জীবিকা ও জীবন -৩ ঃ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে কি ভাবে তৈরী হতে হবে ছোটবেলা থেকে ?
বিপ্লব পাল, পয়লা মার্চ, ২০২৩
এটা মাধ্যমিক, সিবিএসসির সময়। আমি বেশ অবাক হই, এখনো এদের সিলেবাসে সেসব প্রশ্ন আসে, যা গুগুল করলে এক সেকেন্ডেই পাওয়া যায়। চ্যাট জিপিটি আরো এক কাঠি ওপরে-এখন প্রশ্ন করলে, "মোটামুটি" কোয়ালিটি উত্তর ও দিয়ে দেবে।
২০০১ সালের প্রবল ঠান্ডার মধ্যে যখন আমেরিকাতে এসেছিলাম, তখন দেশটাকে ঘুরে দেখার একমাত্র উপায় ছিল পেপারের ওপর আঁকা ম্যাপ। ২০০৪ সালে কর্মসূত্রে ক্যালিফোর্নিয়াতে একেক মাসেই ঘুরতাম প্রায় আট দশ হাজার মাইল । গ্রাম থেকে গ্রামে, পাহার থেকে হ্রদে। ক্যালিফোর্নিয়ার গোটা রাজ্যটাই পৃথিবীর বুকে স্বর্গ। হাতে ম্যাপ। মাধ্যমিকের ভূগোল নলেজ কাজে আসত। তারপর এসে গেল জিপিএস-গার্মিন। সেই বলে দিতে লাগল, রাস্তা, অলি গলি। এখান থেকে ওখানে! ব্যাস গত ১৬ বছরে ম্যাপ রিডিং একদম হারিয়ে গেছে। এখন ইচ্ছা করেই অনেক সময় জিপিএস চালাই না। আমার টেসলার সামনে এক ঢাউস ম্যাপ দেখা যায়। নিজেই ম্যাপ দেখে রাস্তা রাউট করি। এইটুকু মাঝে মাঝে, না করলে, ম্যাপ রিডিং করার ব্রেনের যে ক্ষমতা ছিল, যা সম্পূর্ন নষ্ট হয়ে যাবে।
আরেকটা মজার ঘটনা বলি। কোলকাতায় আমার যে ড্রাইভার-সে একবার কোন রাস্তায় গেলে, সম্পূর্ন মনে রাখে। মানে ছবির মতন রাস্তাঘাট মনে রাখত। গত দুই বছর দেখছি-সেও স্মার্টফোনে নেভিগেশনের স্বাদ পেয়ে গেছে। এখন আর মনে রাখার চেষ্টা করে না। এখন সেও স্মার্টফোনের নির্দেশ নির্ভর!
ক্যালকুলেটর আর স্প্রেডশিটের দিনে কেউ আর যোগ বিয়োগ গুন ভাগ মনে মনে করে না। ফলে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সেন্স অব নাম্বারটাই হারিয়ে গেছে। আমি এখনো কিছু কিছু যোগ বিয়োগ গুন ভাগ, মনে মনে করার চেষ্টা করি। নইলে সেন্স অব নাম্বার সম্পূর্ন হারিয়ে যাবে। যা একজন ইঞ্জিনিয়ার এর পক্ষে খারাপ।
চ্যাট জিপিটি আসার সাথে সাথে, এটাই আমার প্রথমে মনে এল। এবার ছাত্রছাত্রীরা লেখালেখির অভ্যেস ছেড়ে দেবে। যদিও চ্যাট জিপিটির লেখার হাত মারাত্মক কিছু ক্রিয়েটিভ না- কিন্ত কার্যকর। কিন্ত ছাত্রছাত্রীরা যদি লেখালেখি ছেড়ে দেয়, চিন্তা করাটাই ছেড়ে দেবে। লেখাত আমাদের চিন্তার প্রতিবিম্ব।
মেশিনের ওপর নির্ভর হতে হতে এই যে সেন্স অব ডিরেকশন, সেন্স অব নাম্বার, বেসিক চিন্তাকে ট্রান্সলেট করার ক্ষমতা হারিয়ে যাচ্ছে- এর ফল হবে মারাত্মক।
আপনি বলবেন কেন? অটোমেশন যা করে দিচ্ছে-যা মানুষে করে কি হবে?
এবসোলিউটলি ঠিক। কিন্ত অটোমেশন কি করবে- সেটা খামারই হোক বা কারখানা- মিলিটারি বা মেডিক্যাল -বলে দিতে হবে কিন্ত সেই মানুষকেই। আর সেটা করতে গেলে আমাদের চিন্তাকে আরো উন্নত করতে হবে- যেখানে এই সেন্স অব ডিরেকশন, সেন্স অব নাম্বার, এবসট্রাকশন, কাল এবং ত্রিমাত্রিক ধারনা-একটা সিম্যুলেশন সম্পূর্ন মাথায় রাখা-এগুলো না রাখলে সেই সৃজনজীল চিন্তা, সেই ক্রিয়েটিভ স্ট্রাটেজিই বা আসবে কোথা থেকে?
হোয়াট ইজ ক্রিয়েটিভিটি? সৃজনশীলতা কি ? সৃজনশীলতা-তা কাব্যেই হোক, বা বিজ্ঞানে, অঙ্কে বা ফুটবলের মাঠে- তা একটাই- চিত্রকল্প মাথায় ভেসে ওঠা।
মেসি, এমবাপের পাশ গুলো দেখেছেন? ওই পাশ গুলো যে "অন্যতম সমাধান" সেগুলো আপনি আগে থেকে ভাবতে পারেন? ওরা পারে। কারন ওগুলো দ্রুত ওদের ব্রেনে ভেসে ওঠে।
১৯৯৭-৯৮ সাল। তখন পিএইচডি করছি। আমার লিনাক্স সিস্টেমে একটা দাবার গেম ছিল। সেটার সাথে খেলতাম এবং হারতাম। এটা সেই সময় যখন ক্যাস্পারভ বনাম ডিপ ব্ল -মানুষ বনাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ হত। ২০০৪-৫ সালের পর আর এসব হয় নি। কারন এখন অতি সাধারন কম্পিউটার গেমের এলো রেটিং ৩০০০+ হয় এবং তা গ্রান্ড মাস্টারদের হারিয়ে দেবে। আমি হারতাম, শুধু শিখতে। মনে রাখবেন, জিতলে কেউ শেখে না। শেখে হারলে। সাফল্য শেখায় না, ব্যর্থতা শেখায়।
এখন প্রশ্ন উঠবে, যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের সব ক্ষেত্রে হারিয়ে দেয়, তাহলে, তার সাথে যুদ্ধ করে, প্রতিযোগিতা করে কি হবে?
দুটো ভুল হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু সেই ক্ষেত্রেই কাজ করবে-যেখানে ডিগ্রি অব ফ্রিডম কম এবং সিস্টেমে ডেটারমিনিজম বেশী। দাবাখেলায় কম্পুউটারকে হারানো যায় না- কারন দাবা খেলায় কটা সম্ভাব্য চাল হবে- এবং তার ফল কি হবে, তা আগে থেকে গননা করা সম্ভব।
কিন্ত ধরুন আপনি বৌ বা প্রেমিকার সাথেও খেলছেন। সেই খেলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে চাল দিতে বলুন। ডাঁহা ফেল করবে। কারন আপনার বৌ বা প্রেমিকার মুড এবং চয়েস দুটোই ভীষন আনসার্টেন-কখন কি করবে তার ঠিক নেই! যুক্তিপূর্ন চয়েস নেবে-তারা কোন নিশ্চয়তা নেই। একই কথা খাটে কন্সিউমার মার্কেটে। মহিলারা যে কিভেবে কি যুক্তিতে তাদের পার্টনার বা প্রোডাক্ট সিলেক্ট করে- তার অনেক ক্ষেত্রেই মাথামুন্ডু থাকে না-একজন ক্রেতা কেন কিনবে- সেই যুক্তিও যে খুব যে বেশী যুক্তিপূর্ন -তা না। এখানেই মানুষের স্কোপ।
প্রেমিকা, কনসিউমার-এসব সিস্টেমের ডিগ্রি অব ফ্রিডম এত বেশী-এসব ক্ষেত্রে কিছু কিছু কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করতে পারলেও, মানুষ লাগবেই।
দ্বিতীয় ব্যপারটা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাথে নিরন্তর প্রতিযোগিতায় থেকে, তার কাছ থেকে দ্রুত শিখতে হবে। বুঝতে হবে তার দুর্বলতা। এই জন্যে আমি সব সময় চ্যাট জিপিটি যত গুলো পয়েন্ট বলে- সব সময় ভাবি আর কি ও বললো না। কি মিস করে গেল। কাজটা বেশ কঠিন। একজন ছাত্র হলে আরো কঠিন। কিন্ত ভবিষ্যতে শিক্ষক এবং ছাত্রদের কাজ সেটাই। চ্যট বট, আই-বট- হরেক রকমের বট কি পারে না-যা আমরা পারি-সেটা না বার করতে পারলে, লোকে কাজে কেন নেবে? চ্যাট জিপিটি দিয়েই করবে।
সুতরাং একজন ছাত্রছাত্রীকে এখন থেকেই দুটো কাজে প্রচন্ড দক্ষ হতে হবে
#১ কিভাবে এইসব চ্যাটবট ব্যবহার করে, দক্ষতা আরো অনেক বাড়ানো যায়
# ২ দক্ষতাই শুধু না, চ্যাটবটের ভুল বা, চ্যাটবট যদি কিছু মিস করে যায়-তা ধরার ক্ষমতাও রাখতে হবে। এটা কঠিন কাজ, কিন্ত সম্ভব। ইন্টালেকচুয়াল লেভেল অনেক বেশী লাগবে।
মোদ্দা কথা ক্যাচাপ এন্ড দেন এক্সিড এ আই । কাজটা সহজ হবে না। কিন্ত করতে হবে।
খুব বাজে শোনালেও সত্য, সফটোয়ার শিল্পের ৯৫% চাকরি বাজারে টিকে আছে-কারন মানুষে বাজে কোয়ালিটির কোড লেখে। এগুলো দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে বটেদের উৎকর্ষ উৎপাতে। তারপর? সেই ৯৫% লোক কি করবে?
লোকে টিকে থাকবে আইডিয়া এবং এবস্ট্রাকশনে। অর্থাৎ চিন্তার উৎকর্ষতায়-সৃজনশীলতার জোরে।
কালকে এম আই টির এক ছাত্রীর ইন্টারভিউ দেখছিলাম। তার বয়স এখন ৩৫। বেশ কটি ফেইলড স্টার্টাপের পর লেটেস্ট স্টার্টাপে ২০০ মিলিয়ান ডলার বা ১৬০০ কোটি টাকা তুলেছে। বানিয়েছে এক নতুন প্রোটিনের বিউটি ক্রিম- যা বুড়িদের ও ছুড়ি বানা্বে। বটক্সের বিষহীন বিকল্প। সে একটা কথা ঠিক বলেছে। যতই ভাল স্কুল হোক-তা ১০০তে ১০০ পেতে শেখায়। কেউ শেখায় না শুন্য পেলে,মানে ফে;লিউর হলে, কিভাবে সেই ফেলিওর থেকে শিখে সাফল্যের পথে যেতে হবে। অথচ এটাই হওয়া উচিত আসল শিক্ষা । ভবিষ্যতের শিক্ষা। যেখানে সবাই একটা পরীক্ষা দেবে। সেখানে ১০০ তে সবাই শুন্য পাবে। তারপর ভুলগুলো পর্যবেক্ষন করে ১০০ তে ২০ পাবে। তারপরে আবার ভুলগুলো চর্চা করবে-করে সেখান থেকে ১০০ তে ৫০ পাবে। এইভাবে আসে আস্তে সে একমাস বা দুইমাসের চেষ্টায় ০/১০০ থেকে ৯০/১০০ তে আসবে। এই শিক্ষা না পেলে, কর্মক্ষেত্রে এখন স্কুল কলেজের সব শিক্ষা সম্পূর্ন ইউজলেস। যে প্রশ্নে ১০০/১০০ পাওয়া যায়, তা চ্যাট জিপিটিও করে দেবে।
No comments:
Post a Comment