Saturday, November 7, 2020

আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতি, রাজনীতি এবং এবারের রেজাল্ট (২০২০)

                                              (১)

 আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে গোটা বিশ্বেই এবার তুমুল উন্মাদনা। রিয়ালিটিশোর একজন বড় শিল্পী যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, তখন  এটা অপ্রত্যাশিত কিছুই না। কিন্ত ভারতের অনেকেই আমেরিকার নির্বাচনী সিস্টেম,  পলিটিক্যাল সিস্টেম বুঝতে পারছেন না। এই লেখা মূলত তাদের জন্য। আমেরিকার সংবিধান, রাজনীতি, ভোটিং সিস্টেম এত জটিল, সেটা একটা মেইড-ইন-ইজি সামারি টাইপের লেখাতে ঝেড়ে দেওয়া মুশকিল। লোকে খেই হারিয়ে ফেলবে। সেই জন্যে শুধু গুরুত্বপূর্ন ব্যপারগুলোই লিখছি।

আমেরিকার পলিটিক্যাল সিস্টেম বুঝতে গেলে, মূলত ইতিহাসে ফিরতে হবে--

     কিভাবে ১৩ টা বৃটিশ কলোনিয়াল রাজ্য মিলে একটা "দেশের" জন্ম দিল। কেন দিল। তারা কি চাইছিল? তাদের সামনের রাজনৈতিক সমস্যা কি কি ছিল?  এগুলো বুঝলে আমেরিকার সিস্টেম "কেন" - এই প্রশ্নের ৮০% এর জবাব পাওয়া যাবে। 

      আমেরিকা বৃটেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল কেন?  কাল চামড়ার ভারতীয়দের  মতন এরা সাদা বৃটিশদের কাছে সেকন্ড ক্লাস সিটিজেন ছিল না। তারাও ইউরোপিয়ান। একই রক্ত। একই স্কিন কালার।  তাহলে কেন ১৩ টি বৃটিশ কলোনি বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করল? এটা বুঝলেই, আমেরিকার আত্মাকে বুঝতে পারবেন। এর মূল কারন ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান যুদ্ধের ধার মেটাতে বৃটেন আমেরিকার ১৩ টি কলোনির ওপর বর্ধিত ট্যাক্স বসায়। হঠাত করে আমেরিকান কলোনীবাসীরা দেখল তাদের মতামত গ্রাহ্য না করেই, তাদের পকেট খালি করা হচ্ছে। ট্যাক্সের টাকা যাচ্ছে লন্ডনে। ট্যাক্স বিরোধি অসন্তোষ থেকে  ১৭৭৫ সালে যে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তা এক অর্থে জনযুদ্ধও বটে।  এই যুদ্ধে ১৩টি কলোনী একসাথে বৃটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে যাতে করে যার মূল উদ্দেশ্য দুটি

     -সেলফ গর্ভমেন্ট। ট্যাক্স থেকে পুলিশ-প্রতিটি ব্যাপারে যাতে নাগরিকদের গ্রহনযোগ্যতা থাকে

    -  কোন সরকার যাতে জনগনের ওপর স্বেচ্ছাচারী না হয়ে উঠতে পারে।  দ্বিতীয় ইস্যুটি আমেরিকার সংবিধানের হার্ট এন্ড সোল। 

  এই যে ১৩ কলোনি একসাথে বৃটিশরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করল-তার মানে ত এই না যে যুদ্ধে জিতলে ১৩টা কলোনিকে একসাথে একটি দেশে গঠন করতে হবে! প্রতিটা কলোনির আলাদা আইন। আলাদা মিলিটারি। সবাই একেকটা দেশ। তারা সবাই মিলে একটা নতুন দেশ ঘোষনা করতে যাবেই বা কেন? বিশেষতন উত্তরের কলোনিগুলি অনেক বেশী শিল্প নির্ভর। সেখানে দাসপ্রথা চলে না, বা চললেও আইন খুব কড়া। অথচ দক্ষিনের কলোনিগুলি কৃষি নির্ভর। সেখানে দাসপ্রথার পক্ষে আইন শক্তিশালী। 

 কিন্ত বৃটিশ  কলোনিয়াল পাওয়ার  বিশ্বের সব থেকে শক্তিশালী সাম্রাজ্য। যুদ্ধে  ফ্রান্সের সাহায্য দরকার। সুতরাং একটি জয়েন্ট মিলিটারি, জয়েন্ট বিদেশনীতি ছাড়া স্বাধীনতার যুদ্ধ সম্ভব ছিল  না। তাছাড়া ব্যবসায়ীরা এদ্দিন ১৩ টা কলোনিতেই অবাধে ব্যবসা করেছে। তারাও চাইছে সব কলোনী মিলে একটা নতুন দেশ হোক। এদের পরে বলা হবে ফেডারেলিস্ট। যারা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে। অন্যদিকে দক্ষিনের তুলো চাষ করা রাজ্যগুলি- সর্বদায় ভয়ে থাকত। উত্তরের এলিট শিক্ষিতরা দেশ গঠন করে, দাসপ্রথা তুলে দিতে পারে।  এছারা ভার্জিনিয়া , ম্যাসাচুসেটস, নিউয়ার্ক এগুলি বেশ বড় আকারের কলোনি। অন্যদিকে ডেলোয়ার বা মেরীল্যান্ড ছোট। লোক সংখ্যা কম। এদের ভয়, একসাথে দেশ হয়ে গেলে, বড় রাজ্যগুলোই আইন ঠিক করবে। ছোট রাজ্যগুলো পাত্তা পাবে না। 

 সুতরাং আমেরিকার ফাউন্ডিং ফাদারদের সামনে ১৩টা কলোনি একসাথে জুরে একট নতুন দেশ গঠন করা ছিল বেশ কঠিন কাজ। নুন্যতম যেটুকু ক্ষমতা না দিলে একটি দেশ গঠন করা সম্ভব না, সেটুকুই করা হল। অর্থাৎ কেন্দ্রের হাতে শুধু মিলিটারি, বিদেশনীতি, ডলার ছাপানো, পোষ্টাল সার্ভিস এটুকুই থাকে। ট্যাক্স বসানোর অধিকার পর্যন্ত প্রথমে কেন্দ্রের হাতে ছিল না। পরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চালানোর খরচ ওঠাতে ওটা ঢোকে।  ব্যবসা , ন্যাচারাল রিসোর্স,  পারিবারিক, ক্রিমিন্যাল আইন , শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ট্যাক্স, পুলিশ, কোর্ট কাছারি- এমন কি ছোট মিলিটারি সব কিছুই থাকল রাজ্যের হাতে। 

  ফলে আমেরিকান সিস্টেমে রাজ্যগুলি প্রায় স্বাধীন দেশের মতন। ভারতের রাজ্যগুলি থেকে আমেরিকার রাজ্যগুলির ক্ষমতা অনেক অনেক বেশী। যদিও ১৯৩০ সালে ফ্রেডরিক রুজভেল্টের ্নিউ ডিলের ফলে কেন্দ্রের হাতে অনেক বেশী ক্ষমতা আসে। আমেরিকান প্রেসিডেন্টও সংবিধান বহির্ভুত অনেক ক্ষমতার অধিকারি হোন যেগুলির সংবিধানে সরাসরি কোন নির্দেশ নেই। 

 এবার এই যে নতুন দেশ তৈরী হল- তার সরকার কেমন হবে? আমেরিকান সংবিধানে বলা হল, সরকারের তিনটে ব্রাঞ্চ থাকবে। 

 এক্সিকিউটিভ- যারা  মিলিটারি, অর্থনীতি এবং অন্যান্য কাজ পরিচালনা করবে সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী।  এর সর্বাধিনায়ক হবেন প্রেসিডেন্ট। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে এসে   তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বানিজ্য ইত্যাদি সেক্রেটারিদের নিয়োগ করেন। আমেরিকাতে সেক্ট্রেটারীরা  ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সমান। পার্থক্য হচ্ছে ভারতের মন্ত্রীরা নির্বাচিত রাজনীতিবিদ। আর আমেরিকাতে সেক্টেটারিরা হচ্ছে দক্ষ পেশাদার যাদের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন সেনেটের অনুমতি ক্রমে। শুধু চার বছরের জন্য।  এইজন্যে আমেরিকান সিস্টেমে আই এ এস লাগে না। কারন প্রেসিডেন্টের পরিষদ তৈরীই হয়, পেশাদারি দক্ষ লোকেদের দিয়ে। প্রেসিডেন্ট সুপ্রীম কোর্ট এবং ফেডারেল কোর্টের জাজেদের ও নিয়োগ করেন। 


 আমেরিকার সংবিধান অনু্যায়ী জনগনের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে লেজিসলেটিভ ব্রাঞ্চ- যারা আইন প্রনয়ন করবেন। ট্যাক্স , বাজেট, খরচ এদের হাতে। এরা টাকা দিলে তবে প্রেসিডেন্ট খরচ করতে পারবেন।  এক্সিকিউটিভ ব্রাঞ্চের কাজকর্ম ঠিক ঠাক হচ্ছে কিনা দেখাশোনা করবেন।এরা জনগনের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত।  লেজিসলেটিভ   ব্রাঞ্চ বা আমেরিকান কংগ্রেসের  এর দুটি শাখা- হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভ ( সংক্ষেপে হাউস) এবং সেনেট।  হাউস রেপ ব্যপারটা ঠিক ভারতের লোকসভার মতন। প্রতিটা রাজ্যের জনসংখ্যা অনুয়ারী হাউস রিপ্রেসেন্টিভ কজন হবে ঠিক করে দেওয়া আছে । হাউস রিপ্রেসেন্টেটিভদের বলে কংগ্রেসম্যান।  আমেরিকান কংগ্রেসম্যান এবং ভারতের এম পি একই জিনিস।  ভারতের এমপিদের মতন আমেরিকার কংগ্রেস ম্যানেদের নির্দিষ্ট কনস্টিয়ুএন্সি আছে। আমেরিকাতে এটিকে কংগ্রেশনাল ডিস্ট্রিক্ট বলে। মোট রিপ্রেসেন্টেটিভদের সংখ্যা ৪৩৫। নুন্যতম ২৫ বছর বয়স এবং ৬ বছর সিটিজেন থাকার রেকর্ড থাকা চাই। হাউসের নির্বাচন হয় দুবছরে একবার। 

আমেরিকার যে লেজিসলেটিভ ব্র্যাঞ্চ ভারতের থেকে সম্পূর্ন আলাদা-সেটি হচ্ছে সেনেট। আমেরিকাতে ৫০টি রাজ্য। প্রতিটি রাজ্যে থেকে দুজন সেনেটর নির্বাচিত হন। ফলে মোট সেনেটর ১০০ জন।  আগে আমেরিকার সেনেট নির্বাচন ছিল,  ভারতের রাজ্যসভার মতন। অর্থাৎ রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেনেটর নির্বাচিত করতেন। বর্তমানে রাজ্যের লোকেদের ভোটে সরাসরি সেনেটর নির্বাচিত হোন। সেনেটর হওয়ার নুন্যতম বয়স ৩০। সাত বছর সিটিজেন হওয়া দরকার।  সেনেটরদের ছ বছরে একবার র্নিবাচনে যেতে হয়।  দুবছর অন্তর অন্তর ৩৩% সেনেট সিটের নির্বাচন হয়। 

প্রশ্ন হচ্ছে হাউস অব রিপ্রেসেন্টিভ থাকতে সেনেটের দরকার হল কেন? আপনি বলবেন কেন, ভারতেও ত   আপার হাউস রাজ্যসভা আছে। পার্থক্য কি? বিরাট পার্থক্য। সেটা হচ্ছে সেনেটররা জনগন দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত। এবং সব রাজ্যের দুটি সেনেটর।  এর মূল কারন আমেরিকা যখন তৈরী হচ্ছিল ছোট ছোট রাজ্যগুলি হাউস অব রিপ্রেসেন্টিভ ফর্মুলা মানতে চাইছিল না। সেই সময়ের হিসাবে, ভার্জিনিয়ার ১৫ জন প্রতিনিধি হাউসে গেলে, ডেলওয়ারের যাচ্ছিল মোটে ১ জন! ফলে ছোট ছোট রাজ্যগুলি প্রতিবাদ করে।  তারা বলে এই সিস্টেম চললে ছোট ছোট রাজ্যগুলোর কথা কেউ শুনবে না। এই জন্য কানেক্টিকাটের প্রতিনিধি রজার সারমন (১৭৮৯) প্রস্তাব দেন তাহলে সেনেট চালুহোক যেখানে প্রতিটা রাজ্যের দুজন প্রতিনিধি থাকবে।  সেনেট মূলত প্রেসিডেন্ট এবং হাউস-দুটোরই ক্ষমতা "চেক" করবে। অর্থাৎ এই যে মন্ত্রী পরিশদ প্রেসিডেন্ট বানাবেন, তার অনুমতি কিন্ত সেনেট থেকে নিতে হবে। বিদেশনীতির ট্রিটি-সেগুলোও সেনেটের অনুমোদন লাগে।  ইনফ্যাক্ট প্রেসিডেন্টের প্রায় প্রতিটি কাজেই সেনেটের অনুমোদন লাগে। 

অন্যদিকে সমস্ত নতুন আইন প্রনয়ন, ট্যাক্স ইত্যাদি তৈরী হয় হাউসে। সেটিও সেনেটে পাশ হয়ে আসতে হয়। 

সুতরাং আমেরিকাতে সেনেট হচ্ছে সব থেকে বড় বাঁশ। এটি না জিতলে পারলে, বাকী প্রেসিডেন্সি এবং হাউস জিতে লাভ নেই।  যেমন ধরুন গত চার বছর ট্রাম্প খুব আনন্দে কাজ করেছেন। কারন সেনেটে রিপাবলিকান মেজরিটি ছিল। অন্যদিকে ওবামার ৮ বছরের মধ্যে  ৬ বছর সেনেট ছিল রিপাবলিকানদের হাতে। যাদের নেতা ছিলেন মিচ মিকোনেল।  মিচ ওবামার সব কিছু আটকে দিয়ে তাকে ঠুটো জগন্নাথে পরিনত করেছিলেন। ওবামা যা কিছু করার তার প্রেসিডেন্সির প্রথম দু বছর করেছেন। এবার ও সেনেটে ডেমোক্রাটরা না জিতলে বাইডেন বিশেষ কিছু করতে পারবেন না। এখন সেটা নির্ভর করছে জর্জিয়ার ওপরে। আশা কম। 

লাস্ট ব্রাঞ্চ জুডিয়াশিয়ারী। কোর্ট। যারা বিবাদের ঠিক করবে, আসলে সংবিধান কি বলেছে। এই প্রবন্ধে ওটি উহ্য থাকল।


                                                 (২)

আবার আসি আমেরিকার নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে। শুধু প্রেসিডেন্ট না, একই সাথে হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভ, সেনেটর ( যদি সেই বছর টার্ম আসে) এবং প্রেসিডেন্টের নির্বাচন চলে। ভারতের মতন আমেরিকাতে কোন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন নেই।  প্রতিটি রাজ্যের আলাদা নির্বাচন কমিশন যা ওই রাজ্যের গর্ভনররা তৈরী করেন। এখানে মনে রাখতে হবে আমেরিকাতে গর্ভনর হচ্ছে রাজ্যের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। ভারতের মতন দিল্লী থেকে পাঠানো বাঁশ না যা বৃটিশ কলোনিয়াল হ্যাঙ্গোওভার।  সুতরাং রাজ্যের নির্বাচন কমিশন প্রেসিডেন্ট বা সেনেটের  কোন কথা শুনতে বাধ্য না। যার জন্যে পেনসিলভেনিয়ার নির্বাচন কমিশনার টিভিতে ট্রাম্পকে মিথ্যুক বলার সরাসরি সাহস রাখেন। ট্রাম্প ও নির্বাচন চুরি হচ্ছে বলেই খালাস-কোন রাজ্যের  নির্বাচন কমিশনের ওপর তার নিয়ন্ত্রন নেই। 

আমেরিকাতে প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হয় না। তারজন্য ইলেক্টোরাল কলেজ আছে। প্রতিটা রাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজে কটা ভোট তা ফর্মুলা অনুযায়ী নির্ধারিত। যেমন মেরীল্যান্ডে ৮ টি হাউস প্রতিনিধি, ২ টি সেনেটর। সেইজন্যে মেরীলান্ডের ভোট ১০ টি। এইভাবে ৫০ টি রাজ্যের টোটাল ইলেক্টরাল কলেজ ভোট হয় ৫৩৮ টি। 

নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবার আমেরিকাতে ভোট হয়। প্রতিটা রাজ্যে কারা ভোট দেবে, কিভাবে ভোট দেবে, পোষ্টাল ব্যালটে দেবে না বুথে দেবে, কখন দেবে-এসব ঠিক করে সেই রাজ্যের নির্বাচন কমিশন। কিভাবে তারা তাদের ইলেক্টরাল কলেজ তৈরি করবে,সটাও ঠিক করে সেই রাজ্যের সংবিধান। যেমন আমেরিকার ৪৮ টি রাজ্যের নিয়ম ( মেইন এবং নাব্রাস্কা বাদে)- সেই রাজ্যে যে প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেট সব থেকে বেশী ভোট পাবে, সে রাজ্যের সবকটি ইলেক্টরাল কলেজ ভোটপাবে। যেমন ধরুন টেক্সাসে বাইডেন পাঁচ মিলিয়ানের ( ৫০ লক্ষ)  কাছাকাছি ভোট পেয়েছেন। ট্রাম্প তার থেকে মোটে ৬ লাখ বেশী পেয়েছেন। কিন্ত টেক্সাসের ৩৮ টি ইলেক্টরাল কলেজ ভোট ট্রাম্পএর কাছেই যাবে।  অর্থাৎ সেই পঞ্চাশ লাখ ডেমোক্রাটিক ভোট গ্রাহ্যই হল না। মেইন এবং নাব্রাস্কাতে ডিস্ট্রিক্ট ধরে ইলেক্টরাল কলেজ ভোট আছে।  অর্থাৎ এই ডিস্ট্রিক্ট জিতলে তুমি একটা ইলেক্টরাল ভোট পেলে। এমন ব্যপার। 

সুতরাং এই সিস্টেম খুবই বাজে। শুধু তাই না আমেরিকার ৪০ টা রাজ্য সম্পূর্ন ভাবে ডেমোক্রাট বা রিপাবলিকানের কব্জায়। আসল ভোট হয় ১০ টা রাজ্যে। কারন সেখানে একবার ডেমোক্রাট, আরেকবার রিপাবলিকানরা জেতে। যেমন ফ্লোরিডা, ওহায়ো, পেনসিলভেনিইয়া, এরিজোনা। আমেরিকার নির্বাচন এই দশটি রাজ্যের নির্বাচন হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এই রাজ্যের অধিবাসীরাই ঠিক করে কে হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। বাকী সব রাজ্য ফাউ। কারন তাদের রাজ্যে কে জিতবে তা আগে থেকেই বলে দেওয়া যায় যেহেতু বাকি ৪০ টি রাজ্যের অধিবাসীরা হয় নীল ( ডেমোক্রাট) নইলে লাল( রিপাবলিকান)। এইজন্যে আমেরিকার ইলেক্টরাল কলেজ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে বারেবারে। তুলে দেওয়ার জন্য কংগ্রেসে ভোটাভুটি  হয়েছে ৪ বার। তবে প্রতিটা রাজ্য ইলেক্টরাল কলেজ ভোট কিভাবে ভাগ করবে-তা  বদলাতে পারে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়াতে বা টেক্সাসের ৩৮ টি যদি অনুপাতে ভাগ করে দেওয়া হত, তাহলে ট্রাম্প পেতেন ২০, বাইডেন ১৮।  কিন্ত টেক্সাস বা ক্যালিফর্নিয়ার হাউস বা সেনেট ( এখানে প্রতিটা রাজ্যের আলাদা হাউস এবং সেনেট আছে কেন্দ্রের আদলে)  যেহেতু বিজয়ী পার্টির, তারা চাইছে সবকটা ইলেক্টরাল ভোট। তারা ইচ্ছা করলেই এটা প্রোপশনাল করতে পারে। কিন্ত করলে তাদের ক্ষতি। ফলে এই বিদিগিচ্ছিরি দুশো বছরের ব্যাপারটা চলেই আসছে।

১৬ ই ডিসেম্বর এই  ইলেক্টরাল কলেজই সরকারি ভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে বা এবার করবে যদি রাজ্যের গর্ভনররা তার রাজ্যের ভোটটি ইলেক্টরাল কলেজকে পাঠিয়ে দেন। ২০০ বছর ধরে এর কোন ব্যতিক্রম হয় নি।  ৪ ই জানুয়ারী নতুন সেনেট এবং হাউস শপথ নেবে। তারপর ৬ ই জানুয়ারী সেনেট ইলেক্টরাল কলেজের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে মেনে নেবে এবং ভাইএস প্রেসিডেন্ট সেনেটের স্পিকার নির্বাচিত হবেন। 

এগুলো এদ্দিন সবই ফর্মালিটি ছিল। এবার ট্রাম্প এখনো হার স্বীকার করেন নি। এমনটা আমেরিকার ইতিহাসে হয় নি। এবার ফর্মালিটি ফুলফিল হবে কি না বলা যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে হাউসের হাতে ক্ষমতা আছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার। 


                        (৩)

এবারের ইলেকশনের বিতর্কের মূল কারন পোষ্টাল ব্যালট।  ১৫০ মিলিয়ান ভোটদাতাদের মধ্যে ৯০ মিলিয়ান পোষ্টাল ভোট দিয়েছে। প্যান্ডেমিকের জন্য সব রাজ্যই এবার নো ফল্ট পোষ্টাল ব্যালট ইস্যু করে। পোষ্টাল ব্যালটের ৭৮% ভোট গেছে ডেমোক্রাটদের দখলে।  যার জন্য ট্রাম্প কারচুপির অভিযোগ এনেছেন। যদিও এখনো প্রমান দিতে পারেন নি।  

এবার দেখা যাক সুইং স্টেটের যেখানে নন পোষ্টাল ব্যালটে ট্রাম্প এগিয়েছিল, সেখানে পোষ্টাল ব্যালটে বাইডেন এত বেশী পেতে পারেন কি না। নাকি কারচুপি হয়েছে।

নির্বাচন যদি পেপার ব্যালটে হয়, তাও পোষ্টালে-তাহলে কারচুপি হবেই। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে কতটা ফ্রড হতে পারে, যাতে ট্রাম্প যদি ৫০,০০০ বা ১০০,০০০ ভোটে হারেন, তাহলে সেই হারের জন্য কারচুপিকে দায়ী করা যায় কি না।  এবার আমরা দুই দিকের দাবীকেই পর্যবেক্ষন করব

  বাইডেন ক্যাম্পের দাবী 

           -পোষ্টাল ব্যালটে ৬৬% গেছে রেজিস্টারড ডেমোক্রাটদের কাছে। সুতরাং রেজিস্টার্ড এবং ইন্ডিপেন্ডেবন্ট মিলিয়ে ৭৮% হতেই পারে

            - পোষ্টাল ভোটের কারচুপির সরাসরি প্রমান এখনো নেই

           - ট্রাম্প নিজেই রিপাবলিকানদের পোষ্টাল ভোট দিতে মানা করেছেন। সুতরাং বুথে গিয়ে রিপাবলিকানরাই ভোট দিয়েছে বেশী। 


 ট্রাম্প ক্যাম্পের দাবী -যার ভিত্তিতে ট্রাম্পের আইনজ্ঞরা এবং নিউয়ার্কের প্রাত্তন মেয়র রুডি জুলিয়ানি সোমবার মামলা করবেন 


         - পোষ্টাল ব্যালটে জালি হয় বলে, পোষ্টাল ব্যালটে অনেক চেক এন্ড ব্যালান্স থাকে।  এর একটি হচ্ছে সিগনেচার না মিললে ব্যালট ক্যান্সেল হয়। এবারের প্রাইমারীতে প্রায় এক মিলিয়ান ব্যালট বাতিল হয়েছিল । অথচ এই ব্যটল গ্রাউন্ড স্টেটে কত বাতিল ব্যালট, কিভাবে বাতিল হচ্ছে, ক্যাম্পেইন ম্যানেজারদের জানানো হচ্ছে না।

      -পোষ্টাল ব্যালট গননার ধারে কাছে , তাদের প্রতিনিধিদের যেতে দেওয়া হয় নি। 

এখনো পর্যন্ত ট্রাম্পের করা তিনটি মামলা কোর্ট গ্রহনই করে নি। প্রমান নেই বলে। দেখা যাক মঙ্গলবার কি হয়। বাইডেনের পক্ষে ওয়ার্স্ট কেস সিচুয়েশন- পেনসিল্ভেনিয়ার সুপ্রীম কোর্ট  সেই রাজ্যে রিইলেকশন ডিক্লেয়ার করতে পারে। কিন্ত তাতেও ক্ষতি নেই। কারন বাইডেন প্রচুর রাজ্য জিতেছেন। অন্তত চারটি রাজ্যের সুপ্রীম কোর্টে ট্রাম্প না জিতলে এবং চারটি রাজ্যে পুন নির্বাচন না হলে, রেজাল্ট বদলাবে না। তিনি ২৭০ এর ওপরে ইলেক্টরাল ভোট পেলেই জিতে যাচ্ছেন।  


                         (৪)

এবার আসি আমেরিকার পার্টি সিস্টেমে। এখানে মূল পার্টি দুটি। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রাট।  যা প্রায় ১৬০ বছর ধরে চলে আসছে। এছারাও গ্রীন পার্টি লিবার্টারিয়ান পার্টি আছে। যা ১-২% ভোট টানে। প্রশ্ন হচ্ছে এক্ষেত্রে ভারতের মতন একাধিক পার্টি নেই কেন। কেন রাজ্য ভিত্তিক পার্টি নেই?

 এর কারন দুটো। 

  এক, পার্টি প্রাইমারী। আমেরিকাতে পার্থী কে হবে, তা পার্টি  ঠিক করে না, পার্টির রেজিস্টার্ড ভোটাররা "প্রাইমারী" বলে আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে করে।  যেমন ধরুন এবারের ডেমোক্রাটি প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারীতে বাইডেন ছাড়াও আরো ৭জন ছিলেন। এর মধ্যে লড়াই দাঁড়িয়েছিল বাইডেন বনাম বার্নির মধ্যে। অর্থাৎ পার্টির মধ্যপন্থী বনাম বামপন্থীদের মধ্যে। এই ভোটের লড়াইতে মধ্যপন্থী বাইডেন জেতেন। হারলেও বামপন্থীদের আলাদা পার্টির দরকার হচ্ছে না -কারন   মেইন ইলেকশনে বামেদের ভোট পেতে বাইডেনকে অনেক বামপন্থী ইস্যু গ্রহন করতে হয়েছে। বামেরা একা লড়াই করলে ভারতের সিপিএমের মতন হাল হত। খুঁজে পাওয়া যেত না ন্যাশানাল স্কেলে।  বরং একসাথে থাকায়, মধ্যপন্থীদের মাধ্যমে তাদের ইস্যুগুলি ন্যাশানাল ইস্যু হচ্ছে। 


 দুই এখানকার দুই রাজ্যের মধ্যে কোন জাতিগত ভাষাগত পার্থক্য নেই। ফলে স্টেট ন্যাশানালিজম বা আঞ্চলিকতাবাদ-যা ভারতের রাজনীতিতে আছে, তা এখানে নেই।  ফলে ভাষাগত, জাতিগত পার্টি গড়ার সুযোগ নেই। 


 এখানে ডেমোক্রাটদের বামপন্থী এবং রিপাবলিকানদের দক্ষিনপন্থী লবি পার্টির মধ্যে পার্টি-এবং এরা প্রাইমারীতে খুব সক্রিয় ও কট্টরপন্থী। এদের মধ্যে মারকাটকাট সম্পর্ক।  কিন্ত মধ্যপন্থী রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রাটদের নীতি প্রায় এক।  ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির কট্টর অংশের এবং বাইডেন ডেমোক্রাটিক পার্টির মধ্যপন্থার লোক। ফলে বাইডেনের বন্ধু এবং ভোটবেস অনেক বেশী। অনেক রিপাবলিকান এবার বাইডেনকে ভোট দিয়েছে। 


                         (৫)

বাইদেন প্রেসিডেন্সিতে নতুন কি হবে?

সেনেটে ডেমোক্রাটরা না জিতলে, বাইদেন আভ্যন্তরীন কোন নীতির কিছু পরিবর্তন করতে পারবেন না। আমি আগেই লিখেছি কেন সেনেট হাতে না থাকলে প্রেসিডেন্সি হচ্ছে নিধিরাম সর্দার।  কিন্ত বিদেশনীতি তার হাতে।  সেখানেও ট্রাম্প মূলত শান্তিবাদি নীতি নিয়েই চলছিলেন।  বরং বাইডেন আরো বেশী যুদ্ধবাজ। 


সেনেটে ডেমোক্রাটরা জিতলে বাইডেন অনেক কিছু করে দেখাতে পারবেন। কিন্ত ডেমোক্রাটদের সেনেট দখলের সম্ভাবনা কম। 


করোনা মোকাবিলা আরেকটু ভাল ভাবে করতে পারবেন। কিন্ত সেটিও রাজ্যের গর্ভনরদের হাতে। প্রেসিডেন্টের হাতে নেই। 

   শুধু হোয়াইট হাউসের ক্যাওস , নাটক কমবে। হোয়াইট হাউস ভদ্র হবে। 

বাইডেন মোদিকে ক্যা এবং কাশ্মীর নিয়ে চাপ দিতে পারেন। কারন বাইডেন তার ভোট সঙ্গী হিসাবে সমস্ত আমেরিকান মুসলিম কোয়ালিশনকে পাশে পেয়েছেন। এরপর স্কোয়াড, অর্থাৎ চারজন অতিবিপ্লবী বাম ইস্লামিক মহিলা হাউস রিপ্রেসেন্টেটিভ ( রশিদা তালিব, ইলহান ওমর, আলেক্সান্ডিয়া কোর্তেসিও কর্টেজ ( এওসি) এবং আয়ানা প্রিসলে ) এবারো কংগ্রেসে জিতেছেন। এরা কট্টর মোদি বিরোধি। এর মধ্যে ইলহান ওমর প্রতিটি মুসলিম ইস্যুতেই ইলামিক উম্মাহর আমেরিকান মুখ। এদ্দিন ট্রাম্প এদের বিরোধি থাকায়,  আমেরিকান রাষ্ট্রের চাপ মোদির ওপর ছিল না। কিন্ত এবার ব্যাপার আলাদা। তবে সেই সেনেট। সেনেট হাতে না থাকলে  স্কোয়াড বা বাইডেন কেউ ভারতকে চাপ দিতে পারবে না।  সেই আশা নেই। 

কিন্ত ভবিষ্যতে সমস্যা আছে। আমেরিকার কিশোর তরুন সমাজ বামপন্থা সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে। তারা জার্মানি, ডেনমার্কের মতন সিস্টেম চাইছে। এরা আমেরিকান ক্যাপিটালিজম এবং তার উদ্ভাবনী শক্তিতে বিশ্বাসী না। এর মূল কারন অধিকাংশ নতুন প্রজন্ম কঠিন পরিশ্রমের সাথে পরিচিত না। এরা ভিডিও গেম খেলা পার্টি।  এরা মূলত বার্নির দিকে ঝুঁকছে। আর বার্নির সব থেকে উপযুক্ত শিষ্যা হচ্ছে এওসি। 

সুতরাং এর পরেরবার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে এওসি দাঁড়াচ্ছেন।  এবং তরুনদের ভোটে গ্রাসরুটে সাপোর্টে তার জেতার চান্স ও বেশী।  এওসি সিপিয়াইএম নেতাদের মতন কট্টর বামপন্থী। কারন এই বর্তমান প্রজন্মের তরুনরা ফ্রি এডুকেশন ফ্রি হেলথকেয়ার চাইছে। সেক্ষেত্রে আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ লাগার ভাল চান্স আছে।  কারন এওসি এতটাই র‍্যাডিক্যাল সে আমেরিকান মিলিটারি স্পেন্ডিং খুবই কমিয়ে দেবে। বিলিয়ানদের সম্পদের  ওপর ৯০% রেটে ট্যাক্স বসাবে। আমাজন তার দ্বিতীয় হেডকোয়াটার নিউয়ার্কে করতে চেয়েছিল। এওসির বাধাতে তা হয় নি। এতে ২৫,০০০ নতুন চাকরি তৈরী হত। বেসিক্যালি সেই জঙ্গী সিটুনেতাদের গল্প যাদের জন্য কোলকাতা শিল্প শ্বশান হয়েছিল, এইসব বামেরা আসলেও তাই হবে। কিন্ত বিলাসী বাঙালী তরুনদের যেমব বেসিক সেন্স ছিল না-তারা বামপন্থায় একদা আকৃষ্ট হয়ে রাজ্যের বারোটা বাজিয়েছে। রাজ্য শিল্পশুন্য হয়েছে, বর্তমান আমেরিকাও সেই দিকেই এগোতে পারে যেভাবে বামপন্থার অলীক মোহ তরুনদের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। 

প্রতিটা পার্টিতেই কোন না কোন তরুনের সাথে কথা বলছি। সবাই বার্নি সাপোর্টার। অথচ এই যে আরামের জীবনে তারা আছে-তার জন্য যে খাদ্য তৈরী হচ্ছে, ইনফ্রাস্টাকচার তৈরী হচ্ছে, তারা যে ভিডিও গেম খেলছে-সেই লেবার কোত্থেকে আসে- উৎপাদন না হলে ডলারের ভ্যালু কি হবে-এসব নিয়ে এদের কোন আইডিয়া নেই। আমি সেই সত্তরের দশকের বাঙালী তরুনদের দেখতে পাচ্ছি।  আমেরিকার ভবিষ্যত নিয়ে আমি আশাবাদি নই। 

  









No comments: