মারাদোনা বনাম মেসি-জনপ্রিয়তার রহস্য সন্ধানে
- ১১/২৭/২০২০ বিপ্লব পাল
মারাদোনার মৃত্যুতে যেভাবে গোটা পৃথিবী শোকাচ্ছন্ন-তার উদাহরন কি সাম্প্রতিক, কি সুদূর ইতিহাস-কোথাও পাওয়া যাবে না। দেশ, রাজনীতি, জাতি, ধর্মের ওপরে উঠে, এত ভালবাসা পৃথিবীর কোন ব্যক্তি কোনদিন পেয়েছে কি না, আমার জানা নেই।
কিন্ত এই আকুন্ঠ ভালবাসার উৎস কি? শুধুই তার পায়ের ম্যাজিক?
এটা মানা মুশকিল। যদিও ফুটবল অত বুঝি না-কিন্ত মেসির ড্রিবলিং বা পাশিং দেখতে ততটাই ভাল লাগে। ম্যাজিক্যাল “গোল” দেখতে হলে ইব্রাহমোভিচের অদ্ভুত সব ব্যাককিক গুলো আরোই মনমুগ্ধকর। পেলে ব্রাজিলকে তিনবার বিশ্বকাপ দিয়েছেন। গোটা দলকে খেলানোর প্রশ্ন হলে, জিনেদিন জিদান বা প্ল্যাতিনি যেভাবে গোটা দলকে খেলাতেন, তার তুলনাই বা কোথায়? মেসি অনেক বেশী ট্রফি জিতেছেন। পেলে অনেক বেশী আন্তর্জাতিক গোল করেছেন।
শুধু ফুটবল , পায়ের জাদু মারাদোনার প্রতি গোটা বিশ্বের এত ভালবাসার উৎস হতে পারে না।
এই ভালোবাসার শুরু ১৯৮৪ সাল- ভেনু স্পেনের সর্বোচ্চ ফুটবল ফাইনাল কোপা ডেল রে। মারাদোনা তখন মেসির ক্লাবে-বার্সিলোনা। বিপক্ষে এথেলিটিক বিলবাও। সেদিন পরিকল্পনা করেই মারাদোনাকে মারা হচ্ছিল চোরাগোপ্তা। এই পর্যন্তও ঠিক ছিল। কিন্ত স্টেডিয়ামের দর্শক এবং বিল্বাওএর প্লেয়াররা মারাদোনাকে জাতিবিদ্বেশী কুতসিত গালাগাল দিতে থাকে। মারাদোনার শরীরে বইছে নেটিভ আমেরিকানদের মিশ্র রক্ত। তাই নিয়ে কুতসিত গালাগাল দিচ্ছিল বিপক্ষ। বার্সিলোনা তখন এক গোলে পিছিয়ে। মাঠে মারামারি শুরু হয়। মারাদোনা দেখছিলেন রেফারি কিছুই করছে না। এক লাখ দর্শকের স্টেডিয়ামে বসে আছেন স্প্যানিশ কিং কিং জুয়ান কার্লোস। মারাদোনাই আক্রমন শুরু করেন। মিগেল সোলা মারাদোনাকে বাজে ফাউল করে। কুতসিত গালাগাল দেয় জাতি তুলে। মারাদোনা তেড়ে গিয়ে মাথা ঠুকলেন বিপক্ষের মিডফিল্ডার মিগেল সোলাকে। মিগেল মাঠে পড়ে যেতে ছুটে আসে বাল্বোয়ার সব প্লেয়াররা। মারাদোনাকে পেটাবে। কিন্ত বার্সিলোনার প্লেয়াররা, মারাদোনাকে বাঁচাতে ছূটে যায়। ততক্ষনে গোটা স্টেডিয়ামে মারামারি শুরু হয়েছে। ৬৬ জন আহত।
এবার প্রশ্ন করুন মেসি এত ভদ্র- জীবনে এই ভাবে মাঠে রুখে দাঁড়াত কি না? মারাদোনা নিজেই বলেছেন মেসির সব আছে-কিন্ত প্রতিবাদ করতে জানে না। খুব ভদ্র।
এখানেই মারাদোনা আলাদা। ওই ঘটনার পর বার্সিলোনা যে তাড়িয়ে দেবে, সেটার রিস্ক আর কোন প্লেয়ার নিত? সব থেকে বড় কথা ওই ঘটনার পর ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোও নিতে যায় নি। নিল নেপোলি। যারা ইটালিয়ান লীগেই তখন বাইশ নাম্বারে! বার্সিলোনার মতন পৃথিবীর প্রথম সারির ক্লাব ছেড়ে, ইটালির দ্বিতীয় শ্রেনীর ক্লাবে যাওয়ার রিস্ক কজন ফুটবলার নিতে পারতেন শুধু মাত্র প্রতিবাদের জন্য?
ইটালিতে গিয়েও তিনি নেপলস শহরের রাজা। কেন? উত্তর ইটালি দক্ষিন ইটালিকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল করে। মারাদোনা তাদের হয়ে সেই অবহেলা, তাচ্ছিল্যের জবাব দিচ্ছেন মাঠে। মারাদোনার সাথে মেসির পার্থক্য এখানেই যে মারাদোনা খেললে, সেটা নিছক খেলা থাকে নি। মারাদোনার পায়ের প্রতিস্পর্ধায় পৃথিবীর নির্যাতিত শোষিত অবহেলিত লোকেরা পেয়েছে মুক্তির স্বাদ। যেন মারাদোনা তাদের হয়ে, তাদের জ্বালা যন্ত্রনার জবাব দিচ্ছেন।
আসলে পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই প্রান্তিক। তাদের কথা, তাদের দুঃখের কথা, বঞ্ছনার কথা কে শোনে? গণতন্ত্র ? বামপন্থা ? কেউ শোনে না। তারা জানে এই সিস্টেম তাদের কত অসহায় করে রেখেছে। মাঠে মাঠের বাইরে মারাদোনার প্রতিবাদ -সব কিছুর মধ্যেই তাদের মনে হয় মারাদোনা তাদের জন্যই বলছে, তাদের জন্যই মাঠের মধ্যে প্রতিশোধ নিচ্ছে। তিনিই একমাত্র ফুটবলার যিনি বুশের ইরাক আক্রমন, ইস্রায়েলে গাজা অধিগ্রহন থেকে পৃথিবীর সর্বত্র ঘটে যাওয়া অত্যাচার অবিচারের ঘটনায় শুধু স্লোগান দিয়ে খান্ত হন নি। মিছিলে পা দিয়েছেন। তবে সেটা করতে গিয়ে কিছু অতিবিপ্লবী কাজে ফেঁসেছেন। যেমন পাবলো এস্কোবারের মতন দুনিয়ার একনাম্বারের ড্রাগ ডিলার ও একদা তার বন্ধু ছিল!
ফলে ঢাকা পরে যায় মারাদোনার ৯ টি বেজন্মা সন্তানের কথা এবং তাদের প্রায় সাতজন মায়ের কথা যাদের প্রতি মারাদোনা সুবিচার করেন নি। এর মধ্যে অন্তত তিনজন মহিলার ক্ষেত্রে –( ইটালিয়ান ক্রিস্টিয়ান সিনাগ্রা ( দিয়েগো সিনাগ্রার মা), এবং দুজন কিউবান প্রেমিকা-যারা তার তিনটী সন্তানের মা )-মারাদোনা নিজ দ্বায়িত্বে পিতৃত্ব স্বীকার করেছেন এবং তাদেরকে অস্বীকার করার জন্য তিনি যে সারা জীবন অনুতপ্ত ছিলেন-তাও জানিয়েছেন।
মারাদোনা সঙ্গিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনেকটা চেয়ারম্যান মাও এর মতন। মেসি বা বর্তমান স্টার ফুটবলারদের গার্লফ্রেইন্ড হাইফাই ফ্যাশন মডেলরা। মারাদোনার স্বীকৃত বা গোপন সঙ্গিনীরা সাধারন, একদম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা খুব সাধারন মহিলা। এমন কি শেষ বান্ধবী ( যিনি মারাদোনার থেকে ত্রিশ বছরের ছোট) রোকিও ওলিভিয়া গরীব ফ্যামিলি থেকে উঠে আসা জনপ্রিয় মহিলা ফুটবলার। এদিক থেকেও মারাদোনা বিদ্রোহী- সাধারন খেটে খেওয়া গরীবদের প্রতিনিধিত্ব তার বান্ধবী সিলেকশনে ও স্পষ্ট। অনেকেই বলবেন এটা পিতৃতান্ত্রিক এক্সপ্লয়টেশনকে বিপ্লবী স্ট্যাম্প মারা। কিন্ত ল্যাটিন আমেরিকান কালচারে গোপন প্রেম, অবৈধ সন্তান ব্যপারটা খুবই সাধারন ঘটনা। স্বয়ং ফিদেল কাস্ত্রো নিজেই তার পিতার অবৈধ সন্তান। আর কোন মহিলাই বা চাইবে না দিয়েগো তার সন্তানের পিতা হোক? নেপলসের বন্ধু-বান্ধবীদের কাছেই শুনেছি, নেপলসের যুবতীরা স্টেডিয়ামে নগ্ন বুকে লিখে নিয়ে যেত - দিয়েগো তুমি আমার সন্তানের পিতা হবে? এতটাই ছিল মারাদোনা ক্রেজ!
আসলে ফুটবল, প্রতিবাদ, মিছিল, গোপন সঙ্গিনী- ম্যাটার যাইহোক না মারাদোনার সিলেকশন স্পষ্ট- আমি খেটেখাওয়া নির্যাতিত মার্জিনাল লোকেদের প্রতিনিধি! তবে আর যাইহোক তিনি ভুলেও খেটে খাওয়া মানুষদের মতন জীবন কাটান নি। লাক্সারী কার, প্রাইভেট জেট, ইয়াট- সঙ্গ দেওয়ার জন্য অসংখ্য বান্ধবী-এসব নিয়েই তিনি জীবন কাটিয়েছেন। কিন্ত সেইজন্যেই হয়ত তিনি জনপ্রিয়! খ্যাতি বৈভবের চূড়ায় বসেও যিনি আমআদমীর কথাই ভেবেছেন-তাদের কথাই বলেছেন!
তিনি সারাক্ষন সাধারন মানুষের কথাই বলেছেন। এমন কি দুদিন আগেও তিনি নিজের সন্তান, বান্ধবীদের নিয়ে এতটাই বিরক্ত ছিলেন-বলেছিলেন তার সব সম্পদ তিনি আর্জেন্টিনার গরীবদের দিয়ে যেতে চান। হয়ত সেই উইল করার সুযোগ পেলেন না।
No comments:
Post a Comment