বাঙালী নেতা এবং নেতৃত্ব- বাস্তব বনাম কল্পনা
-বিপ্লব পাল, ১১/২৪/২০২০
(১)
বাঙালীদের মধ্যে নেতৃত্বের অভাব শুধু রাজনীতিতে না। ব্যবসা, খেলাধূলা, প্রশাসন সর্বত্রইতা প্রকট। ব্যতিক্রম কিছুটা বিজ্ঞান এবং গবেষনায়। সৌরভ গাঙ্গুলী বাঙালীদের মধ্যে নেহাতই বেমানান।
নেতা কে?
কেউ একজন সৎ, মহান দরদী মানুষ, আদর্শবাদি মানুষ হলেই মহান নেতা হন না। বরং ইতিহাস যারা বদলেছেন, একটা জাতিকে অন্ধকার থেকে তুলে বিশ্বের শ্রেষ্ট প্রভুর জাতে তুলেছেন, তারা অধিকাংশই ছিলেন নিষ্ঠুর, কঠোর। কিন্ত বুদ্ধিমান, সাহসী এবং দূরদর্শী।
যেমন ধরুন চেঙ্গিস খান। চীনের উত্তর-পূর্বের একটা ছোট জায়গা। ভারতের অরুনাচলের মতন। চেঙ্গিস খানের আগে ওদের না কেউ চিনত, না পুঁচত। কিন্ত এক চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা এশিয়া ইউরোপের অর্ধেক দখল করে বসল মাত্র পঞ্চাশ বছরে। আবার চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর একশো বছরের মধ্যে ইতিহাস থেকে মঙ্গোলরা হারিয়ে গেল। নেতা ছিল, তাই
জাতিটা জাতে উঠে ছিল। চেঙ্গিস খান কোন মহান উদার লোক ছিলেন না। ছিলেন নিষ্ঠুর বুদ্ধিমান
কর্মঠ দূরদর্শী।
অথবা আলেক্সান্ডার দ্যা গ্রেট। গ্রীসে ম্যাসেডোনিয়াকে কেউ চিনত না। স্পার্টা এবং এথেন্স ছিল শ্রেষ্ঠ সিটি স্টেট। কিন্ত সেই ম্যাসেডোনিয়ার এক ছোট রাজা ফিলিপ এবং তার পুত্র আলেক্সান্ডার একদিন গোটা বিশ্ব জয় করে বসলেন। আলেক্সান্ডার সামরিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে "গোল্ড" স্টান্ডার্ড। কাছাকাছি আসবেন জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ান, কার্থিজের সেনাপতি হ্যানিবল, খালিদ ইবন আল ওয়ালিদ ( রসিদুন খিলাফতের প্রবাদ সেনাপতি ), এডমিরাল ই সান সিন ( কোরিয়া) । এরা সবাই ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিলেন।
এদের নিজেদের আদর্শ অবশ্যই ছিল- জীবনের সামনে একটা আদর্শ না থাকলে নেতা কেন, একজন সাধারন মানুষ ও পথ চলতে পারে না। কিন্ত তাই দিয়ে নেতা হওয়া যায় না। ইনারা নেতা হতে পেরেছিলেন, কারন জনগন এইসব নেতাদের জন্য নিজের প্রান দিতে প্রস্তুত ছিল। নেতৃত্বের এটা হচ্ছে প্রথম গুন যে তারা তাদের ফলোয়ার বেস তৈরী করতে পারেন, যারা রক্ত এবং ঘাম ঝরানোর জন্য তৈরী থাকে। পরের ধাপ হচ্ছে যে তিনি তার জাতি এবং দেশকে উন্নত শিখরে নিয়ে যান।
রাজনৈতিক নেতার মুল্যায়নের
ক্ষেত্রে "রাজনীতি" এবং "দেশ"-এই দুটি আলাদা। কেউ তার আদর্শের রাজনীতিতে সফল হলেই, ইতিহাস তাকে সফল নেতা নাও বলতে পারে, যদি তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হোন।
আমি এক্ষেত্রে চীনের উদাহরন সামনে আনব। চীনে গত একশো বছরের নেতৃত্ব ছিল চার প্রবাদ প্রতিম ঐতিহাসিক নেতার কাছে-
সান ইয়াত সেন
চিয়াং কাইসেক
মাও যে দঙ
ডেঙ জিয়াও পিং
এর মধ্যে সান ইয়াত সেন এবং দেঙ, দুজনে রাজনীতি এবং দেশনেতা হিসাবে সফল। মাও শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে সফল কারন তিনি চীনে কমিনিউস্ট বিপ্লবের জনক। কিন্ত রাষ্ট্রনেতা হিসাবে ব্যর্থ। তার কমিনিউস্ট পলিসির দরুন দুর্ভিক্ষে না খেতে পেতে পেয়ে অন্তত ৬০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে ডেঙ জিয়াও পিং এর নেতৃত্বে, চিন আজ প্রযুক্তি এবং ব্যবসায় বিশ্বনেতা। মাত্র ত্রিশ বছরে পৃথিবীর বৃহত্তম দরিদ্র জনগনকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত করে বিশ্বনেতৃত্বে টেনেছেন। নিরেপেক্ষ বিচারে শুধু চীন না, দেং সম্ভবত বিংশ শতাব্দির সেরা নেতা।
তার যেতৃত্বে চীন বিশ্বের অনুন্নত দেশ থেকে, শ্রেষ্ঠ উন্নত দেশ হিসাবে উঠে এল।
ভারতে নেতা নেত্রীদের নিমোর্হ বিশ্লেষন করার সুযোগ কম। আবেগের মুলো খাওয়ার জন্য এত গরুছাগলের চাষ হয়েছে ভারতের এডুকেশন সিস্টেমে , কটু নির্মোহ সত্য এদের পেটে হজম হবে না।
(২)
আলেক্সান্ডারকে গোল্ড স্টান্ডার্ড ধরলে ভারতে সিলভার স্টান্ডার্ড সামরিক নেতা খুব বেশী খুঁজে পাওয়া যাবে না। শিবাজি, বালাজি বাজিরাও-১, রঞ্জিত সিং, এরা ছিলেন। কিন্ত পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মিলিটারি লিডারদের লিস্টে প্রথম ১০০ এর মধ্যে কোন ভারতীয়র দেখা পাওয়া যাবে না। শিবাজি মহারাজ একটি লিস্টে দেখলাম ১০২ নাম্বারে, আরেকটিতে ৯৩ নাম্বারে। ভারত থেকে আর কেউ নেই। এগুলো আমার বানানো লিস্ট না-যারা মিলিটারি ইতিহাসের চর্চা করেন, আমার থেকেও সামরিক ইতিহাস অনেক ভাল জানেন, তাদের বানানো লিস্ট।
কিন্ত সামরিক নেতৃত্বে না হোক, ভারত আধ্যাত্মিক ধার্মিক নেতৃত্বে অবশ্যই এগিয়ে। গৌতম বুদ্ধ, শ্রী চৈতন্য এবং মহত্মা গান্ধীর ফলোয়ার গোটা বিশ্বে এবং তারা বর্তমান বিশ্বের এক বিশাল অংশের মানুষকে প্রভাবিত করেছেন।
মুশকিল হচ্ছে, আমি এই আধ্যাত্মিক ললিপপ গিলতে রাজী না। ভারত ইসলাম এবং বৃটিশদের হাতে পদানত হয়েছে তার কারন ভারতে সমর্থ মিলিটারি জেনারেল ছিল না। বাংলা মোঘল এবং বৃটিশদের হাতে পরাধীন ছিল -কারন বাংলায় সামরিক নেতা ছিল না। ভারত এবং বাংলাকে এর খেয়ারত দিতে হয়েছে প্রচুর। এই কঠিন সত্যকে স্বীকার না করলে, বাঙালী
জাতি একদিন নিজের অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলবে।
কেন বলছি? আকবরের সময়ে গোটা বিশ্বের ২৭% জিডিপি ছিল ভারতের। আবার ভারতের জিডিপির ২৫% আসত বাংলা সুবা থেকে। বাংলা শিল্পে ইউরোপের থেকে উন্নত ছিল। গোটা বাংলার জিডিপি ছিল ইউরোপের বেশী।
তাহলে ইউরোপের শিল্প বিপ্লব ত বাংলায় হওয়ার কথা? এশিয়ার জার্মানি হতে পারত বাংলা। কেন হল না? কেন বাংলা জার্মানি হয়ে উঠল না?
ইতিহাসে গতিতে সেটাই হওয়া উচিত ছিল ?
কিন্ত হয় নি। কারন কোন সামরিক নেতা, নেতৃত্ব সেকালেও আসে নি- আজও নেই। ফলে বাংলা রয়ে গেছে মোঘল এবং বৃটিশদের হাতে। একটা জাতির উন্নয়নের জন্য তার স্বাধীনতার দরকার হয়। প্রুশিয়াতে বিসমার্ক না জন্মালে, আজকে জার্মান রাষ্ট্রের বদলে, জার্মানির একেক টুকরো ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রের হত। বাংলায় বিসমার্কের মতন নেতা জন্মায় নি। ফলে বাঙালী জাতির ভাগ্য নিয়ে অন্যরা খেলা করেছে মাত্র। সেই ট্রাডিশন এখনো চলছে।
এই জন্যেই মুক্তমনে চিন্তার দরকার। ভাবার দরকার কেন বাংলা নেতৃত্বের
অভাবে ডুবে গেল। পরাধীন জাতির কোন ভবিষ্যত থাকতে পারে না। থাকেও নি।
নেতাজি নেতা হিসাবে এক পর্যায়ে সফল যে উনার জন্য সবাই রক্ত দিতে তৈরী ছিল। আবার সফল নন ও-কারন বৃটিশ অধীনস্থ ভারতীয় সেনারা, তার ডাকে মোটেও বিদ্রোহ করে, আজাদ হিন্দ ফৌজে আসে নি। আগের দিন মাস্টারদা সূর্য্য সেনের প্রসঙ্গ উঠল। মাস্টারদা অসম্ভব সাহসী, জেদি, আদর্শবাদি দেশপ্রেমিক। এই নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্ত তাকে এবং তার দলবলকে বাঙালী গোয়েন্দা এবং দারোগারাই ধরেছিল। তার লং টার্ম প্ল্যানিং বা ভিশন -কোনটাই ছিল না। এটা ভগত সিং এর জন্যও সত্য। বাকী ভারতীয়দের সাথে
ইনাদের যোগ ছিল সামান্যই।
সি আর দাশ, বি সি রায়-এরা আদর্শবাদি ভাল লোক। ব্যক্তি হিসাবে এরা তুলনাহীন। কিন্ত শুধু তাই দিয়ে নেতা হয় না। নেতা হতে সাহস লাগে। নিষ্ঠুর ভাবে লক্ষ্যের দিকে এগোতে হয়। স্বাধীনতার অগ্নিযুগের বাঙালী নেতাদের গুনগানে ভর্তি ইতিহাস বই পড়ে, বোঝা যাবে না বাঙালীর নেতৃত্বহীনতার ইতিহাস। তার জন্য পড়তে হবে বাঙালীর ব্যর্থতার ইতিহাস। তা হচ্ছে দেশভাগ।
এই প্রশ্নটা কেউ করে না – স্বাধীনতার সময় এত বড় বড় নেতা থাকতে বাংলা ভাগ হল কি করে??? কেউ বাঙালীর স্বার্থ দেখল না কেন? প্রায় এক কোটি বাঙালী হিন্দু এবং ১৫ লাখ বাঙালী মুসলমান এই বাংলাভাগে তাদের আদি ভিটেমাটি হারিয়ে ভিখিরি হল। বিসি রায়, জ্যোতিবোস- এরা ছিলেন ত!!! কিন্ত বাস্তব এটাই এইসব মহান নেতাদের সবাই ভৃত্যসুল্ভ নেতা। সাহস বা দম কারুর ছিল না। বৃটিশ ভাগকে মেনে নিল! এদের নেতৃত্বের পাশাপাশি ইস্রায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ানের জীবনী পড়ুন। বুঝবেন বাঙালীর এই সব মহান নেতারা কেন বেনগুরিয়ানের পায়ের যোগ্য না। প্যালেস্টাইনকে ভাগ ত বৃটিশরা ও করেছিল! কিন্ত বেনগুরিয়ান সেটা অগ্রাহ্য করলেন যুদ্ধ করেই। কারন তার কুড়ি বছরের প্রিপারেশন ছিল। বাংলার এইসব মহান নেতাদের ( পড়ুন জ্যোতি বসু, বিসিরায়) দেশভাগের বিরুদ্ধে কোন প্রিপারেশনই ছিল না!
(৩)
নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, বাজপেয়ী,
মনমোহন, নরেন্দ্রমোদি-এদের নেতৃত্ব বিচার করব কি করে?
যদি রাজনৈতিক সফলতা দিয়ে বিচার করি, তাহলে মোদি
সব থেকে বেশী এগিয়ে। কারন উনি গোটা ভারতে আর এস এসের আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। এক বিশাল ভারত তার ফলোয়ার। বাকীরা রাজনীতির ক্ষেত্রে
মোদির কাছাকাছিও সফল নন।
কিন্ত তারমানে
কি উনি রাষ্ট্রনেতা হিসাবে সফল ? ডেং এর
সাথে তুলনা করলে বোঝা যাবে, মোদি বরং মাও এর সাথে তুলনীয়। যিনি দেশে নিজের রাজনীতি
প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন-কিন্ত দেশকে টানতে পারেন নি। মোদি বিরাট বিরাট স্বপ্ন দেখেছেন-কিন্ত
এটা বোঝেন নি ভারতের ইনফ্রাস্টাকচার দুর্বল। আমলাতন্ত্র, বেনিয়া পুজির রিফর্ম না হলে
ভারতকে পেছনের সিটে বসতেই হবে। এখানেই ডেং তাকে বিরাট গোল দেবেন। ডেং এর রিফর্ম ছিল
মৌলিক। উনি বুঝেছিলেন স্লোগান না- চীনকে বদলাতে হলে, গোড়ায় ধাক্কা দিতে হবে।
অন্যদিকে মনমোহন সিং হয়ত রাজনীতিতে ব্যর্থ- রাজনৈতিক
নেতা হিসাবে ব্যর্থ। কিন্ত ভারত আজকে যেটুকু এগিয়েছে, সেটা তার সংস্কারের জন্যই।
রাষ্ট্র নেতৃত্বের প্রশ্নে মনমোহন এদের সবার থেকেই এগিয়ে থাকবেন। কিন্ত রাজনীতি
বিহীন রাষ্ট্রনেত্বত্ব সোনার পাথর বাটি।
ভারতের বাম নেতৃত্বের কথা
যত কম বলা যায় তত ভাল। এরা রাজনীতি এবং রাষ্ট্র নেতৃত্ব দুই দিক দিয়েই ব্যর্থ।
ভারতের মতন গরীব দেশের অন্তত ৩০% সিট বামেদের পাওয়ার কথা। ভারতের পার্লামেন্টে
এদের সিটের সংখ্যা ১% ও না বর্তমানে। ঐতিহাসিক হায়েস্ট ১০% । ভারতের কমিনিউস্ট পার্টিতে
আগেও নেতা ছিল না, এখনো নেই। আমি ভারতের কমিনিউস্ট পার্টির ইতিহাস যত পড়েছি, তত এই
ধারনা আমার মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে, এরা চিরকালই নেতাবিহীন- র্যাডারলেস শিপ।
(৪)
নেতা এবং নেতৃত্বের ধারনা, একজন শিশু বা কিশোর তার ফর্মেটিভ এজে- কিভাবে পায়?
বাঙালীদের জন্য ( হয়ত সবার জন্য) মূলত পাঁচটা সোর্স
(১) খেলার মাঠে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া বা টিভিতে খেলা দেখার সময় নেতৃত্ব দিতে দেখা
(২) বাড়িতে বাবা কাকা জেঠা যদি নেতৃত্ব পজিশনে থাকে- সে অফিস, ব্যবসা বা রাজনীতি-যায় হোক না কেন-সেটা দেখে বড় হওয়া
(৩) কলেজের ছাত্র রাজনীতি, জিমখানা, ক্লাব -ইত্যাদিতে জড়ানো
(৪) টিভি, নিউজপেপারের সমকালীন রাজনৈতিক নেতা এবং নেতৃত্বকে দেখে শেখে তরুনরা
(৫) ইতিহাসের নেতাদের দেখে শেখে।
পাঁচ নাম্বারটা গুরুত্বপূর্ন। বাম রাজনীতিতে অনেকেই আসতে পারেন, ফিদেল কিম্বা লেনিনের ইতিহাসে আকৃষ্ট হয়ে। আবার ডান রাজনীতিতে অনেকেই আসেন হেডগাউকরের আদর্শে আকৃষ্ঠ হয়ে।
সুতরাং স্কুলে ইতিহাস কিভাবে পড়াচ্ছে তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে, একজন শিশু বড় হয়ে নেতা বলতে কি বুঝবে।
ভারতে যেভাবে ইতিহাস পড়ানো হয়-তাতে একজন নায়ক, একজন ভিলেন। পুরোটাই বলিউডি একমাত্রিক ইতিহাস। ফলে ভারতের ইতিহাসে নায়ক কি ভিলেন, কারুরই নেতৃত্বের কাঁটাছাড়া হয় না। এর জন্য নেতৃত্ব নিয়ে আজন্ম ভুল ধারনা থেকে যায়। আমি শুধু দুটো উদাহরন দেব
লর্ড ক্লাইভ। ইনি ভারতে ভিলেন, ইংল্যান্ডে মহানায়ক। কিন্ত দুপক্ষই মানবেন তিনি একজন ঐতিহাসিক নেতা। ক্লাইভের ইতিহাস পুরো পড়লে, যে কেউ বুঝবেন এই একটা লোক তার বুদ্ধি সাহস দূরদর্শিতা দিয়ে সেইকাজ করেছিল যা আর কেউ করতে পারে নি। ইংল্যান্ডের মতন একটা ছোট দ্বীপের মাত্র কয়েক হাজার লোক, কোটি কোটি ভারতবাসীর রাজা হয়ে গেল! খুব মোটা দাগেও বোঝা যায় কাজটি খুবই কঠিন ছিল। এবং ক্লাইভ সেটা করেছিলেন। অথচ, ভারতের ইতিহাস পড়লে মনে হবে ক্লাইভ ছল চাতুরো করে ভোলামেলা সিরাজকে হারিয়ে দিলেন! ভারতের ৯০% ছাত্ররাই জানে না, পলাশীর যুদ্ধের আগে দুবার ক্লাইভ সিরাজকে হারান এবং সিরাজ আলি নগরের সন্ধী করতে বাধ্য হোন। উভয় ক্ষেত্রেই ক্লাইভের সেনার সংখ্যা ছিল হাজারের কাছেকাছি, আর সিরাজের ৫০ হাজারের বেশী। এবং দুই ক্ষেত্রেই
ক্লাইভের মিরজাফরের প্রয়োজন হয় নি। ৯৯% লোক এটা জানে না, কলকাতায় আসার আগে ক্লাইভ দাক্ষিনাত্যে দুটি বড় যুদ্ধ জিতেছেন এবং মাদ্রাসে বৃটিশ আধপত্য স্থাপন করেছেন ফ্রেঞ্চ এবং কর্নাটকের রাজাকে হারিয়ে ( প্রথম কর্নাটকের যুদ্ধ)।এবং সেখানেও ক্লাইভের
হাতে বিপক্ষের তুলনায় মোটে ১০% সেনা ছিল!
মুষ্টিমেয় কিছু সৈনিক নিয়ে তার থেকেও দশগুন বেশী শক্তির রাজা নবাবদের কিভাবে হারাতে লর্ড ক্লাইভ? কারন বুদ্ধি। শত্রু পক্ষের প্রতিটি শক্তি দুর্বলতা, তার নখ দর্পনে থাকত। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন কঠিন সময়ে। মুর্শিদাবাদ থেকে কর্নাটক -সর্বত্রই মসনদের রাজনীতির সব কিছুর ডিটেলস দিতে তার গোয়েন্দারা। এর বিপরীতে ভারতের রাজা মহারাজা নবাররা ছিল নেহাত দুগ্ধপোষ্য শিশু। রাজনৈতিক সামরিক নেতৃত্ব শিখতে গেলে, ববার্ট ক্লাইভের কাছ থেকেই শেখা উচিত। কারন ভারতের ইতিহাসে উনার সমতুল্য কেউ নেই। বালখিল্যএর মতন ইতিহাস
চর্চা না করে- এই অপ্রিয় সত্যগুলো স্বীকার করার সময় এসেছে।
দুই, মহম্মদ ঘোরি। সোমনাথ মন্দির ধ্বংস করার জন্য ইনি ভারতের ইতিহাসের আরেক ফেবারিট ভিলেন। কিন্ত এই লোকটার ইতিহাস ভারতে ডিটেলেসএ কেউই পড়ে না। অথচ ভারতের মুসলমান শাসনের আদি পুরুষ ইনিই। ব্যপারটা খুব সহজ ছিল না। ভারতের পশ্চিম প্রান্তে তখন চালুক্য এবং চৌহানদের শক্তিশালী রাজ্য। ঘোরি প্রথমে চালুক্যদের কাছে পরাজিত হোন । কেয়াদারার যুদ্ধে তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর তরাইনের প্রথম যুদ্ধে, পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে ঘোরি আহত হয়ে প্রায় মরতে যাচ্ছিলেন।
দুবার ঘোহারা হারার পর ও কিভাবে মহম্মদ ঘোরি তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে জিতে ভারতে ইসলামিক শাসন শুরু করলেন?
না ভারতীয় রাজাদের বদান্যতা, উদারতায় ঘোরি বেঁচে যান নি। ঘোরিকে মারার জন্য তার পেছন পেছন দৌড়ে লাভ হয় নি। কারন তুর্কীর এই ট্রাইবরা ছিল দ্রুত ঘোরসোয়ার। এরা হিট এন্ড রান টাইপের যুদ্ধ করত। যুদ্ধে হারা শুরু হলেই এরা দ্রুত পালাত। আবার ফিরে আসত। কিন্ত বিপক্ষ হেরে গেলে এরা কচুকাটা করত। বিপক্ষ পালানোর সুযোগ পেত না। কারন ঘোরার পিঠে এরা ছিল দুর্ধস্ব দ্রুত। এই ধরনের লুঠেরা হিট এন্ড রান টাইপের ট্রাইবাল আক্রমনেই রোমান সম্রাজ্য ধ্বংস হয়। প্রথম তরাইনের যুদ্ধের পরই পৃথ্বিরাজের সাবধান হওয়া উচিত ছিল-তাদের সনাতন যুদ্ধ পদ্ধতি খুব বেশীদিন চলবে না। তিনি কোন সামরিক রিফর্ম করেন নি। এখানেই একজন মহান নেতার সাথে তার পার্থক্য। আলেক্সান্ডারের পিতা ফিলিপ, তার সেনাবাহিনীর দুর্বলতা বুঝে প্রথমেই সামরিক টাকটিস, অস্ত্রের পরিবর্তন করেন। ফলে ম্যাডিসনের সেনাবাহিনী গ্রীসের সেরা সেনাবাহিনী হয়ে ওঠে।
ইতিহাসে
শিক্ষা এটাই বাংলা, ইউরোপের জার্মানী হয়ে উঠতে পারত। পারে নি কারন বাংলায় সামরিক
নেতা এবং নেতৃত্ব ছিল না। কোন জাতি রাজনৈতিক ভাবে পরাধীন থাকলে তাদের পক্ষে জার্মান
হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। যাদেরকে বাঙালীর মহান
নেতা হিসাবে মূলোর মতন ঝোলানো হচ্ছে ( এবং সেই মূলো খাবার মতন গরু ছাগলরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ)
, ইতিহাসের একটু ভেতরে ঢুকলে বোঝা যাবে তাদের কেউই মহান নেতা নন। কারন তারা মহান হলে
বাংলা ভাগ হত না। বাংলার ইতিহাস তারা বদলাতে পারতেন।
এই কটু অপ্রিয় সত্যের সামনে দাঁড়ানোর সময় এসেছে।
No comments:
Post a Comment