Thursday, July 6, 2017

আমি হিন্দু নই, তুমিও মুসলমান না!

এই মহাবিশ্বের বয়স?

     তা চোদ্দশ কোটি বছর হবে।

 আকার, আয়তন, পরিধি ?

 জানা নেই। আমরা পৃথিবীর বাসিন্দা।   সৌর জগতের মধ্যে একটা ছোট্ট পৃথিবী - ইডেন উদ্যানে পিংপং বল।

আর ওমন কোটি কোটি সৌর জগত আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে। হাবল টেলিস্কোপের চোখ যদ্দুর যায় - এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বে কোটি কোটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আবিস্কার করেছে মানুষ নিজেই! আর দৃশ্যমান মহাবিশ্ব, আসল মহাবিশ্বের কতটুকু? জানা নেই।

   তাহলে আমি কে? আয়ু একশো বছর। পৃথিবীর পাঁচশোকোটি লোকের একজন!  এই মহাবিশ্বের বয়স যদি হয় একশো বছর, তাহলে আমার জীবনকাল এক সেকেন্ডের চেয়েও ক্ষুদ্র!

  ভাবুন - স্থান এবং কালে- এই মহাবিশ্বের চেতনায়, আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব। আমার জীবনটা মহাজাগতিক কালে-জাস্ট একটা বুদবুদ।  রাতের আকাশের দিকে তাকান-আর নিজেকে ভাবুন-আপনি কে? মহাসমুদ্রের ধারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জোনাকিরা আমার  ক্ষুদ্রতা দেখে হাঁসবে!

  অথচ আমাদের "আমি" ভাবনা থামে না- আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি ধনী, আমার এই নেই, আমার বড় বাড়ি আছে-আমার ছেলে এই-আমার বংশ এই! আমার এই  ডিগ্রী-আমি এই করেছি-"আমি" র লিস্ট মালগাড়ির বগির মতন!

     মানুষের জীবন এতই ক্ষুদ্র-মানুষ সততই ভোলে মৃত্যুর নিমন্ত্রনপত্র নিয়েই সে জন্মেছে। মোমের মতন গলে সেই অহং, যখন একদিন মৃত্যুর সামনে দাঁড়াতে হয়।

  কি আশ্চর্য্য-পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থেই মানুষকে তাই বার বার সাবধান করা হচ্ছে- ওহে তোমার জীবনকাল বড়ই ক্ষুদ্র- বৃথা নষ্ট করো না ঝগড়াঝাঁটি ঈর্ষা খুনোখুনি করে!

   কোরানে মৃত্যু চেতনা আছে প্রায় ৭৩ টি আয়াতে- আল ইমারান (৩/১৮৫ ) এ নাজিল " পৃথিবীর বুকে এই নশ্বর জীবন আসলেই অহংঙ্কারপূর্ন অস্তিত্ব, (কারন সে মৃত্যুর কথা মনে রাখে না)" ।

     উপনিষদের জীবন দর্শনের প্রায় সবটাই মৃত্যুচেতনা থেকে উঠে আসা।  কঠোপনিষদকে এডউইন আর্নাল্ড কবিতায় রূপ দিয়ে লিখেছেন " মৃত্যুর গোপন কথা"।

 কঠোপনিষদে নচিকেতা যমের সম্মুখে --

   যম বল্লেন বর চাও নচিকেতা?

    - হ্যা, প্রভু-যদি আপনি আমার ওপরে প্রফুল্ল, তাহলে দয়া করে বলুন মৃত্যুর ওপারে কি রয়েছে রহস্য?

  - নচিকেতা, মৃত্যু নিয়ে আমায় বিব্রত করো না। অন্য বর চাও। মৃত্যুর রহস্য তোমায় দিতে পারব না।

  - প্রভু দিতে হলে আমাকে এটিই দিন। বলুন মানুষের মৃত্যু রহস্য। কারন আমি জানি, আপনিই কেবল জানেন এই মৃত্যুর রহস্য!

  - নচিকেতা তোমার কি চাই? হাজার বছর আয়ু? কত হাতি, কত সোনা, কত স্ত্রী , কত পুত্র , কত জমি চায় তোমার? সব দিচ্ছি।  কিন্ত আমার কাছে মৃত্যু রহস্য জানতে চেও না। ছেড়ে দাও বাপু-মৃত্যু রহস্য জানার ইচ্ছা!

  নচিকেতা নাছোড়বান্দা।

 -প্রভু এই নশ্বর রাজত্ব, নারী, সম্পদ-সবই ত ক্ষনস্থায়ী, যতক্ষন শ্বাস , ততক্ষন। কোনকিছুই নিত্য না-তাহলে কিসের মোহে মৃত্যুরহস্যের পিছু ছেড়ে এই ক্ষনস্থায়ী ভোগবিলাসে মজি প্রভু?

   যম দেখল, ভবি ভোলার না। নচিকেতা মৃত্যুরহস্য জেনেই ফিরবে!

   মৃত্যুর সামনে মানুষের যে ক্ষুদ্র নশ্বর অস্তিত্ব-এবং তাতেই কুয়োর ব্যঙের মতন আমাদের অহং এর লাফালাফি -প্রতিটা ধর্মই তা বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছে। এই পর্যন্ত ধর্মদর্শনটুকু আমার ভালোই লাগে। কারন অহঙ্কার জ্ঞানের তাপে মোমের মতন গলে।

  ধর্মের সাথে আমার গোল  বাধে এর পরের ধাপে।  হ্যা, এটা মানি, জীবন ক্ষনস্থায়ী-এটা মাথায় রাখলে নিজেকে মোটিভেট করাই মুশকিল।  ফলে একটা বুষ্টিং বর্নভিটা দরকার। জৈন, বৌদ্ধ এবং হিন্দু দর্শনে সেটা পরের জন্ম। পুনঃজন্ম। ইসলাম, খ্রীষ্ঠ ধর্মে স্বর্গের সুরাসরের ধারনা।

    সমস্যা এটাই- যখন সন্ত্রাসবাদিরা এই নশ্বর জীবনকে সত্যি সত্যিই সম্পূর্ন তুচ্ছ ভেবে, স্বর্গের মোহে আত্মঘাতি ভেস্ট বুকে নিয়ে সুইসাইড বোম্বার হয়। মৃত্যুচিন্তা পর্যন্ত সব ধর্মই ঠিক। কিন্ত মৃত্যুপরবর্তী চিন্তাটা সব ধর্মেই রূপকথার মোহজাল এবং তা সুস্থ সমাজের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদীর জন্ম দিতে সক্ষম। তাদের ছোটভাই মৌলবাদিরাও সেই পরকালের মদে বুঁদ।

  সুতরাং যতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হৌক, হোক যতই অকিঞ্চিৎকর-এই ক্ষুদ্রজীবন, তার চাওয়া, পাওয়া ওঠা নামাগুলোকে ভাল লাগা দরকার। জীবনকে যেন প্রতিটা শিশু ভালবাসতে শেখে।  নচেৎ তাদের সন্ত্রাসী হওয়া সময়ের অপেক্ষা।

  যারা বলেন, ইসলাম এখন সব থেকে বেশী সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিচ্ছে-কারন মাদ্রাসা নশ্বর জীবনের মুন্ডপাত করে --বেহস্তে বাহাত্তর হুরের স্বপ্নে তারা বিভোড় -আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই- এই ইসলামেই জন্মে ছিলেন সুফীগুরু জালালুদ্দিন রুমি।  জীবনকে যে এত তীব্রভাবে ভালোবাসা যেতে পারে, সেটা আমরা অনেকে তার কবিতা থেকেই শিখেছি --

( কবিতার ভাষাটি আমার নিজের অনুবাদ, রুমির ভালোবাসার তীব্রতা প্রকাশ করার মতন বাংলা আমি শিখি নি-তাই ক্ষমা মার্জনা চাইছি )

     মানবসত্ত্বা!
    সেত আমার অতিথিগৃহ—
    রোজ সকালে নিত্যনতুন অতিথির আনাগোনা।
এক টুকরো সুখ / একখন্ড হতাশা/ একরাশ ক্ষুদ্রতা,
অপ্রত্যাশিত অতিথির তালিকাটি দীর্ঘ/ ক্ষনিকের অতিথি তারা, এসেছে দুয়ারদ্বারে। 
স্বাগত সবাই/ আমি পা ধুইয়ে দিই তাদের সবাইকে
—যদি তা দুর্বার দুঃখও হয়
যা ওলোট পালট  করে ছুড়ে ফেলে দেয় সাজানো গৃহের সাজানো আসবার 
এরপরেও 
 আন্তরচিত্তে গ্রহণ কর সবাইকে—
হয়তো সে তোমাকে পুরস্কৃত করছে জেনো,
নতুন কিছু আনন্দআগমন উপলক্ষে।
অন্ধকার আশংকা, অপমান, আক্রোশ, ঘৃণা— সবকিছু,
হাসিমুখে এগিয়ে এসো সামনের দরজায়!
জালালুদ্দিন রুমি এগুলো লিখেছেন ত্রয়োদশ শতাব্দিতে, ইরানে। ইসলামের ইতিহাস তখন রক্তাত্ব-এখনকার মতই। উনি ইসলামের সৌর্ন্দয্যকে রাজনীতি থেকে বার করে কবিতায় রূপ দিলেন-কারন সুফীরা তখন ইসলামের  রক্তাত্ব রাজনৈতিক ব্যবহারে বিরক্ত। ঠিক যেমন ভাবে  এখনকার সাধারন মুসলমানরা বিরক্ত হোন যখন রাজনীতিবিদরা ইসলামকে ব্যবহার করেন ভোটের জন্য।

 জালালুদ্দিন রুমি না পড়লে বোঝা যায় না ইসলামিক সংস্কৃতিতেও একদা মানুষ খুঁজেছে চিরন্তন   সৌর্ন্দর্য্য। ওমর খৈয়াম, হাফিজ শিরাজি, খলিল জিব্রান-কার কথা ছেড়ে কার কথা বলি ?

            যেমন উপনিষদ না পড়লে বোঝা অসম্ভব প্রাচীন ভারতের চিন্তার সৌন্দর্য্য-আত্মার মুক্তি। গোরোক্ষা কমিটির হিন্দুএর দেখলে শুধুই মনে হবে হিন্দু ধর্ম আচার-বিচার-জাতফাতের ফিতেই আটকানো পা ভাঙা গরু-শুধু ন্যাদায় গোচনা! কে বলবে এই ধর্মের সর্বোচ্চ উপলদ্ধি উপনিষদের বাণী- যা রবীন্দ্রভাষ্যে  

‘হে মহাপথিক/অবারিত তব দশদিক/তোমার মন্দির নাই, নাই স্বর্গধাম/নাইকো চরম পরিণাম/। তীর্থ তব পদে পদে/চলিয়া তোমার পদে মুক্তি পাই চলার সম্পদে’
 
 তাহলে ক্ষীরটা কি খাইলাম?

  জীবনকে ভালবাসতে হবে- জীবনকে ঘৃণা করা শুরু করলে- ছেলেটা মৌলবাদি নইলে সন্ত্রাসবাদি হবেই।

  জীবনকে ভালবাসিবে কিরূপে? নাচে গানে খাদ্যে সৌর্ন্দয্যে কবিতার ছন্দে?  এখানেই ধর্ম দর্শনের সাথে সংঘাত। কঠোপনিষদ, কোরান-এরা সবাই আমাদের নশ্বর জীবনের আনন্দকে ক্ষনস্থায়ী বলে বাতিল করে দিল!

ঠিক এই কারনেই এই জন্মে আর আমার ধার্মিক হয়ে ওঠা হল না! চলার পথেই যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জেতা হারা-তাই থেকেই যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুদের মতন ছোট ছোট আনন্দ দুঃখের বারিধারা- তার সিঞ্চনেই আমি খুশী। এটা জেনেই এসবের কোন মানে নেই-জীবনের পরম উদ্দেশ্যও নেই।

বেহস্ত, পরের জন্ম, কমিনিউস্ট রাষ্ট্র-ইত্যাদি বড় বড় লক্ষ্যের পেছনে  দৌড়ানোর ঝামেলাটা এই-তাতে জীবনের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাওয়াগুলো হাওয়া হয়ে উড়ে যায়-আর নৈরাশ্যের নেশায় জেগে ওঠে মৌলবাদি দৈত্য।

 বরং এই গ্লাসে গলায় থাকুক এক টুকরো গালিব

  হামকো মালুম হ্যায় জান্নাত কি হক্বিকৎ লেকিন

দিল কে খুশ রাখনে কো গালিব ইয়ে খ্যয়াল আচ্ছা হ্যায়।












No comments: