Saturday, March 19, 2022

কাষ্মীর ফাইলস-ন্যারেটিভের যুদ্ধ

 কাষ্মীর ফাইলস-ন্যারেটিভের যুদ্ধ


-বিপ্লব পাল, ২০শে মার্চ, ২০২২

একটা বলিউডি সিনেমা যেটা বুক ফুলে দাবী করছে, যা দেখাচ্ছি-তা ফিকশন না! ঘটনা সত্য! এটাও দাবী করছে, বর্তমান বিশ্বের সবথেকে চলমান যুদ্ধ ইনফর্মেশন ওয়ার। ন্যারেটিভের দখল নিতে হবে। এটা খুব ঠিক। তবে চেপে গেছে, যে ১৯৯০ সালে ক্ষমতায় ছিলেন ভিপি সিং। যার সমর্থনে ছিল বিজেপি সরকার। পন্ডিতদের সেই সময় বাঁচাতে বিজেপি, ভিপি সিংকে চাপ দিয়েছিল ? এমনটা যে না-সেটা কিন্ত এই সিনেমাই দেখিয়ে দিচ্ছে!

জেনোসাইড মুভি আমি প্রচুর দেখি। আর্মেনিয়ানরা , তুর্কীদের হাতে জেনোসাইড ভুলতে দেয় নি পৃথিবীকে। প্রচুর সিনেমা তৈরী হয়েছে আর্মেনিয়াম জেনোসাইড নিয়ে। যতগুলো দেখেছি- আরারত, নেহাপত, মেরিগ, প্রতিটা সিনেমাই অসাধারন। ইহুদিরাও ভুলতে দেয় নি। গোটা ইউরোপে নাৎসিদের হাতে ইহুদি নিধন নিয়ে সব থেকে বেশী জেনোসাইড সিনেমা তৈরী হয়েছে। ইউক্রেনিয়ানরাও স্টালিনের হাতে হল্ডোমারে তাদের এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠির মৃত্যু ভুলতে দেয় নি পৃথিবীকে।

কিন্ত ভারতবর্ষ একটা অদ্ভুত দেশ। এখানে ইতিহাসের সবকিছু চেপে দেওয়াই রীতি। সর্দার উধম সিং সিনেমাটির আগে জালিওনাবাগ হত্যাকান্ড পর্যন্ত সিনেমাতে দেখায় নি! ভারতভাগ এবং পার্টিশনের দরুন পাঞ্জাব এবং বাংলায় যে জেনোসাইড চলেছে- সেটাও সরকারি ঐতিহাসিকরা চেপে দিয়েছেন।

সুতরাং একদিন না একদিন, এইসব কালোসত্য গর্ত থেকে বেড়োবেই। বিজেপির ন্যারেটিভ জেতার দায়ে এটলিস্ট কাশ্মীরের পন্ডিত গণহত্যার সত্য সবার সামনে এল। কালযদি ভারতের লিব্যারেলরা ক্ষমতা জেতে, তারা গুজরাত গণহত্যা সামনে আনবে। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে বাঙালীদের মধ্যে ঘটা গণহত্যা- গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং, নেলি গণহত্যা, নোয়াখালি গণহত্যা-এগুলোর সত্য সামনে আনার ক্ষমতা কি বাঙালী ফিল্ম মেকারদের আছে?

আমি আশাকরি কাষ্মীর ফাইলস যে ট্রেন্ড তৈরী করে দিল- যেভাবে ভারতের লিব্যারল রাজনীতির কাষ্মীর ন্যারেটিভকে ধ্বংস করল, ঠিক সেইভাবেই এবার নোয়াখালি, নেলি গণহত্যার সিনেমাও তৈরী হবে।

কাষ্মীর ভারতের অংশ , না স্বাধীন অঞ্চল- এসব প্রশ্নের উত্তর ওই ঈশ্বর মহাশয় আছেন না নাই-ঐটাইপের এবস্ট্রাক্ট। কারন দেশ, ঈশ্বর, ধর্ম -এসব কিছুই মানব কল্পনার সৃষ্টি। কিন্ত এই কল্পনার ওপর ভিত্তি করেই তৈরী হয় ন্যারেটিভ-যার ওপর চলে রাজনীতি- কিছু মানুষ দখল করে ক্ষমতা। আর কিছু মানুষ হচ্ছে বোরে। যাদের খেয়ে, গণহত্যা করে রাজাউজিরা খেলে থাকেন!

কাষ্মীর পন্ডিত, হিন্দু বাঙালী -এরা হচ্ছে সেই বোরে। রাজাউজিরদের চালে টস্কানো হচ্ছে এদের ভবিতব্য। ভারতের পার্টিশন কে চেয়েছিল ? মূলত বৃটিশরা। ভারতের মুসলমানরা মোটেও ভারতভাগ চায় নি। আপনি ইতিহাস পুরো খুলে দেখে নিতে পারেন মুসলীম লীগ ৫% ভোট ও পেত না-আর জিন্নাও আমেরিকার ধাঁচে ফেডারাল ভারত চেয়েছিলেন। কিন্ত নেহেরুর ক্ষমতার লোভ এবং বৃটিশদের এন্টিসোভিয়েত এজেন্ডার জন্য পাকিস্তানের দরকার ছিল বৃটিশ-আমেরিকান অক্ষের। এত বড় দেশ ভারত। এতগুলো ভাষাগোষ্ঠি। এত ধর্ম। এমন দেশের ভাগ হলে শুধু ১৯৪৭ সালের জেনোসাইডেই থামবে না- এটা চলতেই থাকবে। হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান সেইদিন ও হয় নি। আজকেও হবে না।

কিন্ত আস্তে আস্তে হবে। তারজন্যই দরকার ইনফর্মেশন ওয়ার। তথ্যের যুদ্ধ। কাষ্মীর ফাইলের পর, নোয়াখালি, নেলি, গুজরাত -সব আসুক। সব সত্যকে বাজারে নগ্ন করে দেখানো হোক। ঠিক কাশ্মীর ফাইলের মতন। আমার ধারনা সাধারন লোকে আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে, তারা যে নিজেদের হিন্দু মুসলমান ইত্যাদি ভাবে- ভেবে আবার গর্বিত হয়- এইসব ফলস আইডেন্টি এফিলিয়েশন বা নিজেদের ধর্মীয় গোষ্ঠির প্রতি আনুগত্য থেকে তারা মুক্ত হবে। কাশ্মীরে শুধু কাশ্মীর পন্ডিতদের গণহত্যা হয়েছে তা না- ধারাবাহিক ভাবে কাশ্মীরের গত ৫০০ বছরের ইতিহাসে হিন্দু মুসলমান শিখ-সব জাতিগোষ্ঠির ওপরই কোন না কোন সময় অত্যাচার চলেছে।

সমস্ত গণহত্যা ঘটিত সিনেমা দেখতে গিয়ে একটাই সত্য উপলদ্ধি করেছি। ইহুদি, আর্মেনিয়ান, পন্ডিত, বাঙালী হিন্দু- এদের একটা "ফলস সেন্স অব সিইকিউরিটি" ছিল-যে প্রতিবেশী বন্ধুরা বাঁচাবে-অন্য ধর্মের হলেও। কিন্ত সেটা হয়ে ওঠে না। কারন সাধারন মানু্ষ খুনীদের সামনে রিস্ক নেয় না। আগের নিজের প্রান, তাররপর না আপনার প্রান! একমাত্র ইস্রায়েলে ইহুদিদের এটা ছিল না। তারা জানত বৃটিশরা চলে গেলে, ৯৫% প্যালেস্টাইনরা তাদের কি হাল করবে। তাই বৃটিশরা প্যালেস্টাইন ছাড়ার কুড়ি বছর আগে থেকে কোন রাজনীতি না মাড়িয়ে অস্ত্র হাতে নিজেদের মিলিটারি তৈরী করেছিল। ফলে মাত্র ৫% ইহুদি, ৯৫% প্যালেস্টাইন আরবদের যুদ্ধে হারিয়ে প্যালেস্টাইনদের নিজেদের স্বভূমি থেকেউৎখাত করেছে! এটা পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র উদাহরন, যেখানে সংখ্যালঘুরা মিলিটারি ফর্মেশনে সংগঠিত হয়ে সংখ্যাগুরুদের তাড়িয়েছে! বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠির মধ্যে দেশভাগের আগে কংগ্রেসি, বিপ্লবী এবং কমিনিউস্ট বাতেলা নেতাদের বদলে বেনগুরিয়ানের মতন ভবিষয়ত দ্রষ্ট্রা নেতা জন্মালে-যেখানে দেশভাগের অনেক আগে থেকে যদি এরা হিন্দুদের মিলিটারি ফোর্সে পরিনত করতে পারতেন-তাহলে আমাদের পূর্বপুরুষদের দেশ ছাড়তে হত না।

ভিটেমাটি রক্ষা করতে গেলে বন্দুক হাতে যুদ্ধ করতে হয়। ওটা কোন রাজনীতিবিদ-কোন ইতিহাস, কোন কাল আপনাকে ভিক্ষে দিতে পারে না। ইউক্রেনিয়ানদের দেখে শিখুন।










1 comment:

Avik Mitra said...

আপনার লেখা যত পড়ছি , আপনার ফ্যান হয়ে যাচ্ছি । মহৎ উদ্দেশ্য আপনার, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।