Tuesday, December 29, 2020

লাভ জিহাদ, লাভ ম্যারেজ এবং পিছিয়ে যাওয়ার রাজনীতি

                                                                             (১) 

আজ মধ্যপ্রদেশে লাভ জিহাদ বিরোধি আইন পাশ হল ( যদিও খাতা কলমে নাম "ফ্রিডম অব রিলিওজিওন" বিল)। এর আগে আইন পাশ করেছে উত্তর প্রদেশ। আসাম, হরিয়ানা, কর্নাটক সহ বিজেপির শাসনাধীন সব রাজ্যই বলছে, তারাও আইন আনবে । পোষাকি নাম " ধর্মান্তকরন বিরোধি" বা "ধর্ম পালনের স্বাধীনতা" বিল। 

  আপাত দৃষ্টিতে বিলটি ধর্ম নিরেপেক্ষ যেহেতু তা সব ধর্মের লোকেদের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। বক্তব্য হচ্ছে,  কাউকে বিয়ে করে, ধর্মান্তকরন করা চলবে না।  আমি নিধার্মিক , ধর্ম তুলে দেওয়ার পক্ষের লোক। সুতরাং এই আইনে খারাপ কিছু দেখি না। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে উত্তর প্রদেশে গত কয়েক সপ্তাহে এই নতুন আইনটি বহু মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করার কাজে লাগানো হয়েছে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাত্রীর ধর্মান্তকরন হয় নি বা হলেও তারা স্বেচ্ছায় করেছে বলে পুলিশের কাছে জানিয়েছে।  অর্থাৎ ভারতের আইনের ক্ষেত্রে যা হয়- ৯৯% ক্ষেত্রেই অপপ্রয়োগ -যেমন বধূ অত্যাচার নিবারন  আইন, আদতে বর অত্যাচার আইনে দাঁড়িয়েছে-এটিও সেই দিকেই যাচ্ছে। 


 লাভ জিহাদ ব্যাপারটা শ্রেফ গোয়েবেলিয় লেভেলের মিথ্যাচার। কেরালার খৃষ্ঠান, পাঞ্জাব, লন্ডনের সর্দার এবং কর্নাটকের হিন্দু সংগঠন গুলির যাবতীয় অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ বা নানান ইনভেস্টিগেশন থেকে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা নেহাতই বিন্দুতে সিন্ধু। শুধু দুটো কেসের লাভ জিহাদ সাবস্টান্স আছে। প্রথমটা কেরলের     হাদিয়া কোর্ট কেস (২০১৭) । কেরালার ভাইকমের হোমিওপাথি ছাত্রী হাদিয়াকে ইসলামিক স্টেট   ব্রেইন ওয়াশ করে জেহাদি প্রেমিকা হতে।   গোটা বিশ্ব জুরেই নাবালিকাদের ভালনারাবিলিটি এক্সপ্লয়েট করেছে আই সিসিস। কিন্ত সেটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদি কার্যকলাপ-এবং তাতে ভারতের কিছু মুসলমান ও জড়িত ছিল। কিন্ত তার সাথে প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া হিন্দু-মুসলমানের প্রেম ঘটিত বিবাহের কেসের কোন সম্পর্ক নেই।  দ্বিতীয়কেস টি জাতীয় শুটার তারা সহদেহর (২০১৮)। রাঁচিতে  রাকিবুল হাসান নামে এক মুসলমান যুবক  রঞ্জি কোহলি  হিন্দু নাম নিয়ে, তাকে বিয়ে করে। যা প্রতারনা।  এরকম কেস আরো কিছু থাকতে পারে। কিন্ত ভারতে ঘটে যাওয়া হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান বিবাহে যা ১% কেস ও না। 

কোন মুসলমান যুবক যদি হিন্দু নাম ভাঁড়িয়ে বিয়ে করে-তাহলে বর্তমান আইনের তিনটে ধারাতে তাকে জেল খাটানো যায়। আলাদা করে নতুন আনার কোন দরকার নেই। আনা হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক আরো খারাপ করতে। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে। 


                                                           (২)

এবার আসি আসল সমস্যায়।  রাজনীতি সমাজের প্রতিফলন। রাজনীতিবিদরা সেটাই করবেন, যাতে তারা ভোটারদের মন পান। তারাত মন জুগিয়ে চলার অভিনেতা।   ভারতবর্ষের অধিকাংশ হিন্দু মুসলমান পিতা মাতা, তাদের সন্তানদের অন্য ধর্মে বিয়ে দিতে চান না। কোন হিন্দু ছেলে যদি মুসলমান মেয়ে বিয়ে করে-বেশ কিছু ক্ষেত্রে তার শশুরবাড়ির লোক সেই ছেলেটি এবং মেয়েটিকে মেরে ফেলেছে হনার কিলিং হিসাবে।  একজন মুসলমান বাপ হনার কিলিং করে জেলে গিয়ে গর্ব বোধ করে যে সে ইসলামের সেবা করছে।  হিন্দু বাপেদের খুন করে জেলে যাওয়ার সাহস নেই -কিন্ত বিজেপির উত্থানে এখন রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে এসেছে। ফলে তারা আইন করে মুসলমান ছেলের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে আটকাচ্ছে।  এটা হচ্ছে সোজা সাপ্টা সত্য। 

 প্রশ্ন হচ্ছে এইভাবে আইন করে কি প্রেমের বিয়ে আটকানো যাবে না তা উচিত?

 ইতিহাসে তাকানো যাক।  

 প্রেম, সেক্স , বিয়ে- এই তিনটি আলাদা, সম্পূর্ন আলাদা শব্দ। 

 সেক্স হচ্ছে ইন্ট্রিগ্রাল বায়োলজিক্যাল প্রসেস-যা কালচারাল, বা লিগ্যাল না-প্রানীর সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। 

 বিয়ে হচ্ছে লিগ্যাল কনস্ট্রাক্ট-ইতিহাসে যার জন্ম মেসোপটেমিয় সভ্যতায় ৪০০০ বছর আগে।  বিয়ের উতপত্তির কারন প্রাইভেট প্রপার্টি বা ব্যক্তিগত সম্পত্তির উত্থান।  ঐতিহাসিক ভাবে এবং আজ থেকে দুশো বছর আগেও বিয়ে করার একমাত্র কারন ছিল সন্তানের জন্ম-যে হবে উত্তরাধিকারি। বিয়ের সাথে প্রেমের কোন সম্পর্কই ছিল না।  বিয়ে ছিল একটা সামাজিক ডিউটি বা কর্তব্য। স্বামী স্ত্রীর প্রেম নেহাত আধুনিক ধারনা। 

  এখনো অনেক আদিবাসি সমাজ, যাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নেই-সেইসব সমাজে বিয়ে বলে কোন প্রথা নেই। 

 প্রেম হচ্ছে সাংস্কৃতিক কনস্ট্রাক্ট।  প্রেম হচ্ছে অনুভূতি এবং ফুলফিলমেন্ট-অনেকটাই ডোপামিনের মোহ। প্রাচীন সাহিত্যে প্রেম পাওয়া গেলেও- " প্রেম করে বিবাহ" ব্যাপারটা গোটা পৃথিবীতেই আধুনিক ধারনা। জন্মস্থল ইংল্যান্ডের উনবিংশ শতক। তার আগে পর্যন্ত ধরা হত, প্রেম এবং বিবাহ হচ্ছে তেলে জলে। প্রেম বিবাহের ভার বইতে অক্ষম! 

 প্রেম করে বিবাহ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের দান। এর তিনটে কারন আছে। শিল্প বিপ্লবের ফলে তিনটে পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। এক, টেক্সটাইল শিল্পে মেয়েরা শ্রমিক হিসাবে যোগ দেওয়াতে তারা পরিবার থেকে কিছুটা হলেও স্বাধীনতা পায়-যাতে তারা পরিবারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পায়।  দ্বিতীয় হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জন্ম।  নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জন্য অনেক বেশী সময় পায়। ফলে আগে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে একজন স্ত্রী তার স্বামীকে সপ্তাহে এক ঘন্টাও পেত না। দরকার ও হত না।  বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের ভার সামলাতেই তার সময় চলে যেত। কিন্ত নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির উত্থানে নারী-পুরুষ উভয়েরই সেই পার্টনারের দরকার হল, যার সাথে তাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে।  তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন বিবর্তন-শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে মানুষের জীবন সংগ্রাম কমে। শিল্প বিপ্লবের আগে প্রতিটা সাধারন মানুষকে প্রতিটা দিন প্রকৃতির সাথে, লোকাল ট্যাক্স কালেক্টরের সাথে , যুদ্ধের সাথে ঝুঝতে হত। প্রায় পশুর মতন ছিল বেঁচে থাকা। সেখানে প্রেম ঢোকা মুশকিল। সন্তান এবং সেক্স ছাড়া কিছু ছিল না। কিন্ত শিল্প বিপ্লবের ফলে যে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর উদয় হল, তাদের জীবন অনেক ইজি। তারা সাহিত্য সঙ্গীত শিল্পে জীবনকে স্পর্ষ করছে যা আগে  এক্সক্লুসিভ ছিল শুধু ধনী এবং রাজউজিরদের। ফলে জীবনে পশুর মতন বেঁচে থাকা ছাড়াও "ফুলফিলমেন্ট" বা "পূর্নতার" ধারনার সাংস্কৃতিক ভিত্তি তৈরী হয়। 

জেন অস্টিনের রোম্যান্টিক উপন্যাসগুলির এটিই প্রেক্ষাপট। এই উনবিংশ শতাব্দিতে শুধু উপন্যাসেই না, বাস্তবেও ইংল্যান্ডে মেয়ের বাবারা, প্রেমে  খাপ্পা হয়ে জামাইকে পিটিয়েছে, মেরে ফেলেছে, তার বিস্তর উদাহরন আছে।  সুতরাং আজ যা ভারতে দেখছেন, পাকিস্তানে আফগানিস্তানে যা ক্যান্সারের মতন আছে, সেই অনার কিলিং বা লাভ জিহাদ আইন আসলে একটা প্রাচীন রক্ষনশীল সংস্কারের প্রতিফলন। যেখানে "সন্তানেরা"  পরিবারের  সম্পদ এবং তাদের "বিবাহ" সামাজিক অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করা ( ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ব্যবসা, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে রাজনীতি) । প্রাক শিল্প বিপ্লবের সমাজে এটাই হত- কারন বিবাহে প্রেমের দরকার হত না।  


                                                               (৩)

অধিকাংশ ভারতীয় উচ্চশিক্ষিত উচ্চপ্রতিষ্ঠিত মুসলমান ছেলেরা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করে। সেটা মোটেও লাভ জিহাদ না। প্রাক্টিক্যাল ইস্যু। কারন ভারতীয় মুসলমান বাপেরা মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত উদার আধুনিক করে গড়ে তোলে না। ফলে অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত মুসলমান ছেলেদের মধ্যে হিন্দু মেয়ে বিয়ে করার  প্রবনতা আছে। কারন একজন পি এই চ ডি করা মুসলিম ছেলে কি করে স্কুল ড্রপ আউট একটা মুসলমান মেয়ের সাথে সারা জীবন কাটাবে????  ফলে এই বিবাহগুলি তাদের এবং  তাদের হিন্দু প্রেমিকাদের জন্য প্রাক্টিক্যাল কনসিডারেশন। এর মধ্যে দু একটি কেসে হয়ত মেয়েটিকে ইসলাম গ্রহনের জন্য শশুর বাড়ি থেকে চাপ দেয়। তবে আমার বন্ধু সার্কেলে এমন কেস দেখিনি। সুতরাং কত % কেসে ইসলাম গ্রহনের জন্য চাপ দেওয়া হয়, আমার জানা নেই। % খুব কম হবে বলেই মনে হয়। 

এখন আপনি বলবেন ইসলামিক আইনে মুসলমানরা অমুসলমানকে বিয়ে করতে পারে না। ফলে অনেক হিন্দু ছেলে বা মেয়ে ইসলাম কবুল করে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। তবে ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্ত স্পেশাল ম্যারেজ এক্টেই বিয়েটা হয়।  আমিও খুব পরিস্কার ভাবেই বিয়ের জন্য ধর্ম বদলানোর বিরোধি। ধর্ম জিনিসটাই আমার কাছে বলদের খাটাল। এবার কেউ যদি বলে এক খাটাল থেকে অন্য খাটালে নাম লেখাচ্ছি-সেটা শ্রেফ নির্বুদ্ধিতা। 

এখানে ইসলাম কি বলে, হিন্দু কাস্ট সিস্টেম কি বলে তাই দিয়ে বিচার করলে সর্বনাশ।  ভারত পিছিয়ে ছিল। তাই থাকবে। পার ক্যাপিটা জিডিপিই বলুন বা হিউম্যান ডেভেল্পমেন্ট ইন্ডেক্স- ভারতের স্থান ১৮৮টা দেশের মধ্যে ১৩০-১৫০ এর মধ্যে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত পিছিয়েছে। এগোয় নি। কংগ্রেস-বিজেপি-এদের সবাই ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ। বেসিক্যালি দেশটা ধর্ম জাতের পাঁকে আটকে। মার্কেট ইকনমি ছাড়া ভারতের এগোনোর কোন পথ নেই। 

মার্কেট ইকনমি ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের জন্য নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি দরকার-আর নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির জন্য লাভ ম্যারেজের সংখ্যা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাবেই।  প্রেম এবং পকেট দেখেই বিয়ে হবে। ডিভোর্স ও বাড়বে। একটা দেশের অর্থনীতি, শিল্প, শিক্ষা, হিউমান ইন্ডেক্স এগোলে- এগুলো হবেই।  লাভ ম্যারেজ একটা মার্কেট ফোর্স। একজন কর্মী এখন বাবা-মায়ের সাথে থাকে না। সে যদি মনের মতন সঙ্গী সঙ্গীনি না পায়-তার লাভ লাইফ, তার সেক্স লাইফ আনফুলফিল্ড থাকে- তার প্রোডাক্টিভিটি ক্রিয়েটিভিটি কমতে ব্যর্থ। 

আমি জানি এই লেখার জন্য প্রচুর হিন্দু আমাকে গালাগাল দেবে। বচন -আপনি মুসলমানদের চেনেন না ( মানে তারা কিরকম গোড়া, গলাকাটার জাত ইত্যাদি ইত্যাদি)। 

 তাদের জানাতে চাই -আমি ইতিহাসের পড়ে অতীতকে জানার চেষ্টা করি। আর প্রযুক্তিবিদ হিসাবে ভবিষ্যতটা দেখতে পাই। ভবিষ্যতের ছেলে মেয়েরা এইসব ইসলাম হিন্দুত্ব মানবে না। কারন গান, নাচ, সাহিত্য, সিনেমা, শিল্প মানুষকে যে জীবনের পূর্নতা দেয় -ধর্ম তা পারে না-ওটা নেহাতই মধ্যযুগীয় কনস্ট্রাক্ট। এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে ধর্মের  কৃত্রিম  বাঁধ সর্বত্র ভাংছে।  আগামী প্রজন্ম ওই কট্টর ধর্মে থাকবে না।  আমেরিকাতে হিন্দু এবং মুসলমানদের দ্বিতীয় প্রজন্মে কট্টর ধার্মিক পাওয়া মুশকিল।   আগামী দিনের প্রজন্ম সবাই মিলে একসাথে দিওয়ালি, ইদ, ক্রীসমাস  পালন করবে-ধর্মর অনুশাসন খুব হাল্কা মানবে। কারন সেই "মার্কেট"।  আপনারা চাইলেও হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্ঠান বিবাহ আটকাতে পারবেন না। কারন আপনি নিজেকে মুসলমান, হিন্দু, খ্রীষ্ঠান মনে করেন। আপনার ছেলে মেয়েরা গুগুল জেনারেশন । তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচিতি মানবে না। কারন তারা গ্লোবালাইজেশনের সন্তান।

তাই আপনারা লাভ জিহাদ প্রতিরোধ আইনে যতই খুশী হোন-ইতিহাস এটাই বলবে -ভারত একসময় সৌদি আরব, পাকিস্তান হওয়ার চেষ্টা করেছিল। 






No comments: