আজ অমর একুশে। ভাষা দিবস। বাংলা ভাষার জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলার দিন। আসলে সবটাই দ্বিচারিতা। অন্তত নিজের দিকে তাকালে সেটাই আগে মনে হবে।
ছোটবেলাতে গণিত, পদার্থবিদ্যা বা ইংরেজি নিঁখুত ভাবে শিখতে হত। কিন্ত বাংলাটা ছিল শুধু নোট মুখস্থ করে উদ্ধার করার জন্য। ভবিষ্যতে কোন কাজে আসবে? না উচ্চ শিক্ষায়, না চাকরিতে, না প্রেমে। বাংলায় অজস্র বানান ভুল করতাম ছোটবেলা থেকেই। কেও দেখেনি কোনদিন। বাংলার শিক্ষক মশাইরা একটু বকে দিতেন-বাবা আর দুটোত বছর- তারপর বাংলা থেকে ছুটি। বাংলা পরীক্ষা নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসি করতাম। পরীক্ষার দিন হল থেকে বেড়িয়ে এ ওকে জিগোতেম-কত পাতা ভাটালি? মানে বাংলা পরীক্ষার খাতা মাস্টারমশাইরা দেখবেন না । দিস্তাভরে গরুর রচনা লিখলেই হল। এটা ছিল আমাদের ধারনা। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন আমার হাতের লেখা ছিল খারাপ। ভীষন খারাপ। ফলে বানান, গঠন এবং হাতের লেখার যুগপৎ ব্যর্থতায়, বাংলাতে খুব কম নাম্বার পেতাম। তাই নিয়ে কারোর কোন মাথাব্যাথা ছিল না । অঙ্কে ৯৯ পেলেও মা একবার জিজ্ঞেস করত কোনটা ভুল করলি। বাংলাতে ৫০ পেলে বাড়িতে বলত, আরেকটু ভাটিয়ে লিখতে পারলি না ?
উচ্চমাধ্যমিকের পর আর বাংলা লিখতে হল না কোন দিন। সেটা ১৯৯১ সাল। তাও বাড়িতে ফোন আসার আগে সপ্তাহে একটা করে চিঠি লিখতে হত মাকে। ১৯৯৩ সাল নাগাদ গ্রামশহরেও ফোন চলে এল। ব্যস-সপ্তাহে একদিন বাংলা লেখার যেটুকু দরকার ছিল, তার থেকেও মুক্ত হলাম। তারপর টানা এগারো বছর একটাও বাংলা শব্দ কোথাও লিখতে হয় নি। ইনফ্যাক্ট নেট জগতেও প্রথমে ইংরেজিতেই লিখতাম। তখন বাংলায় অভ্র আসে নি। সেটা ২০০৪ সাল। ছিল বর্নসফট বলে একটা বাংলা টাইপিং সফটওয়ার। বাংলাদেশী লেখক বন্ধুদের উৎসাহে, বর্নসফটেই লেখা শুরু করি সেই বছর । নিশ্চিত ছিলাম হাত থেকে একটা লাইনও বেড়োবে না । কঠিন কঠিন বানান। ক্রমাগত বুঝেছি, মাতৃভাষা সত্যিই মাতৃদুগ্ধ। যে ভাষা মনে জমে থাকে, তা বানান না মেনেও ঠিকই বেড়িয়ে আসবে।
সেই শুরু। তারপর থেকে লিখেই চলেছি। অনর্গল। ভুল ভাল গঠন আর বানানেই বাংলা লিখি। তাও লিখি। কারন এই প্রবাসে প্রাণের কথা আর কাকেই বা বলবো? জমে থাকা অনুভূতিগুলো মাটির নীচে থাকা মিথেন গ্যাসের মতন উর্ধচাপে নির্গত হতে থাকে। হয়ত পশ্চিম বঙ্গে থাকলে লিখতে হত না । কারন মনের কথা বলার লোক থাকত অনেক। এবং আমি দেখেওছি, ভারতে গেলেই আমার লেখার ইচ্ছা কমে যায়। আসলে মনের কথাটা খুলে বলার লোক পেলে, আর দরকার হয় না লেখার।
বই পড়ার সময়, অবসর ধৈর্য্য কোনটাই আর নেই । মাঝে সাঝে দু একটা কবিতা বা ছোটগল্প পড়ে ফেলি বাংলায়। অখন্ড কাজের চাপে ওটাই আমার রিক্রিয়েশন । অথবা ওইটুকুই নাড়ির যোগ। ছেলেও আমার সাথে কথা বলে ইংরেজিতে। নাতি নাতনি হলে, তারাও ইংরেজিতেই বলবে। আশে পাশের বাঙালীরাও বাংলায় কথা বলাতে খুব বেশী স্বচ্ছন্দ নয়। তবে উইকেন্ড পার্টিতে বাংলিশ আড্ডা হয়। হুইস্কির দুপেগের আগে বাংলা। নেশা চাপলে ইংরেজি। বিলিতি মাল ত!
শুধু একটা পজিটিভ টোনে লেখাটা শেষ করি। কেন বাংলায় লিখব? অথবা কেন লিখব ? কারন লেখার মাধ্যমেই চিন্তার গভীরতাটা অন্যকে সহজে বোঝাতে পারি। লেখালেখি করার অভ্যেস থাকলে দূরহ একটা ধারনা খুব সহজে বোঝানো সম্ভব হয়। পেশাদারি জীবনে মার্কেটিং , সেলস বা ব্যবসায়, এই স্কিলটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ন। লেখালেখির অভ্যেস না থাকলে, আজথেকে কুড়ি বছর আগে ছাত্র জীবনে ট্যান থিটা ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলাম। এখন একটা গুছিয়ে গল্প বলতে সক্ষম-নইলে আমেরিকাতে ব্যবসা করে খেতে হত না । এই স্কিলটা লেখালেখি করতে করতেই এসেছে। টেকনিক্যাল স্কিল নিয়ে পেশাদার জগতে খুব বেশীদূর ওঠা যায় না -কিছুদূর গিয়ে, গল্প বলার স্কিলটাও লাগে।
শুধু এই কারনেই আমি নতুন প্রজন্মকে বাংলায় লিখতে বলব। বানান, ভাষার পরোয়া না করে, ভাষা পুলিশের হুইসেল অগ্রাহ্য করে শুধুই নিজের চিন্তাটাকে জমিয়ে ক্ষীর করে নামিয়ে দাও। অন্য কারুর না আসুক, নিজের কাজে আসবে।
No comments:
Post a Comment