সন্তান কোন স্ট্রিমে পড়াশোনা করবে? তার ফিউচার কি?
বিপ্লব পাল, ২৪শে ফেব্রুয়ারী
(১)
আমি ফেসবুক ইনবক্সে, এই প্রশ্নটাই সব থেকে বেশী পাই। অবশ্যই বাবা-মাদের কাছ থেকে। ভারত বা বাংলাদেশে বাবা-মা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে অনেক বেশী চিন্তিত। আমেরিকাতে এই ধরনের সন্তানচাপ অনেক কম।
#১ কি নিয়ে পড়াশোনা করলে আপনার সন্তান অনেক বেশী রোজগার করবে?
# ২ কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়লে আপনার সন্তানের চাকরির নিরাপত্তা জীবনের নিরাপত্তা সব থেকে বেশী?
# ৩ কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়লে আপনার সন্তানের নামডাক হবে? সে একটা লেগাসি ছেড়ে যেতে পারবে?
আমি যদ্দুর বুঝি, অধিকাংশ অভিভাবক #১ এবং # ২ চাইছেন। # ৩ কোন কোন ক্ষেত্রে।
দুঃখের ব্যাপার, কোন অভিভাবক বোধ হয় জানতেও চান না, কোন কেরিয়ারে গেলে তার সন্তান মনেপ্রাণে সুখী হবে। জীবনে পূর্নতা পাবে।
(২)
এই #১ এবং #২ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে, ছেলেমেয়ে মানুষ করার ব্যপারে আমার নিজস্ব বক্তব্যটা বলা জরুরী।
"সফল" মানুষ কে, তার ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে একেক রকম। আই আই টি খরগপুরে আমার অনেক বন্ধুই বৈবাহিক জীবনে ডিভোর্স মামলা ইত্যাদিতে এত ঘেঁটে আছে হয়ত তাদের থেকে অনেক নিম্নমেধার অতিসাধারন ছেলেমেয়েরা হয়ত গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক বা সাধারন চাকরি করে অনেক ভাল আছে। আমেরিকাতে আমার একদা এক সহকর্মী- এখানকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এম আই টির গ্রাজুয়েট ছিল। লোকটি যথাযত মেধাবী। কিন্ত সে কিছুতেই কাজে মন দিতে পারত না। তার চতুর্থ বিয়ে চলছে-এর আগের সব ডিভোর্সে জীবনের সব সঞ্চয় হারিয়েছে। এবার ছেলেমেয়ের কাস্টডি-ইত্যাদি নিয়ে প্রায় সব এক্স-ওয়াইফদের সাথে এত ঝামেলা, লোকটাকে আমি কিছুতেই প্রোডাক্টিভ করতে পারি নি। এগুলো ব্যতিক্রম কেস না। আই আই টিতে প্রচুর সুইসাইড কেস নিজে দেখেছি। এখনো হচ্ছে।
পয়েন্ট টু নোট- জীবনে লেখাপড়া, ভাল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির থেকেও বেশী জরুরী-
-- সঠিক সিদ্ধান্ত নিওয়ার ক্ষমতা। রাইট জাজমেন্ট। এটি শুধু পড়াশোনার সাবজেক্ট নিয়ে বসে থাকলে হবে না। সাথে সাথে দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি-সব কিছুরই ভাল ফাউন্ডেশন দরকার।
- সুস্থ থাকা। মানসিক এবং শারীরিক দিয়ে। এর জন্য শরীরচর্চা, মনের চর্চা, ঘুম ইত্যাদির দরকার। আজকের ছেলেমেয়ের হাতে স্মার্টফোন, অর্ডার করলে পিজ্জা-আর ঘর থেকে বেড়োলেই দূষন। স্মার্টফোনে চ্যাট করে, গেম খেলে ঘুমের বারোটা বেজে গেছে প্রায় সবার। ফার্স্টফুডের দৌলতে খাবার ও আনহেলদি। ফলে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীই ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। এক্সট্রিম কেসে সুইসাইড। এগুলো হত না যদি বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের শরীর চর্চা অর্থাৎ ফিল্ডগেম বা মনের চর্চা-যেমন সঙ্গীত, আর্টস, সাহিত্য এগুলোও মনোযোগ দিয়ে শেখাতেন।
প্লেটোর শিক্ষাচন্তায় এই দুটিদিক খুব আলোচিত। আমি বুঝতে পারি না, ২৪০০ বছর বাদে যখন ভারতে একটা শিক্ষা ব্যবস্থা চলছে সেখানে স্কুলে কেন শরীর এবং মন উপেক্ষিত? কারন যেটুকু বুঝি, ভারতের শিক্ষা থেকে পুলিশ, আই এ এস থেকে রেইল-সবই বৃটিশ কলোনিয়াল দান। দাসবৃত্তির পরস্পরা।
ফলে এই শিক্ষায় শরীর এবং মন গঠন করার বদলে কে কম্পিউটার সায়েন্স- কে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়বে-তাই নিয়ে বাবা-মারা বেশী চিন্তিত!
আমার কাছে শরীর এবং মন তৈরী করাটাই আসল। কি সাবজেক্ট শিখল সেটার গুরুত্ব তারপর। কারন শরীর এবং মন হচ্ছে শিক্ষার আধার। শরীর আর মন ঠিক না থাকলে-শিখবেই বা কি করে? ডিপ্রেশনে গিয়ে সুইসাইড করে ফেলবে ত!
(৩)
এবার আসি কোন সাবজেক্ট-কোথায় কি পড়বে। ভাল জায়গায় যদি চান্স না পায়!!!!!
এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে ভবিষ্যতই বা কি?
এবার কিছু প্রাক্টিক্যাল দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করি। মানে কিছু ফ্যাক্ট লিখি
-আজকে অধিকাংশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আই টি বা সফটওয়ারের চাকরি করে খাচ্ছে। এই চাকরিগুলি আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগে বাজারে ছিল না। আপনার ছেলেমেয়েরা যে চাকরি গুলি করবে সেগুলি এখনো জন্মায় নি।
- এই মুহুর্তে জব মার্কেটে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষা সম্পূর্ন "ইউজলেস"। শিক্ষকতা আর সরকারি চাকরি ছাড়া-এগুলো কাজে আসবে না। গুগুল, ফেসবুক, টেসলা-আমেরিকার সব বড়বড় কোম্পানীগুলি বর্তমানে "ডিগ্রির" বদলে নিজেদের সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম চালু করেছে। "স্কিল" থাকলে, সেখানে পরীক্ষা দিয়ে, বা শিখে যে কেউ ডিগ্রি না নিয়েও চাকরি পেতে পারে। ভারতে টিসিএস , ইনফি এরাও একই দিকে যাচ্ছে। এটাই ভবিষ্যত। শেখাটাই আসল। সরকারি চাকরি না থাকলে, ডিগ্রি সম্পূর্ন অপ্রয়োজনীয় হতে চলেছে। শিক্ষা --> স্টান্ডাইজড টেস্ট--> ইন্টারভিঊ এই ভাবে চলবে ভবিষ্যত।
- স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটুকু জব শেখার স্কিল- তা খুব সীমিত। মূলত চাকরিতেই স্কিল শিখতে হয়। সেইজন্য জীবনের প্রথম ২-৩ টে চাকরি কোথায় করবে-তার খুব গুরুত্বপূর্ন। সেখানে স্কিল শেখা এবং শেখানোর লোক থাকা সব থেকে বেশী জরুরী।
- চাকরির ক্ষেত্রে- তা যদি সরকারি বা শিক্ষকের চাকরি না হয়-শুধু ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি বা শুধু কোডিং, বা শুধু স্টাটিসস্টিক্স শিখে হয় না। কারন তাকে অন্যদের কাজ ও বুঝতে হবে। সুতরাং সর্বদা সব সময় নতুন কিছু শেখার মনোভাব রাখতে হবে।
- কিছু কিছু জিনিস স্কুল লেভেলে ভাল না শিখলে মুশকিল। প্রথমটা হচ্ছে ভাষাজ্ঞান। কমিউনিকেশন স্কিল। এটি হচ্ছে স্কিল অব দ্যা স্কিলস। শুধু ইংরেজি গ্রামার বা শব্দ জানলেই হবে না। সঠিক ভাবে কি করে গুছিয়ে নিজের বক্তব্য রাখতে পারবে- সেটা আরো বেশী জরুরী। কমিউনিকেশন স্কিল ভাল না হলে শুধু কোন সাবজেক্ট জেনে লাভ নেই। দ্বিতীয় হচ্ছে সংখ্যাতত্ত্বের বেসিক। আর কোডিং বেসিক। যারা টেকনিক্যাল লাইনে থাকবে, তাদের এই তিনটি স্কিল মোটামুটি ৭০%। বাকী ৩০% হচ্ছে নিজেদের সাবজেক্ট।
- আই টি, কম্পিউটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক্স, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, স্টাট- যেকোন সাবজেক্ট শিখলেই ভাল চাকরি পাবে। যদি বাকি তিনটে প্রাথমিক স্কিল থাকে। কিন্ত সমস্যা হচ্ছে কেউ শেখে না। সবাই মার্কস পাচ্ছে। ডিগ্রি পাচ্ছে। এসব বোগাস । ভারতের ৯৮% গ্রাজুয়েট এম্পয়েবল না।
-কেন শেখে না-সেই প্রশ্ন ওঠাও জরুরী। কারন সে ত নিজে থেকে এটা করছে না। বাবা-মা চাপ দিয়ে পড়তে পাঠাচ্ছে। যে শিক্ষক শিক্ষিকা পড়াচ্ছে, তারাও সেই চাপের প্রোডাক্ট। আমার নিজের অভিজ্ঞতা শিক্ষক এর ও ৯৭%+ ইউজলেস। কিন্ত এটা ইউ টিউব, উইকিপেডিয়া এখন চ্যাট জিপিটির যুগ। ইউ টিউবে শেখা যেকোন ক্লাশে শেখার থেকে অনেক গুন ভাল। কিন্ত সেই প্রশ্ন- একজন শিখবে কেন? কোথা থেকে সেই অনুপ্রেরণা পাবে?
এখানেই বুঝতে হবে আপনার সন্তানকে না চাপ দিয়ে, "ভাল লাগতে" শেখান। তার গান, ছবি, কবিতা ভাল লাগুক। গান, ছবি কবিতা এসব ভাল লাগলে, তবেই সে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি এলগোরিদমের মধ্যে ছবি এবং ছন্দ দুই খুঁজে পাবে। তবে না সে একটা সাবজেক্টকে ভালবাসতে পারবে!
-শিখতে ভাল লাগা কেন জরুরী? কারনটা আগেই লিখেছি। স্কিল দ্রুত বদলাচ্ছে। নতুন নতুন চাকরি আসছে। পুরাতন চাকরির বাজার ছোট হচ্ছে। প্রতিদিন নতুন নতুন শেখার নেশা না থাকলে, ভবিষ্যতের মার্কেটে সে টিকতে পারবে না।
৪)
ভবিষ্যত কি?
সরকারি চাকরি, স্কুলের চাকরি এসব থাকবে বলে আমার মনে হয় না। কারন গণতন্ত্রে এখন জনগনকে সরাসরি ঘুঁশ দিয়ে ভোট টানার কাল। সুতরাং বাজেট যাবে ইউ বি আই বা উনিভার্সাল বেসিক ইনকামের দিকে। ফলে সরকারি কাজে অটোমেশন আসছে- আরো বেশী আসবে। এতে সরকারের দক্ষতা বাড়বে। বাজেট কমবে। সরকার জনগনের একাউন্টে আরো বেশি টাকা দিতে পারবে। ফলে সরকারি চাকরির স্কোপ কমতেই থাকবে।
আর বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও ক্রমাগত কম লোক লাগবে। কারন অটোমেশন এ আই।
কিন্ত নতুন নতুন বেসরকারি ক্ষেত্র খুলতেই থাকবে। যেমন আজ থেকে ২০ বছর আগেও শরীরচর্চা বা জিম ইন্সট্রাকটর যে একটা পেশা হতে পারে সেটাই কেউ ভাবে নি। কিন্ত এখন দেখুন পাড়ায় পাড়ায় জিমের দরকার। মনোবিদদের কাজ ও দ্রুত বাড়ছে। ফলিত গবেষনার ক্ষেত্র আরো অনেক বাড়বে।
যারা মানুষের হেলথ নিয়ে কনস্যাল্টন্সি করে-শুধু ডাক্তার না- মনোবিদ, ডায়েটিশিয়ান, জিম ইন্সট্রাকটর এসবের চাহিতা হু হু করে বাড়বে।
আন্তারপ্রেনারদের চাহিদাও বাড়বে। কারন তা না হলে, নতুন ব্যবসা তৈরী হবে না। নতুন ফিল্ডে, নতুন চাকরি তৈরী হবে না। ভবিষ্যতে ব্যবসার স্কিলটাও বেসিক স্কিল হিসাবেই ধরতে হবে।
জীবন আসলেই খুব জটিল। শুধু চাকরি করে, টাকা উপার্জন করে জীবন তৈরী হয় না। কবিতা গান প্রেম ভ্রুমন এসব বাদ দিয়ে শুধু টাকা উপার্জন হচ্ছে কলুর বলদগিরি।
No comments:
Post a Comment