Monday, April 13, 2020

একটি আষাঢ়ে গল্পের খসড়া

একটি আষাঢ়ে গল্পের খসড়া
-বিপ্লব পাল, ১৪ই এপ্রিল
*****
-নিমতলা? বস লম্বা লাইন আছে। অনেকে ডেডবডি নিয়ে তিনদিন বসে। বরফ দিয়ে রাখতে হচ্ছে। পাক্কা খবর। মিঠুর বাবা মারা গেল বেস্পত্তিবার। এখন রবিবার রাত। এখনো নাম্বার আসে নি মনে হচ্ছে
-তাহলে কাশীপুর, গার্ডেনরিচ, ওখানে কত দিন ?
-কি বলবো মলয়দা। সব এক। তিনশো চারশো বডি। তিন চার দিনের লাইন। তবে একটা ফোন দিতে পারি। কিছু বেকার ছেলে পিলে মিলে খুলেছে। আগে সুইগির হয়ে খাবার দিত। এখন ডেডবডি চুল্লীতে পৌছে দিচ্ছে। তবে হ্যা, তিনদিন বডি আগলে থাকতে পারবে না। প্রচুর ডিমান্ড বুঝতেই পারছ। পার বডি এখন পঞ্চাশ হাজার চাইছে। পাঁচে শুরু করেছিল। পাঁচমিনিট ও দাঁড়াবে না। গাড়ি নিয়ে আসবে। হেভি প্রোটেক্টিভ গিয়ার ওদের। চুল্লীর লাইনে ফেলে দেবে। বরফের জোগার ওরাই করবে। তিন চারদিনের আগে নাম্বার আসবে না। বুঝতেই পারছ। আর হ্যা, তোমাকে ত আবার মুখাগ্নি করতে হবে- তোমার প্রোটেক্টিভ গিয়ার আছে ত? করোনার টেস্ট করিয়েছ? চিন্তা করোনা। আরো দশ হাজার ফেললে ওরাই তোমাকে হেবি প্রোটেক্টিভ গিয়ার দিয়ে দেবে। মানে বুঝতেই পারছ, ক্রিমেটোরিয়ামের মানে দুশো তিনশো করোনার লাশ। চারিদিকে ভাইরাস। হেবি গিয়ার চায়। দেখছ না এখন ডাক্তারদেরও পাত্তা পাওয়া যচ্ছে না। সবাই করোনাতে টসে গিয়ে নিজেরাই বাড়িতে কোরান্টাইন।
দুলাল যাকে বলে পাড়ার সব থেকে ডাকাবুকো ছেলে। সিপিএম, তৃনমূল বদলেছে। কিন্ত পাড়ার মুশকিল আসান বদলায় নি। এ তল্লাটে সব কাজে কাউন্সিলার থেকে এম এল এ দুলালকেই চেনে।
প্রথম প্রথম পাড়ায় সপ্তাহে দু তিনজন বৃদ্ধ বৃদ্ধা টসকাচ্ছিল। অজানা জ্বর। করোনা টেস্টিং নেই। আজকাল জ্বরে টসকালে লোকে ধরে নেয় করোনা। শ্বশান বন্ধু পাওয়া যায় না। ভাই, বোন কেউই যাচ্ছে না। পাড়ার বন্ধুবান্ধবরা কেউ আসবে না। টাকা দিয়ে বডি পাঠাতে হচ্ছে। ওই ভাড়াটে ছেলেছোকরারা ফেসবুক লাইভে আত্মীয় স্বজনদের শেষ যাত্রা দেখিয়ে দিচ্ছে। অনেকের ছেলেমেয়েই কোলকাতার বাইরে। ফলে শেষ যাত্রায় ফেসবুক লাইভই এখন দ্যা ট্রেন্ড। সেটা আবার ঘন্টায় হাজার টাকার আলাদা কনট্রাক্ট। এটাই এখন নিয়ম।
পাড়াতে ডেইলি ছ থেকে দশজন মারা যাচ্ছে। এহাত ওহাত ঘুরে দুলালের নাম্বারেই কল আসে। সবাই দুলালকেই ডাকে। আগে দুলাল কমিশন নিত না। এখন ওই নিমতলা পেশাদার শ্বশানবন্ধু কোম্পানী থেকে কাট নিচ্ছে। শালা এত হেবী ব্যবসা। বছরে এ পাড়াতে খুব বেশী হলে তিন চারটে বাড়ি বিক্রি হয়। একটা ফ্ল্যাট ওঠে। একে ওকে দিয়ে আর কত থাকে? আজকাল দুটো পার্টি শশ্বানবন্ধু কোম্পানীকে পাইয়ে দিতে পারলেই দিনে কুড়ি হাজার! পুরো ক্যাশ!
অবশ্য ক্যাশ দেখলেই যে মন ভাল হচ্ছে তা না। বাড়িতে সত্তর বছরের বাবা মা। কালকেই বাবার কাশি উঠেছিল। ভাবছিল টেস্টিংটা করিয়ে নিয়ে আসে। হাসপাতালে যাওয়ার উপায় নেই। করোনাতে ডাক্তার নার্সরাই বোল্ড হয়ে বাড়িতে বসে গেছে! তাছারা হাসপাতাল থেকে করোনা ছড়াচ্ছে আরো বেশী। ডাক্তাররা রুগী দেখা বহুদিন বন্ধ করেছেন। বাবার হাইপ্রেসার। এখন কিছু হলে ডাক্তারবাবুকে ফোন করে ওষুধ নিয়ে আসা। ব্যবস্থা এইটুকুই। আজ মলয়ের বাবা দেহ রেখেছেন। কাল কার বাবাকে নিতে পেশাদার শ্বশান বন্ধুরা এ পাড়ায় আসবে কেউ জানে না। টাকা, দাদা সবকিছু থেকেও লাভ নেই। অজানা ভয় গ্রাস করছে দুলালকে।
ও প্রান্তে মলয় নির্বাক। দুলালই বলে চলল
-মলয়দা তাহলে ওই শ্বশানবন্ধু পার্টিকে বলে দিই। ওদের সিইইও আমার খুব চেনা। আমি একটা ফোন করে দিলেই হবে।
-ইয়ে দুলাল, ওরা কি পুরো পঞ্চাশই নিচ্ছে? মানে বুঝতেই পারছ। লকডাউনের বাজারে গত তিনমাসে আমার ওই দোকান থেকে কোন ইনকাম নেই। এদিকে ছেলের টিউশুনি অনলাইনে নিতে হচ্ছে। তুমি ত বলছিলে ওদের মালিককে চেন...
-কি বলব মলয়দা। দুসপ্তাহ আগেও পাঁচ ছিল। কিন্ত ওরাইবা কি করবে বল। ডেইলি সত্তর আশিটা বডি। তিনটে মাত্র গাড়ি। মেরেকেটে দশটা ছেলে। কে আসবে বলত এই কাজ করতে? প্রানের ভয়ত আছে। তবে বুঝলে সুইগি, ফুড পান্ডার ছেলেগুলোত বেকার এখন। ওদের অনেকেই খুব নীডি বুঝলে। তাদেরই কেউ কেউ আসছে। কিন্ত হেবী ডেইলি রেট দিতে হচ্ছে । দিনে দু হাজার।
- আচ্ছা দুলাল । দিনে দুহাজার দিলেই বডি পৌছানোর লোক পাওয়া যাচ্ছে? তা তুই এক কাজ কর না । আমি তোকে পঁচিশ হাজার দিচ্ছি, তুই গাড়ি আর চারটে ছেলে জোগার করে দে। পঞ্চাশ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বাড়িতে মাও আছে। যা অবস্থা । আজ পঞ্চাশ দিলে, কাল লাগলে আর কিছু থাকবে না রে ভাই।
দুলাল এতটা ভাবে নি। আসলে দালালি করে অভ্যেস। দ্বায়িত্ব নেওয়ার ঝামেলায় থাকে না। মলয়দার প্রস্তাবটা খারাপ না। সত্যিই ত- ছেলেপুলের ত অভাব নেই। লোক ডাউনের বাজারে সবাই বেকার। কিছু ছেলেপুলে জুটে যাবে। পার্টি প্রতি ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকা লাভ।
-মলয়দা, ইয়ে যা বলছেন। তাছাড়া কাকুর শেষ যাত্রা বলে কথা। ঠিক আছে। আমিই দেখছি। তোমাকে আর অন্যকোন খানে দেখতে হবে না। আমি ম্যানেজ করে নেব।
সাপ্লাই লাইন যে কখন কেউরাতলার লাইনে মিশে গেছে, কেইই বুঝে উঠতে পারে নি।

No comments: