ছিল। ফলে ভাস্করাচার্য্যের পক্ষে ক্যালকুলাসের প্রাথমিক সিদ্ধান্তগুলি আবিস্কার করা সত্ত্বেও নতুন গণিতিক শাখার জন্ম দেওয়া সম্ভব হয় নি
 
  (২) দ্বিতীয় সমস্যাটা হচ্ছে- গণিত চর্চায় ভারতীয়রা ডিডাক্টিভ বা ইনডাক্টিভ লজিকের ব্যবহার করত না। শুধু ইনটিউটিভলি সিদ্ধান্তগুলি লিখে রাখত। এর ফলে ভারতে গণিত চর্চা একটা ধাপের পরে আর এগোতে পারে নি। কিছু ভুল সিদ্ধান্তও পাওয়া যাবে । যেমন হলায়ুধ সিদ্ধান্তে এসেছিলেন ০/০ এর মান শুন্য হওয়া উচিত।

  (৩) তৃতীয় সমস্যাটা ঐতিহাসিক। ভারতের গণিত চর্চা ছিল বিশুদ্ধ-ফলিত কারনে না।  ইউরোপে বা আরবে জ্যোতিবিজ্ঞান চর্চার মূল কারন আরো ভালো নৌ নেভিগেশন সিস্টেমের জন্ম দেওয়া। ইজিপ্টে জ্যামিতির জন্ম- জমির ট্যাক্সেশন থেকে।  চীনে গণিতের চর্চা হয়েছে মূলত আরো ভাল যুদ্ধ স্ট্রাটেজির উদ্ভাবনের জন্য। আরবে গণিতের পেছনে মূল ড্রাইভার ছিল-উন্নত যুদ্ধাস্ত্র, নেভিগেশন সিস্টেম।  ইউরোপেও তাই।  ভারতে গণিত চর্চার একটা কারন যজ্ঞের কারনে বেদী, ইত্যাদির জ্যামিতিক মাপ নেওয়া। যা মোটেও কোন ড্রাইভিং বস্তুবাদি কারন ছিল না। ফলে ভারতের গণিত আরব বা ইউরোপের সাথে বেশী দিন পাল্লা দিতে পারে নি। কারন সব কিছুরই রাজকীয় অনুগ্রহ  দরকার হত।  যুদ্ধ বা রাজকার্য্যে ( ট্যাক্সেশন ) না লাগলে, সেই বিদ্যার চর্চা বেশী টানা সম্ভব ছিল না । 

  ভারতের দ্বিতীয় অবদান অবশ্যই দর্শন শাস্ত্রে। উপনিষদের দর্শন পার্শীদের হাতে অনুদিত হয়ে ইউরোপে আসে। সফোমেয়ারের হাত ধরে ইম্যানুয়েল কান্টের হাতে প্রথম ভারতীয় এবং ইউরোপিয়ান দর্শনের সিন্থেসিস হয়। যদিও পরবর্তী কালে নিৎসে বা আধুনিক ইউরোপিয়ান দর্শন মোটেও কান্টিয়ান না। কিন্ত তা সত্ত্বেও , ইম্যানুয়েল কান্ট এখনো ক্ল্যাসিকাল ওয়েস্টার্ন দর্শনের সব থেকে বড় স্তম্ভ। এবং তার দর্শনের অনেকটাই উপনিষদ প্রভাবিত।

 তবে প্রাচীন ভারতের বস্তুবাদি অবদান প্রায় শুন্য। সেই দিক দিয়ে চীনকেই বস্তবাদি সভ্যতার ভিত্তিভূমি বলা যায়।



Thursday, November 26, 2015

অতীত গৌরব

                                                           (১)
আগে যা ছিল চার দেওয়ালের মধ্যে, পর্দার আড়ালে, ফিস্ফাস, গুঞ্জন-এখন তা  সোশাল মিডিয়াতে প্রকাশ্যে আছড়ে উঠছে সুনামীর মতন।

  যারা বাঙাল-শৈশবের স্মৃতি নিশ্চয় ভোলেন নি। হয়ত স্মৃতি না-এখনো জীবন্ত সেসব আলোচনা। বিকেলে কোন মেসো বা জেঠু এসেছে বাড়িতে। চায়ের কাপে ঠোঁট ভিজতেই শুরু মুসলমানদের গালি দেওয়া। মুসলমানদের হাতে দেশ ছাড়া হওয়ার দুঃখ তারা কেউ ভোলেন নি। মুসলমান মানে কোন এক  দাড়িওয়ালা মূর্তিমান তলোয়ার হাতে হিন্দুদের ছাগলের মতন জবাই করছে-এমন এক বিভীষিকাময়  খন্ড ঐতিহাসিক উপন্যাস অশরীরির মতন ঘুরে বেড়ায় এই সব বাঙাল বৈঠকিতে।   অজান্তে, অজ্ঞানে, নিভৃতে  প্রায় প্রতিটা হিন্দু বাড়িতেই শিশুমনে রোপিত হয় ভবিষ্যতের চাড্ডি হওয়ার বীজ।

  তবে মুসলমানদের গালি দেওয়াটা বহুদিন সীমাবদ্ধ ছিল চার দেওয়ালের মধ্যে। বাজারে, স্কুলে, রাস্তায় ইনারাই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক-অনেকেই সিপিএম বা কংগ্রেসের কার্ড হোল্ডার। পাবলিক প্লেসে নিজেদের অসাম্প্রদায়িক প্রমান করার একটা "পিয়ার প্রেসার" কাজ করত।

   মোদির ক্ষমতায়নে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত বিজেপিকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেওয়াতে, অনেক ক্লোজেট হিন্দুত্ববাদিই খোল ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছেন। এখন একজন ডাক্তার, শিক্ষক বা ইঞ্জিনিয়ার প্রকাশ্যেই মুসলমানদের গালি দেওয়াটা "আউট অব প্লেস" বা অভদ্রতা বলে মনে করেন না।

 অবশ্য বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে মুসলমানরা এটা বহুদিন আগেই এচিভ করেছে। পাকিস্থানের টেক্সট বইতে হিন্দু বিরোধি, ভারত বিরোধি উপাখ্যানে সরকারি সিলমোহর আছে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতাতে সরকারি সীলমোহর হয়ত নেই-কিন্ত সেখানেও হিন্দুদের মালু বলে গালাগাল দেওয়াটা এখন আর অসভ্যতা না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের মনের কথা।

  সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দফারফা হচ্ছে কোন সন্দেহ নেই। কিন্ত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি আদৌ কোন কালে ছিল ভারতে? না কোন দেশে যেখানে মুসলমিরা ঐতিহাসিক ভাবে রাজত্ব করেছে?

  ভারতে বা বাংলায় কোন কালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল না। এগুলো ঐতিহাসিক গুজব। সিরাজের বিরুদ্ধে যখন ষড়যন্ত্র সংগঠিত হচ্ছে-মূল সংগঠক নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় হিন্দু রাজা বা এবং বণিকদের অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন। সেগুলো  দেখে নিতে পারেন। তাহলেই বুঝবেন মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রজাদের উষ্মা বহুদিন থেকেই ছিল। আবার বৃটিশ আমলে তীতুমীরের উপাখ্যানেই পরিস্কার হবে মুসলমান প্রজারা কতটা ঘৃণা করত হিন্দু জমিদারদের।  নোয়াখালির দাঙ্গা একদিনে হয় নি। এর সাম্প্রদায়িক পটভূমি প্রায় শত বছরের পুরাতন।

কোন শর্টকাটে এই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প যাওয়ার না। ধর্ম থাকবে-আমরা হিন্দু মুসলমান থাকবো- আবার এক অসাম্প্রদায়িক বাঙালী বা ভারতীয় সমাজ তৈরী হবে-এগুলো অবান্তর দুর্বল মনের চিন্তা।  ধর্ম থাকলে সাম্প্রদায়িকতা থাকবেই।  ইসলাম মানেই ত ইসলামে বিশ্বাসী এক সম্প্রদায় তৈরী করা। হিন্দু ধর্মে এই সেক্ট বা সম্প্রদায়ের ধারনাটা ছিল গুরুকূল ভিত্তিক। হিন্দুত্ব পার্টিগুলির সাফল্য এই যে উনারাও হিন্দু ধর্মকে ইসলাম-২ বানিয়ে হিন্দু সম্প্রদায় তৈরী কর‍তে সক্ষম হয়েছেন।  ইসলাম ভীতিই এর মূল কারন।

 সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে গেলে ধর্মকে কোনঠাসা করতেই হবে। আল্লা ভাল, মহম্মদ ভাল, কৃষ্ণনাম ভাল-সব ধর্মীয় গাঁজাখুরী ভাল- কিন্ত কিছু  মৌলবাদি মুসলিমের জন্য বা কিছু হিন্দুর জন্য দুর্নাম হচ্ছে- ধর্ম ভালো কিন্ত ধর্মের লোকগুলো খারাপ- এগুলো ভীষন দুর্বল যুক্তি। দুর্ভাগ্য এই যে ভারত বাংলাদেশে সোকল্ড সেকুল্যার পার্টিগুলোও এই মিথ, সম্পূর্ন অবাস্তব ভিত্তিহীন বাস্তবতাকেই প্রচার করে।

             সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু বা মুসলমান মনে করে তাদের ধর্ম ভাল। তাদের ধর্মেই সমাধান নিহিত আছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আধুনিক যুক্তিবাদি চিন্তাকে আশ্রয় করে নিজেদের জীবন এবং ভবিষ্যতকে পরিবর্তন করার চেষ্টা কজন বাঙালী বা ভারতীয়র মধ্যে আছে?

 হ্যা, নিজেদের ছেলেমেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সবাই পাঠাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এই  প্রযুক্তির ছাত্ররাই হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের আঁতুরঘর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মূল কারন ধর্মীয় মিথ, ধর্মের ইতিহাস থেকে নিজেকে উদ্ধার করার জন্য যে সার্বিক পড়াশোনা করার দরকার ছিল-সেই চেষ্টা প্রায় কারোর মধ্যেই নেই। আর কোন সরকারি ইতিহাসের বই সেটা চায় ও না। আজ ইন্টারনেটের যুগে অনেক কিছু জানার সুযোগ হচ্ছে বলে, হিন্দু বা মুসলমানদের ইতিহাস কত বিভৎস এবং কলঙ্কিত সেটা গোচরে আসছে। ইতিহাসটাও ইস্যু না। এই পরিবর্তিত সময়ে যেখানে কম্পিউটার এবং অটোমেশনের সামনে কারো চাকরিই সুরক্ষিত না-উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়া বর্ধিত জনসংখ্যাকে খাওয়ানোর কোন উপায় নেই-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া কেওই উন্নত জাতির জন্ম দিতে পারবে না-সেখানে ইসলাম এবং হিন্দু ধর্ম মহান, এদের অবাস্তব মিথগুলোকে বিশ্বাস করা জাতিগত ভাবে আত্মহত্যা ছাড়া কিছু না।  ধর্মে বিশ্বাস থাকলে সাম্প্রদায়িকতা থাকবেই। কেউ আটকাতে পারবে না। কিন্ত এই কথাটা বলার মতন রাজনৈতিক সাহস কারুর নেই। বামেদের ও নেই।


                                  (২)


চীনের শেষ রাজকূল কুইঙ্গ সাম্রাজ্য ( ১৬৪৪-১৯১১)।  সম্রাট কুইনলনের (১৭১১-১৭৯৯) আমলে চীন পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্য এবং অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়।  এই সময়  রপ্তানীতে চীন পৃথিবীর এক নম্বর দেশ ছিল। আমদানি কিছু করতে হত না। চীনারা নিজেদের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত।   চল্লিশ বছর বাদে, প্রথম আফিং যুদ্ধেই ধরা পরে চীনারা নিজেদের নিয়েই যতই গর্বিত বোধ করুক না কেন-আধুনিক ইউরোপিয়ান শক্তির কাছে তারা নস্যি। মাত্র কুড়ি হাজার বৃটিশ আর্মির কাছে হার মানে প্রায় দুলাখ সৈন্যের চাইনিজ এম্পিরিয়াল আর্মি।  সেই সময় মাত্র একটি  বৃটিশ স্টিম যুদ্ধহাহাজ -নেমেসিস প্রায় দেড়শো শক্তির চাইনিজ নৌবহরের মোকাবিলা করে! কারন নেমেসিসের বাস্প  শক্তির জন্য এটি অনেক ভারী কামান বহন করতে পারত-এর রেঞ্জ ছিল অনেক বেশী-এবং শ্রোত বা বাতাসের  বিরুদ্ধে এটিকে সেইল করা ছিল সহজ।  এর ফলে ১৮৪২ সালে চীনের সম্রাট অপমানজনক শর্তে ন্যানকিং চুক্তি করতে বাধ্য হোন।

 ন্যাংকিনের চুক্তি থেকে কুইং রাজবংশের পতন পর্যন্ত ( ১৯১১) চীন এক দীর্ঘ গভীর রক্তক্ষয়ী বিতর্কে নিমজ্জিত হয়। সেটা হচ্ছে পাশ্চাত্য শক্তির হাতে মার খাওয়ার পরে এটা নিশ্চিত ছিল যে সংস্কার দরকার। সরকার, মিলিটারী, আইন সর্বত্রই দরকার। কিন্ত তার অভিমূখ কি হবে? তারা প্রাচীন চৈনিক ঐতিহ্যকেই গ্রহন করবে বা পাশ্চাত্যকরন দরকার?

     সংস্কারের প্রথম দফাতে রাজ বংশ বুঝল আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র এবং প্রযুক্তি ছাড়া মিলিটারী টিকবে না। কিন্ত সরকার এবং শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক করতে গেলে রাজ বংশ কতৃত্ব হারাবে। ফলে আধুনিক প্রযুক্তিকে গ্রহণ করা হল-কিন্ত চাইনিজ আদিম রীতিনীতিকে আঁকড়ে ধরে থাকল।

 কিন্ত তাতে কি শেষ রক্ষা হয়?  ১৮৯৪-৯৫ সালের চীন-জাপান যুদ্ধে, চীনের ভরাডুবি হল। চীন বরাবর জাপানকে একটা পুঁচকে দেশ হিসাবেই ভাবত। তাদের হাতে গো হারা হেরে সম্রাট বুঝলেন আর সেদিন নেই।

 এবার সম্রাট গুয়াংগু দেখলেন ওই জার্মান ইঞ্জিনিয়ার হায়ার করে চীনা সেনাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে চীনা সাম্রাজ্য বাঁচানো যাবে না। দরকার আপাদ মস্তক আধুনিক রিফর্ম।

 এর ফলশ্রুতি ১৮৯৮ সালের ১১ই জুন উনি ১০০ দিনের রিফর্ম চালু করলেন।  যার মূল উদ্দেশ্য চীনকে আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা। এই সংস্কারের মধ্যে ছিল (১) স্কুল সিলেবাসে বিজ্ঞান, গণিত চালু করা ক্ল্যাসিকাল চাইনিজ টেক্সট বাদ দিয়ে -ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনিক্যাল স্কুল খুলতে হবে   (২) সম্রাট হবে বৃটেনের মতন কন্সটিউশনাল-গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন  (৩) মিলিটারী অর্গানাইজেশন হবে আধুনিক ইউরোপিয়ান স্টাইলে (৪) শিল্প স্থাপন, রেইল লাইন স্থাপনে জোর দেওয়া হবে  ৫) মার্কেট রিফর্ম করতে হবে-মার্কেটের ওপর থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রন কমাতে হবে।

  কিন্ত একশো দিনের সংস্কার সফল হয় নি।  সংস্কার করতেই দেওয়া হল না সম্রাটকে। বাধ সাধলেন রাজমাতা ডগার সিকি। যিনি ছিলেন সিংহাসনের পেছনে আসল শক্তি। তার হাতেই ছিল ইম্পিরিয়াল পাওয়ার। উনি প্রচার চালালেন গুয়াংগু পাশ্চাত্য শক্তির এজেন্ট।  ফল হল এই যে ১৯১১ সালে বেইজিং আক্রমনের সাথে সাথে ধ্বংস হল চীনের শেষ রাজবংশ।

  আমি এই ইতিহাসটা এই জন্যেই নিয়ে আসলাম-শুধু বোঝাবার জন্য সামাজিক এবং ঐতিহাসিক বিবর্তন বড়ই নির্মম। আমাদের আশেপাশটা বদলে যাচ্ছে বুঝতে না পারলে-এবং অতীতকে আঁকরে ধরে বসে থাকলে-  নিজেদের এবং জাতির ভবিষ্যতে দুর্দিন আসবেই। চীন বহুদিন ধরেই জ্ঞান প্রযুক্তিতে গোটে বিশ্বেই এগিয়ে ছিল-কিন্ত ওই অতীত থেকে নিজেদের বার করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে উনবিংশ শতাব্দিতে তারা সব কটা যুদ্ধে হেরেছে-বিংশ শতাব্দিতে জাপানের হাতে পদললিত হয়েছে। মহান গৌরবান্বিত চীনের অতীত তাদের বাঁচাতে পারে নি।

 চীন এটা বহু নির্যাতন এবং রক্তের বিনিময়ে বুঝেছে বলেই তারা বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে আজ এত বিনিয়োগ করছে এবং গোটা পৃথিবীতে আবার তারা শ্রেষ্ট স্থানের দাবিদার হিসাবে ফিরে এসেছে।

 ঠিক তেমন  ভারতের গৌরব ধরে বসে থাকলে, আর গণেশ মামার সার্জারীর গল্পকে বিজ্ঞান হিসাবে চালালে,  ভারতের অবস্থা হবে উনবিংশ শতাব্দির চীনের মতন। চীন যেখানে গবেষনা খাতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে, ভারতের হিন্দুত্ববাদি সরকার-তা কমিয়ে চলেছে!  অতীতের গৌরব প্রচার খাতে টাকা আছে-অথচ গবেষনা খাতে বরাদ্দ কমছে- গবেষকদের সংখ্যা কমানো হচ্ছে।

 অতীতের গৌরব ধরে বসে থেকে বর্তমানে ধ্বংস হয়েছে এমন উদাহরন বহু আছে।  আমেরিকাতে আমি হেনরি ফোর্ডের গল্প বলব।  ১৯০৮ সালে ফোর্ড মটোর কোম্পানী বাজারে আনে মডেল টি। মাত্র আটশো ডলারের গাড়ি সেই যুগে ছিল বৈপ্লবিক। নেক্সট দশ বছরে আমেরিকাতে গাড়ি বলতে বোঝাত মডেল টি- ১৭ মিলিয়ান বিক্রি হয়েছিল সেই মডেল টি। কিন্ত ১৯২০ সাল পেরোতেই মডেল টির বিক্রি কমতে থাকে। বাজারে আসে জেনারেল মটোরস।

 হেনরি ফোর্ডের ছেলে ইজেল ফোর্ড বাবাকে বার বার বোঝাতে থাকেন, বাজারে নতুন মডেল আনতে হবে। ফোর্ড দাবী করতে থাকেন, আসলে তার ছেলে ফোর্ড মটোরসের অতীতকে ফেরাতে পারছেন না। যাইহোক ১৯২৭ সালে যখন জেনারেল মটোরস ফোর্ডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে-তখন একরকম বাধ্য হয়ে হেনরি ফোর্ড নতুন মডেল চালু করেন। তদ্দিনে ফোর্ড মটোরস তিন নাম্বারে নেমে গেছে । ফোর্ড মটোরসের বাকী দিনগুলিতেও হেনরি ফোর্ড প্রলাপ বকতেন-যে নাম্বার ওয়ান পজিশনে ফিরতে তাদের অতীতের গৌরবোজ্জল দিনগুলিতে ফিরতে হবে! গবেষনা, ডেভেলেপমেন্টের দরকার নেই! ইনফ্যাক্ট আজকের বিজেপির জাতীয়তাবাদ দেখে আমার হেনরী ফোর্ডের ইতিহাস খুব মনে দাগ কাটে!

 শুধু কি প্রাইভেট কোম্পানী বা রাজবংশ? সিপিএমের দিকে তাকান। মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি করার কোন বাস্তবতা আজ আর নেই- এই নিঠুর বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই নিয়েই কিন্ত ল্যাটিন আমেরিকাতে নব্য বামেরা লেনিনকে ছুঁড়ে ফেলে কোয়াপরেটিভ এবং গণতন্ত্রের মাধ্যমে নতুন জনশক্তি গড়েছেন। এতে ল্যাটিন আমেরিকাতে বাম শক্তি আজও প্রাসঙ্গিক। কিন্ত ভারতে প্রকাশ কারাতের অবস্থা চীনের রাজমাতা ডাওগার জি বা হেনরি ফোর্ডের মতন। পার্টি দেওলিয়া, বেস হারাচ্ছে-আর যত হারছে তত সেই অতীতকে আঁকরে ধরে টিকে থাকতে চাইছে।

 যার হিন্দু বা মুসলমান হয়ে থাকতে চাইছেন-তারাও সেই অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকা পাবলিক। যারা প্রযুক্তির ফলে উদ্ভুত পরিবর্তনকে মানতে চাইছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। ফলে সর্বোনাশটা তাদের ব্যক্তি জীবনেই শুধু আসবে না-জাতীয় জীবনেও আসবে।

   











Sunday, November 22, 2015

গণতন্ত্রের হত্যা

সিপিএমের প্রাত্তন বিধায়ক ধীরেন লেটের ওপর যে অত্যাচার করা হল-যেভাবে তাকে হিউমিলিয়েট করা হল- একজন সাধারন মানুষ হিসাবে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। সিপিএম গণতন্ত্রকে খুন করেছিল, ধীরেন বাবু একজন হামার্দ-কোন যুক্তিই যথেষ্ট হতে পারে না, তাকে পিটিয়ে কান ধরে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ।  এই ভাবে একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধকে হেনস্থা করা -বা করার মতন সাহসের উৎস কি? অবশ্যই তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। যারা এই ঘটনার পরেও বলছেন সিপিএম দোষী-তারাই গোলমাল পাকাতে চেয়েছিল!!


         তিনো নেতৃবৃন্দরা  কি ভুলে যাচ্ছেন যখন  ক্ষমতা থাকবে না, তাদের কেউ প্রকাশ্যে কান ধরে প্রায়শ্চিত করালে একটা কাক ও কাঁদবে না আলিন্দে? ভুলে যাচ্ছেন যে ক্ষমতা হারাবার পরেও তাদের পশ্চিম বঙ্গে থাকতে হবে?   সিপিএম  দোষী হলে,  পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করুক। নিজেদের দলের লেঠেল পাঠিয়ে হিউমিলিয়েট করার অধিকার কোন আইন বা কোন গণতন্ত্র দেয়? এত চেঙ্গিস খানের জমানা চলে এল। যেসব চৈনিক অধিপতিরা চেঙ্গিস খানের বশ্যতা স্বীকার না করে মোঙ্গল আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেত, তাদের হারানোর পরে চেঙ্গিস খান সেইসব রাজা এবং রাণীদের নগ্ন করে তাদের প্রজাদের মধ্যেই ঘোরাতেন। হিউমিলিয়েট করার মধ্যযুগীয় আনন্দ।  আনন্দবাজারে ধীরেন লেটের জবাবনন্দীতে এটাই পরিস্কার তিনোগুন্ডারা তাই করতে চেয়েছিল। উনি কান ধরে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন।

  আমি পশ্চিম বঙ্গে গণতন্ত্রের হত্যা নিয়ে আগে অনেক লেখা লিখেছি। এটাও পরিস্কার যে এর পেছনে মূল কারন ১৯৭৮ সালে জনতা সরকারের গড়া ন্যাশানাল পুলিশ কমিশনের সুপারিশ  কার্যকর করতে জ্যোতিবসুর ব্যর্থতা। উনারা ভাবেছিলেন, সারা জীবন রাজত্ব চলবে। একবারো ভাবেন নি, যদি পুলিশ নিরেপেক্ষ না থাকে, উনারা ক্ষমতা হারালে কি হবে। কিছুদিন আগে বিরোধি নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর বিরুদ্ধেও হাত উঠেছে। এত ক্ষমতা গুন্ডারা পায় কি করে যেখানে মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন একজন বিরোধি নেতার জীবন ও সুরক্ষিত না? কারন অবশ্যই যে পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। যা অবশ্যই পার্টি নিরেপেক্ষ কোন সংস্থার হাতে থাকা উচিত। ইন্দ্রজিত গুপ্ত ন্যাশানাল পুলিশ কমিশনের রিপোর্ট মেনে-তাই চেয়েছিলেন। জ্যোতিবাবু পাত্তা দেন নি । ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে। জ্যোতিবাবুকেও তা অন্ধ করেছিল। আজ যেমন ক্ষমতার মাদকতায় অন্ধের মতন আচরন করছে তৃণমূলের নেতৃত্ববৃন্দ।

 হয়ত ধীরেন লেটের জন্য আজ  বঙ্গের একটা চড়ুই পাখিও দুঃখ পাবে না। হয়ত এর জন্যে সিপিএমের জমানার গণতন্ত্র খুন করার সংস্কৃতিই দায়ী। কিন্ত এত কিছু হয়তর পরেও যে সমাজ একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধ রাজনৈতিক নেতার চরম হেনস্থার বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে ব্যর্থ হবে, কালকে তাদের ঘরের মেয়েকে যখন গুন্ডারা বিবস্থ করবে প্রকাশ্য রাজপথে, তাদের পাশেও কেউ থাকবে না।  জনগন যদি পার্টি, রাজনৈতিক রঙের উর্ধে উঠে এই ঘটনার প্রতিবাদ না করে, তার ফল ভুগবে তারা নিজেরা।


   সিপিএমের বিরুদ্ধেই আমি লিখে চলেছি আজ এক দশক। তাদের হার্মাদ সমর্থকরা আমাকে সব থেকে জঘন্য ভাষায় খিস্তি মেরেছে । আমি এটাও নিশ্চিত যে তারাও গণতান্ত্রিক বিতর্কে না এসে  খিস্তি খাস্থা আর হিউমিলিয়েশনেই বিশ্বাস রাখে বেশী। কিন্ত আমি একবারো বলবো না, ধীরেন লেটের পার্টি নিজেদের পাপের ফল নিজেরা ভোগ করুক। কারন এই লুম্পেনগিরি আর পুলিশের পার্টির লেজুর হওয়া থামাতে না পারলে, পশ্চিম বঙ্গে গুন্ডারাজ আর স্বৈরতন্ত্র চলতেই থাকবে। যার থেকে রাজ্যকে মুক্ত করা দরকার। এর জন্যে সবার আগে দরকার নাগরিক সমাজের কন্ঠশ্বর। তাদের প্রমিনেন্ট মুখরা ত আবার টাকা আর পদ ছাড়া নাগরিক দ্বায়িত্ব পালন করেন না।

Saturday, November 14, 2015

সন্ত্রাসবাদের সাথে ইসলাম বা মুসলমানদের সম্পর্ক কি ?

সন্ত্রাসবাদের সাথে ইসলাম বা মুসলমানদের সম্পর্ক কি ?

          ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের ঘটনা ঘটলেই সোশ্যাল মিডিয়া এই ডিবেটে মজে । কিছু মুসলিম, বামেরা মিলে প্রাণপনে প্রমানের চেষ্টা করে-এর সাথে ইসলামের বা মুসলমানদের সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে ইসলাম বিরোধিরা জল খেয়ে ঘাটে নামে কোরানের আয়াত ধরে-ইসলাম আর মুসলমান মাত্রই পচা ডিম।  আর এই ডিবেটের ধোঁয়াশায় হারিয়ে যায় সন্ত্রাসবাদের আসল কারনগুলো।

  প্রথমত কারুর কি কোন সন্দেহ আছে যে আল্লাহু আকবর বলে যারা প্রেক্ষাগৃহে ১৫০ জনকে মারল, নিজেরাও আত্মঘাতি হল, তারা ইসলামিক আইডিওলজিতে উদবুদ্ধ না?

এখন প্রশ্ন উঠবে কোরান হিংসা স্যাংশন করে কি না! কোরানের সঠিক ব্যাখ্যা কি!!

  এগুলো বোকা বোকা প্রশ্ন। কারন প্রথমত ধর্মের বই গুলো-যাকে আমরা ধর্মগ্রন্থ বলি-সেগুলো বহুদিন আগে খুব দুর্বল দুর্বোধ্য বাক্যে লেখা-যার একাধিক মানে হয়। কোরান যখন লেখা হয়- আরব ভাষাটা তখন ও ঠিক ঠাক ভাবে তৈরী হয় নি। আরবের লিপিও ছিল না। সিরামিক লিপিতে আরবের লোকেরা ব্যবসা করত।

         লিঙ্গুইস্টিকে একে বলে উইক টেক্সট। যেমন বিজ্ঞানের পেপার লেখার সময় ল্যাঙ্গুয়েজ এমন হওয়া দরকার, যাতে একটাই মানে হয়। তাই বিজ্ঞানের টেকনিক্যাল টেক্সট হচ্ছে স্ট্রং টেক্সট। কিন্ত ধর্মের ক্ষেত্রে তা হয় না।  বাইবেল বা গীতা কোরানের থেকে আরো কঠিন ভাষাতে হিংসাকে অনুপ্রেনিত করে। এবং যার জন্য মধ্যযুগে আমরা ক্রুসেডের দেখা পায়।  সুতরাং কোরান সুন্নতে হিংসা আছে, তাই মুসলমানরা হিংস্র এগুলো অতিসরলিকরন।

 এই জন্যেই সঠিক ধর্ম, বেঠিক ধর্ম বলে কিছু নেই। ১৮০ কোটি মুসলমানের প্রত্যেকের নিজস্ব ইসলাম ধর্ম আছে। কোন ধর্মই মনোলিথিক না। ওসামা বিন লাদেন ও মুসলমান, আগাখানের মতন দানবীর ও মুসলমান। কে ঠিক মুসলমান, কে ভুল-এই বিতর্কগুলো অর্থহীন। কারন সব ধর্মেই ভাল খারাপ, উগ্রপন্থী আছে।  এবং সেই উগ্রপন্থীগুলো খুব পরিস্কার ভাবেই সেই ধর্মেরই সদস্য।  সুতরাং খুব পরিস্কার ভাবেই আগা খানের ইসলাম ও ইসলাম, ওসামার বিধর্মী মারার ইসলাম ও ইসলাম।

   সমস্যা এই যে ইসলামিক উগ্রপন্থীদের পলিটিকাল স্পনসর আছে, যারা টাকা বন্দুক দেয়। খালিস্তান ত এই ভাবেই তৈরী হয়েছিল। ইসলামিক উগ্রপন্থীরা আরব, আমেরিকা সহ অনেকের কাছ থেকেই টাকা পেয়েছে।  যেকোন ধর্মের উগ্রপন্থীদের পেছনে টাকা আর অস্ত্র দিলেই সন্ত্রাসবাদি তৈরী হবে-এই ইতিহাস পৃথিবী বহুবার দেখেছে।

 মুশকিল হচ্ছে তাতে মুসলমানদের দোষ কি? তারা ত এসব পছন্দ করে না।  সমস্যাটা এখানেই । আমিও ত আমেরিকার বিদেশ নীতি পছন্দ করি না। কিন্ত সেই নীতির পাপের কোন হিস্যাই কি আমার নেই?  অবশ্যই আছে। আমি এখানে টাকা কামাতে এসেছি-ফলে আমেরিকান রাজনীতিতে শান্তিবাদিদের আন্দোলনে খুব কমই গেছি। অধিকাংশ মুসলমানদের ও এক অবস্থা। তারাও দিন আনে দিন খাই পাবলিক । তারপরে একঘরে হবার ভয়ে নিজের ধর্মকে দোষ দেওয়া থেকে দূরে থাকে। আবার ধর্মভীরুও বটে। ফলে ইসলাম উগ্রপন্থীদের হাতে ছিনতাই হয়েই গেছে।


এখন সঠিক আর বেঠিক ইসলামে গল্প শোনালে কেউ শুনবে?


   আরো পরিস্কার ভাবে বললে-ইসলাম হচ্ছে এবং ছিল আরব সম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক রূপ। খ্রীষ্ঠান ধর্ম যেমন রোমান সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনে বড় হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের সৈনিক পাওয়ার জন্য,  ওমন মরাল সুপিরিয়ার মিথের দরকার হয়।  যেমন এখন আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের মরাল মিথ- গনতন্ত্র এবং স্বাধীনতা। আসলে কিন্ত ব্যপারটা তলায় তলায় সব-এক। জমি আর সম্পতি দখলের খেলা।  সেটাকে সিদ্ধ করার জন্য বড় বড় মরাল জাস্টিফিকেশন দিতে ইসলাম, খ্রীষ্টান ধর্ম এবং বর্তমানে " গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার" মরাল সার্কাস। এবং এই সব মরাল সার্কাসে বিশ্বাসী অনেক সৈনিক এবং তাদের স্পনসর ও আছে। যারা এইসব সন্ত্রাসবাদের ঘটনা থেকে প্রচুর লাভ করে।

  মোদ্দা কথা এখানে কতগুলি সাম্রাজ্যবাদি শক্তি খেলছে। সাধারন মানুষ মুর্গী হচ্ছে। এটাই মরাল স্টোরী। বা সামারী।

Wednesday, November 11, 2015

সেকালের দীপাবলি

সে ছিল আরেক দীপাবলি।  নদী থেকে এঁটেল মাটি তুলে দুদিন আগেই বানাতাম চোদ্দটা মাটির প্রদীপ। রোদে শুকাতো দুদিন। মা শর্ষের তেল দিয়ে পলতে ভিজিয়ে দিত। সন্ধ্যে নামতেই তুলসীতলায় চোদ্দটা প্রদীপ জ্বালাতাম পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্য।

  সাথে থাকত এক প্যাকেট সরু সরু মোমবাতি। দোতালার বারান্দায় সেগুলোর কিছু জ্বালিয়ে, বাকীগুলো বরাদ্দ ছিল নারকেলের খোলে টর্চ তৈরীর খেলায়।

  অমবশ্যা আর লোডশেডিং মিলে  গ্রাম বাংলা ডুবে থাকত নিকষ অন্ধকারে। ওই একটা দিনে অন্ধকারটাই ছিল মজার। অন্ধকার না জমলে, জমত না আমাদের নারকেলের খোলে বানানো টর্চের খেলা।

  বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে শ্বশান। শহর থেকে শ্বশানের রাস্তাও আমাদের বাড়ির ওপর দিয়েই যেত।  সেখানেই হত সব থেকে "জাগ্রত" কালীর পূজো!  তখনো কালীপূজো এত বারোয়ারী হয় নি করিমপুরে। কিছু তান্ত্রিক এবং শাক্ত ফ্যামিলিতেই পূজো হত।  বাড়ির পূজোত কি? গ্রামের দিকে অত নিমন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। সবাই যেত বাড়ি পূজো গুলোতেও।

 শ্বশানকালীর পূজোতে যাওয়ার মধ্যে একটা বেশ ভৌতিক ছমছমে ব্যপার ছিল। তখন করিমপুরের শ্বশানের দিকটাতে বাড়ির থেকে জঙ্গল বেশী।  মাটির রাস্তা, জঙ্গল, শিয়ালের ডাক-ঘুটঘুটে অন্ধকার পেরিয়ে দর্শন হত শ্বশান কালীর!  ছাগল বলি হত তখন। তাই দেখতে হাজার হাজার মানুষের ভীর।  আমরা কয়েকটা বখাটে ছেলে মিলে শ্বশানের ধারে নারকেলের খোলের টর্চ নিয়ে ঘুর ঘুর করতাম-যদি ভূতের দর্শন পাই।  মনে ভয়-কিন্ত ওপরে বাতচিত-ধ্যুস ভুত আছে নাকি?

সবকিছুই ত বদলে যায়। দিন, কাল, স্থান। সেই অন্ধকার, জঙ্গল, শিয়াল, তান্ত্রিক, ছাগবলি-মাটির প্রদীপ হয়ত আর নেই। নগরায়ানের, কেবল টিভির দৌলতে ছেলেবেলা, শহরবেলা, গ্রামবেলা-সব হমোজেনাস, একমাত্রিক রসায়ন।  স্মৃতিতেই বেঁচে থাক সেই পুরানো দিনের গ্রামের দীপাবলি।

Tuesday, November 10, 2015

কালী নগ্ন কেন?

হিন্দুদের সব দেবীদের পড়নেই বেশ ভালো ভালো শাড়ি , শুধু কালীকেই কেন টপলেস করা হল-এটা নিয়ে কিছু খোঁজাখুজি করছিলাম। ইন্টারনেট ঘাঁটলে প্রচুর আধ্যাত্মিক গ্যাস বেড়োবে-যথা কালী হচ্ছে রিয়ালিটির প্রতীক-অসীম-তাই তাকে "সসীম" কাপড় পড়ানো যায় না। বা তার উন্মুক্ত স্তন  প্রতীকি-তিনিই যে জনগণকে খাইয়ে দাইয়ে টিকিয়ে রেখেছেন তার প্রতীক। মানে আমরা  সবাই তার ওই ব্রেস্ট ফি্ডেড সন্তান আর কি !

    কিন্ত এগুলো সব মনগড়া গ্যাস। যেকোন দেবীর পোষাকই সমকালে, মেয়েরা যেসব পোষাকে অভ্যস্ত, সেগুলোই।

  কালি বৈদিক দেবী নন। কেউ কেউ বলেন অথর্ব বেদে তার উল্লেখ আছে-কিন্ত সেই কালিকা, আর কালিকাপূরাণের কালী এক নন।

 কালী আসলেই অন্যার্য্যপূজিত দেবতা। এবং আর্য্যদের আগমনের আগে ভারতে অনার্য্য জাতিগোষ্টির মধ্যে মেয়েরা উর্ধাঙ্গ ঢেকে রাখত না। এখনো আদিবাসিদের মধ্যে অনেক উপজাতিতেই মেয়েরা স্তন ঢেকে রাখে না।

এর সব থেকে বড় উদাহরন মহাভারতে।  একে একে পাশায় হেরে পঞ্ছ পান্ডব সবাই দাস হয়েছেন। দুঃশাসন তাদের উত্তরীয় খুলতে বলছেন। কারন দাশেরা ( যারা অন্যার্য্য ছিল) তারা উর্ধাঙ্গ নিবারন করত না। শুধু গোল বাধল যখন দ্রোপদীকে পনে রেখে হেরে গেলেন যুধিষ্ঠীর। দাসীদের ও সেকালে উর্ধাঙ্গ নিরাভরনই থাকত। ফলে দুঃশাসন দাবী করে বসলেন, দ্রোপদীকে তার স্তনযুগলের ওপর কাপড় সরাতে-হবে। কারন দাসীদের স্তনযুগল নিরাভরন থাকত সেই যুগে। এবং সেখান থেকেই বস্ত্র হরণের শুরু।


সুতরাং আদি অনার্য্যদের দেবীরা টপলেসই ছিলেন। শুধু কালিকা নন-আদিম অন্যার্য্য জাতি গোষ্ঠির দেবীদের যত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় সেখানে দেবীরা টপলেস।

  ফেমিনিস্ট টপলেস মুভমেন্টের দৌলতে , ইউরোপের অনেক দেশেই এখন পাবলিক প্লেসে মেয়েদের টপলেস থাকা স্বীকৃত। আশা করা যায়, ভারতেও মেয়েদের টপলেস থাকা স্বীকৃত হবে একশো বছরের মধ্যে। দুর্ভাগ্য এই যে আর্য্যদের আগমনের আগে, মেয়েদের টপলেস থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। তখন কালী টপলেস কেন-এই প্রশ্ন আর উঠবে না।

 আজ থেকে একশো বছর বাদে দ্বাবিংশ শতাব্দিতে, মেয়েদের খোলা মেলা পোষাকটাই যখন হবে নর্ম ( ট্রপিক্যাল দেশে এমনই হওয়া উচিত। আর্য্যরা ঠান্ডার দেশ থেকে এসেছিল বলে ওদের মেয়েদের উর্ধাঙ্গ ঢাকা থাকত। ভারতের গরম আদ্র আবাহাওয়াতে, গরমের সময় স্তন ঠেকে রাখা খুব স্তস্থিকর না। আর সেই জন্য অনার্য্য নারীদের মধ্যে স্তনবন্ধনীর চল ছিল ও না।), তদ্দিনে যদি হিন্দু ধর্ম টিকে থাকে, তাহলে তাদের গায়েও খোলামেলা পোষাকই উঠবে! স্লীভলেস, লোকাট ব্লাউজত এখনই দেবীদের গায়ে উঠে গেছে। আগামীদিনে ভারতীয়রা বিকিনিতে অভ্যস্ত হলে, বিকিনি পরিহিত লক্ষীও সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

Sunday, November 8, 2015

রাজনৈতিক স্ববিরোধিতা

কিছু কিছু রাজনৈতিক ধোঁয়াশার উত্তর আমার জানা নেই। 

  যেমন ধরুন ভারত এবং আমেরিকা-এই দুই দেশের রাজনীতিতেই ধর্ম এবং মার্কেটপন্থীদের জোটবন্ধন। অথবা কমি/বাম দের সাথে লিব্যারালদের জোট। দুই সম্পূর্ন ভিন্নধর্মী রাজনীতি হয়েও তেলে জলে কি করে মেশে জানা নেই। যদি আমার পাঠকরা কিছু লাইট ফেলেন।

  প্রথমে আসি ধর্ম এবং মার্কেটপন্থীদের জোটবন্ধন। আমেরিকাতে রিপাবলিকান এবং ভারতে বিজেপি-দুই পার্টির বেস-ধর্মীয় রক্ষনশীল এবং মার্কেটপন্থী লিব্যারাল। মুশকিল হচ্ছে এই দুটি বিপরীতমুখী রাজনীতি। মার্কেটের মুলে চাহিদা এবং লোভ। ধর্মের মূল ওই দুটো কমানো।  সব সময় যে তেলে জলে মেশে তাও না। রিপাবলিকান পার্টিতে মার্কেটপন্থীদের সাথে ধর্মপন্থীদের ফাটাফাটী সবসময় হচ্ছে। এখন প্রেসিডেন্সিয়াল রেসে বেন কার্সন বনাম ডোনাল্ড ট্রাম্পের কেসটা ওই ধর্মপন্থী বনাম মার্কেটপন্থীদের লড়াই।  কার্সন সব কিছু ঈশ্বর প্রেরিত, ঈশ্বরের কল্যানে নিয়োজিত-ইত্যাদি প্রচার করে চলেছেন। মাইরী, না দেখলে বিশ্বাস হত না-আমেরকাতে জিওপির ফোর রানার ক্যান্ডিডেট ঈশ্বেরের নামে ভোট চাইছেন। তার কোন অর্থনৈতিক এজেন্ডা নেই! দেশটাকে আবার খ্রীষ্ঠান নেশন বানাবেন যেমন বিজেপি ভারতকে হিন্দু নেশন বানাতে চায়।  এই নিউরোসার্জেনটি সত্যই এক বিনয়ী, সৎ লোক। ফলে বাজারে কাটছে তার ঈশ্বরভক্তি!  বিজেপির অন্দরেও আর এস এস বনাম উদারপন্থীদের লড়াই চলছে।  মুশকিল হচ্ছে-এই তেলেজলে মিশে এরা কেন বাম লিব্যারালদের বিরোধিতা করছেন?

 বাম লিব্যারালদের মধ্যে অবশ্য কালেক্টিভিজম বনাম লিব্যারিলিজমের  এই ভার্টিক্যাল স্পিল্ট  শুধু মাত্র গে রাইট ইত্যাদি ইস্যুতেই প্রকট হয়। ভারতে যেমন গে ইস্যুতে সুসি সহ অনেক কমিনিউস্ট পার্টি ছিল বিরুদ্ধে-কারন তারা মনে করে ওটা লিব্যারিলজমের ইস্যু-যা মার্কেটপন্থী। গে ইস্যুতে ভারতে বামেদের মধ্যে এই প্রভেদ খুব দৃষ্টিকটূ ভাবে দৃশ্যমান ছিল।

আমেরিকাতে কালেক্টিভিস্ট বামেরা ক্ষমতার থেকে অনেক দূরে থাকায়, এগুলো ইস্যু হয় নি। তবে "ইসলামের" মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আমেরিকান বামেদের মধ্যেও এই ভার্টিক্যাল স্প্লিটটা দেখি। লিব্যারাল বামেরা ইসলামের মূল্যায়নে অনেক হার্শ-কর্কশ। কারন ইসলাম গে রাইট সহ অনেক হিউম্যান রাইট বিরোধি। অন্যদিকে কালেক্টিভিস্ট বামেরা ইসালামের ক্ষেত্রে অনেক নরম। কারন তারা মনে করে ইসলামের কালেক্টিভিজম প্রি-ক্লাস স্ট্রাগলের ফসল। তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে দুই তরফের বামেরাই কালেক্টিভিস্ট। মানে অধিক হারে ট্যাক্স চাপিয়ে স্যোশাল বেনিফিট বাড়ানোর তত্ত্বে বিশ্বাসী।

এবার মোদির কথায় আসি। উনার দুটো বেস।  একটা হিন্দুত্ব ছাড়া কিছু বোঝে না। অন্যটা মার্কেটপন্থী, অর্থনৈতিক ব্যবসা বাড়ানোর জন্য তাকে সাপোর্ট করে।  এই দুই বিপরীত মুখী শক্তিকে নিয়ে কি আদৌ চলা সম্ভব?  অর্থনৈতিক বেসটা চাইবে, কম্যুনাল হার্মোনি। যেমন নায়ারানমূর্তি। ভোটের আগে এবং পরে উনি মোদিকেই সমর্থন করছিলেন। কিন্ত হিন্দুত্বের কুৎসিত মুখ বেড়োতে উনিও মোদিকে সমালোচনা করছেন। বলা যায় বাধ্য হচ্ছেন। কারন এইসব ঘটনায় বিশ্বের কাছে ভুল সংকেত যাচ্ছে। ব্রান্ড ইন্ডিয়ার ভ্যালু পড়ছে। ফলে ইনফির ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। এই তেলে জলে মেশানো একদম অসম্ভব। দিল্লীতে গোপন সূত্রে খবর, মোদি এই দুই গোষ্ঠীর দিক থেকেই চাপে থাকেন বলে-উনি ইদানিং ভারতের বাইরে থাকতেই পছন্দ করছেন বেশী। মানে পাতি পালাচ্ছেন আর কি। 

Sunday, November 1, 2015

কমিনিউস্ট ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিরতে এস্টোনিয়া কি রোল মডেল হতে পারে

টাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট, আনন্দবাজারের রিপোর্টে কোলকাতায় বৃদ্ধের সংখ্যা বাড়ছে, তরুন ছেলে মেয়েদের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমছে। ফার্টালিটি রেট নেগেটিভ-মানে পপুলেশন সাসটেইন করার ক্ষমতা নেই। সব থেকে উদ্বেগের কথা কোলকাতায় দম্পতিরা সন্তান নিতে চাইছেন না। না এটা চাইল্ডলেস বাই চয়েস লিবারলিজম না। এর কারন কোলকাতায় ওয়েল পেইং জব খুব কম। ফলে ফ্যাইনান্সিয়াল কারনেই এখানে কাপলরা সন্তান নিচ্ছেন না। আর যারা সক্ষম কর্মক্ষম তাদের বৃহত্তর অংশ অনেক আগেই কোলকাতা ছেড়েছে।

 গোটা শহরটাই এখন কাকু মাসীদের। এদের দেখার জন্য যুবক সম্প্রদায় প্রায় নেই।

 ৩৪ বছরের বামপন্থা বা ভ্রান্ত ভামপ্যান্টিদের ভোট দেওয়ার কুফল বইতেই হত। পাপের ফল কোন না কোনদিন ত ফলতই!

  কমিউনিজম যেখানেই যায়, সেই জাতিকে ধ্বংস করে। অতীতে ধ্বংস হয়েছে রাশিয়ান, রুমানিয়ান, হাঙ্গেরিয়ান, ইউক্রেনিয়ানরা।  ধ্বংস হয়েছে সমৃদ্ধশালী রাশিয়ান সাহিত্য।  এখন ধ্বংসের পথে বাঙালীরা, বিশেষত বাঙালী হিন্দুরা।  তবে আশার আলোও আছে। ইস্ট ইউরোপিয়ানরা খুব দ্রুতই আই টি এবং আধুনিক শিল্পের ওপর ভিত্তি করে, মার্কেটে ইকোনমির উইং এ ভর করে ফিরে এসেছে।  কমিনিউস্টদের হাতে ধ্বংস হওয়ার পরে ইস্টোনিয়া এখন আই টি হাব-স্কাইপ , কাজার জন্মস্থান। ওদের পার ক্যাপিটা জিডিপি এখন আটাশ হাজার ডলারের কাছাকাছি। যা উন্নত বিশ্বের কাছাকাছি। ২০২২ সালের মধ্যে এস্টোনিয়ার পার ক্যাপিটা জিডিপি জার্মানি, ইউকের সমান হবে। ফ্রান্স, ইটালিকে ছাড়িয়ে যাবে।

 এস্টোনিয়ার উদাহরন নিলাম এইজন্যে -যে এস্টোনিয়া বাঙালীদের কাছে রোল মডেল হতে পারে। ১৯৪০ সালে স্টালিন স্বাধীন  এস্তোনিয়া দখল করেন। এস্তোনিয়ার বুদ্ধিজীবি বিজ্ঞানী প্রযুক্তিবিদ-এদের অধিকাংশই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় বাল্টিক দেশগুলিতে। সমৃদ্ধশালী দেশ এস্তোনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়ানের আরেকটা ব্যর্থ পরাধীন প্রদেশ হয়ে কাটিয়েছে পঞ্চাশ বছর । কিন্ত ১৯৮৯ সালে কমিউনিজমের পতন হতেই প্রবাসী এস্তোনিয়ানরা দেশে ফিরতে শুরু করেন এবং সেখানে উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প স্থাপনে মন দেন। এই ভাবেই সেখানে জন্ম হয়ছে কাজা, স্কাইপের মতন কোম্পানী। বর্তমানে এই উদ্ভাবনী শিল্পের ওপর ভিত্তি করেই দ্রুত এগোচ্ছে ইস্টোনিয়া।

 বাঙালীদের ও এক হাল। কমিনিউসস্টদের ৩৪ বছরের রাজত্বে রাজ্য ছেড়েছে সমস্ত সক্ষম বাঙালীরা।  বলা যায় বাধ্য হয়েছে।  রাজ্যটাকে বামপন্থার ভাইরাসশুন্য করতে পারলে, শিল্পের পরিস্থিতি ফেরালে অনেক বাঙালীই ফিরতে পারে-রাজ্যে উদ্ভাবনী শিল্প স্থাপন করতে পারে।  কমিনিউস্ট ধ্বংসস্তুপ থেকে রাজ্যকে উদ্ধার করতে এস্টোনিয়া একটা মডেল হতে পারে। তবে তার জন্য দরকার এস্টোনিয়ার মতন প্রশাসন-যেখানে নাগরিক সুবিধা সব অক্ষুন্ন রেখেও মার্কেট ইকনোমিকে সব থেকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়।  যারা দেশে ফিরে শিল্প গড়তে চাইছে সরকার তাদের সব ধরনের সুবিধা দেয়। ইনফ্যাক্ট এস্তোনিয়া স্টার্ট আপের জন্য এখন আমেরিকার থেকেও বেশী সুবিধা দিচ্ছে।

সেই জন্য যখনই কোন বামপন্থীকে হেজাতে দেখবেন- তাদের মনে করিয়ে দেবেন, তারা  আসলেই মূর্খ কালিদাস। যে ডালে বসে আছি, সেই ডাল কেটে উন্নয়ন হয় না।

Saturday, October 31, 2015

ধর্মের বিরুদ্ধে মার্কেটই আশা, মার্কেটই নিরাশা

আলটিমেটলি রাজনীতিটা ক্ষমতা দখলের খেলা। আবাহমান কাল থেকেই খুন, উৎকোচ, ধর্ষন, ঘরবাড়ি ফসল জ্বালিয়ে দেওয়া-এসব কিছুই করতে হয়েছে ক্ষমতা টেকানোর জন্য। এর মধ্যে সব থেকে সূক্ষ্য যে কগনিটিভ কণ্ট্রোলের রিমোট বাটন ছিল-সেটা হচ্ছে ধর্ম।

তবে এই নিরাশার দিনেও আমি আশার আলো দেখি। আলটিমেটলি ধর্ম টিকে আছে শাসক শ্রেনীকে কগনিটিভি কণ্ট্রোল দিতে। মার্কেটের প্রসারের সাথে সাথে এটা সম্পূর্ন অন্যখেলা হবে। খেলাটা খুব সূক্ষ। ধর্ম মানুষকে একটা ভুল আশা দেখায়-ফলে পরকালে বা অন্যজন্মের আশায় তৈরী হয় তার আশাবাদ। সেটাও বেচা যায়-আধ্যাত্মিকতার আফিঙে মুড়ে সেটার ও কেনা বেচা চলে পৃথিবীর সর্বত্র। কিন্ত সেখানেই মার্কেটের কারসাজি! যদি অবজেক্টিভ ফাংশানের মধ্যে ইহজীবনের ভাল খাদ্য পানীয় সুরা নারী ঢোকানো যেত-খুব সম্ভবত বস্তুবাদি লোভ দিয়েই মানুষকে নিয়ন্ত্রন করা যেত। আধ্যাত্মিক লোভ, পরকালের সুরাহুরিদের লোভে দলে টানতে হত না। মার্কেট সেটাই করে। আমেরিকাতে মদ্য, মারিজুয়ানা, স্ট্রীপ ক্লাব, পর্ণ-এসবের বিরুদ্ধে আপত্তি কিন্ত আসে গোঁড়া ধর্মীয় আধ্যাত্মিক লোভে বিশ্বাসী লোকেদের কাছ থেকে। তবে এগুলোর ক্ষেত্রে ধর্মীয় লোকেদের একটা মরাল হাই গ্রাউন্ড থাকে। কিন্ত আসল প্রতিযোগিতা আসছে একটা নতুন শ্রেনীর "গুরু" দের কাছ থেকে। যারা বলছে তারা পেশাদার "লাইফস্টাইল গুরু"- ফিটনেস-খাওয়া দাওয়া-কাজ করা-চিন্তাকরা- রিলেশনশিপ-ইত্যাদি নিয়ে তারা পেশাদার এডাভাইসার হচ্ছে-দাবী করছে-দুবছরের মধ্যে রোগ সারিয়ে দেবে-পেশাদারী জীবনে উন্নতি করিয়ে দেবে উন্নত প্রোডাক্টভিটির মাধ্যমে। আমার ধারনা এই নো ননসেন্স লাইফস্টাইল গুরুরা আস্তে আস্তে ঈশ্বর এবং ধর্ম ভিত্তিক গুরুদের রিপ্লেস করতে সক্ষম হবে। এটা এখন আমেরিকার টপ ১% এ সীমাবদ্ধ-কিন্ত আস্তে আস্তে এটাই হবে মডেল।

আধ্যাত্মিক লোভের সাথে বস্তুবাদি লোভের একটা বিরোধ আছে। আশার স্থল সেটাই যে মার্কেট তার নিজের প্রয়োজনে বস্তবাদি লোভটাকেই বাড়াতে চাইবে। তাতেও অনেক ক্ষতি আছে। কিন্ত আপাতত তা ধর্মীয় চাপাতির থেকে ভাল।

মার্কেট অবশ্যই কাজ করে। আমেরিকাতে করছে। ১৯৮৯ সালে নিধার্মিকের সংখ্যা ছিল ৮%। এখন ১৮%। পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব দেশে নিধার্মিকরাই এখন সংখ্যাগুরু। ভারত বাংলাদেশেও করবে। মার্কেটকে খেলতে দিতে হবে। যাতে মার্কেট নিজের প্রয়োজনেই আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে সরিয়ে বস্তবাদি লোভ ঢোকাতে পারে। তবে ভারতে ধর্মীয় চাহিদাও মার্কেট হয়ে যায়! দেখা যাক নিরাশায় না ভুগে- জীবদ্দশায় দেখে যেতে চাই ধর্ম মুক্ত ভারত এবং বাংলাদেশে।

Wednesday, October 28, 2015

বিজেপি নিজের ধ্বংস নিজেরাই ডেকে আনছে

মোদি এবং তার সুযোগ্য সেনারা কি ভাবেন জনগণকে যা খুশী খাওয়ানো যায় মিডিয়া ক্যাম্পেইন দিয়ে? লোকে কিছু বুঝবে না?

 মোদির এই উত্থানের পেছনে, লোকজনের "আশার" ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। যে দেশে কিছুই হয় না- সব না এর দেশে যদি লোকটা কিছু করতে পারে! এবার ত দেখা যাচ্ছে উনি করার থেকে দেশের ক্ষতি করে দিলেন বেশী!

   শিক্ষা এবং গবেষনা হচ্ছে একটা জাতির মেরুদন্ড। শুনলাম মোদির পেয়াদারা ঘোষনা করেছেন এবার থেকে রিসার্চের টাকা ল্যাবেটরীগুলিকে নিজেদেরই জোগার করতে হবে! সি এস আই আর কে দেওয়া অনুদানের পরিমান অর্ধেক করা হচ্ছে! যাদের নেট নেই, তারা ফেলোশিপ পাবে না!

   প্রথম কথা হচ্ছে এগুলো আমেরিকাতে সম্ভব কারন এখানে প্রতিটা ফেডারেল এজেন্সি তাদের বাজেটের ৩% গবেষনা এবং নতুন প্রজেক্টের জন্য ছোট কোম্পানী গুলিকে দিতে বাধ্য। এটাকে এস বি আই আর গ্রান্ট বলে যা আমেরিকার অনেক গবেষককে বাঁচিয়ে রেখেছে। এখানেও প্রাইভেট রিসার্চ গ্র্যান্ট খুব কম- অধ্যাপকদের নানান ফেডারেল এজেন্সি থেকেই গ্র্যান্ট আনতে হয়। ভারতে ত এসব কিছুই নেই প্রায়। তাহলে অধ্যাপকরা নিজেদের গ্র্যান্ট পাবে কোত্থেকে? অধিকাংশই রিসার্চ বন্ধ করে দেবে। কারন ভারতে আমেরিকার মতন অধ্যাপকদের বাজে পারফর্মান্সের জন্য তাড়ানো হয় না। তারা ফালতু কষ্ট করে গ্র্যান্ট আনতে যাবেই বা কেন? মাঝ খান থেকে ভারতের গবেষনার বারোটা বাজবে।

 ফালতু পেপার পাবলিকেশনের জন্য গবেশনা বন্ধ করে একাউন্টাবিলিটি আনা উচিত। এটা একদম ঠিক কথা। ভারতে ১৫০ টা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অথচ ভারতের কৃষকদের জন্য তাদের বলার মতন কোন প্রোডাক্ট নেই-এই সব প্রশ্ন উঠুক। গবেষনাতে একাউন্টিবিলিটী বাড়ুক। যেসব অধ্যাপকরা শুধু পাবলিকেশনের জন্য গবেষনা করে, তাদের গ্র্যান্ট কেড়ে নেওয়া হৌক। গবেষনার টাকা ভারতের গরীব লোকেদের জন্য, ভারতের সমস্যার সমাধানে ব্যবহৃত হৌক। এগুলোতে আপত্তি নেই। এটাই হওয়া উচিত। কিন্ত গবেষনার টাকা কমালে, গোটা জাতির সর্বনাশ হবে। কারন স্কিলড ম্যানপাওয়ার না তৈরী হলে, নতুন প্রযুক্তিতে শিক্ষিত ম্যানপাওয়ার না থাকলে- কোন বহুজাতিক আসবে ?

ভারত কেন আমেরিকাতেও শিল্প সংস্থাগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনাতে তেমন কিছু ইনভেস্ট করবে না। এর অনেক কারন আছে। কিন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নতুন কিছু তৈরী করলে, শিল্প সংস্থাগুলি সেটিকে প্রোডাক্টাইজ করতে পারে। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় লাভ করতে পারে। আমাদের এখানে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবছর প্রায় ৮০০০ কোটি টাকার লাইসেন্স বেচেছে।  কিন্ত এই একই বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষনার জন্য সরকারি ফান্ডিং এর ওপর নির্ভরশীল বেশী।

রিসার্চ একাউন্টিবিলিটির যে মডেলটি উন্নত বিশ্বে প্রমানিত-সেটি হচ্ছে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে টাকা দেবে। তবে হ্যা, সেই গ্র্যান্ট গুলিও কম্পিটিশনের মাধ্যমেই পেতে হবে। তার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রযুক্তি বা জ্ঞান তৈরী করবে, যা ইন্ডাস্ট্রি কিনবে। তার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় টাকা পাবে এবং কোন গবেষনা কত বেশী মার্কেটে গেছে, কত বেশী লোকের উপকারে এসেছে, সেটার ইতিহাস দেখে সরকার সফল গবেষক এবং গবেষনাগারগুলিকে আরো বেশী গ্রান্ট দেবে।

বেসিক্যালি মোদি সরকারের সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে চিন্তা ভাবনা করার লোক একদম নেই। সব দিকে ছড়াচ্ছে। ভারতের আরো ক্ষতি হচ্ছে এবং হবে। উনার উচিৎ পার্টির লোকগুলোকে ঘার ধাক্কা দিয়ে বাড় করে পেশাদার লোকেদের এনে স্ট্রাটেজি তৈরী করা। কংগ্রেস কিন্ত সেটাই করত। পার্টির লোকদের শুধু রাস্তায় নামাত-আর দেশ চালানোর জন্য মনমোহনের মতন লোকেদের পেশাদার জগত থেকে আনা হত। আমার ত মনে হয়, সেই মডেলটা তাও চলছিল।  বর্তমানে পার্টির লোকেদের দিয়ে কাজ চালাতে গিয়ে, মোদি যে উদ্দাম ছড়াচ্ছেন, তা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।

Thursday, October 22, 2015

সবাইকে জানাই বিজয়ার শুভেচ্ছা

নিউজ ফিড সিঁদুর রঙে লাল। ফেসবুক জুরে বাচ্চা বুড়ী সবার হাঁসিখুশী মুখ।  শুধু দেহটাই দেশে নেই। মনটা ত্রিশঙ্কুর মতন দ্যোদুল্যমান- পুজোর আবহের ত্রিশ শতাংশ মৌতাতে মেতে আছি ভার্চুয়াল জগতে। কার্সি ফেসবুক।  এই নিয়ে পনেরো বছর পুজোতে দেশে অনুপস্থিত। আগে প্রতিবছর বিজয়াতে মনটা থাকত বিষাদে ভারাক্রান্ত-আসছে বছর আবার কবে হবে!! এখন এবছরই নেই-ত আসছে বছর !

   আসছে বছর না-আরো দূরের আগামীর প্রতীক্ষায় দিন গুনছি। যেদিন-ফেসবুকের নেক্সট ভার্সন হবে, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি। খোদ আমেরিকাতে বসেও আমার সেন্সোরিয়াল অনুভূতিগুলো তৈরী হবে চারিপাশের চতুর্মাত্রিক ভার্চুয়াল জগত দিয়ে।  বাবুবাগানের পূজোর ভীড় বা ম্যাডক্স স্কোয়ারের আড্ডা-বা পুরোনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য আর ছহাজার মাইল উড়ে যেতে হবে না। হাজার হাজার মাইল দূর থেকেও মনে হবে পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছি।

 আবার এটাও হতে পারে আগামী কুড়ি বছরে ভ্যাকুয়াম টিউব ট্রেইন চলে এল-যার গতি হবে ঘন্টায় পাঁচ হাজার মাইল!  মহাসাগরের জলের মধ্যে টিউব ফেলে চলবে সে ট্রেইন।  এদেশ থেকে ওদেশে পাড়ি দেব দুঘন্টায়। উইকেন্ড কোলকাতায় কাটিয়ে, কাজের দিনগুলো এখানে। চীন, আমেরিকা, জাপান সব দেশেই এই নিয়ে পরীক্ষা চলছে।

 মোদ্দা কথা দেশকালের ব্যবধান, ভার্চুয়াল হোক বা রিয়াল-তা ধ্বসবে একদিন। আশাত করাই যায়- জীবনের গোধূলী বছরগুলোতে ভারত-আমেরিকা ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করতে পারব!

Sunday, October 18, 2015

অল্প বয়সে লোকে কেন আদর্শবাদে আকৃষ্ট হয় ?

কমিউনিজম, হিন্দুত্ববাদ, জামাতি ইসলাম ইত্যাদি আদর্শে কেন তরুন তরুনীদের মগঝ ধোলাই হয়, এটা নিয়ে ভেবে কিছু সিদ্ধান্তে এসেছি।

 মূলে যেটা আছে - "সমস্যা" বনাম "সমাধান" এই দুটো শব্দকে আলাদা করতে ব্যর্থ হওয়া। তার কারন হচ্ছে, মূলত যারা হাতে সমাধান আছে বলে দাবী করে-তারাই এই সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা করে। বাকীরা করে না।  আমি উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি।

  ধরুন মালিকদের হাতে শ্রমিকদের শোষন। বা শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরী। বা আয়ের বৈষম্য । এগুলো কিন্ত সমস্যা। এবং বাস্তব সমস্যা। এগুলোকে অস্বীকার কেওই করবে না।

  কিন্ত মুশকিল হচ্ছে এই সমস্যার সমাধানের জন্য যখন কেও দাবী করবে- লেনিনিজম হচ্ছে একমাত্র পথ। বা জঙ্গী ট্রেড ইউনিয়ান একমাত্র পথ।  আরো মুশকিল ইতিহাসটা কেও ডিটেলেস পড়তে চায় না। লেনিনিজম এবং ট্রেড ইউনিয়ানের ইতিহাস ভালো করে জানলে দুমিনিট লাগে বুঝতে লেনিনিজম এবং ট্রেড ইউনিয়ানিজম শ্রমিকদের জন্য কোনদিন কিছু দিতে পারে নি। লেনিনিজম দিয়েছে পার্টির নেতাদের প্রতি দাসত্ব, আর ট্রেড ইউনিয়ানিজমের চোটে কারখানা বন্ধ হয়ে শ্রমিকদের রুটি রোজগার বন্ধ হয়েছে।  এগুলো অস্বীকার করবে কোন মূর্খ?

 আপনি বলবেন তাহলে সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা কাজের অধিকার, নুন্যতম মজুরী এগুলো কোত্থেকে এল ? হে মার্কেটে ঘটনা বা কমিনিউস্ট ইন্টারন্যাশানাল কোন ভূমিকা রাখে নি ? কারন ১৮৭০ সাল থেকেই ত এই দাবী গুলো তোলা হচ্ছিল?

 ইতিহাস পড়লে জানবেন শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতির পেছনে-বা এই যে ১৯৩০-৫০ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বে নুন্যতম মজুরী বা চল্লিশ ঘন্টার কাজের সপ্তাহ এল-তার পেছনে শ্রমিক আন্দোলনের ভূমিকা খুব সামান্যই। হে মার্কেটের ঘটনার তিন বছর বাদে আমেরিকাতেই পেনসিলভেনিয়াতে হোমস্টেড স্টীল ফ্যাক্টরী ( যা কার্নেগী স্টিল অধিগ্রহণ করে ), কাজের সময় সপ্তাহে  ৫০ ঘন্টা থেকে ৬০ ঘন্টা বৃদ্ধি করে।  মজুরী কমিয়ে দেয়।  শুধু তাই না, হে মার্কেটের ঘটনা, যার থেকে মহান মে দিবসের রূপকথা রচিত-তার পরের ত্রিশ বছর আমেরিকাতে শ্রমিকদের অধিকার কমেছে, বাড়ে নি।  কারন ১৯১০ সাল নাগাদ রকাফেলার, মর্গান এবং কার্নেগীদের একচেটিয়া ব্যবসা শীর্ষে পৌঁছায়।  এরা নতুন কারখানা অধিগ্রহণ করতেন, শ্রমিক ছাঁটাই করে, বাকী শ্রমিকদের আরো বেশী ঘন্টা খাটিয়ে আরো বেশী লাভ দিয়েছেন শেয়ার হোল্ডারদের। এবং এগুলো হয়েছে এবং বেশ সুবৃদ্ধি হয়েছে হে মার্কেটের রূপকথার মে দিবসের পরের ত্রিশ দশকেই। হেমার্কেটের ঘটনা শ্রমিকদের কোন অধিকার দিতে পারে নি-সেটা হে মার্কেটের পরের ত্রিশ বছর আমেরিকাতে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস পড়লেই পরিস্কার হয়।

 তাহলে শ্রমিকদের বর্তমান অধিকার এলো কোত্থেকে ? আমেরিকার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এর পেছনে সব থেকে বড় ভূমিকা ছিল রুজভেল্টের। কারন তিনি রকাফেলার, মর্গান এদের মনোপলি বন্ধ করে, কড়া আন্টিট্রাস্ট আইন আনেন। যাতে ছোট ছোট ব্যবসাগুলি বড় ব্যাবসার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে সমর্থ হয়। এবং এর পেছনে মূল কারন ছিল, রুজভেল্ট নিজে ওই ছোট বিজনেস লবীর লোক ছিলেন।

 ইনফ্যাক্ট ভারতের দিকে তাকালেও সেটা বোঝা যাবে। আজকে যে আই টি শিল্পের ওপর নির্ভর করে, ভারতের তরুন তরুনীরা এত ভাল স্যালারী পাচ্ছে- সেটা কি কোন শ্রমিক আন্দোলনের ফল? শ্রমিক আন্দোলন টাটা বিড়লা বা অন্য গোষ্টির কারাখানার শ্রমিকদের এত ভালো স্যালারী দিতে পেরেছে যা আই টি শিল্প পারছে?

আই টি শিল্পে ভাল স্যালারীর কারন এখানে কোন মনোপলী নেই-অসংখ্য হাজারে হাজারে কোম্পানী।  আর এই কোম্পানীগুলোর টিকে থাকতে দক্ষ শ্রমিক দরকার। ফলে শ্রমিকরা দড়াদড়ির সুযোগ পাচ্ছে- মানে তাদের হাতে চয়েস বেড়েছে। অর্থাৎ "লেবার মার্কেটে" একটা প্রতিযোগিতা আনতে পেরেছে আই টি শিল্প। এখন আই টি শিল্পে যদি শুধু টিসিএস আর ইনফোসিস থাকত-আজকে যারা টিসিএসে মাসে দুলাখ মাইনে পাচ্ছে, তারা ত্রিশ হাহার টাকাও পেত না। এই জন্য টাটারা  আই টিতে মাসে দুলাখ টাকা বেতন দিলেও, তাদের বেয়ারিং কোম্পানীতে শ্রমিকদের ১৫ হাজার টাকা বেতন ও দেয় না।

 মোদ্দা কথা শ্রমিক এবং মালিক-এই দুটি দিকেরই ব্যালান্সড বাজার দরকার। একজন শ্রমিকের  ১০০০ জন মালিকের একজনকে সিলেক্ট করার চয়েস থাকতে হবে। আর সেটা তখনই সম্ভব যখন কড়া আন্টিট্রাস্ট বা মনোপলী বিরোধি আইন থাকবে-মার্কেটকে প্রতিযোগী করার জন্য।

এগুলোর জন্য খুব যে বেশী পড়াশোনা করতে হয় -তাও না। চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায় ট্রেড ইউনিয়ানিস্ট লেনিনিস্ট বামেদের চিন্তা ভাবনার অসাড়তা।

হিন্দুত্ব বাদিদের ও এক ইস্যু।

ইসলামিক আইডিওলজি এবং তার থেকে উদ্ভুত সন্ত্রাসবাদ অবশ্যই সমস্যা। বাস্তব সমস্যা। কিন্ত তার সমাধান কি গরুর মাংস খাওয়া বন্ধ করে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করে? ইনফ্যাক্ট এখানেও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা বাড়ালে, আরো দাঙ্গা করলে-সেই বঞ্ছনা থেকে আরো অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদির জন্ম হবে।  ট্রেড ইউনিয়ান যেমন শ্রমিকদের ভাল করার নামে, তাদের ধ্বংস করে, হিন্দুত্ববাদি ঘৃণা, দাঙ্গাও ইসলামিক মৌলবাদের সমস্যাকে আরো বাড়াবে।

যেখানে দরকার ছিল মুসলমানদের আরো বেশী বাজার অর্থনীতির সাথে জড়ানো-এবং তার জন্যে তাদের যা শিক্ষা বা স্কিল দরকার সেগুলো সরকার থেকে আরো বেশী করে খরচ করা-তারা যাতে আর বেশী করে ভাল চাকরী পায়-উচ্চ শিক্ষা পায়-এগুলোকে নিশ্চিত করা-এগুলো না করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা ছড়িয়ে সন্ত্রাসবাদের আগুনে ঘি ঢালছে হিন্দুত্ববাদিরা।

 জামাতিরাও এক ইল্যুউশনে ভোগে। জাস্টিস- চাই জাস্টিস। কোথাও জাস্টিস নেই-চারিদিকে অবিচার-তাই ইসলামই নাকি একমাত্র জাস্টিস বা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে!! চারিদিকে অবিচার এটা ঘটনা-কিন্ত তার সমাধান ইসলাম এটা তারা ধরে নিয়েছেন-কারন হাদিস এবং সুন্নতের অসংখ্য রূপকথা গিলিয়ে এদের মাথায় খাইয়েছে লোকজন। ৫১ টা মুসলিম দেশের কোন দেশে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত?  এই কটা দেশ পৃথিবীর জঘন্যতম দেশ মানবাধিকারের দিক দিয়ে।
জাস্টিস চাইতে গেলে লিব্যারাল ডেমোক্রাসি ছাড়া উপায় নেই। কারন জাস্টিস  সিস্টেম বরাবর ক্ষমতাশীন টাকাপয়সাআলা লোকেদের হাতে আগেও ছিল-এখনো আছে। এগুলোর সমাধানের উপায় আরো ভাল গণতন্ত্র। ইসলামিক একনায়কতন্ত্র মানে সেই কিছু ঘুঘুদের হাতেই ক্ষমতা যাবে-এটা কে বোঝাবে মাথামোটা জামাতিগুলোকে ?

অনেকে বলেন আমিও মার্কেট মৌলবাদে বিশ্বাস করি!  আমি তাদের প্রশ্ন করি-আচ্ছা মার্কেট মানে মার্কিন সম্রাজ্যবাদ গুলিয়ে ফেলেন নি ত?

মার্কেটে মৌলবাদ বলে কিছু হয় না। মানুষ যা চাইছে-সেই চাহিদা থেকেই বাজার তৈরী। এখানে কোন কিছুর জোর চলে না-লোকে যা চায় সেটাই চলে। যেমন ধরুন এডিসন যখন ইলেক্ট্রিক বাল্ব তৈরী করলেন-তখন আমেরিকার সব থেকে বড় ধনী রকাফেলার। উনার টাকার উৎস ছিল -কেরোসিন। যা দিয়ে ল্যাম্প জ্বলত। এডিশনের আবিস্কারে ব্যবসা লাটে উঠবে দেখে রকাফেলার সমস্ত নিউজ পেপারে প্রচুর টাকা ঢালেন লোকজন কে বিভ্রান্ত করতে যে ইলেক্ট্রিসিটিতে লোকে শক খেয়ে মারা যেতে পারে। কিন্ত ইলেক্ট্রিসিটি আটকাতে পেরেছিলেন কি আমেরিকার সব থেকে বড় ধনী হওয়া সত্বেও?  এডিশন ও একই চেষ্টা করেছিলেন টেসলার এসি কারেন্ট আটকাতে। পারেন নি। কারন মার্কেটে ঔ ভাবে কোন কিছু স্থায়ী চাহিদা নেই। জনগণ নিজের জন্য যা ভাল-সেটা চাওয়া এবং কেনার স্বাধীনতাই বাজার।

সুতরাং যারা বাজারকে মৌলবাদি বলেন তারা অশিক্ষিত বামপন্থী। এজ ইউজুয়াল।

Saturday, October 17, 2015

লিব্যারাল ডেমোক্রাসি এবং ফ্যাসিস্ট পার্টি

লেখকবৃন্দের পুরস্কার ছেঁড়াছেঁড়ি বিশাল হ্যাজ ছাড়া কিছু না। প্রথমত লেখকের প্রকৃত পুরস্কার-তার লেখার কালোত্তীর্নতায়। দেশ কালের গন্ডী ছাড়িয়ে সার্বজনীন আবেদন এবং গ্রহণযোগ্যতায়।  একটা ফলক, সার্টিফিকেট আর একলাখ টাকায় লেখা মাপা সম্ভব? সুতরাং কোন লেখক যদি প্রতিবাদ করতেই চান-এই সব সার্টিফিকেট ফেরানোর নাটক বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদিদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী লেখা লিখুন।  লেখা আপনার অস্ত্র-রাজনীতি না। যদি হিম্মতআলে লেখক হৌন পেন ঝ্বলসে উঠুক বারংবার। দেহের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত। তবেই আপনি লেখক। নইলে হ্যাজ। অমন কত লেখক,  আসে যায়, মাইনা পায়।

  আর লেখকের কন্ঠ অবরুদ্ধ করতে চায় না কোন হারামজাদা পলিটিক্যাল পার্টি?  যেসব বামপন্থীরা নেচে বেড়াচ্ছে বিজেপির হাতে লেখকদের হ্যানস্থার জন্য -পশ্চিম বঙ্গের ৩৪ বছরের বামরাজত্বে বাম বিরোধি লেখকদের অবস্থা কি ছিল? বামপন্থী বিরোধি নাট্যকাররা নাটকের মঞ্চ ভাড়া পেত ?

  বিজেপি মোটেও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। সিপিএম ও করে না। একই সাথে আদর্শে এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা যায় না। কারন গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা মানে বিরোধি মতের প্রতি শ্রদ্ধা।  আর আদর্শে বিশ্বাস করা মানে, আমার আদর্শেই একমাত্র সমাধান ও ভবিষ্যত সেটা মেনে নেওয়া। তেলে জলে মেশে?  বিজেপির দাবি হিন্দু সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ( যদিও সেটা পেটে খায় না মাথায় দেয়, সেটা কেওই জানে না )। এখন কেউ যদি বলে হিন্দু সংস্কৃতি আদতে একটি বর্ণবাদি বাল, তারা লেখককে খুন করতেই পারে। ঠিক যেকারনে ইসলামের সমালোচকরা খুন হচ্ছেন। লেনিন কি ১৯১৭-১৯২০ সাল পর্যন্ত তার বিরোধিদের পূজো করেছিলেন? সবাইকে খুন করেছিলেন। কমিনিউজমের সমালোচকদের কি কমিনিউস্ট দেশগুলোতে পূজো করা হত না সাইবেরিয়াতে পাঠানো হত? বিজেপির হাতে হেনস্থা হওয়া লেখকদের জন্য কমিবৃন্দের চোখের জল দেখে বিড়ালের মৎস্যপ্রেম উথলে উঠছে।

লিব্যারাল ডেমোক্রাসি একটা হাঁসজারু মার্কা ফেইলড এক্সপেরিমেন্ট।  ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা যদি এর ক্রাইটেরিয়া হয়, তাহলে গণতন্ত্রে যেকোন টোটালটারিয়ান মতবাদের পার্টিকে ব্যান করতেই হবে। আমেরিকাতে এই জন্য কমিনিউস্ট পার্টি ব্যানড-হিন্দুইস্ট বা ইসলামিস্ট পার্টি যারা টোটালটারিয়ানিজমে বা আমার আদর্শই সর্বোত্তম এবং একমাত্র সত্যে বিশ্বাস করে-তাদের আইন করেই গণতন্ত্রে নিশিদ্ধ করা উচিত। বিজেপি সিপিএমের মতন পার্টি গণতন্ত্রে থাকবে, আবার লেখকদের খুন করা হবে না, হ্যারাস করা হবে না -এসব আকাশকুসুম কল্পনা।  স্পেডকে স্পেড বলতে শিখুন।

 লিব্যারাল ডেমোক্রাসি যদি আইন করে প্রতিটা ফ্যাসিস্ট পার্টিকে আটকাতে না পারে, তারা ভোটে জিতে লিব্যারাল ডেমোক্রাসিকেই ধ্বংস করবে। এটা ইতিহাসেরই পুনারবৃত্তি হচ্ছে। আমি মনে করি আইন করে ভারতে সব কমিনিউস্ট পার্টি, হিন্দুত্ববাদি পার্টি আর ইসলামিক পার্টি গুলিকে নিশিদ্ধ করা দরকার।

আর সেটা না করলে সত্যিকারের লেখকেরা মরতেই থাকবে। সভাকবিরা পুরস্কৃত হবেন-তবে তাদের লেখা কালের বিচারে মাটির গর্তেই ঢুকে যাবে।

অনলাইন ব্যবসা - বাঙালী যুবকদের সামনে আলোর রেখা না মরীচিকা ?

অনলাইন ব্যবসা - বাঙালী যুবকদের সামনে আলোর রেখা না মরীচিকা ?
http://biplabbangla.blogspot.com/2015/10/blog-post_17.html
**********************************         
                                        (১)
  যেখানেই সমস্যা, সেখানেই আশার আলো-চাইনিজ প্রবাদ

চম্পক দে নগরচন্ডালীতে একটা গুরুত্বপূর্ন পোষ্ট দিয়েছে। ফ্লিপকার্ট, স্ন্যাপডিলের চাপে এবার নাকি কোলকাতার পূজোর বাজারে কেনাকাটা অনেক কম। গোপা সরকার, তার পারিবারিক বুটিক ব্যবসার সূত্রে জানিয়েছে, এবার সেল প্রায় ৩০% কমেছে। পরেরবার আরো কমবে -কারন অনলাইন সেল আরো বেশী জনপ্রিয় হচ্ছে। চম্পক আরো জানিয়েছে, আগে তাও বেকার যুবকেরা মোবাইল আর প্রিপেইড চার্জ করিয়ে বাঁচছিল। অনলাইন সেখানেও থাবা বসিয়েছে। তাহলে বাঙালী বেকারেরা যাবে কোথায়? বাংলায় ত কোন ব্যবসা নেই! চম্পকের সুচিন্তক পোষ্টটার অংশ দিয়েই শুরু করি

 পূজোর কটা দিনের জন্য ছোটো বড় মাঝাড়ি ব্যাবসায়ীরা চাতক পাখির মত চেয়ে থাকে বছর ভর। এই সময় তাদের ব্যাবসা তুঙ্গে পৌছায়। বিশেষ করে পোষাকের বিপনন প্রতিষ্ঠান গুলো। বছরের মধ্যে তাদের এই সময় ব্যাবসা এবং ইনকাম কয়েক গুন বেশি হয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যাবসা ধিরে ধিরে তলানিতে এসে নেমেছে। বিশেষ করে এই বছর সেটা মারাত্বক আকার ধারন করেছে। যেসব দোকানে আগে কাস্টমারের লাইন লাগতো সেইসব দোকান এখন এই ভরা সিজনে প্রায় মাছি মারছে। অপর দিকে দেখা যাচ্ছে ক্যুরিয়ার সার্ভিসের কাউন্টারে বিভিন্ন আকারের প্যাকেট এবং মানুষের ঢল। ঘুরপথে এফ ডি আই এর ফল এই সব অনলাইন ব্যাবসা এবং এর রমরমা। তাদের প্রোডাক্টের রকমারি এবং অস্বাভাবিক কম দামের সাথে পেরে উঠছেনা এই সব ছোটো ব্যাবসায়িরা। মার খাছে ছোটো বাজার তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লাখো ব্যাবসায়ি, কর্মচারি এবং তাদের পরিবার। এবছর প্রায় ৩০% ব্যাবসা কমেছে যেটা আগামি বছর গুলোতে বহুগুন বাড়বে। একটা ভয়ানক পরিস্তিতির সামনে আমরা দাড়িয়ে আছি। বহু দোকান উঠে যাবে আগামি কয়েক বছরে এবং বেকার হয়ে পরবে বহু মানুষ। তারা কি করবে? 

 আমার এই লেখা মূলত সেই সব তরুন বাঙালীর জন্য, যারা অনলাইন ব্যবসা খুলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান। এটা ড্রাই আন্ড কাট ব্যবসা সংক্রান্ত লেখা। আঁতেল বাঙালীর জন্য,  ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টারবেশন না।
 প্রথমেই চম্পককে ধন্যবাদ জানাই। ফেসবুকে কোলকাতার সুখী উচ্চশিক্ষিত বাঙালীর বাইরে যে বৃহত্তর বঙ্গ-সেটাই রিয়ালিটি।  সেখানে মাসে দশ হাজার টাকা ইনকাম করতেও অধিকাংশ বাঙালী যুবক অক্ষম। চারদশকের স্বমেহনের  বাম রাজনীতিতে এই শ্বশান বঙ্গে অধিকাংশ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের ভিখারীর দশা।  যেটুকু বেঁচে ছিল-তা হচ্ছে ট্রেডিং। অনলাইন রিটেলের ঠেলায়-তাও চেলা কাঠে। 

তাহলে উপায় কি ? অনলাইন রিটেল আশীর্বাদ না অভিশাপ? 

 আমার নিজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, আমি আমেরিকাকেও এই ফেজের থ্রু দিয়ে যেতে দেখেছি। যদি বাঙালী যুবকরা তাদের মেধা এবং পরিশ্রম কাজে লাগাতে পারে-তাহলে অনলাইন আসলেই আশীর্বাদ। আমি এই লেখাতে কি কি অনলাইন ব্যবসা অল্প পুঁজিতে, শুধু মেধা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে করা সম্ভব-সেটা নিয়েই লিখব। 



                                                    (২)
                                                                         
আমি লেখাটাকে তিন ভাগে ভাগ করেছি। এই ভাগে মূলত আইডিয়া গুলো ডিসকাস করব। পরের ভাগে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু মৌলিক জ্ঞান এবং স্ট্রাটেজি নিয়ে আলোচনা করব।  একদম শেষে নিজের ব্যবসা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।

   অনলাইনে জামাজুতো বই বেচা ? 
                
        খুব বাজে আইডিয়া। কারন এইগুলিতে বড় বড় প্লেয়ারা অনেক টাকা নিয়ে বসে আছে।  সাপ্লাই লাইনে অভিনবত্ব না থাকলে, এখানে ঢোকা উচিত না। যেমন কেউ যদি শান্তিপুরে তাঁত অনলাইনে বেচতে চায়, তাকে নিশ্চিত করতে হবে, সে তাঁতীদের কাছ থেকে ডিরেক্ট কিনতে সক্ষম এবং তাই প্রাইস ওয়ারে পেরে উঠবে।  দোকান থেকে কিনে, দালালের কাছ থেকে কিনে অনলাইনে বেচে দিলাম-সেসব সম্ভব না। অনলাইনে দাম ভীষন কম রাখতে হয়।  লোক্যাল প্রোডিউসারের সাথে ডিরেক্ট যোগাযোগ না থাকলে, এই ব্যপারে নামা উচিত না। তাহলে কি কি জিনিস অনলাইনে বেচা যায়? যা ইনোভেটিভ? আমি পরে আসছি সেই প্রশ্নে।  তার আগে জানা যাক -কিভাবে সেট করতে হয় অনলাইন ব্যবসা 

  কি করে সেট আপ করবেন নিজের অনলাইন ব্যবসা ?
  
এটা খুব সোজা। ফ্লিপকার্ট, আমাজন, ইবে সর্বত্র সেলার আকাউন্ট খুলে আপনার ভার্চুলাল স্টোর খুলে বসুন। কেউ কেউ মাসে চার্চ কর, কেউ ফ্রিতে দেয়।  একাউন্ট খোলার পরে, নিজেই নিজের প্রোডাক্টের ফটো, বিনপন, গুনমান তুলে দেওয়া যায়। ঠিক ফেসবুকে প্রোফাইল সাজানোর মতন। আরো বড় স্টোর খুলতে হলে কনসাল্টটান্টের সাহায্য নিতে পারেন। ফেসবুক, লিঙ্কডিনে ফ্লিপকার্ট আমাজন স্টোর যারা সাজায়, তাদের বিরাট গ্রুপ আছে। সেখানে একটা পোষ্ট করলেই অনেকে এগিয়ে আসবে। খরচ পড়বে ১০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকার মতন। আপওয়ার্কে (www.upwork.com) এড দিয়েও দেখেশুনে লোক নিতে পারেন। 

নিজের সাইটেও ইকর্মাস খুলতে পারেন। ইকর্মাসের সব থেকে জনপ্রিয় সফটোয়ার হচ্ছে ম্যাজেন্টো (http://magento.com/)। ম্যাজেন্টো ফ্রি । কিন্ত চালাতে সার্ভারে বসাতে হয়। এছাড়া ম্যাজেন্টোর সাস মডেল ও আছে। আরেকটা জনপ্রিয় সফটোয়ার http://www.ucommerce.net/. যারা ওয়ার্ডপ্রেসে সাইট করেছেন, সেখানে এটা প্লাগইন হিসাবে বসানো যায়। আমি অবশ্য ম্যাজেন্টোই সাজেস্ট করব। ওদের লজিস্টিক ইন্টিগ্রেশন অনেক ভাল।

 সার্ভারের খরচ মাসে ২৫০/ থেকে ২০,০০০/ টাকা পড়বে মোটামুটি ১০ টা থেকে ১০০০ টা আইটেমের মধ্যে থাকলে-আর যদি সাইট ভিজিটর দিনে ১০০ থেকে ২০০০ এর মধ্যে থাকে। ভারতে আজকাল অনেকেই অনেক সস্তায় সার্ভার দিচ্ছে। 

 আর কি করে আমাজনে বা ফ্লিপকার্টে সেলার হতে হয়, তার অনেক ইউটিউব ভিডিও আছে। এগুলো দেখে নিন।

(1) https://www.youtube.com/watch?v=qeYeiXeuNMk
(2) https://www.youtube.com/watch?v=6aac8vPr3CQ


নিজের সাইট বনাম ফ্লিপকার্ট বা আমাজন ?

  দুটোর ই দরকার আছে। সাইট খুললেই ত হলো না। সাইটে লোক টানতে হবে। তার থেকেও বড় কথা বাজে মাল গছালে রিটার্নের গ্যারান্টি কোথায়? রিটার্ন গ্যারান্টির জন্য লোকে আপনার সাইট থেকে কিনবে না। সস্তায় দিলেও না। সেই আমাজন বা ফ্লিপ কার্ট থেকেই কিনবে।

 তাহলে নিজের সাইট কেন? কারন আমাজন বা ফ্লিপকার্ট ১০-১৮% কাট নেয়। ওটা দেওয়ার পরে অধিকাংশ ব্যবসাতে ১০% লাভ ও থাকে না। সেই জন্য অনেকেই যেটা করে, আমাজন বা ফ্লিপকার্টে বেচে প্রথমে ক্লায়েন্টদের নাম এড্রেস ইমেল জেনে নেয়। ফ্লিপকার্ট দিয়ে,  একবার ডেলিভারি দিয়ে সেই ক্লায়েন্টের কাছে ব্রান্ডটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, আপনি নিজে তাকে ইমেল করুন আপনার ওয়েব সাইট থেকে কিনতে-তাহলে সে ১০% কমে পাবে। সেই ক্ষেত্রে আপনার চান্স আছে। কারন সেক্ষেত্রে রিটার্ন হ্যান্ডলিং এর কথা ক্লায়েন্ট নাও ভাবতে পারে।

 আরেকটা কারনে নিজের সাইট দরকার। পেরিশেবল গুডস বা সার্ভিস ব্যবসা অনলাইনে আনতে গেলে, নিজের সাইট ছাড়া গতি নেই। কারন এগুলো ভীষন ভাবে নিজের লজিস্টিক ইন্ট্রিগ্রেশনের ওপর নির্ভরশীল। অনলাইনে এই সার্ভিস বা পেরিশেবল গুডসের ব্যবসায় ধান্দা এখন বেশী। কারন এগুলো খুব বড় অনলাইন রিটেলারদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই করা অসম্ভব।


কি বিক্রি করবেন অনলাইনে ?
  জামা, প্যান্ট বই, গহনা বিক্রির ধান্দা ছাড়ুন। ওগুলো করতে গেলে ডুববেন।  আরো অনেক চিন্তা ভাবনা করতে হবে যে কোথায় ফ্লিপকার্ট বা স্ন্যাপডিলের পক্ষে ঢোকা সম্ভব না। তবে কিছু কিছু কটেজ মালপত্র -যেমন নানান ধরনের লোক্যাল প্রোডাক্ট -যথা পোড়া মাটি বা কাঠ বা শাঁখের গয়না-বাঁশের কাজপত্র-যা গ্রামে তৈরী হয়-তা যদি সরাসরি কিনে সেখান থেকেই পাঠানোর লজিস্টিক ইন্ট্রিগ্রেশন করতে পারেন-তাহলে ভবিষ্যত আছে। তবে এসব ক্ষেত্রেও টার্গেট ক্লায়েন্ট পশ্চিম বঙ্গের বাইরে হলেই ভাল। কারন পশ্চিম বঙ্গের লোকেদের পকেটে টাকা নেই। 

 আমি দু একটা উদাহরন দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছি। ব্যাঙ্গালোর দিল্লীতে এখন অনেক ছোট ছোট কোম্পানী নিজেদের ওয়েব সাইটের থ্রু দিয়ে এগুলো করছে। এগুলো সব ক্যাশ অন ডেলিভারি। 
 পেরিশেবল গুডস একটা সুইট স্পট। যেমন ধরুন মাছ, মিস্টি এবং সব্জি।  ফ্রেশ মাছ এবং সব্জি কোথায় পাবেন ? উত্তর হচ্ছে পুকুরে আর জমিতে!  এগুলোর সমস্যা হচ্ছে স্টোরেজ এবং ডেলিভারি। উভয় ক্ষেত্রেই রেফ্রিজারেশন মাস্ট। কোল্ড স্টোরেজ সমস্যা না-তবে ভারতে রেফিজারেটেড ট্রাক প্রায় নেই। সুতরাং খুব লোকাল ভাবে ছাড়া এটা হবে না।  এবং বাজারের থেকে দাম ৪০% কম রাখতে হবে। সেটা অবশ্য সম্ভব যদি একদম চাষীদের কাছ থেকে ডাইরেক্ট কিনে স্টোর করতে পারেন। মিস্টি আজকাল অনেকেই অনলাইনে বেচে। কোলকাতা থেকে মিস্টি আজকাল সকালের ফ্লাইটে ব্যাঙ্গালোর বা দিল্লী যাচ্ছে।    

 সার্ভিস বেচা আরো সহজ-তবে এখানে কেউ কিনবে কি না তা নির্ভর করছে অনলাইন মার্কেটিং এর ওপরে। কি কি বেচতে পারেন? একটা সহজ উদাহরন দিই আমেরিকান মার্কেট থেকে। এখানে বৃদ্ধদের পক্ষে কম্পিউটার ঠিক ঠাক করা অনেক অসুবিধা । তাই অনেক অনলাইন কোম্পানী আছে-যেখানে বৃদ্ধদের কম্পিউটার , স্মার্টফোন খারাপ হলেই লোক পাঠিয়ে দেয়।  যারা ভাল কম্পিউটার বা স্মার্টফোন সারাতে পারেন, তারা নিজেদের লোকালিটিতেই নিজেদের ব্যবসাটা অনলাইন করে দিতে পারেন। ওয়ান ক্লিক বা ওয়ান ফোন কলে লোক পাঠিয়ে দিন। অনেকে আবার এটা ওভার সিজ করছে। ভাল কমিউনিকেশন স্কিল থাকলে কোলকাতায় বসে অস্ট্রেলিয়ান বৃদ্ধের কম্পিউটার সারাচ্ছে।

 অনলাইন শিক্ষা-একটা বড় মার্কেট। অনেক ভারতীয় গায়ক এখন আমেরিকানদের গান শেখাচ্ছে স্কাইপ বা গুগল হ্যাঙ্গ আউটের মাধ্যমে। ভারত থেকে আমেরিকান বাচ্চাদের অঙ্ক শেখাচ্ছে অনেকেই। অনেকগুলো সাইট আছে এর জন্য।  ক্লায়েন্ট ধরাটাই আসল এসব ক্ষেত্রে।  কোলকাতা থেকে বসে ব্যাঙ্গালোরের বাচ্চাদেরই শেখান। ইনফ্যাক্ট অনেক প্রবাসী বাঙালী চায়, তাদের ছেলে মেয়েদের জন্য বাঙলা বেসিক টিউটর । বাঙালী এতই ব্যবসা বিমুখ-সেটুকুও কেও এখনো করে উঠতে পারে নি!! 

 আরেকটা বিশাল অপারচুনিটি ট্রাভেল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে। হ্যা, ভ্রুমন।  একটা নতুন ধান্দার কথা বলি যা ইউরোপে  দেখেছি। আমেরিকাতে অতটা নেই। সেটা হচ্ছে গ্রামীন টুরিজম। যেমন ধরুন কোলকাতা থেকে বেড়োনোর জায়গা খুব লিমিটেড-সেই মন্দারমনি, নইলে সুন্দরবন। গ্রামে যাদের বড় বাড়ি আছে-ক্ষেত পুকুর জমি জমা আছে-তাদের সাথে কথা বলে তাদের বাড়িতেই উইকেন্ড গেস্ট হাউস বানান। যেখানে উইকেন্ডে কোলকাতা থেকে বাবুরা ফ্যামিলি সহ এসে গ্রামের জীবন কাটাতে পারবে দুদিন। এগুলো করা খুব সহজ। উত্তর বঙ্গে সিনিক স্পটে অনেকে শুরুও করে দিয়েছে। জাস্ট একটা ফেসবুক পেজ বা গুগল পেজ খুলে ফোন নাম্বার দিন-আলব্যামে ছবি দিন গেস্ট হাউসের। ওয়েব সাইট রাখার ও খরচ নেই। 


 কি ভাবে করবেন মার্কেটিং ?
     
 গুগল সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন বা এস ই ও সব থেকে ভাল অপশন। কিন্ত খরচ খুব বেশী। গ্যারান্টি কম।  এইজন্যে
ছোট থেকে শুরু করুন। ফেসবুক গ্রুপ খুলুন-যা ইন্টারেস্ট গ্রুপ। নিজের প্রোডাক্ট নিয়ে ভাল ব্লগ খুলুন। ভিডিও বানান। স্প্যাম করবেন না। লিখতে শিখুন। ব্লগ খুব এফেক্টিভ।  ভালো সার্ভিস দিলে, কাস্টমারই আপনাকে আরো অনেক কাস্টমার এনে দেবে। 

ইনফ্যাক্ট এখন শহর ভিত্তিক নিউজ পেপারগুলো মারা গেছে। যদি কেও কেও শহর ভিত্তিক ভালো ফেসবুক গ্রুপ চালু করে এবং সেই শহরের খবরগুলো ছবি সহ দেয়-সেটাও ভাল ব্যবসা হতে পারে। কারন এখন একটা জেলা শহরে নিউজ পেপার যেকজনের কাছে পৌছায়, তার থেকে অনেক বেশী লোক ব্যবহার করে ফেসবুক। কেউ যদি পেশাদারি ভাবে, নিজের শহরের একটা ফেসবুক গ্রুপ চালায়-যেখানে সেই শহরের দুই তিন হাজার লোক-রোজ খবর দেখতে বা আড্ডা মারতে আসে-সে লোক্যাল বিজনেসের কাছ থেকে প্রচুর বিজ্ঞাপন পাবেই। 

 কাদের কাছে বেচবেন ?
    
     ক্লায়েন্ট চেনা হচ্ছে ব্যবসার সাফল্যের পেছনে #১ কারন।  যেমন ধরুন-যদি বর্ধমানের মিহিদানা বা কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়া  শুধু পশ্চিম বঙ্গ বাসী বা কোলকাতাবাসির জন্য অনলাইন করে দেন-সেই ব্যবসা  না চলার সম্ভাবনাই বেশী। কারন পশ্চিম বঙ্গে বা কোলকাতায় লোকের টাকা নেই। কিন্ত সেই মাল যদি ব্যাঙ্গালোর, পুনে, হায়দ্রাবাদের বাঙালীদের কাছে পৌছানোর ব্যবস্থা করেন-ব্যবসা রমরমিয়ে চলবে।  ইনফ্যাক্ট পশ্চিম বঙ্গ বাসী কিনবে-এটা যদি ব্যবসার মডেল হয়-আমি প্রথমেই না করে দেব। কিভাবে বৃহত্তর ভারতে বা প্রবাসী বাঙালী বা পশ্চিম বঙ্গে তাদের বাবা-মায়ের কাছে বেচা যায়-সেই মডেল দেখুন। 

 আরো অনেক অনলাইন ব্যাবসা আছে-যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং বা আই টি ডেভলেপমেন্ট বা অনলাইন মার্কেটিং। সেটা অন্য কোন প্রবন্ধে হবে।

                                   (৩)

এবার ব্যবসা করার ব্যপারে কিছু স্ট্রাটেজিক দিক নিয়ে বলে রাখি।

   কাকে পার্টনার করবেন ?
                ব্যাবসার শুরুতে কাউকে পার্টনার না করায় ভাল। বাঙালী পার্টনার হলে একদম না।  ব্যবসা জমে যাওয়ার পরে, আপনি কাউকে মাইনে দিয়ে রাখুন।  পার্টনার করতে হলে ভাই বোন বা ফ্যামিলির মধ্যে রাখুন। ব্যবসা বড় হলে বা হওয়ার চান্স হলে, তাকেই পার্টনার করে আনবেন যে টাকা ঢালতে পারে বা বড় ডিল এনে দিতে পারে। সোয়েট ইক্যুইটি বা দুজনে খেটে ব্যবসা দাঁড়াবে এই মডেলে যাবেন না। আর বন্ধু বান্ধব হলে ত একদমই না। পেশাদারিত্ব থাকবে না। 

  কি করে ফাইনান্স করবেন ?
             সব থেকে ভাল মডেল হচ্ছে নিজে চাকরি করতে করতে, আস্তে আস্তে ফাইন্যান্স করা। আমি সেই ভাবেই শুরু করেছিলাম। এতে বিজনেস মডেল ভ্যালিডেশনটাও হবে-আর একটা ব্যবসা জমতে টাইম ও লাগে।  বুঝতেও সময় লাগে। 

         সবকিছু ছেড়ে হঠাৎ করে নতুন করে কোন ব্যবসায় ঝাঁপালে তা আত্মহত্যার নামান্তর । একটা ব্যবসায় তখনই ফুলটাইম হওয়া যায় যখন সেই ব্যবসা লাভ করছে, ফ্যামিলি চালানোর মতন টাকা আসছে।  

  ব্যবসা ফেইলড করলে ?
  ফেইল করবে, ধাক্কা খাবেন, দেনা হবে-এসব হবেই। সেটা জেনেই এগোতে হবে। ইনফ্যাক্ট আমি ২০০৯ সাল থেকে ব্যবসার চেষ্টা করছি। ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে এসে প্রথম চাকরি ছাড়ার রিস্কটা নিতে পেরেছিলাম কারন তদ্দিনে তিন বছরে ব্যবসা থেকে সংসার চালানোর মতন টাকা আসছিল।  এর মধ্যে কত উদ্যোগ যে ফেইলড করেছে তার ইয়াত্তা নেই। ১০ টার মধ্যে ৯ টাই ফেল করেছে আমার ক্ষেত্রে। কিন্ত যেটা সফল হয়েছে-সেটা ৯ টার লোকসান পুষিয়েও অনেক কিছু দিয়েছে, বড়ও হচ্ছে।  ব্যবসাতে অনেক কিছুই ট্রাই করতে হয়। অধিকাংশ চেষ্টা ব্যর্থ হবে। তাতে টাকাও লোকসান হবে। কিন্ত একটা সফল হওয়াই যথেষ্ট। ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে হবে। 

    পজিশন এবং ব্রান্ডিং ঃ  ইউনিক পজিশনিং সবার আগে দরকার। মার্কেটে কিসের চাহিদা আছে যা মেটানো যাচ্ছে না, বা বেশী টাকা দিয়ে লোকে মেটাচ্ছে-এগুলো বুঝতে হবে মার্কেটে ঢুকে। ব্রান্ডের ইউনিক পজিশনিং না হলে মুশকিল আছে। ধারাবাহিক ভাবে মার্কেট থেকে শিখে পজিশনিং বদলাতে হবে-যাতে প্রোডাক্টের চাহিদা আরো বাড়ে-আরো মার্জিন বাড়ে।

 ডেলিভারি ঃ  ব্যবসা শুরু করলে, ইউনিক প্রপজিশন থাকলে ক্লায়েন্ট এসেই যায়। ক্লায়েন্ট টানাতে খুব সমস্যা হয় না। মূল যেকারনে অধিকাংশ ব্যবসা ফেইল করে-সেটা হচ্ছে পুওর ডেলিভারি। ডেলিভারি ভালো না হওয়া পর্যন্ত ক্লায়েন্ট টানা উচিত না।  ডেলিভারিই আসল জিনিস। ভালো ডেলিভারি থাকলে, বেশী দামেও ক্লায়েন্ট কিনবে। খারাপ ডেলিভারিতে সস্তায় দিলেও কেও নেবে না। ব্যবসাও হবে না। ডেলিভারিতে সব থেকে বড় কাজ হল ম্যান পাওয়ার সামলানো।  শ্রমিক সামলানোর সফট স্কিল না থাকলে ব্যবসায় নামা উচিত না।

   প্রাইসিং ঃ
এটা ট্রায়াল এন্ড এরর মেথডে ঠিক করতে হয়। মার্কেট প্রাইস ডিক্টেট করে। যারা এম বি এ করেছে, তারা অনেক রকম প্রাইসিং এর গল্প জানে। কিন্ত প্রাক্টিক্যালি ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলে, একজন না অনেকের সাথে কথা বলার পরে-প্রাইস বাড়িয়ে কমিয়ে দেখতে হয়।
   
 অবজেক্টিভ বা উদ্দেশ্য ঃ  
  প্রচুর টাকা রোজগার করব, দামী গাড়ী কিনবো-এইসব আশা নিয়ে ব্যবসা করতে আসলে, নিশ্চিত ভাবেই ডুববে। ব্যবসা ভালো চললে টাকা এমনিতেই আসবে । বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। 

  প্রথমেই জিনিসটাকে ভালো লাগা দরকার। কাজ করার মধ্যে যেন আনন্দ থাকে।  খুব কষ্ট করে কাজ করছি, টাকার আশায়-এইভাবে চললে কিস্যু হবে না।  খুব মনোযোগ দিয়ে দাবা খেলছি-খেলাটা উপভোগ করছি-সেটাই যেন হয় মনোভাব।  আর কিছু লোকের চাকরি হচ্ছে-এই বৃহত্তর সামাজিক দ্বায়িত্ববোধটাও গুরুত্বপূর্ন। 

  না বলার ক্ষমতা ঃ
 পরিস্কার ভাবে না বলতে শিখতেই হবে। সে নিজের লোককেই হৌক বা ক্লায়েন্টকেই হৌক। চাকরি জীবন মানুষকে খুব পলিটিক্যালি ইয়েস ম্যান বানিয়ে দেয়। চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় আসলে-ওই এডজাস্টমেন্টা সব থেকে ক্রিটিক্যাল। 

 ডিটেইলড প্ল্যানিং-প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ঃ
সফল ডেলিভারির প্রথম রুল এ থেকে বি তে যাওয়ার প্রতিটা টার্ন জানা। প্ল্যান করা। প্ল্যানিং এর জন্যে গুগল স্প্রেড শিট আমি বহুদিন থেকে ব্যবহার করি। প্রতিটা স্টেপ নিখুত ভাবে জানা উচিত-লেখা উচিত-রিভিউ করা উচিত।


                                   (৪)

অনেকেই অনেক কারনে ব্যবসায় আসে। কেও আসে পারিবারিক কারনে। কেউ বা ভাল চাকরি না পেয়ে। আমি এসেছিলাম, কারন বসিং আমার সহ্য হয় না। আমি স্বাধীনচেতা লোক। ননসেন্স নেওয়ার অভ্যেস নেই।  ব্যবসাতে ক্লায়েন্টরা বস। কিন্ত সেই বসিং অনেক ভাল। সেখানে রাজনীতি নেই। লেনদেনের সম্পর্ক। ইনফ্যাক্ট আমি ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে সব থেকে বেশী শিখেছি। কর্পরেট লাইফ আমার বেকার টাইম পাস বলে মনে হচ্ছিল। 

 প্রথমেই মনে রাখতে হবে জীবনে চাওয়া পাওয়াটা কাটা কুটি করে শুন্যই থাকবে।  কিছু লাভ হলে-কিছু লোকসান হবেই।  ব্যবসা যে করতেই হবে-বা আমার মত করে করতে হবে তাও না। তবে যে যাতে আনন্দ পায়, তার সেটাই করা উচিত। 

 ব্যবসা এতটাই কঠিন পরিশ্রম এবং ধৈর্য্যের জিনিস-খুব দৃঢ়ভাবে ইচ্ছুক না হলে-অর্ধ ইচ্ছায় আসা উচিত না। 

 যাইহোক-আমি মোটেও এক্সপার্ট নই । বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও নই। তবে চার বছর আগে চাকরী জীবনের নিরাপত্তা ছেড়ে-ব্যবসায় টিকে আছি এবং ক্রমাগত বাড়িয়েও চলেছি। ব্যর্থতার মাধ্যমে অনেক কিছু শিখেছি-কারন আমি নেহাত মধ্যবিত্ত শিক্ষক ফ্যামিলির সন্তান। বিজনেস ট্রেনিং এককালে শুন্যই ছিল।  

যাইহোক, আমি যেসব অনলাইন টপিক নিয়ে লিখলাম, সেই লাইনে অনেক এক্সপার্টকেই আমি চিনি-যারা আসলে ওইসব লাইন নিয়ে বহুদিন কাজ করেছে। এদের অনেকেই আমার হয়ে কাজ করে। যদি দেখি যে অনেক ছেলে মেয়ে ইন্টারেস্টেড, আমি তাদের নিয়ে গুগল হ্যাঙ্গ আউট করতে পারি-যদি নতুন ছেলে মেয়েরা ইন্টারেস্ট দেখায়। উইকেন্ডে আন্তারপ্রেনারশিপে উৎসুক ছেলে মেয়ে প্লাস এক্সপার্টদের নিয়ে একটা হ্যাঙ্গ আউট করার ইচ্ছা আছে যদি ইচ্ছুক লোকজন পাওয়া যায়।

 আরেকটা কথা। এই ব্লগের উত্তর আমি ফেসবুকে দেব না। কারুর আরো কিছু জানার থাকলে এই ব্লগার ডট কমের কমেন্ট সেকশনে কমেন্ট করুন-আমি সেখানেই উত্তর দেব। কারন সেক্ষেত্রে ব্লগটিকে আরো ইনফর্মেটিভ করা সম্ভব হবে।

 আমি যা লিখেছি, তা খুব বেসিক আউট লাইন। হিমশৈল্যের ভাসমান অংশ। আরো অনেক অনেক গভীরে অনেক কিছু জানার আছে, যারা অনলাইন ব্যবসায় ইচ্ছুক।