ভারতীয় গণতন্ত্রে
মধ্যবিত্তের ভবিষ্যত
-বিপ্লব পাল, ১২/১২/২০২০
ভারতের কৃষিবিল, কৃষি আন্দোলন, রেল/এয়ার ইন্ডিয়া/
পাবলিক কোম্পানীর বেসরকারিকরন, জিএসটি, ডিমনেটাইজেশন, অধুনা বেসরকারি কর্মচারীদের বেসিক
বেঁধে তাদের ইনকামে বাঁশ দেওয়া – এই সব কিছুর মধ্যেই একটা প্যাটার্ন আছে। সেই প্যাটার্নটা ধরতে পারলেই বুঝতে পারবেন, ভারতে
মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ভবিষ্যত কোন দিকে এগোচ্ছে। বেসিক্যালি কৃষি বিল কি? সরকার বর্তমানে যে ১০০ হাজার
কোটি টাকার কৃষি ভর্তুকি দিতে বাধ্য হচ্ছে- তার সিংহ ভাগ যাচ্ছে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার
কৃষকদের হাতে। এবং যারা বর্তমানে বিজেপির বড় ভোট ব্যাঙ্ক না। বরং ভর্তুকি তুলে দিলে,
ওতে আরো তিনটি স্কিম হয়ে যাবে যাতে অনেক বেশী ভোট কেনা যাবে। ফলে লে আও কৃষি বিল। সিম্পল
ভোটগণিত।
বেসিক্যালি
যেটা পরিষ্কার – বর্তমান কেন্দ্রীয় মোদি সরকারের উদ্দেশ্য দুটো। সরকারের আয় বাড়ানো।
খরচ সাবসিডি কমানো। এবং সরকারের এই আয় দিয়ে,
দুটো শ্রেনীকে খুশী করা।
এক, গরীব ভোটার-যারা ভোট দিয়ে রাজশাহী টেকাবে। তাদেরকে
চিকিৎসা, বাথরুম, ইলেক্টিসিটি ইত্যাদি নানান যোজনার মাধ্যমে সরাসরি টাকা দেওয়া। অর্থাৎ
ভোটারদের ঘুঁশ দেওয়া। কিন্ত ডেমোক্রাসিতে এটাই হওয়া উচিত।
দুই, আম্বানী, আদবানী সহ গুটিকয় বৃহৎ ব্যবসায়ীদের
জন্য বিরাট ব্যবসাক্ষেত্রে প্রস্তুত করা। কারন এই শ্রেনীটির টাকায় পার্টি চলবে। বিধান
সভায় হেরেও ঘোড়া বেচাকেনার টাকা যোগাবে এরাই।
অর্থাৎ ডেমোক্রাসির ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং।
এক, নাম্বার ব্যপারটাই ক্ষতি নেই। কিন্ত তাতে টাকা
যোগাবে কে? সরকারের বিরাট টাকা যায় কৃষি, এয়ার
ইন্ডিয়া, রেলে ভর্তুকি দিতে। সুতরাং সরকার প্রথমেই ওইতিনটে যায়গায় হানা দিয়েছে। এই
পর্যন্তও ঠিক ছিল। যে ট্যাক্সের টাকা গরীবদের কাছেই যাক। তাতে মার্কেট বাড়বে।
এরপর আছে জি এস টির মাধ্যমে ইনকাম বাড়ানো। বেসরকারী
কোম্পানী গুলি একটা বড় টাকা বাঁচায়, তাদের কর্মচারীদের বেসিক কম দেখিয়ে, আলায়ান্স বেশী
রাখে। কারন বেসিকের ওপর এম্পয়মেন্ট ট্যাক্স দিতে হয়। সেখানেও হানা দিয়েছে মোদি সরকার।
ফলে, অধিকাংশ বেসরকারি কর্মচারীদের টেকহোম ইনকাম কমবে। কারন কোম্পানীগুলিকে ট্যাক্স
ব্যালান্স করতে হবে।
এই টাকার পুরোটা ঐ গরীবদের স্কিমে গেলে বা আদানী
আম্বানীর পদসেবায় গেলে, ঘোরতর মুশকিল আছে। কারন আপনি আমার ব্যবসা থেকে ১৮% ট্যাক্স
তুলছেন। সেটা ব্যবসার জন্য তখুনি ভাল যখন ঐ ট্যাক্সের টাকাটা ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারনে
সরকার লাগাবে। কিন্ত সেটা সরকার করছে না। চীনে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার নিজে ব্যবসা শুরু
করতে গেলে কিভাবে নানান দিক থেকে সরকারি সাহায্য পায় সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। এই
জিসটির টাকায় সরকার যদি ছোট ছোট ব্যবসা, ম্যানুফাকচারিং ইউনিট গুলিকে সাহায্য করত,
যা চীন আমেরিকাতে করে-তাহলে ১৮% কেন ৩০% জি এস টিও ব্যবসার বৃদ্ধিতে সাহায্য করত। কিন্ত বর্তমানে কি অবস্থা? ১৮% জি এস টি পে করে,
ভারতের টেক্সটাইল বাংলাদেশের কাছে ১০০% হেরে বসে আছে।একেই ভারতের ম্যানুফাকচারিং ইউনিটগুলোর
মারোয়াড়ী গুজরাটি মালিক। আধুনিকরন, রিসার্চে
টাকা লাগায় না। ফলে যেসব ক্ষেত্রে ভারত আগে
এক্সপোর্ট করত- ইলেক্ট্রিকাল গুডস, টেক্সটাইল সর্বত্রই ভারতের ইনকাম পড়তির দিকে। এক দিকে মারোয়ারী, অন্যদিকে মোদি ট্যাক্স। ফলে ভারতে
ম্যানুফাকচারিং এর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।
এবার মধ্যবিত্তর ভবিষ্যত দেখুন। মধ্যবিত্ত চাকরি
প্রেমী বা ছোট ব্যবসা করে খায়। ট্যাক্সের চোটে ছোট ব্যবসার হাল আগেই লিখেছি। মধ্যবিত্তের চাকরির তিনটে সেক্টর
-সরকারি। এখানে সংকোচন চলছে। আরো চলবে। কারন সরকার
যত কম সরকারি নিয়োগ দেবে, তত বেশী টাকা বাঁচবে স্কীমের জন্য-মানে ভোট ঘুঁশের জন্য।
এখানে স্কোপ জিরো হতে চলেছে বা প্রায় তাই এখন
-বেসরকারি
আই টি/ সফটোয়ার । এটা ভারতের মধ্যবিত্তকে এদ্দিন বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্ত কদ্দিন?
অটোমেশনের ফলে, আই টি মার্কেট এখন তুখোর ছেলে মেয়েদের দরকার। সরকারি শিক্ষা আমূল ভাবে
সাজানোর দরকার। সেসব কিস্যু হয় নি। চীনের শিক্ষার মানের সাথে ভারতের শিক্ষার মানের
কোন তুলনা হয় না। ভারত এখন যোজন যোজন পেছনে।
এছাড়া আমেরিকা বর্তমানে নিজেই প্রচুর সফটোয়ার কর্মী প্রডিউস করার জন্য স্কুল
লেভেল থেকেই সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্পেশালিজেশন দিচ্ছে। আগামী দশ বছরে, এই ক্ষেত্রে
ভারতের ছেলে মেয়েদের স্কোপ বিরাট কমবে
-ম্যানুফাকচারিং। এক্ষেত্রে ডবল প্রবলেম। মাড়োয়ারী মালিকরা মাইনে ভাল
দেবে না, রিসার্চে ইনভেস্ট করবে না। আর গোদের ওপর
বিষফোঁড়া মতন মোদিট্যাক্সে এরা কাহিল। মেইড ইন্ডিয়া জাস্ট বুলি। একটা রাইফেল
ও আমেরিকা থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। রাফাল বা এফ-১৬ এর যন্ত্রাংশ ভারতে এসেম্বলি হবে-তাতে
চাড্ডিরা লাফাচ্ছে বটে কিন্ত এটা ভুলে যাচ্ছে, আগে কোলকাতা, পুনেতে তৈরী মটোর গোটা
বিশ্বে রপ্তানী হত। বর্তমানে ওই মার্কেট সম্পূর্ন চীনের। মাত্র ত্রিশ বছরে এই হাল কি
করে হয়?
আর বেসরকারি শিক্ষাক্ষেত্রের কথা বাদ দিলাম। ওখানে
শিক্ষকদের যা মাইনে দেয় তার থেকে অনেক বেশী ইনকাম করে হাওড়ার কুলিরা। তাদের দরিদ্র
ক্লাসে ফেলা ছাড়া উপায় নেই।
তাহলে মধ্যবিত্ত কি করবে? ওয়েল তৃনমূল ও একই ফর্মুলাতেই
রাজ্য চালাচ্ছে। কারন এটাই বর্তমান গণতন্ত্রের উইনিং ফর্মুলা। বিজেপি, তৃনমূলের মধ্যে স্ট্রাটেজিগত কোন পার্থক্য
নেই, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রশ্নে। এমন
কি কংগ্রেসের সাথেও নেই। সুতরাং মধ্যবিত্তর স্বার্থের প্রশ্নে মধ্যবিত্তের পাশে কোন
দলই নেই। অথচ ফেসবুক হোয়াটসাপে এদের ছেলেমেয়েরাই
এইসব পার্টিগুলোর হয়ে বুক চিরে হনুমান হচ্ছে।
পরে রইল বামেরা। ভারতের বামেরা কিন্ত কৃষক-শ্রমিকদের
পার্টি না- মধ্যবিত্তদের স্বার্থ, সরকারি চাকরির স্বার্থ রক্ষা করা পার্টি। কিন্ত তারা
ভারতে হেরে ভুত। কারন তারা বাকী পার্টিগুলোর মতন গরীব ভোটারদের ঘুঁশ দিতে ব্যর্থ। তারা
মূলত মধ্যবিত্তের স্বার্থ দেখতে গিয়ে গরীবদের থেকে বিচ্ছিন্ন। এছাড়া তাদের নেতাদের বালখিল্যের ন্যায় চলছে না চলবে
নার ফলে, ম্যান্যফাকরিং ব্যবসার প্রচুর ক্ষতি হয়। সুতরাং তাদের নেতৃত্ব, স্ট্রাটেজি
সব কিছুই কোন শ্রেনীর কাছেই ( সরকারি চাকুরিজীবি ছাড়া) গ্রহণযোগ্য না। তারা প্রমানিত
ব্যর্থ।
তাহলে উপায় কি?
ইনফ্যাক্ট উপায় দেখাতে পারত পশ্চিম বঙ্গ। যেটা বুদ্ধদেব শুরু করেছিলেন , ডেং জিয়াও পঙের মতন
সরকারি নিয়ন্ত্রনে সরকারি সাহায্যে ম্যানুফাকচারিং বাড়ানো। তথ্য দেখলেই পরিস্কার হবে
ডেং জিওয়াও পং বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ নেতা। একটা ১৪০ কোটির দেশে, যার ১০০% দরিদ্র,
সেই দেশের ৯০% কে মধ্যবিত্ত স্তরে নিয়ে এসেছেন মাত্র কুড়ি বছরে। পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ
এটা পারে নি। কিন্ত বুদ্ধকে বোঝার মতন কেউ
ছিল না। না উনার পার্টিতে। না ভারতে। না পশ্চিম বঙ্গে।
কোন পার্টি এটা করবে জানি না। কিন্ত ভারতে ডেং বা
পুতিনকে দরকার। বর্তমান গণতান্ত্রিক ধারা চলতে
থাকলে, ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর কোন ভবিষ্যত
নেই। তারা ব্যাঙাচির মতন বিজেপি, তৃনমূল সিপিএম কংগ্রেসের পক্ষে ফেসবুক হোয়াটসাআপে
লিখে যাবে। কিন্ত বাস্তব হচ্ছে তাদের জন্য আর কেউ নেই।
1 comment:
"কিন্ত ভারতে ডেং বা পুতিনকে দরকার।"
এই বিষয়ে আপনার সাথে একমত।
Post a Comment