Friday, January 9, 2015

ধর্মীয় পরিচিতির সমস্যা

পেশোয়ার থেকে প্যারিস। ইসলামিক সন্ত্রাসবাদিদের দৌঁড়াত্বে বিরক্ত অমুসলিমদের মনে একটাই প্রশ্ন। চারিদিকে ইসলামের এত কদর্য্য রূপ দেখার পরেও কি করে কোন সুস্থ মস্তিস্কের মুসলমান ইসলামকে আঁকড়ে ধরে থাকে? তাহলে কি মডারেট মুসলমান বলে কেও নেই ? ধার্মিক মুসলমান মাত্রই মৌলবাদি?  নইলে কেন সহি ইসলামের প্রহেলিকায় এখনো নিজেদের ধর্মীয় পরিচিতিটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছে ইসলামি বিশ্ব ?  মার্ক জুকারবার্গ যেখানে বাক স্বাধীনতার পক্ষে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন, সেই পেজে ১০০% মুসলিমদের কমেন্ট এটাই তারা বাক স্বাধীনতার চেয়ে ইসলামে থাকতে পছন্দ করবেন বেশী। কেন এই ধর্মীয় পরিচয়কে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা ?

না সমস্যা অন্যত্র? যে ধর্মীয় পরিচয় বা রিলিজিয়াস আইডেন্টিটা আমাদের সবার জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ন সেটা ছাড়া যায় না ? না ধর্মীয় পরিচয়ের সমস্যাটা বস্তবাদি-মোটেও ভাববাদি না ? এর পেছনেও আছে ধান্দা-মানুষ আসলেই যুক্তিবাদি এবং সেই যুক্তিটা টিকে থাকার?

 প্রথমে পরিচিতির প্রশ্নে আসি। কেন লোকে মুসলমান, ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাঙালী , হিন্দু ইত্যাদি নিয়ে গর্ব অনুভব করে? এটা কি ভাববাদি না বস্তুবাদি সমস্যা? না ছোটবেলা থেকে ব্রেইন ওয়াশিং এর ফল ? যে হিন্দুরা শ্রেষ্ঠ-মুসলমানরা শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি? বাংলাদেশে যেমন নৃশংস লুঠেরা  বখতিয়ার খিলজিকে হিরো হিসাবে দেখানো হয় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করার জন্য।  পাকিস্তান বাংলাদেশে টেক্সট বুকে মহম্মদ ঘোরি, বখতিয়ার খিলজির মতন সন্ত্রাসবাদি লুঠেরা হচ্ছে হিরো। তাহলে মুসলিমরা কেন প্যারিসের সন্ত্রাসবাদিদের সমর্থক হবে না যদি ছোটবেলা থেকে ব্রেইনটা ওইভাবে ড্যামেজ হয়ে থাকে ? আবার রবীন্দ্রনাথ  যশোররাজ প্রতাপাদিত্যকে মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়া বিখ্যাত হিন্দু বীর হিসাবে পূজো করার জন্য বিশেষ হিন্দু অনুষ্ঠান চালু করেছিলেন। বাস্তব এটাই প্রতাপাদিত্য আরেক লুঠেরা জমিদার ছিলেন-মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শ্রেফ কয়েক ঘন্টায় তার নৌসেনাবাহিনী সম্পূর্ন ধ্বংস হয়।  বিবেকানন্দ বারংবার গর্বিত হিন্দু হওয়ার জন্য ডাক দিয়েছেন। বিজেপি, আর এস এস, বজরং দল-চারিদিকে এখন "গর্বিত হিন্দু", গর্বিত ভারতীয় হওয়া ডাক। এজ ইফ গরুকে পূজো করে গর্বিত না হলে আপনি অপরাধী!

 এই সমস্যাটা শুধু ভারত, পাকিস্তান, হিন্দু মুসলমানের না । আমেরিকাতেও চারিদিকে গর্বিত আমেরিকান হওয়ার ডাক। আমেরিকা পৃথিবীর অর্থনীতির চালক, আবিস্কারের পূন্যভূমি, গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা-তাই সারাদিন আমেরিকান টিভিগুলো জনগণকে গর্বিত হওয়ার জন্য ডাকছে।  এম এন বিসিএর মতন লিব্যারাল টিভিতেও কোনদিন দেখলাম না আমেরিকার বিদেশনীতিতে কিভাবে অন্যদেশের মানুষেরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাই নিয়ে সমালোচনা। আমেরিকায় থাকলে মনে হয় পৃথিবীতে তিনতে জাত আছে-আমেরিকান  যারা শ্রেষ্ঠ, সব কিছু যাদের হাতে, ইউরোপিয়ান যারা আমাদের পূর্বপুরুষ কিন্ত সোশালিস্ট কেয়ারে আছে বলে গরীব আর অলস-এর বাইরে সবাই বর্বর অসভ্য!!

সুতরাং পরিচয় নিয়ে গর্ব করার সমস্যাটা শুধু মুসলমানদের না -এটা সার্বজনীন। কেন এমন সেটাই ভাবতে হবে।

ধরুন বাঙালীদের নিয়েই শুরু করি। বাঙালী হিসাবে আপনি গর্বিত?  না লজ্জিত?  সৎ উত্তর হচ্ছে নিশ্চয় আমরা আমাদের গান, সাহিত্য, সহজিয়া সাধনা, বাউলদের নিয়ে গর্বিত। আবার রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে আমাদের সার্বিক ব্যর্থতা নিয়ে লজ্জিতও বটে।

 হিন্দু হিসাবে আপনি গর্বিত ?  যে ধর্মে বর্নপ্রথা চালু সে ধর্ম নিয়ে কিভাবে গর্বিত হওয়া সম্ভব ? আবার উপনিষদের দর্শনে যেসব জীবন প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা হই -সেগুলি আমার ত মনে হয়েছে জীবনটাকে আরো গভীরে বোঝার জন্য বিশেষভাবে দরকার । সুতরাং হিন্দু ধর্মে জন্ম গ্রহণ করে আমি একই সাথে গর্বিত এবং লজ্জিত।

 মুসলমান হিসাবে আপনি গর্বিত? ইসলামের ইতিহাসে এত রক্ত, এত খুন, এত নৃশংসতা -এমন ধর্ম যার নবী নিজেই নিষ্ঠুরতা, লুঠ এবং নারীলোলুপতার জন্য বিখ্যাত-সেই ধর্ম নিয়ে কোন সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ কিভাবে  গর্ব বোধ করতে পারে ?  প্যারিসের বা পেশোয়ারের সন্ত্রাসবাদিদের কথা ছেড়ে দিলাম-নবীজির নিজের জীবনের ইতিহাসই ত গোলমেলে।  কিন্ত এর বাইরেও ইসলামের একটা গর্বিত দিক আছে। সেটা সুফী ইসলামে। ইসলাম, খ্রীষ্ঠান ইত্যাদির বাইরে বেড়িয়ে, আমাদের প্রথম পরিচয় যে মানুষ-সেই সহজিয়া ভাবের প্রথম পাঠ কিন্ত বিশ্ব পেয়েছে জালালুদ্দিন রুমির কাছ থেকে।  যদিও জালালুদ্দিন রুমি তথা সুফীদের মানবিকতাবাদ সমস্ত ইসলামিক বিশ্বেই ব্রাত্য।

ভারতীয় হিসাবে আপনি গর্বিত?  যেদেশের সব থেকে উচু থেকে নীচুতে এত দুর্নীতি, ঘুস ছাড়া কিছু হয় না - মেয়েদের কোন নিরাপত্তা নেই-সমগ্র বিশ্বের চল্লিশ শতাংশ নিরক্ষর লোকেরা বাস করে-ত্রিশ শতাংশ লোক একবেলা খেয়ে থাকে-সেই দেশ নিয়ে লজ্জিত না হলে কোন দেশ নিয়ে লজ্জা পাবেন? আবার এটাও ঠিক, ভারত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে এত ধর্ম, এত বর্ণ, এত ভাষার লোক পাশাপাশি আছে -যেটা আর কোন দেশ পারে নি। বিবিধের মাঝে এই মহান মিলন পৃথিবীর আর কোথাও নেই । এটা অবশ্যই ভারতের বিরাট সাফল্য এবং গর্বের উপাদান ও বটে।

নাস্তিক হিসাবে আমি গর্বিত? স্টালিন, গত শতাব্দির অন্যতম সেরা খুনী এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদি নাস্তিক ই ছিলেন। সঙ্গে পলপট বা অন্যান্য নাস্তিক কমিনিউস্টদের খুনের ইতিহাস নাই বা আনলাম। চলুন যদি বলি কমিনিউস্ট নাস্তিকরা খারাপ-ক্যাপিটালিস্ট নাস্তিকরা না -তাহলে এনরনের সি ই ও জেফ্রি স্কিলিং বা আচার্য্য রজনীশের দিকে তাকাই। যারা বস্তবাদি ভোগকেই মানুষের পরম উদ্দেশ্য বলে গণ্য করতেন।  প্রথমজন গত শতাব্দির সব থেকে বড় অপরাধিদের একজন-আর আচার্য্য রজনীশ ভোগবাদি জীবন নিয়ন্ত্রনে রাখতে না পেরে খুন থেকে একাধিক অপরাধ করেছেন।  আবার এটাও সত্য যে পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানীদের ৯০%  নাস্তিক।  পাশ্চাত্যে বুদ্ধিজীবি বা ব্যবসার শীর্ষস্থানীয় লোকেদের সিংহ ভাগ নাস্তিক।  আমেরিকাতে মূলত গরীব প্রান্তিক লোকেরাই ধার্মিক হয়।

আমেরিকান হিসাবে আমি গর্বিত ? পৃথিবীর যাবতীয় আবিস্কার, ব্যবসার ভরকেন্দ্র আমেরিকা । এখানকার লোকেদের কর্ম এবং উদ্ভাবন শক্তিতে আমি অবশ্যই গর্বিত। আবার আমেরিকার বিদেশনীতি -যেখানে স্বার্থ আছে,  দিয়ে আসি দুই ঘা- পাড়ার এই দাদাগিরি এবং মস্তানির জন্য লজ্জিত ও বটে।

  খুব সামান্য ক্রিটিক্যাল দৃষ্টি ভংগী নিয়ে দেখলেও এটা পরিস্কার কোন পরিচিতি নিয়েই ওই ভাবে গর্বিত বা লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই । সেটা যারা করে তারা শ্রেফ অশিক্ষিত, অজ্ঞানের অন্ধকারে আছে ডুবে।

তাহলে কেন লোকে তার ধর্মীয় পরিচিতি থেকে বেড়োতে চায় না?

 এর কারন স্যোশাল ইউটিলিটি ভ্যালু [২]। অর্থাৎ আপনার আমার সামাজিক মূল্য অন্যের চোখে। খুব বাস্তব কারনেই আমরা সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে চাই না ।  কারন নানান কারনে এই সমাজকে আমাদের দরকার হয়। ধরুন আমেরিকাত বিজনেস মিটিং  এ আমি কি আরো পাঁচ জন আমেরিকানের সামনে দেখাতে চাইব আমি আমেরিকা বিরোধি? না প্রমান করার চেষ্টা করব আমেরিকা ভুল?

 এটা মুসলিমরাও ফেস করে।  মুসলমান ফ্যামিলিতে জন্ম নেওয়ার জন্য তাদের মুসলিমদের মধ্যেই মেলামেশা করতে হয়। সুতরাং একজন মুসলমান যখন আরো পাঁচজন মুসলিমদের সাথে ওঠা বসা করছে-করতে হচ্ছে -সে কি করে বলবে বা দেখাবে আমি মুসলমান হিসাবে গর্বিত না ? একটা সামাজিক চাপ থাকেই বিচ্ছিন্ন না হওয়ার। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সকলেই যতটা পারা যায় কর্মক্ষেত্রে আমেরিকান, স্যোশাল গ্যাদারিং এ বাঙালী বা হিন্দু বা মুসলমান-এই  পজিশনিং রেখে চলতে হয়। এটা যুক্তিবাদি অবস্থান। সমাজ এবং চাকরি থেকে বেনিফিট পেতে।

এটা আস্তে আস্তে কমে আসবে যখন সমাজের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা কমবে।

[১] স্যোশাল ইউটিলিটি এবং ধর্মীয় পরিচিতি --[  https://sites.google.com/site/biplabpal2000/ReligiousIdentity.pdf                            ]


No comments: