Monday, November 24, 2014

ব্রাত্য -থ্রিয়েট্রিক্সের দুর্দান্ত কমেডি!

সমালোচনা লেখার আগে প্রথমেই ডিরেক্টর  দিব্যেন্দু পালকে একটা হাজার ওয়াটের ধন্যবাদ। আমেরিকায় আছি চোদ্দবছর। গন্ডে পিন্ডে,  পূজোয় এবং গজায় দু চারটি নাটক প্রতিবছরই দেখি। কিন্ত কোন এক অজ্ঞাত কারনে, নস্টালজিয়া বা যেকারনেই হোক না কেন- সবাই ওই উৎপল দত্ত না হলে ম্যাক্সিমাম বাদল সরকারের টিপিক্যাল সত্তর বা আশির দশকেই লটকে থাকে। মাঝে সাজে প্লেইন ভ্যানিলা কমেডি। দেশের সেরা সন্তানেরাই আমেরিকাতে আসে। তাদের এই স্টিরিওটাইপে আমি ক্লান্ত। প্রবাসে নাটকের প্রতি এক তুচ্ছ অবজ্ঞা ছাড়া আমার কিছুই বাকী ছিল না ।



থ্রিয়েট্রিক্সের  "ব্রাত্য" এক বিশাল ব্যতিক্রম সেই এক ঘেঁয়েমি থেকে। পরীক্ষামূলক উচ্চমানের কমেডি। সিটে বসে মনে হচ্ছিল একাডেমিতে বা মধূসূদন  মঞ্চে নান্দীকার দেখছি। দিব্যেন্দু সাক্ষাত অজিতেশ।

থ্রিয়েট্রিক্সের "ব্রাত্য"  প্রবাসের নাট্য মরুভূমিতে মৌসুমি বৃষ্টি।

 নাটকটি নবনিতা দেবসেনের ছোট গল্পের নাট্যরূপ। ঘটনা, গল্প-সবটাই আশির দশকে বালিগঞ্জের এক বিয়েবাড়ি। এই গল্প বা নাটকের মূল থিমটা এন্টন চেকভের "ওয়েডিং" নাটকের ছায়ায়। নাটকের মূল চরিত্র মেশোমশাই বা কন্যার পিতার চরিত্রের অনুপ্রেরনা চেকভের জিগলভ।  যিনি, বিয়েতে হরেক রকমের খরচকে যৌত্বিক ভাবেই বাজে খরচ মনে করেন। তাই নিয়ে পরিবারের সকলের সাথে ঝগড়া।  অশান্তি। ফলে আক্কেল জ্ঞান নেই বলে, তিনি আউটকাস্ট বা ব্রাত্য। এই নাটকে মেশোমশাই একজন টিপিক্যাল বাঙাল। যিনি সাতপাঁচ না ভেবে হৃদয়ের নির্দেশে কাজ করেন। মনের কথা রাখঢাক না রেখেই বলে ফেলেন!  এটি একটি ক্ল্যাসিক চেকভ ঘরনার নাট্য চরিত্র-যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনার সংবেদনশীলতায় গল্প এগোয়।

 নাটকের ভিত্তি  আমাদের চেতনাকে কুঠারাঘাত করা একটা প্রশ্ন।  আমাদের এত প্রয়োজনের উৎস কি? সামাজিক চাপ না সত্য সত্যই এত কিছু আমাদের দরকার আছে?  মেশোমশাই এর সাথে বাকী চরিত্রদের ঘাত প্রতিঘাতে এই প্রশ্নটাই আসে ঘুরে ফিরে।

এই ভোগবাদি সমাজের জাঁতাকলে প্রয়োজনের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। অথচ আমরা প্রশ্ন করি না -এত কিছু কি আমাদের সত্যই দরকার? বা যেগুলো দরকার সেগুলোও  কি আমরা চাইছি না সমাজ যা চাইতে বলছে তাই চাইছি ? আমাদের চেতনার শ্রোতকেই কি আমরা ব্রাত্য করে রেখেছি ভোগবাদের, সামাজিকতার প্রবল চাপে?

এই গভীর ডায়েলেক্টিকটি একটি কমেডি নাটকে নামানো বেশ চাপের কাজ। কিন্ত মানতেই হবে দিব্যেন্দু এবং অরিন্দম একশো শতাংশ সফল এই কাজে। একবারের জন্যও একঘেঁয়ে হয় নি-সদা হাস্যরসে  থেকেছে দর্শক।

নাটকের সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করছিল দিব্যেন্দুর অভিনয় দক্ষতার ওপরে।  তিনি সফল। উনার অভিনয় দেখে,  পাবনার পিশেমশাইকে মনে পড়ল।  একগুঁয়ে, একবল্গা, ঠোঁটকাটা বাঙাল-প্রতিটা মুর্হুর্তে ওপার বাংলায় শিকড়ের সন্ধানে।  সাত পাঁচ না ভেবে মন যা চায়, তাই কয়ে ফেলেন! আর তার এই আপাত নিরীহ প্রশ্ন গুলিই দর্শকের দিকে গুগলি - সত্যই কি আমরা ভাবি আমাদের জীবনে কি দরকার? কি চাইছি? নাকি  আমাদের চেতনা এক ভোগবাদি সামাজিকতার কাছে বন্ধক ?

রন্টুর রোলে অরিন্দম ঘোষ।  দর্শকাসনে এসে, প্রথমেই থার্ড ফর্মে দর্শকের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টাটাতে ও সফল। এমনিতেই এটা নাটকের মনোলগ, তা সব অবস্থাতেই কঠিন। অরিন্দম কিন্ত সেই কঠিন কাজটাই স্বভাবসুলভ দক্ষতার সাথে নামিয়েছে হাজারো মুন্সিয়ানা এবং ইম্পোভাইজেশনের মধ্যে দিয়ে।

বাকী সবার অভিনয় বেশ উচ্চমানের। নাটকের কুশীলবরা নাটকের সারবস্তু এবং চরিত্রের অন্দরমহলে হাঁটাচলা করেছেন-যেটা বিশাল পাওনা। মাসীমার রোলে স্বাতীকে ভালোই মানিয়েছে-বিশেষত দিব্যেন্দুর মতন পোড়খাওয়া সিজনড অভিনেতার পাশে কাজ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাতে স্বাতী উত্তীর্ন। তবে নাটক অনুযায়ী ও শান্তিপুরের মেয়ে। ওর ভাষাতে শান্তিপুরি পরিশীলতার ভাবটা একটু বাড়াত হবে চরিত্রটি আরো বিশ্বাসযোগ্য করে আঁকতে।  যশোমান ব্যানার্জি অল্প সময় ছিলেন স্টেজে রসুই এর রোলে-কিন্ত তার স্টেজ প্রেজেন্সে এবং বডি ল্যাঙ্গোয়েজে পাকা অভিনেতার সাক্ষর ।

 শালীর রোলে পরমা খুব দক্ষ অভিনেত্রী। ওর অভিনয় ক্ষমতা এবং সেট পিস ও উপভোগ্য। কিন্ত আরেকটু ইম্পোভাইজেশন দরকার । পিশীমার রোলে সুবর্না নিঁখুত এবং মসৃন।  রাইমা চরিত্রে শম্পা স্টেজের ওপর একটা হাল্কা মিষ্টি সৌর্ন্দয্য ছড়িয়ে দিতে পেরেছে-যেটা ওর অভিনয়ের সার্থকতা।

ঋতুপর্নার আবহসঙ্গীত গুলো একদম খাপে খাপ, অসাধারন। তবে সেখানে পরীক্ষার ছাপ নেই । টাইমস এন্ড টেস্টেড সেট পিস গুলিই নির্বাচন করা হয়েছে।

 স্টেজটা একটু বেখাপ্পা। এত ভালো কোয়ালিটির প্রযোজনার সাথে বেমানান। শ্রাদ্ধ বাড়ি না বিয়ে বাড়ি বোঝার উপায় ছিল না । কল্পনা করতে হচ্ছিল এটা বিয়ে বাড়ি।

 আরেকটা ছোট্ট অনুরোধ। নাটকে এত রাধাবল্লভী ফিসফ্রাই এর গপ্পো-বাইরে একটাও খাওয়ার স্টল ছিল না । অনেকেই লাঞ্চ না করে এসেছিলেন-বেচারাদের ক্লান্ত পেটে এত রাধাবল্লভীর গপ্পো সইল কিনা কে জানে!

No comments: