Monday, December 30, 2019

দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং দেশভাগের ইতিহাস - ৫ঃ বঙ্গভঙ্গ থেকে চম্পারন সত্যাগ্রহ

বৃটিশ আর্মির কিছু কিছু সৈনিকের পরম সৌভাগ্য ( বা দুর্ভাগ্য)- এরা  জার্মানির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং পাঞ্জাবের রিফিউজি ক্যাম্প -ইতিহাসের দুই নির্মম অধ্যায় চাক্ষুষ দেখার সুযোগ পেয়েছেন।  ইনারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, পাঞ্জাবে রায়োটের নৃশংসতা নাৎসি জার্মানির সমস্ত অত্যাচারকেও হার মানায়!

 অথচ দুর্ভাগ্য ভারতবাসীর।  ভারতীয় লিব্যারালরা,  নাৎসী জার্মানির পুনরাবৃত্তি নিয়ে যত চিন্তিত- নিজেদের দেশে ঘটা যাওয়া দেশভাগের দুর্ভাগ্য যে আবার ফিরে আসতে পারে, সেটা নিয়ে উনারা চিন্তিত না।  যে অপশক্তি এবং দুর্বলতাগুলির জন্য দেশভাগ হয়, স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও, তার সবগুলিই বিদ্যমান।  এইজন্য নাৎসী জার্মানীতে হিটলারের ভূতের পেছনে সময় নষ্ট না করে, দেশভাগের ইতিহাস ভারতের লিব্যারালদের সব থেকে বেশী জানা উচিত। কারন ভারতের বর্তমান এবং ভবিষ্যত দেশভাগের দুঃস্বপ্নকে অস্বীকার করে এগোনো সম্ভব না।

 আগের চার পর্বে, দেশভাগের রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে আলোচনা করেছি। ওগুলো অনেকটা ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফর্মেশন।  সাদা ক্যানভাসের মতন। 

 আমি  দুটি পর্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যালোচনা করব।  বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট। এই পর্বে শুধু বঙ্গভঙ্গ এবং  চম্পারন সত্যাগ্রহে গান্ধীর প্রবেশ। তারপরের পর্বে শুধুই গান্ধী।

   এই ইতিহাস অনেকেরই জানা। কিন্ত যা নিয়ে আলোচনা হয় না,  স্কুলপাঠ্য ভারতের ইতিহাস স্বীকার করে না -  প্রতিটি আন্দোলনই আস্তে আস্তে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ বাড়িয়েছে।  এর জন্য দায়ী কে? মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি? নাকি হিন্দুদের হাতে সব সম্পত্তির মালিকানা?  নাকি হিন্দুদের গোঁড়ামি? নাকি বৃটিশদের টোপ খেয়ে কিছু মুসলমান নেতার  ক্ষমতার লোভ? না কি আল দ্যা এবভ?


  ভারতে সকল সশস্ত্র এবং অহিংস আন্দোলনের উৎস এবং দ্বিজাতি তত্ত্বের ক্যাটালিস্ট- বঙ্গভঙ্গ।  ১৯০৫।  বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস খুব ভাল ভাবে পর্যালোচনা করা দরকার।



                                                                               (১)
 বঙ্গভঙ্গ বুঝতে, তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড জর্জ কার্জনকে একটু জানা যাক।  রাজনৈতিক কার্জনকে না জানলে, বঙ্গভঙ্গ বোঝা যাবে না।

  লর্ড কার্জন অব কেডেলস্টন, বৃটিশ রাজনীতির ইতিহাসের বর্ণাট্য চরিত্র। ভারতের ভাইসরয় ছাড়াও বৃটেনের ইতিহাসের সফলতম সেক্ট্রেটারি অব স্টেটস ( বিদেশমন্ত্রী) । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে ইংল্যান্ডের শান্তিবাদি আবহে, লেবার পার্টি এবং লিব্যারালদের রমরমার দিনে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নি ঠিকই- কিন্ত তার সাম্রাজ্যবাদি বিদেশনীতি, তার বৃহত্তম প্রতিদ্বন্দি চার্চিলকে প্রভবিত করে।

 বঙ্গভঙ্গ কার্জনের রাজনৈতিক জীবনে নেহাৎই এক ফুটনোট- কিন্ত ভারতের ইতিহাসে যুগসন্ধিক্ষন!

  কার্জন এগারো ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। মা ব্ল্যাঙ্কে এগারো সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান।  বাবা আলফ্রেড কার্জন সার্সডেলের চতুর্থ ব্যারন। চূড়ান্ত রক্ষনশীল এই জমিদার পরিবার।

 কার্জন বড় হয়েছেন গর্ভনন্সের হাতে। তার ধাত্রীমা এলেন ম্যারী পার্মন ছিলেন কঠোর নৃশংস নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী। ছোটবেলায় জর্জ কার্জন সামান্য কিছু অপরাধ করলে,  ম্যারী তার বুকে প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে দিতেন - মিথ্যেবাদি, কাপুরুষ। সেই ভাবে তাকে গোটা গ্রাম ঘুরতে হত!


 বৃটিশ লিব্যারালিজম বা উদারনৈতিকতা তাকে আকর্ষন করে নি কোনদিন। কারন তার এই কঠোর, নিষ্ঠুর ভাবে বড় হওয়া- যেখানে তাকে শেখানো হয়েছিল- একমাত্র পানিশমেন্টই ডিসিপ্লিন দিতে পারে!
   
  মেধাবী ছাত্র ছিলেন।  অক্সফর্ড ইউনিয়ানের প্রেসিডেন্ট  হৌন। কিন্ত  তার স্বপ্নে ইংল্যান্ডের প্রাচীন গৌরব। স্যার থমাস মুরের রিচার্ড দ্যা থার্ডের পৌরানিক গাথায় তার নির্বাক বিশ্বাস।

 ফলে ১৮৮৬ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের এম পি হিসাবে যখন পার্লামেন্টে প্রবেশ করলেন-তিনি কট্টর সাম্রাজ্যবাদি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের গৌরবই তার একমাত্র ধ্যান ধারনা। বৃটিশ পার্লামেন্ট তার প্রথম ভাষনই ছিল- কেন ভারতীয়দের স্বরাজ ( নিজেরদের সরকার)  দেওয়া উচিত না!

 তিনি নিজেকে অভিজাত বলেন। এদিকে তার এস্টেট খুব ছোট। আভিজাত্যের ইচ্ছা প্রচুর- অর্থনৈতিক ক্ষমতা নেই। টাকার জন্য বিয়ে করলেন আমেরিকান শিল্পপতির কন্যা - মেরী ভিক্টরিয়া লেইটারকে। টাকার জন্য বিয়ে করলেও  তার বিয়ে সুখী হয়।  তখনকার দিনে প্রায় মিলিয়ান ডলারের ওপর উপকৌটন পান শশুরের কাছ থেকে।

 রাজনৈতিক প্রতিভা ত ছিলই। শশুরের টাকায় রাজনীতিবিদদের কেনাও সহজ হল। ফলে পেলেন বৃটিশ শাসনের সব থেকে কাঙ্খিত এসাইনমেন্ট!

 ১৮৯৯ সালে তাকে ভারতের ভাইসরয় করে পাঠানো হয়!  ব্যপারটা খুব সহজ ছিল না। বৃটিশ রাজনীতিতে তিনি লিব্যারালদের চোখের দুশমন। সাম্রাজ্যবাদি বুনো মোষ। বৃটিশ রাজনীতিতে তার গ্রাফ আটকাতে আমেরিকার বৃটিশ রাষ্ট্রদূত, কার্জনের ভাবী শশুরের কাছে গিয়ে কাঠি করেন। যাতে বিয়েটা ভাঙ্গে।  কারন সবাই জানত কার্জনের হাতে শশুরের টাকা এলে, একে আর আটকানো যাবে না।

 ঘটনা ছোট্ট ।কিন্ত দেখা যাচ্ছে,  স্বয়ং বৃটিশ রাজনীতিবিদরাই তার সাম্রাজ্যবাদি আফিং নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এতটাই যে তার বিয়ে ভাংতেও তারা পিছু হঠেন নি। বৃটিশ মহলে একটা শঙ্কা ছিলই-এই লোককে ভাইসরয় করে পাঠালে, ভারতে জাতিয়তাবাদি আন্দোলন আরো উতলা হবে!

  বৃটিশ লিব্যারালদের আশঙ্কা ১০০% সত্য । ১৯০৫ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের নেতারা পুরোপুরি কনস্টিটিউশনাল। দাদাভাই নরৌজি, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, মহামান্য গোখলে -সবাই ভাইসরয়ের কাছে পিটিশন লিখতেন।  রাস্তায় নেমে সরাসরি বৃটিশ বিরোধি রাজনীতির সময় তখনো আসে নি। কিন্ত লর্ড কাজনকে ভারতের ভাইসরয় হিসাবে পাঠানোতে সব হিসাব উল্টোপাল্টা হয়ে যায়।  অবশ্য এমনটা যে হবে-  ইংল্যান্ডে তার বিরোধি রাজনীতিবিদরা আঁচ করেছিলেন।  এতটাই যে তার ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বিয়ে আটকাতে পর্যন্ত তারা চেষ্টা করেছেন!

 জর্জ কার্জন এক ভূগোলবিদ ও ছিলেন। রয়াল জিওগ্রাফিক সোসাইটির ফেলো। ম্যাপ নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করা তার বহুদিনের অবশেসন।  জারের রাশিয়া যখন মধ্য এশিয়ার কলোনিগুলিকে ট্রেইন লাইন দিয়ে যুক্ত করা শুরু করে, উনি পালটা চাল দিতে ইরান এবং আফগানিস্তানে বৃটিশ প্রভাব বাড়াতে বলেন। উনার ধারনা ছিল জার যেকোন দিন ভারত দখল করতে পারে।  রাশিয়া তখন বিপ্লবীদের আড্ডাঘর। বলশেভিক বিপ্লবের বহুপূর্ব থেকেই ( ১৮৬৭), রাশিয়াতে অনেক নিহিলিস্ট বিপ্লবীদের কার্যকলাপ।  গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা গুলি ছোঁড়ার রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ রাশিয়ার বিপ্লবীদের আবিস্কার ।  ভারতের ছেলেছোকরারা রাশিয়া থেকে যাতে বিপ্লবী তালিম না পায়, তার জন্যে কি কি করিতে হইবে, ভারতযাত্রার বহু  আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন!

 এবার সহজেই অনুমেয় উনি কোলকাতায় আসার পর কি কি কাজ করতে ছটফট করবেন।  প্রথমেই আফগানিস্তানের সাথে নিরাপত্তা বাড়াতে নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স গঠন করলেন।

বাংলা সেই সময় বিরাট প্রদেশ। আট কোটি লোক। বর্তমানের পশ্চিম বাংলা, বাংলাদেশ, বিহার এবং উড়িষ্যার অংশ নিয়ে তৈরী।  ফলে সরকারি কাজের সুবিধার জন্য বাংলার বিভাজন বহুদিন থেকেই হওয়ার কথা।

 ১৮৭৮ সালে বাংলার প্রথম বিভাজন হয়।  তখন এডমিনিস্ট্রেটিভ কারনে আসাম বিভাজন নিয়ে কোন গন্ডগোল হয় নি।  ১৯০৩ সালে লর্ড কার্জন -  ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং সিলেট ডিভিশন আসামের সাথে জুড়ে দিতে চাইলেন।  হিন্দু এবং মুসলমান উভয়পক্ষেই বিরোধিতা করল।

 ১৯০৪ সালে তিনি পূর্ব বঙ্গে গেলেন মুসলমানদের "মুড" বুঝতে। স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এবং সৈয়দ আমীর আলির দৌলতে তিনি ভালোভাবেই জানতেন মুসলমানরা আলাদা রাজনৈতিক ক্ষমতা চাইছে। উনি ঢাকার নবাবের সাথে দেখা করেন।  নবাবের সাথে কথা বলে বুঝলেন , পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলা আলাদা করেদিলে, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সাপোর্ট তিনি পাবেন। এবং এই ইস্যুতে হিন্দু-মুসলমান বৈরিতা শুরু হবে। 

 ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হয়। কার্জন নিশ্চিত ছিলেন বাঙালী হিন্দুরা এর বিরোধিতা করবে, বাঙালী মুসলমানরা এর সমর্থনে থাকবে।  কার্জন জানতেন আজ না হলে কাল, ভারতের জাতিয়তাবাদি আন্দোলন গড়ে উঠবেই। আর তার বিরুদ্ধে সেফটিভালভ হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা। মুসলমানদের পিছিয়ে থাকা।

 আরো একটা কারন কার্জন তার ঘনিষ্ট সার্কলে বলেছিলেন। উনি দেখলেন জাতীয়তাবাদের উৎস কোলকাতা।  কোলকাতায় বাঙালী মধ্যবিত্তদের টাকার উৎস জমিদারি। এদিকে জমিদারির আয়ের অর্ধেক আসে পূর্ব বঙ্গ থেকে। উনি চাইছিলেন ঢাকায় পালটা জমিদার বসতি হোক। যাতে কোলকাতায় টাকার সাপ্লাই কমে। দ্বিধায় জাতিয়তাবাদি আন্দোলন দুর্বল হয়।

  বঙ্গভঙ্গ প্রথম ঘটনা যাতে স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের দ্বিজাতি তত্ত্ব সত্য  বলে প্রমানিত হয়।  কংগ্রেসের হিন্দু নেতারা  জোর করে নিজেদের অজান্তেই স্যার সৈয়দের দ্বিজাতি তত্ত্বে স্টাম্প মারে।  কারন বঙ্গভঙ্গে বাংলার মুসলমানরা উপকৃত হত। কিন্ত হিন্দু মধ্যবত্ত শ্রেনী বাংলাকে ভাগ করা সাম্রাজ্যবাদি চক্রান্ত বলে, পথে নেমে গেল। বাঙালী মুসলমানদের সাথে আলোচনা করার ও প্রয়োজন বোধ করল না।

মুশকিল হচ্ছে এক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম দুই ন্যারেটিভই সঠিক। যেটা বেঠিক। সেটি হচ্ছে কংগ্রেসের নেতৃত্ব।  এটি আর কোন কালেই ঠিক হয় নি!

                                                     (২)
 ১৯০৫ সালে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যা  ৪৪ঃ ৫৬
                                   হিন্দু           ঃ   মুসলমান
  ভাগচাষি -                    ৫                        ৯
  জমিদার                       ৭                       ৩
 উকিল                           ৯                       ১
  ডাক্তার                          ৫                      ১
 শিক্ষক                           ৭                       ২ 
  সিভিল সার্ভেন্ট            ৩                       ১
  পুলিশ                            ২                      ১   


  ইংরেজি শিক্ষিত   ১০,০০০ জনের মধ্যে   ঃ  হিন্দু ১১৫, মুসলিম  ২২
 উঁচুপদে                  হিন্দু    ১১২৫               মুসলমান      ৪৪

  এই পরিসংখ্যান থেকে পরিস্কার হিন্দুদের তুলনায় বাংলায় মুসলমানদের অবস্থা সেকালে বেশ খারাপ ছিল।   পশ্চিম বঙ্গে এখনো প্রায় তাই আছে।   সেকালেও এই পিছিয়ে থাকার কারন মুসলমানরা পাশ্চাত্য শিক্ষায় আগ্রহী ছিল না।  অধিকাংশই তাদের সম্প্রদায় এবং ধর্মকে জড়িয়ে যে ইসলামিক জীবন-সেই জীবনেই থাকতে বেশী আগ্রহী ।  এখনো তাই আছে। দেশভাগের ওটাই হচ্ছে মূল বারুদ।  অধিকাংশ  মুসলমানরা পাশ্চাত্য  শিক্ষা, রাজনীতি এবং জীবনে আগ্রহী না। তারা ইসলামক শিক্ষা, ইসলামিক জীবনধারা এবং ইসলামিক রাজনীতি ( শরিয়া) তে বেশী আগ্রহী।  ফলে এখনো গরীব মুসলমানরা তাদের ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসাতে পাঠায়। দীর্ঘদিন "কমিনিউস্ট পার্টি" করা রেজ্জাক মোল্লা বলে তার জীবনে মহম্মদ মার্ক্সের থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ন।

  আমি এই জন্যেই এই অধ্যায়ের শুরুতেই লিখেছি- দেশভাগের যে বারুদ, তা এখনো তরতাজা।

   এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় পূর্ব বাংলার রাজধানী হলে,  অনেক হিন্দু জমিদাররা ঢাকায় যেতে বাধ্য হত। অনেক হিন্দু ব্যারিস্টার উকিলকেও কলকাতা ছাড়াতে হত।  তৎকালীন নেতারা সবাই এই উকিল-ব্যারিস্টার শ্রেনীর লোক।  ফলে তারাই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে মাঠে নামলেন ।  বাকীদের ও নামালেন।

   বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকেই স্বদেশী আন্দোলনের শুরু। বৃটিশ বস্ত্র ছেড়ে দেশের খাদির কাপড় পরা -বৃটিশ দ্রব্য বর্জনের এই আন্দোলন খুব বেশী সফল হয় নি। মুসলমানরা এই বৃটিশ দ্রব্য বর্জন করে নি।  গ্রামের দিকেও এই আন্দোলন ছিল দুর্বল। শুধু তাই না। হিন্দুরা পূর্ব বাংলায় প্রায় ৫০০ টি মিটিং করে মুসলমানদের ওপর জোর করে স্বদেশী চাপাতে যায়। ফলে কিছু কিছু জায়গায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। যা রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের পটভূমি।

  কিন্ত স্বদেশী আন্দোলনের অরাজনৈতিক দিকটা খুব উজ্জ্বল।  শুধু বঙ্গভঙ্গই কার্জনের একমাত্র কীর্তি না! বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধীনতা হরন করেন। মিউনিসিপালিটি গুলিতেও সরকারি কতৃত্ব বাড়ানো হয়! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঠাট্টা করে বলা হত - গোলদিঘির গোলামখানা! ফলে স্বাধীন শিক্ষার জন্য স্বদেশীরা জাতীয় এডুকেশন ট্রাস্ট তৈরী করলে।  তৈরী হল জাতীয়তাবাদি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

  আরেকটা উল্লেখযোগ্য পাওনা   সশস্ত্র আন্দোলন। যুগান্তর এবং অনুশীলন সমিতি। বৃটিশরা এই আন্দোলন পুলিশ দিয়ে ভাংল বটে-কিন্ত প্রমানিত হয় বাঙালী হিন্দু নপুংসক না। যা বৃটিশরা বরাবর ভেবে এসেছে। ফলে বৃটিশরা জাতীয়তাবাদিদের দাবী দাওয়া সিরিয়াসলি নেওয়া শুরু করে।

 জন স্ট্রেচি  লিখেছিলেন   --

     Bengal is the only country in the world where you can find a great population among whom personal cowardice is looked upon as in no way disgraceful... It is for such reasons that Englishmen who know Bengal, and the extraordinary effiminacy of its people, find it difficult to treat seriously many of the political decl  ( বাঙালীই  ( উনি বাঙালী হিন্দুদেরকেই বলছেন) পৃথিবীর একমাত্র জাতি যেখানে কাপুরষতাকে "মহান" বলে ধরা হয়- কোন বাঙালী পুরুষ কাপুরুষতার কাজ করলে- তাকে নিয়ে কেউ লজ্জা পায় না। ফলে এমন নারীসুলভ জাতির রাজনৈতিক দাবীকে বৃটিশরা কেন পাত্তা দেবে? )

  ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর বোমা, আত্মত্যাগে বাঙালীদের নিয়ে বৃটিশদের এই ধারনা বদলাতে থাকে।
এটাও মনে রাখতে হবে বিপ্লবীদের আত্মত্যাগই গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে নামার সাহস যুগিয়েছিল সাধারন ভারতবাসিদের।

 ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এটা এই আন্দোলনের সাফল্য না ব্যর্থতা বলা মুশকিল।  কেন?



                                                         (৩)

 স্বদেশী আন্দোলনে সম্পূর্ন ব্যর্থতা এই যে- এর সাথে বাঙালী মুসলমানদের যুক্ত করা যায় নি। বরং বাঙালী মুসলমানরা এর সক্রিয় বিরোধিতা করেছে।  এ ছিল তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিরোধি। ঢাকায় প্রদেশিক রাজনীতি হলেই তাদের সুবিধা হত বেশী।
 

  সশস্ত্র  বিপ্লবীরা  বিবেকানন্দর নিঃস্বার্থ দেশসেবা , গীতার নিহিলিজম, বঙ্কিম চন্দ্রের বন্দেমাতরম, কালীর চন্ডাল মূর্তি থেকে নিজেদের অনুপ্রেনিত করেছেন। এখানে একজন মুসলমান যুবক কিভাবে যোগ দেবে? সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি গদগদে হয়ে বল্লেন, বঙ্গভঙ্গ বিরোধি আন্দোলন এক ধর্মীয়  রূপ নিয়েছে। এখন এই আন্দোলনই আমাদের ধর্ম!  একবার ও দেখলেন না, এটা হিন্দু রিজিস্টান্স মুভমেন্টের রূপ নিয়েছে, যাতে মুসলমানদের স্বার্থ নেই। সংস্কার ও নেই।  তাই তারা নেই।

 কংগ্রেস এই একই ভুল তাদের সব আন্দোলনেই পুনারবৃত্তি করবে।

  হিন্দু নেতারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা করছেন। ভাল কথা। কিন্ত মুসলমানরা যে ইংরেজি শিক্ষায় পিছিয়ে আছে , সেই নিয়ে আলোচনা নেই।

ফলে অধিকাংশ মুসলমান এই বঙ্গভঙ্গ থেকে দূরে থাকলেন। অনেকে সরাসরি বিরোধিতা করলেন।

 ১৯০৬ সালে ঢাকাতে মুসলীম লিগের জন্ম হল। বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলন ভারতের মুসলমানদের চোখে ( পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ইতিহাস বইতে এই ভাবেই লেখা আছে) , মুসলমান স্বার্থ বিরোধি হিন্দু আন্দোলন। ফলে মুসলীম লীগের জন্ম অনির্বায্য হয়।

  এবার একটু ঘুরে দেখি। অষ্টাদশ শতাব্দিতে, হিন্দুরাই বৃটিশদের ডেকে আনে মুসলমান শাসন থেকে মুক্তি পেতে।  গোটা উনবিংশ শতাব্দিতে বৃটিশ আনুকুল্যে হিন্দুরা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে এগিয়ে যায়।  আরো এগোনোর জন্য তারা যখন বৃটিশ বিরোধি জাতিয়তাবাদি আন্দোলন সবে শুরু করেছে ( বঙ্গভঙ্গ) তারা মুসলমানদের সাথে পেল না।  মুসলমানদের  বাদ দিয়ে, কখনো বিরোধিতা করেই কংগ্রেসকে এগোতে হল। কারন তদ্দিনে মুসলমানরা দেখছে, এই হিন্দু-বৃটিশ দ্বন্দে তারা বৃটিশের পক্ষ নিলেই তাদের রাজনৈতিক লাভ। দুশো বছর আগে, হিন্দুরা বৃটিশ-মুসলিম দ্বন্দে বৃটিশ পক্ষ নিয়েছিল। একই দৃশ্যে- একই সাম্রাজ্যবাদি স্ট্রাটেজি- শুধু হিন্দু মুসলমানরা নিজেদের রেস্পেক্টীভ পজিশন বদলেছে।

 সোজা বাংলায় বললে বঙ্গভঙ্গ লর্ড কার্জনের পাতা ফাঁদ। কংগ্রেস ফাঁদে পা দিল।  তারা কার্যত সেটাই করে, যা কার্জন চেয়েছিলেন। মুসলমানদের বুঝিয়ে দেওয়া হল দ্বিজাতি তত্ত্ব আসলেই সত্য!

  কংগ্রেসের অবশ্যই অসহযোগ আন্দোলনে যাওয়া উচিত ছিল-কিন্ত সেটা বঙ্গ ভঙ্গকে কেন্দ্র করে না।  লর্ড কার্জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা মিউনিসিপালিটির স্বয়ত্বশাসন হরন করেন। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য একশো একটা ইস্যু ছিল কংগ্রেসের হাতে। ্বঙ্গভঙ্গটাকে ইস্যু করা উচিতই হয় নি।

আমাদের যে ইতিহাস পড়ানো হয় তাতে বলা হয় বৃটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রদ করেন (১৯১১) । কিন্ত  ১৯১১ সালে ,  পূর্ব বাংলা - পশ্চিম বাংলা এক করা হলেও, বিহার এবং উড়িশ্যাকে বাংলা প্রভিন্স থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।  ১৯১১ সালে যে নতুন বাংলা প্রভিন্স তৈরী হল, তাতে মুসলমানরা প্রায় ২ ঃ ১ সংখ্যাগুরু।  ফলে  ১৯৩৭ সালে যখন ইন্ডিয়া এক্টের বদৌলতে বাংলা বিধানসভা ( স্টেট লেজিসলেটিভ), তৈরী হয়, তাতে প্রায় সব মন্ত্রীই মুসলমান ছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আটকানোর ফল এটাই , পরে যখন স্বয়ত্ব শাসন দেওয়া শুরু করে বৃটিশেরা- বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে যায় মুসলমানদের হাতে।  ১৯৪৫-৪৬ সালে কলকাতা সহ গোটা বাংলায় দাঙ্গার এটাই সব থেকে বড় কারন।

ইতিহাস নির্মম এবং সুস্পষ্ট। কংগ্রেস মুসলিমদের দাবি দাওয়া, আশা আকাঙ্খা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে নি।  দ্বিজাতি তত্ত্বে সিলমোহর মেরেছে নিজেদের অজান্তে।

                                      (৩)

মহত্মা গান্ধী ভারতে এলেন ১৯১৫ সালে। কংগ্রেস তখন নরম পন্থী এবং চরমপন্থীদের কলহে দীর্ন। সর্বজন গ্রহনযোগ্য নেতা নেই।  রাজনীতির কোন দিশা নেই। জনবিচ্ছিন্ন।   এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস টেকাতে দরকার ছিল -নতুন ধরনের রাজনীতি এবং নতুন ধরনের নেতৃত্ব- যা চরমপন্থী এবং নরমপন্থীদের হাতাহাতি থেকে কংগ্রেসকে মুক্ত করে, আবার দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এপিসেন্টারে নিয়ে আসবে। ফলে "গান্ধী" র মতন একজন মধ্যমমেধার এবসার্ডলি আইডিয়ালিস্ট ব্যক্তিত্বকে বিড়াল থেকে বাঘ বানালো কংগ্রেস।  যে রাজনৈতিক মঞ্চে এই মেটামরফসিস ( গান্ধীর রাজনৈতিক উত্থান)  সমাধা হয়-তা বিহারের চম্পারন সত্যাগ্রহ (১৯১৭)।

চম্পারন সত্যাগ্রহ সম্মন্ধে স্কুলে কি পড়ানো হয় আমাদের ?
পশ্চিম বঙ্গের ক্লাস টেনের পাঠ্য বইতে যা  আছে,সেটা তুলে দিচ্ছি। তারপরে,  গভীরে গিয়ে দেখব, কিভাবে ইতিহাসে, রাজনীতিতে বিড়ালকে বাঘ বানানো হয়!

////////

চম্পারণ সত্যাগ্রহ [Champaran Satyagraha]: ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সদ্যসমাপ্ত সফল সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতে ফেরেন । তিনি প্রথমেই ব্রিটিশ সরকারকে ভাড়াটে শ্রমিক আইন রদ করতে অনুরোধ করেন । এই আইন বলে ভারত থেকে ঠিকা শ্রমিকদের দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানো হত । তিনি ঘোষণা করেন ভাড়াটে শ্রমিক আইন প্রত্যাহৃত না হলে তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করবেন । সরকার গান্ধিজির দাবি মেনে নিলে গান্ধিজি নিবৃত্ত হন । এভাবে তাঁর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রথম প্রয়াস জয়যুক্ত হয় । এরপর তিনি উত্তর বিহারের চম্পারণের কৃষকদের দুঃখ দুর্দশা দূর করার জন্য ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান । সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি সেখানকার নীল চাষীদের দুঃখ দুর্দশা ও অসন্তোষের কথা শোনেন । বিহারের চম্পারণে 'তিন কাঠিয়া প্রথা' অনুসারে নীলকর সাহেবরা কৃষকের জমির ৩/২০ ভাগ বা বিঘাপ্রতি তিন কাঠাতে নীল চাষ করতে বাধ্য করত ।  চম্পারণের কৃষকদের দুঃখ দুর্দশার অবসানকল্পে ও ব্রিটিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে গান্ধিজি চম্পারণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন । গান্ধিজির অসাধারণ দৃঢ়তার ফলে—
(১) সরকার নীল চাষীদের ওপর সর্বপ্রকার জুলুম বন্ধ করতে বাধ্য হন ।
(২) চম্পারণের কৃষকদের অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকার চম্পারণে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করতে বাধ্য হন ।
(৩) গান্ধিজি এই কমিটির সদস্য হন ।
(৪) তিন কাঠিয়া প্রথা তুলে দেওয়া হয় ।
(৫) বর্ধিত খাজনার ২০%-২৫% হ্রাস করা হয় ।
(৬) নীলকর সাহেবরা চম্পারণ ছেড়ে চলে যায় ।
এ সময় বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, জে.বি. কৃপালনী, এ.এন.সিংহ, ব্রজকিশোর প্রমুখ নেতৃবর্গ গান্ধিজির সঙ্গী হয়েছিলেন ।
এই বছর তিনি অনশন ও সত্যাগ্রহ করে আমেদাবাদের মিল মালিক এবং শ্রমিকদের বিরোধের নিষ্পত্তি করেন ।  তিনি 'মজুর মহাজন সভা' গঠন করে আন্দোলনের দ্বারা শ্রমিকদের দিনে ৮ ঘন্টা কাজের সীমা ধার্য করেন ।  
// /////////////////////////
  আমার ধারনা, আমার পাঠকদের ৯৯% , চম্পারন সত্যাগ্রহ নিয়ে এই টুকুই জানেন, যা ওপরে তুলে দিলাম। পুরো অমিতাভ বচ্চনের অন্ধাকানুন!  মালিক গুন্ডাদের হাতে চাবাগানের শ্রমিকরা শোষিত অত্যাচারিত- হঠাৎ করে ত্রাতা হিসাবে অমিতাভের উদয়!

  বিহারের চম্পারন জেলায় , নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে চাষীদের বিদ্রোহ বহুদিনের পুরাতন। ১৮৬৮ সালে চাষীরা সেখানে বিদ্রোহ করে নীলের চাষের বিরুদ্ধে।  বৃটিশ আইনের সুযোগ নিয়েই সেবার চাষীদের রক্ষা করেছিল, স্থানীয় আইনজীবিরা। ফলে ১৮৭৭ সালে বিহারের প্ল্যাণ্টার এসোশিয়েশন তৈরী হয়। এবং মোটামুটি যা রফা হয় ( যেমন তিনি কাঠিয়া প্রথা, এক বিঘার তিন কাঠায় নীল চাষ করা ) তাতে চাষী এবং নীলকর উভয়েই ভাল লাভ করতে থাকে। এই ভাবেই চম্পারন অঞ্চলে, নীল চাষকে কেন্দ্রকরে এক সমৃদ্ধ কৃষক শ্রেনীর উদ্ভব হয়।  প্রায় ৯০০,০০০ একর জমিতে নীলের চাষ হত। 
১৮৭৭-১৯০৭ সাল - তিন দশক  চম্পারন সুখেই কাটিয়েছে। যদ্দিন আন্তর্জাতিক বাজারে নীলের দাম ছিল চড়া।  জার্মানীতে রাসায়নিক নীল আবিস্কৃত হলে আন্তর্জাতিক মার্কেটে নীলের চাহিদা নষ্ট হয়।  ফলে নীলকর সাহেবরা তাদের লস, চাষীদের ওপর চালাতে চাইলেন।  চম্পারনের কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। নীলকর সাহেব ব্লমফিল্ডকে হত্যা করে রায়তরা।  এই বিদ্রোহ যথেষ্ট সংগঠিত ।  প্রায় দুশোর ওপর কৃষককে গ্রেফতার করা হয়। তাদের ছাড়াতে সমস্ত আইনি সহযোগিতা দেওয়া হত চাঁদা তুলে। "গান্ধী" আসার অনেক আগেই ( প্রায় দশ বছর)  চম্পারনের কৃষকরা  সহিংস অসহযোগ হাতে করে দেখিয়েছে।  নীলকরদের অন্যায় দাবী তারা মানেন নি।  এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দুই কৃষক-  শীতল রায় এবং শেখ গুলাব। হিন্দু মুসলমান সব কৃষকই অংশ নিয়েছেন-কারন ইহা বঙ্গভঙ্গের ন্যায় কোলকাতার বাবুদের সৌখিন আন্দোলন ছিল না। এছিল  কৃষকদের বাঁচার লড়াই।  গ্রামে গ্রামে কমিটি গঠন করে সমগ্র আন্দোলনের একটা সেন্ট্রাল কমিটি তৈরী হয়।

  ১৯১০ সালে বৃটিশ সরকার,  চম্পারনের   কৃষকদের দাবী মেনে  এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি  গর্লে সাহেবের নেতৃত্বে একটি কমিশন বসান। কমিশন কৃষকদের দাবী মেনে তিন কাঠিয়া প্রথাকে দু কাঠিয়া প্রথায় নিয়ে আসে। এছাড়াও আরো অনেক রক্ষাকবচ দেওয়া হয় নীলকরদের বিরুদ্ধে।  এসব হয়েছে শীতল রায় এবং শেখ গুলাবের নেতৃত্বে চাষীদের অসহযোগ আন্দোলনের জন্য।  তখনো কংগ্রেস বা গান্ধীর কোন টিকি নেই!

 মুশকিল হচ্ছে আন্তর্জাতিক মার্কেটে নীলের দাম কমতেই থাকে। ফলে গর্লে কমিশন, তিন কাঠিয়া থেকে  সাময়িক স্বস্তি দিলেও, নীলকর সাহেবরা পালটা চাল দিচ্ছিলেন। পুরো লস তোলা সম্ভব না দেখে, তারা আংশিক ভাবে লস মেটানোর জন্য নতুন দুই ধরনের কনট্রাক্ট চালু করেন- তাওয়ান এবং সরাবেশী। এবার কৃষকরা বিদ্রোহ করে এবং বৃটিশ সরকার যে এ সুইনির নেতৃত্বে একটি কমিশন বসান কৃষকদের দাবি দাওয়া অভিযোগ খাতিয়ে দেখতে (১৯১৩-১৭)।  মহত্মা গান্ধী এবং কংগ্রেসের নেতৃত্ব ছাড়া, তারা নিজেরা যথেষ্ট সংগঠিত ভাবেই অসহযোগ আন্দোলন করছিলেন এবং বৃটিশদের দুটি কমিশন বসাতে বাধ্য করেছেন। 
  
 ১৯১২ সালে বিহার, বাংলা থেকে ভেঙে আলাদা প্রদেশ হিসাবে তৈরী হয়। বিহার প্রদেশ কংগ্রেসে, চম্পারনে কৃষক বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত প্রথম শোনান ব্রজ কিশোর প্রসাদ। ১৯১৫ সালে কংগ্রেসের জাতীয়  অধিবেশনে  ( চাপড়া) এই ইস্যু তুল্লেন রাজ কুমার শুক্লা - যিনি নিজেই চম্পারনের একজন কৃষক নেতা।  লখনৌ অধিবেশনে গান্ধীজিকে চম্পারনে আসার আমন্ত্রন জানান শুক্লা। গান্ধী প্রথমেই আসতেই চান নি! পরে রাজী হৌন। 

 চম্পারনের কৃষক আন্দোলন দশ বছরের পরিণত আন্দোলন।  গান্ধীজি চম্পারনে এসে আন্দোলনে নতুন কি করলেন আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি নি!  স্থানীয় কৃষকরা যথেষ্ঠ সংগঠিত ভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালাচ্ছিল  এবং তাদের জন্য বৃটিশরা দুবার কমিশন বসিয়েছে!   গান্ধী বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে যা দাবী আদায় করেছেন, তা এমন কিছু না- যা চম্পারনের কৃষক নেতারা নিজেরা তা পারতেন না। বা তাদের নেতৃত্বের কোন দরকার ছিল!

  কিন্ত কংগ্রেসের দরকার ছিল  ন্যাশানাল স্কেলে চম্পারন কৃষক আন্দলনকে হাইজ্যাক করে, গান্ধীকে  জাতীয় আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে বসানো।  গান্ধী চম্পারনে এসে স্কুল খুললেন, অসস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন, মেয়েদের আন্দোলনে টেনে নিলেন।  এসব গান্ধীকে জাতীয় নেতা বানানোর মাল মশালা। কিন্ত বাস্তবটা কি?
  নীলের যখন দাম ছিল, চম্পারনের কৃষকরা যথেষ্টই সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে এবং চম্পারন জেলায় কৃষকদের শিক্ষার হার ভারতের অন্যান্য  জেলার থেকে ওপরের দিকেই।  চম্পারনের মেয়েরা বহুদিন থেকেই কৃষক বিদ্রোহে শক্ত ঘাঁটি। বাড়ির মেয়েদের সহযোগিতা ছাড়াই দশ বছর ধরে চম্পারনের কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়েছে? 

বেসিক্যালি এই সব স্কুল স্থাপন, অস্পৃশ্যতা বিরোধি আন্দোলন, নারী প্রগতি গান্ধী " স্টোরি লাইনে" যুক্ত করেন। যাতে সমগ্র ভারতের সাংবাদিকরা "বেশ একটা অন্য ধরনের আন্দোলনের " স্বীকৃতি দেয়। কারন শুধু অসহযোগ আন্দোলন এখানে খেত না।   এখানকার কৃষকরা বহুদিন থেকেই অসহযোগ আন্দোলন করছে। সফল ও হয়েছে।  গান্ধীর  রাবার স্টাম্প তাদের দরকার হয় নি। 
 কিন্ত আরো একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার গান্ধীর জীবনীকাররা এড়িয়ে গেছেন। এই চম্পারনে থাকার সময় দলে দলে কৃষকরা তার কাছে আসত। শুধু বসে থাকত গান্ধীর মুখ পানে চেয়ে।  গান্ধী যত না রাজনৈতিক তার থেকে আধ্যাত্মিক আলোচনা করতেন বেশী।  রাজনৈতিক নেতা হিসাবে না, আধ্যাত্মিক মুক্তির গুরু হিসাবেই তাকে দেখেছে চম্পারনের কৃষকরা। যেখানে তিনি এই রাজনৈতিক আন্দোলনকে সবার জন্য আধ্যাত্মিক মুক্তির ( স্যালভেশন ) পথ হিসাবে দেখালেন! 
 রাজনৈতিক নেতা ব্যাপারটা আসলে আপামর ভারতীয়দের কাছে "ওয়েস্টার্ন" কনসেপ্ট। ভারত ধর্মের দেশ। এখানে লোকেরা রাজনৈতিক নেতা না গুরুদেবে বিশ্বাস রাখে বেশী। গান্ধীও সেটাই বুঝলেন। ভারতের সুপ্রীম নেতা হতে গেলে, রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রতিটা ব্যক্তির ধর্মের সাথে, তার স্যালভেশন বা মুক্তির সাথে জুড়তে হবে।
 তিনি সফল হলেন ঠিকই। কিন্ত ভারত ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসাবে ব্যর্থ হল।  চম্পারনের অসহযোগ আন্দোলনকে রাজনৈতিক থেকে আধ্যাত্মিক পথে টেনে দ্বিজাতি তত্ত্বের মালিকদের অক্সিজেন জোগালেন। কারন তিনি আসার আগে কৃষক নেতা শেখ গুলাব এবং শীতল রায় একই সাথে বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছে।  এই প্রতিবাদি রাজনীতির মধ্যে ধর্মের আফিং খাইয়ে, তিনি শেখ গুলাবের ক্ষেত্রটাকে ছোট করে দিলেন!  যে ভুল বুঝতে পেরে তিনি, মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেবেন!  মানে একটা ভুল ঢাকতে আরো বড় ভুল করবেন গান্ধী। 
পরের অধ্যায়ে, তাই সম্পূর্ন ভাবেই গান্ধী নিয়ে আলোচনা করব। 
 কারন চম্পারনের ইতিহাসে পরিস্কার, কৃষক বিদ্রোহ বৃটিশ রাজত্বে আস্তে আস্তে দানা বাঁধছিল। বৃটিশ আইনের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় আইনজীবিরা কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে।  বৃটিশ সরকার  কৃষকদের কথা শুনতে একাধিক কমিশন ও বসিয়েছে।  এসব কিছুই হয়েছে কংগ্রেস এবং গান্ধী ছাড়া। হিন্দু -মুসলমান একসাথে জমিদার-নীলকরদের সাথে লড়েছে।  কোথায় তখন পাকিস্তান বা দ্বিজাতি তত্ত্ব?
কিন্ত এই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে ধর্মের মদ ঢেলে, গান্ধী দেশব্যাপী বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনকে জনপ্রিয় করলেন ঠিকই -কিন্ত একই সাথে পাকিস্তানের পথও চওড়া করে খুলে দিলেন!
  
  










   




  







  
  

  


 



















 

   
 

                                     











1 comment:

মনির said...

Biplab Pal দাদাভাই, "দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং দেশভাগের ইতিহাস" এর বাকি পর্বগুলো পড়া জন্য তর সইছে না দয়াকরে আমার ইমেইলে দেবেন ।