Saturday, April 24, 2021

ভারতের সেকন্ড ওয়েভ-আমেরিকার ফার্ষ্ট ওয়েভ – পপুলিস্ট নেতারা কেন ক্রাইসিসে দেশকে ডুবিয়ে থাকেন

 ভারতের সেকন্ড ওয়েভ-আমেরিকার ফার্ষ্ট ওয়েভ – পপুলিস্ট নেতারা কেন ক্রাইসিসে দেশকে ডুবিয়ে থাকেন

-বিপ্লব পাল, ৪/১৪/২১
গুজরাতের সুরাট, গান্ধীনগর, আমেদাবাদের চুল্লীর সামনে গতদুই দিনে মৃতের লম্বা লাইন। ভারতে ১২ই এপ্রিল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা একদিনে এক লাখ ষাট হাজার। মানে আসল নাম্বারটা ৫ লাখ ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হবার কিছু নেই। ঠিক একবছর আগে নিউইয়ার্কের এই হাল হয়েছিল। হাসপাতালে নতুন রুগী নেওয়ার জায়গা ছিল না। ফলে নিউইয়ার্কের ঘরে ঘরে, পথে লোক মারা গেছে। পৃথিবীর সব থেকে শক্তিধরদেশের বিজনেস ক্যাপিটালে রাস্তায় কুকুরের মতন লোক মরেছে। কারন? দুই “জনপ্রিয় নেতা” রিপাবলিকান ট্রাম্প এবং নিউয়ার্কের গর্ভনর “ডেমোক্রাট” কুমিওর “দূরদর্শিতা”। কারন ইনারা জনপ্রিয় নেতা। সময় থাকতে থাকতে বিজনেস বন্ধ করে, মাস্ক পড়তে বাধ্য করে “জনপ্রিয়তা” খোয়াতে চান নি!!! ৫-৬ইমার্চ যখন নিউয়ার্কে সবে ৩০-৪০টা কেস ধরা পড়েছে, সেই দুদিন আমি নিউয়ার্কেই ছিলাম। টাইম স্কোয়ার থেকে প্রতিটা রাস্তায় ভীড় উপচে পড়ছিল!! এরপরের ঘটনা ইতিহাস। ৭ই মার্চ সকালে ভয় পেয়ে আমি নিজেই পালিয়ে বাল্টিমোরে চলে আসি। নইলে এদ্দিনে নিজেই ইতিহাস হয়ে যেতাম হয়ত।
অনেকেই ভাবছেন দূর- দেখলাম ত ফার্ষ্ট ওয়েভ! করোনা আবার ভাইরাস নাকি! হেলে সাপ! ওই একটু হাঁচি, কাশি। তারপর বাই বাই!
ওয়েট।
আগের বছর যা করোনা দেখেছেন --ফার্স্ট ওয়েভ , ওটা জাস্ট সুনামীর ট্রেলর! কারন ফার্স্ট ওয়েভের ভাইরাস স্ট্রেনটা এসেছিল বিদেশ থেকে। ভারতীয়দের বেসিক ইমিউনিটি লেভেল এমনিতেই একটু বেশী। অপরিস্কার দেশে বড় হওয়ার কিছু সুবিধাও থাকে! সেকেন্ড ওয়েভে তিনটে মেজর স্ট্রেইন আছে- এগুলো কিন্ত স্বদেশী। এরা ভারতীয়দের ইমিউন সিস্টেমেই মিউটেট করেছে। মানে ফার্স্ট ওয়েভের মতন বিদেশী ভাইরাস এঁরা নন- হোম গ্রাউন্ড এডভ্যান্টেজে ভারতীয়দের ইমিউন সিস্টেম ফার্স্ট ওয়েভের মতন শীল্ড হতে পারবে না। সুতরাং সেকেন্ড ওয়েভে ভারতীয়দের আক্রান্ত হওয়ার চান্স অনেক অনেক গুন বেশী।
হ্যাঁ- যেসব বিজ্ঞানী সংশয়ী বন্ধুরা আফশোস করছিলেন কেন দিল্লীর কৃষান র্যালিতে একটাও কোভিড কেস হচ্ছে না- কেন মমতা০মোদির র্যালি থেকে কোভিড ছড়াচ্ছে না-বা বিজেপির ভক্ত সন্তানেরা বুক ফুলিয়ে বলছিলেন ভারত প্যান্ডেমিক “মুকাবিলা” দেখিয়ে দিয়েছে- তাদের সবার অপেক্ষার দিন শেষ! আসুন। এবার আসল খেলা শুরু হয়েছে সবে।
ভেবে দেখুন। ভারত প্রায় একবছর সময় পেয়েছে। আমেরিকাও তাই। আমেরিকাতেও দ্বিতীয় ওয়েভ ধাক্কা মারছে। তবে আমেরিকাতে প্রায় ১০০ মিলিয়ান লোকের (৩০%) টীকা নেওয়া হয়ে গেছে। টিকা মানে সেকন্ড ওয়েভে আক্রান্ত হবে না, তা না। অনেকেই টীকা নেওয়া সত্ত্বেও আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্ত মন্দের ভাল। যার জন্য দ্বিতীয় ওয়েভ আমেরিকাতে এখনো মহামারীর রূপ নেয় নি। কিন্ত ভারতে টীকার এখন অকাল! আমেরিকা তার ৩৪০ মিলিয়ান লোকের জন্য ৬০০ মিলিয়ান মর্ডানা এবং ফাইজার টীকা সংগ্রহে রেখেছে। ভারত সেখানে সম্পূর্ন ভ্যাক্সিনেটেড ১%। একবার ভ্যাক্সিন পেয়েছে ৭% । শ্রীরাম ইন্সটিউট বলছে, তাদের ৩০০০ কোটি টাকা দিলে, তারা প্রোডাকশন বাড়াতে পারবে। এখনো পর্যন্ত মোদিজি দিদি দিদি ডাক ছেড়ে সেইদিকে সময় দিতে পেরেছেন বলে জানা নেই!
্গুজরাত তার নিজের রাজ্য। সেখানে জুনাগড়ের এক হাসপাতালে কাল একদিনে ৬০জন মারা গেছে। প্রতিটা হাসপাতালের সামনে এম্বুলেন্সের লাইন। শ্বশানের প্রাচীর ভাংতে হচ্ছে আরো বেশী সংখ্যক মৃতদেহ একসাথে পোড়ানোর জন্য। আর তিনি পশ্চিমবঙ্গ দখলের জন্য দিদি ও দিদি করে আওয়াজ দিচ্ছেন বর্ধমানে! তার প্রতিটা র্যালি থেকে করোনা নিশ্চিত ভাবেই ছড়িয়েছে। কারন পশ্চিম বঙ্গের কোন হাসপাতালেই বেড খালি নেই। এটা ভারতের জনপ্রিয়তম নেতার দ্বায়িত্ববোধের নমুনা?
নাকি জনপ্রিয় নেতা হলে, তাদের দ্বায়িত্ববোধের এই লেভেলই এক্সপেক্টেড? ঠিক ট্রাম্প এবং কুমিওর মতন?
এই ব্যপারটা গভীর বিশ্লেষন করা দরকার। কুম্ভমেলায় ২৮ লাখ লোক হয়েছে এবার। থার্মাল স্ক্রিনিং, টেস্টিং কিছুই হচ্ছে না। মাস্ক ও খুব কমলোকেই ব্যবহার করছে। মোটে ১৮,০০০ লোকের টেস্টিং হয়েছে। তাতে ১০৪ জনের করোনা ধরা পরেছে কালকের খবর পাওয়া পর্যন্ত। কুম্ভমেলা সুপারস্প্রেড ইভেন্ট হতে চলেছে। অথচ গত বছর তবলীগীদের করোনা সন্ত্রাসবাদি বলে সর্বত্র গালি দেওয়া হয়েছে সেই একই কুকীর্তির জন্য! তবলীগী বা কুম্ভমেলার তীর্থযাত্রীরা করোনা সন্ত্রাসী কিনা জানি না। তবে স্যার কার্ল পপারের অমোঘবাণী এদের জন্য প্রযোজ্য- যারা স্বর্গের সন্ধান করেন, নরকযাত্রা তাদের ভাগ্যেই জোটে ( যদিও এটা তিনি কমিনিউস্টদের জন্য লিখেছিলেন)।
উত্তরাখন্ডের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী ত্রিভেন্দ্র সিং রাওয়াতকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলছেন, যিনি দিয়েছেন, তিনিই রাখবেন ! ( অর্থাৎ তীর্থযাত্রীদের ভয় নেই, ঈশ্বর বাঁচাবে)। আমেরিকাতেও চার্চগোয়ারদের বিরাট অংশ এখনো তাই ভাবে- ঈশ্বরপুত্র যীশুর আরাধনায় চার্চে যাচ্ছি-তিনিই বাঁচাবেন! আমেরিকার চার্চগুলি করোনা স্প্রেডিং সেন্টার। আমেরিকার রক্ষনশীল সুপ্রীম কোর্ট জানিয়েছে ধর্ম পালনে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। গণতন্ত্রে কোন নেতা ইচ্ছা করে জনপ্রিয়তা খোয়াতে চায় বলুন ত?
মোদি বা ত্রিভেন্দ্র সিং এর জনপ্রিয়তার উৎস-?
এরা সাধারন হিন্দুদের বহুবছরের পুরাতন অন্ধত্ব কুসংস্কারকে তোল্লাই দিয়ে হিন্দুদের হৃদয় জয় করেছেন। যা খুব রূঢ় সত্য। এমন কি আগের বছর কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে , প্রদীপ জ্বালিয়ে করোনা তাড়ানোর নাটক আসলেই হিন্দুদের কুসংসরাচ্ছন্ন মনের আবেগকে কাজে লাগিয়ে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর পরিকল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই না।
গত বছর করোনা মোকাবিলার করার জন্য যে ২০,০০০ কোটি টাকা সরকার ঘোষনা করল, সেই টাকা গেল কোথায়? পশ্চিম বঙ্গের কথা ছেড়েদিন। সেখানে নাকি দুষ্টু মমতা বেগম থাকেন। কিন্ত সোনার গুজরাতে দেখা যাচ্ছে হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়ে নি। ফার্মাসি থেকে রেমডেসেভির উধাও ! এই বিশাল টাকা দিয়ে দেশের কটা বেডের সংখ্যা বেড়েছে? এই প্রশ্ন কিন্ত আজকে গুজরাতিরাই করছে!
দেশে ১৩০ কোটি টীকার সংস্থান না করে উনি ২৩ টি দেশকে টীকা পাঠিয়েছেন!! মেইড ইন্ডিয়ারা জয়জয় চারিদিকে! আর আজকে আমেরিকা থেকে মর্ডানা আর ফাইজারের টিকা চাইছেন! মানে বাধ্য হচ্ছেন!! জনপ্রিয়তার সন্ধান আসলেই নেমে যাবার সিঁড়ি। হোয়াটসাপ ইউনিভার্সিটির প্রচার দিয়ে কিন্ত লাশের মিছিল আটকানো যাবে না। লাশেরা যখন কথা বলবে হোয়াটসাপ ইউনিভার্সিটির পি এই চডি করা ভক্তরা আটকাতে পারবে ত?
নেতারা যখন জনগনের ধর্মীয় অন্ধত্বকে, কুসংস্কারক্‌ জাতিগত ধর্মগত বিদ্বেশকে তোল্লাই দিয়ে জনপ্রিয় হবার চেষ্টা করেন, সেই দেশের ভাগ্যই দুর্ভাগ্য। ১৯১৯ সালে সমগ্র ভারতজাতিকে এই দুর্ভাগ্যের সামনে এনেছিলেন মহত্মাগান্ধী,। তুরস্কে যখন খিলাফতের পতন হল (১৯১৯), তুরস্কের তরুন নেতারা আধুনিক ধর্মনিরেপেক্ষ তুরস্ক চাইলেন। তাতে সমগ্র ইসলামিক বিশ্বের মুসলমানরা নাকি ব্যাথায় কাতর! তুরস্কের দুঃখে ভারতের মুসলমানদের বুক ফেটে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা মোটেও তা না। ভারতের এক তরুন মুসলমান নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ বল্লেন, তুরস্কের এই অগ্রগতি মুসলমানদের আরো আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতি আকৃষ্ট করবে। কিন্ত তিনি মহত্মা নন- তিনি জিন্না। ভারতের পিছিয়ে পরা মুসলমানদের তুলতে তাদের মতের , তাদের আবেগের বিরুদ্ধে যেতে হবে তা বিলক্ষন জানতেন। কিন্ত মহত্মা গান্ধী? তিনি গোটা ভারতের মুসলমান্ দের ও মহত্মা হতে চান! ফলে তিনিও নাকি ভারতীয় মুসলমানদের ব্যাথায় সমব্যাথী হয়ে খিলাফত আন্দোলন চালু করলেন! এরফলে জিন্না কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য হোন । বুঝলেন ভারতের কংগ্রেসের হিন্দুনেতারা মুসলমানদের অন্ধকারযুগে রাখতে চায়। ভারত ভাগ হল। আর ভারতভাগের সত্যিকারের অকংগ্রেস লিখিত ইতিহাস জনগনের সামনে আসলে একদিন না একদিন বিজেপি ক্ষমতায় আসতই।
গান্ধীর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল, মুসলীম নেশনের দাবী। তিনি মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় হতে গিয়ে, গোটা ভারতকে ডুবিয়েছেন । হিন্দু মুসলমান সবার ক্ষতি করেছেন। হলোকাস্টের পর সব থেকে বড় জেনোসাইড দেশভাগ। তার জন্য তিনি এবং নেহেরু দায়ী।
মোদির সামনে চ্যালেঞ্জ চীন। যা গোটা বিশ্বের ম্যানুফাকচারিংকে কুক্ষিগত করছে। ইলেক্ট্রনিক্স এর সব পার্টস এখন চীন থেকে কিনতে হয়। গতমাসে একটা চাইনিজ কোম্পানী কাউন্টারফিট চিপ দিচ্ছিল । তাদের হাতে নাতে ধরা হল! আমরা ঠিক করলাম, আর চীন থেকে কিছু কিনব না। সবাই মিলে তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, জাপানে খোঁজ লাগালাম। ও বাবা। সবার করুন অবস্থা! সাপ্লাই লাইন নেই! একমাত্র চাইনিজ কোম্পনীর কাছেই মাল আছে। ওরা কাউন্টারফিট চিপ দিচ্ছে জেনেও কিনতে হবে। মানে চীন এখন এমন মনোপলি করে ফেলছে উতপাদনে ওরা আমেরিকা ভারতকে থাপ্পর মারলেও, সেটা হজম করা ছাড়া উপায় নেই! আমেরিকান সামরিক অস্ত্রের ২০% বন্ধ হয়ে যাবে চাইনিজ পার্টস না পেলে! ভারতের ম্যানুফাকচারিং এর প্রায় ৯০% বসে যাবে চাইনা থেকে সাপ্লাই বন্ধ হলে! চীনের সাথে আপনি কি যুদ্ধ করবেন?
মহারাষ্ট্র ভারতের ম্যানুফাকচারিং সেন্টার। আজ সেখানেই করোনার কারনে কার্ফু। ফলে ভারতের ধুঁকতে থাকা ম্যানুফাকচারিং আরো ঝুলে গেল। করোনা কন্ট্রোল না করতে পারলে, ভারতের ম্যানুচাকরিং সম্পূর্ন চৈনিক তিমির পেটে ঢুকে যাবে। এইভাবে নেতৃত্বে ছড়ালে, চীনের উপনিবেশ হতে আর ৫-১০ বছর লাগবে ম্যাক্সিমাম। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এরা তিমির পেটে ঢুকেই গেছে। এমন নেতৃত্ব বেশীদিন চললে, ভারতই বা আর বাকী থাকবে কেন!
ভারতে নেতা দরকার। নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, লেট মি লিড ইউ। তোমারা যা চাও সেই আবেগে ( সাদাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ) স্টাম্প মারলে, আমার জনপ্রিয়তাই শুধু বাড়বে। কিন্ত ধ্বংস হবে সাউথ আফ্রিকা।
জনপ্রিয় নেতৃত্ব আসলেই ধ্বংসের সিঁড়ি। পপুলিজম গণতন্ত্রের একিলিস হিল- যা গণতন্ত্রকেই একদিন হয়ত ধ্বংস করবে। সত্যিকারের নেতা দরকার। যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরুদ্ধে গিয়ে অপ্রিয় কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন ভারতের মেরুদন্ড সোজা করার জন্য।

No comments: