(১) অতীত
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ইতিহাসের দুটি অধ্যায়।
১৯৮৬ সালের আগে এবং পরে। ১৯৮৬ সাল ভারতীয় আই
টির ল্যান্ডমার্ক ইয়ার। ওই বছর রাজীব গান্ধীর সরকার পারসোনাল কম্পিউটার এবং
সফটোয়ার আমদানির ওপর শুল্ক প্রায় তুলে দিলেন। উদ্দেশ্য ভারতের এক নবীনতম শিল্প
সম্ভাবনা যেন অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়।
১৯৮১-৮৫ । আমেরিকাতে
পারসোনাল কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রি বুম সবে শুরু হয়েছে। আই বি এম 5150 এপেলের ম্যাকিণ্টোশ সবে বাজারে
কা্টে বছরে চার পাঁচ লাখ। এছারাও অসংখ্য ছোটখাট সফটোয়ার কোম্পানী আই বি এম
কম্প্যাটিবল বিজনেস এবং গেমিং সফটোয়ার লিখছে। ১৯৮৪ সালের মধ্যেই আমেরিকাতে বড়
ব্যবসাগুলি আস্তে আস্তে আই বি এম মেইন ফ্রেইম এবং ছোট ব্যবসা আই বি এম 5150 নির্ভর হয়ে
ওঠে। এদের সফটোয়ার তৈরী বা মেইন্টেনান্সের
জন্য, ভারতের কিছু কিছু কোম্পানী ভারত থেকেই সাপোর্ট দেওয়া শুরু করেছে। না তখনো
ইন্টারনেট আসে নি। এই বিপুল সম্ভাবনা যাতে অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়, তার জন্য স্যাম
পিদ্রোদার অনুরোধে রাজীব গান্ধী এই শিল্পের ওপরে ইম্পোর্ট ডিউটি কমিয়ে দিলেন।
১৯৮৬ সালের আগে ভারতের
তথ্য প্রযুক্তির ছবিটি আলাদা। তখনো নেহেরু অর্থনীতির রূপরেখায় চলেছে ভারতের আদিম
আই টি প্রযুক্তি। অর্থাৎ তার আগে পর্যন্ত প্রচেষ্টা কিভাবে পাবলিক সেক্টর কোম্পানী খুলে ভারতকে
ইলেক্ট্রনিক্স এবং কম্পিঊটার শিল্পে এগিয়ে রাখা যায়। এই সূত্র ধরে ১৯৭১ সালে
ডিপার্ট্মেন্ট অব ইলেকট্রনিক্সের জন্ম।
ইসিয়াইল বলে একটি পাবলিক সেক্টর
কোম্পানী খোলে ভারত সরকার (১৯৭৮)-যারা TDC 312 /316 নামে দুটি
প্রাগৈতিহাসিক কম্পিউটার ও বানায় সেকালে।
১৯৭৮ সালে ভারত থেকে আই বি এমকে তাড়ায় তৎকালীন জনতা সরকার। তখন ও পর্যন্ত প্রচেষ্টা সেইল বা ভেইল যেভাবে
পাবলিক সেক্টর কোম্পানীর মাধ্যমে, ভারতে স্টিল এবং ভারী ইলেক্ট্রিকাল শিল্প স্থাপন
করেছে, সেই ট্রাকেই চলবে ভারতের আই টির ট্রেইন।
কিন্ত রাজীব গান্ধীর উপদেষ্টা স্যাম পিদ্রোদা,
দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকার সুবাদে বুঝেছিলেন আমেরিকাতে যে পি সি বুম হচ্ছে, তার থেকে
এক বিশাল আউটসোর্সিং সম্ভাবনা বিদ্যমান। ফলে কম্পিউটার এবং সফটোয়ারের ওপর যাবতীয়
ইম্পোর্ট ডিউটি তুলে দিলেন রাজীব গান্ধী। কারন ইসিয়াইএলের কম্পিউটার এবং সফটোয়ারে
ভারতীয়রা শিক্ষিত হলে-বিদেশী মার্কেট ধরা যাবে না । বিদেশী মার্কেট ধরতে শিখতে হবে
মেইন ফ্রেইম বা আই বি এম 5010.
১৯৮৬-৮৮ সাল থেকেই ভারতীয়
সংস্থাগুলি হিসাব পত্র, লেখা, নথিভুক্তিকরন ইত্যাদি কাজের জন্য আস্তে আস্তে
কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু করে। ভারতীয় রেইল, এল আই সি এতে অগ্রনী হয়। ফলে কোলকাতার কিছু কিছু অফিসে কেরানীবাবুদের
চাকরি হারানোর পরিস্থিতি তৈরী হয়। এমন অবস্থায়, জ্যোতিবসুর সরকার জানালেন, তারা
কম্পিউটারাইজেশনের বিরোধিতা করবে। মানুষের চাকরি আগে!
১৯৮৬
সালে যখন আই টি শিল্প সবে উঠছে, জ্যোতি বসুর সিদ্ধান্ত পশ্চিম বঙ্গের আই টি
শিল্পের সম্ভবনা অঙ্কুরে ধ্বংশ করে। পরবর্তীকালে ২০০৪ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য
ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন-বামেরা ঐ সময়
কম্পিঊটার শিল্পের বিরোধিতা করে নির্বোধের মতন কাজ করেছে। পশ্চিম বঙ্গের আই টি
শিল্পের সম্ভাবনায় কুড়ুল মেরেছে। এ স্বীকারক্তি স্বয়ং বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রীর ("That was in the 1970s...that was foolish,
foolish. It started when they were going to introduce computers in banks and
(insurance companies). Their employees protested and we supported it. But how
can you stop modern technology? Nowadays, they have understood...We have
entered a century where industries will be talent-based)
বুদ্ধদেব বাবু মুখ্যমন্ত্রী হওয়া মাত্র কিছুটা
খেলা ঘোরানোর চেষ্টা করেন। তার আমলেই এল সেক্টর ফাইভ, রাজার হাট। তবে তখন ব্যাঙ্গালোর খরগোশ, কলকাতা কচ্ছপ। যদিও
সময়টা বুদ্ধদেবের পক্ষেই ছিল। ১৯৯৮ সালে ভারতের আই টি এক্সপোর্ট দুই বিলিয়ান ডলার,
২০১০ সালে হল ৫০ বিলিয়ান। এই পর্বে ভারতের আই টি শিল্প বেড়েছে দুর্দান্ত গতিতে।
বুদ্ধদেবের নেতৃত্বে পশ্চিম বঙ্গ আস্তে আস্তে হলেও এগোচ্ছিল ।
২০০৭ সালে গোটা ভারতের আই
টি এক্সপোর্ট ছিল ৩৫ বিলিয়ান, পশ্চিম বঙ্গের এক্সপোর্ট সেখানে মোটে ৭০০ মিলিয়ান।
২%।
২০১৭ সালের চিত্রটি বদলায় নি। বর্তমানে পশ্চিম
বঙ্গ থেকে সফটোয়ার এক্সপোর্ট আড়াই বিলিয়ান ডলারের, ভারতের এক্সপোর্ট ১৫০ বিলিয়ান
ডলার। সেই ২% এই আটকে আছে পশ্চিম বঙ্গ। জন সংখ্যার নিরিখে, পশ্চিম বঙ্গ ভারতের জন
সংখ্যার প্রায় ৮%। সেই হিসাবে আই টি
এক্সপোর্টে পশ্চিম বঙ্গের হিস্যা হওয়া উচিত ৮-১০%। কিন্ত তা ২%। অর্থাৎ আই টি শিল্প পশ্চিম বঙ্গে যা হওয়া উচিত
বর্তমানে তার অস্তিত্ব মোটে ১/৫ ভাগ।
(২) বর্তমান ঃ
তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের বেস কি? দক্ষ কর্মী।
অথবা শিক্ষিত মেধাবী ছাত্র, যাদের দক্ষ কর্মীতে পরিণত করা সম্ভব। এর সাথে লাগে ভাল
ইন্টারনেট কানেকশন, একটু ভাল অফিস। এই
শিল্পে কর্মীদের গড় বয়স ২৫-৩৫। অধিকাংশ আই টি কর্মীকে যেহেতু দীর্ঘ সময় অফিসে
কাটাতে হয়-অফিসের পাশাপাশি ভাল রেস্টুরেন্ট, জিমনাসিয়াম, বিনোদনের হরেক জায়গা থাকা
আবশ্যক। তাছাড়া ৯৫%+ ক্লায়েন্ট বিদেশী।
সুতরাং কর্মীদের ইংরেজি শিক্ষার মান অতি উত্তম হওয়া দরকার। সাথে সাথে ধর্মঘট হওয়া
চলবে না-কারন বিদেশী ক্লায়েন্টদের কাছে ধর্মঘট কেন হচ্ছে তা ব্যখ্যা করা সম্ভব না।
এবার আস্তে আস্তে দেখা যাক কলকাতার অবস্থা।
অভিজ্ঞ কর্মী কলকাতায় কম। কিছু কিছু ক্রিটিক্যাল স্কিল যেমন ওয়েব সার্ভিস, বিগ
ডেটা বা ক্লাউড ম্যানেজমেন্টের লোক কলকাতায় মুষ্টিমেয়। কারন যারা অভিজ্ঞ বা মেধাবী, অনেক বেশী মাইনের
চাকরির দিয়ে তাদের টেনে নিয়েছে ব্যাঙ্গালোর হাইদ্রবাদ, পুনে। অভিজ্ঞ ম্যানেজারের ও
অকাল একই কারনে। আর একবার কেউ ব্যাঙ্গালোর বা পুনেতে চলে গেলে কলকাতায় ফিরতে চায়
না-কারন এখানে যেহেতু ভাল শিল্প নেই, চাকরি চলে গেলে অন্য একটা চাকরি পাওয়া কঠিন।
যদিও সবাই স্বীকার করে বর্তমানে কলকাতায় নাগরিক সুবিধা ব্যাঙ্গালোর এবং পুনের থেকে
অনেক ভাল। এই দুটো শহরেই জলের সংকট তীব্র,
ট্রাফিক জ্যামে ত্রাহি অবস্থা। তার থেকে কোলকাতার অবস্থা অনেকটাই উন্নত। কিন্ত
তবুও কলকাতায় ফিরতে চাইছে এমন বাঙালী আই টি কর্মীর সংখ্যা কম। জীবিকা বড় দায়।
অভিজ্ঞ কর্মী এবং ম্যানেজারের অভাবে কোলকাতায়
স্বয়ংসম্পূর্ন বড় আই টি অপারেশন চালানো
কঠিন। স্যাটেলাইট অফিস বসালে কিন্ত লাভ আছে। কারন এখানে আই টি কর্মীদের মাইনা
তুলনামূলক ভাবে প্রায় ৫০% কম। যেহেতু ব্যাঙ্গালোর বা পুনের তুলনায় কোলকাতায় ঘর
ভাড়া, খাওয়া, বাস ভাড়া এখনো সস্তা। সেক্টর ফাইভে ফুটপাতের ঝুপড়িগুলো যেদামে খাবার
দেয় এখনো, ব্যাঙ্গালোরে ওসব সম্ভব না।
তবে সুবিধা এই যে এই শহরের ইন্টেলেকচুয়াল বেস
এখনো স্ট্রং। ইংরেজি শিক্ষার হাল ভারতের অন্যান্য শহরের থেকে এখনো ভাল। বড় নামি এম এন সি নেই। ফলে দক্ষ কর্মীদের
তুলনামূলক ভাবে ঠিক ঠাক মাইনে বা সুযোগ সুবিধা দিলে রেখে দেওয়া সম্ভব।
ব্যাঙ্গালোর এবং পুনেতে
অন্যান্য শহর থেকে আসা ভ্যাগান্বেশী ছোকরাদের ভীর। এরা এসেছে টাকার টানে। এর ভাল খারাপ দুটো দিকই দেখি। এইসব
ছেলেমেয়েগুলো অনেক বেশী চৌকস, প্রচুর স্কিল শেখে আরো মাইনের চাকরির আশায়। তুখোর প্রফেশনাল। কিন্ত কোম্পানীর প্রতি
লইয়ালিটি কম। ছমাস থেকে এক বছরের মধ্যে বেশী মাইনে নিয়ে অন্য কোম্পানীতে লাফ দেবে।
তুলনায় কলকাতার আই টি
শিল্পের কর্মীরা অতটা দক্ষ বা প্রফেশনাল না। এবং অতটা লোভীও না। ফলে সাধারনত এরা
একটা কোম্পানীতে অনেকদিন টেকে। যেটা কোম্পানীর জন্য ভাল।
তৃনমূল সরকার ক্ষমতায়
আসার পরে বন্ধ বন্ধ খেলাটি কলকাতায় বন্ধ। কলকাতায় ব্যবসা স্থাপনের জন্য এটা ছিল সব
থেকে বড় শর্ত। স্ট্রাইক বন্ধ করতে হবে। দিদি সেটা সাফল্যের সাথে করেছেন। বন্ধ নামক ওই বামপন্থী ছেলেখেলাটি বন্ধ না হলে,
আমি প্রথমেই লিখে দিতাম ভবিষ্যত শুন্য। কিন্ত এখন কলকাতায় রাজনৈতিক সমস্যার কারনে
বন্ধ বা লেবার স্ট্রাইক সব থেকে কম। সুতরাং শিল্প স্থাপনের নুন্যতম শর্তটি কলকাতায়
এখন বিদ্যমান।
(৩) ভবিষ্যত ঃ
প্রশ্ন হচ্ছে ভবিষ্যত কি?
ভবিষ্যতে আই টি ঝুঁকছে এন্যালাইটিক,
এম্বেডেড সিস্টেম, আই ও টি,মোবাইল ওয়েব সার্ভিসের দিকে। এর মধ্যে ওয়েব সার্ভিস/ বিগ ডেটা বাদ দিয়ে, বাকী
স্কিলগুলি কলকাতায় বিরল না। একটা বেস আছে। তবে বিগ ডেটা এখন ফ্যাক্টর না- মাইক্রোসফট এজিওর
বা আমাজন ওয়েব সার্ভিস এখন এত সুন্দর-বিগ ডেটা কিছু না জেনেও সম্পূর্ন ভাবে মাইক্রোসার্ভিস
দিয়ে ওয়েব সার্ভিস আরো ভাল ভাবে দেওয়া সম্ভব। ফলে বিগ ডেটা স্কিলের অভাবে আগে যেসব
কাজ কলকাতায় করা সম্ভব ছিল না-বর্তমানে মাইক্রোসফট বা আমাজন বা আই বি এম
প্ল্যাটফর্মের দৌলতে সেসব কাজ করা কঠিন না। এবং কোলকাতায় অনেক ছোট ছোট কোম্পানী
সেই কাজ ধরছেও।
কিন্ত অসুবিধা অন্যত্র।
প্রথমত কলকাতায় প্রযুক্তির ইকোসিস্টেমটাই খুব
দুর্বল। ইকোসিস্টেম মানে কাস্টমার থেকে ডেলিভারি ফ্লো। ছোট এবং মাঝারি
কোম্পানীগুলোর একটা বা দুটো ভাল ক্লায়েন্ট, তাই দিয়ে চলে। এদের ক্যাপিটাল এত কম, না
ইনভেস্ট করতে পারে মার্কেটিং সেলসে, না ডেলিভারি টিম বাড়াতে। না নতুন কোন
প্রোডাক্টে ইনভেস্ট করতে।
দ্বিতীয়ত বড় কোম্পানীগুলোও অটোমেশন এবং
ট্রাম্পের ধাক্কা সামলাতে চোরাগোপ্তা ছাঁটাই করছে। সেখানে সামনে কোন গ্রোথ নেই।
গ্রোথ সম্ভব ছোট ছোট এইসব মোবাইল বা আনালাইটিক শপ গুলোতে। স্মল এবং মিডিয়াম স্কেল বিজনেসে। কিন্ত এই ধরনের
ছোট ব্যবসা গুলোর সমস্যা এই, এখানে পাঁচ হাজার জনের কর্ম সংস্থান হতেও দুশোর বেশি
ব্যবসা দরকার।
সেক্টর ফাইভে মেরে কেটে
পঞ্চাশের মতন সংস্থা আছে, যারা উচ্চপ্রযুক্তির সাথে জড়িত। এগুলির স্থপতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রবাসী বাঙালী
প্রযুক্তিবিদরা। খুব ভাল, উচ্চমেধার কোম্পানী এগুলি। এদের মধ্যে আছে- সম্রাট
গাঙ্গুলীর জাংশন টিভি ( টিভি স্ট্রিমিং প্রযুক্তি), অনি সীলের ডেটা বাজার ( যা
বিদেশে ইকমার্স প্রযুক্তি দেয়), রেবেকা সফটোয়ার ( যারা ভিডিও প্রযুক্তিতে
আন্তর্জাতিক মানের কাজ করে) । এরকম আরো
আছে অনেকে। এদের সমস্যা এগুলি খুব নিশ এরিয়া, যতই চান না কেন তারা জনা পঞ্চাশের
বেশী কর্মীর সংস্থান করতে পারবেন না।
বাকী অধিকাংশ ছোট সংস্থাগুলি,
যাদের মালিকানাও স্থানীয়- মোবাইল, ওয়েব ডিজাইন, এস ই ও-এইসব করেই চালাচ্ছে। এখানে
ভাল মাইনের সংস্থান সম্ভব না। ফলে ছোট ছোট
উচ্চ প্রযুক্তির সংস্থা যে সংখ্যায় হলে, বড় কোম্পানীগুলির ছাঁটাইকে অফসেট করবে-সেই
সংখ্যা অনুপস্থিত।
তৃতীয় সমস্যা স্টার্টাপ সিস্টেমের অভাব। এটা
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের। এখানে আই আই টি খরগপুর, যাদবপুর, শিবপুরের মতন প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয় আছে, মারোয়ারীদের ক্যাপিটাল আছে-কিন্ত দুই দুই চারের যোগ হচ্ছে না।
দুটো কারন।
(১) ভারতের সর্বত্রই বাড়ি
জমির দাম যেভাবে হু হু করে বারে, হাতে বর্ধিত পুঁজি থাকলে, সবাই তা জমিতেই পুঁতে
দেয়। ভারতে জমির দাম যা হওয়া উচিত মার্কেট
ভ্যালু তার দশগুন। বাড়ি ভাড়া একটা এসেট ইনকামের বেস ধরলে, বাড়ি/ ফ্ল্যাটের দাম অন্তত পাঁচগুন বেশী। এই
উর্ধগতির কারনে মাড়োয়ারী বিজনেস ক্লাসের ক্যাপিটাল নতুন প্রযুক্তি ত দূরের কথা,
তারা নিজেদের ফ্যাক্টরি ইনোভেশনেও টাকা ঢালে না। সব বাড়ী, জমিতে ঢেলেছে। গত তিন
বছরে কলকাতার রিয়াল এস্টেটের দাম কমছে। ডিমনেটাইজেশন, জি এস টির ফলে এখন কোলকাতার
রিয়াল এস্টেট মার্কেট শুয়ে যাওয়ার যোগাড়। ফলে আশা করা যায় এখন আস্তে আস্তে
কোলকাতার মারোয়াড়ীরা প্রযুক্তি ব্যবসায় আরো বেশী আসবেন।
আমেরিকাতে বাড়ি জমির থেকে
ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, অনেক বেশী হট পপার্টি। ভারতে ইন্টেলেকচুয়াল পপার্টি এখনো
নগন্য। সুতরাং নতুন প্রযুক্তির ব্যবসায় লোকে তবেই টাকা ঢালবে যখন জমি-বাড়ির দাম
সম্পূর্ন ক্র্যাশ করবে।
জমি বাড়ি থেকে বিজনেস
ক্যাপিটালের আউটফ্লো, প্রযুক্তি ব্যবসার উন্নতির অন্যতম প্রথম শর্ত। সেটা আস্তে
আস্তে হচ্ছে-বিশেষত এই ডিমনেটাইজেশনের পরে।
(২) আই
আই টি খরগপুর সহ ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং একাডেমিক্সের সর্বত্র এক সমস্যা। ল্যাবেরটরি
থেকে প্রোডাক্টকে মার্কেটে আনার ট্রাক রেকর্ড খুব দুর্বল। আই আই টি খরগপুর সব সময় পেপার পাবলিকেশন বা
ডিফেন্স কনসাল্টিং ইত্যাদিতে যা জোর দেয়। কোন ইঞ্জিনিয়ারিং উদ্ভাবনকে মার্কেটে
আনার ব্যপারে সাপোর্ট সিস্টেম খুব দুর্বল। প্রায় নেই। শিবরাত্রের সলতে স্টেপ বলে
একটি আন্তারপ্রেনার সেল, যা ক্যাম্পাসের বাইরে স্টেপ চাইল্ডের মতন অবহেলিত। সেই
১৯৯৫ সালে আই আই টিতে স্টেপ বা টেকনোয়ান্তারপ্রেনার পার্ক তৈরী হয়েছে, কিন্ত এই
দীর্ঘ ২২ বছরে, ওখান থেকে আই আই টি উদ্ভাবিত কোন প্রযুক্তি মার্কেটে গেছে কি না
সন্দেহ। প্রায় প্রতি মাসেই দেখি আই আই টি খরগপুরে কোন না কোন ভাল কাজ, খবরে
আসে। কিন্ত সব হারিয়ে যায়-কোন উদ্ভাবনই
মার্কেটে আসে না। কারন কিভাবে একটা গবেষনালদ্ধ প্রোডাক্ট মার্কেটে আনা যেতে পারে,
সেই ব্যপারে আই আই টিতে অধ্যাপকদের কোন ধারনা নেই। কোন পেশাদা্রি ওর্গানাইজেশন ও
নেই যে এব্যপারে ওদের সাহায্য করবে। ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরাও সেই উদ্যোগের সাথে
যুক্ত না।
সিলিকন ভ্যালি স্টাটাপ
সিস্টেম গড়ে উঠেছে, স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। বোস্টন স্টার্টাপ
সিস্টেম এম আই টিকে কেন্দ্র করে। এম আই টির ছাত্র গবেষকদের জন্য ভিসি ফান্ডিং প্রায়
দুই বিলিয়ান ডলারের। সেখানে আই আই টি খরগপুরে কিছু ব্যতিক্রমি ছাত্রছাত্রীরা যদিও
বা স্টার্টাপ করে, তাদের জন্য পেশাদারি ফান্ডিং প্রায় নেই। আই আই টি খরগপুরে গবেষনার অপচয় হতেই থাকবে,
যদ্দিন না এই স্টার্টাপ ইকোসিস্টেম বানানো সম্ভব।
(৪) তাহলে সামনে উপায় কি?
টানেলের শেষে শুধুই অন্ধকার?
আমি কিন্ত প্রচুর আলোই দেখছি। শুধু দরকার একটু
সরকারি বেসরকারি সদিচ্ছা।
প্রযুক্তি বা ইঞ্জিনিয়ারিং জাস্ট একটা টুল।
এখন এত প্ল্যাটফর্ম এসে গেছে, দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের দরকার অনেক কম। বা অনেক কম সময়
এবং কম কর্মী দিয়ে ভাল প্রোডাক্ট বানানো সম্ভব। সুতরাং কলকাতায় আগে আই টি স্কিলের অভাবের জন্য যে সমস্যা ছিল-সেটা
কিন্ত বর্তমানে বাধা হবে না। বরং বর্তমানে দরকার সেই সব ছাত্রছাত্রীদের যাদের কোর
ইঞ্জিনিয়ারিং নলেজ গভীর, উদ্ভাবন করতে সক্ষম, আর্টসে ভাল দখল। কলকাতা আর্টস এবং
ডিজাইন সেন্সের জন্য এখনো উত্তম। সুতরাং ভবিষ্যত আই টি প্রোডাক্টের বেস কিন্ত
এখানে বেশ শক্ত। শুধু ইউটিলাইজেশন খুব দুর্বল-ইকোসিস্টেম নেই।
কলকাতায় যারা ছোট ছোট ওয়েব, মোবাইল, আনালাইটিক
আউটসোর্সিং এর শপ খুলেছেন -হয়ত খুব লো টেক-কিন্ত শুরুটা তাদের সাথেই করতে হবে।
শঙ্কু বোসের ফ্রেইন্ডস অব বেঙ্গল উদ্যোগে অনেক প্রবাসী বাঙালীর দেখা পেলাম, যারা কলকাতাকে
বেস করতে চাইছে, নতুন উদ্যোগে নামতে ইচ্ছুক। এইসব প্রবাসী উদ্যোগপতিদের সাথে কলকাতায় যারা
আলরেডি ছোট ছোট আই টি শপ খুলে বসে আছেন, তাদের সেতু বন্ধন জরুরী।
আমি যখন কলকাতাকে আমার
আউটসোর্সিং বেস করি ২০১২ সালে, প্রথমেই আমরা বড় অফিস খুলি নি। তিনমাস আমি কলকাতায়
ছিলাম নানান ধরনের এইসব ক্ষুদ্র উদ্যোগপতিদের সাথে পরিচিত হতে। আমেরিকা থেকে আনা
অধিকাংশ প্রজেক্ট এদের দিয়েই করাতাম আগে। কেউ ইলেকট্রনিক্সটা করে দিত, কেউ মোবাইল
বা ওয়েব। আমরা শুধু ইন্ট্রিগ্রেশন এবং টেস্টিং করতাম। তারপরে আস্তে আস্তে নিজেদের টিমটা অনেক
বাড়িয়েছি। সুতরাং যেসব প্রবাসী বাঙালীরা
কলকাতায় শিল্প স্থাপনে ইচ্ছুক, তাদের প্রথমেই অফিস খোলার দরকার নেই। বরং এই সব ছোট
ছোট স্থানীয় উদ্যোগপতিদের সাথে পরিচিত হোন।
তাদের ম্যানপাওয়ার স্কিল ব্যবহার করে নিজের প্রোডাক্ট বা ব্যবসা শুরু করুন। এই কাজটা সহজ। কারন এইসব ছোটখাট শপ গুলোর
সমস্যা এই যে এরা আমেরিকান বা বিদেশী ক্লায়ন্টদের কাছে কাজ পায় আপ ওয়ার্ক বা ওই
জাতীয় সাইটগুলো থেকে। বিদেশে গিয়ে সেলস মার্কেটিং করার ক্ষমতা এদের নেই। বিদেশে কোন প্রোডাক্ট চলতে পারে সেই ধারনাও
নেই। সুতরাং বিদেশে চলতে পারে এমন
প্রোডাক্ট আইডিয়া থাকলে, তার পেছনে দশ বিশ হাজার ডলার ঢেলে প্রবাসীরা যদি নামে, কলকাতার
আই টি চিত্র বদলাবে দ্রুত।
তবে সমস্যা এই যে প্রবাসী বাঙালী দুশো হাজার
ডলার খরচ করে সাউথ সিটি বা রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনবে কিন্ত কুড়ি হাজার ডলার খরচ করে
কোন প্রোডাক্ট বানাবে না-যার থেকে সে দুই মিলিয়ান ডলার তুলতে পারে। যেহেতু রিস্ক
আছে। এখানেও সেই রিয়াল এস্টেটের উর্ধগতির গল্প। সৌভাগ্য এই যে রিয়াল এস্টেটের গরু
আর গাছে উঠবে না। আশা করা যায় এবার বদলাবে পরিস্থিতি।
সাথে সাথে পশ্চিম বঙ্গের
স্কুল শিক্ষার আমূল পরিবর্তন দরকার। এখনো সেই পাশ ফেইল, পরীক্ষায় পাশ করার জন্যে
পড়লে, কোন উদ্যোগপতি পাওয়া যাবে না। দরকার আল রাউন্ড প্রাক্টিক্যাল শিক্ষা।
নেতৃত্ব, ইনোভেশন, ছোটবেলা থেকেই সফটোয়ার বা হার্ডোয়ার শিল্পের সাথে পরিচিত হওয়া
দরকার স্কুল ছাত্রছাত্রীদের। বর্তমান
শিক্ষা ব্যবস্থা যদ্দিন চালু থাকবে, তদ্দিন কদ্দুর কি হবে বলতে পারছি না। কারন
যেসব ছাত্র বিটেক করে বেড়োচ্ছে, তারা আন্তারপ্রেনারশিপ ত দূরে থাক, বর্তমান
ইঞ্জিনিয়ারিং কাজের জন্যই যোগ্য না।
কলকাতায় সেজের দরকার অবশ্যই। আশা করব মাননীয়া
মুখ্যমন্ত্রী সেটা দ্রুত বুঝবেন। তবে ইনফি, উইপ্রো, টিসিএস এরা কলকাতার আই টি
চিত্র উজ্জ্বল করবে-সেই দৃশ্যের যবনিকা সমাপ্ত ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়ের সাথে
সাথে।
সুতরাং এখন এই সব
প্রোডাক্ট বেসড ছোট ছোট টেক শপগুলিই ভবিষ্যতের ভরসা। এই ইকোসিস্টেমটা কি করে বড় করা যায়, সেটাই
দেখতে হবে। গোটা বিশ্ব সেই দিকেই এগোচ্ছে। এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে আলাদা করে
কিন্ত বাঁচার সুযোগ নেই।