(১)
হিন্দু শব্দটা গোলমেলে, বিতর্কিত এবং বিটকেলে। তাই বিতর্ক, ধন্দ এবং ধান্দা এড়াতে প্রথমেই একটা সহজ সংজ্ঞা দিই। আমি হিন্দু ধর্ম বলতে কোন তাত্ত্বিক কথকথা, শাস্ত্র, ইতিহাস-কিছুই টানছি না এখানে। বাংলায় হিন্দুধর্ম বলতে আমি তাদের কথা বলছি-যারা মূর্তিপূজো যেমন দূর্গাপূজো, কালীপূজো করে, ঘরে দু একটি দেব দেবীর ছবি রাখে। বাপ মায়ের মৃত্যু হলে শ্রাদ্ধশ্রান্তি। বিয়েতে বামুন ডেকে মন্ত্র মার্জনা। কীর্ত্তনে, গাজন, জন্মাষ্ঠমীর বারো মাসে তেরো পার্বন। আমি সেই হিন্দু ধর্মের কথা বলছি এখানে, যা সবাই বোঝে। জানে। এর একটা দিক বৈদিক হিন্দুধর্ম -অন্যটা লোকায়েত প্যাগানিজম। ধরুন দুই এর মিশেল। ককটেল ধর্ম।
প্রশ্ন হচ্ছে এই যে বাঙালীগুলো ইদানিং নিজেদের হিন্দু হিন্দু বলে হর হর মহাদেব গাইছে সকাল বিকেল আর বিদেশী বলে মুসলিমদের তাড়াতে চাইছে-তা জানতে ইচ্ছে হয়, তাদের এই হিন্দু ধর্মটা কতটা স্বদেশী?
নিজেদের মধ্যে এদেরএই প্রকট হিন্দুত্বের ভাবটা যদি ইসলামের হাত থেকে বাঁচতে, একটা সারভাইভাল স্ট্রাট্রেজি হয়-তাহলে আমার কিছু বলার নেই । কারন সেক্ষেত্রে সেটা এক্সজিস্টেন্টিয়াল-অস্তিত্ববাদি অবস্থান- যুক্তির থেকে বাঁচার দায় বেশী। গ্রান্টেড।
কিন্ত এই সব বাঙালীরা যদি সত্য সত্যই ভেবে থাকে এই হিন্দু ধর্মটা তাদের আদি পুরুষের ধর্ম-ইসলামের মতন ইম্পোটেড মাদক না-সেটা হবে সত্যের ছয়লাপ। কারন এই "হিন্দু ধর্মের" প্রায় সবটাই বাঙালীর জীবনে বিদেশী আমদানী। একদম মুসলমানদের মতন ।
(২)
বাংলায় এই হিন্দু ধর্ম বুঝতে আমাদের একটু মহাভারত ঘাঁটতে হবে।
আচ্ছা মহাভারত যারা পরেছেন-তারা কি দেখেছেন মহাভারতের কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র মন্দিরে গিয়ে পূজো দিচ্ছে? মূর্তিপূজো করছে? কালীপূজো বা দূর্গাপূজো বা কোন পূজো করছে?
গোটা মহাভারতটাই ধর্ম বনাম অধর্মের যুদ্ধ। সেই যুগে ধর্ম বলতে কি বোঝাত, মহাভারতের ছত্রে ছত্রে পরিস্কার। তার জিস্ট হচ্ছে যক্ষপ্রশ্নের সংকলন । যক্ষ যখন যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন ধর্ম কি? যুদ্ধিষ্ঠির কোথাও কি বলেছিলেন ধর্মপালন মানে মন্দিরে গিয়ে যজ্ঞ করা? পূজো করা?
যুধিষ্ঠির উত্তর দেন বুদ্ধিমান লোকের কর্মই ধর্ম। এবং গোটা মহাভারত জুরে কোথাও মূর্তিপূজো পাওয়া যাবে না । অশ্বমেধ যজ্ঞের উল্লেখ আছে অনেকবার। কিন্ত যাগ যজ্ঞ পূজা অর্চনাকে কেও ধর্মের সাথে গোলান নি। যুষ্ঠিষ্ঠির যক্ষরাজকে যে উত্তর দিয়েছিলেন -অর্থাৎ বুদ্ধিমান লোকের মতন কর্মপালনই ধর্ম-তাই আমরা দেখবো মহাভারত জুরে। ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞাপালনে সুবদ্ধ-কর্ন তার দানকর্মের মগ্ন। কেও বর্ণভেদ মানছেন-কেও বর্ণভেদের বিরোধিতা করছেন কারন তা অমানবিক। সেগুলোই ছিল তাদের ধর্ম। লক্ষ্যনীয় যে মহাভারতের কথাকার "ধর্ম পালনের" প্রসঙ্গে বর্নভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেও উস্কানি দিয়েছেন-আবার প্রধান চরিত্রদের বর্নভেদ মানিয়েওছেন।
কোথায় মূর্তিপূজো বা পূজো অর্চনা আছে মহাভারতে? কোথাও নেই ।
আসল সত্য হল এই মূর্তিতুলে পূজো অর্চনাটাও ভারতে ইম্পোর্টেড। বহিরাগত হুনদের কাছ থেকে শেখা (০০৭০-০০৮০) । সেটা মহাভারতের যুগের অনেক পরে এসেছে। মহেঞ্জোদারোতে যে যোগী মূর্তি পাওয়া গেছে, সেটা সম্ভবত জৈন যোগগুরুর। এবং আরেকটা ভুল ধারনা মন থেকে ভাঙা দরকার। জৈন ধর্ম ভারত কেন পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। ঋকবেদের ও আগে এর অস্তিত্ব ছিল। এটি মোটেও হিন্দু ধর্মসংস্কার বা বৈদিক ব্রাহ্মন্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না। উৎসাহী পাঠকরা জৈন ধর্ম নিয়ে আমার আগের লেখাটা দেখতে পারেন ( http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=28847 )। সুতরাং বৈদিক হিন্দু ধর্ম, ঋকবেদের ধর্ম আদি সনাতন ধর্ম -এসব ভুল ধারনা ভাঙা দরকার।
বৈদিক হিন্দু ধর্মের মূল চারযোগে। অথচ এই যোগ এবং সাধনার কোন ধারনাই ঋকবেদে নেই। ঋকবেদে শুধুই আচার অনুষ্ঠান, স্তোত্র, মন্ত্র। যোগ সাধনা নিঃসন্দেহে জৈন ধর্ম থেকে বৈদিক ধর্মে ঢুকেছে। ঠিক যেমন বৌদ্ধ পন্ডিতদের চাপে বৈদিক ধর্মের সব থেকে সুন্দর সাহিত্য উপনিষদের জন্ম হয়।
প্রায় দেখি বাংলাদেশের অনেক হিন্দু নিজেদের সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী বলে গর্ব করেন। তা এই সনাতন ধর্ম বলতে তারা যা পালন করেন, তা কতটা দেশী আর কতটা বিদেশী মাল? যদি ধরে নিই সনাতম ধর্মের একটা রূপরেখা আমরা মহাভারতে পাই-তাহলে তারা যেসব মূর্তি তুলে পূজো অর্চনা করছেন, পালা পার্বনে অংশ নিচ্ছেন-তা কি আদৌ কোনদিন সনাতন ধর্মে ছিল?
একটু পড়াশোনা করলেই জানা যেত যে বাংলায় যেসব দেবদেবী পূজিত হয়-শিব, দূর্গা কালী ইত্যাদি-এদের অধিকাংশই শংকর প্রজাতির দেবতা। কিছুটা দেশী, কিছুটা বৈদিক পুরান-সব ঘেঁটে ঘ হয়ে এই সব দেবদেবীরা বিবর্তিত। এর সাথে মহাভারতের সনাতন ধর্মের সম্পর্ক নেই ।
(৩)
বল্লাল সেনের (1160–1179) আগে বাংলায় বৈদিক ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। কোন ব্রাহ্মন ক্ষত্রিয় ছিল না বাংলায়। অনেকে বলবেন প্রথম গৌড়ীয় রাজা শশাঙ্ক ছিলেন শৈব। এই ব্যপারটা গোলমেলে। এটা ঠিক শশাঙ্কের আমলের এবং তার আগের অনেক শৈব মূর্তি বাংলার মাটি খুঁড়লে এখনো ওঠে। আমি যেখানে থাকতাম সেখান থেকেও দেখতাম মাটির তলা থেকে প্রাচীন শৈব মূর্তি উদ্ধার হত। কিন্ত ইনি বৈদিক শিব নন। ঠিক যেমন মহেঞ্জোদারোর যোগী বৈদিক শিব নন। শিব আসলে উর্বরাশক্তির লিঙ্গ দেবতা এবং যোগী দেবতার শংকঢ়। জায়গায় এর নানা ভ্যারিয়েশন। পরে ইনি বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ঢুকে যান। লিঙ্গ দেবতার ধারনা পৃথিবীর সব দেশের প্যাগানদের মধ্যে ছিল । মেসোপটেমিয়া থেকে রোম সর্বত্র লিঙ্গ দেবতার ধারনা ছিল। সুতরাং কোন লিঙ্গ দেবতা কেও পূজো করতো মানেই সে বৈদিক ধর্মের অনুসারী তা কিন্ত নয়। লিঙ্গদেবতার ধারনা সর্বব্যাপী।
বল্লাল সেনের আগে পাল রাজাদের আমলে বাংলাতে বৌদ্ধ এবং লোকায়েত অনেক ধর্মই ছিল-যার মধ্যে তান্ত্রিক, কালীভক্ত এবং নানান স্থানীয় প্যাগান সংস্কৃতিই পাওয়া যাবে। বৌদ্ধ ছিল রাজধর্ম। কিন্ত কোন জাতিভেদ পাওয়া যাবে না ।
সেন রাজারা এসে প্রথমে বাংলার সব প্রজাদের শুদ্র বানাইলেন! কনৌজ থেকে ব্রাহ্মন ধরে এনে তাদের গ্রাম দিয়ে বাংলায় ব্রাহ্মন্য ধর্ম, বৈদিক মতে পূজা অর্চনা চালু করলেন। ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি করতে এদেরকে অনেকগুলি গ্রাম দিলেন। কুলীন ব্রাহ্মনদের অসংখ্য বিবাহে উৎসাহ দেওয়া হল যাতে ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি হয়। এরাই আজকের চট্টোপাধ্যায় ( যারা চিটাগঞ্জের কাছে গ্রাম পেয়েছিলেন ) বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি উপাধ্যায়।
এক অদ্ভুত হিন্দু যুগের সুচনা হল বাংলায়। কিছু ব্রাহ্মন। বাকী সবাই শুদ্র। বাংলাতে আজো ক্ষত্রিয় বৈশ্য নেই । বাংলার ব্যবসায়ী শ্রেনী সাহারাও শুদ্র আবার বোসের মতন রাজকরনিক শ্রেনীও শুদ্র!!
পাল রাজাদের আমলে যারা ধর্মীয় সাম্য উপভোগ করছিলেন, তারা হঠাৎ করে বর্নহিন্দুর এই শুদ্র স্টাটাসটা মানবেন কেন ? না । বাংলা কখনোই সেন রাজাদের মেনে নেয় নি। বল্লাল সেনের আমলে তার এই জোর করে ব্রাহ্মন্য হিন্দুধর্ম চাপানোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় চারিদিকে। এর মধ্যে বিখ্যাত ছিল বর্ধমানের কৃষক-জেলে বিদ্রোহ। সুন্দরবন এলাকাতে বিদ্রোহ করেন কোম্মপাল (১১৯৬) । তিনি সুন্দরবন এলাকাতে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে লক্ষণ সেন, বাংলার শুদ্রদের মধ্যে ২৭ টি কাস্টকে উত্তমর্ন শুদ্র স্টাটাস দিলেন ! কিন্ত তাতে কি আর শেষ রক্ষা হয়? বাংলার জনগন তখন এই বহিরাগত ব্রাহ্মন আর সেনদের প্রতি বেজায় বিক্ষুব্ধ।
ফলে মাত্র দুহাজার সৈন্য নিয়ে বখতিয়াল খিলজি যখন নবদ্বীপ আক্রমন করলেন (১২০২), লক্ষন সেনের পালানো ছাড়া আর কোন পথ ছিল না ।
এর পরবর্তীকালে বাংলায় লোকজন দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে থাকে ব্রাহ্মন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণায়। হজরত শাহ জালালের (১৩০৬-) মতন সুফীদের প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালী দলে দলে ইসলাম গ্রহন করতে থাকে চোদ্দশ শতক পর্যন্ত ( শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মের আগে পর্যন্ত)।
তবে বাঙালীর ইসলাম ও এক অদ্ভুত ধর্ম। বাঙালী মুসলমান আরবিক জানত না কোনদিন ই -বাংলাতে লেখা কোরান ছিল না এই উনবিংশ শতকেও। তারা মুসলমান হয়েছিল, নামে মাত্রই । অধিকাংশ বাংলা মুসলমান গৃহেই তাদের আদি ধর্ম এবং পার্বনের চল ছিল ষোল আনা। অনেক বাঙালী মুসলমান গৃহেই কালীপুজো হত এই সেদিন ও। আমি নিজেই দেখেছি এরূপ অদ্ভুত জিনিস গ্রামে।
না -বাঙালী মুসলমানদের কোরান হাদিসে উৎসাহ ছিল না কোনদিন ই। এর সব থেকে বড় উদাহরন আরাকানের রাজসভায় প্রথম বাঙালী মুসলমান কবি (১৫৯৭-১৬৭৩) আলাউল। আলাউল বিখ্যাত পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থের জন্য। তার বাকী কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বদিউজ্জামাল কাব্যগ্রন্থটি বাদ দিলে বাকীগুলি ( সতী ময়না, সপ্ত পয়কর ) সবগুলিই হিন্দু কাব্য কাহিনী থেকে নেওয়া।
আর সেই জন্যেই উনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত একজন ও বাঙালী মুসলমান পাওয়া গেল না যিনি কোরান বাংলায় অনুবাদ করতে উৎসাহী হবেন। বাংলায় কোরান অনুদিত হল। কিন্ত করলেন একজন ব্রাহ্ম। গিরীশ ভাই। কেশব চন্দ্র সেনের অনুরোধে। তাও তাকে যেতে হল লক্ষ্ণৌতে। কারন বাংলাতে তিনি একজন ও কোরান বিশারদ পন্ডিত পেলেন না !
অর্থাৎ বাঙালী মুসলমানরা নামেই মুসলমান ছিল-কোরানে কি আছে না আছে-এদের কেওই কোনদিন জানার চেষ্টাও করে নি। ফলে ইসলামটা অধিকাংশ বাঙালী মুসলমানদের কাছে একটা ধর্মীয় আইডেন্টির বেশী কিছু ছিল না দীর্ঘদিন।
যাইহোক চৈতন্যের জন্মের আগেই অধিকাংশ বাঙালী নমঃ নমঃ করে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে-যদিও তারা আদৌ জানত না কোরান হাদিস কি বা মহম্মদ কে ছিলেন! সবটাই যেটুকু সুফী ইসলামের ভাল ভাল গল্প উপদেশ তারা শুনতো-সেই টুকু ইসলামি লোকগাথাই ছিল তাদের ইসলাম।
(৪)
চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৪) গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মই প্রথম বাঙালী হিন্দুত্বের একটা প্রথম আইডেন্টিটি। তিনি জাতিভেদ তুলে দিলেন। শুদ্রদের ডেকে নিলেন। সব হিন্দু আচার বর্জনের ডাক দিলেন। ফলে ইসলামের রথ ও আটকে গেল। যদি কেও মাটির ধর্মে সাম্য পায়, যে নিশ্চয় আরবের ধর্মে সাম্য খুঁজতে যাবে না ! সেই সময় আসলেই অনেকেই ইসলাম নিয়েছিলেন নামে মাত্রে। সেই অর্থে আরবের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না । ফলে এক বিপুল সংখ্যক মুসলিম আবার চৈতন্যের হরি-সংকীর্তনে হিন্দু ধর্মে ফিরে এল। চৈতন্য ভাগবতে এর উল্লেখ আছে।
গ্রামে গঞ্জে বাঙালীর হিন্দু ধর্মের ভিত্তি সেই বৈষ্ণব ধর্ম। এই সব পূজো অর্চনা চিরকালই জমিদারি শ্রেনীর অনুষ্ঠান। জমিদারদের এই পূজাপার্বনে নিম্ন বর্নের হিন্দুরা অংশ নিত ঠিকই-কিন্ত তাদের প্রানের ধর্ম ছিল হরি সংকীর্তন । এই ট্রাডিশন আজো চলছে। গ্রাম বাংলাতে অধিকাংশ লোক এখনো শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মেই আপ্লুত। রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ বা রবীন্দ্রনাথ এরা ভীষন আরবান। এতটাই শহুরে, যে শহরের বাইরে এদের খুঁজতে আজও কষ্ট হবে।
(৫)
আমি শুধু এটুকুই লিখতে চেয়েছিলাম, বাঙালীর মধ্যে হিন্দুত্ব বা ইসলামিয়তের আইডেন্টিটি খুব গভীরে না । বরং বাঙালীর প্রাণের অনেক গভীরে তার বাউল গান, তার ভাটিয়ালি গান। কিন্ত গত ত্রিশ বছরে পেট্রোডলারে অসংখ্য মাদ্রাসা গজানোয় এবং মসজিদ তৈরী করে বাঙালী মুসলমানের মনে এবং রক্তে আরবের বর্বর ইসলামের বিশাক্ত বীজ বপন করা হয়েছে। ফলে পাশাপাশি থাকা হিন্দুদের জীবন হয়েছে বিপন্ন। পরিত্রানের আশায় তারাও এখন হিন্দু ধর্মে তাদের আইডেন্টি, পরিচয় খুঁজছে। বিজেপি, হিন্দু সংহতি ইত্যাদি সংগঠনের তলায় নিজেদের সংঘবদ্ধ করছে।
সমস্যা হচ্ছে, হিন্দু ধর্মে তারা যে আইডেন্টি খুঁজছে, তা কিন্ত তাদের নয়!
শ্রী চৈতন্য কি মুসলমানদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন ? হরিদাস ঠাকুর (যবন হরিদাস) প্রথম জীবনে মুসলিম ছিলেন যিনি পরে বৈষ্ণব আন্দোলনের একজন শীর্ষ নেতা হবেন। চৈতন্য ভাগবতে দেখা যাচ্ছে হরিদাস ঠাকুরকে যখন ইসলাম ছাড়ার জন্য মৃত্যদন্ড দিল কাজী-উনি মোটেও ইসলামকে অসন্মান করেন নি। সেই কাজীকে একটা মুল্যবান কথা বলেছিন হরিদাস ঠাকুর। প্রকৃত ভক্তের শুধু একটাই ভগবান থাকে-আর সেই ভগবানকে ধর্মের নামে আলাদা করা যায় না ।
সুতরাং বৈষ্ণব ধর্মকে যদি বাংলার মূল হিন্দুধর্ম ধরি-তা মোটেও মুসলিমদের ঘৃণা করতে শেখায় না ! বরং চৈতন্য চরিত্রামৃত এবং চৈতন্য ভাগবতে অনেক উদাহরন পাওয়া যাবে যেখানে শ্রী চৈতন্য মুসলিমদেরও ভাই হিসাবে ডেকে নিয়ে একসাথে নামসংকীর্তন করেছেন-তারাও ক্রমে বৈষ্ণব ধর্মের কোলে ফিরে এসেছে!
আজকে যারা হিন্দু হিন্দু বলে আকাশ বাতাস মুখরিত করছেন, তারা পারবেন শ্রীচৈতন্যের মতন মুসলিমদের বুকে টেনে নিতে? তারাত শুধু ম্লেচ্ছ বলে বিষ ছড়াতেই ব্যস্ত। পারলে তাদেরকে ভারত থেকে বিদেয় করতে পারলে বাঁচে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ঘৃণাকে তারা হিন্দু ধর্ম বলে চালাতে চান। সেই ঘৃণা দেখলেও আঁতকে উঠতে হয়। এটা কোন ভবিষ্যতের পথ না । ওয়াহাবী ইসলামের কবল থেকে বাঙালী মুসলমানদের বাঁচাতে হলে, তাদেরকে চৈতন্যের প্রেমের পথই দেখাতে হবে। নইলে তারা তাদের ইসলামিক পরিচিতিটা আঁকরে ধরে আরো বেশী ওয়াহাবী মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করবে-যার পরিনাম আরো বেশী জঙ্গী, জেহাদি ও বোমা।
হিন্দু শব্দটা গোলমেলে, বিতর্কিত এবং বিটকেলে। তাই বিতর্ক, ধন্দ এবং ধান্দা এড়াতে প্রথমেই একটা সহজ সংজ্ঞা দিই। আমি হিন্দু ধর্ম বলতে কোন তাত্ত্বিক কথকথা, শাস্ত্র, ইতিহাস-কিছুই টানছি না এখানে। বাংলায় হিন্দুধর্ম বলতে আমি তাদের কথা বলছি-যারা মূর্তিপূজো যেমন দূর্গাপূজো, কালীপূজো করে, ঘরে দু একটি দেব দেবীর ছবি রাখে। বাপ মায়ের মৃত্যু হলে শ্রাদ্ধশ্রান্তি। বিয়েতে বামুন ডেকে মন্ত্র মার্জনা। কীর্ত্তনে, গাজন, জন্মাষ্ঠমীর বারো মাসে তেরো পার্বন। আমি সেই হিন্দু ধর্মের কথা বলছি এখানে, যা সবাই বোঝে। জানে। এর একটা দিক বৈদিক হিন্দুধর্ম -অন্যটা লোকায়েত প্যাগানিজম। ধরুন দুই এর মিশেল। ককটেল ধর্ম।
প্রশ্ন হচ্ছে এই যে বাঙালীগুলো ইদানিং নিজেদের হিন্দু হিন্দু বলে হর হর মহাদেব গাইছে সকাল বিকেল আর বিদেশী বলে মুসলিমদের তাড়াতে চাইছে-তা জানতে ইচ্ছে হয়, তাদের এই হিন্দু ধর্মটা কতটা স্বদেশী?
নিজেদের মধ্যে এদেরএই প্রকট হিন্দুত্বের ভাবটা যদি ইসলামের হাত থেকে বাঁচতে, একটা সারভাইভাল স্ট্রাট্রেজি হয়-তাহলে আমার কিছু বলার নেই । কারন সেক্ষেত্রে সেটা এক্সজিস্টেন্টিয়াল-অস্তিত্ববাদি অবস্থান- যুক্তির থেকে বাঁচার দায় বেশী। গ্রান্টেড।
কিন্ত এই সব বাঙালীরা যদি সত্য সত্যই ভেবে থাকে এই হিন্দু ধর্মটা তাদের আদি পুরুষের ধর্ম-ইসলামের মতন ইম্পোটেড মাদক না-সেটা হবে সত্যের ছয়লাপ। কারন এই "হিন্দু ধর্মের" প্রায় সবটাই বাঙালীর জীবনে বিদেশী আমদানী। একদম মুসলমানদের মতন ।
(২)
বাংলায় এই হিন্দু ধর্ম বুঝতে আমাদের একটু মহাভারত ঘাঁটতে হবে।
আচ্ছা মহাভারত যারা পরেছেন-তারা কি দেখেছেন মহাভারতের কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র মন্দিরে গিয়ে পূজো দিচ্ছে? মূর্তিপূজো করছে? কালীপূজো বা দূর্গাপূজো বা কোন পূজো করছে?
গোটা মহাভারতটাই ধর্ম বনাম অধর্মের যুদ্ধ। সেই যুগে ধর্ম বলতে কি বোঝাত, মহাভারতের ছত্রে ছত্রে পরিস্কার। তার জিস্ট হচ্ছে যক্ষপ্রশ্নের সংকলন । যক্ষ যখন যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন ধর্ম কি? যুদ্ধিষ্ঠির কোথাও কি বলেছিলেন ধর্মপালন মানে মন্দিরে গিয়ে যজ্ঞ করা? পূজো করা?
যুধিষ্ঠির উত্তর দেন বুদ্ধিমান লোকের কর্মই ধর্ম। এবং গোটা মহাভারত জুরে কোথাও মূর্তিপূজো পাওয়া যাবে না । অশ্বমেধ যজ্ঞের উল্লেখ আছে অনেকবার। কিন্ত যাগ যজ্ঞ পূজা অর্চনাকে কেও ধর্মের সাথে গোলান নি। যুষ্ঠিষ্ঠির যক্ষরাজকে যে উত্তর দিয়েছিলেন -অর্থাৎ বুদ্ধিমান লোকের মতন কর্মপালনই ধর্ম-তাই আমরা দেখবো মহাভারত জুরে। ভীষ্ম তার প্রতিজ্ঞাপালনে সুবদ্ধ-কর্ন তার দানকর্মের মগ্ন। কেও বর্ণভেদ মানছেন-কেও বর্ণভেদের বিরোধিতা করছেন কারন তা অমানবিক। সেগুলোই ছিল তাদের ধর্ম। লক্ষ্যনীয় যে মহাভারতের কথাকার "ধর্ম পালনের" প্রসঙ্গে বর্নভেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহেও উস্কানি দিয়েছেন-আবার প্রধান চরিত্রদের বর্নভেদ মানিয়েওছেন।
কোথায় মূর্তিপূজো বা পূজো অর্চনা আছে মহাভারতে? কোথাও নেই ।
আসল সত্য হল এই মূর্তিতুলে পূজো অর্চনাটাও ভারতে ইম্পোর্টেড। বহিরাগত হুনদের কাছ থেকে শেখা (০০৭০-০০৮০) । সেটা মহাভারতের যুগের অনেক পরে এসেছে। মহেঞ্জোদারোতে যে যোগী মূর্তি পাওয়া গেছে, সেটা সম্ভবত জৈন যোগগুরুর। এবং আরেকটা ভুল ধারনা মন থেকে ভাঙা দরকার। জৈন ধর্ম ভারত কেন পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম। ঋকবেদের ও আগে এর অস্তিত্ব ছিল। এটি মোটেও হিন্দু ধর্মসংস্কার বা বৈদিক ব্রাহ্মন্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না। উৎসাহী পাঠকরা জৈন ধর্ম নিয়ে আমার আগের লেখাটা দেখতে পারেন ( http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=28847 )। সুতরাং বৈদিক হিন্দু ধর্ম, ঋকবেদের ধর্ম আদি সনাতন ধর্ম -এসব ভুল ধারনা ভাঙা দরকার।
বৈদিক হিন্দু ধর্মের মূল চারযোগে। অথচ এই যোগ এবং সাধনার কোন ধারনাই ঋকবেদে নেই। ঋকবেদে শুধুই আচার অনুষ্ঠান, স্তোত্র, মন্ত্র। যোগ সাধনা নিঃসন্দেহে জৈন ধর্ম থেকে বৈদিক ধর্মে ঢুকেছে। ঠিক যেমন বৌদ্ধ পন্ডিতদের চাপে বৈদিক ধর্মের সব থেকে সুন্দর সাহিত্য উপনিষদের জন্ম হয়।
প্রায় দেখি বাংলাদেশের অনেক হিন্দু নিজেদের সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী বলে গর্ব করেন। তা এই সনাতন ধর্ম বলতে তারা যা পালন করেন, তা কতটা দেশী আর কতটা বিদেশী মাল? যদি ধরে নিই সনাতম ধর্মের একটা রূপরেখা আমরা মহাভারতে পাই-তাহলে তারা যেসব মূর্তি তুলে পূজো অর্চনা করছেন, পালা পার্বনে অংশ নিচ্ছেন-তা কি আদৌ কোনদিন সনাতন ধর্মে ছিল?
একটু পড়াশোনা করলেই জানা যেত যে বাংলায় যেসব দেবদেবী পূজিত হয়-শিব, দূর্গা কালী ইত্যাদি-এদের অধিকাংশই শংকর প্রজাতির দেবতা। কিছুটা দেশী, কিছুটা বৈদিক পুরান-সব ঘেঁটে ঘ হয়ে এই সব দেবদেবীরা বিবর্তিত। এর সাথে মহাভারতের সনাতন ধর্মের সম্পর্ক নেই ।
(৩)
বল্লাল সেনের (1160–1179) আগে বাংলায় বৈদিক ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। কোন ব্রাহ্মন ক্ষত্রিয় ছিল না বাংলায়। অনেকে বলবেন প্রথম গৌড়ীয় রাজা শশাঙ্ক ছিলেন শৈব। এই ব্যপারটা গোলমেলে। এটা ঠিক শশাঙ্কের আমলের এবং তার আগের অনেক শৈব মূর্তি বাংলার মাটি খুঁড়লে এখনো ওঠে। আমি যেখানে থাকতাম সেখান থেকেও দেখতাম মাটির তলা থেকে প্রাচীন শৈব মূর্তি উদ্ধার হত। কিন্ত ইনি বৈদিক শিব নন। ঠিক যেমন মহেঞ্জোদারোর যোগী বৈদিক শিব নন। শিব আসলে উর্বরাশক্তির লিঙ্গ দেবতা এবং যোগী দেবতার শংকঢ়। জায়গায় এর নানা ভ্যারিয়েশন। পরে ইনি বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ঢুকে যান। লিঙ্গ দেবতার ধারনা পৃথিবীর সব দেশের প্যাগানদের মধ্যে ছিল । মেসোপটেমিয়া থেকে রোম সর্বত্র লিঙ্গ দেবতার ধারনা ছিল। সুতরাং কোন লিঙ্গ দেবতা কেও পূজো করতো মানেই সে বৈদিক ধর্মের অনুসারী তা কিন্ত নয়। লিঙ্গদেবতার ধারনা সর্বব্যাপী।
বল্লাল সেনের আগে পাল রাজাদের আমলে বাংলাতে বৌদ্ধ এবং লোকায়েত অনেক ধর্মই ছিল-যার মধ্যে তান্ত্রিক, কালীভক্ত এবং নানান স্থানীয় প্যাগান সংস্কৃতিই পাওয়া যাবে। বৌদ্ধ ছিল রাজধর্ম। কিন্ত কোন জাতিভেদ পাওয়া যাবে না ।
সেন রাজারা এসে প্রথমে বাংলার সব প্রজাদের শুদ্র বানাইলেন! কনৌজ থেকে ব্রাহ্মন ধরে এনে তাদের গ্রাম দিয়ে বাংলায় ব্রাহ্মন্য ধর্ম, বৈদিক মতে পূজা অর্চনা চালু করলেন। ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি করতে এদেরকে অনেকগুলি গ্রাম দিলেন। কুলীন ব্রাহ্মনদের অসংখ্য বিবাহে উৎসাহ দেওয়া হল যাতে ব্রাহ্মনদের বংশ বৃদ্ধি হয়। এরাই আজকের চট্টোপাধ্যায় ( যারা চিটাগঞ্জের কাছে গ্রাম পেয়েছিলেন ) বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি উপাধ্যায়।
এক অদ্ভুত হিন্দু যুগের সুচনা হল বাংলায়। কিছু ব্রাহ্মন। বাকী সবাই শুদ্র। বাংলাতে আজো ক্ষত্রিয় বৈশ্য নেই । বাংলার ব্যবসায়ী শ্রেনী সাহারাও শুদ্র আবার বোসের মতন রাজকরনিক শ্রেনীও শুদ্র!!
পাল রাজাদের আমলে যারা ধর্মীয় সাম্য উপভোগ করছিলেন, তারা হঠাৎ করে বর্নহিন্দুর এই শুদ্র স্টাটাসটা মানবেন কেন ? না । বাংলা কখনোই সেন রাজাদের মেনে নেয় নি। বল্লাল সেনের আমলে তার এই জোর করে ব্রাহ্মন্য হিন্দুধর্ম চাপানোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয় চারিদিকে। এর মধ্যে বিখ্যাত ছিল বর্ধমানের কৃষক-জেলে বিদ্রোহ। সুন্দরবন এলাকাতে বিদ্রোহ করেন কোম্মপাল (১১৯৬) । তিনি সুন্দরবন এলাকাতে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
অবস্থা বেগতিক দেখে লক্ষণ সেন, বাংলার শুদ্রদের মধ্যে ২৭ টি কাস্টকে উত্তমর্ন শুদ্র স্টাটাস দিলেন ! কিন্ত তাতে কি আর শেষ রক্ষা হয়? বাংলার জনগন তখন এই বহিরাগত ব্রাহ্মন আর সেনদের প্রতি বেজায় বিক্ষুব্ধ।
ফলে মাত্র দুহাজার সৈন্য নিয়ে বখতিয়াল খিলজি যখন নবদ্বীপ আক্রমন করলেন (১২০২), লক্ষন সেনের পালানো ছাড়া আর কোন পথ ছিল না ।
এর পরবর্তীকালে বাংলায় লোকজন দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করতে থাকে ব্রাহ্মন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণায়। হজরত শাহ জালালের (১৩০৬-) মতন সুফীদের প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে বাঙালী দলে দলে ইসলাম গ্রহন করতে থাকে চোদ্দশ শতক পর্যন্ত ( শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মের আগে পর্যন্ত)।
তবে বাঙালীর ইসলাম ও এক অদ্ভুত ধর্ম। বাঙালী মুসলমান আরবিক জানত না কোনদিন ই -বাংলাতে লেখা কোরান ছিল না এই উনবিংশ শতকেও। তারা মুসলমান হয়েছিল, নামে মাত্রই । অধিকাংশ বাংলা মুসলমান গৃহেই তাদের আদি ধর্ম এবং পার্বনের চল ছিল ষোল আনা। অনেক বাঙালী মুসলমান গৃহেই কালীপুজো হত এই সেদিন ও। আমি নিজেই দেখেছি এরূপ অদ্ভুত জিনিস গ্রামে।
না -বাঙালী মুসলমানদের কোরান হাদিসে উৎসাহ ছিল না কোনদিন ই। এর সব থেকে বড় উদাহরন আরাকানের রাজসভায় প্রথম বাঙালী মুসলমান কবি (১৫৯৭-১৬৭৩) আলাউল। আলাউল বিখ্যাত পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থের জন্য। তার বাকী কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বদিউজ্জামাল কাব্যগ্রন্থটি বাদ দিলে বাকীগুলি ( সতী ময়না, সপ্ত পয়কর ) সবগুলিই হিন্দু কাব্য কাহিনী থেকে নেওয়া।
আর সেই জন্যেই উনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত একজন ও বাঙালী মুসলমান পাওয়া গেল না যিনি কোরান বাংলায় অনুবাদ করতে উৎসাহী হবেন। বাংলায় কোরান অনুদিত হল। কিন্ত করলেন একজন ব্রাহ্ম। গিরীশ ভাই। কেশব চন্দ্র সেনের অনুরোধে। তাও তাকে যেতে হল লক্ষ্ণৌতে। কারন বাংলাতে তিনি একজন ও কোরান বিশারদ পন্ডিত পেলেন না !
অর্থাৎ বাঙালী মুসলমানরা নামেই মুসলমান ছিল-কোরানে কি আছে না আছে-এদের কেওই কোনদিন জানার চেষ্টাও করে নি। ফলে ইসলামটা অধিকাংশ বাঙালী মুসলমানদের কাছে একটা ধর্মীয় আইডেন্টির বেশী কিছু ছিল না দীর্ঘদিন।
যাইহোক চৈতন্যের জন্মের আগেই অধিকাংশ বাঙালী নমঃ নমঃ করে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে-যদিও তারা আদৌ জানত না কোরান হাদিস কি বা মহম্মদ কে ছিলেন! সবটাই যেটুকু সুফী ইসলামের ভাল ভাল গল্প উপদেশ তারা শুনতো-সেই টুকু ইসলামি লোকগাথাই ছিল তাদের ইসলাম।
(৪)
চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৪) গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মই প্রথম বাঙালী হিন্দুত্বের একটা প্রথম আইডেন্টিটি। তিনি জাতিভেদ তুলে দিলেন। শুদ্রদের ডেকে নিলেন। সব হিন্দু আচার বর্জনের ডাক দিলেন। ফলে ইসলামের রথ ও আটকে গেল। যদি কেও মাটির ধর্মে সাম্য পায়, যে নিশ্চয় আরবের ধর্মে সাম্য খুঁজতে যাবে না ! সেই সময় আসলেই অনেকেই ইসলাম নিয়েছিলেন নামে মাত্রে। সেই অর্থে আরবের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না । ফলে এক বিপুল সংখ্যক মুসলিম আবার চৈতন্যের হরি-সংকীর্তনে হিন্দু ধর্মে ফিরে এল। চৈতন্য ভাগবতে এর উল্লেখ আছে।
গ্রামে গঞ্জে বাঙালীর হিন্দু ধর্মের ভিত্তি সেই বৈষ্ণব ধর্ম। এই সব পূজো অর্চনা চিরকালই জমিদারি শ্রেনীর অনুষ্ঠান। জমিদারদের এই পূজাপার্বনে নিম্ন বর্নের হিন্দুরা অংশ নিত ঠিকই-কিন্ত তাদের প্রানের ধর্ম ছিল হরি সংকীর্তন । এই ট্রাডিশন আজো চলছে। গ্রাম বাংলাতে অধিকাংশ লোক এখনো শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্মেই আপ্লুত। রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ বা রবীন্দ্রনাথ এরা ভীষন আরবান। এতটাই শহুরে, যে শহরের বাইরে এদের খুঁজতে আজও কষ্ট হবে।
(৫)
আমি শুধু এটুকুই লিখতে চেয়েছিলাম, বাঙালীর মধ্যে হিন্দুত্ব বা ইসলামিয়তের আইডেন্টিটি খুব গভীরে না । বরং বাঙালীর প্রাণের অনেক গভীরে তার বাউল গান, তার ভাটিয়ালি গান। কিন্ত গত ত্রিশ বছরে পেট্রোডলারে অসংখ্য মাদ্রাসা গজানোয় এবং মসজিদ তৈরী করে বাঙালী মুসলমানের মনে এবং রক্তে আরবের বর্বর ইসলামের বিশাক্ত বীজ বপন করা হয়েছে। ফলে পাশাপাশি থাকা হিন্দুদের জীবন হয়েছে বিপন্ন। পরিত্রানের আশায় তারাও এখন হিন্দু ধর্মে তাদের আইডেন্টি, পরিচয় খুঁজছে। বিজেপি, হিন্দু সংহতি ইত্যাদি সংগঠনের তলায় নিজেদের সংঘবদ্ধ করছে।
সমস্যা হচ্ছে, হিন্দু ধর্মে তারা যে আইডেন্টি খুঁজছে, তা কিন্ত তাদের নয়!
শ্রী চৈতন্য কি মুসলমানদের ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন ? হরিদাস ঠাকুর (যবন হরিদাস) প্রথম জীবনে মুসলিম ছিলেন যিনি পরে বৈষ্ণব আন্দোলনের একজন শীর্ষ নেতা হবেন। চৈতন্য ভাগবতে দেখা যাচ্ছে হরিদাস ঠাকুরকে যখন ইসলাম ছাড়ার জন্য মৃত্যদন্ড দিল কাজী-উনি মোটেও ইসলামকে অসন্মান করেন নি। সেই কাজীকে একটা মুল্যবান কথা বলেছিন হরিদাস ঠাকুর। প্রকৃত ভক্তের শুধু একটাই ভগবান থাকে-আর সেই ভগবানকে ধর্মের নামে আলাদা করা যায় না ।
সুতরাং বৈষ্ণব ধর্মকে যদি বাংলার মূল হিন্দুধর্ম ধরি-তা মোটেও মুসলিমদের ঘৃণা করতে শেখায় না ! বরং চৈতন্য চরিত্রামৃত এবং চৈতন্য ভাগবতে অনেক উদাহরন পাওয়া যাবে যেখানে শ্রী চৈতন্য মুসলিমদেরও ভাই হিসাবে ডেকে নিয়ে একসাথে নামসংকীর্তন করেছেন-তারাও ক্রমে বৈষ্ণব ধর্মের কোলে ফিরে এসেছে!
আজকে যারা হিন্দু হিন্দু বলে আকাশ বাতাস মুখরিত করছেন, তারা পারবেন শ্রীচৈতন্যের মতন মুসলিমদের বুকে টেনে নিতে? তারাত শুধু ম্লেচ্ছ বলে বিষ ছড়াতেই ব্যস্ত। পারলে তাদেরকে ভারত থেকে বিদেয় করতে পারলে বাঁচে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ঘৃণাকে তারা হিন্দু ধর্ম বলে চালাতে চান। সেই ঘৃণা দেখলেও আঁতকে উঠতে হয়। এটা কোন ভবিষ্যতের পথ না । ওয়াহাবী ইসলামের কবল থেকে বাঙালী মুসলমানদের বাঁচাতে হলে, তাদেরকে চৈতন্যের প্রেমের পথই দেখাতে হবে। নইলে তারা তাদের ইসলামিক পরিচিতিটা আঁকরে ধরে আরো বেশী ওয়াহাবী মুসলমান হওয়ার চেষ্টা করবে-যার পরিনাম আরো বেশী জঙ্গী, জেহাদি ও বোমা।
4 comments:
apni kotobar Ramayan ar Mahabharat porechen ?
এই প্রবন্ধটি স্কুল বা কলেজে পাঠ্য হওয়া উচিত
Amio thik etai bhabchilam..
কেশব চন্দ্র সেন কে ?
তার সম্বন্ধে কিছু লিখা নাই ।
আর তিনি কেনই বা কোরান অনুবাদ করতে বললেন
তাও জানার দরকার ছিল।
Post a Comment