Sunday, July 30, 2017

কোলকাতায় তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের ভবিষ্যৎ

(১)  অতীত

     ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ইতিহাসের  দুটি অধ্যায়।

  ১৯৮৬ সালের আগে এবং পরে। ১৯৮৬ সাল ভারতীয় আই টির ল্যান্ডমার্ক ইয়ার। ওই বছর রাজীব গান্ধীর সরকার পারসোনাল কম্পিউটার এবং সফটোয়ার আমদানির ওপর শুল্ক প্রায় তুলে দিলেন। উদ্দেশ্য ভারতের এক নবীনতম শিল্প সম্ভাবনা যেন অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়।

১৯৮১-৮৫ । আমেরিকাতে পারসোনাল কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রি বুম সবে শুরু হয়েছে।  আই বি এম 5150 এপেলের ম্যাকিণ্টোশ সবে বাজারে কা্টে বছরে চার পাঁচ লাখ। এছারাও অসংখ্য ছোটখাট সফটোয়ার কোম্পানী আই বি এম কম্প্যাটিবল বিজনেস এবং গেমিং সফটোয়ার লিখছে। ১৯৮৪ সালের মধ্যেই আমেরিকাতে বড় ব্যবসাগুলি আস্তে আস্তে আই বি এম মেইন ফ্রেইম এবং ছোট ব্যবসা আই বি এম 5150 নির্ভর হয়ে ওঠে।  এদের সফটোয়ার তৈরী বা মেইন্টেনান্সের জন্য, ভারতের কিছু কিছু কোম্পানী ভারত থেকেই সাপোর্ট দেওয়া শুরু করেছে। না তখনো ইন্টারনেট আসে নি। এই বিপুল সম্ভাবনা যাতে অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়, তার জন্য স্যাম পিদ্রোদার অনুরোধে রাজীব গান্ধী এই শিল্পের ওপরে ইম্পোর্ট ডিউটি কমিয়ে দিলেন।

১৯৮৬ সালের আগে ভারতের তথ্য প্রযুক্তির ছবিটি আলাদা। তখনো নেহেরু অর্থনীতির রূপরেখায় চলেছে ভারতের আদিম আই টি প্রযুক্তি। অর্থাৎ তার আগে পর্যন্ত প্রচেষ্টা  কিভাবে পাবলিক সেক্টর কোম্পানী খুলে ভারতকে ইলেক্ট্রনিক্স এবং কম্পিঊটার শিল্পে এগিয়ে রাখা যায়। এই সূত্র ধরে ১৯৭১ সালে ডিপার্ট্মেন্ট অব ইলেকট্রনিক্সের জন্ম।  ইসিয়াইল  বলে একটি পাবলিক সেক্টর কোম্পানী খোলে ভারত সরকার (১৯৭৮)-যারা  TDC 312 /316  নামে দুটি প্রাগৈতিহাসিক কম্পিউটার ও বানায় সেকালে।  ১৯৭৮ সালে ভারত থেকে আই বি এমকে তাড়ায় তৎকালীন জনতা সরকার।  তখন ও পর্যন্ত প্রচেষ্টা সেইল বা ভেইল যেভাবে পাবলিক সেক্টর কোম্পানীর মাধ্যমে, ভারতে স্টিল এবং ভারী ইলেক্ট্রিকাল শিল্প স্থাপন করেছে, সেই ট্রাকেই চলবে ভারতের আই টির ট্রেইন।

 কিন্ত রাজীব গান্ধীর উপদেষ্টা স্যাম পিদ্রোদা, দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকার সুবাদে বুঝেছিলেন আমেরিকাতে যে পি সি বুম হচ্ছে, তার থেকে এক বিশাল আউটসোর্সিং সম্ভাবনা বিদ্যমান। ফলে কম্পিউটার এবং সফটোয়ারের ওপর যাবতীয় ইম্পোর্ট ডিউটি তুলে দিলেন রাজীব গান্ধী। কারন ইসিয়াইএলের কম্পিউটার এবং সফটোয়ারে ভারতীয়রা শিক্ষিত হলে-বিদেশী মার্কেট ধরা যাবে না । বিদেশী মার্কেট ধরতে শিখতে হবে মেইন ফ্রেইম বা আই বি এম 5010.

১৯৮৬-৮৮ সাল থেকেই ভারতীয় সংস্থাগুলি হিসাব পত্র, লেখা, নথিভুক্তিকরন ইত্যাদি কাজের জন্য আস্তে আস্তে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু করে। ভারতীয় রেইল, এল আই সি এতে অগ্রনী হয়।  ফলে কোলকাতার কিছু কিছু অফিসে কেরানীবাবুদের চাকরি হারানোর পরিস্থিতি তৈরী হয়। এমন অবস্থায়, জ্যোতিবসুর সরকার জানালেন, তারা কম্পিউটারাইজেশনের বিরোধিতা করবে। মানুষের চাকরি আগে!

  ১৯৮৬ সালে যখন আই টি শিল্প সবে উঠছে, জ্যোতি বসুর সিদ্ধান্ত পশ্চিম বঙ্গের আই টি শিল্পের সম্ভবনা অঙ্কুরে ধ্বংশ করে।  পরবর্তীকালে ২০০৪ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন-বামেরা ঐ সময় কম্পিঊটার শিল্পের বিরোধিতা করে নির্বোধের মতন কাজ করেছে। পশ্চিম বঙ্গের আই টি শিল্পের সম্ভাবনায় কুড়ুল মেরেছে। এ স্বীকারক্তি স্বয়ং বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রীর ("That was in the 1970s...that was foolish, foolish. It started when they were going to introduce computers in banks and (insurance companies). Their employees protested and we supported it. But how can you stop modern technology? Nowadays, they have understood...We have entered a century where industries will be talent-based)

 বুদ্ধদেব বাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মাত্র কিছুটা খেলা ঘোরানোর চেষ্টা করেন। তার আমলেই এল সেক্টর ফাইভ, রাজার হাট।  তবে তখন ব্যাঙ্গালোর খরগোশ, কলকাতা কচ্ছপ। যদিও সময়টা বুদ্ধদেবের পক্ষেই ছিল। ১৯৯৮ সালে ভারতের আই টি এক্সপোর্ট দুই বিলিয়ান ডলার, ২০১০ সালে হল ৫০ বিলিয়ান। এই পর্বে ভারতের আই টি শিল্প বেড়েছে দুর্দান্ত গতিতে। বুদ্ধদেবের নেতৃত্বে পশ্চিম বঙ্গ আস্তে আস্তে হলেও এগোচ্ছিল ।

২০০৭ সালে গোটা ভারতের আই টি এক্সপোর্ট ছিল ৩৫ বিলিয়ান, পশ্চিম বঙ্গের এক্সপোর্ট সেখানে মোটে ৭০০ মিলিয়ান। ২%।

 ২০১৭ সালের চিত্রটি বদলায় নি। বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গ থেকে সফটোয়ার এক্সপোর্ট আড়াই বিলিয়ান ডলারের, ভারতের এক্সপোর্ট ১৫০ বিলিয়ান ডলার। সেই ২% এই আটকে আছে পশ্চিম বঙ্গ। জন সংখ্যার নিরিখে, পশ্চিম বঙ্গ ভারতের জন সংখ্যার প্রায় ৮%।  সেই হিসাবে আই টি এক্সপোর্টে পশ্চিম বঙ্গের হিস্যা হওয়া উচিত ৮-১০%। কিন্ত তা ২%।  অর্থাৎ আই টি শিল্প পশ্চিম বঙ্গে যা হওয়া উচিত বর্তমানে তার অস্তিত্ব মোটে ১/৫ ভাগ।


(২)  বর্তমান ঃ

 তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের বেস কি? দক্ষ কর্মী। অথবা শিক্ষিত মেধাবী ছাত্র, যাদের দক্ষ কর্মীতে পরিণত করা সম্ভব। এর সাথে লাগে ভাল ইন্টারনেট কানেকশন, একটু ভাল অফিস।  এই শিল্পে কর্মীদের গড় বয়স ২৫-৩৫। অধিকাংশ আই টি কর্মীকে যেহেতু দীর্ঘ সময় অফিসে কাটাতে হয়-অফিসের পাশাপাশি ভাল রেস্টুরেন্ট, জিমনাসিয়াম, বিনোদনের হরেক জায়গা থাকা আবশ্যক।  তাছাড়া ৯৫%+ ক্লায়েন্ট বিদেশী। সুতরাং কর্মীদের ইংরেজি শিক্ষার মান অতি উত্তম হওয়া দরকার। সাথে সাথে ধর্মঘট হওয়া চলবে না-কারন বিদেশী ক্লায়েন্টদের কাছে ধর্মঘট কেন হচ্ছে তা ব্যখ্যা করা সম্ভব না।

   এবার আস্তে আস্তে দেখা যাক কলকাতার অবস্থা। অভিজ্ঞ কর্মী কলকাতায় কম। কিছু কিছু ক্রিটিক্যাল স্কিল যেমন ওয়েব সার্ভিস, বিগ ডেটা বা ক্লাউড ম্যানেজমেন্টের লোক কলকাতায় মুষ্টিমেয়।  কারন যারা অভিজ্ঞ বা মেধাবী, অনেক বেশী মাইনের চাকরির দিয়ে তাদের টেনে নিয়েছে ব্যাঙ্গালোর হাইদ্রবাদ, পুনে। অভিজ্ঞ ম্যানেজারের ও অকাল একই কারনে। আর একবার কেউ ব্যাঙ্গালোর বা পুনেতে চলে গেলে কলকাতায় ফিরতে চায় না-কারন এখানে যেহেতু ভাল শিল্প নেই, চাকরি চলে গেলে অন্য একটা চাকরি পাওয়া কঠিন। যদিও সবাই স্বীকার করে বর্তমানে কলকাতায় নাগরিক সুবিধা ব্যাঙ্গালোর এবং পুনের থেকে অনেক ভাল।  এই দুটো শহরেই জলের সংকট তীব্র, ট্রাফিক জ্যামে ত্রাহি অবস্থা। তার থেকে কোলকাতার অবস্থা অনেকটাই উন্নত। কিন্ত তবুও কলকাতায় ফিরতে চাইছে এমন বাঙালী আই টি কর্মীর সংখ্যা কম। জীবিকা বড় দায়।

    অভিজ্ঞ কর্মী এবং ম্যানেজারের অভাবে কোলকাতায় স্বয়ংসম্পূর্ন  বড় আই টি অপারেশন চালানো কঠিন। স্যাটেলাইট অফিস বসালে কিন্ত লাভ আছে। কারন এখানে আই টি কর্মীদের মাইনা তুলনামূলক ভাবে প্রায় ৫০% কম। যেহেতু ব্যাঙ্গালোর বা পুনের তুলনায় কোলকাতায় ঘর ভাড়া, খাওয়া, বাস ভাড়া এখনো সস্তা। সেক্টর ফাইভে ফুটপাতের ঝুপড়িগুলো যেদামে খাবার দেয় এখনো, ব্যাঙ্গালোরে ওসব সম্ভব না।

  তবে সুবিধা এই যে এই শহরের ইন্টেলেকচুয়াল বেস এখনো স্ট্রং। ইংরেজি শিক্ষার হাল ভারতের অন্যান্য শহরের থেকে এখনো ভাল।  বড় নামি এম এন সি নেই। ফলে দক্ষ কর্মীদের তুলনামূলক ভাবে ঠিক ঠাক মাইনে বা সুযোগ সুবিধা দিলে রেখে দেওয়া সম্ভব।

ব্যাঙ্গালোর এবং পুনেতে অন্যান্য শহর থেকে আসা ভ্যাগান্বেশী ছোকরাদের ভীর। এরা এসেছে টাকার টানে।  এর ভাল খারাপ দুটো দিকই দেখি। এইসব ছেলেমেয়েগুলো অনেক বেশী চৌকস, প্রচুর স্কিল শেখে আরো মাইনের চাকরির আশায়।  তুখোর প্রফেশনাল। কিন্ত কোম্পানীর প্রতি লইয়ালিটি কম। ছমাস থেকে এক বছরের মধ্যে বেশী মাইনে নিয়ে অন্য কোম্পানীতে লাফ দেবে।

তুলনায় কলকাতার আই টি শিল্পের কর্মীরা অতটা দক্ষ বা প্রফেশনাল না। এবং অতটা লোভীও না। ফলে সাধারনত এরা একটা কোম্পানীতে অনেকদিন টেকে। যেটা কোম্পানীর জন্য ভাল।
তৃনমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বন্ধ বন্ধ খেলাটি কলকাতায় বন্ধ। কলকাতায় ব্যবসা স্থাপনের জন্য এটা ছিল সব থেকে বড় শর্ত। স্ট্রাইক বন্ধ করতে হবে। দিদি সেটা সাফল্যের সাথে করেছেন।  বন্ধ নামক ওই বামপন্থী ছেলেখেলাটি বন্ধ না হলে, আমি প্রথমেই লিখে দিতাম ভবিষ্যত শুন্য। কিন্ত এখন কলকাতায় রাজনৈতিক সমস্যার কারনে বন্ধ বা লেবার স্ট্রাইক সব থেকে কম। সুতরাং শিল্প স্থাপনের নুন্যতম শর্তটি কলকাতায় এখন বিদ্যমান।

(৩) ভবিষ্যত ঃ

প্রশ্ন হচ্ছে ভবিষ্যত কি?
     ভবিষ্যতে আই টি ঝুঁকছে এন্যালাইটিক, এম্বেডেড সিস্টেম, আই ও টি,মোবাইল ওয়েব সার্ভিসের দিকে।  এর মধ্যে ওয়েব সার্ভিস/ বিগ ডেটা বাদ দিয়ে, বাকী স্কিলগুলি কলকাতায় বিরল না। একটা বেস আছে।  তবে বিগ ডেটা এখন ফ্যাক্টর না- মাইক্রোসফট এজিওর বা আমাজন ওয়েব সার্ভিস এখন এত সুন্দর-বিগ ডেটা কিছু না জেনেও সম্পূর্ন ভাবে মাইক্রোসার্ভিস দিয়ে ওয়েব সার্ভিস আরো ভাল ভাবে দেওয়া সম্ভব। ফলে বিগ ডেটা স্কিলের অভাবে আগে যেসব কাজ কলকাতায় করা সম্ভব ছিল না-বর্তমানে মাইক্রোসফট বা আমাজন বা আই বি এম প্ল্যাটফর্মের দৌলতে সেসব কাজ করা কঠিন না। এবং কোলকাতায় অনেক ছোট ছোট কোম্পানী সেই কাজ ধরছেও।

 কিন্ত অসুবিধা অন্যত্র।

 প্রথমত কলকাতায় প্রযুক্তির ইকোসিস্টেমটাই খুব দুর্বল। ইকোসিস্টেম মানে কাস্টমার থেকে ডেলিভারি ফ্লো। ছোট এবং মাঝারি কোম্পানীগুলোর একটা বা দুটো ভাল ক্লায়েন্ট, তাই দিয়ে চলে। এদের ক্যাপিটাল এত কম, না ইনভেস্ট করতে পারে মার্কেটিং সেলসে, না ডেলিভারি টিম বাড়াতে। না নতুন কোন প্রোডাক্টে ইনভেস্ট করতে।

 দ্বিতীয়ত বড় কোম্পানীগুলোও অটোমেশন এবং ট্রাম্পের ধাক্কা সামলাতে চোরাগোপ্তা ছাঁটাই করছে। সেখানে সামনে কোন গ্রোথ নেই। গ্রোথ সম্ভব ছোট ছোট এইসব মোবাইল বা আনালাইটিক শপ গুলোতে।  স্মল এবং মিডিয়াম স্কেল বিজনেসে। কিন্ত এই ধরনের ছোট ব্যবসা গুলোর সমস্যা এই, এখানে পাঁচ হাজার জনের কর্ম সংস্থান হতেও দুশোর বেশি ব্যবসা দরকার। 

সেক্টর ফাইভে মেরে কেটে পঞ্চাশের মতন সংস্থা আছে, যারা উচ্চপ্রযুক্তির সাথে জড়িত।  এগুলির স্থপতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রবাসী বাঙালী প্রযুক্তিবিদরা। খুব ভাল, উচ্চমেধার কোম্পানী এগুলি। এদের মধ্যে আছে- সম্রাট গাঙ্গুলীর জাংশন টিভি ( টিভি স্ট্রিমিং প্রযুক্তি), অনি সীলের ডেটা বাজার ( যা বিদেশে ইকমার্স প্রযুক্তি দেয়), রেবেকা সফটোয়ার ( যারা ভিডিও প্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করে)    । এরকম আরো আছে অনেকে। এদের সমস্যা এগুলি খুব নিশ এরিয়া, যতই চান না কেন তারা জনা পঞ্চাশের বেশী কর্মীর সংস্থান করতে পারবেন না।

বাকী অধিকাংশ ছোট সংস্থাগুলি, যাদের মালিকানাও স্থানীয়- মোবাইল, ওয়েব ডিজাইন, এস ই ও-এইসব করেই চালাচ্ছে। এখানে ভাল মাইনের সংস্থান সম্ভব না।  ফলে ছোট ছোট উচ্চ প্রযুক্তির সংস্থা যে সংখ্যায় হলে, বড় কোম্পানীগুলির ছাঁটাইকে অফসেট করবে-সেই সংখ্যা অনুপস্থিত।

 তৃতীয় সমস্যা স্টার্টাপ সিস্টেমের অভাব। এটা সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের। এখানে আই আই টি খরগপুর, যাদবপুর, শিবপুরের মতন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, মারোয়ারীদের ক্যাপিটাল আছে-কিন্ত দুই দুই চারের যোগ হচ্ছে না। দুটো কারন।
(১) ভারতের সর্বত্রই বাড়ি জমির দাম যেভাবে হু হু করে বারে, হাতে বর্ধিত পুঁজি থাকলে, সবাই তা জমিতেই পুঁতে দেয়।  ভারতে জমির দাম যা হওয়া উচিত মার্কেট ভ্যালু তার দশগুন। বাড়ি ভাড়া একটা এসেট ইনকামের বেস ধরলে,  বাড়ি/ ফ্ল্যাটের দাম অন্তত পাঁচগুন বেশী। এই উর্ধগতির কারনে মাড়োয়ারী বিজনেস ক্লাসের ক্যাপিটাল নতুন প্রযুক্তি ত দূরের কথা, তারা নিজেদের ফ্যাক্টরি ইনোভেশনেও টাকা ঢালে না। সব বাড়ী, জমিতে ঢেলেছে। গত তিন বছরে কলকাতার রিয়াল এস্টেটের দাম কমছে। ডিমনেটাইজেশন, জি এস টির ফলে এখন কোলকাতার রিয়াল এস্টেট মার্কেট শুয়ে যাওয়ার যোগাড়। ফলে আশা করা যায় এখন আস্তে আস্তে কোলকাতার মারোয়াড়ীরা প্রযুক্তি ব্যবসায় আরো বেশী আসবেন।

আমেরিকাতে বাড়ি জমির থেকে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, অনেক বেশী হট পপার্টি। ভারতে ইন্টেলেকচুয়াল পপার্টি এখনো নগন্য। সুতরাং নতুন প্রযুক্তির ব্যবসায় লোকে তবেই টাকা ঢালবে যখন জমি-বাড়ির দাম সম্পূর্ন ক্র্যাশ করবে।

জমি বাড়ি থেকে বিজনেস ক্যাপিটালের আউটফ্লো, প্রযুক্তি ব্যবসার উন্নতির অন্যতম প্রথম শর্ত। সেটা আস্তে আস্তে হচ্ছে-বিশেষত এই ডিমনেটাইজেশনের পরে।

  (২) আই আই টি খরগপুর সহ ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিক্সের সর্বত্র এক সমস্যা। ল্যাবেরটরি থেকে প্রোডাক্টকে মার্কেটে আনার ট্রাক রেকর্ড খুব দুর্বল।  আই আই টি খরগপুর সব সময় পেপার পাবলিকেশন বা ডিফেন্স কনসাল্টিং ইত্যাদিতে যা জোর দেয়। কোন ইঞ্জিনিয়ারিং উদ্ভাবনকে মার্কেটে আনার ব্যপারে সাপোর্ট সিস্টেম খুব দুর্বল। প্রায় নেই। শিবরাত্রের সলতে স্টেপ বলে একটি আন্তারপ্রেনার সেল, যা ক্যাম্পাসের বাইরে স্টেপ চাইল্ডের মতন অবহেলিত। সেই ১৯৯৫ সালে আই আই টিতে স্টেপ বা টেকনোয়ান্তারপ্রেনার পার্ক তৈরী হয়েছে, কিন্ত এই দীর্ঘ ২২ বছরে, ওখান থেকে আই আই টি উদ্ভাবিত কোন প্রযুক্তি মার্কেটে গেছে কি না সন্দেহ। প্রায় প্রতি মাসেই দেখি আই আই টি খরগপুরে কোন না কোন ভাল কাজ, খবরে আসে।  কিন্ত সব হারিয়ে যায়-কোন উদ্ভাবনই মার্কেটে আসে না। কারন কিভাবে একটা গবেষনালদ্ধ প্রোডাক্ট মার্কেটে আনা যেতে পারে, সেই ব্যপারে আই আই টিতে অধ্যাপকদের কোন ধারনা নেই। কোন পেশাদা্রি ওর্গানাইজেশন ও নেই যে এব্যপারে ওদের সাহায্য করবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরাও সেই উদ্যোগের সাথে যুক্ত না।

সিলিকন ভ্যালি স্টাটাপ সিস্টেম গড়ে উঠেছে, স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। বোস্টন স্টার্টাপ সিস্টেম এম আই টিকে কেন্দ্র করে। এম আই টির ছাত্র গবেষকদের জন্য ভিসি ফান্ডিং প্রায় দুই বিলিয়ান ডলারের। সেখানে আই আই টি খরগপুরে কিছু ব্যতিক্রমি ছাত্রছাত্রীরা যদিও বা স্টার্টাপ করে, তাদের জন্য পেশাদারি ফান্ডিং প্রায় নেই।  আই আই টি খরগপুরে গবেষনার অপচয় হতেই থাকবে, যদ্দিন না এই স্টার্টাপ ইকোসিস্টেম বানানো সম্ভব।

(৪) তাহলে সামনে উপায় কি?
     
 টানেলের শেষে শুধুই অন্ধকার?

  আমি কিন্ত প্রচুর আলোই দেখছি। শুধু দরকার একটু সরকারি বেসরকারি সদিচ্ছা।
    প্রযুক্তি বা ইঞ্জিনিয়ারিং জাস্ট একটা টুল। এখন এত প্ল্যাটফর্ম এসে গেছে, দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের দরকার অনেক কম। বা অনেক কম সময় এবং কম কর্মী দিয়ে ভাল প্রোডাক্ট বানানো সম্ভব। সুতরাং কলকাতায় আগে  আই টি স্কিলের অভাবের জন্য যে সমস্যা ছিল-সেটা কিন্ত বর্তমানে বাধা হবে না। বরং বর্তমানে দরকার সেই সব ছাত্রছাত্রীদের যাদের কোর ইঞ্জিনিয়ারিং নলেজ গভীর, উদ্ভাবন করতে সক্ষম, আর্টসে ভাল দখল। কলকাতা আর্টস এবং ডিজাইন সেন্সের জন্য এখনো উত্তম। সুতরাং ভবিষ্যত আই টি প্রোডাক্টের বেস কিন্ত এখানে বেশ শক্ত। শুধু ইউটিলাইজেশন খুব দুর্বল-ইকোসিস্টেম নেই।
 কলকাতায় যারা ছোট ছোট ওয়েব, মোবাইল, আনালাইটিক আউটসোর্সিং এর শপ খুলেছেন -হয়ত খুব লো টেক-কিন্ত শুরুটা তাদের সাথেই করতে হবে। শঙ্কু বোসের ফ্রেইন্ডস অব বেঙ্গল উদ্যোগে অনেক প্রবাসী বাঙালীর দেখা পেলাম, যারা কলকাতাকে বেস করতে চাইছে, নতুন উদ্যোগে নামতে ইচ্ছুক।  এইসব প্রবাসী উদ্যোগপতিদের সাথে কলকাতায় যারা আলরেডি ছোট ছোট আই টি শপ খুলে বসে আছেন, তাদের সেতু বন্ধন জরুরী।

আমি যখন কলকাতাকে আমার আউটসোর্সিং বেস করি ২০১২ সালে, প্রথমেই আমরা বড় অফিস খুলি নি। তিনমাস আমি কলকাতায় ছিলাম নানান ধরনের এইসব ক্ষুদ্র উদ্যোগপতিদের সাথে পরিচিত হতে। আমেরিকা থেকে আনা অধিকাংশ প্রজেক্ট এদের দিয়েই করাতাম আগে। কেউ ইলেকট্রনিক্সটা করে দিত, কেউ মোবাইল বা ওয়েব। আমরা শুধু ইন্ট্রিগ্রেশন এবং টেস্টিং করতাম।  তারপরে আস্তে আস্তে নিজেদের টিমটা অনেক বাড়িয়েছি।  সুতরাং যেসব প্রবাসী বাঙালীরা কলকাতায় শিল্প স্থাপনে ইচ্ছুক, তাদের প্রথমেই অফিস খোলার দরকার নেই। বরং এই সব ছোট ছোট স্থানীয় উদ্যোগপতিদের সাথে পরিচিত হোন।  তাদের ম্যানপাওয়ার স্কিল ব্যবহার করে নিজের প্রোডাক্ট বা ব্যবসা শুরু করুন।  এই কাজটা সহজ। কারন এইসব ছোটখাট শপ গুলোর সমস্যা এই যে এরা আমেরিকান বা বিদেশী ক্লায়ন্টদের কাছে কাজ পায় আপ ওয়ার্ক বা ওই জাতীয় সাইটগুলো থেকে। বিদেশে গিয়ে সেলস মার্কেটিং করার ক্ষমতা এদের নেই।  বিদেশে কোন প্রোডাক্ট চলতে পারে সেই ধারনাও নেই।  সুতরাং বিদেশে চলতে পারে এমন প্রোডাক্ট আইডিয়া থাকলে, তার পেছনে দশ বিশ হাজার ডলার ঢেলে প্রবাসীরা যদি নামে, কলকাতার আই টি চিত্র বদলাবে দ্রুত।

 তবে সমস্যা এই যে প্রবাসী বাঙালী দুশো হাজার ডলার খরচ করে সাউথ সিটি বা রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনবে কিন্ত কুড়ি হাজার ডলার খরচ করে কোন প্রোডাক্ট বানাবে না-যার থেকে সে দুই মিলিয়ান ডলার তুলতে পারে। যেহেতু রিস্ক আছে। এখানেও সেই রিয়াল এস্টেটের উর্ধগতির গল্প। সৌভাগ্য এই যে রিয়াল এস্টেটের গরু আর গাছে উঠবে না। আশা করা যায় এবার বদলাবে পরিস্থিতি।

সাথে সাথে পশ্চিম বঙ্গের স্কুল শিক্ষার আমূল পরিবর্তন দরকার। এখনো সেই পাশ ফেইল, পরীক্ষায় পাশ করার জন্যে পড়লে, কোন উদ্যোগপতি পাওয়া যাবে না। দরকার আল রাউন্ড প্রাক্টিক্যাল শিক্ষা। নেতৃত্ব, ইনোভেশন, ছোটবেলা থেকেই সফটোয়ার বা হার্ডোয়ার শিল্পের সাথে পরিচিত হওয়া দরকার স্কুল ছাত্রছাত্রীদের।  বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা যদ্দিন চালু থাকবে, তদ্দিন কদ্দুর কি হবে বলতে পারছি না। কারন যেসব ছাত্র বিটেক করে বেড়োচ্ছে, তারা আন্তারপ্রেনারশিপ ত দূরে থাক, বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের জন্যই যোগ্য না।

 কলকাতায় সেজের দরকার অবশ্যই। আশা করব মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সেটা দ্রুত বুঝবেন। তবে ইনফি, উইপ্রো, টিসিএস এরা কলকাতার আই টি চিত্র উজ্জ্বল করবে-সেই দৃশ্যের যবনিকা সমাপ্ত ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়ের সাথে সাথে।

সুতরাং এখন এই সব প্রোডাক্ট বেসড ছোট ছোট টেক শপগুলিই ভবিষ্যতের ভরসা।  এই ইকোসিস্টেমটা কি করে বড় করা যায়, সেটাই দেখতে হবে। গোটা বিশ্ব সেই দিকেই এগোচ্ছে। এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে আলাদা করে কিন্ত বাঁচার সুযোগ নেই।

Saturday, July 15, 2017

কম্পিউটার প্রোগ্রামিং স্কুল লেভেল থেকেই শেখা ভাল

 আমার আগের লেখাটার ( ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরির ভূত ভবিষ্যত) পরিপ্রেক্ষিতে এটা ক্ল্যারিফিকেশন নোট। অনেকেই জানিয়েছেন, “কোর” ইঞ্জিনিয়ারদের ভবিষ্যত কি ( যেন তাদের প্রোগ্রামিং জানার দরকার নেই) বা ছোটবেলা থেকে কম্পুটার ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে কি হবে?

বাচ্চাদের  ছোটবেলা থেকে কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ কেন শেখানো উচিত -আমার এই সিদ্ধান্তে পেছনে, অবশ্যই আমার নিজের অভিজ্ঞতা।  আমেরিকাতে এখন সরকারি স্কুলগুলোতে ক্লাস সেভেন থেকে শেখাচ্ছে-তবে তা ইলেক্টিভ।

(১) আমি যতটুকু শিশুমনের সাথে পরিচিত-ওরা নিজেরা কিছু করতে ভালবাসে- যা এবস্ট্রাক্ট না-নিজেরা খেলার ছলে পরীক্ষা করে দেখতে পারে। প্রোগ্রামিং শেখালে ওরা নিজেরাই নিজেদের মতন করে নানান খেলা তৈরী করতে পারবে।  বাচ্চাদের প্রোগ্রামিং শেখানো হয় এখন ওই গেম তৈরী খেলার ছলেই।  চোখের সামনেই ওরা দেখে ওদের “সৃষ্টি” কেমন আলাদিনের প্রদীপের মতন “ম্যাজিক” দেখাচ্ছে।
এমনিতেই আজকালকার বাচ্চারা ভিডিও মোবাইল গেমে প্রচুর সময় নষ্ট করে, যা তাদের মানসিক বিকাশের সহায়ক ত নয়ই, বরং নেশাটা ড্রাগ এডিক্টের মতনই খারাপ। ওদের একটা খেলা দরকার, যা খেলে, ওরা শিখবে।
প্রথম কারনটা অবশ্যই পজিটিভ ইনভল্ভমেন্ট।

(২) বাচ্চাদের সামনে আপনি রোল মডেল হিসাবে কাকে তুলে ধরবেন? আমি যেহেতু আন্তারপ্রেনার, আমার সামনে রোল মডেল নিঃসন্দেহে বিল গেটস, স্টিভ জবস, মার্ক জুকারবার্গ।  পৃথিবীকে এরাই বদলেছেন বেশী গত ত্রিশ বছরে। এদের বায়োগ্রাফিতে অনেক জিনিস কমন 
     -কেউ পড়াশোনা বা ডিগ্রি কমপ্লিট করেন নি-এদের সবাই ড্রপ আউট। এরা এই পোষাকি ব্যাচেলর, মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রির ধার ধারেন নি।
    - এবং সবাই ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, প্রসেসর প্রোগ্রামিং শিখেছেন -এবং সেগুলোই ছিল এদের বাল্যকালের “অবশেসন”।  ছোটবেলায় ইলেকট্রনিক্স এবং কম্পিঊটারের সাথে এদের শুধু পরিচিতিই ছিল না-এরা ছিলেন খুদে মাস্টার। স্টিভ জবস যখন ক্লাস এইটে, বিশ্ববিখ্যাত জেরক্স কোম্পানী তাকে ইনটার্ন হিসাবে নিয়েছিল মাইক্রোপ্রসেসর সারানোর জন্য! মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে বিল গেটস কম্পুটার প্রোগ্রামিং এ তুখোর ছিলেন যখন গোটা আমেরিকাতেই কম্পুউটারের সংখ্যা হাতে গোনা যেত। 
     এরা যে অনায়াসে হার্ভাডের মত বিশ্ববিদ্যালয়ের ( হার্ভাডের র‍্যাঙ্কিং গোটা বিশ্বের নাম্বার ওয়ান-যেখানে ভারতের কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম একশোতেই নেই!)  কম্পিউটার সায়েন্সের বিটেক ডিগ্রিকে লাথি মারতে পেরেছেন-তার কারন একটাই।  এরা কম্পুটার সায়েন্স এতটাই ভাল জানতেন, ডিগ্রির দরকার ছিল না এদের। চাকরির ও না। পাশ আউট করার আগেই বিল গেটস, নিজের ওপারেটিং সিস্টেম লিখে সেটা বেচেও দিয়েছেন একটা বড় কোম্পানীকে।

 ছোট বেলা থেকে প্রোগ্রামিং না শিখলে, এসব হত না।

(৩)  আমার নিজের অভিজ্ঞতাটা লিখি। কর্মসূত্রে অসংখ্য ছোট ছোট স্টার্টাপের ফাউন্ডারদের সাথে আমার আলাপ। আধুনিককালে  আমেরিকাতে “সফল” টেক স্টার্টাপের সংখ্যা যদি দেখি, তাদের ফাউন্ডারদের অধিকাংশই নিজেরা খুব ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারে দক্ষ। যারা শুধু ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছেন, তারা ব্যবসাটা ছোট বেলা থেকেই করছেন।
 পরের দিকে এসে শিখে, লোকে সফল হয় নি এমন না। তবে সংখ্যাটা কম।

 আমি নিজে প্রোগ্রামিং শিখেছি পিএইইচডির শুরুর দিকে, মানে তেইশ বছর বয়সে। এই নয় যে বেশী বয়সে ওটা শেখা যায় না। অবশ্যই যায়। কিন্ত সেটা প্রশ্ন না। প্রশ্ন হচ্ছে কোন লেভেলে শিখলে সে নিজেই নতুন কিছু করার ক্ষমতা রাখবে?
 ইঞ্জিনিয়ারিং শেখার তিনটে লেভেল আছে।

   এক চাকরির জন্যে শেখা-যেখানে খুব বেশী না শিখলেও চলে।
 দুই পড়ানোর জন্য বা শিক্ষকতার জন্য শেখা-সেখানে আরেকটু বেশী শিখতে হয়,

  তিন -নিজে প্রোডাক্ট বানানোর জন্য শেখা।  লেভেল এক দুই এর সাথে তিনের পার্থক্য আকাশ পাতাল।

 লেভেল থ্রিতে পৌছাতে গেলে, কম্পুটার প্রোগ্রামিং ছোটবেলা থেকেই শুরু করতে হবে।

(৪) অনেকে বলছেন যারা বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী বা “কোর ইঞ্জিনিয়ারিং” এ যাবে তাদের ও শিখতে হবে? উত্তর হচ্ছে হ্যা। কারন এটা একটা  নতুন ভাষা শিক্ষা, যার প্রয়োজন সর্বত্র। আমি নিজেও কোর ইঞ্জিনিয়ারিং এই কাজ করি-এবং সেখানেও নতুন যা কিছু হচ্ছে, তা সিম্যুলেশন এবং অটোমেশন নির্ভর। সেখানে প্রোগ্রামিং এবং ম্যাথেমেটিক্স ছাড়া গতি নেই। ব্যবসাও আস্তে আস্তে বিজনেস আনালাইটিক্স নির্ভর । সেখানেও ভাল অঙ্ক না জানলে কিস্যু হবে না।

অনেকেই কোর ইঞ্জিনিয়ারিং শেখার ছলনায়, প্রোগ্রামিং শিখতে চায় না। এটা ভুল পদক্ষেপ।  সিমুলেশন এবং অটোমেশনের দৌলতে কোর ইঞ্জিনিয়ারিং এখন প্রোগ্রামিং নির্ভর।

প্রযুক্তির কাঁধে ভর দিয়ে দিন বদলাচ্ছে দ্রুত। আপনারা যেভাবে করে খাচ্ছেন, আজ থেকে দশ বিশ বছর বাদে, নতুন প্রজন্ম সেই ভাবে টিকবে না।  আস্তে আস্তে  টিসিএস, ইনফি ইত্যাদি বড় বড় কর্পরেশনের অস্তিত্বই থাকবে না-যদিও থাকে, তা থাকবে শুধু মাত্র  টেকনোলজি ইন্ট্রিগ্রেটর হিসাবে-যেখানে কর্ম সংস্থান হবে কম, খুব কম। অধিকাংশ  ছেলেমেয়েরা নতুন নতুন প্রোডাক্ট এবং সার্ভিস ডিজাইন করেই জীবিকা নির্বাহ করবে। এটা ভাল দিক। কিন্ত সেই ক্ষেত্রে যারা ছোটবেলা থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখেছে বনাম যারা মুখস্থ করে ডিগ্রি নিয়েছে, তাদের পার্থক্য অনেক।

 আর এটা ভবিষ্যত না বর্তমান। আমেরিকা এবং ভারতে আমি সেই সব আন্তারপ্রেনারদের দেখা পাচ্ছি, যারা ছোট বেলা থেকেই কোম্পানী খুলে বসে আছে, প্রোডাক্ট বানাচ্ছে। অনেকেরই কোন ডিগ্রি নেই। আর তাদের হয়ে কাজ করছে ডিগ্রিধারী ইঞ্জিনিয়াররা।

শিক্ষিত- সেত বাজারে মেলে ভুরিভুরি।
প্রতিভা- সেটাও বাজারে অনেক।

সাফল্যের রসায়ন দুটো- প্যাশন এবং পারসিভ্যারেন্স ( কোন কিছু ভালবেসে করা এবং লেগে থাকা)। 

শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং কেন-কবিতা, সাহিত্য, সিনেমা বানানো, ডাক্তারি, ওকালতি কোন কিছুই নিবিড় চর্চা ছাড়া হয় না। ৫% প্রতিভা, ৯৫% গায়ের ঘাম ঝড়াতে হয়।


এগুলো শিশু বয়সে বাচ্চাদের মধ্যে ঢোকাতে গেলে, তাদের এমন কিছু দিতে হবে, যাতে তারা এই দুটো গুনের অধিকারী হয়। 

Saturday, July 8, 2017

ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরির ভূত ভবিষ্যত!

(১)
 ভারতের আই টি শিল্পে কর্মী ছাঁটাই অব্যহত। এখন যা হচ্ছে, তা হিমশৈলের ভাসমান অংশমাত্র। আমেরিকাতে আমার যেসব বন্ধু সার্ভিস সেলসে আছেন-তাদের অনেকের কাছ থেকেই শুনছি ট্রাম্প জমানা আসাতে অনেক ডিল হয় বাতিল, না হলে পেছোচ্ছে-নইলে  কাজ পাচ্ছে স্থানীয় আমেরিকান কোম্পানী। সেলস পাইপলাইন শুকানোর দিকে। এখনো বড়সর কিছু লে-অফ হবে না। কিন্ত আস্তে আস্তে আই টি ইঞ্জিনিয়ারদের ওপরে অটোমেশন এবং ট্রাম্পের গিলোটিন ঝপাৎ করে নামার অপেক্ষায়।

  ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাটার ভবিষ্যতই প্রশ্নের মুখে। অনেক বাবা মা যাদের ছেলেমেয়েরা উচ্চমাধ্যমিক দিচ্ছেন তারাও আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আবার যাদের ছেলেমেয়েরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, তাদের কপালেও চিন্তার খাঁজ। টিসিএস, ইনফি এরা ক্যাম্পাসিংএ না এলে, ফ্রেশার না নিলে কি ছেলেটার ভবিষ্যত কি?  যারা এই পেশাতে আছে, তারাও আমাকে ইনবক্স করছেন। ফলে বহুদিন থেকেই ভাবছিলাম এই ব্লগটা লিখব। বিশেষত আমরা যখন উচ্চমাধ্যমিকে, ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা নিয়ে স্বচ্ছ ধারনা ছিল না কারুর। এখনো অবস্থার পরিবর্তন হয় নি। সব থেকে বড় কথা, এখন যে কাজগুলো করে আমরা খাচ্ছি, সেইসব পেশার অস্তিত্বই ছিল না তখন। ইঞ্জিনিয়ারিং এ এটাই সব থেকে বড় কথা। প্রযুক্তির গতি এখন তীব্র। প্রতি দুই তিন বছরে বদলে যাচ্ছে টেকনোলজি প্ল্যাটফর্ম। ট্রেন ধরতে লেট করলেই ভোকাট্টা ঘুরির মতন মার্কেট থেকে  আছড়ে  মাটিতে।

 তবে এর মধ্যেও শান্তনা এটা যে ভাল ইঞ্জিনিয়ারের অভাব এখনো সুতীব্র। ভারতে প্রতি কুড়িটা ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে একজন পাতে দেওয়ার যোগ্য। একশো জনে একজন পাওয়া যায়, যাকে আন্তর্জাতিক মানে ডিস্টিংশন দেওয়া যায়। ফলে যারা খুব খেটে প্যাশনেটলি কোডিং শিখছে, নিজের সাবজেক্ট শিখছে, নানান প্রোডাক্ট ডিজাইনে অংশ নিচ্ছে-তাদের কোন চিন্তা নেই। কিন্ত যারা বিটেকের চারটে বছর গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে আগে ক্যাম্পাস নামিয়ে দিত-দুর্দিন তাদের।


  (২)
  এবারে আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা এবং তার হালচাল নিয়ে কিছু ধারনা করা যাক। প্রযুক্তি মানেই যন্ত্রের সাহায্যে মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ, সুন্দর এবং নিরাপত্তা দেওয়া। এর বাইরে কিছু হয় না। এই পেশাতে সব কিছুই লাগে-বিজ্ঞান, গণিত, আর্টস, ডিজাইন, অর্থনীতি, একাউন্টিং।  ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা বলে আলদা কিছু নেই-এটাও ডাক্তারদের মতন অভিজ্ঞতাবাদ বা এম্প্রিরিসিজম। অভিজ্ঞতা লদ্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানো।

   ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার সেই অর্থে কোন গ্ল্যামার ছিল না।  পাবলিক সেক্টরে ভাল মাইনের চাকরি পেলেই অনেকেই বর্তে যেত। ১৯৯১ সাল থেকেই চাকা ঘোরে। মনমোহন সিংহের উদারনীতির জমানায় ভারতে ঢোকে একাধিক আমেরিকান কোম্পানী। এর সাথে সাথে আমেরিকাতে শুরু হয় কম্প্যুটার ইন্ড্রাস্ট্রির বুম। ১৯৯৫ সাল থেকে সিলিকন ভ্যালিতে শুরু অসংখ্য ইকর্মাস স্টার্টাপ। এরা এমন সব মাইনে দেওয়া শুরু করল, যা নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভারতে কেউ ভাবতেও পারত না আগে।  আমার মনে আছে সেই ১৯৯৩-৯৫ সালে কেডেন্স, সান সিস্টেম এরা আই আই টি ক্যাম্পাসে বছরে সাত লাখ টাকার প্যাকেজ নিয়ে আসে। যা তখন ছিল অকল্পনীয়। কারন আই আই টির সিনিয়ার অধ্যাপকদের বার্ষিক বেতন তখন পাঁচ লাখের নীচে।

   এর পরে আমেরিকাতে আই টি শিল্পের চাহিদা যত বেড়েছে-ভারতের আই টি কোম্পানী গুলি ফুলে ফেঁপে উঠেছে । কারন আমেরিকাতে অত আইটি কর্মী ছিল না-এখনো নেই। ১৯৯৩ সাল নাগাদ ক্লিনটন গ্যাট চুক্তি সাইন করেন। প্রেসিডেন্ট  ক্লিনটন গ্লোবালাইজেশনের পক্ষে ছিলেন। ফলে উনার আমলে আই টি কর্মীদের আমেরিকাতে নিয়ে আসা সহজ করতে এইচ ওয়ান বি ভিসা চালু হয়। যার অধিকাংশ পেয়েছে ভারতীয়রা।

 ১৯৯৫-২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় আই টি শিল্পের স্বর্নযুগ।  পৃথিবীর সব দেশেই ভারতীয় আই টি কর্মীদের চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। আই টি শিল্পের সাপ্লাই লাইন বজায় রাখতে ভারতে গজিয়ে ওঠে অসংখ্য প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সাথে সাথে বেড়েছে মাহিনাও। বিশেষত যারা অভিজ্ঞ। এন্ট্রি লেভেল মাইনে একই থেকেছে।

  আমেরিকাতে ২০০৭-৮ এর অর্থনৈতিক মন্দায় ভারতীয় আই টি প্রথম ধাক্কা খায়। যদিও আমেরিকা প্রচুর ধার করে, অর্থনীতি ফিরিয়ে নিয়ে আসে আগের যায়গায়, আই টি শিল্পের জগন্নাথ রথ পাঁচ টি গাড্ডায় হোঁচট খায়।
   
            -- অর্থনৈতিক মন্দার আগে, আমেরিকাতে শিক্ষিত লোকজন এত ভারতীয় বিদ্বেশী ছিল না। ভারতীয়রা চাকরি নিয়ে যাচ্ছে এটা রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিনত হয় নি। এর কারন আছে। ২০০১-২০০৭ পর্যন্ত আমেরিকার রিয়াল এস্টেট বাড়ছিল হুহা করে। ফলে বাড়ির দাম, স্টকের দামের হুহু করে বাড়তে থাকায়, মোদ্দা কথা পকেট ভারী থাকায়, ভারতীয়রা চাকরি নিয়ে গেলেও কেউ আন্দোলনে নামে নি।। নিজেদের ফূর্তির টাকা এসে গেলে আমেরিকানরা খুশ-কিন্ত না এলেই তারা ভয়ংকর।  অর্থনৈতিক মন্দার পরে, আমেরিকার অর্থনীতি স্বাভাবিক হল-কিন্ত যাদের চাকরি গেছিল-অনেকেই চাকরি ফিরে পেল না। জবলেস রিকভারি। এরাই আস্তে আস্তে সংগঠিত হতে থাকে ভারত এবং চীনে আউটসোর্সিং এর বিরুদ্ধে। গ্লোবালাইজেশনের বিরুদ্ধে এই রাগ কাজে লাগিয়ে এলেন ট্রাম্প-ফলে আউটসোর্সিং এর পক্ষে যেতে ভয় পাচ্ছেন আমেরিকান সিইওরা।

   - দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইফসাইকল। যেকোন ইঞ্জিনিয়ারিং জিনিস যখন মার্কেটে আসে-প্রথমে প্রচুর স্কোপ থাকে। আস্তে আস্তে সব কিছু স্টান্ডার্ডাইজ করা হয়। এর ফলে পুরো জিনিসটা একদম ছকে ফেলে প্রোডাক্ট-অটোমেশন করা সম্ভব। যে কাজের জন্য ২০০৫ সালে পঞ্চাশ জন লাগত, এখন লাগে তিন জন। কিন্ত তারপরেও অসুবিধা নেই। নতুন নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোডাক্ট বা প্রযুক্তি বাজারে আসতেই থাকে। নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের সেই নতুন প্রযুক্তিতেই সংস্থান হয়।

  -  তৃতীয় সমস্যাটা এই নতুন প্রযুক্তি থেকেই উদ্ভুত। ২০১২ সালের মধ্যে বলতে গেলে আমেরিকা এমন কি ভারতেও সব বিজনেসে কোন না কোন আই টি প্ল্যাটফর্ম আছে। সেসব চালাতে বেশী লোক লাগে না।  মার্কেটের নতুন দাবী হচ্ছে এই যে এত ডেটা আসছে সেটা কাজে লাগিয়ে বিজনেসটা বাড়াও। মানে সেলস বাড়ানোর জন্য তথ্য বিশ্লেষন কর। সাপ্লাইচেইন ভাল করার জন্য ডেটা সায়েন্স। ইত্যাদি।  সেখানেই এখন প্রজেক্ট বেশী।  মুশকিল হচ্ছে, ভারতের অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ার এই ধরনের কাজের জন্য তৈরী না। কারন এরা অঙ্ক, কম্পুটার সায়েন্সের গভীর ফান্ডামেন্টাল এবং পরিসংখ্যানবিদ্যা বা স্টাটিসস্টিক্স শেখে না ভাল করে কলেজে। ফলে তাদেরকে এই কাজের জন্য রিস্কিলিং করা দুঃসাধ্য। সেটাই মূল সমস্যা এখন।

  -চতুর্থ সমস্যার উৎ্পত্তি তৃতীয় সমস্যা থেকেই। ভারতে  শিক্ষার মান নিম্নগামী। এর কারন শিক্ষার বেসরকারিকরন। আমেরিকাতে যেখানে অধিকাংশ ছাত্ররা সরকারি স্কুলে যায়, ভারতে মেট্রোশহরগুলোতে সব প্রাইভেট স্কুল। সেখানে না আছে ভাল টিচার-না হয় পড়াশোনা। শুধু মার্কস ওঠে। আর এই যে এনালাইটিক্যাল কাজের বিরাট মার্কেট তৈরী হয়েছে, সেখানে চিন্তাশীল ছাত্রছাড়া জাস্ট গাঁতানো লোকজন দিয়ে কিস্যু হবে না। কারন প্রতিটা পরিস্থিতি আলাদা। ্পরিস্থিতি বুঝে সমাধান করার অভ্যেস ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের একদম নেই।

 মোদ্দা কথা ইঞ্জিনিয়ারিং এমন একটা পেশা যেখানে আজ একটা প্রযুক্তি, কাল অন্য প্রযুক্তি আসবে। এবং নতুন প্রযুক্তিতেই নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের সংস্থান হবে। এটাই নিয়ম। কিন্ত সেখানে অসুবিধা হচ্ছে কারন এখন এই নতুন প্রযুক্তি বোঝার মতন যে ব্যাকগ্রাউন্ড দরকার, সেটা অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্রছাত্রীদের নেই।

 - আর শেষ সমস্যাটা ম্যানেজারদের নিয়ে। ভারতের সমাজে বর্ণবাদের প্রভাব খুব গভীরে। ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজাররা ছড়ি ঘোরাতে ভালবাসে, নিজেরা একবার ম্যানেজার হয়ে গেলে নিজেদের ব্রাহ্মন আর অধীনস্থদের শুদ্রভাবে। ফলটা এই যে-নিজেরা প্রযুক্তি শেখা ছেড়ে দেয়। যার জন্য ভারতের মিডল ম্যানেজারদের একবার চাকরি গেল , নতুন করে তাদের চাকরি পাওয়া মুশকিল। কারন তারা ইঞ্জিনিয়ারিং সব ভুলে গেছে।  ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে ওটা নৈবচ।

 (৩) তাহলে উপায় ?

 যারা ইঞ্জিনিয়ারিংকে পেশা হিসাবে নিতে চাইছে, তাদের প্রথম কর্তব্য এটা বোঝা, শিক্ষাব্যবস্থা, নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং চাহিদার জন্য সম্পূর্ন ফেলিওর। সুতরাং প্রস্তুতি এই ভাবে নিতে হবে

            - মিডল স্কুল ( সিস্ক সেভেন )  থেকে কোডিং শিখতে হবে
           -স্টাটিস্টিক্স, ম্যাথ এবং এলগোরিদম শিখতে হবে ক্লাস ফাইভ থেকেই । খান একাডেমি থেকে অনেক সংস্থাএখন ফ্রিতে কোডিং এবং এলগোর কোর্স দিচ্ছে।
            -সাথে সাথে কম্পুটারাইজড ডিজাইনের -যেমন এডব ফটোশট ইত্যাদি শেখা ভাল।
            - ক্লাস এইট নাইন থেকে ছোট ছোট আই টি কোম্পানী গুলির সাথে যুক্ত হয়ে পা্ট টাইম
   ইনটার্নশিপ শুরু করা ভাল।
     -ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকলে, সেখানে যে সাবজেক্টটাই নাও, সেটা ভাল করে শেখা উচিত। আগে দরকার ছিল না। এখন আছে। স্টাট, ম্যাথ, কম্পুটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স, ফিজিক্স-এই সাবজেক্ট গুলো যারা নেবে এবং "শিখবে" -তাদের এডভ্যান্টেজ।

 বর্তমানে যেভাবে ছেলেমেয়েরা আট নটা টিউশুনি করতে দৌড়াচ্ছে মার্কস তোলার আশায়-তারা এইসব কি করবে জানি না। তবে না করলে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিছিয়ে যাবে। কারন তারা যখন মার্কেটে আসবে, প্রতিযোগিতা আরো তীব্র হবে।

   (৪)
 ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে সংকট নেই। গোটা পৃথিবী চলছে প্রযুক্তির চাকায়। প্রচুর টাকা এখন ইঞ্জিনিয়ারিং এ। আমেরিকা সহ পৃথিবীর সব থেকে লাভ করা প্রথম পাঁচটা কোম্পানীর জন্ম হয়েছে গত কুড়ি বছরে ( আমাজন, গুগল, আপেল, নেটফ্লীক্স, ফেসবুক)।  সুতরাং ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে মাইনে চক্রবৃদ্ধি হারে  বেড়েছে এবং বাড়বে। স্টার্টাপ করে ধনী হওয়ার সুযোগ ও বেশী।  সৃজনশীল চিন্তাভাবনা ঢোকানো, শিল্পের কদর এখানে সম্ভব।  পেশা হিসাবে নতুন যুগের ইঞ্জিনিয়ারিং আগের যুগের থেকে অনেক বেশী চিত্তাকর্ষক, উদ্ভাবনমুখী এবং বৈভবশালী।

 সংকট এবং সমস্যা একটাই-এত দুর্বল শিক্ষা নিয়ে এই পেশাতে আসলে। নতুন যুগের ইঞ্জিনিয়ারিং এ কিস্যু হবে না। চাকরিই পাবে না। কেউ নেবে না।

  দুদিন আগেও রাম শ্যাম যদু মধু-সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং এ চাকরি পেত। কারন যেটুকু শিখতে হত, তা একজন ক্লার্ককেও শিখতে হয় না । সেসব কাজ এখন অটোমেটেড।  হয়ে গেছে বা হবে। সুতরাং দরকার সৃজনশীল ইঞ্জিনিয়ারদের। আর সেটা আটটা টিউশনি পড়ে হবে না। সৃজনশীলতাও চর্চা করতে হয়।


















     

Thursday, July 6, 2017

আমি হিন্দু নই, তুমিও মুসলমান না!

এই মহাবিশ্বের বয়স?

     তা চোদ্দশ কোটি বছর হবে।

 আকার, আয়তন, পরিধি ?

 জানা নেই। আমরা পৃথিবীর বাসিন্দা।   সৌর জগতের মধ্যে একটা ছোট্ট পৃথিবী - ইডেন উদ্যানে পিংপং বল।

আর ওমন কোটি কোটি সৌর জগত আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে। হাবল টেলিস্কোপের চোখ যদ্দুর যায় - এই দৃশ্যমান মহাবিশ্বে কোটি কোটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আবিস্কার করেছে মানুষ নিজেই! আর দৃশ্যমান মহাবিশ্ব, আসল মহাবিশ্বের কতটুকু? জানা নেই।

   তাহলে আমি কে? আয়ু একশো বছর। পৃথিবীর পাঁচশোকোটি লোকের একজন!  এই মহাবিশ্বের বয়স যদি হয় একশো বছর, তাহলে আমার জীবনকাল এক সেকেন্ডের চেয়েও ক্ষুদ্র!

  ভাবুন - স্থান এবং কালে- এই মহাবিশ্বের চেতনায়, আমি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব। আমার জীবনটা মহাজাগতিক কালে-জাস্ট একটা বুদবুদ।  রাতের আকাশের দিকে তাকান-আর নিজেকে ভাবুন-আপনি কে? মহাসমুদ্রের ধারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জোনাকিরা আমার  ক্ষুদ্রতা দেখে হাঁসবে!

  অথচ আমাদের "আমি" ভাবনা থামে না- আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি ধনী, আমার এই নেই, আমার বড় বাড়ি আছে-আমার ছেলে এই-আমার বংশ এই! আমার এই  ডিগ্রী-আমি এই করেছি-"আমি" র লিস্ট মালগাড়ির বগির মতন!

     মানুষের জীবন এতই ক্ষুদ্র-মানুষ সততই ভোলে মৃত্যুর নিমন্ত্রনপত্র নিয়েই সে জন্মেছে। মোমের মতন গলে সেই অহং, যখন একদিন মৃত্যুর সামনে দাঁড়াতে হয়।

  কি আশ্চর্য্য-পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থেই মানুষকে তাই বার বার সাবধান করা হচ্ছে- ওহে তোমার জীবনকাল বড়ই ক্ষুদ্র- বৃথা নষ্ট করো না ঝগড়াঝাঁটি ঈর্ষা খুনোখুনি করে!

   কোরানে মৃত্যু চেতনা আছে প্রায় ৭৩ টি আয়াতে- আল ইমারান (৩/১৮৫ ) এ নাজিল " পৃথিবীর বুকে এই নশ্বর জীবন আসলেই অহংঙ্কারপূর্ন অস্তিত্ব, (কারন সে মৃত্যুর কথা মনে রাখে না)" ।

     উপনিষদের জীবন দর্শনের প্রায় সবটাই মৃত্যুচেতনা থেকে উঠে আসা।  কঠোপনিষদকে এডউইন আর্নাল্ড কবিতায় রূপ দিয়ে লিখেছেন " মৃত্যুর গোপন কথা"।

 কঠোপনিষদে নচিকেতা যমের সম্মুখে --

   যম বল্লেন বর চাও নচিকেতা?

    - হ্যা, প্রভু-যদি আপনি আমার ওপরে প্রফুল্ল, তাহলে দয়া করে বলুন মৃত্যুর ওপারে কি রয়েছে রহস্য?

  - নচিকেতা, মৃত্যু নিয়ে আমায় বিব্রত করো না। অন্য বর চাও। মৃত্যুর রহস্য তোমায় দিতে পারব না।

  - প্রভু দিতে হলে আমাকে এটিই দিন। বলুন মানুষের মৃত্যু রহস্য। কারন আমি জানি, আপনিই কেবল জানেন এই মৃত্যুর রহস্য!

  - নচিকেতা তোমার কি চাই? হাজার বছর আয়ু? কত হাতি, কত সোনা, কত স্ত্রী , কত পুত্র , কত জমি চায় তোমার? সব দিচ্ছি।  কিন্ত আমার কাছে মৃত্যু রহস্য জানতে চেও না। ছেড়ে দাও বাপু-মৃত্যু রহস্য জানার ইচ্ছা!

  নচিকেতা নাছোড়বান্দা।

 -প্রভু এই নশ্বর রাজত্ব, নারী, সম্পদ-সবই ত ক্ষনস্থায়ী, যতক্ষন শ্বাস , ততক্ষন। কোনকিছুই নিত্য না-তাহলে কিসের মোহে মৃত্যুরহস্যের পিছু ছেড়ে এই ক্ষনস্থায়ী ভোগবিলাসে মজি প্রভু?

   যম দেখল, ভবি ভোলার না। নচিকেতা মৃত্যুরহস্য জেনেই ফিরবে!

   মৃত্যুর সামনে মানুষের যে ক্ষুদ্র নশ্বর অস্তিত্ব-এবং তাতেই কুয়োর ব্যঙের মতন আমাদের অহং এর লাফালাফি -প্রতিটা ধর্মই তা বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছে। এই পর্যন্ত ধর্মদর্শনটুকু আমার ভালোই লাগে। কারন অহঙ্কার জ্ঞানের তাপে মোমের মতন গলে।

  ধর্মের সাথে আমার গোল  বাধে এর পরের ধাপে।  হ্যা, এটা মানি, জীবন ক্ষনস্থায়ী-এটা মাথায় রাখলে নিজেকে মোটিভেট করাই মুশকিল।  ফলে একটা বুষ্টিং বর্নভিটা দরকার। জৈন, বৌদ্ধ এবং হিন্দু দর্শনে সেটা পরের জন্ম। পুনঃজন্ম। ইসলাম, খ্রীষ্ঠ ধর্মে স্বর্গের সুরাসরের ধারনা।

    সমস্যা এটাই- যখন সন্ত্রাসবাদিরা এই নশ্বর জীবনকে সত্যি সত্যিই সম্পূর্ন তুচ্ছ ভেবে, স্বর্গের মোহে আত্মঘাতি ভেস্ট বুকে নিয়ে সুইসাইড বোম্বার হয়। মৃত্যুচিন্তা পর্যন্ত সব ধর্মই ঠিক। কিন্ত মৃত্যুপরবর্তী চিন্তাটা সব ধর্মেই রূপকথার মোহজাল এবং তা সুস্থ সমাজের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই ভয়ংকর সন্ত্রাসবাদীর জন্ম দিতে সক্ষম। তাদের ছোটভাই মৌলবাদিরাও সেই পরকালের মদে বুঁদ।

  সুতরাং যতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হৌক, হোক যতই অকিঞ্চিৎকর-এই ক্ষুদ্রজীবন, তার চাওয়া, পাওয়া ওঠা নামাগুলোকে ভাল লাগা দরকার। জীবনকে যেন প্রতিটা শিশু ভালবাসতে শেখে।  নচেৎ তাদের সন্ত্রাসী হওয়া সময়ের অপেক্ষা।

  যারা বলেন, ইসলাম এখন সব থেকে বেশী সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিচ্ছে-কারন মাদ্রাসা নশ্বর জীবনের মুন্ডপাত করে --বেহস্তে বাহাত্তর হুরের স্বপ্নে তারা বিভোড় -আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই- এই ইসলামেই জন্মে ছিলেন সুফীগুরু জালালুদ্দিন রুমি।  জীবনকে যে এত তীব্রভাবে ভালোবাসা যেতে পারে, সেটা আমরা অনেকে তার কবিতা থেকেই শিখেছি --

( কবিতার ভাষাটি আমার নিজের অনুবাদ, রুমির ভালোবাসার তীব্রতা প্রকাশ করার মতন বাংলা আমি শিখি নি-তাই ক্ষমা মার্জনা চাইছি )

     মানবসত্ত্বা!
    সেত আমার অতিথিগৃহ—
    রোজ সকালে নিত্যনতুন অতিথির আনাগোনা।
এক টুকরো সুখ / একখন্ড হতাশা/ একরাশ ক্ষুদ্রতা,
অপ্রত্যাশিত অতিথির তালিকাটি দীর্ঘ/ ক্ষনিকের অতিথি তারা, এসেছে দুয়ারদ্বারে। 
স্বাগত সবাই/ আমি পা ধুইয়ে দিই তাদের সবাইকে
—যদি তা দুর্বার দুঃখও হয়
যা ওলোট পালট  করে ছুড়ে ফেলে দেয় সাজানো গৃহের সাজানো আসবার 
এরপরেও 
 আন্তরচিত্তে গ্রহণ কর সবাইকে—
হয়তো সে তোমাকে পুরস্কৃত করছে জেনো,
নতুন কিছু আনন্দআগমন উপলক্ষে।
অন্ধকার আশংকা, অপমান, আক্রোশ, ঘৃণা— সবকিছু,
হাসিমুখে এগিয়ে এসো সামনের দরজায়!
জালালুদ্দিন রুমি এগুলো লিখেছেন ত্রয়োদশ শতাব্দিতে, ইরানে। ইসলামের ইতিহাস তখন রক্তাত্ব-এখনকার মতই। উনি ইসলামের সৌর্ন্দয্যকে রাজনীতি থেকে বার করে কবিতায় রূপ দিলেন-কারন সুফীরা তখন ইসলামের  রক্তাত্ব রাজনৈতিক ব্যবহারে বিরক্ত। ঠিক যেমন ভাবে  এখনকার সাধারন মুসলমানরা বিরক্ত হোন যখন রাজনীতিবিদরা ইসলামকে ব্যবহার করেন ভোটের জন্য।

 জালালুদ্দিন রুমি না পড়লে বোঝা যায় না ইসলামিক সংস্কৃতিতেও একদা মানুষ খুঁজেছে চিরন্তন   সৌর্ন্দর্য্য। ওমর খৈয়াম, হাফিজ শিরাজি, খলিল জিব্রান-কার কথা ছেড়ে কার কথা বলি ?

            যেমন উপনিষদ না পড়লে বোঝা অসম্ভব প্রাচীন ভারতের চিন্তার সৌন্দর্য্য-আত্মার মুক্তি। গোরোক্ষা কমিটির হিন্দুএর দেখলে শুধুই মনে হবে হিন্দু ধর্ম আচার-বিচার-জাতফাতের ফিতেই আটকানো পা ভাঙা গরু-শুধু ন্যাদায় গোচনা! কে বলবে এই ধর্মের সর্বোচ্চ উপলদ্ধি উপনিষদের বাণী- যা রবীন্দ্রভাষ্যে  

‘হে মহাপথিক/অবারিত তব দশদিক/তোমার মন্দির নাই, নাই স্বর্গধাম/নাইকো চরম পরিণাম/। তীর্থ তব পদে পদে/চলিয়া তোমার পদে মুক্তি পাই চলার সম্পদে’
 
 তাহলে ক্ষীরটা কি খাইলাম?

  জীবনকে ভালবাসতে হবে- জীবনকে ঘৃণা করা শুরু করলে- ছেলেটা মৌলবাদি নইলে সন্ত্রাসবাদি হবেই।

  জীবনকে ভালবাসিবে কিরূপে? নাচে গানে খাদ্যে সৌর্ন্দয্যে কবিতার ছন্দে?  এখানেই ধর্ম দর্শনের সাথে সংঘাত। কঠোপনিষদ, কোরান-এরা সবাই আমাদের নশ্বর জীবনের আনন্দকে ক্ষনস্থায়ী বলে বাতিল করে দিল!

ঠিক এই কারনেই এই জন্মে আর আমার ধার্মিক হয়ে ওঠা হল না! চলার পথেই যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জেতা হারা-তাই থেকেই যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুদের মতন ছোট ছোট আনন্দ দুঃখের বারিধারা- তার সিঞ্চনেই আমি খুশী। এটা জেনেই এসবের কোন মানে নেই-জীবনের পরম উদ্দেশ্যও নেই।

বেহস্ত, পরের জন্ম, কমিনিউস্ট রাষ্ট্র-ইত্যাদি বড় বড় লক্ষ্যের পেছনে  দৌড়ানোর ঝামেলাটা এই-তাতে জীবনের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাওয়াগুলো হাওয়া হয়ে উড়ে যায়-আর নৈরাশ্যের নেশায় জেগে ওঠে মৌলবাদি দৈত্য।

 বরং এই গ্লাসে গলায় থাকুক এক টুকরো গালিব

  হামকো মালুম হ্যায় জান্নাত কি হক্বিকৎ লেকিন

দিল কে খুশ রাখনে কো গালিব ইয়ে খ্যয়াল আচ্ছা হ্যায়।












Wednesday, July 5, 2017

বাঙালী পরিচিতিটাই আসল-হিন্দু মুসলমান পরিচিতিটা ইল্যুউশন

ধন্যবাদ আনিস খানকে। কালকেই লিখেছিলাম বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পে জল ঢালতে বাঙালী পরিচয় বা বাঙালী আইডেন্টিটি সামনে আনা জরুরী। এটা দেখে ভাল লাগল, তার মতন একজন শিল্পদ্যোগী, বাঙালী আইডেন্টিটি সামনে আনার দ্বায়িত্ব নিজের পরিসরে পালন করছেন। ঘরে বাইরের নিখিলেশের কথা মনে এল।

হিন্দু বা মুসলমান কোন পরিচয় হতে পারে না। প্রাচীন ভারত, গ্রীস, রোম-কোথাও ধর্মীয় পরিচিতি বলে কিছু ছিল না। মানুষের ধর্মাচরন ছিল, আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসা ছিল। সবটাই ব্যক্তিগত।

মুসলমানরা যখন ভারতে প্রথম আসে-তারা ভারতীয়দের জিজ্ঞাসা করত তোমাদের ধর্ম কি? আসলেই ত কোন ধর্ম ছিল না ভারতে-প্রত্যেকের নিজস্ব উপাসনা, নিজের মতন করে সত্যকে খোঁজা। এটাই ভারতীয় দর্শনের শাস্বত বানী। ফলে উত্তর না পেয়ে, মুসলমানরা বললো-ওকে-তাহলে এটা হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। কারন পার্শী শব্দে হিন্দু মানে সিন্দুনদের ওপারে যারা থাকে। হিন্দু শব্দটা কোন হিন্দু গ্রন্থে নেই-কারন ওই শব্দটা মুসলমানদের দান। মুসলমানদের দেওয়া সেই হিন্দু আইডেন্টিটি নিয়ে-আজ তাদের সাথেই লড়াই!

রোম সম্রাট কনস্টানটাইন প্রথম খ্রীষ্টান ধর্মের জনপ্রিয়তা এবং পরিচিতিকে কাজে লাগান উত্তরের উপজাতিগুলোকে রোমান সাম্রাজ্যের বশবর্তী করতে। খ্রীষ্ঠান সাম্রাজ্যবাদের সেই মডেলটাই আরো উন্নতাকারে নিয়ে আসে সপ্তম শতাব্দির আরবের বাসিন্দারা। খৃষ্টান এবং মুসলমান -এই দুই পরিচিতির যুদ্ধ আরো তীব্র হয় তিনটে ক্রশেডের মধ্যে দিয়ে। যেহেতু গত এক হাজার বছর এই দুটো ধর্মই গোটা পৃথিবী দখল করতে চেয়েছে -রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতিতে ধর্মীয় পরিচয় আস্তে আস্তে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন হয়েছে। ইউরোপে রেনেসাস এবং শিল্প বিপ্লবের ফলে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে হঠানো গেছে ঠিকই-কিন্ত ৫৬ টা মুসলমান দেশ এবং ভারতে ধর্ম আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে রাজনীতিকে।

বাঙালী একটা লোকের পরিচিতি বা আইডেন্টি হতে পারে-কিন্তু হিন্দু বা মুসলমান কি করে একটা লোকের পরিচিতি হয় -তা আমার বোধগম্য না। সেটা রাজনৈতিক চক্রান্ত ছাড়া কিছু না। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, বাংলা খাবার খাই-তাই আমরা বাঙালী। আমি মন্দিরে যাই-তাই হিন্দু-বা মসজিদে যাই, ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলি, তাই মুসলিম-এগুলো অবোধের নির্বোধ বুদ্ধি। বা জোর করে ব্রেইন ওয়াশ করে শিশু বয়স থেকে শেখানো হয় ধর্ম গ্রন্থের মাধ্যমে, রাষ্ট্রের সহযোগিতায়। হ্যা-এই ব্রেইন ওয়াশ বন্ধ না হলে, এই যে কোটি কোটি ধর্মান্ধ তৈরী হচ্ছে, তাদের সামাল দিতে পারবে না কোন পুলিশ, কোন মিলিটারি।

কেন হিন্দু, মুসলমান পরিচিতিটা ফেক? ইল্যুউশন? ভ্রুম?

কারন আমি যে বাঙালী পোস্ত খাই, ইলিশ খাই-সেটা সত্য। খাবারের অস্তিত্ব আছে। হিন্দু-মুসলমানরা যেসব জিনিস মানে ধর্মের নামে-তার সবটাই রূপকথা। অতীতের রাজনীতির কারনে সাজানো রূপকথা। এইসব গল্পে বিশ্বাস করে পরিচিতি? এর মানে স্পাইডারম্যানের গল্পে বিশ্বাস করে স্পাইডারম্যান ফ্যান ক্লাবের সদস্য হয়ে ঘোষনা করা- ওটাই আমার পরিচয়! এইসব গাঁজাখুরি গল্প যদি মানুষের পরিচিতির ভিত্তি হয়, একবিংশ শতাব্দিতে, তাহলে গোড়ায় গলদ। সরি, কোন মিলিটারি, কোন বিজেপি আপনাদের বাঁচাতে পারবে না। আরেকবার দেশভাগের মতন দাঙ্গা বাঁধবে। কারন যে পরিচিতির ভিত্তিটাই মানুষের মাথায় টুপি পড়িয়ে, ছোটবেলা থেকে ব্রেইন ওয়াশ করিয়ে তৈরী হয়েছে-তার মিথ্যাচার, মিথটাকে টিকিয়ে রাখতে দাঙ্গা বাধাবেই। আজ না হলে কাল। কাঠকয়লার আগুন-ধিকি ধিকি করে জ্বলে। খড় পরলেই ঘরবাড়ি ব্যাবসা জ্বালিয়ে সাফ করে দেবে।

ধর্ম বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা বা নিজের সন্ধান সবার মধ্যেই ওই সুরসুড়ি আছে। নাস্তিকের ও আছে। আমার ও আছে। আমার বিশ্বাস সততায়, বুদ্ধিতে পরিশ্রমে। ওইটুকুতে বিশ্বাস করেই, বাকী জীবনটা কাটানো সম্ভব। উপনিষদ পড়তে আমার ভাল লাগে-কিন্ত তার জন্যে নিজেকে হিন্দু বলে পরিচিতি দেব কেন? কারন ইমানুয়েল কান্টের ক্রিটিক অব পিউর রিজন, আমার একই রকম ভাল লাগে। এটাত নিজের জানার জন্য ব্যক্তিগত যাত্রা। প্রতিটা মানুষের ধর্ম, সে হিন্দুই হৌক বা মুসলমান হোক, তার ব্যক্তিগত যাত্রা- পারসোনাল জার্নি। সেই জন্যেই ১৬০ কোটি মুসলমানের ১৬০ কোটি ইসলাম। কোন দুজন মুসলমান পাবেন না-যার ইসলাম হুবহু এক। কোন দুজন হিন্দু পাবেন না-যাদের হিন্দু ধর্ম হুবহু এক। কারন ধর্ম একটা ব্যক্তিগত জার্নি-তা কখনোই পরিচিতি বা আইডেন্টিটি হতে পারে না।

কিন্তু দুজন বাঙালী পাবেন -আনিশ খান এবং আশীষ রায়-যারা সর্ষে ইলিশ খেয়ে ঢেঁকুর তুলবে। গাইবে- আমি বাংলায় গান গাই। কারন ইলিশ এবং গান-দুটোই বাস্তব।

Tuesday, July 4, 2017

বাঙালী সংস্কৃতি দিয়েই মৌলবাদি উত্থান ঠেকাতে হবে

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করুন-ইত্যাদি উপাদেয় উপদেশ ভাল-কিন্ত কথাটির মধ্যেই র‍য়ে গেছে-স্ববিরোধিতার বীজ। পৃথক ধর্মীয় সম্প্রদায় থাকতে পারে-এটারই যদি বৈধতা থাকে, সাম্প্রদায়িক বৈরিতাও বৈধতা পায়। কারন প্রথম প্রশ্নই উঠবে, বাঙালীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুটো আলাদা সম্প্রদায় কেন? এদের খাওয়া দাওয়া ভাষা কবি নগর শহর-সব এক। তাহলে বাঙালীদের হিন্দু মুসলমানে ভাগ করাটা বৈধ হয় কি যুক্তিতে?

যুক্তি খুব সরল। অধিকাংশ বাঙালী, তার বাঙালী পরিচিতির চেয়েও, তার নিজেদের ধর্মীয় পরিচিতিতে বেশী গুরুত্ব দেয়। অধিকাংশ বাঙালীর নিজের অস্তিত্বে যতনা বাঙালীয়ানা, তার থেকেও বেশী তারা নিজেদের মুসলমান বা হিন্দু ভাবে। বাঙালীর যে নিজস্ব আধ্যাত্মিক চিন্তা আছে- যা সহজিয়া, আউল বাউল হয়ে লালন রবীন্দ্রনাথে পূর্নতা পেয়েছে -সেই মাটির ধর্ম সম্মন্ধেই অধিকাংশ বাঙালী বিস্মৃত।

বাঙালীর শুধু ভাষা না-তার নিজস্ব ধর্ম আছে-যা হিন্দুত্ব বা ইসলামের থেকে আলাদা-এটাইত অধিকাংশ বাঙালী জানে না!!

যে বাঙালীর রবীন্দ্রনাথ লালন আছে- সে কেন আরব সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদে ( ইসলাম ) বুঁদ হয়ে থাকে? বা ইসলামের আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য কেনই বা তাকে উত্তর ভারতের গোবলয়ের গোচনা সেবন করতে হয়?

আমরা রবীন্দ্রনজরুল বলে অনেক লম্ফ ঝম্ফ দিই বটে-কিন্ত বাস্তবে যখন দেখা যায় এক দুষ্টু বালকের সামান্য ফেসবুক পোষ্টের জন্য বাদুরিয়ার মুসলমানরা দম দেওয়া কলের পুতুলের মতন দাঙ্গা করতে পঙ্গপালের মতন দোকান পাট বাড়ি ঘরদোর ধ্বংস করছে-তখন এটা পরিস্কার, রবীন্দ্রনাথ , নজরুল বা এমন কি লালন --শুধুই শিক্ষিত বাঙালীর ড্রইংরুমে। বাঙালী এলিট লিব্যারাল এবং সাধারন মানুষ-দুই ভিন্ন বাংলার বাসিন্দা।

দেগঙ্গা থেকে বাদুরিয়া-বাংলার যে বলকানাইজেশন চলছে, তা ঠেকাতে মমতা ব্যার্নার্জির সামনে একটাই পথ। বাঙালী সংস্কৃতি দিয়েই হিন্দু মুসলমান বলে যে পৃথক আইডেন্টিটি তৈরী করা হয়েছে, সেটাকে আগে ফিকে করতে হবে। উনি সেটা করেন নি। মুসলমান ভোট ব্যঙ্কে ধরে রাখার জন্য, বাঙালী মুসলমানকে মুসলমান করে রেখেছে সব পার্টিই- কংগ্রেস, সিপিএম, তৃনমূল , বিজেপি।

শরৎচন্দ্রের সেই বাঙালী বনাম মুসলমানের ফুটবল খেলার মতন আজো সমান কনফিউশন-এরা বাঙালী না মুসলমান!! লালন, নজরুল-কেউ সেই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ঘোচাতে পারেন নি। কারন সরকারি টাকায় মাদ্রাসা, আলেম, হুজুরদের পোষা হচ্ছে-লালন সাঁইকে পৌছে দেওয়া হচ্ছে না। আলেম হুজুররা নিজেদের ধর্ম ব্যবসা টেকাতে-একজন মুসলমানের মুসলমান পরিচিতিই পোক্ত করবে-ফলে বাদুরিয়াতে যখন এই সব ধর্মোন্মাদরা পঙ্গপালের মতন লাঠি নিয়ে তাড়া করে- সেটা প্রশাসনের নীতির ভুল। কারন আলেমদের টাকা না দিয়ে যদি গ্রামে গ্রামে লালন সাই এর শিষ্যদের, বাউল কালচার ছড়িয়ে দেওয়া যেত- তাহলে বাংলা মুখরিত হত, বাঙালীর চিন্তনে!

‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।

সরকার থেকে এসব উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। ফলে মুসলমানকে আরো বেশী মুসলমান বানানো হয়েছে-আর তার প্রতিক্রিয়াতে হিন্দুরা আরো বেশী হিন্দু হচ্ছে।

মধ্যে খান থেকে বাঙালীদের স্পেসটা আরো আরো অনেক ছোট হচ্ছে। অথচ এরা নাকি বাংলার মসনদে।

যে জাতি নিজের সংস্কৃতি, নিজের ঐতিহ্যশালী লোকায়িত সহজিয়া ধর্মকে চেনে না-তাদের মাটির দখল আরব আর উত্তর ভারতের দালালদের দখলে যাবে-সেটাই স্বাভাবিক।



কিন্ত এখনো সময় আছে। সংস্কৃতি প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী-গ্রামে গ্রামে বাংলার সহজিয়া ঐতিহ্য ছড়িয়ে দিন। ছড়িয়ে দিন রবীন্দ্রনাথ নজরুলের জীবন দর্শন। যাতে সবাই নিজেদের বাঙালী ভাবতে শেখে আগে। তাদের মুসলমান বা হিন্দু পরিচিতি যেন গৌন হয়। তার বদলে উনি যদি দুধ কলা দিয়ে "ইসলামিক পরিচিতির" বিষ ছড়ানো কালসাপদের পোষেন মাসোহারা দিয়ে, তার ফল হবে বাউরিয়া-এবং সম্ভবত উনিও ক্ষমতা হারাবেন।