Monday, December 21, 2020

সান জু, প্রশান্ত কিশোর এবং ২০২১ এর বঙ্গ বিধানসভা যুদ্ধ

 

সান জু, প্রশান্ত কিশোর এবং ২০২১ এর বঙ্গ বিধানসভা যুদ্ধ

          -বিপ্লব পাল,  ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২০

                                                                        (১)

চীনে ঝাও সাম্রাজ্যের অবসানে গোটাদেশে সাতটা নতুন রাজ্য তৈরী হয়। সেটা প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। রাজ্য এবং রাজা মানেই আধিপত্যকামী। ফলে রাজ্যগুলোর মধ্যে  যুদ্ধ লেগেই থাকত। এর মধ্যে চীনের পূর্বে উই প্রদেশের রাজা হেলু,  সান জু ( মাস্টার সান)  নামে এক উচ্চভিলাসী স্ট্রাটেজিস্টকে “হায়ার” করলেন। আসলে উই ছিল একটা ছোট রাজ্য। তার পাশেই বিশাল রাজ্য চু। যার সামরিক শক্তি উই এর দশগুন! চু কোন না কোনদিন উইকে আক্রমন করে, গিলে খাবে-এই দেওয়াল লিখন রাজা হেলু জানতেন। ফলে সারা চীন দেশ খুঁজে তিনি এমন একজন ধুরন্দর “স্ট্রাটেজিস্ট”কে নিয়ে আসলেন, যিনি রণকৌশলে নিপুন। সামরিক শক্তি ১ঃ ১০ হলেও ভয় পান না- সেই অনুযায়ী স্ট্রাটেজি নামান!  ইনিই হচ্ছে আর্ট অব ওয়ার গ্রন্থের লেখক সান জু। যার নাম এখন গোটা বিশ্ব মানে, আর্ট অব ওয়ার গ্রন্থের লেখক হিসাবে।

 

রাজা হেলু ভাবলেন , মাস্টার সান কেমন বিখ্যাত স্ট্রাটেজিস্ট পরীক্ষা নেওয়া যাক। হেলু বললেন, আমার প্রায় ৩৪০ জন রক্ষিতা আছে। তুমি তাদের ট্রেনিং দিয়ে সেনা বাহিনীর মতন সুশিক্ষিত ডিসিপ্লিনড আর্মি বানাতে পারবে?

 

মাস্টার সান জু বললেন পারব। তবে শর্ত হচ্ছে, আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে। আপনি “ইন্টারফেয়ার” করতে পারবেন না।  রাজা হেলু মেনে নিলেন।

 

  সান জু সমস্ত প্রাসাদ রক্ষিতাদের দুটো দলে, দুই প্ল্যাটুনে ভাগ করে দাঁড় করালেন। দুই দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন, রাজার প্রিয়তমা দুই নারীকে। তাদেরকে করা হল প্লেটুন অফিসার। প্রথমে তাদের সেনা বাহিনীর ড্রিল শেখানো হল। যে বাদ্যের তালে তালে এই ভাবে পা ফেলতে হবে।

 

 ড্রিল শেখানোর পর বাদ্য বাজানো হল। দেখা গেল কোন রক্ষিতাই সামরিক তালে পা ফেলছে না। তারা হেসে কুটোকুটি। আর তাদের অফিসার -রাজার প্রিয় দুই রক্ষিতার ভ্রুক্ষেপ নেই। তারাও হাসছে।

 

  সান জু রাজার দুই প্রিয় মহিলাকে  বল্লেন, দেখ প্রথম বারের ব্যর্থতা -আমার ব্যর্থতা। যে হয়ত আমি শেখাতে পারি নি। পরের বার ও যদি এই ৩৪০জন সামরিক কায়দায় পা ফেলতে ব্যর্থ হয় সেটা হবে তোমাদের ব্যর্থতা।

 

 আবার সামরিক বাদ্য বাজল। এবারও মেয়েরা হেসেই আকুল।  দুই মহিলা অফিসার হাসি ঠাট্টাতেই মেতে রইলেন।

 

 সান জু, পেয়াদাকে বল্লেন তলোয়ার দিয়ে দুই মহিলা অফিসার তথা রাজার প্রিয় রক্ষিতাদ্বয়ের মাথা কেটে ফেলতে। রাজা হেলু মহা খাপ্পা। বলে, আরে মাস্টার সান কর কি। অবলার জীব। এরা মারা গেলে আমার শৃঙ্গার  প্রেমের কি হবে বাছা? আমি ত এমনি মস্করা করছিলাম। মেয়েদের দিয়ে কি আর সামরিক ড্রিল হয়?

 

  সান জু বল্লেন মহারাজ, আপনার কি মনে হয় আপনার দশ হাজার সেনা, চু এর এক লাখ সেনাকে হারাতে পারবে?  মেয়েরা সেনানী হতে পারার মতন সেটাও ত অবিশ্বাস্য না? আপনি যখন আমাকে দ্বায়িত্ব দিয়েইছেন, কাজটা করতে দিন।

 

 রাজা হেলু দেখলেন সান জুর কথায় ধক আছে। রাজার প্রিয়তমা দুই রক্ষিতার গর্দন নেওয়া হল। এবার নতুন দুজন ডেপুটিকে আনা হল নেতৃত্বের জন্য-যারা পুরো ঘটনাটা দেখেছে। আবার সামরিক বাদ্য বেজে উঠল। এবার কোন মেয়ের সামরিক তালে ভুল হল না।

 

 সান জু দেখালেন যাদের দিয়ে যুদ্ধ হবে না মনে হচ্ছে, তাদের দিয়েও সেরা সেনানী বানানো যায়, যদি “স্টাটেজি” ঠিক থাকে। বোজুর যুদ্ধে রাজা হেলুর মাত্র ২০ হাজার সেনা, চু এর দু লাখ সেনা বাহিনীকে কচুকাটা করে।

 

                                                             (২)

প্রশান্ত কিশোর এক বিংশ শতাব্দিতে ভারতের সান জু। ভোট যুদ্ধে জিততে যাকে স্ট্রাটিজিস্ট হিসাবে ভাড়া করা হয়। প্রশান্ত কিশোর ২০১৪ সালে মোদির বিজয়, ২০১৫ সালে বিহারে নীতিশ, ২০১৯ সালে জগন এবং কেজরিওয়ালকে জিতিয়ে নিজের যোগ্যতার প্রমান দিয়েছেন। কিন্ত তিনি উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস-সমাজবাদির জোটের হয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ। কারন, কংগ্রেসের মাঝারি নেতৃত্ব তার কথা শোনে নি। ডিসিপ্লিনহীন পার্টিতে তিনি কিছুই করতে পারেন নি।

 

 এবার দেখুন। যারা বিজেপিতে যাচ্ছে তারা পিকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। এবং তৃনমূলে যারা টিকে আছে তাদের অনেকেই পিকের কাজকর্মে অখুশী। কেন? কারন তাদের রিপোর্ট কার্ড, দুর্নীতি, ভালকাজ, গ্রহনযোগ্যতা সব কিছুই পিকের আইপ্যাকের মাধ্যমে দিদির কাছে পৌছে যাচ্ছে। পিকের টিম দ্বায়িত্ব নেওয়ার পর, সামান্য সার্ভে করেই বুঝেছিলেন সীমাহীন দুর্নীতির কারনে তৃনমূলের মাটি সরে যাচ্ছে। ফলে তিনি তৃনমূলের নেতাদের গোপন এসেসমেন্ট চালু করেন। তাতেই নেতারা ক্ষাপ্পা।

 

পিকের বিরুদ্ধে মমতা ব্যানার্জি অনেক অভিযোগ পেয়েছেন। কিন্ত শুনলেন না কেন? কেন শুভেন্দুর সাথে একবারও দেখা করলেন না? একটু কেমন ঠেকছে না? মমতা ব্যানার্জি এবং প্রশান্ত কিশোর একটা নির্দিষ্ট স্ট্রাটেজি নিয়ে না চললে, এমনটা হওয়ার কথা না। সান জুর মতন নিশ্চিত পিকেও শর্ত রেখেছেন, যতই প্রিয়তম হোক, স্ট্রাটেজি অনুযায়ী ঘ্যাঁচাত করতে হলে করতে হবে। শুভেন্দুকে পিকের পরিকল্পনা মাফিক ঘ্যাঁচাত করা হয়েছে। নইলে শুভেন্দুকে রাখতে ম্যাডাম নিজে মাঠে নামতেন। বাকীদের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য। কারন এরা দলে থাকা অবস্থায় পিকের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ করেছে। কিন্ত ম্যাডাম পাত্তা দিচ্ছেন না। এবং তারা দলত্যাগ করছে। ম্যাডাম কি এতই বোকা যে এর পরেও পিকের ওপর জেতার জন্য ভরসা রাখছেন?

 

এবং পিকেও হুঙ্কার ছাড়ছেন বিজেপি ১০০ পেরোতে পারবে না? ১০০ ছাড়ালে পিকে আর কোনদিন স্ট্রাটেজিস্টদের কাজ করবেন না!

 

 দাবা খেলায় জিততে হলে বোরে, নৌকা ইচ্ছা করেই অনেক সময় খাওয়াতে হয়।

 

 কিন্ত এক্ষেত্রে পিকে এবং দিদির চালটা কি সেটা বোঝা যাচ্ছে না। পিকের টিম  জেলায় জেলায় ঘুরে প্রতিটা কেন্দ্রে ভাল পার্থী খুঁজেছেন। বামেদের কাছেও গেছেন। কিন্ত ভাল পার্থী পেয়েছেন এমন জানা নেই।

 

 সব ক্যাম্পেনেই পিকের তিনটে স্ট্রাটেজি থাকে

-       ভোটের মুখ। এক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জি-ফলে সমস্যা নেই। উলটো দিকে এখনো শুন্য। লোকে মমতা ব্যানার্জিকে দেখেই ভোট দেবে বা দেবে না।

 

-        দুই ডিসিপ্লিন। পার্টর মধ্যে দ্বন্দ কমিয়ে কর্পরেট স্টাকচারে আনা। নেতাদের ইগো দিয়ে পার্টি না চালানো। লক্ষ্য করলে দেখবেন পিকে আসার পর তৃনমূলে গোষ্টিদ্বন্দ মিইয়ে গেছে। কারন দিদি কোন গোষ্টির কথাই শুনছেন না। শুনছেন পিকের টিমের ফিডব্যাক। ফলে অনেক গোষ্টির লোকেরা বিজেপিতে জয়েন করছে। এতে আখেরে তৃনমূলের সুবিধাই হচ্ছে। টিম ছোট হচ্ছে-কিন্ত ইউনিটি ডিসিপ্লিন -একটা কমন টার্গেটে কাজ করার ক্ষমতা বাড়ছে। এটাও সান জুর শিক্ষা।

 

-       জন সংযোগের প্রোগ্রাম। সেটাতে পিকে যথেষ্ট সফল।

 

 কিন্ত উলটো দিক ও আছে। শোভন, মুকুল , শুভেন্দু- এরা তৃনমূলের আসল মুখ। যতই দুর্নীতিপরায়ন হোক না কেন , এদের কর্মকুশলতা নিয়ে অভিযোগ নেই।  রাজনৈতিক কর্মী এবং কর্পরেট কর্মী এক না। একজন রাজনৈতিক কর্মী দলটাকে ভালোবেসে করে। একজন কর্পরেট কর্মী কোম্পানীকে ভালবেসে কাজ করে না-করে মাইনের জন্য।  সুতরাং একজন রাজনৈতিক কর্মীর আবেগ-ইগো থাকবেই,। সেটাকে অস্বীকার করে, তারা সবই পিকের কর্পরেট স্টাইল মেনে মাইনে করা চাকরের মতন কাজ করবে, এমনটা ভাবা কি ঠিক? আবার এটাও ঠিক-এই ভালোবাসা আবেগ এবং তার সাথে কিঞ্চিত উপরিপাওনার আশাতেই কিন্ত দলে গোষ্টী দ্বন্দ তৈরী হয়।

 

 দিদিকি তা জানেন না ? তাহলে পিকের কথা মেনে নিচ্ছেন কেন? কেন মেনে নিচ্ছেন দলের রক্তক্ষরন?

আমার ধারনা  সান হু, রাজা হেলুকে যে যুক্তি দিয়েছিলেন, সেটাই মমতা ব্যানার্জিকে দিয়েছেন পিকে। বিজেপির এখন লোকবল অর্থবল অনেক বেশী। দশগুন। সুতরাং বিজেপির হাতে পশ্চিম বঙ্গের পতন প্রায় নিশ্চিত। কেবল মাত্র একটা স্ট্রাটেজিই এক্ষেত্রে তৃনমূলের পক্ষে খাটবে। যদি গোটা তৃনমূল একটা ঐক্যবদ্ধ ডিসিপ্লিন্ড  পার্টী হিসাবে স্ট্রাটেজি অনুযায়ী খেলে যেতে পারে।  বিজেপিতে এত এত নেতা ঢোকা মানেই বিজেপি শক্তিশালী হচ্ছে এটা বলা যাবে না। এমনিতেই রাজ্য বিজেপিতে অনেক দল। যত বেনোজল ঢুকবে তাতে গোষ্ঠিদ্বন্দ বাড়বে। একত্রে কাজ করার ক্ষমতা কমবে । আর্ট অব ওয়ার বলে, বড় দল না , ঐক্যবদ্ধ দলই জেতে।

 

পশ্চিম বাংলা এখন ভারতের কুরুক্ষেত্র। একদিকে ভোট চানক্য অমিত শাহ। অন্যদিকে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। লড়াই জমবে। আমরা খেলা দেখি।

No comments: