(১)
ভারতের আই টি শিল্পে কর্মী ছাঁটাই অব্যহত। এখন যা হচ্ছে, তা হিমশৈলের ভাসমান অংশমাত্র। আমেরিকাতে আমার যেসব বন্ধু সার্ভিস সেলসে আছেন-তাদের অনেকের কাছ থেকেই শুনছি ট্রাম্প জমানা আসাতে অনেক ডিল হয় বাতিল, না হলে পেছোচ্ছে-নইলে কাজ পাচ্ছে স্থানীয় আমেরিকান কোম্পানী। সেলস পাইপলাইন শুকানোর দিকে। এখনো বড়সর কিছু লে-অফ হবে না। কিন্ত আস্তে আস্তে আই টি ইঞ্জিনিয়ারদের ওপরে অটোমেশন এবং ট্রাম্পের গিলোটিন ঝপাৎ করে নামার অপেক্ষায়।
ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাটার ভবিষ্যতই প্রশ্নের মুখে। অনেক বাবা মা যাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছেন তারাও আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আবার যাদের ছেলেমেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তাদের কপালেও চিন্তার খাঁজ। টিসিএস, ইনফি এরা ক্যাম্পাসিংএ না এলে, ফ্রেশার না নিলে কি ছেলেটার ভবিষ্যত কি? যারা এই পেশাতে আছে, তারাও আমাকে ইনবক্স করছেন। ফলে বহুদিন থেকেই ভাবছিলাম এই ব্লগটা লিখব। বিশেষত আমরা যখন উচ্চমাধ্যমিকে, ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা নিয়ে স্বচ্ছ ধারনা ছিল না কারুর। এখনো অবস্থার পরিবর্তন হয় নি। সব থেকে বড় কথা, এখন যে কাজগুলো করে আমরা খাচ্ছি, সেইসব পেশার অস্তিত্বই ছিল না তখন। ইঞ্জিনিয়ারিং এ এটাই সব থেকে বড় কথা। প্রযুক্তির গতি এখন তীব্র। প্রতি দুই তিন বছরে বদলে যাচ্ছে টেকনোলজি প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন ধরতে লেট করলেই ভোকাট্টা ঘুরির মতন মার্কেট থেকে আছড়ে মাটিতে।
তবে এর মধ্যেও শান্তনা এটা যে ভাল ইঞ্জিনিয়ারের অভাব এখনো সুতীব্র। ভারতে প্রতি কুড়িটা ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে একজন পাতে দেওয়ার যোগ্য। একশো জনে একজন পাওয়া যায়, যাকে আন্তর্জাতিক মানে ডিস্টিংশন দেওয়া যায়। ফলে যারা খুব খেটে প্যাশনেটলি কোডিং শিখছে, নিজের সাবজেক্ট শিখছে, নানান প্রোডাক্ট ডিজাইনে অংশ নিচ্ছে-তাদের কোন চিন্তা নেই। কিন্ত যারা বিটেকের চারটে বছর গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে আগে ক্যাম্পাস নামিয়ে দিত-দুর্দিন তাদের।
(২)
এবারে আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা এবং তার হালচাল নিয়ে কিছু ধারনা করা যাক। প্রযুক্তি মানেই যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ, সুন্দর এবং নিরাপত্তা দেওয়া। এর বাইরে কিছু হয় না। এই পেশাতে সব কিছুই লাগে-বিজ্ঞান, গণিত, আর্টস, ডিজাইন, অর্থনীতি, একাউন্টিং। ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা বলে আলদা কিছু নেই-এটাও ডাক্তারদের মতন অভিজ্ঞতাবাদ বা এম্প্রিরিসিজম। অভিজ্ঞতা লদ্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানো।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার সেই অর্থে কোন গ্ল্যামার ছিল না। পাবলিক সেক্টরে ভাল মাইনের চাকরি পেলেই অনেকেই বর্তে যেত। ১৯৯১ সাল থেকেই চাকা ঘোরে। মনমোহন সিংহের উদারনীতির জমানায় ভারতে ঢোকে একাধিক আমেরিকান কোম্পানী। এর সাথে সাথে আমেরিকাতে শুরু হয় কম্প্যুটার ইন্ড্রাস্ট্রির বুম। ১৯৯৫ সাল থেকে সিলিকন ভ্যালিতে শুরু অসংখ্য ইকর্মাস স্টার্টাপ। এরা এমন সব মাইনে দেওয়া শুরু করল, যা নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভারতে কেউ ভাবতেও পারত না আগে। আমার মনে আছে সেই ১৯৯৩-৯৫ সালে কেডেন্স, সান সিস্টেম এরা আই আই টি ক্যাম্পাসে বছরে সাত লাখ টাকার প্যাকেজ নিয়ে আসে। যা তখন ছিল অকল্পনীয়। কারন আই আই টির সিনিয়ার অধ্যাপকদের বার্ষিক বেতন তখন পাঁচ লাখের নীচে।
এর পরে আমেরিকাতে আই টি শিল্পের চাহিদা যত বেড়েছে-ভারতের আই টি কোম্পানী গুলি ফুলে ফেঁপে উঠেছে । কারন আমেরিকাতে অত আইটি কর্মী ছিল না-এখনো নেই। ১৯৯৩ সাল নাগাদ ক্লিনটন গ্যাট চুক্তি সাইন করেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন গ্লোবালাইজেশনের পক্ষে ছিলেন। ফলে উনার আমলে আই টি কর্মীদের আমেরিকাতে নিয়ে আসা সহজ করতে এইচ ওয়ান বি ভিসা চালু হয়। যার অধিকাংশ পেয়েছে ভারতীয়রা।
১৯৯৫-২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় আই টি শিল্পের স্বর্নযুগ। পৃথিবীর সব দেশেই ভারতীয় আই টি কর্মীদের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। আই টি শিল্পের সাপ্লাই লাইন বজায় রাখতে ভারতে গজিয়ে ওঠে অসংখ্য প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সাথে সাথে বেড়েছে মাহিনাও। বিশেষত যারা অভিজ্ঞ। এন্ট্রি লেভেল মাইনে একই থেকেছে।
আমেরিকাতে ২০০৭-৮ এর অর্থনৈতিক মন্দায় ভারতীয় আই টি প্রথম ধাক্কা খায়। যদিও আমেরিকা প্রচুর ধার করে, অর্থনীতি ফিরিয়ে নিয়ে আসে আগের যায়গায়, আই টি শিল্পের জগন্নাথ রথ পাঁচ টি গাড্ডায় হোঁচট খায়।
-- অর্থনৈতিক মন্দার আগে, আমেরিকাতে শিক্ষিত লোকজন এত ভারতীয় বিদ্বেশী ছিল না। ভারতীয়রা চাকরি নিয়ে যাচ্ছে এটা রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিনত হয় নি। এর কারন আছে। ২০০১-২০০৭ পর্যন্ত আমেরিকার রিয়াল এস্টেট বাড়ছিল হুহা করে। ফলে বাড়ির দাম, স্টকের দামের হুহু করে বাড়তে থাকায়, মোদ্দা কথা পকেট ভারী থাকায়, ভারতীয়রা চাকরি নিয়ে গেলেও কেউ আন্দোলনে নামে নি।। নিজেদের ফূর্তির টাকা এসে গেলে আমেরিকানরা খুশ-কিন্ত না এলেই তারা ভয়ংকর। অর্থনৈতিক মন্দার পরে, আমেরিকার অর্থনীতি স্বাভাবিক হল-কিন্ত যাদের চাকরি গেছিল-অনেকেই চাকরি ফিরে পেল না। জবলেস রিকভারি। এরাই আস্তে আস্তে সংগঠিত হতে থাকে ভারত এবং চীনে আউটসোর্সিং এর বিরুদ্ধে। গ্লোবালাইজেশনের বিরুদ্ধে এই রাগ কাজে লাগিয়ে এলেন ট্রাম্প-ফলে আউটসোর্সিং এর পক্ষে যেতে ভয় পাচ্ছেন আমেরিকান সিইওরা।
- দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফসাইকল। যেকোন ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিস যখন মার্কেটে আসে-প্রথমে প্রচুর স্কোপ থাকে। আস্তে আস্তে সব কিছু স্টান্ডার্ডাইজ করা হয়। এর ফলে পুরো জিনিসটা একদম ছকে ফেলে প্রোডাক্ট-অটোমেশন করা সম্ভব। যে কাজের জন্য ২০০৫ সালে পঞ্চাশ জন লাগত, এখন লাগে তিন জন। কিন্ত তারপরেও অসুবিধা নেই। নতুন নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাক্ট বা প্রযুক্তি বাজারে আসতেই থাকে। নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের সেই নতুন প্রযুক্তিতেই সংস্থান হয়।
- তৃতীয় সমস্যাটা এই নতুন প্রযুক্তি থেকেই উদ্ভুত। ২০১২ সালের মধ্যে বলতে গেলে আমেরিকা এমন কি ভারতেও সব বিজনেসে কোন না কোন আই টি প্ল্যাটফর্ম আছে। সেসব চালাতে বেশী লোক লাগে না। মার্কেটের নতুন দাবী হচ্ছে এই যে এত ডেটা আসছে সেটা কাজে লাগিয়ে বিজনেসটা বাড়াও। মানে সেলস বাড়ানোর জন্য তথ্য বিশ্লেষন কর। সাপ্লাইচেইন ভাল করার জন্য ডেটা সায়েন্স। ইত্যাদি। সেখানেই এখন প্রজেক্ট বেশী। মুশকিল হচ্ছে, ভারতের অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার এই ধরনের কাজের জন্য তৈরী না। কারন এরা অঙ্ক, কম্পুটার সায়েন্সের গভীর ফান্ডামেন্টাল এবং পরিসংখ্যানবিদ্যা বা স্টাটিসস্টিক্স শেখে না ভাল করে কলেজে। ফলে তাদেরকে এই কাজের জন্য রিস্কিলিং করা দুঃসাধ্য। সেটাই মূল সমস্যা এখন।
-চতুর্থ সমস্যার উৎ্পত্তি তৃতীয় সমস্যা থেকেই। ভারতে শিক্ষার মান নিম্নগামী। এর কারন শিক্ষার বেসরকারিকরন। আমেরিকাতে যেখানে অধিকাংশ ছাত্ররা সরকারি স্কুলে যায়, ভারতে মেট্রোশহরগুলোতে সব প্রাইভেট স্কুল। সেখানে না আছে ভাল টিচার-না হয় পড়াশোনা। শুধু মার্কস ওঠে। আর এই যে এনালাইটিক্যাল কাজের বিরাট মার্কেট তৈরী হয়েছে, সেখানে চিন্তাশীল ছাত্রছাড়া জাস্ট গাঁতানো লোকজন দিয়ে কিস্যু হবে না। কারন প্রতিটা পরিস্থিতি আলাদা। ্পরিস্থিতি বুঝে সমাধান করার অভ্যেস ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের একদম নেই।
মোদ্দা কথা ইঞ্জিনিয়ারিং এমন একটা পেশা যেখানে আজ একটা প্রযুক্তি, কাল অন্য প্রযুক্তি আসবে। এবং নতুন প্রযুক্তিতেই নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের সংস্থান হবে। এটাই নিয়ম। কিন্ত সেখানে অসুবিধা হচ্ছে কারন এখন এই নতুন প্রযুক্তি বোঝার মতন যে ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার, সেটা অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের নেই।
- আর শেষ সমস্যাটা ম্যানেজারদের নিয়ে। ভারতের সমাজে বর্ণবাদের প্রভাব খুব গভীরে। ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজাররা ছড়ি ঘোরাতে ভালবাসে, নিজেরা একবার ম্যানেজার হয়ে গেলে নিজেদের ব্রাহ্মন আর অধীনস্থদের শুদ্রভাবে। ফলটা এই যে-নিজেরা প্রযুক্তি শেখা ছেড়ে দেয়। যার জন্য ভারতের মিডল ম্যানেজারদের একবার চাকরি গেল , নতুন করে তাদের চাকরি পাওয়া মুশকিল। কারন তারা ইঞ্জিনিয়ারিং সব ভুলে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে ওটা নৈবচ।
(৩) তাহলে উপায় ?
যারা ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসাবে নিতে চাইছে, তাদের প্রথম কর্তব্য এটা বোঝা, শিক্ষাব্যবস্থা, নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং চাহিদার জন্য সম্পূর্ন ফেলিওর। সুতরাং প্রস্তুতি এই ভাবে নিতে হবে
- মিডল স্কুল ( সিস্ক সেভেন ) থেকে কোডিং শিখতে হবে
-স্টাটিস্টিক্স, ম্যাথ এবং এলগোরিদম শিখতে হবে ক্লাস ফাইভ থেকেই । খান একাডেমি থেকে অনেক সংস্থাএখন ফ্রিতে কোডিং এবং এলগোর কোর্স দিচ্ছে।
-সাথে সাথে কম্পুটারাইজড ডিজাইনের -যেমন এডব ফটোশট ইত্যাদি শেখা ভাল।
- ক্লাস এইট নাইন থেকে ছোট ছোট আই টি কোম্পানী গুলির সাথে যুক্ত হয়ে পা্ট টাইম
ইনটার্নশিপ শুরু করা ভাল।
-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকলে, সেখানে যে সাবজেক্টটাই নাও, সেটা ভাল করে শেখা উচিত। আগে দরকার ছিল না। এখন আছে। স্টাট, ম্যাথ, কম্পুটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স, ফিজিক্স-এই সাবজেক্ট গুলো যারা নেবে এবং "শিখবে" -তাদের এডভ্যান্টেজ।
বর্তমানে যেভাবে ছেলেমেয়েরা আট নটা টিউশুনি করতে দৌড়াচ্ছে মার্কস তোলার আশায়-তারা এইসব কি করবে জানি না। তবে না করলে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিছিয়ে যাবে। কারন তারা যখন মার্কেটে আসবে, প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে।
(৪)
ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে সংকট নেই। গোটা পৃথিবী চলছে প্রযুক্তির চাকায়। প্রচুর টাকা এখন ইঞ্জিনিয়ারিং এ। আমেরিকা সহ পৃথিবীর সব থেকে লাভ করা প্রথম পাঁচটা কোম্পানীর জন্ম হয়েছে গত কুড়ি বছরে ( আমাজন, গুগল, আপেল, নেটফ্লীক্স, ফেসবুক)। সুতরাং ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে মাইনে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে এবং বাড়বে। স্টার্টাপ করে ধনী হওয়ার সুযোগ ও বেশী। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ঢোকানো, শিল্পের কদর এখানে সম্ভব। পেশা হিসাবে নতুন যুগের ইঞ্জিনিয়ারিং আগের যুগের থেকে অনেক বেশী চিত্তাকর্ষক, উদ্ভাবনমুখী এবং বৈভবশালী।
সংকট এবং সমস্যা একটাই-এত দুর্বল শিক্ষা নিয়ে এই পেশাতে আসলে। নতুন যুগের ইঞ্জিনিয়ারিং এ কিস্যু হবে না। চাকরিই পাবে না। কেউ নেবে না।
দুদিন আগেও রাম শ্যাম যদু মধু-সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং এ চাকরি পেত। কারন যেটুকু শিখতে হত, তা একজন ক্লার্ককেও শিখতে হয় না । সেসব কাজ এখন অটোমেটেড। হয়ে গেছে বা হবে। সুতরাং দরকার সৃজনশীল ইঞ্জিনিয়ারদের। আর সেটা আটটা টিউশনি পড়ে হবে না। সৃজনশীলতাও চর্চা করতে হয়।
ভারতের আই টি শিল্পে কর্মী ছাঁটাই অব্যহত। এখন যা হচ্ছে, তা হিমশৈলের ভাসমান অংশমাত্র। আমেরিকাতে আমার যেসব বন্ধু সার্ভিস সেলসে আছেন-তাদের অনেকের কাছ থেকেই শুনছি ট্রাম্প জমানা আসাতে অনেক ডিল হয় বাতিল, না হলে পেছোচ্ছে-নইলে কাজ পাচ্ছে স্থানীয় আমেরিকান কোম্পানী। সেলস পাইপলাইন শুকানোর দিকে। এখনো বড়সর কিছু লে-অফ হবে না। কিন্ত আস্তে আস্তে আই টি ইঞ্জিনিয়ারদের ওপরে অটোমেশন এবং ট্রাম্পের গিলোটিন ঝপাৎ করে নামার অপেক্ষায়।
ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাটার ভবিষ্যতই প্রশ্নের মুখে। অনেক বাবা মা যাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছেন তারাও আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আবার যাদের ছেলেমেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তাদের কপালেও চিন্তার খাঁজ। টিসিএস, ইনফি এরা ক্যাম্পাসিংএ না এলে, ফ্রেশার না নিলে কি ছেলেটার ভবিষ্যত কি? যারা এই পেশাতে আছে, তারাও আমাকে ইনবক্স করছেন। ফলে বহুদিন থেকেই ভাবছিলাম এই ব্লগটা লিখব। বিশেষত আমরা যখন উচ্চমাধ্যমিকে, ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা নিয়ে স্বচ্ছ ধারনা ছিল না কারুর। এখনো অবস্থার পরিবর্তন হয় নি। সব থেকে বড় কথা, এখন যে কাজগুলো করে আমরা খাচ্ছি, সেইসব পেশার অস্তিত্বই ছিল না তখন। ইঞ্জিনিয়ারিং এ এটাই সব থেকে বড় কথা। প্রযুক্তির গতি এখন তীব্র। প্রতি দুই তিন বছরে বদলে যাচ্ছে টেকনোলজি প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন ধরতে লেট করলেই ভোকাট্টা ঘুরির মতন মার্কেট থেকে আছড়ে মাটিতে।
তবে এর মধ্যেও শান্তনা এটা যে ভাল ইঞ্জিনিয়ারের অভাব এখনো সুতীব্র। ভারতে প্রতি কুড়িটা ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে একজন পাতে দেওয়ার যোগ্য। একশো জনে একজন পাওয়া যায়, যাকে আন্তর্জাতিক মানে ডিস্টিংশন দেওয়া যায়। ফলে যারা খুব খেটে প্যাশনেটলি কোডিং শিখছে, নিজের সাবজেক্ট শিখছে, নানান প্রোডাক্ট ডিজাইনে অংশ নিচ্ছে-তাদের কোন চিন্তা নেই। কিন্ত যারা বিটেকের চারটে বছর গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে আগে ক্যাম্পাস নামিয়ে দিত-দুর্দিন তাদের।
(২)
এবারে আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা এবং তার হালচাল নিয়ে কিছু ধারনা করা যাক। প্রযুক্তি মানেই যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ, সুন্দর এবং নিরাপত্তা দেওয়া। এর বাইরে কিছু হয় না। এই পেশাতে সব কিছুই লাগে-বিজ্ঞান, গণিত, আর্টস, ডিজাইন, অর্থনীতি, একাউন্টিং। ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা বলে আলদা কিছু নেই-এটাও ডাক্তারদের মতন অভিজ্ঞতাবাদ বা এম্প্রিরিসিজম। অভিজ্ঞতা লদ্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানো।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার সেই অর্থে কোন গ্ল্যামার ছিল না। পাবলিক সেক্টরে ভাল মাইনের চাকরি পেলেই অনেকেই বর্তে যেত। ১৯৯১ সাল থেকেই চাকা ঘোরে। মনমোহন সিংহের উদারনীতির জমানায় ভারতে ঢোকে একাধিক আমেরিকান কোম্পানী। এর সাথে সাথে আমেরিকাতে শুরু হয় কম্প্যুটার ইন্ড্রাস্ট্রির বুম। ১৯৯৫ সাল থেকে সিলিকন ভ্যালিতে শুরু অসংখ্য ইকর্মাস স্টার্টাপ। এরা এমন সব মাইনে দেওয়া শুরু করল, যা নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভারতে কেউ ভাবতেও পারত না আগে। আমার মনে আছে সেই ১৯৯৩-৯৫ সালে কেডেন্স, সান সিস্টেম এরা আই আই টি ক্যাম্পাসে বছরে সাত লাখ টাকার প্যাকেজ নিয়ে আসে। যা তখন ছিল অকল্পনীয়। কারন আই আই টির সিনিয়ার অধ্যাপকদের বার্ষিক বেতন তখন পাঁচ লাখের নীচে।
এর পরে আমেরিকাতে আই টি শিল্পের চাহিদা যত বেড়েছে-ভারতের আই টি কোম্পানী গুলি ফুলে ফেঁপে উঠেছে । কারন আমেরিকাতে অত আইটি কর্মী ছিল না-এখনো নেই। ১৯৯৩ সাল নাগাদ ক্লিনটন গ্যাট চুক্তি সাইন করেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন গ্লোবালাইজেশনের পক্ষে ছিলেন। ফলে উনার আমলে আই টি কর্মীদের আমেরিকাতে নিয়ে আসা সহজ করতে এইচ ওয়ান বি ভিসা চালু হয়। যার অধিকাংশ পেয়েছে ভারতীয়রা।
১৯৯৫-২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় আই টি শিল্পের স্বর্নযুগ। পৃথিবীর সব দেশেই ভারতীয় আই টি কর্মীদের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। আই টি শিল্পের সাপ্লাই লাইন বজায় রাখতে ভারতে গজিয়ে ওঠে অসংখ্য প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সাথে সাথে বেড়েছে মাহিনাও। বিশেষত যারা অভিজ্ঞ। এন্ট্রি লেভেল মাইনে একই থেকেছে।
আমেরিকাতে ২০০৭-৮ এর অর্থনৈতিক মন্দায় ভারতীয় আই টি প্রথম ধাক্কা খায়। যদিও আমেরিকা প্রচুর ধার করে, অর্থনীতি ফিরিয়ে নিয়ে আসে আগের যায়গায়, আই টি শিল্পের জগন্নাথ রথ পাঁচ টি গাড্ডায় হোঁচট খায়।
-- অর্থনৈতিক মন্দার আগে, আমেরিকাতে শিক্ষিত লোকজন এত ভারতীয় বিদ্বেশী ছিল না। ভারতীয়রা চাকরি নিয়ে যাচ্ছে এটা রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিনত হয় নি। এর কারন আছে। ২০০১-২০০৭ পর্যন্ত আমেরিকার রিয়াল এস্টেট বাড়ছিল হুহা করে। ফলে বাড়ির দাম, স্টকের দামের হুহু করে বাড়তে থাকায়, মোদ্দা কথা পকেট ভারী থাকায়, ভারতীয়রা চাকরি নিয়ে গেলেও কেউ আন্দোলনে নামে নি।। নিজেদের ফূর্তির টাকা এসে গেলে আমেরিকানরা খুশ-কিন্ত না এলেই তারা ভয়ংকর। অর্থনৈতিক মন্দার পরে, আমেরিকার অর্থনীতি স্বাভাবিক হল-কিন্ত যাদের চাকরি গেছিল-অনেকেই চাকরি ফিরে পেল না। জবলেস রিকভারি। এরাই আস্তে আস্তে সংগঠিত হতে থাকে ভারত এবং চীনে আউটসোর্সিং এর বিরুদ্ধে। গ্লোবালাইজেশনের বিরুদ্ধে এই রাগ কাজে লাগিয়ে এলেন ট্রাম্প-ফলে আউটসোর্সিং এর পক্ষে যেতে ভয় পাচ্ছেন আমেরিকান সিইওরা।
- দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফসাইকল। যেকোন ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিস যখন মার্কেটে আসে-প্রথমে প্রচুর স্কোপ থাকে। আস্তে আস্তে সব কিছু স্টান্ডার্ডাইজ করা হয়। এর ফলে পুরো জিনিসটা একদম ছকে ফেলে প্রোডাক্ট-অটোমেশন করা সম্ভব। যে কাজের জন্য ২০০৫ সালে পঞ্চাশ জন লাগত, এখন লাগে তিন জন। কিন্ত তারপরেও অসুবিধা নেই। নতুন নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাক্ট বা প্রযুক্তি বাজারে আসতেই থাকে। নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের সেই নতুন প্রযুক্তিতেই সংস্থান হয়।
- তৃতীয় সমস্যাটা এই নতুন প্রযুক্তি থেকেই উদ্ভুত। ২০১২ সালের মধ্যে বলতে গেলে আমেরিকা এমন কি ভারতেও সব বিজনেসে কোন না কোন আই টি প্ল্যাটফর্ম আছে। সেসব চালাতে বেশী লোক লাগে না। মার্কেটের নতুন দাবী হচ্ছে এই যে এত ডেটা আসছে সেটা কাজে লাগিয়ে বিজনেসটা বাড়াও। মানে সেলস বাড়ানোর জন্য তথ্য বিশ্লেষন কর। সাপ্লাইচেইন ভাল করার জন্য ডেটা সায়েন্স। ইত্যাদি। সেখানেই এখন প্রজেক্ট বেশী। মুশকিল হচ্ছে, ভারতের অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার এই ধরনের কাজের জন্য তৈরী না। কারন এরা অঙ্ক, কম্পুটার সায়েন্সের গভীর ফান্ডামেন্টাল এবং পরিসংখ্যানবিদ্যা বা স্টাটিসস্টিক্স শেখে না ভাল করে কলেজে। ফলে তাদেরকে এই কাজের জন্য রিস্কিলিং করা দুঃসাধ্য। সেটাই মূল সমস্যা এখন।
-চতুর্থ সমস্যার উৎ্পত্তি তৃতীয় সমস্যা থেকেই। ভারতে শিক্ষার মান নিম্নগামী। এর কারন শিক্ষার বেসরকারিকরন। আমেরিকাতে যেখানে অধিকাংশ ছাত্ররা সরকারি স্কুলে যায়, ভারতে মেট্রোশহরগুলোতে সব প্রাইভেট স্কুল। সেখানে না আছে ভাল টিচার-না হয় পড়াশোনা। শুধু মার্কস ওঠে। আর এই যে এনালাইটিক্যাল কাজের বিরাট মার্কেট তৈরী হয়েছে, সেখানে চিন্তাশীল ছাত্রছাড়া জাস্ট গাঁতানো লোকজন দিয়ে কিস্যু হবে না। কারন প্রতিটা পরিস্থিতি আলাদা। ্পরিস্থিতি বুঝে সমাধান করার অভ্যেস ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের একদম নেই।
মোদ্দা কথা ইঞ্জিনিয়ারিং এমন একটা পেশা যেখানে আজ একটা প্রযুক্তি, কাল অন্য প্রযুক্তি আসবে। এবং নতুন প্রযুক্তিতেই নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের সংস্থান হবে। এটাই নিয়ম। কিন্ত সেখানে অসুবিধা হচ্ছে কারন এখন এই নতুন প্রযুক্তি বোঝার মতন যে ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার, সেটা অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের নেই।
- আর শেষ সমস্যাটা ম্যানেজারদের নিয়ে। ভারতের সমাজে বর্ণবাদের প্রভাব খুব গভীরে। ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজাররা ছড়ি ঘোরাতে ভালবাসে, নিজেরা একবার ম্যানেজার হয়ে গেলে নিজেদের ব্রাহ্মন আর অধীনস্থদের শুদ্রভাবে। ফলটা এই যে-নিজেরা প্রযুক্তি শেখা ছেড়ে দেয়। যার জন্য ভারতের মিডল ম্যানেজারদের একবার চাকরি গেল , নতুন করে তাদের চাকরি পাওয়া মুশকিল। কারন তারা ইঞ্জিনিয়ারিং সব ভুলে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে ওটা নৈবচ।
(৩) তাহলে উপায় ?
যারা ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসাবে নিতে চাইছে, তাদের প্রথম কর্তব্য এটা বোঝা, শিক্ষাব্যবস্থা, নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং চাহিদার জন্য সম্পূর্ন ফেলিওর। সুতরাং প্রস্তুতি এই ভাবে নিতে হবে
- মিডল স্কুল ( সিস্ক সেভেন ) থেকে কোডিং শিখতে হবে
-স্টাটিস্টিক্স, ম্যাথ এবং এলগোরিদম শিখতে হবে ক্লাস ফাইভ থেকেই । খান একাডেমি থেকে অনেক সংস্থাএখন ফ্রিতে কোডিং এবং এলগোর কোর্স দিচ্ছে।
-সাথে সাথে কম্পুটারাইজড ডিজাইনের -যেমন এডব ফটোশট ইত্যাদি শেখা ভাল।
- ক্লাস এইট নাইন থেকে ছোট ছোট আই টি কোম্পানী গুলির সাথে যুক্ত হয়ে পা্ট টাইম
ইনটার্নশিপ শুরু করা ভাল।
-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকলে, সেখানে যে সাবজেক্টটাই নাও, সেটা ভাল করে শেখা উচিত। আগে দরকার ছিল না। এখন আছে। স্টাট, ম্যাথ, কম্পুটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স, ফিজিক্স-এই সাবজেক্ট গুলো যারা নেবে এবং "শিখবে" -তাদের এডভ্যান্টেজ।
বর্তমানে যেভাবে ছেলেমেয়েরা আট নটা টিউশুনি করতে দৌড়াচ্ছে মার্কস তোলার আশায়-তারা এইসব কি করবে জানি না। তবে না করলে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিছিয়ে যাবে। কারন তারা যখন মার্কেটে আসবে, প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে।
(৪)
ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে সংকট নেই। গোটা পৃথিবী চলছে প্রযুক্তির চাকায়। প্রচুর টাকা এখন ইঞ্জিনিয়ারিং এ। আমেরিকা সহ পৃথিবীর সব থেকে লাভ করা প্রথম পাঁচটা কোম্পানীর জন্ম হয়েছে গত কুড়ি বছরে ( আমাজন, গুগল, আপেল, নেটফ্লীক্স, ফেসবুক)। সুতরাং ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে মাইনে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে এবং বাড়বে। স্টার্টাপ করে ধনী হওয়ার সুযোগ ও বেশী। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ঢোকানো, শিল্পের কদর এখানে সম্ভব। পেশা হিসাবে নতুন যুগের ইঞ্জিনিয়ারিং আগের যুগের থেকে অনেক বেশী চিত্তাকর্ষক, উদ্ভাবনমুখী এবং বৈভবশালী।
সংকট এবং সমস্যা একটাই-এত দুর্বল শিক্ষা নিয়ে এই পেশাতে আসলে। নতুন যুগের ইঞ্জিনিয়ারিং এ কিস্যু হবে না। চাকরিই পাবে না। কেউ নেবে না।
দুদিন আগেও রাম শ্যাম যদু মধু-সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং এ চাকরি পেত। কারন যেটুকু শিখতে হত, তা একজন ক্লার্ককেও শিখতে হয় না । সেসব কাজ এখন অটোমেটেড। হয়ে গেছে বা হবে। সুতরাং দরকার সৃজনশীল ইঞ্জিনিয়ারদের। আর সেটা আটটা টিউশনি পড়ে হবে না। সৃজনশীলতাও চর্চা করতে হয়।
No comments:
Post a Comment