জীবন এবং জীবিকা-৫ ঃ কোম্পানীতে ইন্টার্নশিপ, বিটেক সার্টিফিকেটের থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ন ?
শ্রীধর ভেম্বুর নাম শুনেছেন? অনেকেই শোনেন নি-কারন তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে ভারতের সব থেকে সফল সফটোয়ার প্রোডাক্ট কোম্পানী জোহো তৈরী করেছেন। শ্রীধর আই আই টি মাদ্রাস, তারপর প্রিন্সটনের পি এইচ ডি। জোহো ভারতের সব থেকে সফল স্টার্টাপ-কিন্ত কোন স্টার্টাপ ফান্ডিং নেয় নি। সম্পূর্ন অর্গানিক গ্রোথ। জোহোর নাম, ভারতের আই টি ছাত্ররা হয়ত শোনে নি-কারন জোহো ক্যাম্পাসিং করে না। অথচ, আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে জোহোর সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোয়ালিট ভারতের অন্যান্য সফটোয়ার কোম্পানীর থেকে অনেক এগিয়ে। গোট বিশ্বজুড়ে তাদের প্রোডাক্টের সাফল্য-যেখানে তারা সিলিকন ভ্যালির বহু বিলিয়ান ইনভেস্টেড কোম্পানী সেলসফোর্সকে হারিয়ে দিচ্ছে- সেখানে সন্দেহের অবকাশ থাকে না, তাদের সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের কোয়ালিটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্ত তারা আই আই টি ইত্যাদি ক্যাম্পাসিং করে না!!
শ্রীধর মনে করেন, ভারতের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি কোয়ালিটি সম্পূর্ন ফালতু। ওই দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের প্রোডাক্ট কোম্পানী হবে না- বড়জোর টিসিএস ইনফির আই টি কুলিগিরির বিজনেস হবে। সেইজন্য শ্রীধর তামিলনাডুর গ্রামে গ্রামে নিজেই জোহোর স্কুল খুলেছেন। বাছাই করা গরীব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের তুলে এনে মাসে ১০,০০০ টাকা ইন্টার্নশিপ স্টাইপেন্ড দেন। একদম স্কুল থেকে তারা জোহোর ভাল ভাল সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে হাতে কলমে শেখার সুযোগ পাচ্ছে ( ইন্টার্নশিপ )। শ্রীধরের কোম্পানীর একদম সেরা মানের সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার পাওয়ার চাবিকাঠি এটাই।
শ্রীধর ভেম্বু দেখিয়ে দিয়েছেন ভারতের ছেলেমেয়েরাও পারে। একদম বিশ্বমাঝে শ্রেষ্ঠ আসন নিতে পারে যদি, তাদের আমরা সেই সুযোগ, সেই পরিকাঠামো দিই।
কোলকাতার সেক্টর ফাইভের সফটোয়ার কোম্পানীর অধিকাংশ সিইওই আমার ব্যক্তিগত লেভেলে চেনা। অনেকে বহুদিনের বন্ধু। তাদের সাথে দেখা হলেই, গল্পটা আক্ষেপের পর্যায়ে চলে যায়। আক্ষেপ এই যে- আই টি ব্যবসার মার্কেট খুব ভাল। বিশেষত আউটসোর্সিং এর। কিন্ত আমরা সঠিক ভাবে ভাল কোডার পাই না। সাপ্লাই লাইনের অভাবে আমাদের সবার ব্যবসাতেই ভাল ক্ষতি হচ্ছে। প্রোডাক্ট কোম্পানী বানানো অনেক দূর। ব্যাঙ্গালোর বা পুনেতে যে অবস্থা খুব বেশী ভাল তা না। এত এত ছেলে পাশ করে বেরোচ্ছে- এদের ১% ও ভাল কোডার না। ২০১৯ সালে একবার আমরা ক্যাম্পাসিং এ পরীক্ষা নিয়েছিলাম। ১৮০০ ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৩জন ৩০% এর বেশী পেয়েছিল। আমাদের একটা কোডিং ক্লাব আছে- সেখানে ৫০০+ মতন ছাত্রছাত্রী কোডিং চ্যালেঞ্জ প্রাক্টিস করে। ১০জন ছাত্রছাত্রীও নেই যে বলবো এরা কোডিং ভাল শিখেছে। ভাল শিখেছে মানে গুগুলের যে কোডিং স্টান্ডার্ড- কোডিং জ্যাম এর স্টান্ডার্ড মেইন্টেইন করতে পারে!
এবার আমরা সব দোষ দিই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ওপর। কারন অভিযোগ তারা টিচারদের ঠিকঠাক ইউজিসির স্কেল দেয় না। টিচার নেই। মুশকিল হচ্ছে যদি তারা শিক্ষকদের ঠিক ঠাক ইউজিসির স্কেল দিতও, তাহলেও একজন ভাল কোডারের বেতন একজন ইউজিসির প্রফেসরের থেকে ৩-৮ গুন!!!! সুতরাং কোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, শিক্ষকদের ইউজিসি স্কেল দিলেও ভাল কোডিং শিক্ষক পাওয়া যাবে তা কিন্ত গণিতের নিয়মেই সম্ভব না।
তাহলে ছেলেমেয়েরা সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বা কোডিং ভাল শিখবে কোথায়?
অনেক বাবা-মা চিন্তিত হয়ে আমাকে হোয়াটসাপ মেসেজ পাঠান-ছেলেটা +১২ এ খুব খারাপ রেজাল্ট করেছে। এখন একটা ওচা প্রাইভেট ইঞ্জিনিইয়ারিং কলেজ ছাড়া পাচ্ছে না! কি করা যায় ইত্যাদি-ইত্যাদি--
আমি তাদের একটা কথায় বারবার বলেছি- তাদের ছেলে বা মেয়েরা যদি সত্যিই সফটয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং শিখে ভাল চাকরি করতে ইচ্ছুক- তাহলে কোন কলেজে কি ডিগ্রি পাচ্ছে-তা দেখে লাভ নেই। তাকে ফার্স্ট ইয়ার থেকে কোন সফটোয়ার কোম্পানীতে ইন্টার্নশিপ মানে খাতা কলমে কোডিং শিখতে হবে।
কোলকাতায় এমন প্রচুর ছোটখাট কোম্পানী আছে। ৪-১০জন কর্মী। কিন্ত মালিক নিজেই সফটয়ার কোডার। ভাল কোডার। সেই শেখায়। আজকের দি্নে বিটেক, বি এস সি এসব ডিগ্রি দিয়ে কেউ চাকরি পাবে না। সে স্কিল জানে সেই পাবে। যারা আই টি ক্যারিয়ারে ইচ্ছুক-তাদের একদম স্কুল লেভেল থেকেই এইসব ছোট ছোট সফটোয়ার কোম্পানীতে ইন্টার্নশিপ করে কোডিং শেখা উচিত। আরেকটু ভাল শিখলে, আরেকটু বড় কোম্পানীতে যাবে।
নইলে ৩ বা ৪ বা ৫ বছরের যাই আই টির কোর্স হোক-সব বেকার। কোন কাজের না। কোন কলেজেই কোডিং এর ভাল শিক্ষক নেই। কারন যে ভাল কোডীং জানবে সে কোম্পানীতে চাকরি করবে, বা নিজেই কোম্পানী খুলবে।
সুতরাং যারা আই টি কেরিয়ারে ইচ্ছুক-তাদের প্রথম বর্ষ থেকেই ছোট ছোট কোম্পানীগুলোতে ইন্টার্নশিপে যেতে হবে। এছাড়া কোডিং ভাল শেখার দ্বিতীয় কোন উপায় নেই।
No comments:
Post a Comment