Saturday, October 10, 2020

রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব -পর্ব-2

                                                                            (৪)

রায়চৌধুরী সমীকরন এবং তার গুরুত্ব বোঝার  আগে অমলবাবুর সাথে একটু পরিচয় সেরে নেওয়া যাক।

       অমল রায়চৌধুরীর জন্ম বরিশালে। ১৯২৬। জন্মের পর তার পিতা -যিনি গণিতের শিক্ষক ছিলেন, চলে এলেন কোলকাতায়। হিন্দু স্কুলে তার পড়াশোনা। প্রেসিডেন্সিতে ১৯৪২ সালে  ফিজিক্সে  বি এস সি। ভারত তখন টালমাটাল। একদিকে কুইট ইন্ডিয়া।  কোলকাতার আকাশে জাপানী প্লেনের সর্টি।  দুর্ভিক্ষ। অন্যদিকে জিন্নার ডাকে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক ক্রমশ খারাপের দিকে। 

  কোলকাতায় থাকা "সেফ" না। অমল বাবুর ফ্যামিলি বরিশালে ফিরে এল। সেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি। চাপা টেনশন। শেষে অমলবাবুর ফ্যামিলরা আবার কলকাতায় ফিরলেন। অমল রায় চৌধুরী ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে এম এস সি পাশ করেন ।

 ছোটবেলা থেকে অমলের নেশা অঙ্কে। এলজেব্রার বই পেলে দুই দিনে সব অঙ্ক শেষ। বাকী সাবজেক্টে মন নেই। কিন্ত অঙ্ক না নিয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়লেন। কেন?

 কারন অমলবাবুর পিতা। উনি অমলকে বললেন দেখছিস ত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার পরেও স্কুলের শিক্ষকতা করছি। অঙ্ক বাদ দে। অন্য সাবজেক্ট নিয়ে পড়।  সুযোগ বেশী।

 অমল রায়চৌধুরী ফিজিক্স নিলেন। কারন অঙ্ক করার সুযোগ বেশী। কিন্ত ল্যাবেটরীর ক্লাস তার ভাল লাগত না। 

এম এস সি পাশ করে যাদবপুরের কাল্টিভেশনে গবেষনা করতে ঢুকলেন (১৯৪৬)।  পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক কাজে ফেলোশিপ প্রায় থাকেই না। ফলে এক্সপেরিমেন্টাল কাজ শুরু করতে হল। ধাতু -অর্থাৎ মেটালের ধর্ম নিয়ে পি এইচ ডি শুরু করলেন।

কিন্ত ল্যাবে মন নেই। অঙ্ক করতে, অঙ্কের সমাধান করতে ভালবাসেন অমল।  আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সমীকরনের সমাধান নিয়ে প্রচুর চর্চা-বিতর্ক চলছে। মহাবিশ্ব  প্রসারনশীল-মানে একটা বিন্দু থেকে শুরু করে আজকের অবস্থায় এসেছে-তাই নিয়ে দুর্দান্ত সব কাজ ফিজিক্সের জার্নালে পড়ছেন। কিন্ত দিনের বেলায় স্পেক্টোফটোমিটারে রিডিং নিচ্ছেন! মন ভরে আছে সব বিরাট বিরাট ইকোয়েশনে। হাত মন নিশপিশ করছে সেসব সলভ করতে। কিন্ত উপায় নেই!

ফলে সাড়ে চার বছর বাদে দেখা গেল এক্সপেরিমেন্টাল কাজে  কিছুই করতে পারেন নি।  একটি পেপার ও না। অমল রায়চৌধুরীর আত্মবিশ্বাস ধাক্কা খেয়েছিল।  এদিকে পারিবারিক অবস্থা খারাপ। ফেলোশিপ গেছে। ফলে আশুতোষ কলেজে ফিজিক্সের লেকচারারের কাজ নিলেন। সেটা ১৯৫০ সাল।

কি আর করা যাবে। পাখীকে সাঁতার কাটতে বলা আর মাছকে উড়তে বলা একই ব্যাপার! 

কলেজে পড়ানোর কাজ একদিকে ভাল। কারন এখন তিনি মুক্ত।  যা চাইবেন তাই নিয়ে কাজ করতে পারবেন। ফলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্ণিতের অধ্যাপক সেনের কাছে গেলেন, আইনস্টাইনের সমীকরনের এক বিশেষ সমাধান নিয়ে। 

সেই সময় কোলকাতায় কসমোলজিতে ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রী বোঝার মতন কেউ ছিল না। সেন কিছুই বুঝলেন না। শুধু বল্লেন কোলকাতার ম্যাথ গেজেটে ছাপিয়ে দাও। আর হ্যা, শেষে আমার নাম টা দিও কিন্ত।

অমলরায় চৌধুরী বুঝলেন কোলকাতার বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে তার পাওয়ার কিছু নেই।  এর থেকে নিজে কাজ করে বিদেশী জার্নালে পাঠানোই ঠিক কাজ হবে।

তিনি প্রথমেই যে প্রবলেমটা সমাধান করার চেষ্টা করছিলেন -সেটা হচ্ছে এই যে আইনস্টাইনের সমীকরনের সব সমাধান তখনো পর্যন্ত আইসোট্রোপিক হমোজেনাস মহাবিশ্বের অনুমান। অর্থাৎ মহাবিশ্বের ভর, ধর্ম চারিদিকে সমান! কিন্ত মহাবিশ্ব তা না। তার ধর্ম বা ভর চারিদিকে সমান ভাবে ছড়িয়ে নেই। তাহলে একটা বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে  কি করে তৈরী হল এই এনাইসোট্রোপিক মহাবিশ্ব যার চারিদিক সমান না?

 তা ছাড়া সব সমাধানেই সিঙ্গুলারিটি আসছে- যার কোন পরীক্ষালদ্ধ প্রমান তখনো নেই। তাহলে কি এমন সমাধান পাওয়া যাবে, সেখানে স্পেস টাইম ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধে ভেঙে পড়বে না?  এমন হাজারো চিন্তা তরুন অমলের মাথায়। 

১৯৫০ থেকে ৫৫ সালের মধ্যে এই সমস্যাগুলির সমাধানে তিনটে পেপার পাবলিশ করেন অমল রায়চৌধুরী। এর মধ্যে তার তৃতীয় পেপারে ছিল তার বিখ্যাত রায়চৌধুরী ইকোয়েশন। 

 উনি দেখালেন গ্রাভিটেশনাল ফোর্স ছাড়াও ঘুর্নয়মান বস্তু বা ক্লাস্টারের জন্য আইনস্টাইনের ইকোয়েশনের সমাধান করতে গেলে দেখা যাচ্ছে, গ্রাভিটেশন ছাড়াও, ঘুর্ননের জন্য সিওডোফোর্স, শিয়ারিং ফোর্স, টর্সন আরো অনেক কিছুই বস্তুর ওপর কাজ করছে।  এদের কেউ গ্রাভিটেশনের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে কাজ করে। 

কেন গুরুত্বপূর্ন এই কাজ? কারন বিপুল পরিমান ভর নিজের গ্রাভিটেশনের চাপে 
কোলাপ্স করতে পারে। তাতে সিঙ্গুলারিটি তৈরী হয়-অর্থাত স্থান কালের জ্যামিতি এমন ভাবে ভেঙে যায়- সেই সমাধান বিশ্বাসযোগ্য না। 

রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে প্রথম জানাগেল, গ্রাভিটেশনাল কোলাপ্স আটকাতে কিছু বিরুদ্ধ ফোর্সও তৈরী হচ্ছে।  সুতরাং খুব ক্ষুদ্র গোলকের মধ্যে সব ভর ঢুকিয়ে দিলেই সব কিছু 
কোলাপ্স করবে ( যা সোয়ার্জ চাইল্ড সমাধানে ছিল )-ব্যপারটা অমন জলবৎ তরলং না। খুব ক্ষুদ্র ব্যাসার্ধের মধ্যে অনেক ভর ঢুকিয়ে দিলেও জ্যামিতি সম্পূর্ন ঘাঁটবে না-যা সোয়ার্জচাইল্ড সমীকরনে হচ্ছিল। 

অর্থাৎ একটা সূত্র পেলেন বিশ্বের  বিজ্ঞানীরা।  আইনস্টাইনের সমীকরনে যে সিঙ্গুলারিটি আসে- যার থেকে ব্ল্যাকহোলের  উৎপত্তি-তা সম্পূর্ন বোধগোম্যের বাইরে তা না। 

,মুশকিল হচ্ছে, আইনস্টাইনের মতন রায়চৌধুরীও সমীকরন দিয়ে সরে গেলেন। সমাধান তিনিও দিয়ে যান নি। তার জন্য আমাদের হকিং-পেনরোজ পর্যন্ত পনেরো বছর অপেক্ষা করতে হবে (১৯৭০)।  সেটা নিয়ে পরের পর্বে লিখব। 

দুঃখের ব্যপার এই যে অমল বাবু নিজের সমীকরন সমাধান করার চেষ্টা করলেন না কেন? কেন সেই কাজ পেনরোজ হকিং এর জন্য পড়ে রইল? 

১৯৫৭ সালের মধ্যে তার কাজ গোটা বিশ্বে সমাদৃত। কিন্ত আশুতোষ কলেজের এক ফিজিক্সের লেকচার তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তার উপায় ই বা কি?  অমল বাবু আবার কাল্টিভেশন অব ফিজিক্সে গবেষক হওয়ার দরখাস্ত করেন । এবারো কেউ  পাত্তা দিল না। তার কাজ কোলকাতায় কেউ বুঝত না। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রফেসর হিসাবে যোগ দেন। 

এখানে তিনি সারাদিন ছাত্র পড়াতেন। ল্যাব নিতেন। রিসার্চের সময় পেতেন কম। নিজেকে উজাড় করে ছাত্রদের দিয়েছেন। কিন্ত তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে পরিবেশ ফুসরত দরকার ছিল, সেটা পান নি। ফলে তার সমীকরনের সমাধান করে পেনরোজ হকিং ব্ল্যাকহোল তত্ত্বের মূল জনক। পেনরোজ স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল প্রাইজ পেলেন এবছর।  তিনি হয়ে রইলেন প্রিয় মাস্টার মশাই। 


                                                            (৫)

  গণিত আসলে কি? সমীকরন বা ইকোয়েশন এদ্দিন ধরে যা করে আসছি সেটাই আসলে কি ? গণিত আসলে বিজ্ঞানের ভাষা। ভাষাতে যেমন আছে অক্ষর, অক্ষর সাজিয়ে শব্দ-সেখান থেকে বাক্য। গণিত ও তাই। এখানে "বাস্তবতার" ব্যবহারকে ভাষা দিতে নোটেশন-নোটেশন থেকে ইকোয়েশন বা সমীকরনের জন্ম। আর তার সমাধান হচ্ছে একেকটি গল্প, বা কবিতা বা উপন্যাস। 

                   - তলের পরিবর্তনের জ্যামিতি যা  রিকি কার্ভেচার বলে আগের পর্বে জানলাম, সেটা কিভাবে বদলাবে যদি আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকোয়েশন একটি ঘুর্নয়মান ভরের জন্য সমাধান করা হয়?  দুটি ঘটনা যদি আগে পিছে ঘটে তারাই বা এই কার্ভেচারে জ্যামিতে কিভাবে আসবে সমীকরনের অংশ হিসাবে?

                   -জিওডেসিস্ক , অর্থাৎ যে পথে একটি বস্তু একটি তলের ওপর  পয়েন্ট এ থেকে বি তে ক্ষুদ্রতম দূরত্বে পৌছাবে। যেমন ধরুন ইন্টারন্যাশাল ফ্লাইটগুলি জ্বালানী কমাতে  পৃথিবীর এক শহর থেকে যখন অন্যশহরে যায় তখন লক্ষ্য থাকে কিভাবে পৃথিবীর গোলকতলের ওপর সংক্ষিপ্ততম পথ নেবে। গ্রাভিটেশন বা অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে কিভাবে একটি পার্টিকল একটি বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে যাবে, সেটা আইনস্টাইনের ফিল্ড সমীকরনে খুব সহজ -জাস্ট একটা জিওডেসিস্ক যা স্থান কালের তলে ক্ষুদ্রতম পথে এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে পৌঁছে যায়।

   

     মূলত এই তিনটিই ভিত্তি রায়চৌধুরী সমীকরনের।  হকিং-পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি থিওরেম কিভাবে রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে এল সেটি নিয়ে পরের পর্বে লিখব। এবার সংক্ষেপে রায় চৌধুরী সমীকরনটি জেনে নিই। 

 রায়চৌধুরী সমীকরনের বাঁদিকের টার্মটি  যেহারে মহাজাগতিক বস্তুর ভর বেড়ে চলেছে বা কমছে। সেই রেট। এটিকে বলে এক্সপানশন স্ক্যালার। কারন এই টার্মটি থেকেই বোঝা যাবে মহাজগত একটি ক্ষুদ্রকনা থেকে শুরু করে কিভাবে চারিদিকে তার এক্সপানশন হচ্ছে। 


  কিন্ত এই বস্তুর ভরের এই এক্সপানশন বা বর্ধন রেট কার কার ওপর নির্ভরশীল? সেটাই সমীকরনের ডানদিক। 

 ডানদিকে চারটি গুরুত্বপূর্ন টার্ম।

 এক ভরের এক্সপানশন ভরের বর্গানুপাতিক- অর্থাৎ স্কোয়ারের ওপর নির্ভরশীল 

  দুই শিয়ার ফোর্স -অর্থাৎ স্থানকালের যে জ্যামিতিক তল-তার গাঁ ঘেষে আরেকটি ফোর্স তৈরী হয়।

   তিন টর্সন । স্থানকালের জ্যামিতিক তলগুলোকে মুচরানোর জন্য আরেকটি ফিল্ড

   চতুর্থ টাইডাল টেন্সর থেকে উদ্ভুত রায়চৌধুরী স্ক্যালার। যা আসলে ক্ল্যাসিক্যাল গ্রাভিটেশনাল বলের আরেক রিপ্রেজেন্টেশন। 

 তাহলে দাঁড়াল কি? ধরুন একটি গ্যালাক্সি তৈরী হচ্ছে। শুরুতে গ্যাসগুলি বৃত্তাকারে ঘুরছে।  স্থানকালের জ্যামিতি গ্যাসের ভরের জন্য আস্তে আস্তে গ্যালাক্সির স্ট্রাকচার চেঞ্জ করছে। রায়চৌধুরী সমীকরন দেখাচ্ছে সেখানে গ্রাভিটেশন বা অভিকর্ষজ বল ছাড়া-শিয়ারিং ফোর্স, টর্সন আরো অনেক কিছুই আছে-যার প্রভাবে আস্তে আস্তে গ্যালাক্সির এক্সপানশন হবে। এবং চারিদিকে সমান ভাবে তা হবে না।

শুধুই কি তাই? যদি গ্রাভিটেশনের ফোর্স অন্যান্য টার্মের থেকে বেশী হয়? তাহলে সিস্টেম কোলাপ্স করে-সব মাস একসাথে এসে সিঙ্গুলারিটিটে ঢুকে যাবে।

যদি শিয়ার বা টর্সন বেশী থাকে? জ্যামিতির তলকে আরো টানতে থাকুন- সিস্টেম আস্তে আস্তে বড় হবে।

অর্থাৎ অভিকর্ষজ বলের প্রভাবে বড় বড় নক্ষত্রগুলি কিভাবে  নিজের ভরের চাপে, নিজেরা কেন কোলাপ্স করে ব্ল্যাকহোলের দিকে যাবে বা স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখতে পারবে -কেন পারবে-তার একটা দিশা পাওয়া গেল রায় চৌধুরী ইকোয়েশন থেকে। 

রায়চৌধুরী ইকোয়েশনকে অনেক সময় ল্যান্ডাউ-রায় চৌধুরী ইকোয়েশন বলা হয়। কারন নোবেল জয়ী সোভিয়েত বিজ্ঞানী লেভ ল্যান্ডাউ  প্রায় একই সময়ে এই সমীকরন, অন্যভাবে দেখান। 

দুর্ভাগ্য আমাদের।   অমল রায়চৌধুরীর নাম লেভ ল্যান্ডাউ, পেনরোজ, হকিং, হয়েল ইত্যাদিদের সাথে উচ্চারিত হয়। যারা এই শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।  অথচ ১৯৫৭ সালে রায়চৌধুরী ইকোয়েশন তৈরী করার পর, তিনি ভারতের রিসার্চ ইন্সটিউটের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কেউ যদি তাকে গবেষক হিসাবে নিতে রাজি হয়। কারন আশুতোষ কলেজে ছাত্র পড়িয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে এই গবেষনা টেনে নিয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব। তিনি গবেষনার পরিবেশ খুঁজছিলেন। কোলকাতায় কেউ তার কাজ বুঝতেই পারে নি। কারুর কাছ থেকে এতটুকু সাহায্য পান নি। 

পরের পর্বে হকিং পেনরোজ কিভাবে রায়চৌধুরীর ইকোয়েশন কাজে লাগিতে ব্ল্যাকহোলের ধারনা দিলেন-সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।  একদম শেষ পর্বে ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব পরীক্ষার মাধ্যমে কিভাবে প্রমানিত হয়ে চলেছে  ।  যার জন্য এবছর পেনরোজের সাথে নোবেল প্রাইজ পেলেন এন্ড্রিয়া গেইজ এবং রিচার্ড গেঞ্জেল। যারা দেখিয়েছেন গ্যালাক্সির জন্মই সম্ভব না ব্ল্যাকহোল ছাড়া এবং আমাদের মিল্কওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও আছে এক সুপার ব্ল্যাকহোল।  এই আবিস্কারের গল্পও চিত্তাকর্ষক এবং ধারাবাহিক। 





   

  

                  

                  

                        

রায়চৌধুরী সমীকরন থেকে পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব -পর্ব-১

                                                                     (১)
রজার পেনরোজ বেশ ঘন ঘন কোলকাতায় এসেছেন গত দুই দশক। মূলত তার ব্লক ব্লাস্টার বেস্ট সেলার " এম্পায়ার নিউমাইন্ডের" দৌলতে কিশোর বয়স থেকেই তার নাম শুনেছেন অধিকাংশ বুদ্ধিজীবি বাঙালী।্পেনরোজের  কোয়ান্টাম কনসাসনেসের কনজেক্টচার খায় না মাথায় দেয়, সেটা না বুঝলেও, অজানা অচেনা চেতনার বিজ্ঞান যে বিজ্ঞানের চেনাজানা পথে বোঝা যাবে না, সেটুকু পেনরোজ পড়েই জেনেছি কলেজ জীবনে। 

 রজার পেনরোজ নোবেল না জিতলেও কিছু যায় আসত না। তিনি গণিত এবং অঙ্কে এতকিছু নতুন ধারনা, নতুন সমাধানের জন্ম দিয়েছেন ( পেনরোজ টাইলিং, পেনরোজ লুকাস আর্গুমেন্ট ইত্যাদি)  সেগুলোর ফর্দ বানালে মনে হবে,  সেটা বুঝি একটা গোটা দেশের এক শতাব্দির অবদান!  তার কাজ নিয়ে জার্নালিস্ট সিমপ্লিফিকেশনে লেখা বেশ কঠিন, কিন্ত ইচ্ছা রইল পরে লিখব। 

 রজার নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন ব্ল্যাকহোলের পদার্থবিদ্যায় তার অবদানের জন্য- যা পেনরোজ হকিং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্ব নামে খ্যাত।  যার উৎসে আছে এক বাঙালী বিজ্ঞানীর নাম- অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরী-যিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বহুদিন অধ্যাপনা করেছেন।  এই তথ্যটুকু নানান ওয়েব্জাইনের দৌলতে সবাই জেনে গেছে। কিন্ত কোন লেখাতেই রায়চৌধুরী সমীকরন এক্সাক্টলি কি- সেটা নিয়ে কোন সহজ আর্টিকল চোখে পড়ল না।  যেহেতু, তার কাজ ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রি নিয়ে, এটা সহজ করে বোঝানো বেশ কঠিন। আমি এই প্রবন্ধে চেষ্টা করছি,  সহজ করে বোঝাতে, যাতে একটা সাধারন ধারনা হয়। ( তবে লিখতে গিয়ে বুঝলাম কাজটা বেশ কঠিন)। 

                                                                              (২)
আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটির প্রকাশকাল ১৯১৫। ঘনঘোর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই আইনস্টাইন সুন্দর একটি টেন্সর সমীকরন দিলেন-কিভাবে মাস অর্থাৎ ভরের প্রভাবে স্থান-কালের জ্যামিতিটাই বদলে যাবে। 

কিন্ত সমীকরন হচ্ছে একটা সিস্টেম কিভাবে আচরন করবে সেটা বোঝানোর জন্য বিভিন্ন রাশিগুলির ( যেমন নক্ষত্রের ভর, গ্যালাক্সির ভর, তাদের স্থান কালের জ্যামিতির নানান প্যারামিটার)  মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটির গণিতিক রূপ।  অর্থাৎ পদার্থবিদ্যা বা বিজ্ঞানে ইকোয়েশন হচ্ছে ( বা যেকোন গণিতের জন্যই ইহা সত্য- তা বিজনেস গণিত হলেও ) মেকানিকের স্ক্র ড্রাইভার বা ইলেক্ট্রিশিয়ানের মাল্টিমিটার।  
টুল বা তাত্ত্বিকদের সেই যন্ত্র হচ্ছে ইকোয়েশন-যেটা দিয়ে তারা মহাবিশ্বের প্রকৃতির রহস্যের ঘোমটা খুলবেন। 

তা ধরুন আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে শুধু জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটির সমীকরনটাই দিয়ে গেলেন। তাতে কিন্ত সমাধান নেই। কিভাবে আইন্সটাইনের সমীকরনের সমাধান করা যায়, সেটা আরেকটা বিরাট ইতিহাস গত একশো বছর ধরে। 

তত্ত্ব-সমীকরন দিলেই ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন না। কারন তত্ত্ব/ সমাধান  তৈরীর মূলে থাকে "এসাম্পশন"-অসংখ্য অনুমান। সেই অনুমান ঠিক কি করে বুঝবেন?

  সুতরাং  আইনস্টাইন শুধু রিলেটিভিস্টিক গ্রাভিটেশনের সমীকরন দিয়ে দেবেন এবং বিখ্যাত হবেন, ব্যপারটা মোটেও অত সহজ না ১৯১৫ সালে।   তার সমীকরনের অসংখ্য সমাধান থাকলেও, তাকে দুটি ক্ষেত্রে সমীকরনটা সমাধান করতে হল যেখানে পরীক্ষালদ্ধ প্রমান সম্ভব--

          আইনস্টাইনের হাতে যে ডেটা ছিল, যা নিউটনিয়ান ফিজিক্স দিয়ে ব্যখ্যা করা যায় না- সেটা হচ্ছে মার্কারী বা বুধের প্রিশেশন।  সমস্ত গ্রহ সূর্যের চারিদিকে উপবৃত্তাকার কক্ষে ঘোরে। এটা আমরা জানি। এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথ একটা সমতলে থাকে।মুশকিল হচ্ছে এই যে সমতলে সমস্ত গ্রহ ঘুরছে, সেই সমতলটি আবার একটু আধটু দুলতে থাকে-বেশ নিয়ম মেনে, লাট্টুর মতন। এর কারন বুধের ওপর অন্যান্য গ্রহদের টান ( তা সূর্য্যের থেকে যতই কম হোক না কেন)।  

   যোশেফ ভার্নিয়ার ( যার নামে ভার্নিয়ার স্কেল), ১৮৫৯ সালে জানালেন, নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে এই  প্রিশেসন ডেটা মিলছে না। উনি ১৬৯৭ থেকে ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত মার্কারির সমস্ত প্রশেশনের ডেটা নিলেন।  দেখাগেল মার্কারির প্রিশেন এঙ্গল- অর্থাৎ এই যে হেলছে দুলছে নিজের অক্ষ থেকে, যতটা এঙ্গলে হেলেছে তা ৫৭০ সেকেন্ডের কাছাকাছি। নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে ৫৪০ পর্যন্ত ব্যখ্যা করা যাচ্ছে । ৩০ সেকেন্ডের পার্থক্য ( বর্তমানে আমরা জানি এক্যুরেট ৪২ সেকেন্ডের পার্থক্য থাকে)- কোন ব্যখ্যা নেই।

  ১৯১৫ সালেই তার সেই ভীষন জটিল সমীকরনের বেশ সহজ সরল এক সমাধান করে ( এবং যা করতে গিয়ে তাকে এক গুচ্ছের অনুমানের সাহায্য নিতে হয়) আইস্টাইন  দেখালেন এই ৩০ সেকেন্ডে পার্থক্য, তার জেনারেল থিওরী অব রিলেটিভিটি  ব্যখ্যা করতে পারছে। 

 কিন্ত বিজ্ঞানীরা তাকে বিশ্বাস করবে কেন? রেজাল্ট জানা থাকলে, অনুমান গুলি ম্যানুপুলেট করা সহজ। সুতরাং তার সমীকরন যতই সুন্দর হোক, দরকার ছিল এই সমীকরন থেকে "প্রেডিক্ট" করা কোন ঘটনা -যা নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিতে পারবে না-এবং এস্ট্রোনমাররা তা পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন।

 হেনরী ক্যাভেন্ডিশ ( হ্যা আমাদের সেই বিখ্যাত কেমিস্ট যিনি হাইড্রোজেন আবিস্কার করেছিলেন) ১৭৯৭ সালে দেখান যে নিউটনিয়ান মেকানিক্সএর একটি প্রতিপাদ্য হচ্ছে, সূর্য্যের মতন বৃহৎ ভরের বস্তুর কাছ দিয়ে আলো আসার সময় বেঁকে যাবে। ১৯১১ সালে আইনস্টাইন দেখালেন,  ( তখন ও জেনারেল রিলেটিভিটি আসে নি) এর মান হবে , এক সেকেন্ডের কিছু কম। এবং তার প্রেডিকশন জোহান সোল্ডনারের সাথে মিলে যাচ্ছে যিনি ১৮০০ সালে একই প্রেডিকশন করেছিলেন।

 কিন্ত ১৯১৫ সালে  জেনারেল থিওরী আবিস্কার করার সাথে সাথে আইনস্টাইন বুঝলেন, ১৯১১ সালের কাজ ভুল।  আসলে সূর্য্যের প্রভাবে যে নক্ষত্রের আলো বেঁকে যাবে ( নইলে আলোর সরলরেখায় চলা উচিত চিরকাল ) তার মান 1.75 সেকেন্ড। 

 কি করে তা মাপা যাবে? তার জন্য সূর্য্যগ্রহন হওয়া দরকার। পূর্নগ্রাস সূর্য্যগ্রহনের সময় যদি দূরের নক্ষত্রগুলোকে দেখি যা সূর্য্যের দিকে আছে তখন, তাদের আলো কতটা বেঁকেছে জানা সম্ভব। কাজটা বেশ কঠিন। কারন পার্থক্য মাত্র 1.75 second-খুব ক্ষুদ্র এবং সূক্ষ্য। 

 মুশকিল হচ্ছে সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সূর্য্যগ্রহন বন্ধুদের দেশে না হলে যুদ্ধের বাজারে এই পরীক্ষা করা অসম্ভব। আমেরিকান এস্ট্রনমাররা ১৯১৬ সালে রাশিয়ায় সূর্য্যগ্রহনের সময় এটা পরীক্ষা করার চেষ্টা করেন-কিন্ত  টেলিস্কোপ কেড়ে নিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিল রাশিয়া (১৯১৭)। 

   এদিকে বৃটিশ এস্ট্রোনমার আর্থার এডিংটন এই পরীক্ষা করতে চাইছেন। কিন্ত রাষ্ট্র বলছে এইসব বিজ্ঞান ছাড়-এখন যুদ্ধে যাও।  এডিংটন যুদ্ধে সৈনিক হিসাবে গেলেন না।

শুধু তাই?  শত্রু রাষ্ট্র জার্মানীর বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কাজ পরীক্ষা করতে চাইছেন। তাকে বৃটেনের মিডিয়া জাতির শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দিল।  বিজ্ঞানীর কাজ ত দূরের কথা, প্রায় জেলে ঢুকতে চলেছিলেন আর্থার এডিংটন। কিন্ত শান্তিবাদি হিসাবে তিনি অনড়!

 যাইহোক যুদ্ধ শেষ হলে, তিনি পরীক্ষা করার অনুমতি এবং গ্রান্ট পেলেন।  সেটা ১৯১৯ সাল।  মে ২৯, ১৯১৯ সেই বিখ্যাত দিন। অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিন আফ্রিকা-দুই জাগাতেই সূর্য্যগ্রহনের সময় নক্ষত্রদের আলোর অপরসরনের পরীক্ষা হয়।  দুই জায়গায় রেজাল্ট এক ।  1.75 second. ৩০শে মে সমস্ত বিশ্বের নিউজপেপারে এল আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটির এই অদ্ভুত আবিস্কার।  

   বিজ্ঞানীরা এবার নিশ্চিত আইনস্টাইনের সমীকরন নির্ভুল, নিখুত এবং সুন্দর।

                                                                       (৩)

  কিন্ত এই সমীকরন নিখুঁত হওয়াটাই আবার অনেক সমস্যার জন্ম দিল। ভীষন জটিল এই টেন্সর সমীকরন। এখানে ভর, নিউটনের সমীকরনের মতন নিরীহ ঠুঁটো জগন্নাথ না। ভর এখানে এনার্জি মোমেন্টাম টেন্সর। এইটা না বুঝলে রয়চৌধুরী সমীকরন বোঝা মুশকিল। 


আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকোয়েশনে ভর হচ্ছে " টেন্সর ফিল্ড"।  টেন্সর ফিল্ড বোঝার আগে ভেক্টর ফিল্ড বোঝা যাক।  ধরুন একটা চার্জ অন্য চার্জকে টানছে বা দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমরা সবাই জানি ওটা ইলেক্ট্রোস্টাটিক ফিল্ড।  সোজা ভাষায় কোন এক ডিরেকশনে ফোর্স থাকলে, সেইদিকে বস্তুর ত্বরন থাকবে। এটা ভেক্টর ফিল্ডের সহজ উদাহরন। 

  টেন্সর ফিল্ড আরো জেনারালাইজড। ধরুন একটা বাঁশ। আপনি দুমড়াচ্ছেন। মানে ক্লক ওয়াইজ বা এন্টিক্লক ওয়াইজ একটা ফোর্স দিচ্ছেন। তার মানে কি বাশটা শুধুই ওই ক্লক ওয়াইজ বাঁ এন্টি ক্লক ওয়াইজ দুমড়াবে? 

 মোটেও না। আপনি ঘোরানোর জন্য ফোর্স দিচ্ছেন-কিন্ত বাশটার ফাটল তৈরী হল ধরুন ওপর নীচ। ভার্টিকাল। কারন ম্যাটেরিয়ালের একদিকে ফোর্স দিলে, ডিফর্মেশন অন্য অনেক দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ক্ল্যাসিকাল পদার্থবিদ্যায় এই ধরনের  শিয়ার, টর্সন ইত্যাদি নানাবিধ ফোর্স্ফিল্ড দেখতে পাবেন।

 আরেকটা উদাহরন দিই।  ধরুন জলঘোলা করছেন। আপনি বল প্রয়োগ করছেন বৃত্তাকারে-কিন্ত জল উথাল পাতাল হচ্ছে। অর্থাৎ একদিকে ফোর্স দিলেন, কিন্ত প্রভাব ছড়াচ্ছে সব দিকে। 

 এই ধরনের  ঘটনাগুলিকে ব্যখ্যাকরার জন্য গণিতের  দুটি জিনিস খুব প্রয়োজনীয় 

   এক,  টেন্সর। যা একধরনের ম্যাট্রিক্স এবং একদিকের বলপ্রয়োগ অন্যদিকে কিভাবে ছড়ায় তার একটা "রিপ্রেজেন্টেশন" বা নোটেশন দেয়। সমাধান দেয় না কিন্ত!

  দুই রিকি ফ্লো। রিকি ফ্লো দাঁড়িয়ে আছে রিকি কার্ভেচার টেন্সরের ওপর। 

  ওই যে বল্লাম বাঁশকে দুমড়ে মুরছে দিচ্ছেন। জলকে ঘুলিয়ে দিলেন। কি হচ্ছে এফেক্টটা? বাঁশটা ছিল সিলিন্ডার- কিন্ত তার তল গুলিকে সব ঘেঁটে দিয়েছেন। তারা বেঁকে দুমড়ে মুছড়ে গেছে। জলঘোলা করার সময় ভাবুন। জলের তল ছিল সমতল। কিন্ত সেই তলের জ্যামিতি সব আলাদা করে দিলেন ফোর্স চালাতে। 

   রিকি টেন্সর ডিফারেনশিয়াল জিওমেট্রির সব থেকে গুরুত্বপূর্ন রেজাল্ট। ভাবছেন ডিফারেন্সিয়াল জ্যামিতিটা কি?   ওইযে বল্লাম জল বাঁশ মাটি-এদের ওপর বলপ্রয়োগে যখন এদের জ্যামিতি বদলে দিচ্ছেন তখন কি হচ্ছে ? ক্রমাগত তাদের তলের পরিবর্তন হয়ে চলেছে।  এই পরিবর্তনশীল তলের জ্যামিতিকে ধরার জন্য রিকি টেন্সর লাগে।

 আবার ফিরে আসি আইনস্টাইনে। উনার সমীকরন বলছে বস্তুর ভরের জন্য স্থান কালের যে জ্যামিতি  তা দুমড়ে মুছরে দিচ্ছে ।  তাহলে আইনস্টাইনের সমীকরনটা এইভাবে ভাবুন 

     ভর, অর্থাৎ এনার্জি-মোমেন্টাম টেন্সর , স্থান কালের রিকি টেন্সরগুলোকে বদলে দিচ্ছে। তাহলে  আইনস্টাইনের ফিল্ড ইকোয়েশন  হবে এই রকম 

   স্থানকালের রিকি কার্ভেচার টেন্সরের পরিবর্তন =কনস্টান্ট  x মাস টেন্সর 

  বাদিকেরটা আসলে লেখা হয় আইনস্টাইন টেন্সর হিসাবে যা রিকিটেন্সরের সাথে গ্রাভিটেশনাল  মেট্রিক গুন করে পাওয়া যায়। আর কনস্টান্টের ভ্যালু , উনিভার্সাল গ্রাভিটেশনাল কনস্টান্ট/ (আলোর বেগের) ^4 

 মোদ্দা কথা আইনস্টাইনের সমীকরন মানে বিভিন্ন টাইপের মাস- মানে নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এরা কিভাবে স্থানকালের জ্যামিতিকে বদলে দিচ্ছে, সেটা বলে দেয়। 

       আইনস্টাইনের সমীকরন এত জটিল , উনি নিজেও ভাবেন নি কেউ এর সমাধান করবে। কিন্ত জার্মান গণিতজ্ঞ কার্ল সোয়াজচাইল্ড কয়েকমাসের মধ্যেই প্রথম গ্রহনযোগ্য সমাধান আনলেন দুটো স্পেশাল কেসে 
    
        এক, যদি ভর একটি গোলক হয় ( সূর্য্য বা অধিকাংশ নক্ষত্র প্রায় গোলক)।
         দুই,  যদি ভর একটি পয়েন্ট মাস হয়। মানে ধরুন একটি কনা, যার ভর সূর্য্যের থেকেও বেশী। 

   তার সমাধানে একটা অদ্ভুত প্যারামিটার এল, যাকে এখন আমরা সোয়ার্জচাইল্ড রেডিয়াস বলব। ব্যপারটা এই, সোয়ার্জচাইল্ড সমাধানে দুটো টার্ম থাকে- একটা ( 1-r_s/r)   [ 1/(1-r/r_s)] । এর মানে দাঁড়ায় এই যে ধরুন সূর্য্যের যে ভর, তাতে সূর্য্যের ব্যাসার্ধ্য যদি ৩ কিমি হত, তাহলে সূর্য্যের জন্য তার আশেপাশের স্থান-কাল পুরো দুমরে মুছরে শেষ হয়ে যেত-মানে সব এত বেশী গ্রাভিটেশনার পুল তৈরী হত, সেখানে আলো আটকে যাবে। সব কিছু আটকে যাবে। পৃথিবীর যা ভর, তাতে তার সোয়ার্জ চাইল্ড র‍্যাডিয়াস ৯ মিলিমিটার মোটে। অর্থাৎ পৃথিবীর সবকিছুকে একটা ৯ মিলিমিটার ব্যসার্ধের গোলকের মধ্যে পুরদিতে পারলে, তার মধ্যে আলো আটকে যাবে। 

  যাইহোক অদ্ভুত প্রতিভা ক্ষনজন্মা জার্মান ইহুদি বিজ্ঞানী সোয়ার্জ চাইল্ডের।  তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। উনি নিজের ইচ্ছায়  জার্মান কামান বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। কামান বাহিনীর অঙ্ক করেন দিনে।  বাতাসের গতিবেগের ওপর নির্ভর করে কত ডিগ্রিতে কামান ছাড়ালে, কোথায় গোলা পৌছাবে।     রাশিয়ান ফ্রন্টে। এটা তার যুদ্ধের কাজ। কিন্ত রাশিয়ান ফ্রন্ট অনেক শান্ত। অধিকাংশ সময় কাজ নেই। তাই বসে বসে অঙ্ক করেন।  ১৯১৫ সালে আইন স্টাইনের ফিল্ড সমীকরন দেখে আনন্দে সেই নিয়েই পরে রইলেন একমাস । যে সমীকরন সমাধান করা প্রায় অসম্ভব মনে হয়েছিল আইনস্টাইনের কাছে,  তার কাজ দেখে আইনস্টাইন আনন্দে বিহ্ববল । সোয়ার্জচাইল্ডকে জানালেন তিনি ভাবতেই পারেন নি মাত্র একমাসের মধ্যে কেউ তার সমীকরনের এত ভাল সমাধান দেবে।

 তবে ওই সোয়ার্জচাইল্ড র‍্যাডিয়াসের ব্যপারটাই উনি বিশ্বাস করলেন না। তার মনে হল এমন বাস্তবে হওয়া সম্ভব না। 

  দুর্ভাগ্য এই যে এর কয়েকমাস বাদেই সোয়ার্জচাইল্ড মারা যান।  কিন্ত ব্ল্যাকহোলের প্রথম তাত্ত্বিক তিনিই। 

  রায়চৌধুরী তার সমীকরন দেন ১৯৫৫ সালে।  ১৯১৫-৫৫, প্রায় চল্লিশ বছর আইনস্টাইনের সমীকরনের আরো অনেক সমাধান আসবে। 

  ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান দেখালেন, তার সমাধানে এই মহাবিশ্ব সম্প্রসরানশীল। হাবল ১৯২৯ সালে সেটার প্রমান দিলেন। লার্মাট, রেইন্সনার, নর্সডার্ম, কের- এরাও গুরুত্বপূর্ন সমাধান দিয়েছেন। 

  তাহলে রায়চৌধুরী এক্সক্টলি কি করলেন যার জন্য তার সমীকরন এত গুরুত্বপূর্ন? 

   আসলে উনার কাজের গুরুত্ব বুঝতে গেলে প্রথমেই বুঝতে হবে, এদ্দিন (১৯৫৫) পর্যন্ত আইনস্টাইনের সমীকরনের যত সমাধান এল, তাতে মহাবিশ্বের এই বস্তুগুলিকে স্টাটিক-মানে স্থির ভরের স্থির বস্তু হিসাবে ধরা হত।  কিন্ত আসলেই ত সূর্য্য থেকে সব নক্ষত্র স্থির না- তাদের ঘুর্নন আছে-আবার গ্যালাক্সিতেও কক্ষপথে ঘুরছে। 

 সেক্ষেত্রে রিকি কার্ভেচারের কি হবে?  এটাই আমরা দেখব পরের পর্বে। 

   
   

 





Sunday, July 19, 2020

ডাইনোসর কোম্পানিগুলো কেন ভারতে রাজত্ব করছে?

এটি বিশ্বের প্রথম ৫০ টি ইনোভেটিভ কোম্পানীর লিস্ট। লক্ষ্য করুন এর মধ্যে একটিও ভারতীয় কোম্পানী নেই। টাটা, আম্বানী কেউ নেই।
অথচ এই কোম্পানীগুলিতে প্রচুর ভারতীয় আছেন উচ্চপদে। ভারতে এই সব কোম্পানীগুলির বড় আরন্ডি আছে। অনেক ক্ষেত্রে ( গুগুল, ফেসবুক, মাইক্রোসফট) ভারতীয়রাই এই সব কোম্পানীগুলির মূল ইনোভেটিভ "ফোর্স"।
অথচ এদের একটও ভারতীয় না।
অনেকেই আশ্চর্য্য হবেন। ভারত এবং আমেরিকার শিল্প সংস্থায় দীর্ঘ কুড়ি বছর কাজ করার সুবাদে আমি একদম অবাক হই নি।
এর মূল কারন ভারতের ব্যবসা এবং শিল্প চালায় যে শ্রেনীটি-তারা মূলত মারোয়ারী, গুজরাতি, পার্শী এবং কিছু সিলেক্টিভ বিজনেস কমিউনিটি। শিল্প স্থাপন থেকে শিল্প চালনার ক্যাপিটাল কেবল মাত্র এই বিজনেস ফ্যামিলিগুলির হাতেই আছে। ভারতের মূল সমস্যা হচ্ছে ক্যাপিটাল যেসব ফ্যামিলিগুলোর হাতে, শিল্প পরিচালনা মূলত সেই সব ফ্যামিলির ছেলে মেয়েরাই করে। ইনভেস্টর এবং এক্সিকিউটিভ ক্লাসটা আলাদা না। যেমন ধরুন গোয়েঙ্কারা। ওদের ছেলেরাই চালাচ্ছে। আবার তারাই কোম্পানীর মালিক-কারন ক্যাপিটাল তাদেরই।
আমেরিকা/ইউরোপ বা জাপানে এমন হয় না। এখানে ক্যাপিটাল বা ওনারশিপ, পাবলিক বা প্রাইভেট হতে পারে। কিন্ত কোম্পানীর সিইইও বা যারা চালাবে-তারা মূলত পেশাদার। ফলে আমেরিকান কর্পরেট স্ট্রাকচার চলে মেরিটোক্রাসিতে। আমেরিকার সিইওরা কিন্ত একদম গ্রাউন্ড লেভেল থেকে উঠে আসা মানুষ।
ভারতে এলন্টি, ইনফোসিস কিছুটা ওইভাবে চলে। যার জন্য এদের কর্পরেট গভর্নেন্স ভাল। কিন্ত অধিকাংশ কোম্পানীতেই মালিকদের ছেলে মেয়ে ভাইপোরা উচ্চপদ অধিকার করে বসে আছে। গোয়েঙ্কা, আম্বানীরা এইভাবেই কোম্পানী চালাচ্ছে।
ভাবছেন এর সাথে ইনোভেশনের সম্পর্ক কি? আছে। ক্যাপিটালিস্ট স্ট্রাকচারে সব কিছুই পুঁজির সাথে গাঁটছাড়া। হাওয়াতে কিছু হয় না। ফ্যামিলি বিজনেসগুলো ভারতে ইনোভেশনের ওপর জোর দেয় না। তারা টেকনোলজি লাইসেন্সেই আস্থা রাখে। কারন তাতে রিস্ক কম। রিটার্ন অনেক বেশী। এটাই ভারতের বিজনেস ফ্যামিলি কালচার। এই কালচারে বড় হওয়া সিইওদের দুটো সমস্যা (১) ইনোভেশনের ক্ষেত্রে বিদেশী নির্ভরতা (২) মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভু ভৃত্যের সামন্ততান্ত্রিক কালচার। বিড়লা, আম্বানী, টাটা, গোয়েঙ্কা -এদের সবার ব্যবসার ইতিহাস গোলমেলে। বৃটিশ আমলে কেউ আফিঙ, কেউ সোনা, কেউ তুলো, কেউ বেশ্যাদের স্মাগলিং করে টাকা করেছিল। আমবাগানে ত আর হঠাৎ করে কাঁঠাল ফলবে না। সে যতই চতুর্থ বা পঞ্চম জেনারেশনের আম বাগান হোক।
ফলে ট্যলেন্টেড লোকেরা এইসব কোম্পানীতে কাজ করতে যায় না। যায় সেকেন্ড রেটেড ট্যালেন্ট বা লিডারশিপ।
এবং এইভাবেই চলছে। ভারতের ফ্যামিলি কোম্পানীগুলো টেকনোলজি লাইসেন্স করে লাভ ভাল করে। কারন বিশাল মার্কেট। ভারতের বিশাল মার্কেট এক্ষেত্রে টেকনোলজি ইনোভেশনের সহায়ক না হয়ে অন্তরায় হয়েছে।
কিন্ত ভারতে এই ধরনের
ডাইনোসর কোম্পানিগুলো কেন ভারতে রাজত্ব করছে? কেন নতুন কোম্পানীগুলি তাদের প্রতিযোগিতায় সরিয়ে দিচ্ছে না?
এখানেই ভারতের দুর্বল ক্যাপিটাল স্ট্রাকচারের সমস্যা। আমেরিকাতে একজন অভিজ্ঞ এক্সিকিঊটিভ নতুন আইডিয়া নিয়ে মার্কেটে ঢুকতে চাইলে পেশাদার ইনভেস্টর পাবেন। ভারতে ধরুন একজন মারোমাড়ী মালিকের অভিজ্ঞ বাঙালী এক্সিকিউটিভ দেখলেন সেই মার্কেটে নতুন আইডিয়া নিয়ে নতুন ধরনের ব্যবসা খুলতে পারেন। কিন্ত সেই বাঙালীকে টাকা কে দেবে? ভারতে ব্যবসার টাকা পুরোটাই মারোয়ারি, গুজরাতি, পাঞ্জাবীদের হাতে। তারা শুধু নিজেদের কমিউনিটিতে মূলত নতুন বিজনেসে টাকা খাটায়।
ফলে ভারতের শিল্প ব্যবসার সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো-মানে ফ্যামিলি বিজনেস যাওয়ার না। আর ওটা না গেলে, ভারতে ২৪ টা কেন ২৪০টা আই আই টি খুললেও কিছু হবে না। আই আই টিয়ানদের মাথায় যদি মারোমারী গুজরাতি মালিক থাকে, সে লাভ-ক্ষতির হিসাব করা ম্যানেজার হবে। ইনোভেটিভ ইঞ্জিনিয়ার হবে না।
তবে নতুন স্টার্টাপ কালচারে ভারতে এসব বদলাচ্ছে। আস্তে আস্তে বদলাতেই হবে। কিন্ত সময় লাগবে। মুশকিল হচ্ছে চিনের সরকার তার প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ারদের যে সাপোর্ট দিচ্ছে ভারতে তা অনুপস্থিত। অনেক আই আই টির ছাত্র স্টার্টাপ খুলছে। কিন্ত কোন সরকারি সাহায্য নেই। ইনভেস্টর ও কম। চীনকে শুধু গালাগাল দিলেই হবে না। চীনের সরকার কিভাবে প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়াদের টাকা দিয়ে কোম্পানী খুলতে সাহায্য করে- সেসব ও দেখে শিখতেই হবে। শুধু ওই মুখে জাতীয়তাবাদি ডায়ালোগ মেরে ভারত উঠবে না।

Friday, July 17, 2020

কোভিড নেতৃত্ব

বন্ধু এবং নেতৃত্ব- দুটোই আপনি চিনবেন সংকটে। দুঃসময়ে।
প্যান্ডেমিকের সামনে ট্রাম্পের রিয়ালিটি শো, মোদি ম্যাজিক, মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রীত্ব সবই ভ্যানিশ!
হু এর নেতৃত্ব, আই সি এম আর, সিডিসি-ইত্যাদি যেসব বিজ্ঞান সংস্থার লিড করা উচিত, আজকে তাদের আর কেউ বিশ্বাস করে না! কেন করবে? আজ যা বলছে, কালকে ১৮০ ডিগ্রি পালটি খাবে! একদিন প্রকাশিত হচ্ছে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন কাজ করে, পরের দিন অন্য আরেক গবেষনা বলছে কাজ করে না! ছমাস হতে চললো। ভাইরাস কি ভাবে একজন থেকে অন্য জন্যে সংক্রামিত হয়-সেটা পর্যন্ত কেউ সঠিক ভাবে বার করতে পারল না। কিভাবে ভাইরাস ছড়াচ্ছে-সেটাই যদি বিজ্ঞানীরা ঠিক ভাবে বার করতে না পারে, তাহলে রোগ ছড়ানো কিভাবে আটকাবে? আল্টিমেটলি এই ছফুট স্যোশাল ডিস্টানিং, মাস্ক পড়া ইত্যাদি আদৌ কাজ করে কি না-কারুর পক্ষে নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব না।
বেসিক্যালি এই ভাইরাস সব "অথোরিটির" প্যান্ট খুলে দিয়েছে। চোখ খুলে দেখাচ্ছে, আমাদের রাষ্ট্র, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য কাঠামোর করুন অবস্থা।
বর্তমানে আমেরিকাতে প্রতিদিন ৫০,০০০ ইনফেক্টেড হচ্ছে। ২০,০০০ এ নেমে এসেছিল। লকডাউন তুলে দিতে দুই সপ্তাহে ২০,০০০ থেকে বেড়ে ৫০,০০০। তবে ভাগ্য ভাল এই যে মৃত্যুর সংখ্যা ২০০০ থেকে কমে গড়ে ৫০০ তে নেমেছে আমেরিকাতে। ভারত/পশ্চিম বঙ্গে এক অবস্থা। লক ডাউন একটু হাল্কা করতেই , অগ্ন্যৎপাতের মতন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাস।
এবার আপনার স্মার্টফোনের দিকে তাকান। গত দশ বছরে স্মার্টফোনের এত উন্নতি হয়েছে-হাতের মুঠোই আপনার পৃথিবী। স্মার্টফোনের যে ছোট ছোট সিলিকন ইউনিটগুলি ডেটা স্টোর করছে, ডেটা নিয়ে কাজ করছে, তার আয়তন কিন্ত করোনা ভাইরাসের থেকেও অনেক ছোট। সেগুলো মানুষের তৈরী আবিস্কার। তাই দিয়ে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বড়াই করছি- মুহুর্তের মধ্যে হোয়াটসাপএ পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের কাছের মানুষটির সাথে ভিডও চ্যাট করছি!
অথচ মাত্র একটা ভাইরাসকে গোটা পৃথিবীর সব বিজ্ঞানী, ডাক্তার, রাষ্ট্রনেতা, প্রযুক্তিবিদ মিলেও কব্জা করতে পারছে না। কব্জা করাত দূরের কথা ভাইরাস কিভাবে ছড়াচ্ছে, সেটা পর্যন্ত ঠিক ভাবে জানে না।
প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের দিকে দিয়ে দেখতে গেলে একটা স্মার্টফোন তৈরী করতে যে পরিমান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি লাগে তার কাছে যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি নিয়ে আমরা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছি, তা নেহাতই শিশু।
এবং সমস্যাটা এখানেই। মানুষ বা বিজ্ঞানীরা পারে না তা না। গত দশ বছরে স্মার্টফোনের গবেষনা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এর পেছনে প্রায় ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। প্রচুর মেধা সেখানে কাজ করেছে। তার তুলনায় ভাইরাস বা প্যান্ডেমিক আটকানোর গবেষনায় এক বিলিয়ান ও খরচ হয় নি। অর্থাৎ স্মার্টফোনের উন্নতিতে , গুগুল, ফেসবুকের আরন্ডীতে মানবজাতি যা খরচ করেছে, ভাইরাস ঘটিত প্যান্ডেমিক ঠেকানোর জন্য গত দশ বছর তার দশমিক এক পার্সেন্ট ও খরচ হয় নি! ফলে প্যান্ডেমিক ঠেকানোর প্রযুক্তি, ঔষধ কোনটাই নেই। কিন্ত কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে যে প্রযুক্তির দরকার ছিল, তা স্মার্টফোনের তুলনায় নেহাতই শিশুতোষ।
এখানেই ক্যাপিটালিস্ট অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক সিস্টেমের ব্যর্থতা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে আল্টারনেটিভ কোন সিস্টেম নেই যা দিয়ে বিজ্ঞান লদ্ধ ফল মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া যায়। স্যোশালিজম দিয়ে কিস্যু হবে না প্রমানিত। আবার ক্যাপটালিস্ট সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সুতরাং সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক সিস্টেম বদলাবে। সেটা সমাজতান্ত্রিক হবে না। কারন সোশালিজম ফেইল্ড এক্সপেরিমেন্ট। যেখানেই চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে সর্বত্র চূড়ান্ত ব্যর্থ। ক্যাপিটালিজম ও হবে না। ক্যাপিটালিজমের অবস্থা এখন শতাব্দি পুরাতন গাড়ির মতন। বাজারে নতুন মডেল নেই-ফলে পুরাতন যা চলে, তাই দিয়ে চালানো। কিন্ত সত্যিই গাড়ি আর চলছে না।
ধনতন্ত্র/মার্কেট ইকনমি থেকে উন্নততর কিছু আমাদের দরকার। সেটা অবশ্যই স্যোশালিজম না। উন্নততর রাজনীতি এবং উৎপাদন কাঠামো না আসলে, ভাইরাস, ভূমিকম্প, জলের অভাব, দূষন-সব কিছু মিলে এই সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেবে।

আত্মঘাতি জ্যোতি বসু

আত্মঘাতি বাঙালীর আদর্শ আত্মঘাতি কালিদাস নেতা ছিলেন জ্যোতি বসু। এই সাদা ধুতি পরা গুড ফর নাথিং বাম বাঙালী এলিটেদের জন্য বাংলার আজ এই হাল। প্রথমেই এটা মাথা থেকে বার করতে হবে, সাদা ধুতি, সাদা চুল, সৎ বাম নেতা মানে ভদ্র ভাল বাঙালী নেতা-এটা ঠিক না। এপারেয়ান্স কান বি ডিসেপ্টিভ।
নেতা জনতা থেকে আলাদা নন। জ্যোতি বসু এদ্দিন বাঙালীর নাম্বার ওয়ান নেতা ছিলেন কারন বাঙালীর ঐ সাদা ধুতি সৎ বাম বাঙালী নেতা নিয়ে একটা আশা ভরসার জায়গা ছিল-বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল। কিন্ত অন হাইন্ডসাইট, লুক ইজ ডিসেপ্টিভ।
উনাকে নিয়ে আগে বহু লিখেছি-গল্প এবং কেন উনি পশ্চিম বঙ্গ ধ্বংসের ধৃতরাষ্ট্র। পুরাতন টাইম লাইন থেকে তিনটে তুলে দিলাম...
নিজের পোষ্টগুলো লাস্ট চারবছরে এই ৮-৯ জুলাইতে লেখা।
(1)
আমাদের প্রজন্ম এবং তার আশেপাশের দুই দশকের বাঙালী সন্তানদের অধিকাংশই পশ্চিম বঙ্গে ফিরতে পারবে না। কারন জ্যোতিবসু এবং সিপিএম। বুদ্ধ সফল হলে হয়ত, এই লাইনগুলো লিখতে হত না। আই আই টিতে জ্যোতি বসু সম্মন্ধে ছড়া কাটত অবাঙালীরা- জাতীয় পশু, জ্যোতি বসু। বাইরের রাজ্যগুলো এগোচ্ছে, পশ্চিম বঙ্গ ক্রমশ তখন পিছোচ্ছে। অন্যরাজ্যের ছেলে মেয়েরা ভীষন টিটকারি মারত।
এমন একজন ছিল স্বামীনাথন-মেটার ছাত্র, আমাদের একবছরের সিনিয়ার। আই আই টি কেজিপিতে এই স্বামী আর আজকের গুগুলের সিইও সুন্দর পিচাই ছিল হরিহর আত্মা। একবার হয়েছে কি তামিলনাডুতে হেবি নাটক চলছে। ডি এম কে এসে জয়ললিতাকে জেলে পুরেছে-তামিলনাডু জ্বলছে। আমরা বেশ মজা নিচ্ছি। শনিবারের সকালে স্বামীকে হালকা করে প্যাঁক মারার সুরে ব্রেকফাস্ট টেবলে বল্লাম-তামিলনাডু হচ্ছে ভারতের রাজনীতির আর্মপিট। তামিল রাজনীতি থেকে শুধুই বগলে ঘামের গন্ধ বেরোয়।
স্বামী ফোঁস করে উঠল। ছেলেটা তামিল কিন্ত ভালো বাংলা শিখেছিল। বলে-শালা তোরা বাঙালীরা ১৫ বছরে মুখ্যমন্ত্রী চেঞ্জ করতে পারলি না-যে আরামে তোদের পোঁদ মেরে যাচ্ছে । সব বাঙালী শালা হোমো নইলে একটা পার্টি আর তার অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রী কি করে তোদের বছরের পর বছর পেছন মারে!!
সেটা বোধ হয় ১৯৯৪। স্বামী আমেরিকাতে মারা যায় ১৯৯৭ সালে, ট্রাকের সাথে গাড়ীর ধাক্কায়। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। সিপিএম মাত্র ১৫ বছর টেকাতেই তামিলদের কাছে অমুন প্যাঁক খেয়েছিলাম। না জানি ও যদি জানত সিপিএম ৩৪ বছর ধরে বাংলার ক্ষতি করে গেছে।
(2)
জ্যোতিবসু ব্যক্তিগত ভাবে একজন সজ্জন বাঙালী ভদ্রলোক। কিন্ত রাজনৈতিক বিচার বিবেচনায়, বাংলাকে ধ্বংশের পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রতিদ্বন্দী একমাত্র বল্লাল সেনই হতে পারে। তার পোষ্য সিটুর অত্যাচারে যখন একের পর এক কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছিল, তিনি শ্রমিক আন্দোলনে রাশ টানেন নি, যে রাশ ছিল তার নিজের হাতে। পক্ষান্তরে আজকে যে লাখে লাখে বাঙালী যুবকদের রাজ্য ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর পুনেতে গিয়ে করে খেতে হচ্ছে- সে আই টি কর্মীই হোক, আর হোটেলের ওয়েটারই হোক- সেই সব্বোনাশের পথটা উনার তৈরী।
আমি উনার ওপর এই জন্য ক্রদ্ধ, যে সিপিএমের ৩৪ বছরে বাংলার যে সর্বনাশ হয়েছে, সেটা হারে হারে টের পাই যখন দেখি কোলকাতায় একটা ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং ট্যালেন্ট খুঁজতে গেলে পাওয়া যায় না। ভালরা সবাই ব্যাঙ্গালোর, পুনে চলে গেছে বা এখনো যাচ্ছে। এই অবস্থায় কোলকাতায় ভাল আই টি প্রজেক্ট আসাও মুশকিল। এর সাথে মমতার জমির নীতির সম্পর্ক নেই। মূল সমস্যা এখন ডিম না মুর্গী আগে। দক্ষ কর্মী না থাকলে, ভাল প্রোজেক্ট এখানে আসবে না-আর প্রজেক্ট না এলে দক্ষ কর্মী তৈরী সম্ভব না।
উনি বোঝেন ও নি, পশ্চিম বঙ্গের কি সর্বনাশটাই উনি করছিলেন। সেটা আরো বেশী অন্ধত্ব। গোটা রাজ্য থেকে সক্ষম প্রতিভাবান বাঙালীরা সবাই চলে গেছে বহুদিন। এখনো যে দুচারটি প্রতিভা ওঠে, তারাও চলে যায় ব্যাঙ্গালোর পুনে তে। কারন কোলকাতায় সুযোগ নেই- সে ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসা, সিনেমা গান- সব কিছুর জন্যই সত্য।
উনার ফ্যানবেস ও বোঝে না উনিই বাংলার সর্বোনাশের আসল কান্ডারী। আজকে সিন্ডিকেট থেকে কলেজে ভর্তি হওয়া, পুলিশ থেকে প্রফেসার সবার দলদাস হওয়া-সবটাই উনার দান। বা উনার সৃষ্ট বেকারত্বের দান।
এমন বাঙালীর জন্মদিনে "কমরেড লহ প্রনাম" যারা এখনো লিখছে আবেগে, তাদের বলি, কমরেড লিখুন " বাংলার শ্রেষ্ঠ কালিদাসের জন্মদিনে লহ প্রনাম"।
(৩)
সিপিএম -আত্মঘাতি বাঙালীর ইতিহাস
(১)
২১ ই আগস্ট, ১৯৯১। মস্কোতে ট্যাঙ্ক ঘিরে ফেলেছে ক্রেমলিনের প্রাসাদ। হার্ডলাইন কমিনিউস্ট নেতারা গর্বাচেভকে তার ক্রিমিয়ার সামার রিসর্টে গৃহবন্দি করে বিশুদ্ধ কমিনিউজম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মিলিটারী ক্যু ঘটিয়েছেন। জনগণ পালা করে পাহারা দিচ্ছে বরিস ইয়েটসলিনের গণতন্ত্রপ্রেমী রাজনৈতিক নেতাদের। কেজিবির ওপর নির্দেশ এল, মেশিনগান নিয়ে ঢুকে বিদ্রোহি গণতন্ত্রকামী নেতাদের ১০০% ডাইল্যুউশনের। ফিনিশ দেম। সেভ কমিউনিজম!
এই অধ্যায়ে কেজিবির হেড তাদের কমরেডদের জিজ্ঞেস করলেন-তোমরা কি চাও? সেই কমিনিউস্ট জমানায় ফিরে যেতে যেখানে পার্টির অঙ্গুলি হেলনে কারনে অকারনে খুন করতে হয়, বন্দি করতে হয়-নাকি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাশিয়া? কজন বরিস ইয়েসলিনের ( তখন বরিস ইয়েসলিন রাশিয়ান ফেডারেশনের হেড) দলবলকে খুন করতে রাজী আছ?
একজন কেজিবি এজেন্ট ও এগিয়ে এল না।
কি করে আসবে? তারা দেখেছে রাশিয়া দুরাবস্থা। কোথাও খাবার নেই। সর্বত্র স্ট্রাইক। গত কুড়ি বছর ধরে একটা দেশের অর্থনৈতিক প্রগতি নেগেটিভ।
সেই মুহুর্তটাই কমিনিউস্ট নামক দানবটির মৃত্যুক্ষন। এরপর যা ঘটেছে সোভিয়েতের পতন, ইস্টার্ন ব্লকের পতন,পশ্চিম বঙ্গের কমিনিউস্টদের পতন-সবটাই সেই মৃত্যুর পরে, দানবটার আস্তে আস্তে একেকটা অর্গান শুকিয়ে আসা। নতুন করে মৃত্যু না। মৃত্যু অনেক আগেই ঘটেছে। সেই ২১শে আগস্ট, ১৯৯১।
এর আগে পর্যন্ত, মিথ্যে প্রচারে আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম সোভিয়েত ইউনিয়ান হচ্ছে স্বর্গরাজ্য। কেন কমিউনিজম? ছোটবেলায় আমাদেরকে দেখানো হত -সোভিয়েত ইউনিয়ান। এক স্বপ্নরাজ্য। সেই প্রপাগান্ডার জন্য মির পাবলিকেশন থেকে আসত বাংলায় অনুদিত প্ত্রিকা সোভিয়েত ইউনিউয়ান। বিনা পয়সায় মাসে একদিন। অবিশ্বাস্য পেপার এবং প্রিন্টিং কোয়ালিটি। ওই প্রিন্টিং কোয়ালিটি দেখেই কমিনিউজমের প্রতি বিশ্বাসে মাথা নীচু হয়ে আসত! তার ওপরে আছে অবিশ্বাস্য সব ছবি সোভিয়েতের লাইফ-স্টাইলের। সুইমিং পুল, টেনিস , ডিস্কো-রেস্টুরেন্ট। কে জানত তখন ওই লোকগুলো মাত্র দুশো গ্রাম বাটারের জন্য রেশনের লাইনে মারামারি করে মাথা ফাটাচ্ছে?
অথচ কোনদিনই তখন জানতাম না, যাসের অবিশ্বাস্য পরিশ্রমে বেড়োচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ান, তাদের পেটে রুটি নেই। খাদ্য সংকট এত তীব্র হয় রাশিয়ায়, ১৯৮৯ সাল থেকে রেশন চালু করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার ।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ান ধ্বংস হয়, পৃথিবীর সমস্ত দেশের কমিনিউস্ট পার্টিগুলির মৃত্যুদিন সেদিনই লেখা হয়ে গিয়েছিল। ওই ১৯৯১ সালের পরেও যে পশ্চিম বঙ্গে একটা কমিনিউস্ট পার্টি ৩৪ বছর টিকে আসে-এই বিশ্লেষনটা করা দরকার আছে। কমিনিউজমের মৃত্যু মানে অবশ্যই বামপন্থার মৃত্যু না। কিন্ত ওই লেনিনবাদি পার্টি স্বর্গ, পার্টি মর্ত্য টাইপের আবাল আদর্শবাদ পয়দা করে একটা জাতিকে সম্পূর্ন ধ্বংশ করার আত্মঘাতি রাজনীতি ১৯৯১ সালের পরেও কিভাবে ২৫ বছর বাংলায় টিকে গেল-তার সম্পূর্ন কৃতিত্ব প্রাপ্য ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের।
(২)
১৯৯১ সালের মধ্যেই, জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ানের দৌড়াত্মে পশ্চিম বঙ্গের শিল্প সম্পূর্ন মৃত্যুমুখে পতিত। ব্যান্ডেল থেকে হাওড়া যেতে গঙ্গার দুইধারে সারি সারি কারখানার কংকাল। ট্রেনে ভর্তি ভিখিরী-হকার। যারা এককালে ছিল কারখানার শ্রমিক। কিন্ত ১৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনে পুলিশ, এডমিনিস্ট্রেশনে সর্বত্র সিপিএম। কেন্দ্রের কংগ্রেসের কোন দায় নেই সিপিএমকে বাংলা থেকে সরানোর। কারন লোকসভায় কংগ্রেসের দিল্লী হাইকমান্ডের কাছে জ্যোতিবাবু যতটা প্রিয়ছিল- প্রিয়রঞ্জনরা ছিলেন না। বাংলার লোকেরাও যে তরমুজ কংগ্রেস নেতাদের ওপর ভরসা করতে পারছে -এমন না। ব্যাপক ছাপ্পা আর পঙ্গু কংগ্রেস নেতৃত্বের ফলে জ্যোতি বসুর মতন একজন মধ্যম মেধার মাথামোটা লোক, পশ্চিম বঙ্গে রাজত্ব করে গেল কুড়ি বছর। জ্যোতি মোষ ( ওটাই আমাদের চালু নাম) রাজত্ব করেছে বললে ভুল হবে। জংগী ট্রেড ইউনিয়ানের বুলডোজার চালিয়ে পশ্চিম বঙ্গকে ধ্বংস করছে। ওই লোকটাই পশ্চিম বঙ্গের শিল্পের কালাপাহাড়।
আমরা বড় হচ্ছি-ক্লাস সিক্স থেকে ইংরেজি। তার থেকেও মারাত্মক, সব কারখানাতেই লক আউট। নতুন কোন শিল্প আসছে না। যেগুলো ছিল, সব আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এইঅবস্থায় কিছুটা আশার সঞ্চার হয় কম্পিউটার এবং সফটোয়ার আউটসোর্সিং এ। কিন্ত বাধ সাধলেন জ্যোতিবসু। পশ্চিম বঙ্গে কম্পিউটার ব্যবহারে অলিখিত নিশেধাজ্ঞা আসে ট্রেড ইউনিয়ানের মাধ্যমে। উনি জানালেন কম্পিউটারের ব্যবহারের ফলে প্রচুর কেরানী চাকরি হারাবে।
এই সময়ের একটা ঘটনা বলি। আমি তখন আই আই টিতে দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। আমার এক বন্ধু কোলকাতার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে ইন্টার্নশিপ করছে সামারে (১৯৯২)। আমি ইন্টার্নশিপ করতাম সাহা ইন্সিটিউটে। ওর কারখানাতে গেছি একদিন। দেখি ও ফার্মের কম্পিউটারে চুটিয়ে ভিডিও গেম খেলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম -কিরে এই কোম্পানীতে লোকে কম্পিউটার ব্যবহার করছে না?
ও বললো, না। ট্রেড ইউনিয়ানের নির্দেশ আছে-কেউ যেন কম্পিউটার ব্যবহার না করে। তাই কর্মীরা এতে ভিডিও গেম খেলে। ফলে যা হওয়ার তাই হল। আই টি শিল্পে এগিয়ে গেল ব্যাঙ্গালোর, নয়দা, হায়দ্রাবাদ। কোলকাতা পেল শুন্যে শুন্য।
আশা করি বুঝতে পারছেন জ্যোতি বসু এবং অশোক মিত্রের মতন বামপন্থী নেতারা সেকালে কি লেভেলের গাধা ছিল এবং কিভাবে তাদের একের পর এক আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের খেসারত দিয়েছে আমাদের প্রজন্ম। বামপন্থী তাত্ত্বিক গাধামো এতটাই ক্ষতিকর, এবং আমাদের প্রজন্ম সেই গাধামোর জন্য এতটাই সাফার করেছে, পশ্চিম বঙ্গের শাসন ক্ষমতা থেকে এই "ভদ্রলোক" বামপন্থী বুদ্ধিজীবি ক্লাসটাকে ছুঁড়ে না ফেলে দিলে, এই রাজ্যের কোন ভবিষ্যত থাকা সম্ভব না।
ভাববেন না আমি বামপন্থী বিরোধি কেউ। কিন্ত পশ্চিম বঙ্গে সিপিএমের মাধ্যমে যে বামপন্থী ক্লাসের সৃষ্টি হয়েছে, সেটি আদ্যপান্ত একটি পরজীবি বুর্জোয়া ক্লাস । যাদের পেটে না আছে বিদ্যা । মাথায় না আছে বুদ্ধি। না আছে চাষের জমিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা। না কারখানায় কাজ করার শিক্ষা। না কিভাবে ব্যবসা করতে হয়, তার নো-হাও। এদের মোক্ষ স্কুল কলেজের একটি সিকিউরড চাকরি! সেটা বাগিয়ে সর্বত্র সাংস্কৃতিক বালামো করা-এই হচ্ছে তখনকার এবং বর্তমানের সিপিএমের পেডিগ্রি।
এই নয় যে গ্রাম খুব এগোচ্ছে তখন । ওপারেশন বর্গার ফলে একটা স্বচ্ছল কৃষি সমাজ তৈরী হয়েছে। কিন্ত সবার ছোট ছোট জমি। কারুর হাতে পুঁজি নেই যে গ্রামে ছোট ছোট কৃষি ভিত্তিক কারখানা করবে। কৃষি থেকে কৃষি ভিত্তিক শিল্পের উত্তোরনের জন্য দরকার ছিল কোয়াপরেটিভের। সেসব হল না । ফলে গ্রামে যাদের তিনটে চারটে করে ছেলে মেয়ে-অনেকেই বেকারত্বের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অন্য রাজ্যবাসী হতে বাধ্য হয়েছে বহুকাল আগেই।
এর পরেও সিপিএম টিকেছে বেশ কিছুদিন। বুদ্ধ এসে অবস্থা আঁচ করেছিলেন। ভদ্রলোক ভালোই চেষ্টা করেছিলেন। জনগণ তাকে দুহাত তুলে ভোট ও দিয়েছিল। কিন্ত যারা ব্যবসা বোঝেনা, তারা যদি রাতারাতি শিল্প তৈরী করতে যায়, দালালদের খপ্পরে যাবেই। বুদ্ধর ও সেই হাল হল। কোলকাতার শহর তলিতে গজিয়ে ওঠে জমি হাঙর। যারা পার্টির সিলমোহরে, চাষীদের ভয় দেখিয়ে জমি কারতে শুরু করে। তবে সব থেকে বড় ক্ষতিটা তদ্দিনে করে দিয়েছেন প্রকাশ কারাত। ইউএস ভারত নিউক্লিয়ার ডিলে জন্য ইউ পি এ থেকে বেড়িয়ে এসে।
প্রকাশ কারাতের মতন সিপিএমের নেতারা কতটা নির্বোধ-সেটা যদি জানতে চান-শুধু এই তথ্যটা জানুন। আমেরিকা-ভারত নিউক্লিয়ার ডিল সাইনের ১০ বছরের পরেও কোন আমেরিকান বহুজাতিক ভারতে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট খোলে নি। অথচ এই আমেরিকান বহুজাতিকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, প্রকাশ কারাত। সাথে সাথে সিপিএম। এদিকে ডিল সাইনের দশ বছর বাদেও কোন আমেরিকান বহুজাতিকদের দেখা নেই নিউক্লিয়ার সেক্টরে!!
অর্থাৎ ভুতের সাথে যুদ্ধ করে আত্মঘাতি হয়েছিলেন প্রকাশ কারাত। ডুবিয়েছিলেন বুদ্ধকে। সিপিএম পার্টিটাকে।
এই সব বাম নির্বোধরা, তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য ডুবলে আনন্দই পাই। কিন্ত মুশকিল হয় যখন এই নির্বোধরা ক্ষমতায় বসে সফটোয়ার শিল্পকে শুরুতেই ধ্বংস করে।
আমি এই জন্যেই লিখেছিলাম-পশ্চিম বঙ্গের উন্নতির প্রথম শর্ত সিপিএম "ভদ্রলোক" মুক্ত পশ্চিম বঙ্গ। সেটা এই নির্বাচনে ঘটেছে। এবার এগোবে পশ্চিম বঙ্গ

নাম্বার দর্শন!

ভারত যখন বৃটিশ শাসনে ছিল- তখনকার কিশোর তরুনদের একটা অংশের মধ্যে "ভারতের স্বাধীনতা" , জাতিয়তাবাদের কারনে কিশোর বয়স থেকেই ছাত্র ছাত্রীরা এক বৃহত্তর উদ্দেশ্যের সন্ধান পেত। যারা ঐ সময় স্বদেশী করতেন-তাদের অনেকেই আমার শিক্ষক বা আত্মীয় ছিলেন। ছোটবেলায় মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাদের কথা শুনতাম। সেইসব ঋজু চরিত্রগুলো বাঙালী জীবনে আজ আর নেই। দেখি না।

স্বাধীনতাপূর্ব ভারত, কোন ল্যাবেরটরী, কোন অর্থ সাহায্য ছাড়াও সিভি রমন, জেসিবোস, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহাদের জন্ম। স্বাধীনতার পরে, ভারতের বিজ্ঞানে এত টাকা ঢেলেও , বলার মতন কেউ নেই। কোন নোবেল প্রাইজ আসে নি।

আর রাজনীতির কথা না বলাই ভাল। স্বাধীনতার পূর্বের কংগ্রেসের নেতাদের সাথে নিশ্চয় বর্তমানের নেতাদের তুলনা আপনি করবেন না।

সমস্যার সূত্রপাত কিন্ত ওই স্কুল শিক্ষায়। ছেলেমেয়েদের আপনি কি শেখাচ্ছেন? নাম্বার পেতে হবে? কম্ফটেবল লাইফের সন্ধান খুব শক্ত ঘুঁটি না। জীবনে যখনই ঝড় ঝঞ্জা আসবে- জীবনের উদ্দেশ্য আরো বৃহত্তর না হলে, সে টিকতেই পারবে না।
প্রফেশনাল এক্সিলেন্সির কথা বাদ দিলাম। ওটা ওই প্যাশন ছাড়া সম্ভবই না।

ভারতের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার। নইলে রাষ্ট্রটাই টিকবে না।

Saturday, July 11, 2020

হাগিয়া সোফিয়া/আয়া সোফিয়া - প্যান্ডেমিকের মধ্যে ধর্মান্ধদের অন্ধ দর্শন

   (১)
  ২৯ই মে - ১৪৫৩ ।  ৫৩ দিনের  প্রবল যুদ্ধের পর,  মেহমুদ-২ এর সৈন্যরা কনস্টানিনোপলের হাজার বছরের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেঙে খ্রীষ্ঠানদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন  ঐতিহাসিক শহরে ঢুকে পড়েছে।  শহরের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম গীর্জা  হাগিয়া সোফিয়া।  আশ্রয় নিয়েছে শিশু কিশোর নারী  অথর্ব মানুষ এবং সমস্ত খ্রীষ্ঠান সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীরা।  পোপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সৈন্য রণতরী পাঠাবেন।  ২৭ মে অব্দি তার দেখা নেই। এদিকে ব্যাসিলিকার মতন ২৭ ফুটের বৃহৎ কামান, যার গোলার ওজন ৬০০ পাউন্ড বা তিনকুইন্টাল দিয়ে শহরের বিখ্যাত প্রাচীর প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে অটোমান গোলান্দাজরা।  আর কোন মতেই আটকানো যাবে না। জেনোয়া থেকে আগত  বিখ্যাত ইটালিয়ান সেনাপতি জিওভানি গুইস্তিয়ানির ২০০০ মার্সেনারী সেনার অধিকাংশ নিহত। যুদ্ধের প্রথম দিকে জিওভানির সফল নেতৃত্বে-তার সেনাদের অভিজ্ঞতায় মেহমুদের সৈন্যরা অনেকবার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।  ৫৩ দিনের লাগাতার যুদ্ধে তাদের অধিকাংশ আহত বা নিহত।  কনস্টান্টিনোপল বাঁচানোর আর কোন আশাই নেই!

    ২৮ ই মে সন্ধ্যায় বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের শেষ সম্রাট, শহরের মালিক  একাদশ কনস্টানটাইন  হাগিয়া সোফিয়াতে শেষ পার্থনা সভা ডাকলেন-শহরের সব সন্ন্যাসী এবং বিশ্বাসীদের নিয়ে।  গত সপ্তাহের আগে পর্যন্ত পেন্ডুলামের মতন দোদুল্যমান ছিল শহরের ভাগ্য।  অর্থডক্স, গ্রীক খ্রীষ্ঠানদের দৃঢ় বিশ্বাস মাতা মেরী হাগিয়া সোফিয়াতে জাগ্রত। তিনিই বাঁচাবেন। শহরের ডিফেন্স যত দুর্বল হয়েছে,পার্থনার ধুম তত বাড়ন্ত! মাতা মেরী হাজার বছর ধরে বাঁচিয়েছেন। এবারো বাঁ চাবেন।

    অথচ একবছর আগে হাঙ্গেরিয়ান কামান ইঞ্জিনিয়ার অরবান যখন সম্রাট একাদশ কনস্টানটাইনকে প্রস্তাব দেন শহরের প্রতিরক্ষার জন্য বিশাল কামান বানিয়ে দেবেন, তাকেই পাত্তাই দেন নি সম্রাট। কনস্টানিনোপলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। মাতা মেরীর আশীর্বাদ। অত খরচ করে কামান বানানোর কি দরকার? আবার লোকটা বলে কি না, শহরের গীর্জার পিতলের বড় বড় ঘন্টা গলিয়েই কামান বানিয়ে দেবে!  খ্রীষ্ঠান হয়ে ঐ পাপ তিনি করতে অক্ষম।

   অরবান একজন ইঞ্জিনিয়িয়ার। পেশাদার কামান নির্মাতা। খ্রীষ্ঠান সম্রাট না পাত্তা দিল ত কি হয়েছে। মেহমুদ-২ আছেন। অটোমানরা কামান বানাতে দক্ষ না।  মেহমুদ-২ এর কাছে গেলে অরবান। মেহমুদ-২  অরবানকে দিলেন অঢেল অর্থ। সেযুগের বৃহত্তম ফাউন্ড্রি।  বললেন, বানাও। কতবড় কামান বানাতে পারবে বানাও। কিন্ত সেই কামানের গোলাতে যেন ভেঙে পড়ে কনস্টান্টিনোপলের ১০০০ বছরের দুর্ভেদ্য প্রাচীর।  তৈরী হল ঐতিহাসিক কামান ব্যাসিলিকা। ২৭ ফুট লম্বা। একেকটি গোলার ওজন ৬০০ পাউন্ড।  দুকিলোমিটার রেঞ্জ। গোটা পৃথিবী দেখেনি এত বড় কামান!

 ফলে ২৯ই মে, ১৪৫৩ ছিল সময়ের অপেক্ষা।

  একদিকে মেহমুদ-২ । যিনি হাঙ্গেরি সার্বিয়া থেকে ইউরোপের বেস্ট ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ করেছেন নিজের বাহিনীতে। বহু অর্থের বিনিময়ে।  তারা খ্রীষ্ঠান হলত কি হয়েছে।

  অন্যদিকে কনস্তানতাইন -১১। যিনি অন্ধ যীশু ভক্ত।  শহর বাঁচাতে লোকজন আরো বেশী করে হাগিয়া সোফিয়াতে পার্থনা সভা জমাল।  আর তিনি পোপকে লিখে গেলেন। না পার্থনা বা নিজের ধর্মের লোক তাকে বাঁচায় নি। অরবানের কথা শুনে শহরের সব গীর্জার বিখ্যাত ঘন্টাগুলোকে কামান বানালে এই দিন দেখতে হত না।

 ২৯ ই মে  মেহমুদের সৈন্যরা হাগিয়া সোফিয়াতে আটকে থাকা নিরীহ নরনারীদের ওপর যে অত্যাচার চালায় তা অবর্নীয়। সেকালের নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধজয়ের পরের দুদিন সেনাদের অধিকার থাকত লুঠতরাজের। হাগিয়া সোফিয়ার অসমর্থ লোকেদের মেরে ফেলা হল।  খ্রীষ্ঠান ধর্ম যাজকদের মেরে ফেলা হয়।  আটকে পড়া সমস্ত মেয়েদের যৌনদাসী হিসাবে ধরে নিয়ে যায় মেহমুদের সৈন্যরা। সন্নাসিনীদের ও জোর করে যৌনদাসী হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।  কিশোর এবং বালকদের ও স্লেভ হিসাবে বিক্রি করা হয় ধর্মান্তকরনের পর।  না যীশুখ্রীষ্ট বা মাতা মেরীর দেখা মেলে নি তাদের বাঁচাতে।  ওই একই দিনে যীশু এবং মেরীর সব মূর্তি ভাঙা হয় হাগিয়া সোফিয়াতে। কে যেন বলে ইসলামে যীশুও একজন প্রফেট?

 ২৯ই মে ১৪৫৩ হাগিয়া সোফিয়াতে খ্রীষ্ঠানদের ওপর যে নৃশংস অত্যচার হয়েছে, তা মধ্যযুগের ইতিহাসে ব্যতিক্রম কিছু না।  মধ্যযুগে  বিজয়ী খ্রীষ্টান এবং ইসলামিক সেনাদের ব্যবহার ওমনই ছিল।

 কিন্ত যা অত্যন্ত নোংরা এবং কুরুচিকর-সেটা হচ্ছে ২৯ মে, তুর্কীতে বিজয় উৎসবের দিন।  যেদিন খ্রীষ্টানদের মেরে ফেলে মুসলমানরা শহরের দখল নেয়। এইসব মধ্যযুগীয় ধর্মীয় উন্মাদনায় যদি এখনো মুসলমানরা বিশ্বাস করে, তাহলে, তারা যখন খ্রীষ্টান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ার সম্মুখীন হয়, তাদের কে বাঁচাবে?

 মনে রাখবেন আফগানিস্তান ইরাক আক্রমনের পূর্বে জর্জ বুশ বলেছিলেন এটা ক্রসেড। ট্রাম্প বলেন নি, কিন্ত উনি মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেন ইসলামিক বিশ্ব থেকে আমেরিকাতে লোকজন আসা উনি পছন্দ করেন না। যদিও আমেরিকার সংবিধান তাকে বরাবর হতাশ করেছে।  আমেরিকার সংবিধান যদি তুর্কী বা ভারতের মতন দুর্বল হত, আমি নিশ্চিত ট্রাম্প বহু মুসলিমকে আমেরিকা ছাড়া করতেন।

এইসব ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্যেই কিন্ত ভাল দিকের ও আভাস পাচ্ছি। আমেরিকাতে কলম্বাস ডে উদযাপিত হত। কলম্বাসের আমেরিকা পদার্পনকে স্বরণ করে। কিন্ত ভুলে যাওয়া হত, এই কলম্বাস বেসিক্যালি লুঠেরা এক খুনী। যেসব দ্বীপে সে পা দিয়েছে সেইসব দ্বীপের আদিবাসীদের সমূলে ধ্বংস করেছে এই স্প্যানিশ লুঠেরা।  গতমাসে গোটা আমেরিকা জুরে কলম্বাসের মূর্তি ভাঙা হয়েছে।  শুধু তাই না আমেরিকা দেশটির জাতীয় পিতা জর্জ ওয়াশিংটনের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। কারন তিনি দাস রাখতেন।

 সুতরাং মেহমুদ-২, তুর্কীর, মুসলমানদের জাতীয় বীরের সন্মান পেতেই পারেন। কিন্ত সেক্ষেত্রে মুসলমানদের মনে রাখতে হবে, এই বীরত্ব অসংখ্য  খ্রীষ্টানকে খুন করে। তাদের মধ্যে নিরীহ খ্রীষ্ঠান ও প্রচুর। এইসব কারনে যদি  খ্রীষ্ঠানরা মুসলমানদের  ঘৃনা করে --শুধু ইসলামোফোবিয়া বললে খ্রীষ্ঠান বিশ্বে কেউ পাত্তা দেবে না।

 এটা মহম্মদ ঘোরি বা বখতিয়ার খিলজির জন্যও প্রযোয্য। এরা নিষ্ঠূর লুঠেরা ডাকাত ছিল। ইতিহাসে এই নিয়ে দ্বিমত নেই। অসংখ্য হিন্দু বৌদ্ধ খুন করেছে এই দুই ডাকাত।  তবে সেটা ধর্মের জন্য না পয়সার জন্য- বলা মুশকিল। এহেন খুনী ডাকাতকে যখন পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের বই "হিরো" বা নায়কের মর্যাদা দেয়,  তখন সহজেই অনুমেয় কেন ভারতের হিন্দুরা মুসলমানদের বিশ্বাস করতে পারে না।

  এদিক দিয়ে দেখলে আমেরিকাতে ইতিহাসের যে পুনমুল্যায়ন শুরু হয়েছে, তাতে হিন্দু খ্রীষ্ঠান মুসলমান সবার সামিল হওয়া উচিত। কে কত অন্য ধর্মের অন্য জাতির লোক মেরে বীরত্ব দেখিয়েছে- তাদেরকে ইতিহাসের মহান নায়ক বলে স্বীকৃতি দিলে, মানব জাতির ইউনিটি সম্ভব না।  ইতিহাসের নায়ক তারাই যারা মানুষকে রক্ষা করেছে। নতুন আবিস্কারে পৃথিবীকে এগিয়ে দিয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসকে অন্যভাবে লিখতে হবে।

 হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্টান ঐক্য- গোটা মানবজাতির জন্য দরকার। এই বিভক্ত পৃথিবী আর নেওয়া যাচ্ছে না।  এটাই বর্তমান ইতিহাসের দাবি। বিজয়ী সেনাপতি রাজা মহারাজ বাদশা নবাবদের লুঠেরা খুনী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। তাদেরকে  জাতির নায়কের  সিংহাসন থেকে টেনে নামানো হোক।

(২)
 ১৯৩৫ সালে কামাল আতার্তুক আয়া সোফিয়া মসজিদকে মিউজিয়াম বানালেন। কেন করেছিলেন? কারন উনি জানতেন হাজার বছর ধরে হাগিয়া সোফিয়া ছিল খ্রীষ্ঠানদের বৃহত্তম পার্থনা গৃহ। এই গৃহ যদ্দিন মসজিদ হিসাবে চালানো হবে, তাতে মুসলমানদের বিশ্বজয়ের  পাশবিক স্বপ্নের পুষ্টিকরন হতে পারে, কিন্ত খ্রীষ্ঠান বিশ্বের কাছে তুর্কী গ্রহনযোগ্য হবে না।  বিশেষত এই হাগিয়া সোফিয়ার সাথে খ্রীষ্ঠানদের হাজার বছরের ইতিহাস জড়িত। আবেগ জড়িত। যুদ্ধে জিতে একটা গীর্জার সব লোকেদের মেরেফেলে, দাস হিসাবে বিক্রি করে,  সেটাকে মসজিদ বানানো কালো ইতিহাস। সঙ্গত কারনেই উনি সামনের দিকে এগোতে চেয়েছিলেন সেই কালো ইতিহাস মুছে।  ফলে উনি মিউজিয়াম করে দিলেন। পরিস্কার আদেশ ছিল ওখানে কোন নামাজ পড়া যাবে না।

 কালক্রমে হাগিয়া সোফিয়া উনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে স্থান পায়। প্রচুর খীষ্ঠান টুরিস্ট আসত।

 ২০১০ সাল থেকে তুর্কীতে ইসলামিক পার্টিগুলির পালে হাওয়া লাগে। এদের এজেন্ডাতে বহুদিন থেকেই হাগিয়া সোফিয়া ছিল। কারন ধর্মীয় সুরসুড়ি যৌনসুরসুড়ির মতন এফেক্টিভ। রাজনীতির ক্ষেত্রে। ইমানদন্ড দাঁড়িয়ে যায়।

২০১৬ সাল থেকেই সেখানে নামাজ পড়া শুরু হয়েছে।  ২০১৮ সাল থেকে নিয়মিত নামাজ পড়া হত।  ২০২০ ১০ই জুলাই এর শেষ ডিক্রী অনুযায়ী ইহা এখন পুরো মসজিদ। কোন মিউজিয়াম থাকল না!

বাজারে ঘুরছে কোর্টের অর্ডারে এটা হয়েছে। ভুল। ২০১৬ সালে যখন পিটিশন আনে এটিকে মসজিদ করার জন্য, কোর্ট তার বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছিল। ১৯৩৪ সালে ভবিষ্যত দ্রষ্ট্রা প্রেসিডেন্ট কামাল আতার্তুক এটিকে প্রেসিডেন্টিয়াল ডিক্রিতে মিউজিয়াম বানিয়েছিলেন। ২০২০ সালেও সেই গায়ের জোরেই এরডোগানের ধর্মীয় মিনিস্ট্রি এটাকে মসজিদ বানালো।

অথচ ইউনেস্কোর সাথে আলাপ আলোচনা করলেন না প্রেসিডেন্ট এরডোগান। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে টাকা পেত হাগিয়া সোফিয়া। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইন সম্পূর্ন লঙ্ঘন করে জোর করে নিজেকে ইসলামিক বিশ্বের নেতা জাহির করতে এই দুষ্কর্মটি করলেন এরডোগান।

 এরডোগান যেটা জানেন না- কি করা উচিত বা উচিত না, সেটা ঠিক করার শ্রেষ্ঠ উপায় ইমানুয়েল কান্টের ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পারেটিভ। ক্যাটেগরিক্যাল ইম্পারেটিভের প্রন্সিপল হচ্ছে সিম্পল। তুমি যে কাজ অন্যের বিরুদ্ধে করছ- সেটা তখনই যাস্টিফায়েড যখন, অন্যকেউ সেই একই কাজ তোমার বিরুদ্ধে করলে যেন জাস্টিফায়েড হয়। অর্থাৎ এরডোগান যদি বলেন আল্লার ইচ্ছার জন্য উনি এই মিউজিয়ামকে মসজিদ বানালেন- তাহলে কালকে যদি মোদি বা ট্রাম্প বা  পুতিন কোন মসজিদকে মিউজিয়াম বা মন্দির বানিয়ে দেয়, সেটিও কিন্ত তার নিজের যুক্তিতেই সিদ্ধ হয়। কারন এরডোগানের মূল নীতি হচ্ছে মুসলমান দেশে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ভাবাবেগকেই গুরুত্ব দেওয়া হবে। সংখ্যালঘু খ্রীষ্ঠানদের ভাবাবেগকে গুরুত্ব দেওয়া হবে না।

 যেসব মুসলমানরা এরডোগানকে সমর্থন করছেন, তারা ভুলে যাচ্ছেন, এই সমর্থনের মাধ্যমে তারা বাবরি মসজিদের ধ্বংসকে নৈতিক দিক দিয়ে সমর্থন জানালেন।

 অবশ্য এতটা ভাবাই হয়ত ভুল। কারন এতই যদি এদের পেটে বিদ্যাবুদ্ধি থাকবে, কেউ ধর্মান্ধ হবেই বা কেন?

 যাইহোক আমেরিকার বর্তমান ঘটনায় আমি আশাবাদি। ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে। হাগিয়া  সোফিয়াতে খ্রীষ্ঠানদের গণ নিধনের জন্য একদিন খোদ তুর্কীতেই মেহমুদ-২ খলনায়ক হবেন। যেমন আমেরিকাতে কলম্বাস এখন খলনায়ক। হাগিয়া সোফিয়া আবার খ্রীষ্ঠানদের হাতে ফিরিয়ে দেবে তুর্করা। শুধু সেই দিন, সেই দিন ইসলামিক বিশ্বের লোকেরা মুসলমান থেকে মানুষ হবে।

 আর এটা যদ্দিন পর্যন্ত হবে না- মুসলমানদের প্রতি অমুসলিমদের  ফোবিয়া থাকবেই। সেই ফোবিয়াকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন।