Monday, November 12, 2012

ওবামার জয় পরাজয়

-বিপ্লব

  সব জয়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের পরাজয়।  সব বিজয় উৎসবই আনন্দমুখর -আবার একই সাথে আগামী দুর্যোগের আভাস!

   ওবামার জয় যে নিশ্চিত সেটা আমি আগের প্রবন্ধে লিখেছিলাম।  প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটেই জিতলেন। ১০ টা সুইং স্টেটের ৮ টাই তার সাথে এল।  কিন্ত তার সাথে সাথে আমেরিকান সমাজের জাতি বিভাজন সাংঘাতিক ভাবে সামনে এল-যা আমার মতে অশনি সংকেত।

  সাদা আমেরিকান পুরুষদের মধ্যে ওবামা ২৩% মাত্র ভোট পেয়েছেন!  একজন সামান্য কর্মচারী বা শিক্ষক যখন শুধু ধর্ম বা সাদা চামড়ার জন্য রমনিকে ভোট দেন, সেটা নিসঃন্দেহে চিন্তার রেখা।


                    তবে আশা রেখেছেন মেয়েরা। দেখা যাচ্ছে মেয়েদের মধ্যে ৫৪% ভোট পেয়েছেন ওবামা। আবার সেটা যদি অবিবাহিত নারীদের মধ্যে দেখা যায়, দেখা যাবে, ওবামা পেয়েছেন ৭০% এর বেশি ভোট।  আর বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে ওবামা ডাউন-সেখানে ওবামা পেয়েছেন ৪৫% এর মতন।  এই ঘটনা বিবাহিত মেয়েদের স্বার্থপরতার সূচক। কেন সেটা বলি।  অধিকাংশ অবিবাহিত বা সিঙ্গল মেয়েরা ওবামাকে ভোট দেবেন এটা স্বাভাবিক । এর কারন রিপাবলিকানরা গর্ভনিরোধের এবং তজ্জন্যে রাষ্ট্রের খরচের ঘোর বিরোধি।  আমেরিকাতে সিঙ্গল মেয়েদের জন্য গর্ভনিরোধকের ব্যবস্থা খুবী প্রয়োজনীয়-কারন তারা ত আমাদের রক্ষণশীল সমাজের অবিবাহিত বা ডিভোর্সি মেয়েদের মতন লক্ষী হয়ে ঘরে বসে হাহুতাস করে না। তাদের এক বা একাধিক পুরুষ বন্ধু আছে এবং অসংযত সহবাসের কারনে গর্ভধারন করাটা এদের নিত্য দুর্ভোগ। কিন্ত এর পরে রাষ্ট্র যদি প্ল্যান্ড পেরেন্ঠুড বা গর্ভনিরোধক সংস্থাগুলিকে বন্ধ করার পরিকল্পনা  নেয়, যা দুর্ভাগ্যবশত রিপাবলিকানদের এজেন্ডা খুব স্বাভাবিক কারনে সিঙ্গল মেয়েরা, ওবামাকে ভোট দিতে বাধ্য। এতে আশ্চর্য্য কিছু নেই। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে ওবামা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন না কেন?  এর একটাই কারন থাকতে পারে। সেটা হচ্ছে বিবাহিত মেয়েরা গর্ভনিরোধক ক্লিনিক গুলোর অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তিত না-যেহেতু, তাদের জীবনে জন্যে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন কি করে তারা চাকরি রাখবেন বা ফ্যামিলির উপায়ের প্রশ্ন বড় ছিল। আর চাকরির প্রশ্নে ওবামা রমনির চেয়ে একটু পিছিয়েই ছিলেন। অর্থাৎ  দেখা যাচ্ছে বিবাহিত মেয়েরা ফেমিনিস্ট এজেন্ডা দিয়ে চালিত হন না। তাদের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ন পরিবারের অর্থনীতি।

   এবার দেখা যাচ্ছে ওবামা ল্যাটিনোদের ৭৭% আর কালোদের ৯১% ভোট পেয়েছেন।  ল্যাটিনো কমিউনিটি সরাসরি ডেমোক্রাটদের হাতে এখন। বুশের আমলে এমন ছিল না।  এর মূল কারন রিপাবলিকানরা ড্রিম আক্টের বিরোধি যা আমেরিকাতে জন্মানো অবৈধ ল্যাটিনো সন্তানদের সিটিজেনশিপ দিত।  খুব স্বাভাবিক কারনেই ল্যাটীনোরা রিপাবলিকানদের ওপর খাপ্পা।  এশিয়ানদের মধ্যেও ওবামা ৬৫%।

  অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সাদা আমেরিকান বনাম বাকীদের মধ্যে পার্থক্য তৈরী হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক। কারন সাদা আমেরিকান বলেত কিছু নেই। সবাই এসেছে জার্মানী, ইটালি, আয়ারল্যান্ড ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশ থেকে। এদেশটাই অভিবাসিদের দেশ। এখানে গায়ের চামড়ার রঙে দেশটা ভাগ হবে এমনটা দুর্ভাগ্য জনক। যেসব সাদারা ওবামাকে ভোট দিয়েছেন, তারা উচ্চশিক্ষিত, লিব্যারাল এবং শহুরে। এখানে গ্রামে সাদাদের বাস বেশি। সেখানে প্রায় ৯০% গ্রামে ওবামা হেরেছেন।  ওবামা কৃষকদের শত্রু এমন না। বরং গত কয়েক বছর চাষীদের ইনকাম বেড়েছে আমেরিকাতে। কিন্ত কি অদ্ভুত-দেখা যাচ্ছে ওবামাকে শত্রু ভাবা হল শুধু গায়ের রঙের জন্য! এ ধরনের বর্ণবিদ্বেশ একবিংশ শতকের আমেরিকাতে অনভিপ্রেত!

   এমনিতে আমি থাকি মেরীল্যান্ডের মতন লিব্যারাল স্টেটে।  এখানে বর্ণ বিদ্বেশের ছাপ নেই। কিন্ত কিছু কিছু রাজ্যে ওবামা ২০% এর কম ভোট পেয়েছেন!  এই সব রাজ্যে জন কেরির বা বিল ক্লিণটন ৪০% পেতেন।  এই সব রাজ্যগুলিকে এখানে রেড নেক বলে। এরা সাদা চামড়ার উৎকৃষ্টতার গল্পে গর্বিত।

  ওবামার বিরুদ্ধে প্রচুর নেগেটিভ প্রচার ছিল আমেরিকার ইনসিউরান্স, হেলথকেয়ার, এনার্জি কোম্পানীগুলির।  সারাক্ষন টিভিতে এদের লবির ওবামা বিরোধি প্রচার। এরা হচ্ছে সাদা কলারের আমেরিকারন চোর ডাকাত। সরকার এবং আম আদমিকে লুঠ করে এরা পয়সা বানাতো। ওবামার নতুন হেলথকেয়ার আইন এবং এনার্জি পলিসির জন্য, এদের  অবাধ লুঠের ব্যাবসায় ঘন্টা বাজছে।  আর সেই লুঠকে বৈধ করার জন্য এরা জাতি, গায়ের রং এবং ধর্মের তাস খেলে।  আমেরিকার হেলথকেয়ার হচ্ছে ক্রনি ক্যাপিটালিজমের নিকৃষ্ট উদাহরন যে কিভাবে বৃহৎ ব্যবসার লুঠ তরাজ চালানোর জন্য মানুষের মনে যে জাতিগত বা ধর্মগত সুরসুড়ি আছে তাকে কাজে লাগানো হয়।  শেষমেশ ওবামা এদের প্রতিহত করতে পারলেও, আমেরিকান পার্লামেন্ট বা যা আমেরিকান কংগ্রেস ( হাউস অব রিপ্রেসেন্টেটিভ)  নামে খ্যাত সেখানে কিন্ত রিপাবলিকানরা আবার ব্যাপক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেয়েছেন। হাউসের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের থেকে কম কিছু না। তারাই বিল বানায়।  ডেমোক্ত্রাটদের এই হারের কারন তারা নিজেরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডেমোক্রাট পার্থীদের মধ্যে দুঃশ্চরিত্র এবং অসৎ লোকেদের বেশি সমাহার। আমি নিজে লিব্যারাল হলেও অসৎ লিবারাল পার্থীদের ত কেও ভোট দেবে না। আর আমেরিকানদের মধ্যে সেই ডেমোক্রাট এবং রিপাবলিকান হার্ড সাপোর্টার ব্যাপারটাও হারিয়ে যাচ্ছে। বরং অধিকাংশ লোকই দুই পার্টির ওপর খাপ্পা।

 যাইহোক ওবামা স্বস্তিতে থাকবেন না। এখন আমেরিকান রাজনীতি ধণতন্ত্র বনাম মধ্যপন্থীদের যুদ্ধক্ষেত্র।  কেওই শেষ কথা বলবেন না-কারন সেরকম হলে, আমেরিকার অর্থনীতিই শেষ কথা বলে দেবে। 

Sunday, October 28, 2012

আমেরিকান নির্বাচন ২০১২



(১)
আমেরিকান নির্বাচন হয় প্রতি চার বছর অন্তর। গোটা পৃথিবী আমেরিকার ওপর এত নির্ভরশীল, আমেরিকান নির্বাচনের প্রভাব পড়ে প্রতিটা দেশে।  এই অর্থনৈতিক ডামাডোলের বাজারে আমেরিকার গুরুত্ব আরো বেড়েছে। কারন চীন, ভারত, জাপান সহ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশের বৈদেশিক সঞ্চয় জমা আছে আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভে। আমেরিকান সরকার বাহাদুরের যখন ডলারের প্রয়োজন হয়, সে ডলার নেয় ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে। বিনিময়ে ফেডারেল রিজার্ভ পায় সরকারি বন্ড।  এই বন্ড ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে কেনে ভারত, চীন, জাপান সহ বহুদেশ। তাদের অর্থভান্ডার সুরক্ষিত করতে। সুতরাং আমেরিকা দেউলিয়া মানে পৃথিবী দেওলিয়া হবে। ভারতের কথা ধরা যাক। ভারত সরকারের আনুমানিক আশি বিলিয়ান ডলার বা ৪০০,০০০ কোটি টাকা জমা আছে ফেডারেল রিজার্ভে। চিনের আছে তিন ট্রিলিয়ান ডলারের বেশি।

 প্রশ্ন উঠবে ভারত বা চীন তাদের ডলার কেন বিক্রি করে দিচ্ছে না? তাহলেই ত আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কমে। উঁহু সেটি হচ্ছে না। কারন ভারত যে মুহুর্তে ডলার বিক্রি শুরু করবে, টাকার দাম ্বাড়তে থাকবে। এবার টাকার দাম ডলার প্রতি ৩০ এ নেমে এলে,  আউটসোর্সিংই বন্ধ হয়ে যাবে। চীনের ও একই হাল। চীনের কারেন্সির দাম কমানোর একমাত্র উপায় সঞ্চিত ডলার আমেরিকাতেই জমা রাখা। এই ভাবেই ডলারএর দাম এত বেশী-যার পুরোটাই ফানুস।

১৯৭১ সালে গোল্ড বা সোনার স্টান্ডার্ড থেকে সরে আসে ডলার। এর পর থেকেই শুরু হয়েছে এই বিশাল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার। ১৯৭১ সালের আগে আমেরিকান ডলার বাঁধা থাকত সোনা বা ফেড়ারাল গোল্ড রিজার্ভের কাছে। ১ আউন্স সোনার দাম ৩১ ডলার। অর্থাৎ আমেরিকান সরকার ইচ্ছা করলেই ডলার ছাপাতে পারত না।  রিচার্ড নিক্সনের সময় আমেরিকান সরকার বুঝতে পারে ডলারের বিনিময়ে সোনার দেওয়ার ক্ষমতা ফেডারেল রিজার্ভের নেই। ডিক্রি দিয়ে ডলারকে সোনা মুক্ত করা হয়। ফলে যে কারেন্সির যুগে আমরা বাস করছি, তাকে বলে ফিয়াট কারেন্সি-অর্থাৎ ডলার বা টাকার দামের পেছনে কোন গ্যারান্টি নেই। সরকার বন্ড ছেরে ডলার ছাপাতে পারে । মানে ঘাটতি মেটাতে  ইচ্ছা মতন ডলার প্রিন্ট করলেই হল।  সুতরাং ভার‍ত চীন সহ পৃথিবীর সব দেশে তাদের এত কষ্টের অর্জিত সম্পদ যে ডলারে জমা রেখেছে, তা পুরো লোপাট হয়ে যেতে পারে যদি আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রীস বা পর্তুগালের মতন পপুলিস্ট এজেন্ডাতে চলে রাজকোষ ফাঁকা করতে থাকে। এখানেই আমেরিকান নির্বাচনে মহাগুরুত্ব।

আজকে গ্রীস থেকে পশ্চিম বঙ্গ, ভারত, আমেরিকাতে সরকারের যে বাজেট ঘাটতি বা ডেফিসিট সমস্যা -তার শুরু এই ফিয়াট কারেন্সি থেকে। ফিয়াট কারেন্সি কি মারাত্মক অর্থনৈতিক সিস্টেম সেটা না বুঝলে আমরা বুঝবো না আমেরিকা, ভারত, গ্রীস  সহ সব দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সঙ্কটটা আসলে কি। আসলে বর্তমানে সব দেশেই চলছে একধরনের পঞ্জি স্কিম। ধার করে আগের ধারের সুদের টাকা মেটানো।  সেটাও যখন সম্ভব হয় না যেমন গ্রীসে হয়েছে, তখন দেশটা পুরো শেষ।  পশ্চিম বঙ্গে মমতা সরকারের ও একই হাল। তারা যে টাকা ধার করে, যা চলে যাচ্ছে আগের ধারের সুদ দিতে। এই অবস্থা এখন পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের। এবং এর মূল হচ্ছে গোল্ড স্টান্ডার্ড থেকে ফিয়াট কারেন্সিতে সরে আসা।

কিন্ত আসলে আমেরিকার কেন্দ্র থেকে ব্যাপারটা কি হচ্ছে?

 আমেরিকা যত রফতানি করে, তার থেকে দ্বিগুন আমদানি করে। ফলে চীন, জাপান, ভারত, জার্মানী সব দেশেই জমা হচ্ছে ডলার। এই সব দেশের কাছে এই ডলার গুলো হচ্ছে শাঁখের করাত। যদি এরা নিজেদের কারেন্সিতে ভাঙাতে যায়, তাহলে তাদের কারেন্সির দাম বেড়ে যাবে। অর্থাৎ এখন ৫০ রুপি = ১ ডলার নেমে আসবে ৩০ রুপিতে। এতে ভারতের রফতানি বাণিজ্য বসে যাবে। ফলে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই ডলার আমেরিকান বন্ডে বিনিয়োগ করে-যাতে টাকার দাম ঠিক ঠাক থাকে রফতানির জন্য। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা দেশই এই ভাবে ফেডারেল রিজার্ভে  নিজেদের কষ্টাপার্জিত     ডলার জমা রাখে।

আর সেই টাকা খায় কে? আমেরিকান রা। কারন এই যে ডলারটা চিন বা ভারত দিচ্ছে, সেটা যাচ্ছে আমেরিকার রাজকোষের ঘাটতি মেটাতে। আর তার বড় অংশ যাচ্ছে আমেরিকান বুড়োদের বাঁচিয়ে রাখতে এবং আফগানিস্থানে ড্রোন দিয়ে মোল্লা মারার জন্যে হাইটেক পুতুল বানাতে  ।

যদি এই টাকা আমেরিকা গবেষণা বা নিজেদের ইনফ্রাস্টাকচারে বিনিয়োগ করত-তাহলে চীন, জাপান বা ভারতের জমা হওয়া ডলার সুরক্ষিত থাকত। কারন এই ধরনের গবেষণা থেকে আরো নতুন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আসত-তাতে আমেরিকার জিডিপি বাড়ত। এবং ধার করে আমেরিকাকে এই ধার শোধ করতে হত না।  কিন্ত তার বদলে এই টাকাটা যাচ্ছে যুদ্ধ করতে আর বুড়োদের বাঁচিয়ে রাখতে। ডিফেন্স আর হেলথকেউয়ার আমেরিকার সব থেকে বড় শিল্প এখন -কোটি কোটি লোকের জীবিকা। এবং তাদের ডলারটা কিন্ত আসছে চীন জাপান থেকে।  আমেরিকা এদেরকে মাইনা দিচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে।     এই ভাবে ত জিডিপি বাড়ে না।  ফলে একটা বিরাট অর্থনৈতিক বম্বের ওপর আমরা বসে আছি। যা আমেরিকাত ত বটেই -গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ধ্বংশ করতে সক্ষম।

(২)
আমেরিকার ২০১২ এর নির্বাচন বুঝতে ওপরে ব্যাপারটা বোঝা জরুরী। কারন আমেরিকা আসলে খাচ্ছে নাচছে স্ফূর্তি করছে অন্যের ইনকামে। এখন আমেরিকার ধার ১৬ ট্রিলিয়ান ডলারের ওপরে। যদি এই ভাবে আমেরিকার রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে থাকে খুব স্বাভাবিক কারনেই চীন সহ সব দেশ আমেরিকান বন্ড কিনতে চাইবে না। কারন আমেরিকার দেউলিয়া হয়ে গেলে এদের সব সঞ্চয় জলে যাবে। আর আমেরিকান বন্ড বাজারে না চললে পথে বসবে আমেরিকান সরকার। সরকারী কর্মচারীদের মাইনে পর্যন্ত দিতে পারবে না।  

ফলে এবারে নির্বাচনে মুখ্য ইস্যু এই দুটি- বাজেট ঘাটতি এবং বেকারত্ব। সরকারি ভাবে বেকারত্বর হার এখানে এখন ৮% এর কাছে, বেসরকারি সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হবে।  এর পরেও আছে। গত দশ বছরে প্রতিটা আমেরিকান ফ্যামিলির ক্রয় ক্ষমতা এবং ইনকাম কমেছে প্রায় ৫% এর কাছে। ১৯৭০ সাল নাগাদ আমেরিকাতে শুধু পুরুষরাই চাকরি করত এবং সেটা করেও তারা গড়ে ৪-৫ জন সন্তান মানুষ করেছে। বর্তমানে স্বামী স্ত্রী দুজনকেই চাকরি করতে হয়। তার পরেও সংসার চলে ক্রেডিক কার্ডে!  এর মূল কারন যেসব চাকরিগুলো মোটামুটি ভাল ছিল, সেগুলো এখন চীন এবং ভারতে। ফলে আমেরিকানরা তাদের বেকারত্বর জন্যে চীন এবং ভারতকেই দুষছে।  চীনকে দেখে নেব, এমন ডায়ালোগ  মিট  রমনি অহরহ মারছেন। বাস্তব হল, রমনির কোম্পানী বেইন ক্যাপিটাল সেই সব কোম্পানীতেই বিনিয়োগ করে যারা আউটসোর্সিং করে বেঁচে আছে!  ফলে ওবামা ক্যাম্প রমনির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে বারে বারে।

আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা যে তস্য বাজে সে নিয়ে সন্দেহ নেই। বাজেটে ছাঁটাই করতেই হবে। কিন্ত ট্যাক্স বাড়ানো যাবে না। আবার বাজেট ছাঁটাই মানে চাকরি ছাঁটাই। মাথায় ঘোমটা টানতে গেলে পাছা র  কাপড় ওঠে। আবার তার মধ্যে ডিফেন্স ধরে রেখে দাদাগিরিও বজায় রাখতে হবে। ফলে এই ইলেকশনে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই দুটো জিনিসই বারবার ফিরে আসছে-কি করে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে ধার কমানো যায়। আর কি করে আমেরিকাতে আরো নতুন চাকরি সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রথমটা করতে গেলে, জনপ্রিয়তার বিপরীতে হাঁটতে হবে। আর দ্বিতীয়টা প্রায় অসম্ভব। তবুও ৫ পয়েন্ট প্ল্যান ইত্যাদি মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে চলেছেন দুই পার্থীই। ওবামা এবং রমনির চাকরি জন্য এনার্জি এবং ইউটিলিটি সেক্টরের দিকে তাকাচ্ছেন। তা বিশুদ্ধ ভাঁওতাবাজি। কারন আমেরিকানদের এনার্জি বিল তাদের বাড়ির ইনকামের ৩-৪% এর বেশি না। তাই দিয়ে ৫০,০০০ নতুন চাকরি হবে কি না সন্দেহ আছে। তেলের আমদানী কমাতে আমেরিকা সক্ষম হয়েছে। সেটাই এত অন্ধকারে আশার আলো। সেসব মিলিয়ে বড়জোর ১০০,০০০ নতুন চাকরি আমেরিকাতে সম্ভব। কিন্ত ২১০ লাখ লোক যেখানে বেকার -সেখানে ১ লাখ চাকরি ত সিন্ধুতে বিন্দু! বাজেট ঘাটতি কমাতে গিয়ে আরো বেশি লোক চাকরি হারাবে। না কমালে, ভবিষ্যতে আরো অনেক বেশি লোকের চাকরি যাবে যদি আমেরিকান বণ্ড কেও কিনতে না চায়।

ফলে সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে এই অসুবিধা বা আমেরিকার করুণ অবস্থাটা কেওই স্বীকার করতে চাইছেন না। ওবামা এবং  রমনি এমন ভাব করছেন যেন দুজনের হাতেই আছে ম্যাজিক জাদুকাঠি। আসলে সব শুন্য। ওবামা তাও স্বীকার করেছেন, একমাত্র ভরসা আমেরিকানদের আরো ভালভাবে গণিত এবং বিজ্ঞানে শিক্ষিত করা। সেই অনুযায়ী কাজ শুরুও হয়েছে দেখছি স্কুলগুলোতে। আগের থেকে সিলেবাস অনেক কঠিন করা হয়েছে এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এবং হোমওয়ার্কের সময় বেড়েছে। সদ্য পাশ করা ৪০% আমেরিকান গ্রাজুয়েটদের কোন চাকরি নেই।  এতে কিছু হেরফের হবে না-তবে মন্দের ভাল যে, শীতঘুম ভেঙে আমেরিকান ছাত্ররা বুঝতে শিখছে বাকী জীবন আরামে কাটবে না।

(৩)
আমেরিকাতে ২০ বছর আগেও ডেমোক্রাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে এত ব্যবধান ছিল না। ডেমোক্রাটরা ছিল লেফট-সেন্টার, রিপাবলিকানরা ছিল রাইট সেন্টার। দুই দলেই সেন্ট্রিস্ট বা মধ্যম ধারনার লোক ছিল বেশি। মানে অনেক বেশি সেন্সিবল লোক ছিল দুই দলে-এবং যার জন্যে বিল পাশ করা সমস্যা ছিল না।  বর্তমানে ডেমোক্রাটদের মধ্যে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট ইত্যাদি টাইপের অতিবাম এবং  রিপাবলিকানদের মধ্যে অতিরক্ষণশীলদের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। ফলে কেও কারুর কথা শোনার অবস্থায় নেই।  অতিবাম বনাম অতিডানের এই লড়াই এ আমেরিকার আশুলাভ শুন্য-ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে ওবামা এবং রমনি-দুজনেই সেন্ত্রিস্ট। কিন্ত তাদের সাগরেদরা অতিবাম এবং অতিডান। এতটাই যে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদরা ধর্ষণ ঈশ্বরের ইচ্ছা বলতে দ্বিধা বোধ করেন না! এর পরেও উনারা মহিলা ভোট খুব বেশি হারাচ্ছেন না-কারন অনেক মহিলা নারীমুক্তির মতন বিমূর্ত ধারনার চেয়ে অর্থনীতি নিয়ে বেশি চিন্তিত। কারন আজকে তারাও সংসারের মেইন ব্রেড আর্নার। ফলে রিপাবলিকানরা সেক্সিস্ট, নারী বিরোধি, ইত্যাদি ডেমোক্রাটিক  প্রচার খুব কাজে আসছে না। দেখা আচ্ছে আসলে আমেরিকান নারীদের অধিকাংশ ফেমিনিস্ট না-প্রাগমাটিস্ট-নিজেদের ইনকাম এবং চাকরির স্থিরতা নিয়ে তারা বেশি চিন্তিত।

এমন কি বিদেশ নীতিও এই নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলছে না। ওবামা সরকার যে বিদেশনীতিতে সফল তা স্বীকার করছে রিপাবলিকানরাও। ওবামা বার বার করে জানাচ্ছেন ওসামাকে বধ করেছেন তিনিই। কিন্ত তা মোটেও বাজছেনা ভুখা আমেরিকান মনে। বরং মিট রমনির বারংবার গদাঘাত যে ওবামা অর্থনীতির হাল ফেরাতে ব্যর্থ সেটাই ফিরে আসছে নির্বাচনের মূল বিতর্ক হিসাবে। তাতেও কিছু লাভ নেই। এক্ষেত্রে ওবামার সাফ উত্তর হচ্ছে রিপাবলিকানদের ভুল নীতির জন্যেই দেশ ডুবেছিল। এতটাই ডুবেছিল, যে এত দ্রুত তাকে জলের ওপরে টানা সম্ভব না।

(৩)
রমনী এবং ওবামার নির্বাচনী ইস্তেহার যতই আলাদা হোক বাস্তবে যে এরা খুব আলাদা ভাবে দেশ শাসন করতে চাইছেন বা চাইবেন-তা নয়।  এদের দৃষ্টিভংগীর মূল পার্থক্য ব্যাবসার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্র ওবামা ব্যাবসা ও শিল্পের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রনের পক্ষে। মিট রমনি এর বিপক্ষে।  ওবামার মতে ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রন হারালে দেশ আবার ডুববে। মিট রমনি বলছেন এত বেশি নিয়ন্ত্রন সরকার চালাচ্ছে ফাইনান্সে, পরিবেশে এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রন সংস্থায়, আমেরিকাতে ব্যাবসাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুজনার বক্তব্যেই অনেকটা সত্য আছে। আমার নিজেই দেখছি ডোড ফ্রাঙ্ক আইন বলে যে নতুন নিয়ন্ত্রন এসেছে ফাইনান্সিয়াল ইন্সটিটিউট গুলোর ওপরে, তাতে তাদের এবং তাদের ভেন্ডরদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এতটা নিয়ন্ত্রন ব্যাবসার জন্যে ক্ষতিকর। কিন্ত পাশাপাশি এটাও ঠিক-রিপাবলিকানরা এতই নিয়ন্ত্রন ঢিলে করে দেয় যে ২০০৮ সালের মতন সাবপ্রাইম ক্রাইসিস তৈরী হয় মার্কেটে। মাঝারি পথ কেও নিতে চাইছেন না।

এখানের ব্যাবসায়ীরা প্রায় সবাই রিপাবলিকান। আর চাকুরিজীবি শ্রমজীবিদের বড় অংশ হচ্ছে ডেমোক্রাট।  সুতরাং ডেমোক্রাটিক পার্টিতে লেবার ইউনিয়ান, শিক্ষক ইউনিয়ানের প্রভাব বেশি।  তার সাথে আছে লিব্যারালরা। আর রিপাবলিকান পার্টি ভর্তি আমেরিকান টপ ২% ধনীদের নিয়ে। মূলত তাদের স্বার্থেই কাজ করে এই পার্টি। তবুও এরাই ক্ষমতাই আছে ৫০ টি স্টেটের ৩০ টিতেই। কারন মূলত ডেমোক্রাট দের ব্যার্থতা অর্থনৈতিক হাল ফেরাতে। আমেরিকা চলে মূলত ব্যাবসার ওপর। ব্যাবসার ক্ষতি হয় এমন আইন কোন পার্টিই আনে না-বরং দুই পার্টিই ব্যাবসার পক্ষেই কাজ করে। এর মধ্যে রিপাবলিকানরা শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারের সম্পূর্ন বিপক্ষে এবং মুক্ত মার্কেটের পক্ষে। কোন রিপাবলিকান স্টেটে শ্রমিকদের নুন্যতম মাইনে বারে না।

প্রশ্ন উঠবে এর পরেও রিপাবলিকানরা জেতে কি করে। এর মূলকারন দুটি-(১) শ্রমিক শ্রেনী ডেমোক্রাটদের ওপর আস্থা হারিয়ে ভোট দিতে আসে না (২) রিপাবলিকানদের ধর্মীয় এবং রেস বেস। ডেমোক্রাটিক পার্টি এখন কালো, ল্যাটিনো এবং অন্যান্য ইমিগ্রান্টদের বেস। ফলে আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউরোপিয়ান ককেশিয়ানদের বড় অংশই রিপাবলিকানদের দিকে ঝুঁকেছে।  অন্যদিকে ডেমোক্রাটিক পার্টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের বেসের জন্য কিছু করতে ব্যর্থ হয়। যেমন ওবামা বড়লোকদের ওপর নিজেই ট্যাক্স বসালেন না এত দিন-আর ভোটের সময় এসে বলছেন মিট রমনি ধনীদের ওপর ট্যাক্স বসাতে চাইছেন না। 


 কিন্ত ওবামার ট্রাক রেকর্ডের দিকে তাকালে দেখা যাবে যখন সেনেট এবং কংগ্রেসে ডেমোক্রাট দের সংখ্যাধিক্য ছিল, উনি নিজেই বুশ জমানার টাক্স কাট বহাল তবিয়তে রেখে দিলেন! ফলে এবার ডেমোক্রাটদের মূল সমস্যা ছিল, অনেক কম ভোটার রেজিস্ট্রেশন।  ওবামার ওপর ক্রদ্ধ নিম্নমধ্যবিত্তরা। তিনি কথা রাখেন নি। তার আমলে নিম্নবিত্তদের অবস্থা হয়েছে আরো অনেক বেশি করুণ। ২০০৮ সালে মাত্র  ২ কোটি লোক সরকারি ফুডস্টাম্প ব্যবহার করত। ফুডস্টাম্প এখানে ব্যবহার করে গরিবরা-যাতে সরকারি সাহায্য নিয়ে সস্তায় খাবার কিনে খেতে পাঁরে । আজকে সেই সংখ্যাটা ৫ কোটিতে। এখানে ধণতন্ত্রের এমনই রূপ যে অধিকাংশ হিউম্যানিটিজের অধ্যাপকরা পর্যন্ত ফুড স্টাম্প নিতে বাধ্য হোন! আমেরিকাতে ইতিহাস, দর্শন , সমাজবিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়ান, তারা এত কম মাইনে পান ( কারন এখানে সবই ডিমান্ড সাপ্লাই কার্ভ মেনে হয়!) তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা রাজমিস্ত্রি  বা ছুতোর মিস্ত্রিদের থেকে অনেক খারাপ।  মোদ্দা কথা ওবামা যাই বলুন না কেন, দারিদ্র আমেরিকাতে এত বেড়েছে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন ওবামা। এই মুহুর্তে মিট রমনি ৪৮-৪৭ পয়েন্টে এগিয়ে। কিন্ত এর পরেও জিতবেন ওবামা। কারন আমেরিকান ভোটের অদ্ভুত পাটি গণিত!

(৪)

আপাতত জনপ্রিয়তা না-পাটিগণিতই ভরসা ওবামার।  এখানে নিয়ম হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ভোট সরাসরি কাউন্ট হয় না। অর্থাৎ ক্যালিফোর্নিয়ার ২২ মিলিয়ান ভোটারের মধ্যে ১৪ মিলিয়ান ওবামাকে ভোট দিলে, ওবামা পাবেন কিন্ত সেই পুরো ২২ মিলিয়ান ভোট। যার ভ্যালু ৫১।


এর সবটাই যাবে ওবামার পক্ষে।  তেমন টেক্সাস জিতবেন মিট রমনি-যেখান থেকে তিনি পাবেন পুরো ৪১ আর ওবামা ০।
আমেরিকার ৫০ রাজ্যের ৪০ টি রাজ্যের ফল আগে থেকে জানা। এরা হয় ডিপ ব্লু ( মানে হার্ডকোর ডেমোক্রাট) বা ডিপ রেড স্টেট ( রিপাবলিকান)।

 এই পূর্ব নির্ধাতিত ফলের বাইরে আছে প্রায় ১০ টি ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট বা সুইং স্টেট-যারা যে কোন পক্ষেই যেতে পারে। এই রাজ্য গুলি হচ্ছে ওহায়ো, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা, নেভাদা, উইনকনসিন্স, ইন্ডিয়ানা ইত্যাদি । ওবামার সুবিধা হচ্ছে তিনি মিট রমনির চেয়ে ২৩১-১৯১ তে এগিয়ে শুরু করছেন। ওহায়ো এর এর সাথে আরেকটা সুইং স্টেট জিতলেই তিনি ২৭০ পেয়ে যাবেন। সেখানে রমনিকে ফ্লোরিডা, ভার্জিনিয়া সহ আরো অনেক গুলি সুইং স্টেট জিততে হবে। এর মধ্যে মোটামুটি নিশ্চিত ওবামা ওয়াহো পাবেন। কারন সেখানকার অটো ইন্ডাস্ট্রিকে বেইল আউট করে তিনি বাঁচিয়েছিলেন-রমনি ছিলেন এর বিরোধি। ফলে পাটিগণিত এবং মিট রমনির পূর্বকৃত    ওয়াহো   পাপের ফলে এযাত্রায় ওবামা কান ঘেঁষে পাশ করে যাবেন মনে হচ্ছে। তবে পপুলার ভোট মিট রমনি ওবামার থেকে বেশি পাবেন।

প্রথম টেলিভিশন ডিবেটের আগে প্রায় সব সুইং স্টেটে ওবামা এগিয়ে ছিলেন। এর কারন ডেমোক্রাটরা নানা ভাবে মিট রমনিকে আস্ত রামছাগল প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্ত প্রথম ডিবেটে রমনি ওবামাকে বিরাট সারপ্রাইজ দেন-সেটা হচ্ছে রমনি আমেরিকানদের সামনে তুলে ধরেন, তিনি অতিডান না-তিনি মডারেট। আমেরিকা অতিবাম বা অতিডান পছন্দ করে না। তারা বরাবরের জন্য মডারেট প্রেসিডেন্টকেই ভোট দিতে ইচ্ছুক। এই প্রথম ডিবেটে ওবামার পতনের ফলে সুইং স্টেট ফ্লোরিডা এবং ভার্জিনিয়াতে মিট রমনি ওবামার চেয়ে এগিয়ে যান। ফলে যে নির্বাচন ওবামার জন্য প্রায় নিশ্চিত ছিল, তা হয়ে যায় চরম অনিশ্চিত। তবে ওহায়োর ভোটাররা ওবামার প্রতি কৃতজ্ঞতার জন্য ডিবেট দেখে সুইং করেন নি।  শুধু এই রাজ্যের লোকেদের কৃতজ্ঞতা এযাত্রায় ওবামাকে বাঁচাবে। বলা যেতে পারে মিট রমনি হারবেন তার শুধু একটি লেখার জন্য-সেটি হচ্ছে তিনি ৪ বছর আগে একটি উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, যেখানে তিনি  ওবামার অটো বেইল আউটের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্ত এই বেইল আউটের জন্য ওহায়ো রাজ্যটাতে অটো শিল্প টিকে আছে। ফলে এই রাজ্যে মিট রমনি ভিলেন।

যাইহোক এখন ওবামার নির্বাচন প্রায় নিশ্চিত। যদি না ওহায়ো ঘুরে যায় এই দুদিনে।

Sunday, October 21, 2012

দূর্গাপুজো মানে সপ্তাহভোর পার্টি


 দূর্গাপুজা সে অর্থে কোন কালেই আধ্যাত্মিক গুরু গম্ভীর ধর্মীয় উপাসনা ছিল না।  বরাবরের জন্যে এ শারদ উৎসব।শারদিয়া, আমোদ, খানাপিনা। সপ্তদশ শতকে কৃষ্ণনগরে ভবানন্দের জমিদারিতে এর শুরু হলেও, অষ্টাদশ  শতকেও বাঙালীর জীবনে দুর্গোৎসব বলে কিছু ছিল না। দূর্গাপুজোর জনপ্রিয়তার মূল কারন বৃটিশ এবং তার কলোনিয়াল ইতিহাস!

       বর্তমানের দূর্গাপূজার জনপ্রিয়তার শুরু বাবু নবকৃষ্ণের পুজো দিয়ে যা সেকালে পরিচিত ছিল কোম্পানীর পূজো বা আজ শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজো বলে টিকে আছে। পলাশীর যুদ্ধের পর, যারা ক্লাইভের সহযোগী ছিলেন, তাদের জন্যে ক্লাইভ পার্টি দিতে চাইলেন কোলকাতায়। এদিকে কোলকাতায় কোন বড় গীর্জা ছিল না সেকালে। নবকৃষ্ণ ক্লাইভের সেই সংকট জানতে পেরে, উনাকে জানালেন, দূর্গাপূজার মাধ্যমে ক্লাইভ একদিন না চারদিনের পার্টি দিতে পারবেন। ক্লাইভ, বললেন, বাবু আমরা খৃষ্ঠান-তোমাদের জাত যাইবে! বাবু নবকৃষ্ণ বলেছিলেন, টাকা দিয়ে বাঙালীকে ম্যানেজ করা এমন কি কঠিন ব্যাপার! বাঙালীর সব প্যানপ্যানানি ধাপানিসা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা যায়। এ জাতি মেরুদন্ডহীন!

  বাবু বা রাজা নবকৃষ্ণকে নিয়ে  কিছু বলা প্রয়োজন। পলাশীর যুদ্ধের প্রাক্কালে ইংরেজি জানা বাঙালী ছিল বিরল। বাবু নবকৃষ্ণ ছিলেন পেশায় মুন্সি এবং তজ্জন্যে আরবী,ফার্সী সংস্কৃত সহ অনেক ভাষা জানতেন। ফলে ইংরেজিটাও শিখে নিলেন দ্রুত। পলাশী চক্রান্তে মূলত ইনিই ক্লাইভের দোভাষী হিসাবে কাজ করেছিলেন।  এই বাবুটি না থাকলে ক্লাইভ এত সহজ ভাবে এবং দ্রুত দেশীয় জমিদার ও রাজাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতেন না।  বৃটিশ অকৃতজ্ঞ না। পলাশীর যুদ্ধের পর বৃটিশরা মুর্শিদাবাদের ৫০ কোটি টাকা লুন্ঠন করে। ভাগের বাটোয়ারা অনুযায়ী বাবু নবকৃষ্ণ পেলেন আট কোটি টাকা।  ছিলেন মুন্সি। বৃটিশদের সহযোগিতা করার জন্যে  হয়ে গেলেন রাজা। এবার রাজ্যপাট নেই, রাজ সেনা নেই-সেব বৃটিশদের হাতে। হাতে আছে শুধু টাকা। সুতরাং রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার দেখাবার জন্যে দরকার বিরাট বারোয়ারী পার্টি। দূর্গাপুজোর জনপ্রিয় হবার কারন সেটাই। এই পুজো চারদিন ব্যাপী হওয়াতে, ব্যাপক জাঁকজমক এবং পার্টি দেওয়ার সুযোগ থাকত।

সেই থেকে শুরু হল শোভাবাজারের পূজো যা কোলকাতায় তথা বঙ্গে সব থেকে বড় রকমের জাঁকজমকপূর্ন পূজো। এই পূজোতে হোস্ট ছিলেন স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ। রাজন্য বর্গের জন্যে সুরা বাইজি এবং বারবাণিতাদের অবাধ আয়োজন। সাথে সাহেবদের জন্যে গোমাংস সহযোগে ডিনার। মুসলিম বাবুর্চিরা রান্না করত। এবং এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা না- উনবিংশ শতকে বাবু নবকৃষ্ণের দেখা দেখি সব বাবুর পুজোতেই মদ্যপান, নারী এবং গোমাংস সহযোগে উদ্যোম পার্টি হত সাহেব সুবোদের নিয়ে। দুর্গাপুজোর জনপ্রিয়তার এটাই মূল কারন যে তা বৃটিশদের পিষ্ঠপোষকাতে তাদের উমেদার দের জন্যেই জনপ্রিয় হয়েছে। সুতরাং এ পুজো না- এটিকে উৎসব বলাই ভাল। এতেব আমার মতে দূর্গাপুজো হচ্ছে বাঙালীর জন্যে পার্টি টাইম। খাসি, গোমাংস এবং পানীয় সহযোগে নৃত্য করুন! এই পূজোতে গোমাংস সহযোগে উদ্দাম পানীয় পার্টি না করা হলে, ইতিহাসের অবমাননা হবে!

এরপরেও ইতিহাস আছে। যে বাবু নবকৃষ্ণের দূর্গাপুজোতে গোমাংস, ম্লেচ্ছ, বারবানিতা, মদ্যপান সবই আদৃত ছিল, সেই দেব বংশের লোকেরাই ( রাধাকান্ত দেব) সতিদাহ প্রথা রোধের বিরুদ্ধে ছিল। ছিল বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের বিপক্ষেই। এরাই ছিল সনাতন হিন্দু ধর্মের ধ্বজ্জাধারি। নবকৃষ্ণ দেব এবং তার শোভাবাজারের রাজপরিবারের মধ্যে বাঙালী চরিত্রের সব নিকৃষ্ট দিকের দিগদর্শন সম্ভব। সুতরাং দূর্গাপুজা হচ্ছে বাঙালীর কলোনিয়াল হ্যাংওভার। ক্লাইভ অনেক কিছুই বাঙ্গালীকে শিখিয়ে গেছেন-তার মধ্যে বৃহত্তম হচ্ছে দূর্গাপুজো সহযোগে পার্টি। আরেকবার বৃটিশদের কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছি। কারন আমার কাছেও দূর্গাপুজো মানে সপ্তাহভোর পার্টি করা সুযোগ!

Sunday, October 14, 2012

বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান?

বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান?

-বিপ্লব

বাঙালী রোম্যান্টিক। আপাত দৃষ্টিতে এটা ভাল। কিন্ত সেই মদ, গাঁজা, কবিতা আর বামপন্থার রোম্যান্টিকতায় ডুবে থাকা বাঙালী যখন বিদেশী বিনিয়োগ আটকাতে যায়, সেটা হয় আত্মহত্যা। জ্যোতিবাবুর হাত ধরে বাঙালী কম্পিঊটার আটকাতে গেছিল-সেটা যেমন পশ্চিম বঙ্গের চূড়ান্ত ক্ষতি করেছিল-আজকে এফ ডি আই এর বিরুদ্ধে মমতার জিহাদ ও দেশ এবং রাজ্যের জন্য ততটাই ক্ষতিকর। প্রযুক্তি এবং বিশ
্বায়নকে আটকানোর সাধ্য স্বয়ং আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ও নেই-সেই ক্ষমতা বিশ্বের এক কোনে পরিতক্ত্য কুয়াতে পচতে থাকা কূপমন্ডুক বাঙালীর থাকবে? এই ধরনের চিন্তা ভাবনা অজ্ঞতা, কুসংস্কার এবং দুর্বল বুদ্ধির পরিচয়। মানব সভ্যতা এবং মানুষ স্পেসিসটির ইতিহাস শুধু এক ভাবেই বর্ননা করা যায়-সেটা হচ্ছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ( সেটা জলবায়ু, প্রযুক্তি বা সুনামি/ভূমিকম্প ) যে জাতি নিজেকে যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে, সেই জাতিই শুধু টিকে থাকে। ইতিহাসে বাঙালীর মতন হাজার হাজার জাতি এসেছে এবং তাদের অবলুপ্তিও হয়েছে। সেই সব অবলুপ্তির মূল কারন তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেদের অভিযোজন করতে ব্যার্থ হয়েছে। এটা প্রযুক্তির যুগ। এযুগে খুচরো ব্যাবসা হবে ইন্টারনেটে ইকমার্সের মাধ্যমে। আমেরিকার বড় বড় দোকান এই প্রযুক্তির সামনে উঠে যাচ্ছে বা তারাও ইকমার্সে চলে যাচ্ছে। এরপর কি মমতা দোকান বাঁচাতে ইকমার্স বন্ধ করবেন পশ্চিম বঙ্গে? কারন মমতার লজিক মানলে ইকমার্স ও পশ্চিম বঙ্গে বন্ধ করতে হয়!!! কি সব ভয়ংকর যুক্তি! প্রযুক্তির সাথে পুরাতনের অবসান হবে, নতুনের হবে আবাহন-এটাই নিয়ম। করনিক কুলের চাকরি যাবে বলে জ্যোতিবাবুর মতন গোঁ ধরে কম্পিউটার এ রাজ্যে বন্ধ করলে, পশ্চিম বঙ্গের হালটা কি হত? মানুষকে, ব্যাবসাকে নতুন প্রযুক্তির সাথে ক্রমাগত মানিয়ে নিতে হবে। এটাকে না মানলে পশ্চিম বঙ্গ আবার আদিম যুগে চলে যাবে। সিপিএম এমনিতেই পশ্চিম বঙ্গকে তাম্রযুগে পাঠিয়ে দিয়েছে-এবার মনে হচ্ছে দিদি রাজ্যাটাকে প্রস্তর যুগে পাঠাবেন।

বাঙালী গত ৮০০ বছর ধরেই পরাধীন জাতি। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের জীবনে রাজনৈতিক সার্থকতার চেয়ে ব্যার্থতা বেশি। পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূল সর্বপ্রথম স্বাধীন একটি সরকার চালাচ্ছে। কারন এর আগের কংগ্রেস বা সিপিএম সরকার চলত দিল্লী থেকে-সিপিএমের রাজ্য নেতারার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কারাতের মতন নেতাদের বোঝাতে ব্যার্থ হতেন। সেই অর্থে তৃণমূলই প্রথম সম্পূর্ন স্বাধীন বাংলা সরকার। এই জন্যেই এদের কাছ থেকে আশা প্রাত্যাশাও বেশি। কিন্ত মমতা এবং তাদের ভাইরা ভুলে গেছেন, জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। জনপ্রিয় ও হব, আবার সরকার ও চালাব, দুটো বোধ হয় একসাথে হবার নয়। এটা মমতাদেবী যত দ্রুত বুঝবেন তত ভাল।

বামপন্থার আসল নকল!

বামপন্থার আসল নকল!
-বিপ্লব পাল
অধুনা ভিরমি খাইতেছি। শুধু আমি খাইলেই যথেষ্ঠ নহে, বিমান বোস ও খাইতেছেন। প্রকাশ কারাতের রাজ্য বাধ্যবাধকতা নাই-দিল্লী ফ্ল্যাশব্যাক পাইলেই উনি সিদ্ধ। কংগ্রেসকে না ডোবাইলে, তাহা অপ্রাপ্য, দুঃস্প্রাপ্য। তাই তিনি দিদিকে বামপন্থার সার্টিফিকেট দরাজ হাতে দিতে বাধ্য হইয়াছেন। বিমান বুদ্ধর ধুতির কোলে লুকাইয়া যাহা তিনি পান নাই, মমতার আঁচল ধরিয়া যদি ভবিষ্যতে দিল্লীতে কিছু খুঁটি ত
ৈয়ার হয়। সিপিএম সাইনবোর্ড পার্টি হইবে না ইতিহাসের পাতায় লুকাইবে, ইহা এখনো বলা সম্ভব নহে-কিন্ত মমতার বামমতিতে তাহার সম্ভবনা সুদুরপরাহত নহে।

কে আসল বামপন্থী, প্রকৃত গরীব দরদি-সে বাগযুদ্ধ স্যোশাল মিডিয়া হইতে প্রিন্ট মিডিয়াতে সর্বত্র দেখিতে পাইতেছি। ইহাতে আমোদিত হইবার যাবতীয় উপাদান মজবুত। ভাবুন, সকালে উঠিয়া দেখিলেন রাস্তার ধারের দুই গাছে দুই বালক মগডালে বসিয়া নিজের ডাল কাটিতেছে, আর নিজেদের মধ্যে কাজিয়া বাধাইতেছে, আমিই শালা আসল কালিদাস। তুই নকল। ইহাতে হাসিতে পারেন, কিন্ত যখন ভাবিবেন রাজ্যভার এই দুই কালিদাসের হাতেই-তখন ইতিহাসে তাকাইলে দেখিতে পাবেন, জ্যোতি বোস নামে এক মহাপূজিত বাঙালী কালিদাসের পুরাকীর্তি হেতু বাঙালী আই টি শিল্পে পুনে ব্যাঙ্গালোর অপেক্ষা শতযোজন পশ্চাতে বসিয়াছে। কারন বাঙালীর ইতিহাসে মহাসন্মানিত এই মহাকালিদাসটি কম্পিউটার মানুষের চাকরি খাবে বলিয়া পশ্চিম বঙ্গের আই টি শিল্পের ডালটি কাটিয়া ছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য সীমিত ক্ষমতা বলে, দিল্লীর কারাতীয় শৃঙ্খল পরিধান পূর্বক, এই কালিদাসত্ব থেকে উদ্ধার পাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। ফল মিলিতেছিল। পরিসংখ্যান বলিতেছে ২০০১ সাল হইতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গের জিডিপি প্রায় ৯% হারে বাড়িয়াছে যা জাতীয় গ্রোথের ১% বেশি।
অধুনা কালিদাস-২ এর দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে আসিয়াছেন। এক্ষনে আমাদিগের মহাকালী মা দেবী, বলিতেছেন সাহাবাবু দের রক্ষার্থে বিদেশী বিনিয়োগ আটকাইবেন। সাধু! প্রযুক্তির উন্নতির সামনে কেরানীকুলের চাকরি জ্যোতিবাবু রাজ্যের মগডাল কাটিয়া আটকাইতে পারেন নাই। মমতাদেবীও সাহাবাবুদের বাঁচাইতে পারিবেন না। প্রযুক্তির হাতে তাহাদের শেষের সে দিন সমাগত-যেদিন মোবাইলে এক বাটনের চাপে লোকে ক্রয় বিক্রয় করিবে-গোডাউন থেকে ঘরে বাজার আসিবে ইকমার্স সিস্টেম। ইহাই ইতিহাসের গতি এবং লিখন। ইহাকে আটকাইবে কার সাধ্য? জ্যোতিবাবুর ন্যায় আটকানোর কালিদাসীয় কুনাট্য রচিলে, রাজ্যে ধপাস করিয়া আরেকবার বসিবে। ইহাতে আশ্চর্য্য কি? যে রাজ্যের লোকে মগডালে বসিয়া থাকা কালিদাসদের মহানেতা নেত্রী জ্ঞানে পূজা এবং কালিদাসী ক্রিয়ার ভজনা করিয়া থাকে, তাহাদের ভিন রাজ্যেই চাকরি খুঁজিতে হইবে।

Monday, October 1, 2012

বিদেশী বিনিয়োগে দেশ বিক্রী!


কথাটা নতুন নয়-বামেরা এককালে আকাশ বাতাস মুখরিত করেছে দেশ বিক্রীর আষাঢ়ে গল্পে। মনমোহন যেদিন ভারতে বিনিয়োগের দরজা খুলেছিলেন-সেদিন ও কিছু বাম এসব করেছিল। আজ তারা ভুতেদের দলে। কারন এই বিদেশী বিনিয়োগের হাত ধরেই ভারত গত দুদশকে দ্রুত উঠেছে।
 অধুনা বাম, মমতা দিদিও একই অর্ন্তজলি পথের পথিক।। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গণতন্ত্রে উনার সেই অধিকার আছে এবং আমি বলবো মমতার এই কেন্দ্রবিরোধি অবস্থান গণতন্ত্রের জন্যে ভাল হলেও দেশের জন্যে ভাল না।
 বিদেশী বিনিয়োগে সত্যিই কি দেশ বিক্রি হয়? আসুন আমরা একটু যুক্তি তথ্যের সাহায্যে বুঝি!
·          পৃথিবীতে সব থেকে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ হয় আমেরিকাতে। আমেরিকা সব দেশের কাছে বিক্রি হয় গেছে? কি হাস্যকর।  এরপর সব থেকে বেশি বিনিয়োগ হয় চীনে। সেই দেশটাও কাল বিক্রি হয়ে গেল? পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দুই দেশে বিদেশী বিনিয়োগ সর্বাধিক!

·         ১৯৯১ সাল থেকে ভারতে সিরিয়াস বিদেশী বিনিয়োগ আসতে থাকে। আজকে যে সফটোয়ারের মধ্যবিত্ত শ্রেনী তৈরী হয়েছে-সেটা পুরোপুরিই বিদেশী বিনিয়োগের হাত ধরে। সেদিন মনমোহন যদি জ্যোতিবোসের কথা শুনতেন ( আজকের জ্যোতি হচ্ছে মমতা ) তাহলে যে ছেলেগুলো আজকে প্লেনে চড়ে বিদেশে ঘুরছে, বড় ফ্ল্যাট কিনছে  এরা বড়জোর কোন মারোয়ারী ফার্মে পাঁচ হাজারি চাকরি করত। এই সত্য অস্বীকার করবে কে?
·         বিদেশী বিনিয়োগ ছাড়া কোন বিজনেসে আধুনিক প্রযুক্তিই বা আসবে কোথা থেকে? ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও, চলছে না চলবে না তে কি ভারত এগিয়েছে?  প্রযুক্তিই একমাত্র দেশকে এগিয়ে দেয়। বিদেশী বিনিয়োগ না হলে ভারতে প্রযুক্তি নির্ভর সমাজের উত্থান আরো মন্থর হবে।
·         এটা প্লোবালাইজেশনের যুগ। কালকে ওবামা যদি আমেরিকানদের কথা মেনে, যে আমেরিকানদের চাকরি যাচ্ছে, তাই আউটসোর্সিং বন্ধ করার আইন আনেন, তাহলে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণী পথের ভিখিরী হয়ে যাবে একদিনে। কিন্ত আমেরিকান লোকেদের যতই মনবাঞ্ছা থাক আউটসোর্সিং বন্ধ করার জন্যে আমেরিকান রাজনৈতিক নেতৃত্ব তা করে না। কারন সেটা করলে, আমেরিকা আর প্রতিযোগিতার মার্কেটে টিকতেই পারত না।  তাতে আরো বেশি আমেরিকানের চাকরী যেত-এবং আমেরিকা নেতৃত্ব পজিশন ও হারাত। কিছু সাহাবাবু দের ব্যাবসার ক্ষতি হবে, সেই যুক্তি মেনে চললে, ভারত পিছিয়ে পড়বে। যেভাবে আজ পশ্চিম বঙ্গ  ব্যাঙ্গালোরের অনেক পেছনে চলে গেছে।

সুতরাং  গ্লোবাইজেশনের যুগে, এই ধরনের প্রটেকশনিজম অর্থহীন।  এই ব্যাপারে মার্ক্সের কথাকেই আরেকবার স্বরণ করি
Moreover, the protectionist system is nothing but a means of establishing large-scale industry in any given country, that is to say, of making it dependent upon the world market, and from the moment that dependence upon the world market is established, there is already more or less dependence upon free trade. Besides this, the protective system helps to develop free trade competition within a country. Hence we see that in countries where the bourgeoisie is beginning to make itself felt as a class, in Germany for example, it makes great efforts to obtain protective duties. They serve the bourgeoisie as weapons against feudalism and absolute government, as a means for the concentration of its own powers and for the realization of free trade within the same country.
But, in general, the protective system of our day is conservative, while the free trade system is destructive. It breaks up old nationalities and pushes the antagonism of the proletariat and the bourgeoisie to the extreme point. In a word, the free trade system hastens the social revolution. It is in this revolutionary sense alone, gentlemen, that I vote in favor of free trade.
  মার্ক্স বহুদিন আগে যা বলে গিয়েছিলেন তা আজও সত্য। সেই সত্যটা হল এই, বিদেশী বিনিয়োগে খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয় না-তারা দেশজ বুর্জোয়াদের বদলে বিদেশী বুর্জোয়াদের হাতে শোষিত হবে। আর এই ধরনের বিদেশী বিনিয়োগের বিরোধিতা করবে দেশীয় বুর্জোয়া শ্রেনী-অর্থাৎ দেশীয় দোকানদাররা।  ভারতে আজ আমরা সেটাই দেখছি।
 মার্ক্স যে কারনে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে ছিলেন, আমিও সেই কারনেই মুক্ত এবং অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে।  ভারতের উন্নতির সব থেকে বড় অন্তরায় দেশীয় মারোয়ারি , পারিবারিক ব্যাবসায়ীরা। বিদেশী বিনিয়োগের সামনে এরা উড়ে যাবে। এরা এত অসৎ এবং দল পাকিয়ে রেখেছে-মমতার মতন রাজনীতিবিদ দের কিনে রেখেছে,  এদের না ওঠাতে পারলে ভারতের ব্যাবসাতে সৎ মেধাবী ছেলে মেয়েদের আসা অসম্ভব।  সুতরাং দেশীয় এই পারিবারিক ব্যবসায়ী শ্রেনীর ধ্বংস করার জন্যে বিদেশী বিনিয়োগ আসুক এবং ভারতে আমেরিকার মতন সাধারন ঘর থেকে মেধাবী পরিশ্রমী ব্যাবসায়ি শ্রেনী উঠে আসুক। 

Friday, September 21, 2012

আম আদমি ! ও রিয়ালি?


আম আদমি ! ও রিয়ালি?
 -বিপ্লব
মনমোহনের ভাষন শোনার পর, মমতার ফেসবুক স্টাটাস আপডেট- সবাই আম আদমির নাম করে, আম আর ছালা চুরিতে ব্যস্ত!

  চারিদিকে বাম বাঙালী, তৃণমূলী বাঙালী এবং প্রবিজ্ঞ বাঙালীর কথা শুনে মনে হতে পারে রিটেলে বিদেশী বিনিয়োগ মানে দেশের সর্বনাশ হল বলে! দেশের সাধারন দোকানদাররা, যারা দুয়ানা করে খাচ্ছিল, তারা এবার গেল!

প্রথমেই বলে রাখি –আমি কংগ্রেসের তথা মনমোহনের গুণমুদ্ধ কেও নই। চারিদিকে যেভাবে সরকারটাই চুরি হয়ে গেছে, মনমোহন তার নিজের অপদার্থতার চূড়ান্ত প্রমান দিয়েছেন।  নৈতিক দ্বায়িত্ব মেনে কয়লা বা কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারীতেই তার পদত্যাগ করা উচিৎ ছিল। কমনওয়েলথ গেমসের বাজারে, এক বছর আগে থেকেই ডিল নিলাম হচ্ছিল এবং ফরের দল খেলছিল। গোটা দিল্লী জানত এই খেলার মহা খেলুড়েটে কে আর মনমোহন জানতেন না?  অসম্ভব।  সুতরাং সর্দারজী নিজে চোর না হলেও, চুরি ডাকাতি গায়ে মাখেন না-এটা নিয়ে আমাদের কারুর কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।  এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী চোর ও ডাকাত দের এত মমত্ব দিয়ে পুষিলে, তার যোগ্যতা নিয়ে সংশয় থাকবেই।

কিন্ত এই সর্দারজির জন্যেই ভারত আজকে জগৎ সভায় মুখ উঁচু করে চলে। এই সর্দারজির জন্যেই ভারতে আজ ৫০ লাখের বেশী সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার এবং মাইক্রোসফট থেকে পৃথিবীর সব সেরা কোম্পানীগুলির অফিস ভারতে। এই সর্দারজির জন্যেই ভারতের তরুন মধ্যবিত্ত সমাজ ভাল চাকরির স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। এবং ভারতে আজকে যেটুকু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, তার মূলে অবশ্যই বিদেশী বিনিয়োগ যা মনমোহনের সংস্কারের পথেই এসেছে। কারন একমাত্র বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমেই ভারত বিশ্বের অর্থানীতির সাথে যুক্ত হতে পারে, যা উৎপাদন উন্নততর করে।  সুতরাং যেসেব সেক্টর বিদেশী বিদেশী বিনিয়োগের জন্যে খুলে দেওয়া হয়েছে,  সেখানে আমরা চমকপ্রদ উন্নতি দেখেছি। সফটোয়ার বা ফার্মা সেক্টর এর সব থেকে বড় উদাহরণ।

 এবার প্রশ্ন হচ্ছে খুচরো ব্যাবসায় বিদেশী বিনিয়োগ, ভারতের দোকানদার দের ক্ষতি করবে কি না। তাদের রুটি রোজগার মারবে কি না। বিশেষত যখন ভারতের ১৩% লোক দোকানদারি করেই খাচ্ছে।
  এর সোজা উত্তর সেই ১৩% এর মধ্যে অন্তত ৫-৬% ব্যাবসা হারাবে। আনন্দবাজার বা প্রধানমন্ত্রী যতই আশ্বাস দিক,  আমার আমেরিকাতে দেখা অভিজ্ঞতা হল কোন নতুন শহরে ওয়ালমার্ট আসলে, স্থানীয় ব্যাবসার ৮০% পাঠ তোলে। আমি অন্তত ৪ টি এমন কেস চোখে দেখেছি।  ভারতে সেটা ২০% মতন হবে কারন এক কোটির বড় শহর ছাড়া এই ধরনের বড় রিটেল খোলার অনুমতি বিলে দেয় নি। তাছারা ভারতে এই সব বড় শপ, শহরের অনেক বাইরেই করতে হবে। সুতরাং বিগরিটেলে ভারতের ছোট ব্যবসায়িদের ক্ষতি কিছু হবে-কিন্ত সেটা আমেরিকার অনুপাতে কমই হবে।

 কিন্ত এসবের পরেও আমি নিশ্চিত ভাবেই মনে করি বিগ রিটেলে বিদেশী বিনিয়োগ ১০০% সঠিক সিদ্ধান্ত।
 
   [১]  উন্নততর উৎপাদন এবং বন্টন রাজনীতি করে আটকানো সবসময় মূঢ়তা। কারন, এতে উৎপাদন কমে। ভারতে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক বেশি দাম। আমেরিকাতে অধিকাংশই দ্রব্যই ভারতের থেকে সস্তা যেখানে আমেরিকাতে লো কস্ট ম্যানপাওয়ারের কস্ট ভারতের প্রায় ২০ গুন। কারন বিগ রিটেলের সিস্টেম। সেখানে সাপ্লাই চেন থেকে ডেলিভারি সব সিস্টেমে হবে-ফলে অসংখ্য মিডলম্যান সেই বিগরিটেল ট্রেনে কাটা পড়বে। এবং ভল্যুয়মে বিক্রি হলে মার্জিন অনেক কম রেখে বিক্রি সম্ভব-উৎপাদক সরাসরি ডেলিভারি দিতে পারবে।  যার ফলে আস্তে আস্তে ভারতে অনেক দ্রব্যের দাম কমবে।  

 বেসিক্যালি ব্যাপারটা হবে এই- ভারতের ১৩% লোক মধ্যসত্ত্বভোগী ছিল-এবার তাদের টাকা না দিতে হওয়াতে, খুচরো জিনিসের দাম অবধারিত ভাবে কমবে। যা আমরা আমেরিকাতে দেখেছি। সুতরাং আম আদমীর প্রশ্ন উঠলে কৃষক এবং সাধারন মানুষের জন্যে রেটেলে বিদেশী বিনিয়োগ আশীর্বাদ। অভিশাপ না।  সুতরাং রিটেলে বিদেশী বিনিয়োগ আমআদমীর পক্ষেই।

 [২] প্রশ্ন হচ্ছে এই ১৩% দোকানদার দের, আমাদের সাহাবাবু দের কি হইবে?
 কোন ভণিতা না করেই বলা যাক, তাদের দোকানদারি ছেরে অন্য ব্যবসা দেখতে হবে।  উন্নততর উৎপাদন প্রক্রিয়া আসলে, অনুন্নত উৎপাদনের সাথে যারা জড়িত, তাদের কর্মনাশ হয়। এটা ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি। আমরা কি দেখিনি গত ২০ বছর কেরানী বলে পেশাটা উঠে গেছে?  এখন গ্রামীন শহরের বড় দোকানগুলিতেও খাতা দেখাশোনা করার ব্যাপার নেই। কম্পুটার চলছে। যারা খাতা লিখত, তারা অতীত। তরুন যুবকেরা সবটাই কম্পুটার একাউন্টিং করছে।  অথচ এই সেই দিনও কমরেডরা আকাশ বাতাস মুখরিত করেছিলেন কম্পুটারের বিরুদ্ধে ----কম্পুটার আসলে লোকের চাকরি যাবে! আসলে সেই কম্পিউটারই ভারতের নতুন কর্মপন্থা খুলে দিলে। রিটেলেও তাই হবে। সেখানে বিনিয়োগ আসলে উন্নত রিটেলের সাথে অনেক উন্নত পরিশেবা আসে, যেখানে চাকরির সংস্থান হবে।

 এই ভাবেই কলকাতা তলিয়ে গিয়েছিল ব্যাঙ্গালোরের অনেক অনেক নীচে।  নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা আসলে, পুরাতনের কর্মনাশ হয়। এটা না হলে ত সভ্যতাই এগোবে না!  হাল বসে যাবে বলে আমরা জমিতে ট্রাক্টর চালাতে দেব না? এটাত সভ্যতার গতি হতে পারে না।  ইতিহাস বলে যে সমাজ উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তারা ধ্বংস হয় কালক্রমে।

[৩] সব থেকে বড় কথা সভ্যতা গতি বিগ রিটেলেও না। সভ্যতার গতি ইকমার্স রিটেলে। যা ভারতে বিরাট ভাবে ঢুকেছে।  সাহাবাবুরা চান বা না চান, তাদের দোকানের বয়স আর ২০ বছরের বেশি না। ভারতেও ইকমার্স এবং ইডেলিভারি আগামী ১০ বছরে সাঁই সাঁই করে উঠবে। ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানগুলি দেওলিয়া হবে সবার আগে।  দোকানদারির মতন যে পেশা ইন্টারনেট যুগের সাথে সামঞ্জস্য না, সেই পেশাকে টেকানোর জন্যে একটা জাতিকে পিছিয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? দোকানদারের ছেলেরা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে লোকাল ইডেলিভারি ব্যবসা শুরু করুক। সেটাই হবে সভ্যতার গতি।
মোদ্দা কথা মমতা যদি কয়লা কেলেঙ্কারীতে ইউ পি এ ছাড়তেন, আমি সমর্থন করতাম।  কিন্ত মমতা বিরোধিতা করছেন এমন একটা ইস্যুতে যা ভারতকে পেছনের দিকে ঠেলবে।  



Thursday, September 13, 2012

একটি সিনেমা এবং বেনগাজিতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের হত্যালীলা


সিনেমাটার নাম ইনোসেন্স অব মুসলিম। স্যাম বেসাইল নামে এক আমেরিকান ইহুদি এর ডিরেক্টর। সে শ খানেক ইহুদিদের কাছ থেকে কয়েক মিলিয়ান ডলার তুলে সিনেমাটা বানিয়েছে। ইউটিউবে খুঁজলে ১৮ মিনিটের একটা ট্রেলার পাওয়া যাচ্ছে। বি-গ্রেড সিনেমা-কোন এক্টিং নেই। মহম্মদকে নিয়ে কমেডি। আরো পরিস্কার ভাবে হজরত মহম্মদের দুর্বার যৌন জীবন নিয়ে কমেডি-যাতে সুন্দরী নারী এবং সুন্দর বালকের প্রতি নবীজির অপ্রতিরোধ্য আকর্ষন নিয়ে ব্যাঙ্গ করা হয়েছে এবং সেটাও খুব দুর্বল। সোজা কথায় ফাজিল ফালতু সিনেমা।
কিন্ত তাতে কি? মিশর এবং মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম সমাজ প্রতিবাদে শ্যামাপূজোর কালিপটকার মতন নিজেরাই ফাটছে আর ফাটাচ্ছে! উগ্র মুসলিমদের হাতে কাল প্রাণ হারিয়েছেন লিবিয়াতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত ক্রিষ্টোফার স্টিভেনস। তোলপাড় হচ্ছে আমেরিকান রাজনীতি। কাল পরশুর মধ্যে পাকিস্থান আর আফগানিস্থানে আরো কত লোক লাশ হবে আর লাশ ফেলতে চাইবে জানি না। এর আগেও কোরান পোড়ানো বা টয়লেটে কোরান ট্রাশ করা নিয়ে লাশ হওয়া এবং লাশ ফেলার অভিলাশী উৎসাহে কোন ঘাটতি দেখা যায় নি।
আমি নিশ্চিত মুসলিম সমাজ এখন দুইভাবে বিভক্ত-একদল মর্মাহত, কিন্ত হিংসাত্মক উত্তরে বিশ্বাস করেন না। আরেক দল ধর্ম রক্ষার নামে এই ধরনের হিংসাত্মক কাজ কর্মকেই ধর্মীয় নিদান বলে বিশ্বাস করে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই যে ধর্মীয় ভাবাবেগ, যাকে ঘিরে এই কান্ড-সেই মিথটি একবিংশ শতাব্দিতে কি আমাদের সমাজ এবং সভ্যতার জন্যে কাম্য না সব থেকে বড় ক্যান্সার?
এটা খুব সহজেই বিচার করা যায়, যদি আমরা এই প্রশ্নগুলি করি।
• ধরা যাক ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করা উচিৎ না । তাহলে আমার মতন নাস্তিক নিধার্মিকদের ভাবাবেগেও আঘাত করা উচিৎ না। আমেরিকাতে নিধার্মিকদের সংখ্যা এখন ১৫% এর বেশি, অনেক দেশেই নির্ধামিকরাই সংখ্যাগুরু। কিন্ত প্রতিটা ধর্মগ্রন্থে সে কোরানই হোক, বা গীতাই হোক, নিধার্মিক বা বিধার্মিক বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের গর্দভ, শুয়োর থেকে শুরু করে সব ধরনের চোস্ত গালাগাল দেওয়া হয়েছে। তাহলে নিধার্মিক ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে আমাদেরও দাবী করা উচিৎ, আমাদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করার জন্যে কোরান সহ যাবতীয় ধর্মগ্রন্থ যা নিধার্মিকদের বিরুদ্ধে বিদ্বেশগার করে, তাদের ও নিশিদ্ধ করা হৌক? আমরা কিন্ত কোন ধর্মগ্রন্থ নিশিদ্ধ করার পক্ষে না। কারন আমরা জানি ধর্মগ্রন্থগুলিই ধর্মীয় মূঢ়তার বৃহত্তম প্রমান। ইসলাম যদি সেই ধরনের সলিড কিছু হত-তাহলে “ইনোসেন্স অব মুসলিমের” মতন একটি তৃতীয় শ্রেনীর ভাঁড়ামোতে এর গোড়া নড়ে কেন?
• এর আগে আমেরিকাতে লাভগুরু বলে একটি সিনেমা রিলিজের আগে, হিন্দু ধর্মে আঘাত করা হচ্ছে বলে ভারতীয় হিন্দুরা এর রিলিজ বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে হিন্দুদের সমাজ “শিক্ষার” দিক দিয়ে একটু বেশি “বিবর্তিত” বলে লাশ না ফেলে, কোর্টের আশ্রয় নিয়ে সিনেমাটা আটকানোর চেষ্টা করে। সফল হয় নি। এবার ব্যাপারটা ভাবুন। এই হিন্দু ধর্মের ছানাপোনারা দাবী করে, হিন্দু ধর্মের মতন দার্শনিক ধর্ম নাকি হতে পারে না কারন এই ধর্ম সকল ধর্মের মিউজিয়াম। আরে তাই যদি হয়, তাহলে লাভগুরুর মতন একটা সফট পর্ণ ধর্মের ভিত নড়িয়ে দেবে? লাভগুরু তাও সিনেমা হিসাবে ভদ্র ছিল-ইনোসেন্স অব মুসলিম আরো দুর্বল ভাঁড়ামো। তাহলে শুধু এই ধরনের যৌন ভাঁড়ামো করেই ইসলামের নাড়া নড়ানো যায়? সেটাই যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে, ইসলাম ধর্মের পুরোটাই জঙ্গিবাজি-ধর্মের ভিতরে কিছু নাই-সেই জন্যেই তা এত ক্ষণভঙ্গুর।
• কিন্ত হিন্দু বা ইসলাম ধর্ম এত অগভীর বা এত ফালতু এমন ভাবার কারন নেই । এগুলি বিবর্তনের পথে নির্বাচিত ধর্ম যারা হাজার হাজার বছর ধরে টিকেছে। সুতরাং এদের প্রানশক্তি আছে বইকি। না থাকলে, এরা নির্বাচিত হত না। সমস্যা হচ্ছে বিবর্তনের পথে যে আধুনিক উৎপাদন শক্তির উদ্ভব হচ্ছে, তার সাথে ধর্মগুলি দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারছে না। এই ব্যাপারে বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মগুরুরা কিছুটা এডাপ্টিবিলিটি বা অভিযোজন দেখালেও ইসলামিক সমাজের অভিযোজন হচ্ছে না তেলের টাকার কারনে। ৪০ বছর আগেও ইসলামি সমাজ এত ইসলামিক ছিল না কোন দেশে-কারন তাদের ইসলাম থেকে বেড়িয়ে এসে আধুনিক উৎপাদন শক্তিকে আশ্রয় করেই বাঁচতে হত। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষা, পাশ্চাত্য দর্শন, আধুনিক রাজনীতি বিজ্ঞান, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি এর মাধ্যমে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির সাথে তাদের যুক্ত হওয়ার একটা পক্রিয়া আরব জাতিয়তাবাদি আন্দোলনের মাধ্যমে শুরু হয়। কিন্ত সৌদি আরব সহ নানান দেশের রাজাদের সামন্ত তান্ত্রিক ক্ষমতা পিপাসা, তেলের টাকায় ইসলামিক জীবন এবং আমেরিকার প্রচ্ছন্ন মদতে ইসলামের চাকা উলটো দিকে ঘুরতে থাকে। এর সাথে একই রকম ধর্মীয় ভাবাবেগাচ্ছন্ন দক্ষিন ভারতীয়দের তুলনা করা যেতে পারে। তাদের খনিজ সম্পদ এত নেই যে তার টাকাতে পায়ের ওপর পা তুলে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব। ফলে বাঁচার তাগিদেই তারা গোঁড়া হিন্দুত্ব থেকে বেড়িয়ে আস্তে আস্তে আধুনিকতার দিকে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে।
এই বাধ্যবাধকতাটা ইসলামিক সমাজে আসে নি তেলের টাকার জন্যে। সমাজ, রাষ্ট্র, মিডিয়া বা রাজনীতি যতই শেখাক, আমি হিন্দু বা মুসলমান, বাস্তব এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা হচ্ছে- আমি একজন জৈবিক মানুষ। কারন দুদিন না খেতে পাওয়ার পর যদি কোন মুসলমানকে বলা হয় পুজো করলে খেতে পাবে, সেই তাই করবে। এটাত আমি ছোটবেলায়, আখছার দেখেছি পুজোর সময়গুলিতে ভাল খেতে পাওয়ার লোভে, অনেক দরিদ্র মুসলমান প্রসাদ খাওয়ার পাতে বসে। এটাই মানবিক ধর্ম। আবার তারই যখন টাকা হয়, সে পোত্তলিকতার অপরাধ নিয়ে ভাবে। কারন পেটে ভাত থাকলে এই সব মিথ নিয়ে ভাবার অবকাশ পায় লোকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেক হিন্দু ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছে। কারন সেটাই জৈবিক ধর্ম।
কালকের মধ্যপ্রাচ্যও সেই মানুষের জৈব ধর্মই পালন করবে বা করতে বাধ্য হবে। মধ্যপ্রাচ্যে তেলের উপায় কমতে থাকছে ইলেকট্রিক গাড়ির জন্যে। তার সাথে যুক্ত অবাধে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ফল এই যে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটা রাষ্ট্রে এখন তীব্র খাদ্য সংকট ঘণীভূত হচ্ছে। ইসলাম দিয়ে আর নামাজ পরে এই সমস্যার সমাধান হবে না। আধুনিকতা এবং যন্ত্র সভ্যতাকে গ্রহণ করেই তাদের এগোতে হবে। ভারতে এটা আমরা গত ৪০ বছর ধরে দেখেছি। ভারতে আস্তে আস্তে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং হিন্দুত্ববাদিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে উন্নয়নকে জনগণ অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্যে। ফলে মন্দির এবং বাবার সংখ্যা বাড়লেও সমাজ ও রাজনীতির ওপর ধর্মের প্রভাব অনেক কমেছে। বিজেপি কিন্ত সেই নব্বই দশকের পর হুল ফোটাতে পারছে না। নরেন্দ্রমোদিকেও হিন্দুত্ববাদ বাদ দিয়ে উন্নয়নকে হাতিয়ার করে ভোটে জিততে হচ্ছে। আধুনিকতার চাপ।
সুতরাং মধ্যপ্রাচ্যে একবার যখন গণতন্ত্র আসতে শুরু করেছে, এই আশা, দুরাশা বা নিরাশা নয়, যে আস্তে আস্তে ধর্মীয় আবেগ সেখানেও ফিকে হবে। আধুনিক রাষ্ট্র এবং আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে গ্রহণ না করলে, সেই সমাজ খাদ্যাভাবে গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হবে যা আজ আমরা আফ্রিকাতে দেখছি। মধ্যপ্রাচ্য সাবসাহারান আফ্রিকার দিকে যাবে -না ইউরোপের পথে আসবে, সেটা আমরা দ্রুতই দেখতে পাব।

Saturday, August 18, 2012

জৈন ধর্ম- ভারতীয় নাস্তিক দর্শনে অহিংসার সন্ধানে



 নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ধর্ম শব্দটা উচ্চারন করলে, যেকোন যুক্তিবাদি বা পর্যবেক্ষকের বা সাধারন লোকের কাছে যে চিত্রটা উঠে আসে-তা হচ্ছে প্রতিটা ধর্মেই ধর্মগ্রন্থ, ধর্মপ্রতিষ্ঠাতা, আচার বা রিচ্যুয়াল এবং পার্থনাগৃহের সন্ধান পাওয়া যাবে। জৈন ধর্মকে ওপর থেকে দেখলে, অন্য পাঁচটি ধর্ম থেকে আলাদা করা মুশকিল-বিশেষত যেহেতু জৈনরা খাদ্য, উপবাস এবং আচার আচরনের ওপর অনেক কঠিন বিধি নিষেধ আরোপ করে। কিন্ত জৈন গ্রন্থে ও ইতিহাসে ঢুকে যে জৈন দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়, তাতে এমন  এক ধর্মর ঠিকানা আছে,  যার উৎপত্তি, মূল দর্শন এবং লক্ষ্য অন্য ধর্ম থেকে বিশেষ ভাবে আলাদা, আদি এবং অকৃত্রিম।

                  ঈশ্বরের অবিশ্বাসী বা নাস্তিকতা থেকে প্রাচীন ভারতে যে কটি ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে, তার মধ্যে জৈন ধর্মেই এথেইজিমের ( নাস্তিকতা শব্দটা এখানে ব্যাবহার করা যাবে না কারন এথেইজম শব্দটি নাস্তিকতার সুপারসেট বা অনেক ব্যাপৃত অর্থে ব্যাবহৃত) চূড়ান্ত বিকাশ বিশেষ ভাবে পরিলক্ষিত।  জৈন ধর্মই আমার জানা একমাত্র ধর্ম, যা এথেইজিম বা নাস্তিকতার  প্রথম প্রতিপাদ্য মেনে চলে। এই প্রথম প্রতিপাদ্য হচ্ছে পরম সত্যের ( এবসল্যুটিজম) অস্ত্বিত্ব নেই এবং সেই জন্যেই বহুত্ববাদই ( জৈন পরিভাষায় বহুকান্তবাদি) একমাত্র গ্রহনীয়। জৈন দর্শনের শুরুই হচ্ছে  সেই পরম সত্যের অনস্তিত্ব থেকে এবং বলা হচ্ছে বাস্তববে সব সত্যই আপেক্ষিক এবং একই বাস্তবতাকে নানান আপাত সত্যদিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বস্তুত পোষ্ট মর্ডানিজমের এই মূল সূত্রগুলি জৈন ধর্মে তথা ভারতে বহুকাল থেকেই ছিল। পাশ্চাত্য দর্শন বিংশ শতাব্দিতে যে উপলদ্ধি এবং সিদ্ধান্তে এসেছে, আদিম ভারতের নাস্তিক্য দর্শনে তার প্রায় সবটাই পাওয়া যাবে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে ঈশ্বরভিত্তিক ধর্মের অত্যাচারে ভার‍তীয় নাস্তিক্য দর্শনের অনেকটাই লোপাট-তবুও যেটুকু টিকে আছে, তার অধিকাংশই পাওয়া যাবে জৈন ধর্মের মধ্যে।

 পৃথিবীতে জৈন ধর্ম বাদ দিয়ে সব ধর্মই ঈশ্বর, আল্লা, কৃষ্ণ বা কোন না কোন ( যেমন বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে ঈশ্বর না থাকলেও দুঃখ এবং দুর্দশার চার পরম সত্য আছে)  পরম সত্যর ওপর দাঁড়িয়ে যা সেই ধর্মগুলির সেন্ট্রাল ক্যানন বা কেন্দ্রীয় আইনের কাজ করে।  এর কারন হচ্ছে, সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে-সব ধর্মর জন্ম হয়েছে কোন না কোন ঐতিহাসিক সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনে যার সেলফ অর্গানাইজেশন বা বিপ্লবের সংগঠনের জন্যে এই ধরনের পরম সত্যর ধারনা লোকেদের মধ্যে ঢোকাতে হত।  এই স্থানেই জৈন ধর্ম আলাদা। কোন ধর্ম ঠিক ঠাক বুঝতে গেলে, সব থেকে গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে সেই ধর্মের উৎপত্তিকে বোঝা-সমসাময়িক ইতিহাসকে বোঝা।  এটা বুঝলে বোঝা যাবে জৈন ধর্ম কেন আলাদা।
কেন আলাদা, সেটা ভারতের ইতিহাস থেকে বোঝা সম্ভব।  আমাদের ইতিহাসে পড়ানো হত জৈন ধর্ম ভারতে ব্রাহ্মন্যবাদের প্রতিবাদে সংগঠিত সানাজিক বিপ্লব যা মহাভীর দ্বারা স্থাপিত।  আমিও জৈনধর্ম নিয়ে ওপর ওপর জেনে এটাই মনে করতাম। এটা সম্পূর্ন ভুল। জৈন ধর্মের ইতিহাস সব থেকে বেশি ইন্টারেস্টিং, অজ্ঞাত এবং অন্য ধর্ম থেকে সম্পূর্ন আলাদা।  জৈনধর্মে ২৪ জন তীর্থঙ্কর বা গুরুর সন্ধান আছে বটে-কিন্ত বুদ্ধ বা মহম্মদ এর ন্যায় এরা কেওই ধর্মএর প্রতিষ্ঠাতা নন। এরা ছিলেন ধর্মের সংকলক এবং আদর্শ অনুসারী যাদের আচরন দেখে জৈনরা নিজেদের দর্শন ঠিক করে। ২৩ তম তীর্থঙ্কর বা পর্শভা প্রথম ঐতিহাসিক জৈন ধর্মগুরু যার সময়কাল ৮শ খৃষ্টপূর্বাব্দ।  কিন্ত হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর খনন কার্য্য থেকে যে আদি ভারতীয় ধর্ম উঠে আসে, তা সম্পূর্ন অষ্ঠাঙ্গিক যোগ নির্ভর ছিল। ঐতিহাসিক হেনরি মিলার এবং জন মার্শাল মহেঞ্জোদারোর যোগী মূর্তিগুলির ওপর গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এগুলি জৈন ধর্মের কায়সর্গর ( একটি বিশেষ যোগভংগী যা জৈনরা অনুসরণ করে) পূর্বসূরী। একাধিক ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তে এসেছন এই ব্যাপারে।  মহেঞ্জোদারো সভ্যতার ধর্ম জৈন ধর্মের আদিরূপ। এবং হরপ্পা মহেঞ্জাদারোর ধর্মই আজ অব্দি টিকে গেছে জৈন ধর্মের মধ্যে দিয়ে।
       এবং জৈনরাও সেটাই বিশ্বাস করে যে তাদের ধর্ম সম্পূর্ন “ন্যাচারিলিস্টিক ধর্ম” যা মানব বিবর্তনের পথে প্রথম ধর্ম  বা মানুষের আদি ধর্ম। ঐতিহাসিক এবং সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই ধারনার যথেষ্ট ভিত্তি আছে। এর কারন জৈন ধর্মের মূল নীতিগুলি কোন বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে জড়িত না যা অন্য সব ধর্মের জন্যেই সত্য। যেমন ভাগবত গীতার জন্ম মহাভারতের যুদ্ধ-কোরানের জন্মে মহম্মদের ইতিহাসের সাথে সম্পূর্ন ভাবে যুক্ত।  জৈন দর্শন কি সে ব্যাপারে পরে আসছি-তার আগে এটা বোঝা যাক যে কি ভাবে হোমো ইরেক্টাস থেকে হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাবের সাথে সাথে “সামাজিক রিচ্যুয়াল বা আচার আচরনের জন্ম হয়েছে ( রিচ্যুয়াল অবশ্য হোমিনিড দের অন্যান্য স্পেসিসদের মধ্যেও ছিল যারা হোমোস্যাপিয়েন্সের সমসাময়িক ভাবে পৃথিবীতে কিছুদিন ছিল)।  হোমো স্যাপিয়েন্সদের গত ২০০,০০০ বছরের ইতিহাস বিতর্কিত এবং অষ্পষ্ট।  তবে যেসব ব্যাপারে একমত হওয়া যেতে পারি আমরাঃ
    [১] হোমো স্যাপিয়েন্সদয়ের আবির্ভাবের সাথে সাথে সামাজিক তথা গোষ্ঠি আচরন সুস্পষ্ট রূপ নেয় ৭০,০০০ বছর আগে থেকে।
    [২] হোমো স্যাপিয়েন্সরা পৃথিবীর যেখানেই গেছে, ১০,০০০ বছরের মধ্যে সেই স্থানে বন এবং ৯০% প্রানীকূল ধ্বংশ করেছে-কারন এরা ছিল সব থেকে কৌশলী শিকারি
   [৩]  এদের মধ্যে আদিতে আচারের অস্তিত্ব ছিল-কিন্ত কোন গুহাচিত্রেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। অর্থাৎ এদের আদি আচারন-যা ধর্মের মতন একটা গোষ্ঠি মানতে বাধ্যছিল-তা একধরনের নাস্তিক ধর্ম হতে বাধ্য। কারন হোমো স্যাপিয়েন্স দের গুহাচিত্রে পশুপাখী ব্যাতিত আর কোন ঈশ্বর জাতীয় এবস্ট্রাকশ্ নের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং ভারতে তথা গোটা পৃথিবীতেই ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মের পূর্বসূরী ছিল নাস্তিকতা বা ঈশ্বর বর্জিত সম্পূর্ন একধরনের দর্শন নির্ভর ধর্ম যা প্রকৃতি, প্রানী এবং পরিবেশের সার্বিক মঙ্গলকামনা থেকে উদ্ভুত। কারন এমনটা না করলে সেকালে সীমিত খাদ্য এবং প্রানীকূলের ধ্বংশ, মানব সভ্যতার অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করত। বিবর্তনের প্রয়োজনে মানব সভ্যতায় জৈন ধর্মের মতন নাস্তিক অথচ অহিংস এবং ত্যাগী ( বা ব্রতবদ্ধ-অর্থাৎ মানব ও প্রাণীকূলের স্বার্থ রক্ষায় আমি এই এই কাজ করব না) ধর্মের উৎপত্তি ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মের অনেক আগে আসার কথা। এবং জৈন ধর্মের মধ্যে আমরা সেটাই দেখি।
আমার উপোরোক্ত ধারনা আরো বদ্ধমূল এই জন্যে যে গোটা জৈন ধর্মে ঈশ্বর কি, তিনি আছেন কি নেই এসবের কোন অস্তিত্ব নেই। ফলে নেই কোন স্রষ্ট্রার ধারনাও। যেখানে বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধ বারংবার ঈশ্বর আছেন কি নেই-এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন এবং তার উত্তর ছিল ঈশ্বর অপ্রাঙ্গিক হাইপোথিসিস। কিন্ত জৈন ধর্ম নিয়ে পড়লেই বোঝা যায় এই ধর্মের উৎপত্তি প্রাক-ঈশ্বর  যুগে -যখন,  বিবর্তনের পথে ঈশ্বর মানবসভ্যতায় অজ্ঞাত।   এবং মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর জন্যে, সভ্য মানুষের প্রতিষ্ঠার জন্যে এদের ধাপগুলি অসম্ভব যৌত্বিক ।  তা বিশ্বাসের ওপর না বরং দার্শনিক যুক্তি ও তৎকালীন জ্ঞান বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত।  এই ধর্মের প্রধান উপপাদ্য- মানুষের প্রকৃতি-অর্থাৎ মানুষকে, নিজেকে জানা এবং নিজের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ককে জানা।  এবং এই মহাবিশ্বে ও বাস্তবতায় আমাদের অবস্থান থেকে, সবার মঙ্গল কামনায় কিছু আচার আচরনের ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করা।   
অনেকেরই ধারনা ঈশ্বর তথা ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস নৈতিকতার মূল উৎস। নাস্তিকতা মানে নৈতিকতা উচ্ছন্নে যাবে।  এই ধারনা ভাঙার সব থেকে ভাল উপায় জৈন ধর্ম অধ্যয়ন-এটি সম্পূর্ন ঈশ্বর এবং পরম সত্য বর্জিত দর্শন । এই দুইকে বর্জন করেই ( কারন তখনও বিবর্তনের পথে আজকের ঈশ্বর এবং ধর্মগুলি আসে নি) জৈন ধর্মে অত্যন্ত যুক্তিবাদি একটি নৈতিক দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে যা মানবিকতা, সততা এবং প্রেমে অন্য ধর্মগুলির অনেক ওপরেই থাকবে।  এবং যদি ধর্মে অমানবিকতা, অত্যাচারের ইতিহাস দেখা যায়, তাহলে একমাত্র জৈন ধর্মই সেই দাবি করতে পারে যে তাদের ধর্মের ইতিহাস কখনোই হিংসায় রাঙা হয় নি। কোন রক্তপাত ঘটে নি। নৈতিকতার ঐতিহাসিক, বাস্তব এবং তাত্বিক মানদন্ডে এই নাস্তিক পরম সত্য বর্জিত ধর্ম তুলনাহীন। অন্য ধর্মের ইতিহাস যেখানে ক্ষমতা এবং ধর্মীয় আধিপত্যবাদের রঙে রাঙা-জৈন ধর্মের ইতিহাস ত্যাগের উদাহরণে সমুজ্জ্বল।  যারা ঈশ্বর ভিত্তিক ধর্মকে নৈতিকতার উৎস বলে মনে করেন, তাদের ভুল ভাঙার প্রকৃষ্ট উপায় জৈন ধর্ম।  
এবার আমি সংক্ষেপে জৈন ধর্মের মূল জীবন দর্শন আমার নিজের উপলদ্ধি থেকেই ব্যাখ্যা করব।
 জৈন ধর্মের চারটি স্তম্ভ। অর্থাৎ জৈন ধর্মের অনুসারীরা এই চারটি মূল জীবন দর্শনকে জৈন আচরনের ভিত্তি বলে জানেনঃ
অহিংসাঃ  জৈন ধর্মের মূল নীতি অহিংসা। কাওকে কোন ভাবে দৈহিক বা মানসিক ভাবে আঘাত করা যাবে না।  এবং তা পশুপাখী উদ্ভিদ সবার ওপরই ।  নিজে বাঁচার জন্যে অন্যের মৃত্যু, অন্য প্রাণের মৃত্যু-এই ধর্মে স্বীকৃত না।  হিন্দু এবং ইসলামের সাথে এখানেই জৈন ধর্মের বিরাট পার্থক্য। অনেকে প্রশ্ন করবেন, তাহলে আত্মরক্ষার জন্যে হিংসা কেন স্বীকৃত না?  এর মূলকারন জৈন ধর্মে মানুষকে প্রকৃতি থেকে আলাদা করে দেখা হয় না। সে প্রকৃতির অংশ। তার মৃত্যু-জীবনের পরম নিয়তি, প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া  এবং সেই পরম নিয়তিকে দুদিন দূরে পাঠানোর জন্যে হিংসার কোন জাস্টিফিকেশন নেই।  বরং অহিংসার জন্যে নিজের প্রাণত্যাগ সমাজের পক্ষে অনেক বেশী মঙ্গলকর।
এই নীতির অবাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ হতেই পারে। কিন্ত বাস্তবত এটাই যে হিন্দু, খ্রীষ্ঠান বা মুসলমানরা মানব সভ্যতাকে এই ধর্ম যুদ্ধ, ক্রসেড বা জিহাদে নামে এক সম্পূর্ন অমানবিক এবং অস্থিতিশীল রাজনীতির জন্ম দিয়েছেন। আজকের সভ্যতা অনেকটাই বৃটিশ ইউলেটেইয়ান দার্শনিকগণের অবদান কারন আমাদের সভ্য আইনগুলি সেখান থেকেই এসেছে যা ধর্মীয় আইন থেকে মানুষকে অনেকটাই মুক্ত করেছে।  ইউলেটেরিয়ান আইনগুলির সাথে জৈন ধর্মের অনেক মিল আছে।
 সততাঃ
  জৈন ধর্মের দ্বিতীয় পিলার সততা। জৈন মতে একজন পুত্র যেমন মাকে বিশ্বাস করতে পারে,  মানুষের সততা সেই পর্যায়ের হওয়া উচিৎ যাতে তোমাকে সবাই মায়ের মতন বিশ্বাস করবে। আর যদি সততার জন্যে হিংসার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবনা থাকে, জৈন নীতি অনুযায়ী নির্বাক থাকায় শ্রেয়।
 লোক ঠকানো যাবে নাঃ
       জৈন ধর্মের নির্দেশ ঃ
                  ১। কারুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে শোষণ করা যাবে না-কারুর আর্থিক বা অন্য দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা, চুরির সমান
                  ২.  কেও স্বেচ্ছায় দিলেই-তবেই তা গ্রহণ করবে। বলপূর্বক বা ছলপূর্বক কিছু নেওয়া নিশিদ্ধ। এখানে হিন্দু বা ইসলামের সাথে বিরাট পার্থক্য। এই দুই ধর্মেই ধর্মের জন্যে বল বা ছল প্রয়োগ স্বীকৃত।
                  ৩। কারুর ভুলের, অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে, লাভ করা যাবে না।
                  ৪. চুরি করা বস্তু বা যে লাভ অনৈতিক কাজ থেকে আগত, তা গ্রহণযোগ্য না।
     ভারতে পার্শীদের ছারা জৈনরাই সব থেকে বড় ব্যাবসায়ী। এর মূল কারন এই নীতিগুলির জন্যে জৈন ব্যাবসায়ীরা সব থেকে বেশী বিশ্বাসযোগ্য। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা, সফল সৎ ব্যাবসায়ী হওয়ার প্রথম ধাপ।


ব্রহ্মচৈর্য্যঃ
জৈন ধর্মে স্ত্রী ছারা আর কারুর সাথে সহবাস স্বীকৃত না।  তবে জৈন ধর্মের মূলনীতি এক্ষেত্রে হচ্ছে, যা কিছু নেশার বস্তু, যা কিছু আসক্তির জন্ম দেয়, তার সব কিছুই পরিত্যাগ করতে হবে। আসক্তি থেকে মুক্তি, তা মদ্যপান থেকে ভাল খাবার অনেক কিছুই হতে পারে –তা পরম কাম্য। ফলে এই ধর্মে মদ্যপান, নেশাভাং সম্পূর্ন নিশিদ্ধ।

অপরিগ্রহঃ
  বিষয় সম্পত্তি, অর্থ, গৃহ, গাড়ী-বাড়ি, পোশাক-ইত্যাদির ওপর আমিত্ব কমাতে হবে।  আমার সম্পত্তি, আমার বাড়ি, আমার লেখা, আমার কৃতিত্ব-ইত্যাদি বিজাতীয় বন্ধন এবং  আসক্তি ভ্রুম-এই ধরনের ভুল ধারনা মানুষের অহঙ্কার বাড়ায় এবং বিপথে পরিচালিত করে। আজ যে সম্পত্তি আছে, কাল নাও থাকতে পারে।  সুতরাং এই সব কিছুর ওপর থেকে নিজের স্বামীত্ব বা অধিকারিত্বসুলভ মনোভাব থেকে মুক্তি পেতে হবে। সম্পত্তি থাকা অন্যায় না-কিন্ত সম্পত্তির ওপর আসক্তি একধরনের মানসিক ভ্রুম।

 এবার আসব জৈন ধর্মে পুনঃজন্ম এবং আত্মার অস্তিত্ব প্রসঙ্গে। এগুলি জৈন ধর্মের  ভিত্তি কারন আদর্শ জৈন আচরনের মূল লক্ষ্য মোক্ষ। যাতে আর আবার জন্মাতে না হয়।  এবং যেহেতু যুক্তিবাদি সমাজে এগুলি গ্রহণযোগ্য জ্ঞান না সেহেতু ঐতিহাসিক, সামাজিক দৃষ্টিতে আমরা জানব বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মে এই পুনঃজন্ম এবং আত্মা নামক দার্শনিক বস্তুটির উৎপত্তিস্থল কি?
হোমো স্যাপিয়েন্স দের আদিম গুহাচিত্র ও ফসিল থেকে এটা পরিস্কার, যে মৃত্যুর জন্যে বা মৃতকে সমাধিস্থ করার জন্যে আচার আচরনের মূলভিত্তি এই মানব বিশ্বাস যে মৃত্যুর পর জীবন আছে। মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস-মানব সভ্যতায় ঈশ্বরের জন্মের আগে এসেছে। স্বর্গের সাথে যেহেতু ঈশ্বরের ধারনা সংপৃক্ত,এটা অনুমান করা শক্ত না, যে ঈশ্বরের ধারনার জন্মের আগে,  হোমো স্যাপিয়েন্সরা যেসব রিচুয়াল করত, তার উদ্দেশ্য ছিল পরের জন্ম বা পুঃনজন্ম। স্বর্গলাভ না।  কারন ঈশ্বরের ধারনা যেহেতু তাদের মধ্যে ছিল না-স্বর্গের ধারনাও থাকতে পারে না। সুতরাং প্রাক-ঈশ্বর পর্বে ধর্ম ও রিচ্যুয়ালের ভিত্তিই ছিল পুঃনজন্মে বিশ্বাস। জৈন ধর্মের মতন প্রাক ঐশ্বরিক ধর্ম -তাই পুনঃজন্মের ধারনার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এবং বৌদ্ধ ধর্ম মূলত জৈন ধর্ম থেকেই এই ধারনাটি গ্রহণ করে।

কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে হোমো স্যাপিয়েন্স দের আচরনে কেনই বা মৃত্যুর পর বাঁচার বিশ্বাসের জন্ম নিল? মনে রাখতে হবে  বিবর্তনের পথে, মানব সভ্যতায় সব বিশ্বাসের আগমন হয়েছে মানুষের বেঁচে থাকার সারভাইভাল স্ট্রাটেজিকে উন্নত করতে।  জীবনের উদ্দেশ্য যেহেতু বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদ দিয়ে বার করা সম্ভব না এবং এটি একটি অমীমাংসিত প্রশ্ন- সেহেতু এটা অনুমান করা যায় যে শুধু একজন্মে বিশ্বাস মানুষের মনে হতাশার এবং উদ্দেশ্যহীনতার জন্ম দিতে সক্ষম। যা থেকে মানুষ উদ্দেশ্যহীনতায় ভুগে ভোগবাদি আসক্তিতে ডুবে যেতে পারত যা তৎকালীন সমাজের সারভাইভালের জন্যে কাম্য ছিল না।  যা আধুনিক সমাজের স্থিতিশীলতার জন্যেও কাম্য না।  সুতরাং জৈন ধর্ম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, এই ধরনের বিশ্বাস হোমোস্যাপিয়েন্সদয়ের মধ্যে আরো স্থিতিশীল সমাজের জন্ম দিচ্ছিল-তাই এই পুনঃজন্মে বিশ্বাসটিকে কেন্দ্রকরেই প্রথম সামাজিক নৈতিকতা এবং ধর্মীয় আচার আচরনের জন্ম হয়।

          সেকালে যেখানে ধর্মের উদ্দেশ্যই ছিল মানব সমাজে শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা,  এটা বোঝা শক্ত না, ঈশ্বরপূর্ব যুগে, যখন ঈশ্বরের রক্তচক্ষু এবং পাপের জন্ম হয় নি, পুনঃজন্মের আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নৈতিকতার ভিত স্থাপন করা ছিল একমাত্র পথ। সেটাই জৈন ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্ম করে থাকে।
       এবার আত্মার প্রশ্নে আশা যাক। পুনঃজন্ম মানেই একটা আত্মার ধারনাকে স্বীকার করে নিতে হয়, যা বার বার জন্মাচ্ছে। এটাও আসছে সেই আগের কারনটা থেকেই।  এগুলি অবিচ্ছেদ্দ্য ধারনা।
জৈন ধর্ম নিয়ে, আরো বেশী কিছু লিখতে পারলে, ভাল লাগত। কিন্ত যেটুকু নিজের দৃষ্টিতে বুঝেছি, সেটুকুই লিখলাম। এই জন্যেই লিখলাম, যে জৈন ধর্মকে বোঝার মাধ্যমে প্রাক-ঐশ্বরিক ধর্মকে বোঝা সম্ভব। ধর্মের বিবর্তন বোঝা সম্ভব। ঈশ্বরের জন্মের আগে যে ধর্মর অস্তিত্ব ছিল সেটা বোঝা যায়। এবং সে নাস্তিক ধর্মদর্শন যে ঈশ্বরভিত্তিক ধর্মর থেকে উন্নত ছিল, সেটাও আমরা দেখছি।  জৈন ধর্ম মানব সভ্যতার সম্ভবত আদি্মতম এবং আধুনিকতম ধর্ম যার দর্শন সম্পূর্ন ভাবেই ঈশ্বর বর্জিত, শাশ্বত ও চির আধুনিক।


Sunday, June 17, 2012

শিক্ষার বেসরকারীকরন অথবা ধ্বংস প্রক্রিয়া


৬/১৭/১২
 -বিপ্লব পাল

কয়েকদিন আগে বোনের সাথে কথা হচ্ছিল ব্যাঙ্গালোরের স্কুল নিয়ে। সেখানে এখন ব্যাঙের ছাতার মতন ইন্টারন্যাশানাল স্কুল।  কিন্ত সব স্কুলের স্টান্ডার্ড তথৈবচ। সব টাকা খেঁচার ধান্দা। ব্যাঙ্গালোরে এখনো ভাল স্কুল বলতে হ্যাল বা মিলিটারীর হাতে থাকা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়গুলো। বাকী নামকরা প্রাইভেট স্কুলগুলোতে বার্ষিক ২-৫ লাখ টাকা টিঊশন ফি দিয়েও কোন ভাল শিক্ষক পাওয়া যায় না। যাওয়ার কথাও না। কারন প্রাইভেট স্কুলগুলিতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের বেতন সরকারী স্কুলের ২৫%।  সে স্কুলের নাম যাইহোক না কেন। ভারতের বাকী শহরগুলিতেও এক অবস্থা। সমস্ত সরকারি স্কুলগুলিকে ধ্বংশ করা হচ্ছে। ব্যাঙের ছাতার মতন গজাচ্ছে বেসরকারী স্কুল।

  প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং এর অবস্থা আরো বাজে। সেখানেও শুনেছি ইউ জি সি স্কেলের বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধ্যাপকদের  হাতে অনেক কমটাকা ধরানো হয় অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই।  ল্যাব নেই অধিকাংশ কলেজে। ফল এই যে সব পঙ্গু ইঞ্জিনিয়ার বেড়োচ্ছে, তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং এর জ্ঞান শুন্যের কোঠায়।  এগুলো অনুমান না। আমি আমাদের কোলকাতা অফিসের জন্যে এই সব প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গুলি থেকেই ছেলে নিতে বাধ্য হই। কারন সরকারি কলেজের ভাল ছাত্ররা আমাদের মতন অনামী কোম্পানীতে আসবে না। ফলে এদের নিয়েই কাজ চালাতে হয়। কাজ চলে না।  এদের দিয়ে আদৌ কি কোন ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ করানো সম্ভব? সেটা আমার মনে হচ্ছে না। চার বছর ধরে কোন পড়াশোনা এই সব কলেজগুলোতে হয় বলে মনে হয় না। এগুলো শুধু ডিগ্রি দেওয়ার আখড়া।  এমন বাজে অবস্থা যে ইলেক্ট্রনিক্সে বিটেক করা ছেলে প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড বা পি সিবির নাম শোনে নি।  এদের ডিগ্রী থাকা না থাকা সমান।

বেসরকারি শিক্ষা পৃথিবীর কোথাও সফল হয় নি। আমেরিকাতেও না। এখানেও ভাল স্কুলিং সম্পূর্ন ভাবেই সরকারি। চীনেও সরকারি শিক্ষার ওপর ভিত্তি করেই শক্তিশালী মানব সম্পদ তৈরী করেছে। ব্যবসার জন্যে আমাকে চীনাদের সাথে কাজ ও করতে হয়, প্রতিদ্বন্দিতাও করতে হয়। নতুন প্রজন্মের চীনা ছেলে মেয়েরা আমাদের ছেলে মেয়েদের থেকে অনেক বেশী শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর মূল কারন ওদের শক্তশালী সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা।  ইনফোসিস, টিসিএস করে খাচ্ছে শ্রেফ এই জন্যে যে চীনারা এখনো ইংরেজি রপ্ত করতে পারে নি। যেদিন ওরা সেটাও পারবে, ভারতে এই যে অর্ধশিক্ষিতের দল টিসিএস আর ইনফোসিসের গোয়াল ভর্তি করছে-সেসব মায়া হয়ে যাবে।  
ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার বেসরকারীকরনের রমরমায় আমি আতঙ্কিত। এদেরকে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে চিনের সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করে খেতে হবে। না পারলে, হারিয়ে যাবে।  শিক্ষায় বেসরকারি করন এবং সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় টিউশনির রমরমা, ভারতীয় ছাত্রদের মেরুদন্দ ভেঙে দিচ্ছে।  ভারতের যেসব ফ্রেশ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েটদয়ের আমি প্রতিদিন দেখছি, তাদের অঙ্ক, ভাষা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞানে আমি রীতিমত আতঙ্কিত যে এখনি কিছু না করলে, দেশ হিসবে ভারত অনেক পিছিয়ে যাবে।
বেসরকারি শিক্ষা-বিশেষত মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে পৃথিবীতে কোথাও সফল হয় নি। এগুলো জ্ঞাত তথ্য।  সুতরাং চোখ কান বন্ধ করে শিক্ষা বাজেট আরো বাড়ানো হোক। বন্ধ হোক ডিফেন্সের পেছনে ফালতু খরচ। চীনারা যদি শিক্ষার বাজিমাত করে বিশ্বের বাজার দখল করে, কি হবে নিধিরাম সর্দার সেজে কুড়ি বছরের পুরানো প্রযুক্তির কামান নিয়ে অরুনাচলে বসে থেকে?  স্কুল লেভেলে এবং আন্ডারগ্রাজুয়েশনে সম্পূর্ন বন্ধ হোক বেসরকারি স্কুল কলেজ গুলি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষাতে যেখানে মার্কেটের সাথে যোগ আছে সেখানে বেসরকারিকরন চলতে পারে-কারন এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি নিজের প্রয়োজন মেটাতে নিজেরাই উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে।  সরকারি কলেজগুলিকে যেভাবে টাকার অভাব দেখিয়ে পঙ্গু করা হচ্ছে, তাও বন্ধ করা দরকার। এগুলো জাতির লাইফ লাইন।  এইভাবে ব্যবসায়ীদের হাতে আগামী প্রজন্মকে ধ্বংশ হতে দেওয়া যায় না।


শিক্ষার বেসরকারীকরনের মূল কারন সব দেশেই, সব রাজ্যেই এক। রাজস্ব ঘাটতি।  দেখা যাচ্ছে সব দেশে একই ট্রেন্ড। ডিফেন্সের ফালতু খরচে হাত দেওয়া যাবে না-তাই শিক্ষক ছাঁটাই কর। স্কুল তৈরী করা বন্ধ কর। এই ব্যাপারে আমেরিকা-ভারত-বাংলাদেশ সব সমান। ঘাটতি বাজেট থাকলে লোক্যাল ট্যাক্স বসিয়ে স্কুল চালানোর পয়সা জোটানো হোক। যেটা আমেরিকাতে অনেক কাউন্টি করে।  ২-৩% অতিরিক্ত লোকাল শিক্ষা ট্যাক্স বসালে, তাতে সবার লাভ। কারন ভাল স্কুলের জন্যে বাড়ির দাম ও বাড়ে।  এর জন্যে শিক্ষার মধ্যে বাণিজ্য আনা অনুচিত।  শিক্ষায় বেসরকারীকরন কোন বিকল্প হতে পারে না।