Saturday, April 24, 2021

ভ্যাক্সিন কি প্যান্ডেমিক ঠেকাচ্ছে? ভ্যাক্সিনেশনের ক্ষেত্রে ভারতের ব্যর্থতার কারন কি?

 ভ্যাক্সিন কি প্যান্ডেমিক ঠেকাচ্ছে? ভ্যাক্সিনেশনের ক্ষেত্রে ভারতের ব্যর্থতার কারন কি?

বিপ্লব পাল ৪/২৪/২০২১
(১)
কেন্টাকির একটি নার্সিং হোম এখন আমেরিকার সংবাদ শিরোনামে। এই নার্সিং হোমের এক আনভ্যাক্সনিনেটেড নার্স কোভিড ইনফেক্টেড হওয়ার কারনে সেখানকার ৪৬ জন বৃদ্ধবৃদ্ধা করোনা আক্রান্ত হয়। যাদের ৯০% এর ফাইজারের দুটি ডোজ নেওয়া ছিল। যেটা দেখা যাচ্ছে যারা ভ্যাক্সিন নিয়েছিল, তাদের মধ্যে মাত্র তিনজনকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। বাকী ভ্যাক্সিনেটেড বৃদ্ধবৃদ্ধাদের করোনা হলেও সামান্য গলা খুস খুস বা সর্দি গলাব্যাথা উপসর্গর বেশী কিছু হয় নি।
ভারতে গত ১৬ ই এপ্রিল পাওয়া খবর পর্যন্ত ভ্যাক্সিনেটেড লোকজনদের মধ্যে ২৪,০০০ করোনাতে আক্রান্ত। কিন্ত তার মানে কি ভ্যাক্সিন কাজ করছে না?
বরং উলটো। ভারতে একটি ডোজ নিয়েছে এটলিস্ট ১০ কোটি মানুষ। সুতরাং সংখ্যার হিসাবে ২৪,০০০/ ১০ কোটি খুবই কম- ১০ লাখে মাত্র ২৪ জন। যেখানে ভ্যাক্সিনেশন না থাকলে, ১০ লাখে অন্তত ৮০,০০০ লোক ইনফেক্টেড হচ্ছে।
আমেরিকা, বৃটেন, চিলি, জার্মানির ডেটা ঘেঁটে একটা সামারী করলে দাঁড়াচ্ছে- ( এটা খুব রাফ ক্যালকুলেশন )
ভ্যাক্সিনেশন না থাকলে
১০০০ জনে একজন করোনাতে অসুস্থ হচ্ছেন। যারা অসুস্থ হচ্ছেন, তাদের ১০%কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
সিঙ্গল ডোজ -
৫০০০ এ একজন কোভিডে অসুস্থ হচ্ছে। অসুস্থদের মধ্যে ৫%কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
ডবল ডোজ-
১৫,০০০ এর একজন অসুস্থ। অসুস্থদের মধ্যে ২%কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
এখানে দুটো জিনিস গুরুত্বপূর্ন।
এক, ভ্যাক্সিনেশন হলেও কোভিড-১৯ হতেই পারে। কিন্ত সম্ভাবনা প্রায় ১/৫ ভাগ কম ( ডবল ডোজে ১/১৫)। কিন্ত সেটা হলেও, হাসপাতালে যাওয়ার মতন পরিস্থিতি হবে না। ভ্যাক্সিনেশন নেওয়ার পরেও কোভিড-১৯ হয়ে হাসপাতাল যাওয়ার কারন অনেক কিছু হতে পারে- একটা মূল কারন বেসিক ইমিউনিটি দুর্বল কারন ভিটামিন ডি এবং অন্যান্য নিউট্রিয়েন্টের ডেফিসিয়েন্সি।
দুই , যত কোভিড মিউটান্ট বেড়োবে , ভাক্সিনের এফিসিয়েন্সি কমবে। যেমন ফাইজার এবং মর্ডার্নার ক্ষেত্রে দেখা গেছে এটি বৃটিশ, ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে এফেক্টিভ। কিন্ত সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টএর বিরুদ্ধে না। এর মানে হল, মিউটান্টদের সাথে পাল্লা দিতে প্রতি বছর নতুন বুস্টার ডোজ লাগবে। ফ্লু ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমেরিকা এটাই করে । প্রতি বছর নতুন ভ্যাক্সিন লাগে। করোনার বিরুদ্ধে এফেটিভ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বছরে একবার করে ভ্যাক্সিন নিতেই হবে। অর্থাৎ প্রাক্টিক্যালি কোন একটা দেশকে করোনার বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ সিস্টেম গড়তে প্রতি বছর ৩ মাসের মধ্যে সেই দেশের সকল লোককে ভ্যাক্সিনেশন করতেই হবে।
পৃথিবীতে ভ্যাক্সিনেশনে সব থেকে সফল দেশ ইস্রায়েল। দেশটা ছোট-মাত্র এককোটি লোক। তারা ফেব্রুয়ারীর মধ্যেই ৬০+ সবার ভ্যাক্সিনেশন করেছে। বর্তমানে দেশটির ৮৭% ভ্যাক্সিনেশন সম্পূর্ন। ফলে ইস্রায়েল অফিশিয়ালি প্যান্ডেমিক মুক্ত। সেখানে করোনার কারনে হসপিটালাইশনের সংখ্যা ৯৯% কমে গেছে।
কিন্ত ভারত ইস্রায়েল না। ১৩০ কোটির দেশ। সেখানে যদি তিনমাসের মধ্যে ভ্যাক্সিনেশন সম্পূর্ন করতে হয় অন্তত ৮০ কোটির লোকের -সেই পরিমান প্রস্তুতি সরকারের ছিল না। কেন ছিল না?
(২)
এর উত্তর শুধু বিজ্ঞান দিয়ে পাওয়া যাবে না। রাজনীতির মনোবিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে।
তার আগে একটা ছোট্ট তথ্য দিই। ভারতের ১৩০ কোটি লোকের ভ্যাক্সিনেশন করা যে মহাযজ্ঞ এবং তার জন্য সরকারের প্রভুত সাহায্য দরকার এই কথাটা কিন্ত জুন মাস থেকে সিরাম ইন্সটিউটের সি ই ও আদার পুনেওয়ালা বলে আসছিলেন। উনি বারবার বলেছেন গোটা ভারতের যা ভ্যাক্সিন তৈরীর ক্যাপাসিটি তাতে বছরে ৩০ কোটি বেশী লোকের ভ্যাক্সিনেশন সম্ভব না। যেখানে প্রাক্টিক্যাল নিড প্রায় ৩ মাসে ১৩০ কোটি-মানে ক্যাপাসিটি ১৬ গুন বাড়ানো দরকার। এই জন্য তিনি সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেছেন। এগুলো গুগল করলেই পাবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে সরকার শোনে নি কেন? মোদিকে শুধু গালাগাল দেওয়ায় যায়। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে এই সেকেন্ড ওয়েভের আগে বিরোধিরাই বা কি করছিলেন? তারা কি ভারতের ভ্যাক্সিনেশন সমস্যা নিয়ে আগে আঙুল তুলেছেন? কিম্বা জনগনের সামনে এটা নিয়ে এসেছেন যে ইম্পোর্ট করা ৬৬,০০০ ভেন্টিলেটরের মধ্যে মাত্র ৩৪,০০০ কাজ করছে? কিম্বা ১২৪ টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের জন্য সরকার টাকা বরাদ্দ করেছিল-কিন্ত মাত্র ২৩ টি এখনো পর্যন্ত অপারেশনাল। এগুলি মোদির ব্যর্থতা ঠিকই। কিন্ত পশ্চিম বঙ্গের ভোটের বাজারে এই সেকেন্ড ওয়েভ আসার আগে পর্যন্ত কখনো দেখেছেন মমতা ব্যানার্জি এই ইস্যুগুলো তুলে মোদিকে বিদ্ধ করেছেন?
আসল সত্য হচ্ছে সব নেতার মধ্যেই বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তার অভাব আছে। সেকেন্ড ওয়েভ আসবে সেটা ভারতের বিজ্ঞানীরা অক্টবর থেকে বলছেন। নভেম্বর মাসে কেরলাতে সেকেন্ড ওয়েভ এসে গেছে। কোন দলের রাজনীতিবিদরা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল?
সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে গালাগাল দেওয়া সহজ। কিন্ত আসল সমস্যাটা কোথায়? আপনারা কেন কেম্ব্রিজের পি এই এচ ডি করা প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় করে একজন দক্ষ অভিনেতাকে মসনদে বসালেন? একজন ব্যবসায়ীকে সাপ্লাই চেইন ডিমান্ড সাপ্লাই এর অঙ্ক বুঝতে হয়। একজন অভিজ্ঞ বুরোক্রাট ও তা বোঝে। কিন্ত একজন অভিনেতার পক্ষে তা বোঝা সম্ভব না। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য গণতন্ত্রে একজন দক্ষ অভিনেতাই নেতার রোল পান।
এই গনগন্ত্রে ভোটই সব। ভোট আসে একজন নেতা যখন আপনার মন জিততে পারে। মন জেতার খেলাও একটি মনোবিজ্ঞান। মোদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী করার জন্য কর্পরেট লবি কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে মিডিয়াতে মোদির ইমেজ তৈরীর জন্য। যাতে বৃহত্তর হিন্দুদের মাঝে মোদি জনপ্রিয় হোন। মোদি ভাল বক্তা পরিশ্রম ও প্রচুর করেন। কিন্ত এটা পরিস্কার তার দুর্বলদিক গুলো নিয়ে কোন মিডিয়া আলোচনা করে না। মিডিয়া ইমেজ বানায়। জনগন সেটাই খায়। শুধু মোদি কেন। গান্ধী, নেহেরু থেকে মমতা ব্যানার্জিও মিডিয়া তৈরী করা ইমেজ। কারন গণতন্ত্রে ইমেজই সব। খামোকা নেতাদেরই বা দোষ দেব কেন। আপনি কি একজন নেতা কত বড় চিন্তাবিদ, কর্মবীর-সেটা দেখে ভোট দেন?
দেন না। দিলে মনমোহনকে হারিয়ে কেউ মোদিকে আনে না। আপনি ভোট দিচ্ছেন একজন নেতা কিভাবে আপনার হিন্দুত্ববাদে, ইসলামিয়তে , আপনার বাম চিন্তাধারকে তেল মারছে-সেটা দেখে। নেতারা সেই অভিনয় করেন যা আপনারা চান! আপনারা কাজ চাইলে সবার প্রথমে কাজের ভিত্তিতেই ভোটটা দিতেন। সেটা যখন দেন নি-আজকে লাশের মিছিল দেখে ভয় পেয়ে, নেতাদের কাজ করতে হবে, এই দাবী হাস্যকর। ভারতের ৫৫% ভোটার কোন না কোন পার্টিকে বারবার ভোট দেয়। মাত্র ৪৫% নিরেপেক্ষ সুইং ভোটার। কিন্ত গণতন্ত্র মজবুত করার জন্য ৯০%+ সুইং ভোটার হওয়া জরুরী- যাতে ভোট দেওয়ার সময় পার্টির প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন না- নেতাদের কাজটাই একমাত্র বিচারধারায় আসা উচিত।
ডিমনেটাইজেশন, জি এস টি-এখন কোভিড- এটা পরিস্কার বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা স্ট্রাটেজি কিস্যু নেই। কেন নেই? কারন মোদির সাথে দক্ষ বুরোক্রাটরা কাজ করতে পারেন না। উনি বুরোক্রাটদের কথা শোনেন না। রঘুরাম রাজন ডিমনেটাইজেশনে না বলে ছিলেন। মোদি শোনেন নি। ফলে রাজনের মতন দক্ষ বুরোক্রাটকে হারায় ভারত। বর্তমানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর একজন এম এ পাশ করা ব্যাঙ্কার যার সোল কোয়ালিফিকেশন তিনি প্রধানমন্ত্রীর ইয়েসম্যান। আই আই টির ডিরেক্টর থেকে সব ইন্সটিউটের উচ্চ পজিশনে উনি উনার পছন্দের লোকেদের বসিয়েছেন। অবশ্য পশ্চিম বঙ্গবাসীদের জন্য এটা নতুন কিছু না। সিপিএমের আমলে সিপিএমের অনিল বিশ্বাসের লইয়াল লোকজনকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষে বসানো হত।
পার্টির রং দেখে অযোগ্য লোকদের দেশের শীর্ষে বসালে, এই হাল হবেই। কোন দক্ষ বুরোক্রাট বফাদার কুত্তা হবে না। হতে চাইবে না। তার আগে রিটায়ার করবে।
(৩)
এবার আবার ভ্যাক্সিন উৎপাদনে ফিরে আসি। ভারতে ভ্যাক্সিনের কাঁচামালের অভাব। কারন বায়োটেক প্ল্যান্টে এক্সপ্যান্সনের জন্য, বা ডোজের স্টোরেজের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি, বায়োলজি লাগে-সবই প্রায় আমেরিকা থেকে আমদানি করতে হয়। এইদিকে বাইডেন ফেব্রূয়ারী মাসে ডিফেন্স এক্ট এনাক্ট করেছেন যে আমেরিকার কোম্পানীগুলো ভ্যাক্সিন প্রোডাকশন রিলেটেড কোন কিছু রফতানি করতে পারবে না। কারন আমেরিকা নিজের দেশের প্রয়োজনে ভ্যাক্সিন প্রোডাকশন বাড়াচ্ছে। যাতে জুলাই মাসের মধ্যে আমেরিকার সবাইকে ভ্যাক্সিন দেওয়া সম্ভব হয়।
ফলে ভারতে আগামী দিনে ভ্যাক্সিনের সংকট আসছে আরো বেশী। সরকার জনসন জনসন, স্পুটনিক বিদেশ থেকে আনাচ্ছে বটে-কিন্ত সেগুলি তৈরী করতেও আমেরিকান যন্ত্রপাতি বায়োলজিই লাগে। সুতরাং আমেরিকার ডিফেন্স এক্ট না তুলে নিলে, শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ভ্যাক্সিন ক্রাইসিস হবে। কিন্ত ভুগবে বেশী ভারত।
তবে আশার কথা এই যে কতকাল হোয়াইট হাউস ব্রিফিং এ দেখেছিলাম, আমেরিকা এই ব্যাপারে বেশ কড়া ছিল। আজকে দেখলাম, অন্তত বলছে, বাইডেন এডমিনিস্ট্রেশন এই ব্যপারে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
কিন্ত এইসব যন্ত্রপাতি কেন আমেরিকা থেকে আমদানি করতে হচ্ছে? মেইড ইন ইন্ডিয়া, ২৪ টা আই আই টি কি করছে? ওক্সিজেন প্ল্যান্টএর যন্ত্রপাতি, ভেন্টিলেটর এখনো বিদেশ থেকে আনতে হয় । কেন? মেইড ইন্ডিয়ার ঢপ চলছে না? এসব নিয়ে আমি আগেই লিখেছি। গোটা ভারত সরকারটাই স্টান্ট আর ঢপবাজির ওপর দাঁড়িয়ে। তবে এই না যে কংগ্রেস আমলে এর থেকে খুব বেশী কিছু ভাল ছিল। মোদ্দা কথা দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের উন্নতির জন্য ভারত সরকারের সব পরিকল্পনা সব জল-শুধু মিডিয়াতে ঢাক পেটানো। চীন মাত্র ত্রিশ বছরে ইঞ্জিনিয়ারিং এ আমেরিকা জাপান জার্মানীকে টেক্কা দিল। ভারত ও এটা পারে। ট্যালেন্ট আছে। নেতা নেই। নেতৃত্ব নেই। কংগ্রেস বিজেপি-দুটি দলই ভারতকে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সেটা ভারত পারবে যেদিন ভারতের জনগন সেই নেতৃত্ব দাবি করবে। এক বিশাল অংশের শিক্ষিত লোক যদি এই ভাবে নরেন্দ্র মোদি বা জ্যোতি বসুর মতন অপদার্থ নেতাদের ফ্যান হয়ে যায়, সেটা তাদের জন্য, তার ছেলেমেয়েদের জন্য সর্বনাশ ছাড়া কিছু না। আমি মমতা ব্যানার্জি বা রাহুল গান্ধির ফ্যান হতেও বলছি না। আপনার রাজনৈতিক পার্টির ফ্যান হওয়া বন্ধ করে নিরেপেক্ষ দৃষ্টিতে ভোটটা দিন। দেখবেন নেতৃত্বের এমনিতেই উন্নতি হচ্ছে। এই দিন দেখতে হবে না।

No comments: