অক্সিজেন, রেমডেজিভির, হাসপাতাল বেড, ভেন্টিলেটর- সব কিছুর জন্য হাহাকার-কিভাবে হল এই পরিস্থিতি?
-বিপ্লব পাল, ৪/১৭/২০২১
(১)
এন্টিভ্যাইরাল ড্রাগ রেমডেজিভির, যা একমাত্র এফ ডি এ এপ্রুভড এন্টিভাইরাল মেডিকেশন ( যদিও এর কার্যকারীতা এখনো নানান ভাবেই বিতর্কিত। কিন্ত এ ছাড়া আর কোন এপ্রুভড এন্টিভাইরাল ড্রাগ বাজারে নেই ) -ভারতের সব সংবাদের শিরোনামে। কারন হঠাৎ করে এত ডিম্যান্ড বেড়ে গেছে, সাপ্লাই নেই। ভারতে গিলিয়াডের এই ড্রাগ বানানোর লাইসেন্স পেয়েছে সিপলা এবং হেটেরো ড্রাগ। সিপলা মাসে ১০, লাখ ডোজ বানাচ্ছে। রেমডেজিভির বানানো খুব কঠিন। ৭০ টি কাঁচামাল। ৬ মাসে ২৫ টি কেমিক্যাল প্রসেস। সিপলা গত কয়মাসে এপ্রক্সিমেটলি ৫০ লাখ ডোজ বানিয়েছে। কেউ ভেন্টিলেশনে না গেলে রেমডেজিভির দেওয়া উচিত না। কতলোক ভারতে গত চারমাসে ভেন্টলেশনে গেছে? এক্সাক্ট নাম্বার পাওয়া যাবে না। মোটামুটি আন্দাজ করা যেতে পারে। যারা ভেন্টিলেশনে যায়, তার ২০-৩০% লোক মারা যাচ্ছে। সুতরাং গত চারমাসে যদি ধরি গড়ে ২০০জন করোনার জন্য ভারতে মারা গেছে-তাহলে ২৪-২৫,০০০ টোটাল ডেথ। টোটাল ভেন্টলেশন কেসের সংখ্যা গত চারমাসে কমই ছিল- ১ লাখের কাছাকাছি হবে। সুতরাং মেরেকেটে ১০ লাখের বেশী ডোজ ব্যবহার হয় নি। তাহলে সিপলার বাকী ৪০ লাখ রেমডেজিভির ডোজ গেল কোথায়?
একটা অংশ ভাল হাসপাতাল গুলো সঙ্গত কারনেই স্টক করে রেখেছে। যার জন্য ভাল হাসপাতাল গুলোতে যারা ভর্তি হচ্ছেন, তারা রেমডেজিভির পাচ্ছেন। কিন্ত সেটাও খুব বেশী হলে আরো ১০ লাখ ডোজ হবে ( প্রাক্টিক্যালি ৫ লাখ হবে কি না সন্দেহ)। তাহলে বাকী ৩০ লাখ ডোজ কোথায়?
সিপলার মালিক, ভারতের হেলথ মিনিস্ট্রি বলছে রেমডেজিভিরের যথেষ্ট মিসউইজ হয়েছে। ভেন্টিলেশনে না গেলেও, জাস্ট কোভিডে জ্বর হলেই আগেভাগে লোককে রেমডেজিভির দেওয়া হয়েছে। যা দুটো কারনে বেশ ভয়ংকর। এক, এখন, যখন দরকার সব থেকে বেশী, তখন পাওয়া যাচ্ছে না। দুই, রেমডেজিভিরের যথেষ্ট বাজে সাইডএফেন্ট আছে। যেহেতু সেই তুলনায়, এই ওষুধের কার্যকারিতার যথেষ্ট ভাল কোন প্রমান হু এর স্টাডিতে পাওয়া যায় নি, সেহেতু হু বা ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এর ব্যবহারের পক্ষে না। একদম দরকার না হলে এই ওষুধ নেওয়া উচিত না।
অর্থাৎ এটি সম্পূর্ন ডাক্তার-মানুষ সৃষ্ট ক্রাইসিস। এবং সরকারও সম্পূর্ন অপ্রস্তুত ছিল-ভাবেই নি সেকন্ড ওয়েভ আসবে। ফলে রেমডেজিভিরের মিসইজ এদ্দিন ব্যান করেনি। মাত্র দুদিন আগে নিয়ম করেছে যে একমাত্র হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কেসেই দেওয়া হবে।
কিন্ত টু লেইট। বর্তমানে ডেইলি ১,৫০,০০০ কেস। মানে প্রায় ১০% বা ডেইলি ১০-১৫,০০০ কেস ভেন্টলেশনে যাবে। অর্থাৎ প্রতিদিন অন্তত ৫০,০০০ ডোজের সাপ্লাই দরকার। সিপ্লার প্রোডাকশন এখন ৩০,০০০ -বলছে ৬০,০০০ ডেইলি হয়ে যাবে। হেটারো ড্রাগের প্রোডাকশন ডেটা নেই। কিন্ত ডেইলি ১,৫০,০০০ কেস ধরা পড়লে , তার ১০% ভেন্টিলেশনে গেলে, রেমডেজিভির সবার পাওয়া উচিত। ক্রাইসিস থাকা উচিত না। অবশ্য কালোবাজারি, হাসপাতালগুলো হোর্ডিং করলে অন্যকেস। তবে এখন এটি আর ফার্মাসিগুলিকে দেওয়া হচ্ছে না। এই সিদ্ধান্ত আগে নিলে, এই পরিস্থিতি আসার কথাই না। মনে হয় দুই সপ্তাহের মধ্যে সাপ্লাই নর্মাল হবে। কিন্ত আগামী দুই সপ্তাহই সবার জন্য ভয়ংকর হতে চলেছে!
(২)
এবার আসি অক্সিজেন ক্রাইসিস নিয়ে। ১৫,০০০ লোক ডেইলি ভেন্টিলেশনে গেলে এবং তারা ১০ দিন ভেন্টিলেশনে থাকলে, টোটাল ১,৫০,০০০ লোকের প্রতিদিন অক্সিজেন দরকার। ভারতে, আজকের হিসাব অনুযায়ী ৫০,০০০-৬০,০০০ লোক ভেন্টিলেশনে আছে। আগামী দিনে ১,৫০,০০০ লোক ভেন্টিলেশনে গেলে গড়ে ৫০০০ টন অক্সিজেন লাগবে। এই মুহুর্তে শুধু মহারাষ্ট্রেই চাহিদা ১২৫০ টনের কাছাকাছি। ভারতের প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি ৭০০০ টন। সুতরাং এখানেও সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে। অনেকেই অক্সিজেন সিলিন্ডার পাচ্ছেন না। কারন সমস্যা ডিস্ট্রিবিউশনে। যথেষ্ট্র ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্ক নেই -যা আছে তাতে মোটে ডেইলি ২০০০ টন ডিস্ট্রিবিউট করা যায়। অর্থাৎ এখন ভারতের উচিত ক্রায়োট্যাঙ্ক ইম্পোর্ট করা। কিন্ত দেখলাম সরকার অক্সিজেনই ইম্পোর্ট করছে! আমি ব্যপারটা বুঝতে পারছি না! কারন দেশের অক্সিজেন ডিস্ট্রিবিউশন ইনফ্রাতেই সমস্যা আছে। সরকারের উচিত ছিল আগের বছর কোম্পানীগুলিকে টাকা দেওয়া এই সমস্যার সমাধানে। এখন, এগেইন টু লেট। আর যদি ডেইলি কেস আরো বাড়ে? তাহলে শুধু অক্সিজেনের অভাবে ডেইলি ১০,০০০+ লোক মারা যেতে পারে। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি কিন্ত আসতেই পারে।
(৩)
হাসপাতাল বেড। আগেই লিখেছি মোটামুটি ১,৫০,০০০ কোভিড বেড লাগছে যদি বর্তমান রেটকে পিক ধরা হয়। ভারতে টোটাল হাসপাতাল বেডের সংখ্যা প্রায় ১৯-২০ লাখ। আই সি ইউ বেড ১ লাখ। সুতরাং বেডের সমস্যা হওয়া উচিত না। তাহলে? আসল সমস্যা ভেন্টিলেটর শর্টেজ!
ভেন্টলেটর এপ্রিল ২০২০ তে ছিল ৪৬,০০০। গত বছর সরকার ৬১,০০০ ভেন্টিলেটর অর্ডার করে । এর মধ্যে মোটে ২৩,০০০ ইন্সটলড। বাকী ৩৭,০০০? কেউ বলছে দুর্নীতির জন্য খারাপ মাল সাপ্লাই। কেউ বলছে পার্টস নেই। সুতরাং ভারতে মেরে কেটে ৬৬,০০০ ভেন্টিলেটর আছে। এবার যদি ১,৫০,০০০ করে ডেইলি কেস ধরা পরে , ১০ দিন বাদে টোটাল ভেন্টিলেশনে যাওয়া লোকের সংখ্যা দাঁড়াবে ১,৫০,০০০ [ কারন ১০% অফ টোটাল কেস ভেন্টিলেশনে যাচ্ছে] । অর্থাৎ যা দরকার শুধু বর্তমান রেটেই তার ৬০% শর্টেজ হবে। মানে মৃত্যু মিছিলের এখনো কিছুই হয় নি। বাকী যে ৩৭,০০০ ভেন্টিলেটর ইন্সটল হয় নি , বা খারাপ হয়ে গেছে সেগুলো দ্রুত এই দু দিনে ইন্সটল করা দরকার। দরকার হলে সব ইঞ্জিনিয়ারদের এই কাজে লাগানো হোক। এছাড়াও সিপ্যাপ বা বাইপ্যাপ ডিভাইসগুলিকে হ্যাক করে মিনি ভেন্টিলেটর বানানো হোক। যাদের কম অক্সিজেন সাপ্লাই দরকার তাদের ভেন্টিলেশন সিপ্যাপ বা বাইপাপ ডিভাইস দিয়েও করা সম্ভব।
ভেন্টিলেটরের অভাবে অনেক লোক মরতে চলেছে যদি ১,৫০,০০০+ ডেইলি কেস চলতে থাকে। কিন্ত এই পরিস্থিতি আটকানো সম্ভব- এখন সব ইঞ্জিনিয়ার যদি হাত চালিয়ে ভেন্টিলেটর তৈরী করে। সিপ্যাপ, বাইপ্যাপ ডিভাইসগুলি হ্যাক করে কিছুটা নমিন্যাল কেসগুলকে সাপোর্ট দেওয়া হয়।
কিন্ত প্রশ্ন উঠবেই! সরকার ৬১,০০০ ভেন্টিলেটরের অর্ডার দিয়েই খালাস? দেখবেও না ৭০% ইন্সটল পর্যন্ত হয় নি? এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের খুব বাজে নেগলিজেন্স।
আশা করি ভারত এই দুর্দিন কাটিয়ে উঠবে। কিন্ত এই ক্রিটিক্যাল টাইম ডায়ালোগ বাজি আদর্শবাজির সময় না। সবাইকে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে, অঙ্ক করেই, প্ল্যান করেই এগোতে হবে। আমি দেখালাম, ভারতে রিসোর্সের সমস্যা নেই। সমস্যা প্ল্যানিং, এক্সিকিউশন এবং ডিস্ট্রিবিউশনে।
No comments:
Post a Comment