উভাল নোয়া হারারি, আমাদের বহুদিনের একটা পুরাতন ধারনা বদলে দিয়েছেন। উনার মতে বিংশ শতাব্দি থেকে যত যুদ্ধ হয়েছে- তা জমি-সম্পদ-নারী দখলের লড়াই না। প্রায় সবটাই "আইডিওলজি" বা আদর্শের লড়াই। যেমন রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধের নিরাপত্তা জনিত বস্তুবাদি কারন অবশ্যই আছে। কিন্ত সব থেকে বড় যে আদর্শের লড়াইটা চলছে- সেটা হচ্ছে ইউক্রেন কি আদৌ আলাদা কোন জাতি? না রাশিয়ান উপজাতি মাত্র? পুতিন কিন্ত টিভিতে বারবার বলে চলেছেন, ইউক্রেনিয়ানদের ভুল বোঝানো হয়েছে যা তারা রাশিয়ানদের থেকে আলাদা জাতি। ইউক্রেনিয়ানরা আলাদা কোন জাতিই না। তারা রাশিয়ানদের ভাই ভাই। তাই ইউক্রেন রাশিয়াভুক্ত হবে!
হমো স্যাপিয়েন্সরা আনুমানিক ২০,০০০-৩০,০০০ বছর পূর্বে বসতি স্থাপন করে একত্রে আস্তে আস্তে বড় দলে থাকতে শুরু করে- সাথে সাথে মানব সমাজে "কাল্পনিক" কিছু ধারনার জন্ম হয়-যা মানুষকে আরো বৃহত্তর গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত করে এবং সেখান থেকে আনুমানিক ৫০০০ বছর পূর্বে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলে। যেমন ধরুন "ঈশ্বর" , "বিবাহ" , " সম্পত্তি" " সমাজ", "রাষ্ট্র" "পরকাল" "স্বর্গ" এগুলো সবই কাল্পনিক ধারনা থেকে গড়ে ওঠা-যেগুলি না থাকলে মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন গড়ে উঠত না-অন্তত অতীতে। এই প্রতিটি মানব কল্পনা, মানুষের জীবনকে অনেক বেশী উৎপাদনশীল ( প্রোডাক্টিভ) করে !
আমি একটা একটা করে উদাহরন দিচ্ছি। যেমন ধরুন বিবাহ। প্যালিওলিথিক হান্টার গ্যাদারদের মধ্যে বিবাহ্ ছিল না। কিন্ত কৃষিকাজ এবং জমির উত্তরাধিকার শুরু হলে " বিবাহ" নামক অলীক ধারনার আমদানি আবশ্যক হয়। কারন তার আগের সমাজে, পুরুষদের নিজের সন্তানের দরকার হত না-যেহেতু "সম্পত্তি" বলে আরেকটি অলীক ধারনা ছিল না। কিন্ত জমির দখল, এবং সেই জমিতে উৎপাদন বাড়াবার জন্য নিজের সন্তানদের দরকার হওয়া শুরু হয়। ফলে একই সাথে মানব সমাজে বিবাহ ( যে নারী-পুরুষের পিওরেস্ট বন্ধন), সম্পত্তি ( যে এই ভূখন্ডের ওপর আমার অধিকার এবং সন্তানের উত্তরাধিকার), মালিকানা ইত্যাধি ধারনার সূত্রপাত হয়।
ঠিক একই ভাবে মেসোপটেমিয়াতে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা দিতে। বিনিময়ে রাষ্ট্রকে ব্যবসায়ীরা সেনাদল রাখার জন্য ট্যাক্স দেওয়া শুরু করে।
ব্যপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। আজকে যদি বিবাহ বলে ধারনাটা চলে যায়-তাহলে প্রতিটা ছেলে অধিকাংশ সময় নষ্ট করবে, আগামী রাতের সঙ্গিনী খোঁজার অপেক্ষায়। রাষ্ট্রের ধারনা উবে গেলে, প্রতিটা মুহুর্তে পাশে বন্দুক রেখে কাজ করতে হবে- একই সাথে জীবিকার জন্য কাজ করতে হবে, আবার বন্দুক হাতে লড়াই ও করতে হবে। কারন, নিরাপত্তা দেওয়ার কেউ থাকবে না। কোন জটিল কাজ, স্কুল, কলেজে পড়াশোনা, ফ্যাক্টরি, উৎপাদন-কোন কিছুই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ছাড়া হয় না। যার জন্য যেসব স্থলে রাষ্ট্রের ধারনা দুর্বল হয়- অর্থাত একটা সমান্তরাল মাফিয়ারাজ মানুষকে নিয়ন্ত্রন করে, সেই সব জায়গায় কখনোই শিক্ষা, গবেষনা বা শিল্প গড়ে উঠতে পারে না। উদাহরন পাকিস্তান। সিসিলি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে "রাষ্ট্রের " ধারনা কাল্পনিক কেন? কারন পশুদের মধ্যে রাষ্ট্র নেই। মানুষের মধ্যে আছে-কারন মানুষ কল্পনা করতে পেরেছিল, রাষ্ট্র নামে একটা এন্টিটির হাতে যদি অস্ত্রধারি মানুষ (সৈনিক) থাকে, তাহলে, ব্যবসা-কৃষির শ্রীবৃদ্ধি হয়। সেই নিরাপত্তার কারনে। এবার রাষ্ট্র আরো আধুনিক হল। শুধু সামরিক নিরাপত্তা না। আধুনিক রাষ্ট্র মানুষকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বার্ধক্য, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ-ইত্যাদি সব বিষয়েই নিরাপত্তা দিতে বাধ্য।
কিন্ত আধুনিক হতে থাকা এই সমাজ , এই বিশ্ব ভুলে গেছে, রাষ্ট্রের ভিত্তি সেই সামরিক শক্তি! একটা রাষ্ট যতই জনকল্যানকারী , শিল্পে উন্নত হোক না কেন, সামরিক শক্তিতে দুর্বল হলে, সেই রাষ্ট্র খুব বেশীদিন স্বাধীন ভাবে টিকতে পারে না। অন্তত গত দুশো বছরে সেই সত্যই বাস্তব। এমন কি ছোটদেশ সুইজারল্যান্ড কোন ব্যতিক্রম না। ওই রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিক সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার অনেকবার সুইজারল্যান্ড দখল করবেন ভেবেছিলেন-কিন্ত তার জেনারেলরা শ্রেফ বলে দিয়েছিল-ওই দেশে ঢুকলে এর বেঁচে বেড়োতে হবে না! শান্তিপ্রিয় ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র সামরিক বাজেট ২-৩% এ নামিয়ে এনেছিল-এখন বাড়িয়ে আবার ৬-১৩% এ নিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সামরিক বাজেট জিডিপির ৩%। সেটা বেড়ে ৫% হতে চলেছে।
রাষ্ট্রের ধারনাটি গুরুত্বপূর্ন-কিন্ত রাষ্ট্র যদি তার জনগনের খাদ্য নিরাপত্তা না দিয়ে সামরিক নিরাপত্তার পেছনে খরচ করে- বা করতে বাধ্য হয় তাহলে? সমস্যা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উদ্ভবের যুক্তিটাকেই আবার গুলি মারা হচ্ছে। কারন খাদ্যের নিরাপত্তা দিতে সামরিক নিরাপত্তা দরকার-আবার সামরিক নিরাপত্তার পেছনে খরচ বাড়ালে, খাদ্যের নিরাপত্তা আসছে না! তাহলে উপায়?
ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার সৈন্যবল ৫-১০ গুন। তাহলে ইউক্রেন কি তার সামরিক বাজেট ৪-৫ গুন করবে? তাহলে খাবে কি?
এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে সামরিক জোট। অনেকগুলি দেশমিলে জোট তৈরী করা যাতে একত্রিত সৈন্যদল বৃহত রাষ্ট্রের সেনাদের রুখে দিতে পারে। ফলে ন্যাটো বা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের জোট ভূতপূর্ব সোভিয়েত থেকে স্বাধীন হওয়া সব রাষ্ট্রের জন্যই একান্ত দরকার- নইলে রাশিয়া সেই দেশগুলি বকলমে দখল করবেই, একজাতির ধুয়ো তুলে!
কিন্ত কেন? সেই নিরাপত্তা। রাষ্ট্র মানেই, তার প্রথম কাজ নিরাপত্তা দেওয়া। রাশিয়া, চীন, ভারতের মতন বড় দেশগুলির সমস্যা- সীমান্ত প্রচুর লম্বা! রাশিয়ার প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার সীমান্ত! সীমান্তে অসংখ্য দেশ। সেই দেশগুলি যদি, রাশিয়ার বন্ধু দেশ না হয়, এত বড় দেশের নিরাপত্তা প্রায় অসম্ভব।
ফলে জারের আমলে রাশিয়া তার আশেপাশের সব দেশগুলো দখল করেছিল উনবিংশ শতাব্দিতে। তারো আগে এই সব দেশগুলোই আবার রাশিয়াকে নিরাপত্তা দিত, রাশিয়া তাদের অস্ত্র দিত! যেমন ইউক্রেন। ওখানে থাকত কোজাক যোদ্ধারা। দক্ষিন থেকে তাতারদের আক্রমন রুখতে, রাশিয়ান জারেরাই তাদের অস্ত্র দিয়েছে-আবার তাদের অধীকারে নিতে সামরিক অভিযান ও চালিয়েছে। আবার দুটো জাতি একসাথে তাতার আক্রমন রুখেছে। তাতারদের দাপট কমে গেলে জারেরা ইউক্রেনকে নয়া রাশিয়া বলে সাম্রাজ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। লেনিন এবং তার বলশেভিক পার্টি ১৯১১ সাল থেকে এই সব দেশগুলির স্বাধীনতা দাবী করেছিলেন। লেনিনের সাফল্যের একটা বড় কারন ১৯১৭ এর বিপ্লবের দিনে, এই সব স্যাটেলাইট স্টেটগুলি সবাই বলশেভিক বিপ্লবের শরিক ছিল। এবং বিপ্লবের পর লেনিনের প্রতিশ্রুতি মতন এরা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন । স্বাধীন ইউক্রেনের জন্ম হয় ১৯১৮ ন্সালের ফেব্রুয়ারী। কিন্ত খুব শীঘ্র লেনিন বোঝেন, আসলে কমিনিউজম, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার আদর্শ ইত্যাদি দিয়ে রাষ্ট্র চলবে না। তিনিই এখন নতুন জার। ফলে লেনিন সৈন্য পাঠিয়ে আবার স্বাধীন ইউক্রেন দখল করেন। প্রায় তিন বছর ( ১৯১৮-২১) চলেছিল সেই যুদ্ধ। ৪ লাখ ইক্রেনিয়ান রাশিয়ার বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধে মারা যায়। পুতিন এখন নতুন জার। উনিও লেনিনের মতন সেই সত্য বুঝেছেন যে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য সব স্যাটেলাইট স্টেটগুলি অধীনস্থ থাকা দরকার!
আসলে "জাতি" এবং "জাতিয়তাবাদ" ও সেই মানুষেরই কল্পনা-যা রাষ্ট্রের জন্য দরকার ও বটে। যেমন ধরুন ক্রশ্চেভ এবং ব্রেজনেভ-দুজনেই ইউক্রেনের। এরা রাশিয়ার প্রমিয়ার ছিলেন। যেমন বিবেকানন্দ বা নেতাজি। এরা যতটা বাঙালীর ততটাই ভারতের। বৃটিশ আমল থেকে বাংলার ইতিহাস যেভাবে ভারতের ইতিহাসে সাথে মিশে গেছে, তাতে বাঙালীকে যেমন ভারতীয় না বলা যাবে না-ঠিক তেমনই ইউক্রেনিয়ানদের রাশিয়ান না বলাও একই রকমের কঠিন কাজ। আবার এটাও ঠিক বাঙালীদের ভাষা, খাদ্যভ্যাস আলাদা। অতীত ইতিহাস আলাদা। কিন্ত বিগত দুশো বছরে বাংলা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইউক্রেন ও ঠিক তাই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ানে। সোভীয়েতের দুই প্রিমিয়ার এসেছে ইউক্রেন থেকে। সুতরাং পুতিন খুব ভুল বলেন নি। কিন্ত উনি ভুল করছেন । সেটা হচ্ছে এই যে ইউক্রেনের লোকেরা ঠিক করবে, তারা রাশিয়ান কি না। সেটা সেনা পাঠিয়ে করতে গেলে, ইউক্রেনের জাতিতয়তাবাদ আরো বেশী শক্ত হবে। যেমন খানসেনাদের দিয়ে বাংলাদেশীদের পাকিস্তানি বানাতে গিয়ে হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশীরা স্বাধীন হওয়ার পর আরো বেশী পাকিস্তানি হয়েছে-যদিও দেশ পাকিস্তানকে তারা ঘৃনা করে।
পুতিন ইতিহাস ঠিক বললেও, তার সামরিক প্রযোগ সম্পূর্ন ভূল করলেন। হিটলার ও তাই। মেইন ক্যাম্পে ইতিহাস তিনি ভুল লেখেন নি। ফ্রান্স সত্যই বহুদিন থেকে জার্মানিক গোষ্ঠীর নানান প্রিন্সিপালিটিগুলিকে এক হতে দেয় নি। তার মানে এই না যে শোধ তুলতে তিনি সেনা পাঠিয়ে গোটা ইউরোপকে জার্মানি বানাবেন!
ইউক্রেনের যুদ্ধ আদর্শের লড়াই আবার উস্কে দিল। এবার বাচাল চলবে তাইওয়ান কি আলাদা রাষ্ট্র? অরুনাচল , লাদাখ কি চীনের থেকে আলাদা হতে পারে? ভারতের নেহাত সামরিক এবং অর্থনৈতিক দম নেই। রাশিয়ার পর্যায়ে দম থাকলে ভারত ও বলতেই পারে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এগুলি ভারতের অংশ।
কিন্ত এসব কি এই একবিংশ শতকে দরকার আছে? যেখানে আমরা একটা যুদ্ধ বিহীন শতাব্দির কল্পনা করছিলাম? মঙ্গলে বসতি স্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতায় নামছিলাম?